এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • অসৈরণ

    sosen
    অন্যান্য | ২৬ অক্টোবর ২০১৪ | ৪২৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sosen | 111.63.234.98 | ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ২১:০৩654283
  • মা ছোটোটাকে কোলে তুলে চুল আঁচড়াচ্ছে। মার নাইটির কাঁধটা মুঠো করে ধরে ছোটোটা চিৎকার করে কাঁদছে। গলার শির ফুলিয়ে। মা আদরের স্বরে ডাকছে, মিঠু, মিঠু, এই তো আমি বাবা। কাঁদে না, আর কাঁদে না। উফ্ফ, এমন ছিঁচকাঁদুনে হয়েছে না এই মেয়েটা! এক মুহূর্ত তিষ্ঠোতে দেয় না শান্তিতে, ছোটোকে কাঁধে ফেলে মা ঘরে ঢুকে গেলো।
    সে কলপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে অনেক উঁচু একটা বালতি, তাতে জল পড়ে বয়ে যাচ্ছে, কল থেকে বালতি ভরে শানের উপর, তারপর শেওলার উপর তারপর কাঁচা নর্দমা দিয়ে অনেক দূর কোথাও। যেতে যেতেই কালো হয়ে যাচ্ছে জলটা, ঘুলিয়ে উঠছে। বালতিতে একটা মগ ভাসছে।
    সে ক্ষীণ স্বরে ডাকতে থাকে, মা, মা। বেশি জোরে না। তাহলেই মুশকিল।
    মা সাড়া দেয় না। তখন সে দু হাত দিয়ে ভরা জলের মগটা তোলে। মাথার ওপরে তুলতে পারে না। প্রথমে একটু জল ফেলে দ্যায়, তার পর গায়ে ঢালার চেষ্টা করে। তার হাত দুটো বড়ই ছোট। বড় হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এদ্দিনে, না কি অন্য কিছু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এসব ভাবনার তুলনায় তার মাথাটিও খুবই ছোট, অত শত ভাবতে পারে না। সাবানের কেস পাশেই রাখা আছে, সাবান মাখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু চোখে না বাবা, সাবধানে মাখতে হয়, নইলে জ্বালা করে। জল, সাবান ইত্যাদি নিয়ে প্রাণপণে সে স্নানটি সমাপ্ত করার চেষ্টা করে। হাতে ফ্যানাও হয়, বেশ খুশি হয়ে সে ফ্যানায় ফুঁ ফুঁ দ্যায়, তাতে রঙিন বুদবুদ ওঠে। গোল গোল রুপোর চুড়ি পরা হাত গালে বুলোয়, পেটে বুলোয়। সাদা ফ্যানা দিয়ে ছবি আঁকে। তারপর সাবানটা হাত থেকে পিছলে পড়ে যায়। কালো শ্যাওলার ওপর। গড়িয়ে যেতে থাকে নর্দমার দিকে।
    আতংকিত হয়ে সে সাবানটা ধরতে যায়, কিন্তু সাবান হাত পিছলে বেরিয়ে যেতে থাকে, আরো আরো দূরে, ফেনা আর শ্যাওলার উপর ঝপাস করে বসে পড়ে সে। কি সব্বোনাশ হল। দু একটা সমাধান মনে আসে, তাড়াতাড়ি চান করে গা মুছে যেন সে কিচ্ছুটি করেনি এমন করে বসে থাকা, কিন্তু কোনোটাই করতে না পেরে সে কাঁদতে থাকে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ। জোরে , আরো জোরে।
    কি হল রে দিশা! মা ছোটোকে থাপড়াতে থাপড়াতে বেরিয়ে এসে প্রথমটায় বলে পড়ে গ্যাছিস নাকি? বেশ হয়েছে, পাঁচ বছরের ধেড়ে মেয়ে হল, এখনো নিজে চানটুকু করতে পারে না, আবার কান্না হচ্ছে। শ্যাওলার পানে কে যেতে বলেছে তোরে? এইসব বলতে বলতে মা এগিয়ে আসছে, আর আতংকের ভারে হাঁপিয়ে ওঠে সে। আর দম টানতে পারে না। হাঁ করে কাঁদে, কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না।
    কাছে এসে মায়ের দেহটা ঝুঁকে পড়ে তার ওপর-দেখি! নিজে নিজে আবার সাবান মাখতে গ্যাছে, ওমা একি! নতুন সাবানটারে নর্দমায় ফেলেছো, হতভাগা, শয়তান মেয়ে একটা! মায়ের একহাতে ছোটো, আরেক হাতে ঠিক ব্যালেন রেখে ধুমাদ্ধুম বসিয়ে দ্যায় তার গাঁট ওঠা, রোগা শিরদাঁড়ার উপরে, তারপর কান ধরে টেনে তোলে। শিগ্গির গায়ে জল ঢাল। এক্খুনি!
    হাঁ হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে সে কিছু বলতে চায়, নাকের জলে চোখের জলে মাখামাখি। -কি বল্লি, ভারি? ঢং পেয়েছো, এতক্ষণ ভারি লাগছিলো না? শিগগির ঢাল। মাথায় ঢাল।
    হাঁপাতে হাঁপাতে সে মগটাকে প্রাণপণে মাথার উপর তুলে জল ঢালে। কচি হাতের শিরা ফুলে ফুলে ওঠে।
    ছোটো মায়ের কোল থেকে মুখে আঙুল পুরে জুলজুলিয়ে দ্যাখে। ওবাড়ির মৌমাসির মা হাঁক দ্যায় এই দিশার মা, তোমার মেয়ে কাঁদে ক্যানো?
    আর বলবেন না মাসিমা, বড়ো মেয়েটা এত শয়তান হয়েছে, নতুন সাবানটাকে নর্দমায় ফেলে দিল। পয়্সা কি গাছে ফলে? ওর বাবা এসে চেঁচাবে তো আমার উপর!
    পাঁচিলের উপর থেকে ঝুঁকে মৌমাসির মা বলে, তাই, দিশা? ব্ড় দুষ্টু হয়েছো তো তুমি। বোন কেমন শান্ত দ্যাখো তো।
    রাগ আর কান্নার মাঝে তার ইচ্ছে হয় ভারী মগটা তুলে ছুঁড়ে দিতে, কিংবা কিছু একটা করতে, সাংঘাতিক কিছু একটা, কি সেটা বুঝতে না পেরে হাপুস কাঁদতে থাকে।

    টালির উপরে শালিক ঝগড়া করে। এক, দুই, তিন। আরো। চার, সাত, ছয়। এতটা এখনো গুণতে পারে না সে। ইস্কুলে কানমলা খায়। মা বলে সেপুপিসির কাছে ভরতি করে দেবে। সেপুপিসিকে দেখলেই ভয়। পায়ে কেমন শুড়্শুড়ি লাগে, হিসি পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে কমলা সাদা কালো বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে সে। সেপুপিসি ভী-ষ-ণ মারে। আঙুলের গাঁটে, এস্কেল দিয়ে। দেখেছে সে। আরো দেখেছে, জাম্বুরা গাছের ওপর একটা ছেয়ে মতন কি যেন ভয়ঙ্কর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে তখন। ওটা ভয়। ঝাঁপ দেবে এখনি হয়তো। ভেবেই তার গলায় কেমন ব্যথা ব্যথা হয়। তখন সে মায়ের পিঠের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সারা বিকেল মা উঠোনের পাতাপুতা ঝাঁট দিয়েছে। নারকোলের ড্যাগা জড়ো করেছে। এখন মাটির তিনকোণা উনুনের মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে জ্বালায়। কুপি পাশে। মায়ের নাইটির উপর খোলা পিঠে শিরদাঁড়া কেমন গুটুলি হয়ে উঠে উঠে আছে। একটা তালপাতার পাখা নিয়ে নাড়ছে আর সাদা ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। সেও মায়ের পাশে উবু হয়ে বসে ফুঁ দ্যায়, ফু ফু। মনে হয় ধোঁয়াটা আরেকটু উঁচু হয়ে উঠছে। মা, উনুং ধরে গ্যাছে, না?
    ধরে গ্যাছে না ছাই, মা গজ গজ করে, যতো ভেজা ড্যাগা।
    আমি ফুঁ দিলাম যে।
    তবে আর কি , রাজকাজ্জো করেছো। মা একটু হাসে, যাও গিয়ে বইটা নে বোসো, আমাকে আর জন্তনা কোরো না। আর বোনকে তুলিসনা য্যানো দিশা, নইলে এই পাখা তোর পিঠে ভাঙবো বলে দিলাম।
    বোন গোলাপি মশারির মধ্যে ঘুমোয়, ছাতার মতো। এই মশারিটা তার ছিলো, ছিঁড়ে গেছে, মা বাবার লুমগি দিয়ে তাপতি দিয়েছে। মা সবেতে তাপতি দিতে পারে। সেদিন বিছানার চাদর ফেঁসে গেলো তখন মা শাড়ির পাড় দিয়ে এমন তাপতি দিলো যেন ঐখানে একটা ফুল সেলাই করা আছে। এমন তাপতি দিতে কারুর মা পারে না। কিন্তু সেদিন সেকথা বুক ফুলিয়ে মিষ্টুর জন্মদিনে খেতে গিয়ে বললো সে, আর মা বাড়ি এসে দুম দুম দু ঘা দিলো তাকে। দাঁত চেপে চেপে বললো মরে গেলে বাঁচি, এমন হতভাগা মে'।
    ঠোঁট্টা একটু ফুলে ওঠে তার। ওমা, অমনি বোনের ঠোঁট্টাও কেমং ফুলে ফুলে ওঠে। ও টের পায় বুঝি, ভয় পায় সে। কথা বলতে শিখে মা'কে বলে দেবে না তো? বাচ্চারা ঠাকুর হয়, ইতুদিদিমা বলেছে, পান কিনতে এসে।
  • sosen | 125.241.11.228 | ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ২২:০৫654294
  • (চলবে)
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ১০:৪২654305
  • বসে আছি তো
  • d | 24.97.206.133 | ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ১৭:২১654316
  • ইশশ
  • rabaahuta | 172.136.192.1 | ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ১৯:৫৮654327
  • পড়ছি...
  • sosen | 125.241.11.59 | ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ২১:২২654338
  • পাশের বাড়ির মিস্তিরিকাকু হেঁকে বলে বৌমা, অ বৌমা। ডিম আছে?
    মা নাইটির কোঁচড়ে হাত মুছতে মুছতে বলে , বেশি নাই, বারোটা।
    আমারে চারটা দাও দিনি।
    মার ভুরু কুঁচকে থাকে। চারটে ডিম হাতে নিয়ে একটু ভাবে। তারপর একটা পেলাস্টিকে ডিম ভরে সাবধানে তার হাতে দিয়ে বলে, মিস্তিরিদাদুকে দিয়ে আয়। ষোলো টাকা পয়্সা নিবি।
    সে ফ্যালফেলিয়ে চায়। মা আরো বিরক্ত হয়ে বলে, বলবি, ষোলো টাকা। মা বলে দিলো। বুইচিস?
    হুঁউউউ, ঘাড় কাত করে পাঁচিলের ভাঙ্গা গলে সে ওবাড়ি নেমে পড়ে। ডিমগুলো বেশ ভারি। এই বাড়ির বেলগাছে কাঠবিড়ালি আছে। ঘাড় উঁচু করে দেখতে দেখতে সে হাঁটে।
    ডিমগুলো মিস্তিরিদাদুকে দিয়ে বলতে হবে, ষোলো টাকা।
    ষোলো টাকা কি গো দিদিভাই! কি হলুদ দাঁত মিস্তিরিদাদুর। এই নাও পনেরো টাকা।
    সে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে মা বোল্লো ষোলো।
    ষোলো তো, ষোলো। তুমি গুনতি জানো?
    সে হাতে ধরা টাকাগুলোর দিকে তাকায়। দুটো টাকা, সব আলাদা আলাদা। এগুলো গুনতে সে জানে না।
    মা মারবে। তার গলা ধরে আসে। এই বাড়িটা এতো ভয়ের কেন? মিস্তিরিদাদুর গায়ে কতো কালো কালো লোম। ইশ।
    মা মারবে? আহা, তাইলে তো তোমারে দিতি-ই হয়। আচ্ছা দেবানে। মাকে বোলো, দাদু পরে দেবে।
    ঘুরে চলে যাচ্ছে মিস্তিরি দাদু। সে মরিয়া গলায় বলে , না, এখুনি দাও দাদু। মা আমায় গুম গুম কিল মারবে।
    গুম গুম কিল মারবে? হো হো করে হাসে মিস্তিরি দাদু। তারপর লুমগির খোঁট আলগা করে। আরো কত চুল রে বাবা।
    সেইখান থেকে একটা চকচকে টাকা বের করে তার হাতে দ্যায়। হাতটা কি চটচটে। কাদা কাদা।
    সে দৌড় দৌড় ছুট।
    দৌড়োচ্ছিস কেনো রে? মেয়ে না একখানা ঘোড়া হইছো তুমি? মা টাকা হাতে নিয়ে কানটা মুলে দ্যায়। তার অবশ্য ও-সব অভ্যেস আছে। মা বেশি জোরে কান মোলে না। কানের নুতি লম্বা হয়ে যাবে। মৌমাসির মা বলেছে।
    মা, মিস্তিরি দাদুর গায়ে কত লোম! বিচ্ছিরি!
    মা সন্দো সন্দো চোখে দ্যাখে। লোম তো তোর কি? কোলে যাসনি তো?
    নাআআআ সে জোরে জোরে ঘাড় নাড়ে ডাইনে বাঁয়ে। মা বারণ করেছে কারো কোলে যেতে।
    যাও দুধ রুটি দিইছি। খেয়ে আমায় উদ্ধার দাও। বলতে বলতে দাওয়ায় ঘুরে বসে পুট পুট ব্লাউজ খোলে মা। দুধুটা বোনের মুখে ঠুসে দ্যায়।
    তার খুব লোভ হয়। চোখ গুল্গুলিয়ে দ্যাখে। কিন্তু চাইতে গেলেই মা সেদিনকার মতো দেয়ালে মাথা ঠুকে দেয় যদি! হঁয়া, আমায় শুষে ফ্যাল। শুষে ফ্যাল। রক্তচোষার দল সব।
    রক্তচোষা কি জিনিস? কিন্তু কি ভয় ভয় শুনতে, অন্ধকার বাড়ির মতো, সেপুপিসির মতো, রাত্তিরে ঘুম থেকে জেগে বাবার হাঁসফাঁসে গলার মতো আর কি একটা তাল তাল অন্ধকারে নড়ার মতো--বিছনা ভিজে যায়। দাগ-ওলা তোশক শুকু দিতে দিতে মা গজ গজ করে।
  • kumu | 11.39.25.67 | ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ১৯:১৩654349
  • কতবার এসে পড়ে গেলাম।
  • sosen | 125.241.91.14 | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ২২:৫৯654350
  • বোনের পাশে সে বসে আছে। মা বসিয়ে রেখে গেছে। বোনের পা দুটো ছোটো ছোটো। ফসসা। তাতে রুপোর চুড়ি। সে জানে ওটাকে চুড়ি বলে না। কিন্তু কি যে বলে! তার পায়েও অমন আছে। কিন্তু তাতে ঝুমঝুমি নেই। বোনের আছে। বোনের হাত বেয়ে একটা কালো পিঁপড়ের সারি উঠছে। ফসসা মোটা ভাঁজ-অলা গলা বেয়ে মুখের কাছে গিয়ে লেগে থাকা সেরেল্যাকের দানা নিয়ে আবার ওরা নেমে যাবে।
    এতক্ষণে টুপাইদি, তিরিরা খেলা শুরু করে দিয়েছে। মা গেলো তো গেলো-ই। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সামনের বাড়ির কাকুর সাথে গল্প করছে। হেসে হেসে, হাতে মুখ ঢেকে। ওটাকে বলে ঢলানি। ঠাকুমা বলেছে।
    ঠাকুমা কলতলায় স্নান করার সময় সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেমন অন্যরকম দেখতে ঠাকুমাকে। মায়ের মতও না। মানুষের মতও না। বাবার মতও না। কেমন কুঁচকানো মত। বেগুনপোড়ার মত। মা বলেছে ডাইনির মতো।
    সে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসে। ঠাকুমা উঠুনে বসে পশম সেলাই কচ্ছে।
    ও ঠামি, আমি খেলতে যাই?
    ঠামি বলে উঁ?
    খেঁলতেঁ -নাকিসুরে বলে সে। ঠামি তেড়ে উঠে বলে ন্যাকা চৈতন! তুই খেলতে যাবি তো ঠামি কি করবে? চাট্টে ঘর পড়ে গ্যালো। যত্ত অসৈরণ। ভাগ!
    ঠামি অনেক পশম বোনে। সব তুলে রাখে। মা বলে যক্ষ, যক্ষিবুড়ি। ওনার পেরাণের মেয়ে এসে ঐ জামা পরবেন খেনে। সাতজম্মে খোঁজ ন্যায় না, মরে আছে কি বেঁচে আছে জানা নেই!
    ঠামি এক ঘটি গমগাজল মায়ের গায়ে ছুঁড়ে দ্যায়। মর, মর, যার জল আচণ নেই তার আবার বড়ো কথা। ছোটলোকের মেয়ে!।
    তার ভারি ফুর্তি হয়। খেলতে গিয়ে তিরিকে বলে তোর জল আচণ নেই। তুই অসৈরণ।
    তিরি বলে তুই একটা আচম্বিক। তুই কানাগরু।
    সে গমগা জল মিছি মিছি ছুঁড়ে দ্যায়, তারপর হি হি করে হাসে।

    মা, তোমার জল আচণ ক্যানো নেই?
    মা দুধ জ্বাল দিতে দিতে অন্যমনে বলে কি নেই?
    জল আচণ? অনেক দাম?

    মা ভীষণ ভুরু কুঁচকে বলে যত্তো আজে বাজে বকা। পড়তে বসবি, না এই গরম সাঁড়াশি দিয়ে দেবো দু'ঘা।

    সে পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসে। না মা না। আমার নক্ত জল হয়ে যায়। মেরো না মা।

    মা তাকে একটুও ভালোবাসে না। কিন্তু তিরির মা-ও তিরিকে ভালোবাসে না। মেয়েদের মায়েরা ভালো ইবাসে না। খালি বোনদের ভালোবাসে।
    গেটের সামনে মা ডাঁড়িয়ে, তাই সে পাঁচিল টপকে মিস্তিরিদাদুর বাড়ির ভেতর দিয়ে দৌড় লাগায়। ছুট ছুট ছুট। সোন্ঝে লেগে এলো। পুঁ বাজছে আনমমাসিদের বাড়ি। তাড়াতাড়ি এট্টু খেলে নিতে হবে।
  • ranjan roy | 132.176.225.25 | ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ২৩:১৩654351
  • লেখ, সোসেন লেখ।
    এইসব অসাধারণ গল্পগুলো। আমার চেনা দুনিয়ার বাইরে। বসে থাকব।
  • bhagidaar | 106.2.241.35 | ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ২১:২৯654284
  • -- কিক
  • d | 144.159.168.72 | ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ১৩:১৭654285
  • হেঁইয়ো
  • sosen | 125.241.86.239 | ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৮:২৪654286
  • মা, দোদোল। তাতা, দোদোল।
    মা-আ-আ- দোদোললল--
    তাতাআআআ
    কথা নেই বাত্তা নেই মা এসে পিঠে গুদুম করে একটা কিল দিলো। সে ছিটকে সরে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় ইঁটের গুড়োর মশলা, লুচিপাতা, ছোট্টো টিনের গ্যাস উনুন। কি করেছি? ওমা, কি করেছি? সে বলতে যায়, কিন্তু কান্নার চোটে আর বলতে পারে না।
    এখানে বসে নোংরা ঘাঁটছো, ধেড়ে মেয়ে, বোনটা কাঁদছে একটু দোল দিতে পারো না? সব শিকুয়ে দিতে হবে? পড়ালেখায় ঘন্টা, খালি যত নোংরা তুলে এনে পোষ্কার উঠোনটাকে শেষ করছো! ফুলগুনো ছিঁড়েচিস ক্যানো, হ্যাঁ? আদিখ্যেলা পেইচো?
    তাতাআআআ----বোন দোলনা থেকে আরো চিত্কার করে কান্না জোড়ে তার কান্নার সাথে।
    চিচকার করলে গলা টিপে দোবো দিশা। শিগ্গির যা । শিগ্গির বোনের কাছে গিয়ে বস।
    সে হাঁপাতে হাঁপাতে দোলনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের জলে সদ্দিতে মাখামাখি, কেমং নোনতা খেতে। বোন কালো কালো জলভত্তি চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। তারপর দুটো দাঁতওলা গোলাপি মাড়ি বের করে খলখল করে হাসে। তাতা। তাতা দোদোল।
    সে কাঁপা কাঁপা হাতে দড়ি ধরে টানে। তারপর পিছন ফিরে দ্যাখে। মা এখনো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে নুচিপাতা, নলচে ডাঁটা, বোতাম, বনমোরগফুল।

    ঠামি কলতলা থেকে বলে-রাক্কুসী মেয়েছেলে। মেরে ফ্যাল মেয়ে দুটোকে। শুদু হাত ওটে, শুদু হাত ওটে।

    মা আন্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে ঘরে অমন যক্কি থাকলে সবাই রাক্কুসী হয়। পাতের যোগাড় কে দেবে, শুনি?

    পিঠের টিপবোতাম গুলো খুলে গেছে, কাঁধের থেকে ঝুল ঝুল জামা। সে মুখে একটা আঙুল পুরে দড়ি ধরে বসে টানে আর দোল দ্যায়। দোল দ্যায় আর টানে। বোন হাসে।
    তার খুব ইচ্ছে করে বোনের পেটে ঘুরিয়ে একটা প্যাঁচ চিমটি কাটতে। কিন্তু কাঁদলে যদি আবার মা চলে আসে?
    বসে বসে শ্বাসের নীচে বিড়বিড় করে সে, মায়ের মতো গলা করে, ফিসফিসে-মরোণ হোলে বাঁচি। আরেকবার উঠুনের দিকে তাকিয়ে দেখে। নুচিগুলো কেমং সুন্দোর হইছিলো আজ।ভেবেছিলো তিরিকে নেমন্ত করে বেড়ে দেবে খেলাস্সময়।
    একটা হাত দিয়ে সদ্দি মোছে সে। মা রাক্কুসী।
  • | ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ১১:৩০654287
  • অ সুষে-এ-এ-এ-এ-ণ, কই গ্যালে-এ-এ-এ?
  • nina | 78.37.233.36 | ১৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৮:০০654288
  • কি দারুণ হচ্ছে রে ----হাত চালা মামন
  • sosen | 111.63.188.224 | ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০৮:৪৩654289
  • ময়্লা গাড়ি এলেই ছুট্টে যেতে হয়। পুঁ পুঁ করে বাঁশি বাজে, ময়লাকাকু চিচকার করে বলে ময়্লা বৌদি! শিগ্গির, শিগ্গির--পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়াবু না। আর তখন মা তাড়াতাড়ি পেলাস্টিকে ডিমের খোলা আর পেঁজের খোসা ভরতে ভরতে চিচকার করে-ও ময়লা, দাঁড়াও।
    সে ছুট্টে গিয়ে মুখে বুড়ো আঙুল ভরে দাঁড়ায়, বিচ্ছিরি গন্দো হলেও অনেক সুন্নর জিনিসও থাকে কিনা। সেদিন এট্টা খেলনা গাড়ি ছিলো। কার গাড়ি বলো তো। এট্টু ভামগা হলেই ফেলে দেয় নাকি? এই তো তার মুনি পুতুলের চুলগুলো উটে সব টাক মোতো, চোক্গুলো নড়ে না, জামা নেই, সে কি ফেলে দিইছে? তাপ্পর ধরো গে সেদিন বল খেলতে গিয়ে যে তোতনদাদার পা ভেমগে গ্যালো, তা তোতনদাদাকে কি ফেলে দ্যায় ময়লার গাড়িতে? ময়লার গাড়িতে শুদু প্যাঁজের খোসা ফেলতে হয়। আর কিছু ফেল্লে বড়োনোকের বেটি হয়। সেইটা কি তা অবিশ্যি সে জানেনা-খুব খারাপ কিছু এট্টা নিচ্চয়। বড়োনোকের বেটিরা সব জিনিস নষ্ট করে। ফেলে দ্যায়। বড়োনোকের বেটি হলে মা গুম গুম মারবে।

    এখন মালার গাড়ি এইচে। মা মালা কিনেছে, চাট্টে মালা। সে মায়ের পিছনে দৌড়োয়, মা, মালা! মা, মালা! এট্টা ফুল, মা।
    মা একটা ফুল তাকে দেয়। সে লাফাতে লাফাতে আলমারির আয়নার সামনে যায়। কানের উপর ফুল গোঁজে । ঠামির লাল গামছা গায়ে জড়িয়ে শাড়ি পরে। তাপ্পর ঘুরে ঘুরে দ্যাখে। ঠিক মায়ের মতো লাগছে , না?
    না, একটু কম লাগছে। সে একটা চেয়ার টেনে টেনে আনে। তাপ্পর তার উপর উঠে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে পায়ে ডিঙি দিয়ে নাল সিঁদুরকৌটো পাড়ার চেষ্টা করে। এই এই এই--
    তাপ্পর সবশুদ্ধু হুড়্মুড় করে পড়ে যায়। হাঁটুতে কি জোর ব্যথা---মা দৌড়ে আসছে-ভয়ে সিঁদুর মাখা সে গড়িয়ে গড়িয়ে সরে যেতে থাকে।
    ঠামির খ্যানখেনে আকাশ-চেরা চিচকার শুনতে পায়, এক চোখ জলের মদ্দে--মার মার, বিষ দিয়ে মেরে ফ্যাল না! রোজ রোজ এত মারতেও পারে রাক্কুসী--বিষ দিয়ে মেরে ফ্যাল তার চাইতে!
  • de | 24.139.119.173 | ২০ নভেম্বর ২০১৪ ১৫:১৪654290
  • কি মায়া!
  • sosen | 125.241.51.165 | ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০৮:২৬654291
  • কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বোন বিছানায় গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ঠামি চেঁচাচ্ছে, ওগো বৌটাকে মেরে ফেল্লে গো। হতচ্ছাড়া অলপ্পেয়ে ছেলে, মর তুই মর। ওরে ডাম্পি, চন্দন শিগ্গির আয়, ধর ধর, মালের নেশায় কি করছে ছেলেটা দ্যাখ। ওগো কে কোথায় আছো গো--
    উঠোন জুড়ে মা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, নাইটিটা তুলে ধরে, পিছনে বাবা, হাতে একটা কাঠের টুকরো নাকি? ওটা কি সেই কাঠের টুকরোটা, যেটা সে মণিকাকুদের বাড়ি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো? হিম হয়ে থাকে সে। ওটা খুব ভারী তো। কত কষ্ট করে সে টেনে এনেছিলো। ওটা দিয়ে বাবা মাকে মারবে? মা খুব রোগা তো!
    চিঁ চিঁ করে আপনমনে সে বলতে থাকে, ও বাবা, মেরো না। ও বাবা, নাগবে তো। ভয়ে গলাটা কেমন জ্বালা জ্বালা করে।
    তার কথা কেউ শুনতে পায় না। ধড়াম করে একটা আওয়াজ পায় সে, ঠামি দৌড়ে বেরিয়ে যায়, তারপর কত লোকজনের গলার আওয়াজ। হেঁচকি টেনে টেনে মা কানছে। ওমা, মা, কেনো না। মা কেনো না মা।
    বাইরে কে যেন চিচকার করে বলছে-সালা, রোজ মাল খেয়ে আসবে, আর বৌদিকে পেটাবে। আজ এমুখো হলে তোর হাড় ভেম্গে দেবো। পাড়ায় রোজকার হুজ্জুতি! বস্তি পেইছো এটা?
    ঠামি চেঁচায়। মা কানে। বাইরে লোকের পায়ের ধুপধাপ শব্দ। ডাক্তার ডাক একটা। ইস, মাথাটা কেটেছে গো। এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাবো সালা। শম্ভুটা একটা ষাঁড় মাইরি। আমরা কি মাল খাইনা?
    সে পা টিপে টিপে গিয়ে বোনের পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বোনের গায়ে একটা হাত রাখে। অমনি বোন কান্না থামিয়ে বলে -তাতা! তাতা, দল।
    সে ছোট ছোট হাতে মাথার পাশে রাখা জলের বোতল দেয় বোনের মুখে। বোন দু-হাতে ধরে চুক চুক করে জল খায়। মোটা গালের ভাঁজে জল গড়ায়, সে টেপজামার খুঁটে মুছে দ্যায়। তারপর হঠাত ভীষণ ঘুম পায় তার।
    হিসির গন্ধ মাখা কাঁথার এক্কোণে বোনের গায়ে হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুমের আগে হালকা হালকা টের পায়, বোন তার বুড়ো আঙ্গুল চুষছে।
    অন্ধকার অন্ধকারে একবার ঘুম ভেঙ্গে সে ওম পায় মায়ের গায়ের। হাত পা বাড়িয়ে বেশ জড়িয়ে দেখে। নিশ্বাস টের পায়। তারপর মায়ের বুকের মধ্যে মুখটা ঘুঁজুমুজু করে ন্যায়। মা একটু নড়ে, বকে না। তাকে আরেকটু চেপে রাখে।
    কেমন গলে গলে ঘুমের মধ্যে পড়ে যেতে থাকে সে। আঃ কি আরাম। মা রাক্কুসী না। মা খুবভালো। বাবা রাক্কুসী।
  • darshak | 11.39.25.249 | ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০৯:৩১654292
  • কী বলি!!!জীবন এই রকমই তো।
  • sosen | 125.241.32.124 | ২৪ নভেম্বর ২০১৪ ২০:০৪654293
  • বোন হাঁটছে। কেমন টলমল করে, দেবাল ধরে। দেবালের সাদা রং গুঁড়ো হয়ে হয়ে পড়ে নিচে। সে অবাক হয়ে দেখে। দেখে আর ভাবে মা'কে কি ডাকবে? বোন হেঁটে হেঁটে অনেকদূর তো যেতে পারবে না। ওর পা খুব ছোট্ট। ফোলা ফোলা। ওর জুতো-ও নেই।
    সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বোন থুপ করে বসে পড়ে। তার পর হামা দিয়ে দিয়ে তার কাছে আসে। চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। চাট্টে দাঁত দেখিয়ে হাসে। কেমং ঝিনুক ভরা জলের মতো চোখ।
    তাপ্পর এক থাবা দিয়ে সেলেট পেন্সিল তুলে নিয়ে চুষতে থাকে।
    সে বড়োদের মতো গলা করে বকতে গিয়ে ফিক করে হেসে দ্যায়। বুকের মধ্যে কেমং ভিজে ভিজে লাগে।

    টিনের বাস্কোতে একটা গুটলি ওঠা রবাট আছে। একটা কাঠের এস্কেল। আর হাসিখুশি প্রথম ভাগ।এবিসিডির বই। মাদুরের রোদ্দুরে সে ভেজা সেলেট শুকু দ্যায়। তারপর উপোর দিকে মুন্ডু তুলে দ্যাখে পাশের দোতলা বাড়ির বাস্কো জালনা দিয়ে একটা মোটামত সুন্নরমত বউ তাকিয়ে তাদের দেখছে। বউ না, বউ না, মে। ছোটো ছোটো চুল।
    তার চোখে চোখ পড়তে হাসলো মে'টা। মা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ভিজে চুল ঝাড়ছিল। নাল হলুদ গামছা দিয়ে। মা-ও হাসলো।
    তারপর মে'টা সরে গ্যালো। জালনা দিয়ে একটা আয়নার ঝিলমিল দেখা যায়।
    মা ভারী গলা করে বললো ঐ পিসিটা বিলেত গ্যাছিলো, জানিস দিশা?
    বিলেত কোথায় মা?
    সে অনেক দূর। দিল্লীর চাইতেও দূর।
    মামাবাড়ির চাইতেও?
    হঁউ। অনেক। কতো পড়াশোনা করেছে পিসিটা। তবেই না যেতে পারে?
    কতো মা? মিনিদিদির মতো?
    না না, আরো অনেক অনেক। তাপ্পর মা বলে-অমনি ভালো করে পড়ালেখা কল্লে চাক্রি করবি। কতো টাকা মাইনে পাবি। কতো ভালো বে' হবে।
    চাক্রি তো বাবা করে।
    তাতে কি। তুই-ও করবি। তারপর মা ফিরে চলে যেতে যেতে বলতে থাকে -সে কপাল কি আমার আছে? দুটো ভালো মাস্টার ও দিতে পারবো না। ক্যাঁট ক্যাঁট কতা শিখবে। সাজুনি পরী হবে। পালিয়ে গিয়ে বে' করে বসে থাকবে। তোমাদের আর জানিনা? হাড় বজ্জাতের ঝাড়। বেইমান, সবগুলো বেইমান।

    আর শুনতে পায় না সে। মা ঘরের ভিতর ঢুকে গ্যাছে। তার ভারি দুক্ষু হয়। গলার কারে লোকনাত্বাবার ছবিটা ধরে টানে। গলাটা ব্যথা ব্যথা।

    সেলেটে চারটে লাইন টানে তাপ্পর। গোল করে ঘুরিয়ে লিখতে থাকে। অ। ক। যাবো-ই তো। যাবো-ই তো পালিয়ে। সবাই পচা। সব্বাই। সব্বাই সাজুনি পরী। হাড়বজ্জাত। অসৈরণ।
  • sosen | 212.142.95.144 | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৯:০৬654295
  • আমি ওর নাম রাখতে চেয়েছিলাম প্রসন্নতা। শ্বশুরমশাই নাম রাখলেন রাজেশ্বরী।
    কেমন যেন শিকড় ছেঁড়ার বিষাদ ওর চোখে। ছোট্টো, দুবলা দুটো হাত, বুকের মধ্যে থেকে উঁচিয়ে উঠেছে খোঁচা খোঁচা পাঁজর।
    আমার বিশ্বাস হয়না ও বাঁচবে। ন বছরের বিবাহিত জীবন, ছ'টি নষ্ট গর্ভের পর এই আমাদের প্রথম দেহজাত সন্তান। যখন আমরা নীল চোখ, ঝুপসি সোনালী চুলের সাধনকে বাড়ি নিয়ে এসেছি, ইস্কুলে ভরতি করে ফেলেছি। যখন ভুলেও এসেছি, কাজের, ব্যস্ততার, জৈবিকতাহীন মাতৃত্বের হাজারো ঝামেলার মাঝে, যে জন্মনিয়ন্ত্রকের প্রয়োজন আমাদের ফুরিয়ে যায়নি, তখন সহসা এক লাল-হলুদ পাতা ঝরা লং ড্রাইভে, হঠাৎ জাগা ফিসফিসে কামনায়, হাজারো বার ঘাড় ঘুরিয়ে জোড়া চাইল্ডরুমের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আমার পেটে নেমে এলো এক দুবলা, শ্যামবরণ, রুগ্ন মেয়ে।
    সে যে বাঁচবে আমি ভাবিনি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সে যখন তিন মাস পেরিয়ে গেলো, আমার শাশুড়ি বললেন, এতোদিন তো ওখানের ডাক্তারদের দেখলে। একটু দেশে এসে থাকো, আমার কাছে, আমার যত্নে।
    মা-বাবা চলে গেছেন আমার ছাত্রাবস্থায়। দাদা বৌদি আছে কলকাতায়, তারাও সায় দিলো। ব্যস্ত চাকরিটি ছেড়ে, সাধন ও স্বামীকে ন্যু অর্লিয়ান্সের বাড়িতে রেখে চারমাসের শিশু পেটে আমি উড়ে এলাম কলকাতায়। ছ'মাসের মাথায় ইস্কুল ছুটি পড়লে সাধনকে নিয়ে এলো আমার স্বামী , সে অবশ্য থাকতে পারলো না---আমরা রইলাম।
    আমার শিশু বেঁচে গেলো। ন'মাস পূর্ণ করে, দিন ঠিক করা সিজারের আগেই, সে নেমে এলো মাটিতে। নর্মাল ডেলিভারি । আন্ডার ওয়েট, কুঁচকানো চামড়া , হাত ও পায়ের হাড়গুলি ইষৎ বাঁকা---কিন্তু রক্তের তাল নয়, এতোদিন যাদের আমি কমোডে ভেসে যেতে দেখেছি। পূর্ণ, ক্ষুদ্র এক মানবী।
    শাশুড়ী বললেন, একে আরেকটু বড়ো না করে ওদেশে নিয়ে যেতে পাবে না।
    আমার বুকে দুধ এলো। প্রথমে সে শিশু দুধ খেতে পারছিলো না। ডাক্তার বললেন ক্যাঙারু কেয়ার প্রয়োজন। ক্রমান্বয়ে আমি , শাশুড়ী ও বৌদি বুকে চেপে রইলাম ওকে সাতদিন। ছোট্টো সাধন বোনকে ছুঁয়ে বসে রইলো। আমরা স্নান করলাম না, কাপড় বদ্লালাম না। একটি প্রাণকে বুকে ধরে রইলাম। আমার স্বামী দশদিনের ছুটি শেষে আরো ছুটি বাড়ালো। তারপর একদিন সে ক্ষীণ কন্ঠে কাঁদলো। দুধ টানলো। আমরা সকলে কাঁদলাম , ওর সাথে, ভয়ের, স্বস্তির, ভয়ের কান্না।

    ও হাসে না। আমি জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির শিশুদুটির দিকে তাকাই। অমনি বড়ো হবে তো? হাসবে তো? পেটের ভিতর, বুকের ভিতর মাখন গলতে থাকে। তাকে উঠে গেছে আমার পনেরো বছরের এক্সিকিউটিভ এক্সপিরিয়েন্স, এম বি এ ডিগ্রি, ঝকঝকে স্যুট, আমি ফ্লানেলের নাইটি পরি, ফোটানো জলে কাচা গামছা দিয়ে গা মুছি, আমার দোরের কাছে মাদুর পেতে বসে সাধন আর আমার শ্বশুরমশাই খেজুর গুড় দিয়ে পরোটা খান। সাধন তার সদ্যলব্ধ বাংলায় আধো আধো করে বোনকে আদর করে। আমাল মণি। বোনুটা।
    আমি কাঁপতে থাকি। আমার চেনা পৃথিবী, আমার ইস্ট কোস্ট টু ওয়েস্ট কোস্ট সকালে বিকেলের ফ্লাইট, আমার লম্বা মিটিং আর কনকল, আমার বাগানের বার্ড হাউস, আমার শখের ছোট্টো গাড়ি, প্রতিবেশী সান্দ্রার নতুন চাকরি, রায়ানের হাল্কা ফ্লার্টিং, ওয়াইন আর মুভির শনিবার, মেক্সিকান টেক অ্যাওয়ে, এসব সব কোথায় একটা ঝড়ে হারিয়ে গেছে। রিফিউজি আমি, এক অচেনা বাড়ির আদরের বালাপোশের মধ্যে প্রসন্নতাকে বুকে চেপে শুয়ে ভাবতে থাকি---বাঁচবে তো? আর কতোদিন? একটা মাস অন্তত?
  • | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৮:৫৪654296
  • তুলো তুলো মেঘ মেঘ মায়া দিয়ে লেখা যেন।

    তাপ্পর?
  • sosen | 212.142.95.144 | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ১০:৫৩654297
  • ফোনটা ব্লিপ ব্লিপ করছে। কাত হয়ে একটা হাত দিয়ে ফোনটার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করি। নড়লেই ঘুম ভেঙ্গে যায় যদি ! আরো কিছু ভাঙ্গে যদি!
    হ্যালো!
    হাই, মিত্রা! হাউ আর য়ু ডুইং!! হাউ'জ দ্য বেবি! উই আর মিসিং য়ু!
    পায়েল। পায়েল চন্দ্রা, সেই বিজনেস স্কুল থেকে আমাদের ভাব। পায়েল জেরক্সে চাকরি করে---বেশি চাকরি বদলায়নি ও আমার মতো। ঘন্টা তিনেকের গাড়ি-দূরত্বে আমাদের বাড়ি।
    আমি ভালো আছি পায়েল। বেবির কথা জানি না। এতো রোগা! বাঁচবে না মনে হয়।
    ডোন্ট বি অ্যাবসার্ড মিত্রা। ডাক্তার কি বলছে? তোমার ডিপ্রেশন হচ্ছে নাকি? ডাক্তারকে বলো।
    আমার কিচ্ছু হচ্ছে না রে---এভ্রিথিং ফিলস আনরিয়াল। এখানে সব কেমন স্বপ্ন মতো। আমি ভাসা ভাসা গলায় বলার চেষ্টা করি।
    মিত্রা এতো ভেবো না তো---এনজয় করো---এই সময়টা ফিরে পাবে নাকি আর? শোভনের সাথে কথা হলো আমার-হি সেইড হি উইল ট্রাই টু ভিজিট আগেইন নেক্স্ট মান্থ-ওর হাতে আমি প্রিন্সেস-এর জন্য সোয়েটার পাঠাবো!
    না পাঠাস না রে---শীত নেই তো এখানে।
    ওকে। হাউ`জ সাধন?
    হি ইজ ফাইন--দাদুভাইয়ের সাথে খুব জমেছে--
    ইজ হি জেলাস অর সামথিং?
    আমি দোরের দিকে তাকাই। সাধনের গলা পাচ্ছি, মিষ্টি, রিনরিনে, খুব বকছে। না, হি ইজ নট জেলাস। লি'ল কন্ফিউজড, নট জেলাস দো।
    গুড রে--আমি এখন রাখছি, য়ু টেক গুড কেয়ার অফ য়্যোরসেলফ, ওকে?

    ওকে। ফোন রাখতেই জানলা গুলো কেমন যেন বন্ধ হয়ে যায়। আমার চেনা জানলা। আমার বুক টনটন করে, দুধ উপছে জামা ভিজে যেতে থাকে---প্রসন্নতা ছোট্টো একটা হাঁ করে ঘুমোয়--কষে একটু লালা, ও বেশি খেতে পারে না- হাত বাড়িয়ে আমি ব্রেস্ট পাম্প খুঁজি। বাচ্চাটার কানের উপর একটা হাল্কা কাঁথা চাপা দি--কি তুমুল চিৎকার পাশের বাড়ি। কি মারে বাচ্চাগুলোকে ঐ অল্পবয়েসী মেয়েটা---আর রাত্রে ওর বর ওকে মারে। আমি নুয়ে পড়ে ফিসফিস করে প্রসন্নতাকে বলি-আমার স্বয়মাগতা কন্যা, একটু সয়ে থাকো মা, বেঁচে থাকো আর কটা দিন। তোমায় আমি নিয়ে যাবো আমার নিজ ভূমিতে, সেখানে চতুর্দিকে লাল হলুদ পাতার অভয়ারণ্য, তোমার থাকবে ছোট্টো গোলাপি ঘর---কুশনড পকেট, সেখানে আমরা সবাই ক্যাঙারু হয়ে ঘিরে রাখবো তোমাকে। এতো চিৎকার চেঁচামেচি নেই সেখানে।

    দিশা! দিশা-আ-আ-আ!
    সে শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু সাড়া দিতে পারছে না। বুনুকাকু তাকে আদর করছে কিনা। কোলে তুলে , চটকে মটকে, নেশা নেশা জর্দা গন্ধের চুমু খেয়ে। দাড়ি খোঁচা খোঁচা। সে ছটফট করে। উঃ কাকু, দাড়ি!!
    দাড়ি! বুনুকাকু খুব হাসে। সে আরো ছটফট করে বলে ছেড়ে দাও না। মা ডাকছে।
    বুনুকাকু আরেকবার চুমু খেয়ে তাকে ছেড়ে দ্যায়। একখানা প্যায়রা দ্যায়। যাঃ। খেতে খেতে চলে যা।

    সে গাল ঘষতে ঘষতে দৌড় দ্যায়। মায়ের পিছন দিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়ি ঢুকতে হবে। নইলে মার, মা--র।
  • | ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ১৭:১৮654298
  • :-(

    একটু করে লিখে থেমে যায় খালি!! লেখো না
  • kumu | 132.161.210.191 | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৮:১১654299
  • খুব গভীর।খুব ব্যাপক ।আর খুব মায়া।
  • kiki | 125.124.41.34 | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ২০:১০654300
  • হ্যাঁগা রসগুল্লা, সময় হচ্ছে না?
  • sosen | 212.142.113.172 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৪৬654301
  • ইস্কুলের গেটটা উঁচু। মা ঘাড় একটু নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে। তার গলার কাছ্টা কেমং কিলবিল করে। দিদিমুণি জামার কলার ধরে টেনে লাইনে দাঁড় করিয়ে দ্যায়। তা-ও সে ঘাড়টা উঁচিয়ে বেঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। আর দ্যাখা যায় না।
    তার ইস্কুলে বসে মনখারাপ হয়। রবাট চিবোয়। পাশে তাকিয়ে দ্যাখে সুজাতা খাতুন-ও পেন্সিল চিবোচ্ছে । ওর মাথায় ছোট্ট কালো ঘোমটা। তার পাশে পিন্টু মালাকার খাতা জুড়ে তিন লিখেছে।
    দিদিমুণি বোড্ডে অমকো লিখেছে। ইস্কেল উঁচিয়ে বলছে লেখো। দশ বার করে ১ থেকে ৯ লেকো। তানিয়া, তুমি নাক খুঁটছো কেনো? যাও কলে গিয়ে হাদ্ধুয়ে এসো।
    তানিয়া জামার পুট ঘাড়ে তুলতে তুলতে পিছনে তাকাতে তাকাতে কেলাস থেকে বেরিয়ে যায়। দিদিমুণি দরজার কাছে গিয়ে দেখে। হ্যাঁ, ব্যাস ব্যাস। আর যাবেনা। হাদ্ধো-ও। এবার চলে এসো।
    ভিজে হাত এস্কার্টে মুছতে মুছতে তানিয়া আবার কাটের বেঞ্চে।
    এখান থেকে কিচ্ছু দেকা যায় না। টুটু বিলাল কি করছে? বোন কি ঘুমুচ্চে? কানছে না তো? মায়ের পিঠের দাগে কে তেল লাগিয়ে দিলো?
    এই সব সাত পান ভাবতে ভাবতে তার ঢুল আসে। অম্নি কখন দিদিমুণি এসে ইস্কেল দিয়ে হাতে বাড়ি মারে। আস্তে করে কিম্তু। মার মতো জোরে না।
    লেকো। লেকো। ঘুমুচ্চো কেনো?
    হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছতে মুছতে সে ভাবে, খিচুড়ি কখন দেবে? আজ কিসের তক্কারি?

    নেমন্ত হলে মাংক খায়।নইলে খায় না। কিমতু ইশকুলের পাশের দোকানে মাংক দিয়ে গুগনি হয়। বাবা বলেছে একদিন এনে দেবে।পাওরুটি দিয়ে খাবে।
  • sosen | 212.142.113.172 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ২১:০০654302
  • ইশকুল ছুটি হলে বুনুকাকু সাইকেলে করে তাকে নিতে আসে। মা কিনা বাড়িতে একলা।
    বুনুকাকু তাকে লজেন কিনে দ্যায় একটা।কালো কালো দাঁত বুনুকাকুর। সাইকেলের সামনে রডে বসলে তার পাছু ব্যথা করে। বুনুকাকু বলে একটা ছোটো সিট কিনবো তোজ্জন্যে। বুঝলি?
    হঁউ। আর এট্টা হল্দে সারি?
    সে তো সরস্বতী পুজো আসুক। দেবো মাইনে পেলে।
    মাইনে খুব্ভালো। মাইনে পেলে বাবা বড়ো লুই আনে। ঝোল হয়।

    বৌদি---বুনুকাকু তাকে বগলের নিচ দিয়ে ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে আসে। এই যে কার্ড নিন।
    মা ঘরের মধ্যে থেকে বলে ভিত্রে এসো না, বুনুঠাকুরপো।
    বুনুকাকু তাকে উটোনে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢোকে। সে দৌড়ে টুটুবিলাল দেখতে যায়। কি ছোট্টো ছোট্টো পা, মাগো।
    ঘরের ভিতর থেকে খুব হাসির আওয়াজ হয়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। ভাবে যাবে?
    ঠামি রোদ্দুরে বসে বিড় বিড় করে যতো ছেনালপনা। যেমন ছেলে, ত্যামং বৌ। হে গোপাল, আর কতোদিন ঠাকুর!
    তার খুব পছন্দ হয় । সেও পেরাক্টিস করে। হে গোপাল, কোতোদিন, ঠাকুর! ওঠামি! ঠামি!
    কি, অত গলা কিসের র‌্যা মেছেলের ? ঠামি খেঁকায়।
    সে দমে যায় না। আরেকবার বোলো না!
    কি বোলব?
    ঐ যে। গোপাল, ঠাকুর! কোতোদিন!
    ঠাম্মি তেড়ে উঠে বলে অসৈরণ! সবসময় বড়োদের কতা ভ্যাংচানি। দূর হ'।
    সে উপোদ্দিকে মুখ তুলে দেখে পাশের বাড়ির বাস্কো জানলায় বসে বিলেতপিসি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কি সুন্দর হাসি। গালে কেমং ফুটো মত!
    সে-ও খুব খুশি হয়ে হাসে।
  • sosen | 212.142.95.16 | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ২০:৩৮654303
  • আমার মা কোনোদিন জ্ঞানত আমার চুল আঁচড়ে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। আজ শাশুড়ী যখন বললেন এসো দেখি তোমার মাথাটা বেঁধে দিই, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। উনি হাসি চেপে শুধরে বললেন, মানে চুলটা বেঁধে দিই।
    চুল বাঁধা? আয়নায় তাকিয়ে অসম্ভব অবাক লাগে। এতো লম্বা চুল কবে হোলো আমার? এমন কোঁকড়ানো নাকি নিচের দিকটা?
    মাস্টার্স করতে ওদেশে পালিয়েছিলাম। আমাকে আর সাত বছরের বড়ো দাদাকে রেখে এক বছরের ব্যবধানে মা বাবা চলে গেলেন। একজন ক্যানসার, অন্যজন হৃদয়--বেশি সময় কেউই নেননি। দাদা গেলো দিল্লিতে চাকরি করতে। মা বাবার জমানো টাকা পয়্সার অনেকটা আর গয়নাগুলো নিলে মাস্টার্সের দু বছরের মোটামুটি খরচ হয়ে যাচ্ছিল। দাদা আমার বিচক্ষণ। বললো, চলে যা। কলকাতায় বাড়ি তালাবন্ধ করে, আত্মীয়স্বজনদের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে একটা ছোটো সুটকেস নিয়ে দিল্লি, সেখান থেকে আরো একটা সুটকেস নিয়ে, দাদাকে টাটাবাই বাই করে প্লেনে উঠে বসে মনে হয়েছিলো-এ আমি কি করছি?
    চার বছর লেগেছিলো বাড়িতে একবার আসার টাকা জমাতে-বাড়িও যে কোথায় তা-ও তখন বোঝা মুশকিল। ছায়াহীন সে জীবন।
    শোভনের আগে আরেকবার বিয়ের চেষ্টা করেছিলাম আমি। মুভ-ইন করার পরে দুজনেই দেখলাম পোষাচ্ছে না। দ্বিতীয়বার ব্যাপারটা হয়ে গেলো। তখন বিয়ে করাটা আমার খুব দরকার ছিল। দাদার বিয়ে হয়ে গেছে, আমার কেউ নেই, কেউ কোত্থাও নেই, এ চিন্তা মাথার থেকে আর যাচ্ছিলো না। এই ডিপ্রেশনের ফাঁকেই দুম করে বিয়েটা হয়ে গেলো। কিন্তু আমি ঘর খুঁজে পেলাম না ঠিকঠাক।
    এইরকম ঘর। ঐ যে বাচ্চাটাকে রোদে তেল মেখে ছেড়ে দিচ্ছে মা। এই যে আমার শাশুড়ি অযথাই এক শিশি নারকেল তেল নিয়ে মাথায় বুড়ো হাতে ঘষে ঘষে দিচ্ছেন, কি আরাম। অথচ আমি কোনোদিন শাশুড়িকে মা বলিনি। বলাটা কেমন গলার কাছে এসে ড্যালা পাকিয়ে যায়।
    ঐ বাড়ির বৌটা , ইশ ছি ছি আমিও বৌ বলছি, ঐ বাচ্চা মেয়েটা শাশুড়িকে মা বলে। গাল দেয়, কিন্তু মা বলে।
    মা কথাটা আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করছে আজকাল। কতদিন, কতদিন মা বলিনি---মায়ের মুখটা মনেই পড়ে না আর। শুধু একটা স্পর্শ মনে পড়ে, দুপুরবেলায় একটা নরম পেটে আঙুল ঘষা, চামড়া টেনে দাদার সেলাই আর আমার সেলাই গুণতে গুণতে চোখ জুড়ে আসা---
    বড্ড ব্যথাময় এই দেশ, এই ঘর, এখানে চোখ ভিজে আসে---অথচ, অফিসের বাথরুমে রক্তপাতের পর যখন জানি চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে আরেকটি শিশু, তখনো আমি পনেরো মিনিটের প্রেজেন্টেশন দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিজে হাসপাতালে গিয়েছি---কান্না পায়নি, রাগ হয়েছে , বিরক্তি, শূন্যতা--মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার, মায়ের কাজললতা, সিঁদুরকৌটো, ফরাসপেড়ে শাড়ি কিচ্ছু ফিরে না দেখার, গয়নাগুলো-ও বেচে দেওয়ার শাস্তি, মাথার ভিতরে এসব অবান্তর চিন্তা ঘুরতে থাকলেই সাদা রঙের ছোটো ছোটো ট্যাবলেট। এসব ভাবলে কি করে চলবে আমার, স্টুডেন্ট লোন তখনো শোধ হচ্ছে তো হচ্ছেই, তারপর সেই বিদেশকে স্বদেশ করে নেওয়ার অমোঘ চিঠিটি আসবে। কোনখানটা দেশ ঘর আমি জানিনা, কলকাতায় গেলে অনেক ধুলো ঝাড়তে হবে, সে আমার সাহসে কুলোয় না। আমি কাগজপত্রে সই করে ফেলি আর শস্তার হেয়ার কাটারিতে গিয়ে আরো আরো ছোটো করে আসি চুল। নইলে বড্ডো যত্ন করতে হয়।
  • sosen | 113.225.178.154 | ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ১১:২৫654304
  • দিশা, ছটফট করবিনে। চুপটি কর। চু-উ-প-টি করে বস, নইলে দেবো দুঘা পিঠের ওপর।
    হ্যাঁ দিদিভাই, একটু শান্তি করে বোসো দিকিন। এইত্তো এখুনি হয়ে যাবে। আমাকে অন্য বাড়িও যেতে হবে তো।
    সে গলার শির ফুলিয়ে চেঁচায়। শব্দ বেরোয় না, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেমগে গেছে। আমি নেড়া হবো নাআআআ
    আঃ নেড়া কোথায় করছে! নেড়া করবে না।
    অঝোর ধারে জলঝরা বোজা চোখ একবার খুললেই সে মাকে দেখতে পাচ্ছে, কোলে বোন, মাথাটা সাদা ত্যাবড়ানো মত। ভ্যাঁ ভ্যাঁ আবার কান্না পে'যায়। সব মিছে কথা। মাথার চামড়ায় কাঁচির ঠান্ডা লাগতেই সে আবার প্রাণপণে হাত পা ছুঁড়তে থাকে।
    ঘরের ভেতর থেকে ঠামি বেজায় বিরক্ত হয়ে বলে ছাড় না বাপু, ঐ ত কটি চুল।অ লক্ষ্মী ছেড়ে দে।
    হ্যাঁ ছেড়ে দেবে না আরো কিছু। ছোটো করে কাটো তো নাপিতকাকা। রোজ জল ঘাঁটবে, সদ্দি, জ্বর, হাড় মাস একোয়ে গ্যালো। ওনার কি? নাতনী তো ছুঁয়েও দেকে? জক্কিবুড়ি।
    ঠামি-ই-ই-ই
    মর মর যা খুশি কর

    ঝুর্ঝুরিয়ে কালো চুল নিচে পড়ে। উঠোনের উপর, ইঁটের ফাঁকে।

    খোঁচা খোঁচা হয়ে থাকে মাথার উপরটা। হাত দিলেই কান্না।নোন্তা সদ্দি আর জল।
  • sosen | 113.225.178.154 | ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ১১:৫১654306
  • দিশা, ইস্কুল যা।
    দিশা, বোনকে ধর।
    হতভাগা মে' আবার মাতায় সিঁদুর মেকেছো?
    কি বল্লি, মাছ খাবি না, গন্নো? ঊঁঃ লাটের বেটি এইচো?
    কান ধর। কান ধরে ঐ উটোনের কোণায় দাঁড়িয়ে থাগবি।খাওয়া বন্ধ তোর।
    মেরে পিঠ ভেঙ্গে দেবো, রোজ রোজ দুটো অব্দি খ্যালা! মা খেটে মরুক, ভুশক্ষেপ নেই! ওর জন্য থালা বেড়ে বোস থাকবো রোজ!

    মেয়েটা গুটিয়ে যেতে থাকে। কেমন আক্ষরিক অর্থে পেঁচিয়ে, কুঁকড়ে, ছোটো হয়ে যেতে থাকে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে আমার ভয় করে। প্রসন্নতার দিকে তাকাই। ওর চোখের মণি স্থির। বাদামী, স্থির। আমি সামনে একটা লাল বল নাড়ি। ওর চোখের পাতা টুপ করে পড়ে।
    বড় দুঃখী, বড় বিবর্ণ দৃষ্টি। মাগো, বেঁচে থাকতে বড় কষ্ট হচ্ছে, মা?

    মরে যা, মরে যা। মরলে হাড় জুড়োয় আমার, ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসি।মরিস না কেন? মায়ের থানে পুজো দিয়ে আসবো।

    আর পারি না। মৃত্যু তীক্ষ্ণ শব্দের ভিতর দিয়ে গলে বয়ে আসতে থাকে ঘরে, ছাই রঙা স্রোতে।

    ও মেয়ে, শোনো।

    বাসনের পাঁজা থেকে উদ্ভ্রান্ত মুখটা তুলে সে ওপরে তাকায়। কতো বয়েস এর? উনিশ, কুড়ি? কাঁধের হাড়গুলো বেরিয়ে, চোখের নিচে কালি। আধভেজা নাইটির মধ্যে রোগা শরীরে শুধু দুটো মস্ত বুক বলে দ্যায়, ও মা।

    আস্তে আস্তে বলি , অত বকে না। ছোটো মেয়ে তো। অত বোঝে না। অমন করে বলতে নেই। তুমি মা তো।

    মেয়েটা, না বৌটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ভ্যাঁক করে কেঁদে ফ্যালে। নাইটির খুঁটে চোখ মুছতে থাকে। আমি একটু সরে আসি। সঙ্কোচে, অস্বস্তিতে। প্রাপ্তবয়স্কদের কাঁদতে দেখতে আমি অভ্যস্ত নই।
    কিন্তু এই মেয়েটাও তো ছোটো। মা, কিন্তু ছোটো তো। বুকের ভেতরটা কেমন করে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন