এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • জনাথন লিভিংস্টন সীগাল ( ভাষান্তরিত )

    Ishani
    অন্যান্য | ১৯ জুন ২০১৪ | ৩১৯৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ishani | 116.216.161.144 | ১৯ জুন ২০১৪ ২২:৫৮642070
  • গৌরচন্দ্রিকা
    ...................

    জনাথন লিভিংস্টন সীগাল | এক অন্যরকম কাহিনী | সেই সব মানুষের জন্য , যারা একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে , গভীর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে মনের ভেতরে গোপনে লালন করা স্বপ্নের পিছু পিছু হেঁটে যায় | নিজেরাই সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য তৈরী করে নিজেদের নিয়মকানুন |

    এ কাহিনী এক সীগালের | জনাথন লিভিংস্টন | তার সঙ্গীসাথীরা জীবন বলতে জানে খাবার জোগাড় করা আর দিন গুজরান | উড়ান মানে শুধুই খুঁটে খেতে শেখা | কিন্তু জনাথন ? তার কাছে উড়ান বেঁচে থাকার অন্য নাম | জীবনের অন্য নাম | সেই ভালোবাসা তাকে শেখায় উড়তে উড়তে পৌঁছে যেতে আকাশের এমন এক বিন্দুতে , যেখানে ডানার বিস্তার নিরুচ্চারে ঘোষণা করতে পারে ..স্বপ্নকে স্পর্শ করার কথা |

    জীবনকে এভাবেই স্বপ্ন বুনে বুনে সাজিয়ে নিতে জানতে হয় | সমাজ , পরিস্থিতি , অভ্যস্ত যাপনরীতি যদি সেই স্বপ্নের সঙ্গে দূরপাল্লার দৌড়ে হেরে যায় ..বেশ তো ! সে হবে সত্যিকারের জয় | হাওয়ার উল্টোদিকে , স্রোতের উল্টোদিকে এভাবেই এগিয়ে যেতে শিখে নিতে হয় | স্বপ্নের তাগিদে , নিজের জন্য | এই কাহিনী সেই প্রতীকী উড়ানের | জনাথন লিভিংস্টনের |

    লেখক : রিচার্ড বাখ |

    বড় প্রিয় বই আমার | দীর্ঘদিনের ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছে আজ দিনের আলোয় এল | বাংলা অক্ষরের আলোয় | ভাষান্তরে | তিনটি পর্বে | প্রতি পর্ব তিন অংশে |

    প্রথম পর্ব
    ..............
    ( ১ )
    ভোরের আলো সবে ফুটিফুটি | নতুন সূর্য মুঠিমুঠি চিকচিকে সোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে শান্ত সমুদ্রে | ছোট্ট ছোট্ট ঢেউগুলোর গায়ে |
    তীর থেকে মাইলখানেক দূরে একটা জেলে নৌকো জলের সঙ্গে মিতালি পাতাতে ব্যস্ত | অদৃশ্যে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল প্রাতরাশের টুংটাং মায়াবী আহ্বান | সেই ডাক ভাসতে ভাসতে ঠিক পৌঁছেছে প্রায় হাজার খানের সীগালের কাছে | তারা ঝাঁক বেঁধে হুড়োহুড়ি | টুকরোটাকরা খাবারের লোভে | এভাবেই শুরু হয়ে যায় আরও একটি ব্যস্ত দিন |
    কিন্তু নৌকো আর সমুদ্রতীর থেকে অনেকটা দূরে একেবারে একা নিজের মনে অভ্যেস করে যাচ্ছিল জনাথন লিভিংস্টন সীগাল | আকাশের জমিতে | জল থেকে প্রায় একশ' ফুট উঁচুতে | দু'টি লিপ্তপদ নীচু | চঞ্চু সামান্য ঊর্ধ্বমুখ | সে ডানাজোড়া ছড়িয়ে দিল এক দুরূহ বক্ররেখা বরাবর | আ:, যন্ত্রণা...| এই বক্ররেখা মানে তার উড়ান হবে মন্থর | এখন সে গতি কমিয়ে আনছে ..কমিয়ে আনছে ...আরও ..আরও ...যতক্ষণ না বাতাস তার মুখে আছড়ে পড়ছে ফিসফিসে স্বরের মতো , সাগর তার শরীরের নীচে স্থির , শান্ত | চোখ দু'টি সরু হয়ে এল তীব্র একাগ্রতায় , দৃষ্টি তীক্ষ্ণ | শ্বাস বন্ধ | সমস্ত শক্তি জড়ো করে ..এবার..একবার...আর একটু... আর এক ইঞ্চি বাঁক ... পরমুহূর্তেই তার পালকগুলো অগোছালো | সে গতিহীন | পড়ে গেল !
    এইসব সীগাল ..এদের কক্ষনো অনিশ্চয়তায় ভুগতে নেই , থেমে যেতে নেই বাতাসে | তার মানেই লজ্জা আর অসম্মান !
    কিন্তু জনাথন লিভিংস্টন সীগাল , নির্লজ্জ ! আবারও ডানাজোড়া ছড়িয়ে দিল সে | সেই একই কম্পমান দুরূহ বঙ্কিম রেখায় ... গতি কমছে ..গতি কমছে...আবারও মুখ থুবড়ে পড়া ...| সে তো সাধারণ পাখি নয় !
    অধিকাংশ সীগালই উড়ানের সহজ কিছু নিয়ম ছাড়া খুব বেশি কিছু জানতে শিখতে অনাগ্রহী | তীর থেকে উড়ে এসে খাবারের জোগাড় , আর ক্ষুন্নিবৃত্তি হলে ফিরে যাওয়া | এদের কাছে উড়ান জরুরী নয় | বেঁচে থাকতে গেলে খাবার দরকার ; ব্যস , এইটুকুই | আর এই সীগাল ... এর সবই উল্টো ! পেট ভরানোর জন্য নয় , উড়ানই জীবন | শুধু আকাশ স্পর্শ করার জন্যই বেঁচে থাকা | আর কিচ্ছু নয় | জনাথন লিভিংস্টন সীগাল ..উড়ান তার প্রাণভোমরা |
    অবশ্য জনাথন বোঝে যে এই ধরনের চিন্তাভাবনা অন্য সঙ্গীসাথীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র বাড়ায় না | তার বাপ মায়েরই কি দুশ্চিন্তা কিছু কম? এই যে সারাটা দিন সে একা একা নিজের মনে থাকে , নীচু হয়ে হাওয়ায় ভেসে ওড়ে , নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা অষ্টপ্রহর !
    একটা বিষয় কিন্তু সে লক্ষ্য করেছে | জলের ওপর ডানাজোড়া ছড়িয়ে দিলে মোট যতটা বিস্তৃতি , তার অর্ধেকের চেয়ে কম উচ্চতায় সে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমে বেশি সময় ধরে আকাশে ভেসে থাকতে পারে | যখন জলে পড়ে , তখন সাধারণভাবে ওই পা নীচু , জলে ঝপাং ..ওইভাবে হয় না | তার পা দু'টি আঁটোসাঁটো হয়ে শরীরে সংলগ্ন থাকে আর সে জলতল স্পর্শ করে | রয়ে যায় এক মসৃণ প্রায়-অদৃশ্য জলপথচিহ্ন | যখন সে উড়ে গিয়ে বসে ওই সমুদ্রতটে , বালিতে তার এঁকে রাখা পথের রেখা যাচাই করে তার বাপ মায়ের দুশ্চিন্তাই বাড়ে শুধু |
    মা উৎকন্ঠায় |
    " জন , কেন এমন করিস ? কেন তুই আর সকলের মতো হতে পারিস না ? ওই নীচু উড়ান .. থাক পেলিক্যান আর অ্যালবাট্রসদের জন্য | ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করিস না | শরীরে তো শুধু হাড় আর পালক !"
    " আমি এই হাড় আর পালক নিয়ে দিব্যি আছি মা | আমার শুধু এটাই জানার যে হাওয়ায় ভেসে আমি কী করতে পারি আর কী কী পারি না | ব্যস , এইটুকুই | আর কিচ্ছু নয় |"
    জনাথনের বাবার গলা শোনা গেল এবার | সুর গরম নয় | বরং খানিক নরমই |
    " দ্যাখ জনাথন , শীত আসতে খুব বেশি দেরী নেই আর | এরপর জেলে নৌকোর সংখ্যা কমে আসবে | যে মাছগুলো অল্প জলে থাকে, সেগুলো লুকিয়ে পড়বে গভীরে | যদি কিছু সত্যিই শিখতে হয় , তাহলে শিখে নে কী করে খাবারের জোগাড় করতে হয় | এই উড়ান টুরান এসব ঘোড়ারোগ | প্রথম প্রথম ভালো লাগছে তোর | কিন্তু এ দিয়ে কি পেট ভরবে ? ভুলে যাস না , তোর এই ওড়া আসলে খাবারের খোঁজেই |"
    জনাথন বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল |এরপর কয়েকটা দিন সে খুব চেষ্টা করল অন্য সীগালদের মতো হতে | সত্যি সত্যি খুব চেষ্টা করল | চ্যাঁ চ্যাঁ করে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে , জেটিতে আর জেলেনৌকোতে খাবারের টুকরো নিয়ে অন্যদের সঙ্গে মারপিট করে , সাঁ করে জলে ঝাঁপ দিয়ে ভেসে থাকা মাছ আর রুটির টুকরো তুলে নিয়ে... | কিন্তু চেষ্টা করলেই কি আর শেষরক্ষা হয় ?
    এ সব যে তার অর্থহীন লাগে ! এক টুকরো মাছ যুদ্ধ করে জিতে নিয়েছিল সে | কিন্তু ইচ্ছে হল না..খেতে | পেছন পেছন তাড়া করে আসছিল যে বুড়ো সীগাল , আহা..বেচারী ..তার সামনে ইচ্ছে করেই টুপ করে ফেলে দিল মাছের টুকরোটা | ইস , পুরো সময়টা জুড়ে যদি শুধু উড়তে শেখা যেত ! কত কিছুই যে শেখার বাকি রয়ে যায় !
    কাজেই যথাপূর্বং | আবার জনাথন একা | অনেক দূর সমুদ্রে | খিদে , সুখ আর উড়ানের স্বপ্ন নিয়ে |
    আসল কথাটা হল গতি | আর এক সপ্তাহের অনুশীলনে সে গতির বিষয়ে যা যা শিখল , তা যে কোনো দ্রুততম সীগালের চেয়ে ঢের বেশি |
    এক হাজার ফুট ওপরে | যত জোরে পারে ..তত জোরে ডানা ঝাপটানি | জনাথন চোখধাঁধানো ঝাঁপ দিল একটা | সটান ঢেউ বরাবর | আর বুঝেও গেল কেন সীগালগুলো এমন চোখ ঝলসানো ঝাঁপ দেয় না ! ওরা চেষ্টাই করে না কখনও ! মাত্র ছ'সেকেন্ডে তার ওড়ার গতি দাঁড়াল ঘন্টায় সত্তর মাইল ; যে গতিতে সাধারণত ডানাজোড়া ওপরে ঝাপটা দেবার সময়ে ভারসাম্য রাখতে পারে না |
    বারবার এমনটাই ঘটতে থাকে | এমনিতে এত সাবধানী , নিজের শীর্ষ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে চলেছে ; তবু গতি খুব বাড়লে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না | ভারসাম্য হারাচ্ছে |
    এক হাজার ফুট ওপরে ওঠো | পুরো শক্তি জড়ো করে সোজা সামনে এগিয়ে যাও | তারপর একটা ঠেলা দিয়ে ঝাঁকুনি মেরে ডানা ঝাপটে সপাটে সোজা নীচে | আর প্রতিবারই তার বাঁ দিকের ডানা ওপরে তুলে ঝাপটা দিতে গেলেই থমকে যাচ্ছে ! তখন বাঁ দিকে কী ভীষণভাবে পুরো শরীরটা ওলটপালট ! নিজেকে সামলাতে গিয়ে ডান দিকের ডানাটার ঝটপটানি একটু যেই না কমানো , অমনি আগুনের ফুলকির মতো বুনো অবাধ্য ভঙ্গিতে পাক খেতে খেতে ডান দিকে |
    ওই ওপরে ঝাপটানি যখন , ওইটাই কিছুতেই সাবধানে কায়দা করা যাচ্ছে না | দশ বার চেষ্টা করলে দশ বারই ওই ঘন্টায় সত্তর মাইল গতি , একরাশ অগোছালো পালকের দুরন্ত ঘূর্ণি , নিয়ন্ত্রণহীন ; লাট খেতে খেতে সাগরের অনন্ত নীল আর সাদায় |
    সর্বাঙ্গ ভিজে চুপচুপে | অনেক ভেবে মনে হল , এমনও হতে পারে যে ডানাজোড়া ওই গতিতে থাকার সময়ে কোনোভাবে যদি স্থির রাখা যায় ..মানে ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত গতিবেগে ডানা কাঁপবে ; তারপর আর নয় |
    এবার দু'হাজার ফুট ওপরে | আবার চেষ্টা | ঝাঁপ দেবার সময় ওলটপালট | ঠোঁট নীচের দিকে | দুটো ডানাই সম্পূর্ণ ছড়ানো .. আর ওই যে.. যেই না গতিবেগ ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল পেরোল , অমনি ভারসাম্য স্থির | কী ভয়ঙ্কর পরিশ্রম ; কিন্তু এতক্ষণ পর সাফল্যের স্বাদ | দশ সেকেন্ডের মধ্যে এবার ঘন্টা প্রতি গতিবেগ নব্বই মাইল | তাকে আর দেখাই যাচ্ছে না...ঝাপসা অবয়বহীন অস্তিত্ব | সীগালদের উড়ানের এক নতুন বিশ্বরেকর্ড করল আজ | জনাথন !
    কিন্তু জয়ের উল্লাস ? ক্ষণস্থায়ী | যে মুহূর্তে সে হাওয়ায় ভেসে টান দিল ডানাদুটোয় , যেই না বদল করল ডানার কৌণিক পরিমাপ , আবার সেই অনিয়ন্ত্রিত ভীষণ কাণ্ড | আর গতি যে তখন ঘন্টায় নব্বই মাইল ! আহ , জনাথনকে এক প্রতিবর্তী ক্রিয়া আঘাত করল সপাটে | সে উড়ন তুবড়ির মতো ঝলসে গিয়ে যেন ছড়িয়ে গেল আকাশ জুড়ে , বিদীর্ণ হল আর সটান আছড়ে পড়ল নীল জলের সেই ইঁটের মতো কঠিন চবুতরায় |

    (ক্রমশ )
  • Atoz | 161.141.84.164 | ২০ জুন ২০১৪ ০০:০৪642081
  • খুব ভালো লাগছে ঈশানী, আমারও এটা অন্যতম প্রিয় বই। চালিয়ে যান অনুবাদ, খুব ভালো লাগছে।
  • nina | 78.37.233.36 | ২০ জুন ২০১৪ ০৫:১৯642092
  • খুব ভাল লাগছে--
  • | ২০ জুন ২০১৪ ১০:০৭642102
  • খুব সুন্দর সাবলীল। অনুবাদ বলে কোথাও হোঁচট খেতে হচ্ছে না। আত্মীকরণ সম্পূর্ণ।

    একসময়ে খুব প্রিয় ছিল এই বইটা, ব্যাগের মধ্যে, বালিশের পাশে, খেতে বসলে কোলে --- সব স-অ-ব সময় সঙ্গে থাকত। তারপরে কবে যেন বোধহয় মিডনাইটস চিলড্রেন পড়তে শুরু করার সময়ই, প্রথমে টেবিলের একপাশে, তারপর বইয়ের র‌্যাকে তুলে রাখলাম। মাঝেমধ্যে হাতে নিয়ে পাতা উল্টে এক খাবলা এখান থেকে, এক খাবলা ওখান থেকে পড়ে নিতাম। তারপর পড়লাম ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড, আর কখনও এই বইটা হাতে নেওয়া হয় নি।
    আছে এখনও র‌্যাকেই, আমার সাথেই ঘুরে বেড়ায় গুরগাঁও --- পুণে---- কলকাতা-- পুণে। তবে আর হাতে ওঠে না।
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২০ জুন ২০১৪ ১০:২৯642103
  • ( ২ )

    হুঁশ ফিরল যখন , অনেকক্ষণ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে চারদিকে | চাঁদের আলোয় সাগরের জলে পলকা শরীরটা ভাসছিল তার | ডানাজোড়া যেন সীসের মতো ভারী | রাজ্যের ক্লান্তি | কিন্তু সমস্ত শরীরে মনে সেই ক্লান্তির ভার ছাপিয়ে গিয়েছে ব্যর্থতার গ্লানি | আ: , এই গ্লানি যদি এমনটা হত..যে সেই দুর্বহ ভারে তার শরীরটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যেত নাম না জানা নিরুদ্দেশে !
    একটু একটু করে ডুবে যাওয়া...| বুকের গভীরে এক অচেনা শূন্যগর্ভ কন্ঠস্বর | কিচ্ছু করার নেই আমার | আমি সীগাল | আমার নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে | যদি উড়ান শেখার ক্ষমতা থাকত , আমার মাথায় ঢের বেশি বুদ্ধি থাকত | যদি সত্যি দ্রুত ওড়ার কথা থাকত , আমার ডানা দুটো হত ছোট | বাজপাখির যেমন | মাছের বদলে ইঁদুর ধরে খেতাম | বাবা ঠিক বলে | এ সব বোকামি , গোঁয়ার্তুমি আমায় ভুলে যেতে হবে | আমাকে ফিরে যেতে হবে দলের কাছে | খুশি থাকতে হবে | অসহায় সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে |
    কন্ঠস্বর মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে | জনাথন মেনে নিয়েছে | সীগালরা রাতে স্থলভূমির বাসিন্দা | সে প্রতিজ্ঞা করেছে , এই মুহূর্ত থেকে আর পাঁচটা সীগালের মতো হয়ে যাবে | তাতে সবাই খুশিও থাকবে খুব |
    ক্লান্ত শরীরটা অন্ধকার জল থেকে টেনে টেনে সে উড়ে গেল ডাঙার দিকে | এইটুকুই অনেক | কম পরিশ্রমে কম উচ্চতায় উড়ান | যাকে যা মানায় ! এইটুকু শিখেছে সে , এতেই কৃতজ্ঞ |
    কিন্তু...হ্যাঁ , ঠিকই তো | ভুলে যাব আমি কেমন ছিলাম , কেমন থাকতে চেয়েছিলাম | ভুলে যাব যা কিছু নতুন শেখার কথা ভেবেছি | আমি আমার ওই আর পাঁচটা সঙ্গীসাথীর মতোই| ওদের নিয়ম আর স্বভাব যেমন , তেমন করেই উড়ব |
    তাই জনাথন একশ' ফুট উচ্চতা পেরিয়ে এল ব্যথা সহ্য করে | জোরে ঝাপটানি দিল ডানায় | তীরে ফিরতে হবে এইবার |
    এই বেশ ভালো | ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে যাব ..এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরে ভালোই লাগছে | যে অবোধ্য তাগিদ আর অমোঘ আকর্ষণে সে জুটি বাঁধতে চাইত আকাশের সঙ্গে , শিখতে চাইত আকাশ ছোঁয়ার ম্যাজিক ; নিজের সঙ্গে নিজের সেই অবিরাম যুদ্ধ আর নেই | সুতরাং ব্যর্থতার অনুভবও নেই আর | ভালোই লাগছে কিন্তু ; এই সব চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে অন্ধকার শূন্যতা পেরিয়ে তীরে টিমটিম করে জ্বলা ওই আলোর বিন্দুগুলোর দিকে উড়ে যাওয়া |
    অন্ধকার ! ওই শূন্যগর্ভ কন্ঠস্বর তার মাথায় হাতুড়ি পিটছে... সীগাল কখনও অন্ধকারে ওড়ে না |
    জনাথনের মাথা কাজই করছে না যে সতর্কবার্তায় কান দেবে ! বা: বেশ তো ! চাঁদ আর টুকরো টুকরো আলোর ছায়া জলে পড়ে ঝিকমিক ঝিকমিক , আবার সরু রেখায় তারা জল ফুঁড়ে কেমন উঠে আসছে অন্ধকারে | আলোর পথ তৈরী করে | চারিদিক শান্ত | নিস্তব্ধ ...
    বন্ধ কর পাখা | বন্ধ কর উড়ান | অন্ধকারে সীগাল ওড়ে না | যদি তোমার এই অন্ধকারে ওড়ার কথা থাকত , তাহলে দৃষ্টিশক্তি হত পেঁচার মতো | ঘটে বুদ্ধি থাকত অনেক | আর থাকত বাজপাখির মতো ছোট একজোড়া ডানা !
    তারপর ওই রাতে, ওই নিকষ কালো অন্ধকারে জল থেকে একশ' ফুট উঁচুতে উড়তে থাকা জনাথন চোখ বন্ধ করল , চোখ খুলল | তার বেদনা , তার শপথ এক নিমেষেই মিলিয়ে গেল কে জানে কোথায় ! বাজপাখির ছোট ডানা !
    এই তো , উত্তর পাওয়া গেছে ! ইস, আমি একটা বোকার বেহদ্দ | শুধু একজোড়া ছোট ডানা চাই | শুধু আমায় যা করতে হবে , তা হল এই ডানাজোড়াকে যথাসম্ভব গুটিয়ে ছোট করে কেবল প্রান্ত দুটোর ওপর নির্ভর করে উড়ান ! একজোড়া ছোট মাপের ডানা |
    ও ধাঁ করে উঠে গেল সোজা | কালচে সমুদ্রতল থেকে দু'হাজার ফুট ওপরে | এক নিমেষের জন্যও ভাবল না ব্যর্থতা আর মৃত্যুর কথা | জনাথন ডানা দুটোর সামনের দিকটা শক্ত করে গুটিয়ে নিজের শরীরের সঙ্গে সেঁটে নিল | ভেসে রইল শুধু ডানার একেবারে আগার তীক্ষ্ণ আর সরু ফলার মতো অংশ | বাতাসে | তারপর সোজা ঝাঁপ দিল নীচে |
    মাথার ভেতরে ঝড়ো দামাল বাতাস | হা হা করে ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে সজোরে | ঘন্টায় সত্তর মাইল , নব্বই , একশ' কুড়ি ..আরও বাড়ছে গতি | এখন ঘন্টায় একশ' চল্লিশ মাইল | কিন্তু যে কষ্ট আগে সত্তরে হত , তা এখন অত দু:সহ লাগছে না | ডানা দুটোর আগায় সামান্য মোচড় খাইয়ে সে হালকা শরীর নিয়ে উঠে এল সহজে..পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে | ছিটকে গেল ঢেউয়ের মাথায় | চাঁদনি আলোয় ধূসররঙা কামানের গোলার মতোই |
    বাতাসের ঝাপটা থেকে বাঁচতে চোখ দুটো সরু হয়ে এল তার | কী আনন্দ ! ঘন্টায় একশ' চল্লিশ মাইল | এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উড়ান ! যদি দু'হাজারের বদলে পাঁচ হাজার ফুট ওপর থেকে নীচে নেমে আসি সটান , কী জানি তাহলে আরও কত দ্রুত.....
    এক মুহূর্ত আগে করা শপথ গেল ভেসে | দমকা হাওয়ার মুখে উড়ে গেল খড়কুটো যেন | নিজেকে একটুও দোষী মনে হচ্ছে না | প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দোষে | এই সব শপথ সেই সীগালদের জন্যই , যারা সহজ সাধারণ যাপনসুখে বাঁচে | যে নিজের অর্জিত বিদ্যায় আকাশকে চুম্বন করতে জেনেছে ...এই সব ঠুনকো প্রতিশ্রুতি তার জন্য নয় !
    ভোরের আলো ফুটেছে | জনাথনের অনুশীলন শুরু | যথারীতি | পাঁচ হাজার ফুট ওপর থেকে মাছ ধরার নৌকোগুলো যেন নীল জলে ভেসে থাকা বিন্দু | প্রাতরাশের উচ্ছিষ্টলোভী সীগালের ঝাঁক অনেক নীচে...আবছা....বৃত্তাকার ধূলিমেঘ |
    সে এই তো দিব্যি বেঁচে আছে | বিচিত্র পুলকে শরীরে মৃদু কাঁপন | আর এক অনামা গরিমা , ভয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরে | তারপর নিজের কাছে কোনরকম আগাম জানান না দিয়েই সে ডানাজোড়া গুটিয়ে নিল শরীরে , আগের মতোই ছড়িয়ে দিল ডানার পেছনের অংশের ছোট তীক্ষ্ণ ফলা ; তারপর সোজা ঝাঁপ দিল সমুদ্র লক্ষ্য করে | চার হাজার ফুট নামতে তার গতিবেগ ছুঁল প্রান্তিক গতিবেগের মান | বাতাস তখন এক গমগমে শব্দের প্রাচীর যেন | তা পেরিয়ে আরও দ্রুত কিছুতেই এগোনো যায় না |
    এখন ও সোজা নেমে আসছে নীচে | হু হু করে | ঘন্টায় দু'শ চোদ্দ মাইল বেগে | ঢোঁক গিলল জনাথন | একবার যদি ডানাজোড়া খুলে যায় , তাহলে এই গতিবেগে তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে শূন্যে | কত সহস্র , কত লক্ষ টুকরো ! কিন্তু গতি....? গতিই শক্তি , গতিই আনন্দ আর গতিই নিখাদ সৌন্দর্য !
    সে এখন তৈরী নীচে নামতে | আবার | এখন হাজার ফুট ওপরে | দৈত্যের মতো রাগী বাতাস | তার ডানার আগা ঝাপটা মারছে , ঝাপসা দেখাচ্ছে | জেলে নৌকোগুলো আর পাখির ঝাঁক উল্কার গতিতে বেড়ে চলেছে আয়তনে | দৃষ্টিসীমার মধ্যে | সরাসরি |
    থামতেই পারছে না | এমনকি বুঝতেই পারছে না এই দুর্দম গতিতে বাঁক নেবে কেমন করে !
    এখন কোনো কিছুর সঙ্গে মুখোমুখি আঘাত মানেই মৃত্যু |
    আর তাই ও চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল |
    আর তাই সেই সকালে সূর্যোদয়ের ঠিক পরেই জনাথন লিভিংস্টন সীগাল সোজা কামানের গোলার মতো ছিটকে গিয়েছিল আকাশে ..তার সঙ্গীসাথীদের মাঝখান থেকে | সেই মুহূর্তে তার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় দু'শ বারো মাইল | চোখ দু'টি বোজা, হু হু করে... দামাল বাতাস আর সেই বাতাসে সাজিয়ে রাখা একরাশ পালক হয়ে | ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না | অন্তত এইবার | হতাহতের সংখ্যা শূন্য |
    যখন সে ঠোঁটটি তুলে ঊর্ধ্বমুখ ,আকাশে ; তখন তার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় একশ' ষাট মাইল | যখন উড়তে উড়তে উঠতে উঠতে অনেক উঁচুতে পৌঁছে সে গতি কমিয়ে নিয়ে এল ঘন্টায় কুড়ি মাইলে , ছড়িয়ে দিল ক্লান্ত দুটি ডানা ,,অসীম নীলিমায় ...অবশেষে ....তখন চার হাজার ফুট নীচে জেলে নৌকো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাগরের জলে |
    মনপ্রাণ জুড়ে জয়ের সুগন্ধ | প্রান্তিক গতিবেগ ! সীগাল | ঘন্টায় দু' শ চোদ্দ মাইল ! এ তো ভাবাই যায় না | স্বর্ণিম সাফল্য | সীগালদের গোষ্ঠীর ইতিহাসে এই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত এই তো প্রথম ! আর সেই মুহূর্তটিতেই এক নতুন যুগের সূচনা হল জনাথনের জীবনে | অনুশীলনের নির্জন ক্ষেত্রটিতে গিয়ে সে আবার উড়ানসুখে নিবিষ্ট হয়ে গেল | ডানা দু'টি ভাঁজ করে | এবার ঝাঁপ দেবার সময় আট হাজার ফুট উচ্চতা থেকে | এখন নতুন করে আবিষ্কারের সময় ….কী ভাবে বাঁক নিতে হবে |
    ডানার আগার একটিমাত্র পালক এক ইঞ্চির ভগ্নাংশ মাত্রও ঠিকঠাক ঘোরাতে পারলে তা কী দারুণ গতিতে মসৃণ এক বক্রপথ সৃষ্টি করে...ভাবলেও অবাক লাগে | অবশ্য এটা আবিষ্কার করার আগে ও দেখেছিল যে একাধিক পালক ওই গতিবেগে ঘোরালে তা ওকে গোলার মতো ক্রমাগত পাক খাইয়ে দেবে |
    আর তাই..জনাথন পৃথিবীর প্রথম সীগাল যে উড়োজাহাজের যান্ত্রিক নৈপুণ্য আয়ত্ত করেছিল |
    সেদিন আর অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করার মতো সময় ছিল না তার | সে উড়েই চলল , উড়েই চলল | সূর্যাস্ত পার করে | ঘূর্ণিপাকে, ধীর লয়ে ওলটপালট খেতে খেতে , লাট্টুর মতো কখনো , কখনো বা চরকিপাকে |
    যখন জনাথন তার দলের সঙ্গে সমুদ্রতীরে মিলিত হল , তখন পুরোপুরি রাত নেমেছে তখন | কেমন যেন ঘোর লাগা অবস্থা তার | খুব ক্লান্ত | তবুও কী এক অনির্বচনীয় পুলকে সে গোল করে পাক খেতে খেতে নেমে এসেছিল মাটিতে | অদ্ভুত এক নতুন কায়দায় | ভাবছিল , সবাই যখন জানবে আমার এই আবিষ্কারের কথা , এই অলীক উড়ানের গোপন রহস্য.. আনন্দে অধীর হয়ে যাবে নিশ্চিত | আরও কত কিছুই পাওয়ার আছে এক জীবনে ! এই রোজের যাওয়া আসা , জেলে নৌকো থেকে খুদকুঁড়ো আর নিত্য মাধুকরী ..এর বাইরেও তো এক অন্য জীবন আছে ! আমরা নিজেদের উত্তীর্ণ করব অজ্ঞানতার ঘোর তমসা থেকে আকাশ ভরা সোনালি রুপোলি আলোয় | আমরা মেধায় নৈপুণ্যে হয়ে উঠব শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি | আমরা আস্বাদন করতে পারব সেই স্বাধীনতার অমৃতধারা | আমরা শিখে নেব ..এক অনন্ত উড়ান !

    ( ক্রমশ )
  • kiki | 122.79.36.162 | ২০ জুন ২০১৪ ১১:১১642104
  • তৃষা,
    প্রতিবারের মতই..................... অসাধারন!
  • ranjan roy | 24.99.222.232 | ২০ জুন ২০১৪ ২২:৩১642105
  • আমার ছোটমেয়ে প্রথম বইটা পড়তে দেয় সেই দশবছর আগে। এ বইকে ভালো না লাগা বেশ কঠিন।
    আর ঈশানীর অনুবাদ! অসা! চলুক চলুক!
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২১ জুন ২০১৪ ০০:৩৫642106
  • ( ৩ )

    আগামী বছরগুলোয় সোনালি প্রতিশ্রুতি সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে , আর উজ্জ্বল বিভায় ধাঁধিয়ে দিচ্ছে দশ দিক |
    জনাথন যখন আস্তানায় ফিরল , ততক্ষণে বাকিরা সবাই এক জায়গায় জমায়েত হয়ে ..বোঝা গেল ..তার জন্যই অপেক্ষা করছে | অনেকটা ওই পঞ্চায়েতের বিচারসভা বসেছে যেন !
    "জনাথন লিভিংস্টন সীগাল ! তুমি ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াও | " সীগালদের বুড়ো মোড়লের গলায় গমগমে কর্তৃত্বের সুর | এই মাঝখানে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা খুব গোলমেলে | হয় বিরাট সম্মান , নয় ছিছিক্কার | সীগালদের হোমরাচোমরা কেষ্টবিষ্টু কর্তাব্যক্তিরাই এমন মাঝখানে এসে দাঁড়ান | তখন তা বিরাট সম্মানের | জনাথন ভাবলো ...হুম , ব্যাপারটা বোঝা গেছে | ওই যখন আমি ভোরবেলা ওই দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর কাণ্ডটি ঘটিয়েছি , তখন ওই চত্বরে যারা খাবারের খোঁজে গিয়েছিল , তারা আমাকে দেখেছে | আমিও তো চাই, যা আবিষ্কার করেছি..তা সকলকে জানাতে | আমিও ওদের চিনিয়ে দিব এতকালের অধরা ওই প্রায় -অদৃশ্য স্বপ্নের দিগন্তকে | সে সামনে এগিয়ে এল |
    মোড়লবুড়ো গম্ভীর গলায় বলল , " জনাথন লিভিংস্টন সীগাল , একেবারে মাঝখানে এসে দাঁড়াও | যা লজ্জাকর কাণ্ডকারখানা করেছ তুমি , সবাই তোমাকে ভালো করে দেখুক !"
    জনাথনের বুকে যেন ভীষণ জোরে আঘাত করল কেউ | তার হাঁটু কাঁপছে , পালকগুলো আর টানটান নেই ..কেমন ঝুলে গেছে , দু'কানের ভেতরে বোঁ বোঁ শব্দ | ছি ছি করবে সকলে ? তাই তাকে মাঝখানে এসে দাঁড়াতে হবে ? অসম্ভব ! আর ওই যুগান্তকারী আবিষ্কার ? ওরা বুঝতেই পারছে না ! ওরা ভুল, ওরা সব্বাই ভুল !
    ".... ওর এই বেয়াক্কেলে দায়িত্বহীনতার জন্য ," গম্ভীর একঘেয়ে সুরে অভিযোগ চলতে থাকে , " গাল পরিবারের সম্মান ঐতিহ্য সব ধুলোয় মিশে গেছে...."
    এভাবে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সভার মাঝখানে এসে দাঁড়ানোর মানে ওকে একঘরে করে দেওয়া হবে | নি:সঙ্গ একক জীবন | নির্বাসন | ওই দূর পাহাড়চূড়ায় |
    ".....জনাথন লিভিংস্টন সীগাল , একদিন তুমি শিখবে যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য কতখানি মূল্য দিতে হয় | জীবন অজানা , অনিশ্চিত | ইচ্ছে করলেই সবটুকু বুঝে ফেলা যায় না | আমরা পৃথিবীতে এসেছি খেতে , বেঁচে থাকতে ....যত দিন পারা যায় |"
    সীগাল কক্ষনো তার মোড়লের মুখের ওপর কথা বলে না | কিন্তু তবুও আজ গলা তুলল জনাথন |
    " দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ! ভাইসব , একটা গালের থেকে এত দায়িত্ববান আর কে আছে যে জীবনে বেঁচে থাকার আরও বড় আরও অর্থপূর্ণ কারণ খুঁজে বের করতে চাইবে ? হাজার বছর ধরে আমরা মাছের মাথায় ঠোকর মেরে বেঁচে আছি | কিন্তু এখন আমাদের বেঁচে থাকার এক নতুন অর্থ আমি খুঁজে পেয়েছি ...সে এক অন্য সুখ ! তার নাম শিক্ষা , আবিষ্কার , স্বাধীনতা | আমাকে শুধু একটা সুযোগ দাও ..তোমাদের দেখাতে চাই..কী অমূল্য ধন পেয়েছি আমি ...."
    সবাই স্থাণু , পাথরে তৈরী যেন |
    তারপর গমগমে মন্ত্র শোনা গেল | এবং বিচারের রায়ও বটে !
    " নিয়ম ভেঙেছে জনাথন | ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নষ্ট করেছে | "
    সবাই একজোট হয়ে দু'কান বন্ধ করে পেছন ফিরে দাঁড়াল | ওরা জনাথনকে নির্বাসন দিয়েছে |

    সেই দিন বাকি সময়টুকু জনাথন একাই কাটাল | কিন্তু সে পাড়ি দিল পাহাড়চূড়া পেরিয়ে | আরও দীর্ঘ পথ | এই নির্বাসনে তার দু:খ নেই | এই যে অন্য সীগালরা বিশ্বাসই করতে চাইল না উড়ানের মাহাত্ম্য ...এটাই যেন বড় বেশি করে বুকে বেজেছে | ওরা চাইলই না..একটিবার চোখ খুলে নতুনভাবে অন্যভাবে জীবনটাকে দেখতে |

    প্রতিটি দিন এখন নতুন নতুন বিষয় শেখা | সে শিকল যে সোজা নির্দিষ্ট পথে দুরন্ত গতিবেগে ঝাঁপ দিলে দুর্লভ আর সুস্বাদু মাছ শিকার করা যায় ; যে মাছেরা থাকে সমুদ্রের অন্তত দশ ফুট নীচে | তার এখন আর জেলে নৌকোর ওপর বা বাসী পাঁউরুটির টুকরোর ওপর ভরসা করতে হয় না জীবনধারণের জন্য |
    জনাথন শিখে নিয়েছে আকাশের বিছানায় বাতাসের বালিশে ঘুমোতে | রাতে সে তীরের উল্টোমুখে যে হাওয়া বয় , তাতে ভর করে একশ' মাইল পথ পাড়ি দেয় সে | সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত | সেই এক আত্মনিয়ন্ত্রণকে সঙ্গী করে উড়ে যায় ঘন কুয়াশার আস্তরণ ফুঁড়ে ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশে ....সেই সময়ে ..যখন অন্য সব সীগাল স্থলভূমিতে দু'পা শক্ত করে গেঁথে দাঁড়িয়ে | কুয়াশা আর বৃষ্টি ছাড়া যারা কিছুই চেনে না , কিছুই চেনেনি কখনও | সে শিখে নিয়েছে দুরন্ত বাতাস কেটে স্থলভূমিতে কী করে খুঁজে নিতে হয় স্বাদু কীটপতঙ্গ |
    যা কিছু সম্পদ হয়ে থাকবে ভেবেছিল সমস্ত প্রজাতির জন্য , তা এখন তার একার কুবেরের ধন | উড়ান শিখেছে সে | যে মূল্য দিতে হল বিনিময়ে...দু:খ নেই তেমন | জনাথন সীগাল আবিষ্কার করেছে যে একঘেয়েমি , ভয় আর রাগ ...এই তিনের প্রকোপে সীগালদের আয়ু:সীমা কম | আর এই যে এখন এই তিন শত্রু তার চিন্তাভাবনা থেকে নির্মূল , জীবম মধুময় |
    ওরা দু'টিতে এল সন্ধের পর | জনাথন তখন তার প্রিয় আকাশের বুকে শান্তভাবে সাঁতার কেটে চলেছে হাওয়ায় | ভেসে বেড়াচ্চ্ছে মেঘের ভেলার মতো | দু'টি গাল ..ওই দু'টি পাখি তার দু'দিকের ডানা ঘেঁসে ..তারার আলোর মতো ... উজ্জ্বল , অমলিন | তাদের শরীর থেকে উৎসারিত আলো নরম , মায়াবী ...রাতের বাতাসের সঙ্গে যেন অন্তহীন সখ্য তাদের | কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হল তাদের উড়ানশৈলী | তাদের ডানার অগ্রভাগ কী অনায়াস নৈপুণ্যে সব সময় জনাথনের ডানার অগ্রভাগ থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরত্বে |
    কোনো কথা না বলে জনাথন তাদের পরখ করা শুরু করল | এই সেই পরীক্ষা , যাতে কোনো সীগাল কখনও সফল হয়নি | সে নিজের ডানাজোড়া বেঁকিয়ে নিয়ে গতি কমিয়ে দিল ঘন্টায় এক মাইলে | দু'টি উজ্জ্বল পাখিও মসৃণ দক্ষতায় নিজেদের গতি কমিয়ে আনল | ওরা জানে, কী করে কম গতিবেগে উড়তে হয় |
    এবার ডানা দুটো ভাঁজ করল জনাথন | গোল করে মুড়িয়ে নিল | তারপর সাঁ করে সটান ঝাঁপ দিল নীচে | ঘন্টায় একশ' নব্বই মাইল গতিবেগে | ওরাও পিছু পিছু | ত্রুটিহীন দক্ষতায় , একই নকশায় |
    সবশেষে সে ওই একই গতিতে সোজা উঠে গেল ওপরে | দীঘ উল্লম্ব মন্থরগতির ঘূর্ণিপাকে | ওরাও ঠিক তেমনই করে | হাসছে দু'টিতে |
    আবার আগের জায়গায় এসে একটু জিরিয়ে নিল জনাথন | জিজ্ঞেস করল , " বেশ | এবার বল তো বাপু, তোমরা কে ?"
    "আমরাও তোমারই দলের , জনাথন | আমরা তোমার ভাই |" কথাগুলো প্রত্যয়ী , শান্ত | " আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি | আরও ওপরে | তোমার বাড়িতে |"
    " আমার তো কোনো বাড়ি নেই ! আমার কোনো স্বজন নেই | আমি ব্রাত্য | আমরা এখন এই যে মহাপর্বতের চূড়ার বাতাসে উড়ছি , আর কয়েক শ' ফুট হয়ত..এর বেশি উচ্চতা আমার এই জীর্ণ শরীর আর সইতে পারবে না |"

    " কিন্তু তুমি পারবে জনাথন | তুমি তো শিখেছ ! একটা পাঠশালার পাট চুকেছে | এখন সময় অন্য পাঠশালায় যাবার |"
    আর এই চেতনার আলো সারা জীবন জনাথনকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে | সেই বোধ , সেই অনুভব মুহূর্তেই আশ্বস্ত করল জনাথনকে | ওরা ঠিকই বলছে | সে আরও উঁচুতে উড়তে পারবে | আর এখন সময় হল | ঘরে ফেরার |
    জনাথন শেষবারের মতো এক বিলম্বিত দৃষ্টিপাতে আশ্লেষ করল তার আকাশকে | সেই অসীম রুপোলি চারণভূমি , যা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে |
    তারপর বলল , "আমি প্রস্তুত |"
    জনাথন লিভিংস্টন সীগাল দু'টি উজ্জ্বল নক্ষত্রপ্রতিম সীগালকে সঙ্গী করে ডানায় বিদ্যুত এঁকে মিলিয়ে গেল নিখুঁত নিকষ তমসায় আচ্ছন্ন অনন্ত আকাশে |

    ( প্রথম পর্ব সমাপ্ত )
  • pphaltu | 82.37.171.164 | ২১ জুন ২০১৪ ০৩:০০642107
  • আবার বছর কুড়ি পরে...
    আআহঃ ...
  • nina | 78.37.233.36 | ২১ জুন ২০১৪ ০৪:০২642071
  • বহুদিন আগে পড়েছি---দারুণ লাগছে --খুব সুন্দর ভাবে লিখছ---
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২১ জুন ২০১৪ ০৯:৫৯642072
  • যাঁরা এই ধারাবাহিক লেখাটি পড়ছেন , সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা |
  • kiki | 122.79.37.72 | ২১ জুন ২০১৪ ১০:৫৫642073
  • প্রান জুড়োনো লেখা............... তৃষা।
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২১ জুন ২০১৪ ১৬:৪২642074
  • দ্বিতীয় পর্ব
    .....................

    ( ১ )

    এই তাহলে স্বর্গ ! নিজের মনেই হাসল সে | এই উড়তে উড়তে পৌঁছে যাওয়া স্বর্গের সিংহদুয়ারে ..আর ঠিক প্রবেশ করার আগের মুহূর্তে স্বর্গ নিয়ে কাটাছেঁড়া...না : , এটা ঠিক নয় |
    এই যে পৃথিবী ছেড়ে মেঘ পেরিয়ে এই উড়ান , দুই উজ্জ্বল সাথীকে পাশে নিয়ে ... তার নিজের শরীর এখন কেমন ধীরে ধীরে ওদের মতোই দীপ্তিময় হয়ে উঠছে | এ কথা সত্যি , যে সেই অল্পবয়সী জনাথন সীগালের ছায়া কথাও রয়েই গিয়েছিল তার প্রবীণ সোনালি চোখের আয়নায় ; কিন্তু বহিরঙ্গে সে তো অনেকটাই বদলে গেছে !
    এখনও শরীরটাতে সেই সীগালের মতোই অনুভূতি , কিন্তু এই নতুন শরীরে সে উড়তে পেরেছে পুরনো দিনের থেকে অনেকই বেশি ; অনেকই ভালোভাবে | অর্ধেকেরও কম পরিশ্রমে সে এখন পৃথিবীতে থাকাকালীন যা পারত..তার দ্বিগুণ গতিবেগে দ্বিগুণ পারঙ্গমতায় উড়ানে সক্ষম |
    পালকের রাশ এখন ঝকঝকে সাদা | ডানা দুটো মসৃণ, নিখুঁত ...ঠিক যেন চকচকে রুপোর পাত | নতুন খুশিতে সে এই ডানাজোড়াকে ব্যবহার করতে শিখেছে ; এদের মধ্যে শক্তি সঞ্চালন করতে শিখেছে |
    ঘন্টায় দু'শ পঞ্চাশ মাইল | মনে হচ্ছে এই সর্বোচ্চ গতি | দু'শ তিয়াত্তর | এর বেশি গতি বাড়ানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না | খুব আবছা হতাশা ছায়া ফেলল কি কোথাও ? যদিও পৃথিবীতে থাকাকালীন যা গতি ছিল, এ তার তুলনায় অনেকটাই বেশি ; এই সীমা পেরিয়ে আরও এগিয়ে যেতে গেলে যে অনেকটা পরিশ্রম করতে হবে ! নতুন শরীরটা কতটা কী করতে পারবে , তারও তো একটা সীমা আছে ! আসলে..স্বর্গে কোনও কিছুতেই কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা অনুচিত |
    মেঘ ছিঁড়ে গেল | সঙ্গীরা বলল , স্বাগতম জনাথন " |
    শূন্যে মিলিয়ে গেল ওরা |
    এখন নীচে সমুদ্র | এবড়োখেবড়ো তটরেখা দেখা যায় | হাতে গোনা কয়েকটা সীগাল পাহাড়চূড়ায় বাতাসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত | দূরে উত্তরদিকে দিগন্তে আরও কয়েকটি উড়ন্ত পাখি | নতুন দৃশ্য , নতুন ভাবনা , নতুন জিজ্ঞাসা | এত কম গাল কেন ? স্বর্গে তো ঝাঁকে ঝাঁকে থাকার কথা ছিল | আর আমারই বা এত ক্লান্ত লাগছে কেন ? হঠাৎ ? স্বর্গের পাখিদের তো ক্লান্ত হতে নেই , ঘুমিয়ে পড়তে নেই |
    এ কথা কোথায় শুনেছিল সে ? পৃথিবীতে বসবাসের স্মৃতি কেমন আবছা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে | পৃথিবীতে সে অনেক অনেক কিছু শিখেছিল সত্যি ..কিন্তু খুঁটিনাটি সব কিছু কেমন অস্পষ্ট ...সেই যে..কী যেন..খাবার নিয়ে মারামারি..একঘরে হয়ে যাওয়া.....
    তটভূমি থেকে এক দুজন গাল এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে | সবাই চুপটি করে | সে বুঝতে পারছে , এখানে সে স্বাগত আর এই এখন তার নতুন ভুবন | আজকের দিনটা কী ভীষণ অন্যরকম ! এ এক এমনই দিন , যে তার মনেই পড়ছে না সূর্যোদয় হল কখন !
    ও ঘুরে গেল তীরে নামবে বলে | সামান্য কাঁপুনি দিল ডানায় ..বাতাস কেটে ...তারপর হালকা চালে নেমে এসে বসল বালিতে | অন্যরাও নেমে এসেছে | কিন্তু কারো ডানায় কোনো কম্পন নেই | ওরা সবাই কেমন যেন দুলছে বাতাসে , ঝকঝকে ডানাগুলো বিস্তৃত ; তারপর কেমন করে যেন সাজানো পালকের বাঁকটা বদলে নিল ..আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ওদের পা স্পর্শ করল ভূমি | অসামান্য নিয়ন্ত্রণ ! কিন্তু এখিন যে জনাথন বড় ক্লান্ত | চেষ্টা করার জন্য আর সামান্যতম শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই | পারে দাঁড়িয়ে একটিও কথা না বলেই সে ঘুমিয়ে পড়ল |
    এরপরের দিনগুলোতে জনাথন দেখল এই জীবনেও ওই ফেলে আসা জীবনের মতোই উড়ানের ক্ষেত্রে অনেক অনেক কিছু শেখার আছে | কিন্তু একটাই তফাত | এখানে যারা আছে , তাদের সকলের চিন্তাধারা জনাথনেরই মতো | এদের প্রত্যেকের কাছে এই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল নিজের সবচেয়ে ভালোবাসার ক্ষেত্রটিতে শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করা | আর তা....উড়ান ! এরা সবাই খুব সুন্দর | এরা প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা নিবিষ্ট মনে শুধু উড়ানের বিভিন্ন উন্নত মানের কলাকৌশল রপ্ত করে যায় |
    অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে | জনাথনের কিন্তু মনেই পড়েনি ফেলে আসা পৃথিবীতে ফেলে আসা জীবনের কথা | যেখানে তার এতকালের সব স্বজন বান্ধব | সে চোখ বন্ধ করে ছিল | তার বন্ধ চোখের পাতায় লেগে ছিল শুধুই উড়ানের আলো | খাবার খোঁজা , খাবারের জন্য যুদ্ধ ..এ সব থেকে তাকে মুক্তি দিতে ছিল শুধু একজোড়া ডানা | কিন্তু এখন মাঝেমাঝে এক মুহূর্তের জন্য কখনও কখনও কেমন মনে পড়ে যায় !
    একদিন সকালে আসলে তার মনে পড়ে গেল | সেদিন সে তার উপদেষ্টার কাছে শিখছিল ডানাদুটো কী করে চটপট গোটানো যায় | ওরা দুজনেই বিশ্রাম নিচ্ছিল সমুদ্রতটে |
    নীরব জিজ্ঞাসা | এখানকার বাসিন্দারা কেউ চ্যাঁ চ্যাঁ করে হট্টগোল করে না | নি:শব্দেই যত বিনিময় |
    "সবাই কোথায় গেল সুলিভান ? এখানে আমরা আরও অনেকে নেই কেন ? আমি যেখানে থাকতাম , সেখানে তো...."
    সুলিভান মাথা নাড়ল |
    " জানি | হাজার হাজার গাল | তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি জনাথন..যে তুমি ওদের সবার চেয়ে আলাদা | তোমার মতো পাখি লাখে , কোটিতে এক | আমাদের এই আসা ...অনেক সময় পেরিয়ে ..তবেই | আমরা এক জগৎ থেকে অন্য জগতে গেছি ..যে দুই জগতে খুব একটা ফারাক নেই | যা ছেড়ে এসেছি..ভুলে গিয়ে..যেখানে পৌঁছেছি ..পৌঁছে গেছি..ভ্রূক্ষেপ করিনি..কেন , কোথায় ! বেঁচেছি শুধুই মুহূর্তের সুখে | তোমার কোনও ধারণা আছে জনাথন , যে আমরা এমন ক'জন্ম পেরিয়ে এসেছি শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে যে খাওয়া, মারামারি আর গোষ্ঠীতে নেতা হওয়া ছাড়াও জীবনের কাছে আরও অন্য অনেক কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার আছে ? হাজার জন্ম | অযুত জন্ম | তারপর..তারপর আরও একশ' জন্ম কেটে গেছে শুধু এটুকু শিখতে যে চরম উৎকর্ষ বলে কোনও কিছু আছে | এরপরের একশ' জন্ম কেটে গেছে এই বোধটিকে নিজের মধ্যে অনুভব করে , লালন করে তা আয়ত্ত করতে |
    এখনও অবশ্য আমাদের জন্য এই একই নিয়ম | এই জন্মে এই ভুবনে যা শিখব, সেইমতো আমাদের পরের ভুবন | কিছুই যদি না শিখি , পরের ভুবন ঠিক এইটির মতোই | সেই এক সীমাবদ্ধতা , সেই এক দুর্বিষহ ভার নিয়ে বেঁচে থাকা |"
    সুলিভান টানটান করে মেলে দিল তার ডানাজোড়া | বাতাসের দিকে মুখ ফেরালো |
    " কিন্তু জন , তুমি এক জীবনেই এত কিছু আয়ত্ত করেছ যে এই জগতে আসতে তোমাকে আমাদের মতো হাজার জন্ম পেরোতে হয়নি |"
    এক নিমেষেই ওরা আবার আকাশে | উড়ান | অনুশীলন | বিন্দু-ঘূর্ণন ..এই বিন্যাস শৈলী কঠিন | কারণ যে অর্ধে শরীর উল্টোনো অবস্থায় থাকা , তখন চিন্তাও করতে হচ্ছে ওই অস্বস্তিকর অবস্থায় , ডানার বক্রতা উল্টে নিয়ে অনুসরণ করতে হচ্ছে সুলিভানের উড়ান শৈলী , এবং তাও ঠিক সুলিভানের সঙ্গে একই তালে তাল মিলিয়ে |
    বারবার অভ্যাস করাচ্ছে সুলিভান |
    ''এস , আর একবার করো | আর একবার |"
    শেষ পর্যন্ত ..." দিব্যি হয়েছে ! "
    এবার নতুন জিনিস শেখার পালা | উড়ান এমন , যে গতিপথটিকে দেখাবে ঠিক ফাঁসের মতো |

    ( ক্রমশ )
  • nina | 78.37.233.36 | ২১ জুন ২০১৪ ২১:৩২642075
  • তৃষা---দুরন্ত হচ্ছে---লগে রহো তৃষাভাই---
  • kiki | 122.79.39.74 | ২১ জুন ২০১৪ ২২:৫৩642076
  • অসাধারন তৃষা, চুপটি করে পড়ার মত। পড়ে শোরগোল করার মতন নয়।
  • Uma | 34.7.53.228 | ২২ জুন ২০১৪ ০৪:১৭642077
  • এসে গেছি কিকিয়ার পিছু পিছু. কি জ্বালা লিখতে দেয়না ক্যান ?
  • Amit basu | 111.63.115.53 | ২২ জুন ২০১৪ ০৯:৫৯642078
  • সব জায়গাতে যে আপনাকে লিখতে দেবেই , এমন ভাবার কি কারন ?
  • kiki | 122.79.37.145 | ২২ জুন ২০১৪ ১১:০৮642079
  • উমা,
    ঃ)
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২২ জুন ২০১৪ ১১:৫৬642080
  • <( ২ )

    এক সন্ধেবেলা কিছু গাল একসঙ্গে জটলা করছিল বালিতে | নানা চিন্তায় ব্যস্ত সকলে | এদের রাতে ওড়ার পালা নেই | সাহসে ভর করে জনাথন বুড়ো গালের গিয়ে দাঁড়াল | কানাঘুষো চলছে , শিগগিরই নাকি বুড়ো এই জগত থেকে বিদায় নেবে |
    " চিয়াং ..." জনাথনের গলার স্বরে একটু যেন দ্বিধা |
    নরম চোখে বুড়ো সীগাল তাকাল জনাথনের দিকে | " কী খোকা , কিছু বলবে ?" বয়সের প্রকোপে দুর্বল হওয়ার বদলে বুড়োর শরীরে যেন জোর বেড়ে গেছে ! এই ঝাঁকের যে কোনও গালের থেকে সে জোরে ওড়ার হিম্মত রাখে আর এমন সব কলাকৌশল তার হাতের মুঠোয় ; যেগুলো বাকিরা সবে জানতে শুরু করেছে |
    " চিয়াং , এই জগতটা আসলে মোটেই স্বর্গ নয় | তাই না ? "
    চাঁদের আলোয় দেখা গেল বুড়োর ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি |
    " আবারও তুমি শিখছ ..জনাথন সীগাল |"
    " এখান থেকে বেরোলে..মানে এরপর কী আছে ? আমরা কোথায় যাচ্ছি এখান থেকে ? তাহলে কি স্বর্গ বলে কিছুই নেই ?"
    "না , জনাথন | স্বর্গ বলে আদৌ কোনও জায়গাই নেই | স্বর্গ আসলে স্থান নয় , সময় নয় | স্বর্গের অর্থ বা অনুভব হল চরম উৎকর্ষ | "
    এক মুহূর্তের নীরবতা |
    "জনাথন , তুমি তো খুব দ্রুত উড়তে পারো , তাই না ?"
    জনাথন একটু থতমত খেয়ে গেল বটে ; কিন্তু একটু একটু গর্বও হচ্ছিল বুড়ো তাকে লক্ষ্য করেছে বলে |
    '' আমার...মানে গতি জিনিসটা আমি খুব উপভোগ করি |"
    " যে মুহূর্তে তুমি চরম গতিতে পৌঁছতে পারবে , সেই মুহূর্তেই স্বর্গকেও ছুঁতে পারবে জনাথন | আর তার মানে ঘন্টায় হাজার মাইল গতিবেগ নয় , এমনকি দশ লক্ষ মাইলও নয় | আলোর গতি ছুঁলেও নয় |কারণ যা কিছু সংখ্যায় মাপা যায় , তা সীমাবদ্ধ | চরম উৎকর্ষ.... ..সীমাহীন | তার কোনও শেষ থাকে না | চরম গতি মানে সেই শীর্ষবিন্দুটি স্পর্শ করা |"
    একেবারে আচমকাই চিয়াং অদৃশ্য হয়ে গেল | আবার পরক্ষণেই সে পঞ্চাশ ফুট দূরে জলের ধারে | প্রায় চোখের পলকেই | আবার অদৃশ্য , এবং সেই এক মিলিসেকেন্ডেই জনাথনের কাঁধে |
    " বেশ মজা , না ? জনাথন ?"
    জনাথনের চোখে ধাঁধা লেগে যায় | সে ভুলেই যায় স্বর্গের খোঁজ নিতে |
    " কী করে এমনটা পারো তুমি ? কেমন অনুভূতি হয় তোমার ? কত দূর যেতে পারো ?"
    বুড়ো বলল , " তুমি যে কোনও জায়গায় যেতে পারো | যে কোনও সময়ে যেতে পারো ..যেখানে যখন খুশি | আমি যেখানে খুশি গেছি | যখন খুশি | মানে যে সময়ের মধ্যে যেতে চেয়েছি | " তার দৃষ্টি সাগর পেরিয়ে অন্য দিকে |
    " খুব অদ্ভুত ! যে সব গালেরা এই চরম উৎকর্ষকে শুধু কষ্ট করে যেতে হবে ভেবে হেনস্তার চোখে দেখে , তারা ধীরেসুস্থে গেলেও শেষ পর্যন্ত কোনও গন্তব্যেই মানে কোনও শীর্ষবিন্দুতেই কোনও সময়েই পৌঁছতে পারে না | আর যারা চরম সাফল্য অর্জনের কথা মাথায় রেখে যাত্রাপথের চিন্তা গন্তব্যের চিন্তা সময়ের চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে দিয়ে শুধুমাত্র উৎকর্ষকেই স্থির লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে , তারা এক নিমেষেই যে কোনও গন্তব্যে পৌঁছে যায় | জনাথন , মনে রেখো , স্বর্গ কোনও বিশেষ স্থান বা সময় নির্দেশ করে না ..কারণ স্থান , সময় এ সব সত্যি এত অর্থহীন ! স্বর্গ হল....."
    "আমাকে তুমি ঐভাবে উড়তে শেখাবে ?" জনাথন সীগাল উত্তেজনায় কাঁপছে আর এক অজানা অচেনাকে জয় করার জন্য |
    " যদি তুমি শিখতে চাও..অবশ্যই !"
    " চাই তো ! কবে শুরু করব আমরা ?"
    " তুমি চাইলে এখনই |"
    " আমি ঐভাবে উড়ান শিখতে চাই | আমাকে শুধু কী করতে হবে বলে দাও |"
    তার দু'চোখে এক বিচিত্র আলোর ফুলকি ঝিকিয়ে উঠছিল |
    খুব ধীরে ধীরে কথা বলছিল চিয়াং | তার শ্যেনদৃষ্টি তরুণ শিক্ষার্থীর ওপর | " যত জোরে ভেবেছ উড়বে, তত জোরে সত্যি সত্যি উড়তে গেলে তোমাকে আগে জানতে হবে যে তুমি ইতিমধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছ...."
    চিয়াং -এর মতে জনাথনের কৌশল হবে এই কথাটা ভুলে যাওয়া যে সে একটা সীমাবধ্হ শরীরের খাঁচায় বন্দী ; যে শরীরে একজোড়া ডানার বিস্তার বিয়াল্লিশ ইঞ্চি আর যার উড়ান ক্ষমতা একটা লেখচিত্রে এঁকে ফেলা যায় | সাফল্যলাভের আসল ম্যাজিক হল , এই বিশ্বাসে অবিচল থাকা যে তার আসল স্বভাব বেঁচে আছে , মিশে গেছে তার অস্তিত্বে..না -বলা সংখ্যার মতো নিখুঁত আর নির্ভুল , স্থান কালের অবস্থান নির্বিশেষে , যে কোনও জায়গায় , যে কোনও কালাবস্থানে |
    জনাথন এক মনে অভ্যেস করে যায় | দিনের পর দিন | সূর্য ওঠার আগে থেকে মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত | আর এই এত চেষ্টা করেও কিন্তু সে নিজের অবস্থান থেকে এক চুলও এগিয়ে যেতে পারে না |
    চিয়াং অগুনতি বার সেই এক কথা বলে ' " উড়ানে সফল হতে বিশ্বাস লাগে না | উড়ানকে বুঝতে হয় , অনুভব করতে হয় | এটাও কিন্তু ওই আগেরটার মতোই হুবহু এক | কিচ্ছু আলাদা নয় |নাও, এস , আবার চেষ্টা কর... |"
    তারপর একদিন | জনাথন দাঁড়িয়ে সমুদ্রের তীরে | চোখ বন্ধ , চিন্তায় নিবিষ্ট মন | হঠাত আলোর ঝলক ! সে বুঝতে পেরেছে চিয়াং কী বলতে চাইছিল তাকে এতদিন ধরে |
    "সত্যিই তো ! আমি একেবারে ত্রুটিহীন , সীমাবদ্ধতাবিহীন এক পাখি !"
    সে শিউরে উঠল আনন্দে, রোমাঞ্চে |
    চিয়াং বলল , " বুঝেছ তাহলে ! ভালো !"
    তার গলায় জয়ের সুর |
    জনাথন চোখ মেলল | সে দাঁড়িয়ে বুড়ো পাখির সঙ্গে | একেবারে একা | সম্পূর্ণ অন্য এক সমুদ্রতটে | জলের ধার ঘেঁসে গাছের সারি | হলুদ যমজ সূর্য মাথার ওপরে | ঘুরে যাচ্ছে |
    চিয়াং বলল , " যাক শেষ পর্যন্ত বুঝেছ তাহলে ! কিন্তু তোমাকে ওই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আর একটু খাটতে হবে... |"
    জনাথন হতবাক | " আমরা কোথায় ?"
    চারপাশের এই বিচিত্র পরিবেশ ; বুড়োর কিন্তু কোনও হেলদোল নেই | তাচ্ছিল্যের গলায় বলল , " হবে অন্য কোনও গ্রহ | দেখছ না , আকাশ সবুজ আর যমজ সূর্য !"
    জনাথন উল্লাসে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল | সেই পৃথিবী ছেড়ে চলে আসার পর এই প্রথম | " কাজ হয়েছে তার মানে !"
    চিয়াং নির্বিকার | " কাজ তো হতেই হবে জন | স সময়েই ইটা হয়..যখনই তুমি নিশ্চিত জানো ..যে তুমি ঠিক কী করতে চাইছ | এখন তোমার ওই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা ....."

    (ক্রমশ )>
  • kiki | 122.79.37.21 | ২৩ জুন ২০১৪ ১৫:৩২642082
  • আহা! যদি এমনটা সত্যি হত, সীমাবদ্ধতা গুলো ভুলে যাওয়া যেত! ঃ(

    কিন্তু তুমি অস্থির হয়ে পরছো, তোমার এত টাইপের ভুল আমি আগে দেখিনি। যারা ভালো লেখা পড়ে তারা নিশ্চয় পড়ছে তৃষা।তারা সব সময় কমেন্ট করে না। তুমি আরেকটু ধৈর্য্য নাও। রাগ করো না, তোমাকে এ কথা আমার বলা মানায় না, কিন্তু................
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২৩ জুন ২০১৪ ১৬:১০642083
  • তিনটে টাইপের ভুল চোখে পড়ল | "সীমাবদ্ধতা" , "সবসময়ে" আর "এটা" | আর তো দেখতে পেলাম না ! সাধারণত অবশ্য এটাই হয় | নিজের লেখার প্রুফ পাঁচবার দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই...আর ছেপে বেরোলে দেখি ঠিক ছারপোকার বংশ ! খতম হয় না ! সরি কিকি | আর যদিও এটা কোনো এক্সকিউজ নয়, তবু...এই পর্ব খুব দ্রুত লেখা ..কাজের ফাঁকে ফাঁকে | আশা করি পরের বার হবে না এমনটা | :P
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২৩ জুন ২০১৪ ১৬:৩৫642084
  • ( ৩ )

    ওরা যতক্ষণে ফিরল , অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে | অন্য সব গালের সোনালি চোখ জরিপ করছিল জনাথনকে | তাদের দৃষ্টিতে সমীহ | কারণ ওরা তাকে দেখেছে অদৃশ্য হয়ে যেতে... দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় শিকড় গেড়ে থাকার পর |
    সঙ্গীদের অভিনন্দন মিনিটখানেকেরও কম সময় ধরে উপভোগ করে জনাথন বলল , " আমি এখানে নতুন | সবে তো শুরু করেছি | আমাকে তোমাদের সবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে |"
    কাছেই দাঁড়িয়েছিল সুলিভান | সে বলে উঠল , " সেটা নিয়ে কী বলি বল তো তোমায় ! তোমার শিখে নেবার সাহস , মানে কোনো কিছু শিখতে গেলে যে ভয়টাকে জয় করে নিতে হয় ..তা আমার দেখা যে কোনো গালের থেকে বেশি | গত দশ হাজার বছরের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে !" পুরো ঝাঁক চুপ | আর জনাথন অপ্রস্তুত হয়ে উশখুশ | চিয়াং বলল , " সময়ের ব্যাপারটা নিয়ে…তুমি যদি চাও , আমরা লেগে পড়তে পারি ; যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি উড়ানের সাহায্যে অতীত আর ভবিষ্যৎ স্পর্শ করতে পারো | তারপরই তুমি প্রস্তুত হবে সবচেয়ে কঠিন , সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর সবচেয়ে মজার কাজ শুরু করার জন্য | তুমি নিজেকে তৈরী করে নিতে শুরু করবে আরও উঁচুতে ওঠার জন্য ; মমতা আর ভালোবাসার অর্থ উপলব্ধি করার জন্য | "
    কেটে গেল একটি মাস | কিংবা হয়ত এক মাস নয় ...মনে হচ্ছে এক মাস | অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে শিক্ষালাভ করছে জনাথন | সে সবসময়েই একেবারে সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে অনায়াসে অনেক কিছুই শিখে নিয়েছে খুব দ্রুত | আর এখন বুড়োর বিশেষ প্রিয় ছাত্র হিসেবে সে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনায় সমৃদ্ধ হচ্ছে , যেন পালকে ঢাকা একমুখী তপস্যায় অবিচল একটি যন্ত্র |
    কিন্তু এরপরই সেই দিনটি এল ..যেদিন চিয়াং অদৃশ্য হয়ে গেল | সে সকলের সঙ্গে ধীর গলায় কথা বলছিল | উপদেশ দিচ্ছিল , উজ্জীবিত করছিল যাতে শিক্ষা আর অনুশীলনে কোনো বিরতি না আসে | যেন সমস্ত জীবনের সেই সর্বশ্রেষ্ঠ অদৃশ্য বীজমন্ত্রটিকে সমগ্র চেতনা দিয়ে অনুভবে কোনো খামতি না থাকে | আর যখন সে এইসব কথা বলে যাচ্ছে ...তার পালকগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ..আরও..আরও...আর শেষ পর্যন্ত এমন চোখ ঝলসানো , যে কোনও গাল আর তার দিকে তাকিয়ে দেখতেই পারছে না |
    " জনাথন , ভালোবাসা বুকে নিয়ে কাজ করে যাও |"
    এইটুকুই তার শেষ কথা |
    যখন সকলে এরপর চোখ মেলে তাকাল , চিয়াং চলে গেছে |
    দিন কাটছে | জনাথন খেয়াল করল যে মাঝে মাঝেই তার সেই ফেলে আসা পৃথিবীর কথা মনে পড়ছে | এখানে এই জীবনে সে যা শিখছে..যদি তার দশ ভাগের বা একশ' ভাগের একভাগও সে ওখানে থাকতে শিখত , তাহলে জীবন কত অন্যরকম হত ! এখানে বালির ওপর দাঁড়িয়ে জনাথন ভাবে , এখন ওখানে এমন কোনো গাল আছে কি , যে একইভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে , যার কাছে উড়ানের অর্থ নৌকো থেকে উচ্ছিষ্ট রুটির টুকরো খেয়ে বেঁচে থাকা নয় ..উড়ান এ সব তুচ্ছ দৈনন্দিনতার বাইরে অনেক বেশি কিছু | হয়ত দলের সকলের মুখের ওপর এই সব সত্যি কথা বলার অপরাধে আর কেউ কেউ তারই মতো বহিষ্কৃত হয়েছে |
    আর যতই জনাথন মনে মনে মমতা নিয়ে অনুশীলন করছে , ভালোবাসার প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে ...ততই মন চাইছে পৃথিবীতে ফিরে যেতে | কারণ , তার নি:সঙ্গ অতীত সত্ত্বেও জনাথন সীগাল এক জাত- শিক্ষক , আর তার কাছে ভালোবাসা বিলিয়ে দেবার পন্থাটি হল অন্য কোনো গাল যদি সত্যদর্শনে ইচ্ছুক হয় , তার সামনে সেই পথটি উন্মুক্ত করে দেওয়া | সেই সত্যকে চিনে নিতে সহায়তা করা |
    সুলিভান এখন চিন্তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ানে দক্ষ | সে অন্যদের সাহায্য করছে | সুলিভান একটু চিন্তিত |
    " জন , তুমি একবার একঘরে হয়েছিলে | তুমি কী করে ভাবছ যে তোমার সে পুরনো দিনের সাথী অন্য কোনও গাল এখন তোমার কথায় কান দেবে ?সেই প্রবাদটা শুনেছ তো ? 'সবচেয়ে উঁচুতে ওড়ে যে, সবচেয়ে দূরেও দেখে সে |' যেখান থেকে তুমি এসেছ , সেখানকার গালেরা মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকত | নিজেদের মধ্যে হইচই , ঝগড়া, মারপিট | তারা স্বর্গ থেকে হাজার মাইল দূরে ..আর তুমি তাদের সেখান থেকে..ওই দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থেকে স্বর্গ চেনাতে চাইছ ? জন , ওরা নিজেদের ডানার প্রান্তটুকুও চোখ মেলে দেখতে শেখেনি ! এখানে থাকো তুমি | নতুন গাল ,যারা আসছে..তাদের শেখানোর দায়িত্ব নাও | তাদের..যারা ..তুমি যা বলতে চাইছ , শেখাতে চাইছ..অন্তত এতটাই উঁচুতে আছে , যে তোমার কথা উপলব্ধি করতে পারবে |" একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা বলল সুলিভান | " ভেবে দেখো তো , চিয়াং যদি তার পুরনো পৃথিবীতে ফিরে যেত , তাহলে আজ তুমি কোথায় থাকতে ?"
    এই শেষ কথাটি ঠিক কথা | আর সুলিভান ঠিকই বলেছে |'সবচেয়ে উঁচুতে ওড়ে যে, সবচেয়ে দূরেও দেখে সে |’
    জনাথন থেকে গেল | সে নতুন আসা পাখিদের শেখানোর কাজ নিয়েছে ; যারা সকলেই খুব বুদ্ধি ধরে আর খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে | কিন্তু ওই পুরনো অনুভব ফিরে আসে আবার | হতেও তো পারে , ওই আগের পৃথিবীতে একটা দুটো গাল আছে..যারাও এমনটাই শিখে নিতে পারত | সে নিজে যেদিন নির্বাসিত হয়েছিল , যদি সেই দিনই তার সঙ্গে চিয়াং-এর দেখা হত , তাহলে আজ সে আরও কত কিছুই না জানতে পারত !
    শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটল তার |" সুলি , আমাকে ফিরে যেতেই হবে | তোমার ছাত্ররা ভালোই করছে |ওরাই তোমাকে সাহায্য করবে নতুনদের তৈরী করে নিতে |"
    দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলিভান | কিন্তু তর্ক করল না | শুধু বলল , " তোমার কথা খুব মনে পড়বে জনাথন |"
    জনাথনের গলায় তিরস্কার |" ছি সুলি , এসব ছাড় তো ! বোকার মতো কথা যত ! আমরা রোজ কী অভ্যেস করছি ? আমাদের বন্ধুত্ব যদি স্থানকালনির্ভরই হত , তাহলে তো যেদিন আমরা স্থান আর কালের সীমারেখা অতিক্রম করব , সেদিনই আমাদের সম্পর্কের ইতি ! কিন্তু...স্থানের সীমা পেরিয়ে গেলে...পড়ে থাকে শুধু ... 'এইখান'টির বোধ | কাল বা সময় পেরিয়ে যাই যখন ... রয়ে যায় শুধু..এই মুহূর্ত | এই 'এখন'-এর অনুভব | এই 'এখানে ' আর 'এখন ' ..এর মাঝখানে সত্যিই কি তোমার মন বলে না, যে আমাদের এক আধবার নিশ্চয়ই দেখা হবে ?"
    এত মন খারাপেও হেসে ফেলল সুলিভান | নরম গলায় বলল , " পাগল পাখি একটা ! মাটিতে আটকে থাকা মনের একটি পাখিকেও যদি কেউ হাজার মাইল চেনাতে পারে , তার নাম জনাথন লিভিংস্টন সীগাল | জন , বন্ধু আমার ...বিদায় !"
    " বিদায় সুলি | আবার দেখা হবে |"
    এই কথা বলে জনাথন মনে মনে ভেবে নিল সেই পুরনো পৃথিবীর বিশাল সীগাল ঝাঁকটির কথা | অন্য কালতটে দাঁড়িয়ে থাকা | আর সহজাত অভ্যাসে সে জানে যে সে হাড় আর পালকসর্বস্ব নয় , সে আসলে স্বাধীনতা আর উড়ানসুখের এক পরম কাঙ্ক্ষিত অনুভব | যা কোনও কিছুতেই সীমায়িত নয় |

    * * *

    ফ্লেচার লিন্ড সীগাল এখনও যথেষ্টই ছোট | কিন্তু এটুকু সে দিব্যি বুঝতে পারে যে আর কোনও পাখির সঙ্গে তার জাতভাইরা এত নিষ্ঠুর ব্যবহার করে না বা আর কারও প্রতি এত অবিচারও করে না ! মেজাজ গরম হয়ে যায় তার | দূর পাহাড়চূড়ার দিকে উড়ে যেতে যেতে সে ভাবতে থাকে , " এই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ডানা ঝাপটে ঝাপটে উড়ে যাবার বদলে কত কী যে শেখার আছে উড়ান সম্বন্ধে ! উড়ানের আনন্দ এ সবের অনেক ওপরে | সে তো ..সে তো.. একটা সামান্য মশাও উড়ে বেড়ায়| বুড়ো মোড়লের চারপাশে একবার একটু মজা করে গড়ানো পিপের মতো পাক খেয়ে উড়েছি …ব্যস , আমি একঘরে ! ওরা কি অন্ধ ? ওরা কি সত্যি বোঝে না , যে আমরা যেদিন সত্যি সত্যি উড়তে শিখব ..সেদিন তা কত গৌরবের হবে !
    " ওরা কী মনে করল , তাতে আমার ভারী বয়েই গেল ! দেখিয়ে দেব , সত্যিকারের উড়ান কাকে বলে | আমি পুরোপুরি বিদ্রোহী হয়ে যাব ..যদি ওরা তাই চায় , তবে তাই | আর এমন আফসোসের কারণ ঘটাব আমি....."
    তার নিজেরই মাথার ভেতর থেকে খুব মৃদু একটা কন্ঠস্বর ... ভেসে আসে... খুব কোমল....কিন্তু তাও এমন চমকে গেল সে , যে আচমকা বাতাসেই কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ল |
    "ওদের ওপর অকরুণ হয়ো না তুমি , ফ্লেচার সীগাল | তোমাকে নির্বাসন দিয়ে অন্য গালেরা নিজেদেরই কষ্ট দিয়েছে | ওরা একদিন এ কথা ঠিক বুঝবে আর একদিন না একদিন ওরাও...তুমি যা দেখো ..তেমনভাবেই সব দেখতে পাবে | ওদের ক্ষমা করে দাও আর ওদের বোধ জাগ্রত করো |"
    তার ডানদিকের ডানার অগ্রভাগ থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে একটি গাল | এই পৃথিবীর যে কোনও গালের তুলনায় অনেক অনেক বেশি উজ্জ্বল ঝকঝকে সাদা , আকাশে ভেসে যাচ্ছে অনন্য দক্ষতায় , একটি পালকও কাঁপছে না , নড়ছে না ...প্রায় ফ্লেচারের দ্রুততম গতিবেগের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে |
    এক মুহূর্তের জন্য তরুণ পাখিটি এলোমেলো , অবিন্যস্ত |
    " এসব কী হচ্ছে ? আমি কি পাগল হয়ে গেলাম ? মারা গেছি নাকি ? এসব হচ্ছেটা কী ?"
    তার চিন্তার ভুবনে মৃদু শান্ত সেই কন্ঠস্বর উত্তর চেয়ে চলেছে তার কাছে ..." ফ্লেচার লিন্ড সীগাল , তুমি কি উড়তে চাও ?"
    " হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি উড়তে চাই ! "
    " ফ্লেচার লিন্ড সীগাল , তুমি কি এতটাই উড়তে চাও যে সবাইকে ক্ষমা করে দেবে , শিখবে ..শিখবে...আর তারপর একদিন আবার ওদের কাছেই ফিরে আসবে তোমার অনুভব ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে ?"
    এই অলীক অনন্য পারঙ্গম অস্তিত্বর কাছে কি মিথ্যা বলা যায় ! সে ফ্লেচার সীগাল যতই অহঙ্কারী আর আহত হোক না কেন !
    সে মৃদু স্বরে কথা দিল , " আসব |"
    সেই উজ্জ্বল অস্তিত্ব তখন খুব মমতামাখানো গলায় তাকে বলল , " তাহলে...ফ্লেচ ... এস , আমরা আকাশে আপাতত অনুভূমিক স্তরে উড়ান শেখার প্রথম পাঠ শুরু করি...."

    ( দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত )
  • kiki | 122.79.37.11 | ২৩ জুন ২০১৪ ২০:৪২642085
  • :P

    আসলে ধরো আমি যদি একশোটাও ভুল করি, চোখে লাগবে না। কারন সেটা আমি আর আমার কাছে এক্সপেক্টেশন কম, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তৃষা একটা ভুল করলেও চোখে পরে। ভুলটা টাইপো যদিও। কিন্তু সাধারনতঃ তোমার তাও হয় না কিনা। ঃ)
  • nina | 22.149.39.84 | ২৩ জুন ২০১৪ ২২:৪২642086
  • কি সুন্দর উড়ছি --
    কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা--মনে মনে---
    চলুক চলুক--
  • Uma | 34.7.53.228 | ২৪ জুন ২০১৪ ০২:৩১642087
  • লিখতে অসুবিধে হচ্ছে তবে তোমার লেখার টানে ঠিকই আসব । ভালই হয়েছে এখানে সব পর্বগুলো একসাথে পাচ্ছি । কি করে এত ভালো লেখ কেজানে । দারুন শক্ত এত নামকরা ক্লাসিকের অনুবাদ ।
  • | 60.82.180.165 | ২৪ জুন ২০১৪ ০৩:২০642088
  • সেই কবে পড়ে আসা বই।আবার ফিরে দেখা।
    অনুবাদেও খুব ভালো লাগছে। সাবলীল।
  • joldip | 134.125.50.16 | ২৪ জুন ২০১৪ ১৫:০৪642089
  • ভালো লাগল তৃষা। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়লাম সবটা একসাথে।

    এবার নিশ্চয় শেষ পর্বগুলি দেবে?
  • Ishani | 116.216.161.144 | ২৪ জুন ২০১৪ ১৫:২৩642090
  • তৃতীয় পর্ব
    ...................

    ( ১ )

    দূরের ওই পাহাড়চূড়ার ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছিল জনাথন | নজর রাখছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে | এই চোয়াড়ে ছোকরা ফ্লেচার গাল উড়ানের পাঠশালায় প্রায় নিখুঁত ছাত্র | শক্তিশালী , হালকা ওজন আর বাতাস কাটতে পারে দ্রুত | কিন্তু সবচেয়ে জরুরী যে গুণটি আছে , তা হল উড়ান শেখার তীব্র আর অদম্য আকাঙ্ক্ষা |
    এই তো এক্ষুনি ও এখানে | অস্পষ্ট ধূসর একটা ছায়া ছায়া আকার | পাঠশালার পোড়ো তার গুরুমশাইকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল হুশ করে..ঘন্টায় একশ' পঞ্চাশ মাইল গতিবেগে | আচমকা ডানায় টান দিল একটা , ষোলো পয়েন্ট উল্লম্ব ধীরগতির ঘূর্ণনের জন্য ...পয়েন্টের হিসেব করছে আবার গুনে গুনে |
    ".... আট ..নয়...দশ...দেখো.. জনাথন ..আমি.. বাতাসের.. গতিবেগ.. ছাড়িয়ে ...এগারো...আমার..নিখুঁত..পরিষ্কার ..স্পষ্ট..থেমে যাবার বিদ্যে ... জানতে হবে..তোমার মতো ...বারো ...কিন্তু..দূর ছাই..আমি..কেন..যে..কিছুতেই...পারছি না...তেরো...শেষ..এই..তিন ..পয়েন্ট...চো....আঁক !"
    ফ্লেচারের এই সোজা ওপরে উঠে যাওয়া , এক মুহূর্ত থেমে পেছনে সামান্য পিছলে গিয়েই নাক নীচের দিকে রেখে গোঁৎ খেয়ে নেমে আসা হু হু করে ... যেমনটি হবার কথা , তার চেয়ে আরও খারাপ হল কারণ ওই যে..অসাফল্যের জন্য বিরক্তি আর রাগ ! সে পেছনে পড়ল টাল খেয়ে , ওলটপালট খেল , উল্টোমুখে বিশ্রীরকমের পাক খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল | হাঁপাচ্ছে | গুরুমশাইয়ের উড়ানের স্তর থেকে একশ' ফুট নীচে |
    " তুমি আমার জন্য স্রেফ সময় নষ্ট করছ , জনাথন | আমি বোকার বেহদ্দ ! আমি একটা গণ্ডমূর্খ ! চেষ্টার পর চেষ্টা করে যাচ্ছি | দূর , আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না ! "
    জনাথন নীচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল | " ওই অত জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলে কোনোদিনই পারবে না | ফ্লেচার , ওই প্রথম ঝোঁকেই যাবার মুখে তুমি ঘন্টায় চল্লিশ মাইল গতিবেগ হারিয়ে ফেলছ | তোমায় মসৃণ হতে হবে | ঋজু , বলিষ্ঠ ..অথচ মসৃণ ! মনে থাকবে ?"
    জনাথন ঝুপ করে নেমে এল তরুণ গালের ঠিক পাশটিতে | " এস , আমরা এবার একসঙ্গে চেষ্টা করি | নকশা এঁকে ...দু'জোড়া ডানার |আর ওই ওপরে সোজা উঠে যাবার কেরামতির ওপর জোর দাও | মসৃণভাবে, সহজভাবে সটান ঢুকে পড় |"

    তিন মাস ফুরোবার মুখে মুখেই জনাথনের পাঠশালায় আরও ছ'টি শিষ্য | এরা সকলেই নির্বাসিত , তবুও অদম্য কৌতূহল এই উড়ানের আনন্দেই উড়ান বিষয়ে | এ যেন এক নতুন দিগন্ত !
    তবুও কিন্তু এদের জন্য এই চরম উৎকর্ষ অনুশীলন করা অনেক সহজ ..এর পেছনে যৌক্তিকতা বা কারণ খুঁজে ফেরার চেয়ে |
    সাগরতীরে সন্ধেবেলায় জনাথন এদের নানা কথা বলে | " আমরা প্রত্যেকে আসলে একটা ধারণা মাত্র | এক বিশাল গাল | অলৌকিক | সীমাহীন স্বাধীনতার স্বপ্ন | আর নিখুঁত উড়ান আমাদের সেই প্রকৃত স্বভাবের বহিরঙ্গ রূপের প্রকাশের দিকে একটি ধাপ এগিয়ে যাওয়া |যা কিছু আমাদের পথে সীমাবদ্ধতা এনে দেবার চেষ্টা করবে, তাকেই পাশে সরিয়ে রাখতে হবে | তাই এই দ্রুত গতির বা স্বল্প গতির আর উড়ানের অনুশীলন আর বাতাসের সঙ্গে সন্ধি -বিগ্রহের অন্তহীন কলাকৌশল..."
    ...আর তার ছাত্ররা ঘুমে ঢুলছে ...সারাদিনের উড়ানে হা- ক্লান্ত | এই অনুশীলন ওদের মনের মতো ; কারণ আর কিছুই নয়...এর দ্রুতি আর রোমাঞ্চ | আর এই অনুশীলন ওদের প্রত্যেকের মনে প্রতিবারের উড়ানের পর নতুন কিছু শেখার জন্য এক আগ্রাসী খিদের জন্ম দেয় | কিন্তু এদের একজনও এখনও বিশ্বাস করতে পারে না যে এই যে ধ্যানধারণা আর স্বপ্নের উড়ান ...এও বাতাস আর পালকের গতির মতোই বাস্তব | এমনকি ফ্লেচার লিন্ড গালও নয় |
    জনাথন বলে , " তোমাদের সম্পূর্ণ শরীর , মানে এই একটা ডানার প্রান্ত থেকে অন্য ডানার প্রান্ত..আর কিছুই নয় , তোমাদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তার রূপ | যে রূপটি তোমরা চোখে দেখতে পাও | চিন্তাভাবনার শিকল ছিঁড়ে ফেলো ; দেখবে শরীরের শিকল থেকেও মুক্তি পেয়ে গেছ ..." কিন্তু যতই বলুক না কেন , ওদের কানে এসব শোনায় সুন্দর গল্পকথার মতোই | আরও কিছু চাই ওদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে |
    মাসখানেক বাদে জনাথন ঘোষণা করলো সকলে এবার মূল ঝাঁকে ফিরে যাবে |
    হেনরি কেলভিন গাল বলল , " আমরা এখনও প্রস্তুত নই | আমাদের কেউ অভ্যর্থনাও জানাবে না | আমরা ব্রাত্য | যেখানে কেউ আমাদের চায় না , সেখানে উপযাচক হয়ে কী করে যাই আমরা ?"
    জনাথন উত্তর দিল , " আমরা স্বাধীন | যেখানে খুশি যেতে পারি | আমরা ঠিক যেমন..সেভাবেই থাকতে পারি |"
    বালি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল জনাথন | পূর্ব দিকে উড়ান এবার | ওখানেই জনাথনদের স্বজন , বান্ধবদের বাসভূমি |
    জনাথনের ছাত্রদের মধ্যে সামান্য হতাশা মেশানো দু:খ ; কারণ ঝাঁকের নিয়ম হল নির্বাসনে যারা যায় , তারা আর ফেরে না | আর এই নিয়ম গত দশ হাজার বছরেও ভাঙেনি | নিয়ম বলছে... দ্বীপান্তরেই থেকে যাও | জনাথন বলছে..যেতে | আর ইতিমধ্যেই সে জলের ওপর দিয়ে উড়ে গেছে এক মাইল | কাজেই এরা যদি এখন বেশি দেরী করে , তাহলে জনাথনকে একাই শত্রুভাবাপন্ন ঝাঁকের মুখোমুখি হতে হবে |
    ফ্লেচার খানিক আড়ষ্ট গলায় বলল , " আমরা তো আর ঝাঁকের অংশ নই ! কাজেই ওসব নিয়মকানুনও আমাদের জন্য খাটে না | তাই না ? আর যদি মারপিট লেগেই যায় , এখানে না থেকে ওখানে গেলে আমরা বরং খানিক কাজে লাগলেও লাগতে পারি |"
    আর তাই ওরা সকলে সেই সকালবেলায় পশ্চিম দিক থেকে যাত্রা শুরু করল | ওরা আটজন , জোড়া ঘুড়ির নকশায় ..ডানাগুলোর অগ্রভাগ প্রায় একে অপরের সঙ্গে লেগে আছে যেন |সবাই ঘন্টায় একশ' পঁয়ত্রিশ মাইল গতিবেগে উড়ে এসে জড়ো হল নিজেদের পুরনো সমুদ্রতীরে | জনাথন নেতা | ফ্লেচার তার ডানদিকের ডানা মসৃণভাবে ছুঁয়ে আর বাঁদিকে ঠেলেঠুলে হেনরি কেলভিন | আর পুরো দলটা ধীরে ধীরে পাক খেতে খেতে ডানদিক ঘেঁষে ..যেন একটাই পাখি ...একই অনুভূমিক স্তরে ...উল্টে গিয়ে ...আবার সমান...তাদের শরীরে ঝাপটা দিচ্ছে হিমেল বাতাস |
    সীগালদের নিত্যদিনের চেঁচামেচি হুটোপাটি থেমে গেল আচমকা | ঠিক যেন ছুরির মতো দেখাচ্ছে উড়ন্ত ডানার নকশা | পাখিদের আট হাজার চোখ অপলক | একে একে আটটা পাখি পুরো বৃত্তাকারে পাক খেয়ে উঠে গেল ওপরে , তারপর গোটা চত্বরটা গোল হয়ে উড়ে নিথর হয়ে বসল সটান সোজা নেমে এসে..বালিতে | আর এ রকমটা যেন রোজ রোজ হয়েই থাকে..ঠিক সেই ভঙ্গিতেই জনাথন সীগাল তার বক্তব্য শুরু করল উড়ান নিয়ে |
    তার ঠোঁটে সামান্য বাঁকা হাসি | "প্রথমেই যেটা বলব , তোমাদের কিন্তু এখানে আসার পথে উড়ান শুরু করতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল..."
    ঝাঁকের ভেতর দিয়ে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক | এই পাখিগুলোকে তো একঘরে করা হয়েছে ! আর এরা ফিরে এসেছে ? কিন্তু...এমনটা ..এমনটা তো হতে পারে না ! ঝাঁকের সবাই এত হতভম্ব যে ফ্লেচার যে বলেছিল মারপিট লেগে যাবে..সে আশঙ্কা চুলোয় গেছে !
    একটি অপেক্ষাকৃত তরুণ গাল প্রশ্ন করল , " আচ্ছা , ওরা না হয় একঘরে | কিন্তু এমন করে উড়তে শিখল কোথায় ? কী করে ?"
    কমসে কম একটি ঘন্টা লেগে গেল মোড়লের কথা এই হই হট্টগোলের মধ্যে সকলের কানে পৌঁছতে | ওদের পাত্তা দিও না | যে গাল নির্বাসিতদের সঙ্গে কথা বলবে , সে নিজেও একঘরে হবে | যে ওদের তারিফ করবে , ধরে নেওয়া হবে সে দলের নিয়ম ভেঙেছে |
    পরের মুহূর্ত থেকেই পাখিরা সবাই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে | ধূসর পশ্চাদ্দেশ জনাথনের দিকে | কিন্তু কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই তাতে তার | সে তার অনুশীলন শুরু করে দিল ওই তটভূমির ঠিক ওপরে | আকাশে | আর এই প্রথম ছাত্রদের উস্কাতে লাগল তাদের সেরাটা সবার সামনে দেখিয়ে দেবার জন্য |
    আকাশ জুড়ে ভেসে আসে তার তীক্ষ্ণ স্বর | " মার্টিন গাল ! তুমি না বলেছিলে কম গতিবেগে উড়তে জানো ! যতক্ষণ না প্রমাণ দিতে পারছ , কিচ্ছু জানো না তুমি ! উড়ে দেখাও আগে |"

    শান্তশিষ্ট মার্টিন উইলিয়াম সীগাল তার গুরুদেবের শাসনের চোটে ধড়ফড়িয়ে উঠে নিজেকেই তাজ্জব করে দিয়ে কম গতিবেগে ছবির মতোই উড়ান দিল | সে এক জাদু -উড়ান | মৃদুমন্দ বাতাসে সে পালক বেঁকিয়ে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে ভাসিয়ে দিল শূন্যে | একটিবারের জন্যও ডানার কাঁপন ছাড়াই | বালি থেকে মেঘে | আবার মেঘ থেকে বালিতে |
    চার্লস রোল্যান্ড গাল ঝড়ো পাহাড়ী বাতাসে ভর করে উড়ে গেল চব্বিশ হাজার ফুট উঁচুতে | তারপর সটান মন্ত্রবলে নেমে এলো হুশ করে , ঠাণ্ডা হিম হিম বাতাস জড়িয়ে নিয়ে শরীরে , নিজেই অবাক আর খুশি | নিজের কাছে নিজের চ্যালেঞ্জ ...আগামীকাল আরও উঁচুতে উঠতে হবে |

    ফ্লেচার সীগালের আবার ঝোঁক উড়ানের যত বিপজ্জনক কলাকৌশলে | সে নিপুণ দক্ষতায় দেখিয়ে দিল তার ষোলো - পয়েন্ট উল্লম্ব ও ধীরগতির ঘূর্ণিপাক | পরের দিন তার সঙ্গে তিনপাক ডিগবাজি | পালকগুলো ঝকঝকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করছে | আর সমুদ্রতটে তাকে চোরা-চাউনিতে নজর করে যাচ্ছে একের বেশি চোখ |
    ঘন্টায় ঘন্টায় জনাথন ওই সমুদ্রতটে | ছাত্রদের পাশে পাশে | তাদের নমুনা দেখাচ্ছে হাতে কলমে , উপদেশ দিচ্ছে , কড়া শাসন করছে , শিখিয়ে দিচ্ছে | সে ওদের পাশে পাশে উড়ে যাচ্ছে রাতে , মেঘলা আকাশে , এমনকি ঝড়ের তাণ্ডব থাকলেও | এ এক অলীক উড়ান সুখে বাঁচা | আর অন্য সব পাখিরা ? ভীতু ! ওরা সকলে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে | বালিতে |

    (ক্রমশ )
  • nina | 78.37.233.36 | ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:৩১642091
  • জাদু উড়ান --একেবারে জাদু উড়ান--
  • Ishani | 69.92.153.27 | ২৫ জুন ২০১৪ ১৫:৪৫642093
  • ( ২ )

    উড়ানের পাঠ শেষ হলে শিক্ষার্থীরা বালিতে বসে বিশ্রাম করে আর খুব মন দিয়ে জনাথনের কথা শোনে | জনাথনের অবশ্য কিছু অদ্ভুত ভাবনাচিন্তা আছে , যা ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না | কিন্তু কিছু এমন কথাও আছে , যা ওরা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে |
    ধীরে ধীরে দেখা গেল , রাত বাড়লে এই বৃত্তের বাইরে আরও একটা বৃত্ত তৈরী হচ্ছে | কৌতূহলী গাল | যারা রাতের আগন্তুক | ঘন্টার পর ঘন্টা জনাথনের কথা শোনে | কেউ কাউকে দেখা দিতে চেনা দিতে চায় না | ভোরের আলো ফোটার আগেই মিলিয়ে যায় |
    ফিরে আসার এক মাসের মাথায় ওই ঝাঁক থেকে একটা গাল সীমারেখা পেরিয়ে এগিয়ে এল | জানতে চাইল , উড়ানের নিয়ম | এই জানতে চাওয়ার অপরাধে টেরেন্স লোয়েল গাল একঘরে হয়ে গেল | সমাজ তাকে ব্রাত্য করল আর জনাথন পেল তার অষ্টম ছাত্রটিকে |
    পরের রাতে এল কার্ক মেনার্ড গাল ; বালির ওপর দিয়ে ল্যাকপ্যাক করতে করতে | বাঁ দিকের ডানা কষ্ট করে টেনে টেনে | জনাথনের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে | মুমূর্ষু স্বরে বলল , " আমাকে সাহায্য করো | আর কিচ্ছু চাই না আমি..শুধু একটু উড়তে চাই ! "
    জনাথন বলল , " এস তাহলে | আমার সঙ্গে ওঠো মাটি ছেড়ে | আমরা শুরু করি |"
    " তুমি বুঝতেই পারছ না ! আমার ডানা | আমি যে ডানা নাড়াতেই পারি না !"
    "মেনার্ড গাল , তোমার অবাধ স্বাধীনতা আছে একেবারে তোমার নিজের মতো হয়ে ওঠার | এখানে | এখন | আর কিছুই তাতে বাধা হতে পারে না | আশ্চর্য গাল যারা ..যারা সেই মহান পাখি...এ তো তাদেরই নিজস্ব নিয়ম | "
    " তার মানে তুমি বলতে চাইছ , আমি উড়তে পারি ?"
    " আমি শুধু বলছি..তুমি মুক্ত |"
    কী অনায়াসে কী দ্রুত কার্ক মেনার্ড গাল ছড়িয়ে দিল তার ডানাজোড়া .. | উঠে গেল উঁচুতে , অন্ধকার রাতের বাতাসে ভর করে | পাখিদের গোটা মহল্লা জেগে উঠেছে তার উল্লাসধ্বনিতে | পাঁচশ' ফুট ওপর থেকে সে চিৎকার করে বলছে , " আমি উড়তে পারি ! শোনো তোমরা ! আমি উড়তে পারি !"
    সূর্যোদয় হল যখন , প্রায় হাজারখানেক পাখি দাঁড়িয়ে | জনাথনের ছাত্রদের বৃত্তের বাইরে | ওদের কৌতূহলী চোখ মেনার্ডের দিকে | এখন আর কারো মাথাব্যথা নেই ..কে দেখছে বা দেখছে না | ওরা শুনছে | বুঝতে চেষ্টা করছে জনাথন সীগালকে |
    জনাথন খুব সহজ ভাষায় কথা বলে | এই যেমন..গালদের উড়ানের অধিকার আছে | স্বাধীনতা তাদের অস্তিত্বের অংশ , যে প্রতিবন্ধকতাই এই মুক্তির পথে আসুক না কেন , তাকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে রাখতে হবে | তা আচারবিচার, নিয়মকানুন , কুসংস্কার বা অন্য কোনো সীমাবদ্ধতা ..যাই হোক না কেন !
    ঝাঁকের ভেতর থেকে প্রশ্ন ভেসে এল , " ঠেলে সরিয়ে রাখব ? যদি তা গোষ্ঠীর নিয়মরীতিও হয় ?"
    জনাথন উত্তর দিল , " একমাত্র সত্য হল মুক্তির পথ খুঁজে ফেরা | আর অন্য কোনো আইনকানুন নেই |"
    আর একটি কন্ঠস্বর শোনা গেল এবার | " তুমি যেমন করে উড়তে পারো , ভাবছ কী করে যে আমরাও তা পারব ? তুমি আমাদের সবার থেকে আলাদা , তোমার প্রতিভা আছে, তোমার ওপর স্বর্গের আশীর্বাদ আছে ..তুমি অন্যরকম |"
    " তাকিয়ে দেখো তো ! ফ্লেচার , লোয়েল , চার্লস রোল্যান্ড ! এরাও সবাই বিশেষ প্রতিভার অধিকারী , আশীর্বাদধন্য...কী ...তাই তো ? ওরা তোমাদের মতোই | ওরা আমার মতোই | একমাত্র তফাত হল ওরা অনুভব করতে শিখেছে ওরা আসলে ঠিক কী আর তা অনুশীলন করতে শুরু করেছে |"
    জনাথনের সব ছাত্ররা উশখুশ করছিল | শুধু ফ্লেচার ছাড়া | ওরা এতদিন বুঝতেই পারেনি যে এটাই মূল কথা |
    দিনে দিনে ভীড় বাড়ছে | প্রশ্ন করতে , আদর্শ মেনে নিয়ে পুজো করতে , আবার বিদ্রূপ করতেও |

    এক সকালে উঁচু পর্যায়ের গতির কৌশল অভ্যাসের পর ফ্লেচার জনাথনকে বলল , " ওরা বলাবলি করছে যে তুমি যদি সত্যি সেই মহান গালের সন্তান না হও, তাহলে বলতে হবে যে তুমি নিজের সময় থেকে অন্তত হাজার বছর এগিয়ে আছ |"
    জনাথন দীর্ঘশ্বাস ফেলল | ভুল বোঝাবুঝির দাম ! হয় ওরা তোমায় ভগবান ভাববে, নয়তো শয়তান |
    " তোমার কী মনে হয় ফ্লেচ ? আমরা কি আমাদের সময় থেকে অনেকখানি এগিয়ে আছি ?"
    দীর্ঘ নৈ:শব্দ্য | " এই ধরনের উড়ান এখানে চিরকালই ছিল | যে কেউ ইচ্ছে থাকলেই আবিষ্কার করতে পারত | শিখে নিতে পারত | এর সঙ্গে সময়ের কোনও সম্পর্ক নেই | আমরা হয়ত মনের প্রগতির দিক দিয়ে এগিয়ে আছি | সাধারণত অধিকাংশ গাল যেভাবে ওড়ে , সেই তুলনায় |"
    জনাথন উল্টো হয়ে পাক খেতে খেতে বলল , " এটা হক কথা বলেছ বটে ! সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকার চেয়ে এ তবু মন্দের ভালো |"

    ঘটনাটা ঘটল ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় | এক ঝাঁক নতুন ছাত্রদের ফ্লেচার দ্রুত গতির উড়ানের খুঁটিনাটি বিষয় শেখাচ্ছিল | সবে সাত হাজার ফুট উচ্চতা থেকে সটান ঝাঁপ দিয়ে দেখিয়েছে ...এক লম্বা ধূসর রেখা .... তটভূমি থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ওপরে ভেসে থাকা ... তারপর নিজেকে টেনে তুলে নেওয়া খানিক ওপরে | এর মধ্যে সদ্য উড়তে শেখা একটা বাচ্চা পাখি ভাসতে ভাসতে ফ্লেচারের উড়ানপথের ঠিক সামনে ..সে বেচারী মাকে খুঁজছে | এক সেকেণ্ডের এক দশমাংশ সময়ের মধ্যেই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে ফ্লেচার লিন্ড সীগাল বাঁ দিকে ঠাস করে গিয়ে পড়ল ; তখন তার গতিবেগ ঘন্টায় দু'শ' মাইলের বেশি ! কঠিন গ্র্যানাইট পাথরের চূড়ায় সোজা ধাক্কা খেল সে |
    প্রথম ঝোঁকে ফ্লেচারের মনে হল , এই বিরাট পাথরটা আসলে অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করার সিংহদুয়ার | এক ঝলক ভয় , অপ্রত্যাশিত আঘাতজনিত বিহ্বলতা আর দু'চোখে ঘনিয়ে আসা অন্ধকার | কিন্তু তারপরেই সে ভেসে যেতে লাগল এক অচেনা অনামা অন্য আকাশে | ভুলে যাচ্ছে সব কিছু , মনে পড়ছে , আবার ভুলে যাচ্ছে ; ভয় , দু:খ আর ...কী ভীষণ কষ্ট !
    সেই প্রথম যেদিন জনাথন লিভিংস্টন সীগালকে দেখেছিল , সেদিনের মতোই আজও তার কানে ওই বিনবিনে স্বর ভেসে এল |
    " ফ্লেচার , আসল কৌশলটা হল আমরা ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছি | এই পরিকল্পনা অনুযায়ী উঁচু পাথর কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে এখনও খানিক সময় বাকি |"
    "জনাথন !"
    শুকনো গলায় তার শিক্ষক বলল , " …যাকে সবাই বলে সেই মহান গালের সন্তান |"
    " তুমি এখানে কী করছ ? আর পাহাড়ের চূড়া ? আমি তাহলে..আমি তাহলে..মরিনি ?"
    " ও : ফ্লেচ , কী যে বল না ! মাথাটা খাটাও না একটু ! এই যে এখন আমার সঙ্গে কথা বলছ , তার মানে নিশ্চয়ই মরে যাওনি ! তুমি যেটা করতে পেরেছিলে , তা হল ঝট করে তোমার সচেতন অবস্থার মাত্রাটাকে বদলে ফেলতে | এখন তোমার যা পছন্দ | তুমি এই স্তরে থেকে এখানকার যা কিছু শিখে নিতে পারো ...তুমি যে স্তর ছেড়ে এসেছ , তার তুলনায় এটা অনেকটাই উঁচু ; অথবা ফিরে গিয়ে ঝাঁকের বন্ধুদের যেমন শেখাচ্ছিলে..তাও করতে পারো | যত বুড়ো হাবড়া মোড়লগুলো অবশ্য আশা করে বসে আছে কিছু না কিছু কেলেঙ্কারী ঘটেছে ! তুমি নির্ঘাত ওদের মনোবাসনা পূরণ করেছ এতদিনে ! "
    " আমি দলে ফিরে যেতে চাই | সবে ওই নতুন দলের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম |"
    " ঠিক আছে , ফ্লেচার | মনে আছে তো , কী কথা হল সেদিন ? আমাদের শরীর আসলে আমাদের চিন্তাভাবনার আধারটুকু মাত্র ...?"

    ফ্লেচার মাথা ঝাঁকিয়ে টানটান করে দিল ডানাজোড়া | তারপর চোখ খুলে দেখল সে পাহাড়চূড়ার পাদদেশে | সব পাখিরা যেখানে জড়ো হয়েছে , একেবারে তার মাঝখানটিতে | যেই না সে সামান্য নড়াচড়া শুরু করেছে , অমনি ভীড়ের ভেতর থেকে বিরাট চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল |
    " বেঁচে আছে ! মরে গিয়েছিল না ? এই দেখো , ও বেঁচে আছে ! "
    " ওকে ডানা দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিয়েছে , ব্যস ! প্রাণ ফিরে পেয়েছে ! মহান গালের সন্তান !"
    " না | সে নিজেই এ কথা মানে না বলেছে | স্রেফ শয়তান ও ! ভগবান না ছাই ! শয়তান ! আমাদের গোষ্ঠীকে ভেঙে দিতেই এসেছে |"
    চার হাজার গাল ভীড় করে আছে | যা ঘটেছে , তা দেখে তারা ভয় পেয়ে গেছে | আর ওই " শয়তান" "শয়তান" রব তাদের ভেতর দিয়ে শনশন করে বয়ে গেছে সমুদ্রের ঝড়ো বাতাসের তীব্রতায় |চোখগুলো জ্বলজ্বলে , ঠোঁট শানানো , ওরা বৃত্তটা ধীরে ধীরে ছোট করে আনছে এদের ধ্বংস করে দেবে বলে |
    জনাথন জিজ্ঞেস করল , " ফ্লেচার , এখান থেকে আমরা চলে গেলে তুমি খানিক ভরসা পাবে কি ?"
    " যদি যাই... আমি তো তেমন আপত্তির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না..."
    সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল ওরা দাঁড়িয়ে ... দু'জন...আধ মাইল দূরে ..আর আক্রমণকারী পাখিদের তীক্ষ্ণ ঠোঁট বাতাসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে |
    জনাথন খানিক বিভ্রান্ত |
    " আচ্ছা, এমন কেন হয় যে একটা পাখিকে এ কথা বিশ্বাস করাতে জান বেরিয়ে যায় যে সে স্বাধীন , সম্পূর্ণ মুক্ত আর এই সত্য সে নিজের কাছে নিজেই প্রমাণ করতে পারে যদি একটু অনুশীলন করে ? ইটা বোঝা কি এতই কঠিন ?"
    ফ্লেচার তখনও পট পরিবর্তনের ধাক্কায় চোখ পিটপিট করছে |
    " তুমি এক্ষুনি ঠিক কী করলে বল তো ? আমরা এখানে এলাম কীভাবে ?"
    " তুমিই তো বললে ওই ঝাঁকের খপ্পর থেকে বেরোতে চাও !"
    "হ্যাঁ .. কিন্তু তুমি কী করে..."
    " আর সব কিছুর মতোই ফ্লেচার | স্রেফ অভ্যেস ! "

    সকাল হতে না হতে মারকুটে পাখিগুলো নিজেদের পাগলামির কথা বেমালুম ভুলে গেলেও ফ্লেচার কিন্তু ভোলেনি |
    " জনাথন , তোমার মনে আছে , অনেক দিন আগে কী বলেছিলে ? ওই যে..নিজেদের গোষ্ঠীকে ভালোবাসার কথা ..এতটাই ভালোবাসা ..যাতে ফিরে এসে ওদের শেখানো যায় ?"
    " হ্যাঁ "
    " আমার তো মাথাতেই ঢোকে না ..কী করে এই বেয়াড়া মারকুটে পাখিদের বশ করা যায় ! যারা কিনা এক্ষুনি তোমাকে মেরে ফেলার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছে |"
    " ও : , ফ্লেচ , তুমি তো ওই খারাপ গুণটাকে ভালোবাসতে যাচ্ছ না ! তুমি ঘৃণা বা শয়তানী মনোবৃত্তিকে ভালোবাসবে না | তোমাকে অভ্যেস করতে হবে | খুঁজে নিতে হবে সেই আসল গালকে | প্রতিটি পাখির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোকে আর ওদের সাহায্য করতে হবে যাতে নিজেরাও নিজেদের মধ্যে সেই শুভ ছায়াটুকু দেখতে পায় | এইটাই ভালোবাসা | দেখবে , সহজাত স্বত:স্ফুর্ততা একবার আয়ত্ত করতে পারলে কী অপার সুখ !
    " আমার মনে আছে , এক বেয়াড়া ছোকরা ..কী যেন নাম... ফ্লেচার লিন্ড সীগাল... সবে তখন একঘরে হয়েছে সে | ঝাঁকের সঙ্গে মারামারি করতে তৈরী , দরকার হলে মরতেও পিছ পা নয় | নিজের নরক যন্ত্রণার অন্ধকার নিজেই তৈরী করে নেবে বলে ওই দূরের পাহাড়চূড়ায়...আর এখন সে এখানে..নিজের স্বর্গের নন্দনবনে ..পুরো গোষ্ঠীর চেতনা জাগ্রত করতে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত |"
    ফ্লেচার তার গুরুর দিকে তাকাল | এক মুহূর্তের জন্য তার দু'চোখে ভয়ের ছায়া |
    " আমি নেতৃত্ব দেব ? আমি ? এ সব কী বলছ ? তুমি এখানে নেতা , গুরু ..সব | তুমি কোত্থাও যাবে না ! এভাবে যেতেই পারো না ! "
    " ছেড়ে যেতে পারব না ? কেন ? তোমার কি মনে হয় না অন্য কথাও অন্য পাখিদের ঝাঁক , অন্য ফ্লেচাররা অপেক্ষা করে আছে..এই উড়ান শেখার জন্য ? মুক্তির জন্য ? এই একজনের থেকে তাদের প্রয়োজন অনেক বেশি | এই যে ..আমার সামনে.. সে তো আলোর পথে পাড়ি দিয়েই দিয়েছে |
    " আমি ..জন ? আমি নেহাতই সাধারণ এক সীগাল | আর তুমি..."
    " ...আমিই একমাত্র সন্তান..ওই মহান গালের..তাই তো ?"
    জনাথন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাল সমুদ্রের দিকে |
    "তোমার আর আমাকে সত্যিই প্রয়োজন নেই | এবার তোমার নিজেকে নিজের খোঁজার পালা | প্রতিদিন একটু একটু করে | সেই পরম সত্য আর সীমাহীন অস্তিত্বের ফ্লেচার সীগাল | সেই তোমার মনোজগতের গুরু | তোমাকে বুঝতে হবে তাকে , তার উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য নিরন্তর অনুশীলন করে যেতে হবে |"
    এক মুহূর্ত পরেই জনাথনের শরীর কেঁপে উঠল বাতাসে , ঝিকমিক করতে লাগল আর ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হতে থাকল | “আমার সম্বন্ধে ..দেখো..যেন ফালতু গুজব না ছড়ায় ওরা | আমাকে যেন ভগবান বানিয়ে না দেয় | ঠিক আছে , ফ্লেচ ? আমি সীগাল...উড়তে ভালোবাসি ..হয়ত...."
    “জনাথন !"
    '' বেচারী ফ্লেচ...শোনো .. যা দেখছ চোখে , তা বিশ্বাস কোরো না | চোখ শুধু সীমাবদ্ধতাটুকুই চেনায় | মনন দিয়ে বুঝে নিতে শেখো | খুঁজে নিও তুমি কী কী ইতিমধ্যেই জেনে গেছ | তুমি নিজেই প্রকৃত উড়ানের পথ চিনে নিতে পারবে |"
    ঝিকিমিকি বন্ধ হয়ে গেল | জনাথন সীগাল আচমকা সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেল বাতাসে | জাদুমন্ত্রে !
    বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্লেচার গাল নিজেকে টেনে টেনে ভাসিয়ে দিল আকাশে | নতুন একদল শিক্ষার্থী এসেছে | প্রথম পাঠের জন্য উদগ্রীব |
    কষ্ট চেপে রেখে গুরুগম্ভীর গলায় ফ্লেচার বলল , " তোমাদের সবচেয়ে আগে বুঝতে হবে যে সীগাল আর কিছুই নয়...মুক্তির এক সীমাহীন সংজ্ঞা | সেই মহান গালের প্রতিচ্ছবিমাত্র | আর তোমাদের সম্পূর্ণ শরীর..এই এক প্রান্তের ডানা থেকে অন্য প্রান্তের ডানা ..এও আর কিছুই নয় ..তোমাদের নিজস্ব মননের আধার |"
    তরুণ গালেরা তার দিকে তাকিয়ে | চোখে প্রশ্ন | কী যে বলছে ..কে জানে ! এটা তো শুনতে ঠিক উড়ানের নিয়মের মতো লাগছে না !
    দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্লেচার আবার নিজের কথার খেই ধরল | " হুম...আচ্ছা..তাহলে...."
    সে সকলের দিকে তীক্ষ্ণ যাচাই করে নেওয়া চোখে তাকিয়ে বলল , " আট নম্বর স্তর থেকে শুরু করা যাক ! "
    আর এই কথাটুকু বলেই বুঝতে পারল তার বন্ধুও তার মতোই | সত্যি বলতে কী , ফ্লেচারের তুলনায় অনেক বেশিও তো কিছু নয় ! নিজের মননকে অনুভব করাই স্বর্গের স্পর্শসুখ এনে দেয় |
    কোনো সীমা নেই , জনাথন ? সে ভাবছিল | তাহলে সেই সময়ও তো খুব বেশি দূরে নেই যখন আমিও বাতাস বেয়ে আচমকাই তোমার সাগরতটে উপস্থিত হব আর তোমাকে দেখাব...একটা দুটো উড়ানের কলাকৌশল !
    আর..যদিও ফ্লেচার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল ছাত্রদের সামনে ঠিকঠাক গাম্ভীর্য বজায় রাখার , এক নিমেষেই সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল তাদের সকলের অদৃশ্য অন্তরঙ্গ রূপটি | মাত্রই একটি মুহূর্ত ... আর শুধু অপার ভালো লাগাই নয়...নিখাদ ভালোবাসাতেও আচ্ছন্ন হল সে....সত্যিই যে ..সীমা নেই কোনও...জনাথন ! তার ঠোঁটের কোণটি সেজে উঠল হাসির আলোয় | শুরু হল | আবার | অনন্ত শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষায় স্বর্ণিম সেই বিদ্যুৎ-উড়ান |

    ( সমাপ্ত )
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন