এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বেশ্যাদ্বার

    Prosenjit Bose লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২১ নভেম্বর ২০১৭ | ২৫৭২ বার পঠিত
  • বেশ্যাদ্বার (প্রথম পর্ব)
    প্রসেনজিৎ বসু

    রামচন্দ্র দুর্গাপুজো করছেন। রাবণবধের জন্য। বানরসেনা নানা জায়গা থেকে পুজোর বিপুল সামগ্রী জোগাড় করে এনেছে। রঘুবীর পুজো শুরু করেছেন। ষষ্ঠীর বোধন হয়ে গেছে। চলছে সপ্তমীর মহাস্নান। দেবীস্বরূপা সুসজ্জিতা নবপত্রিকাকে একেকটি মন্ত্রে একেকটি দ্রব্য দিয়ে স্নান করাচ্ছেন রাম। নদীজলে, শঙ্খজলে, গঙ্গাজলে স্নান হল। উষ্ণজলে, গন্ধজলে, শুদ্ধজলে স্নান হল। কুশজলে, পুষ্পজলে, ফলজলে স্নান হল। শিশিরজলে, সাগরজলে,ওষধিজলে স্নান হল। তীর্থজলে, বৃষ্টিজলে, ঝর্ণাজলে স্নান হল। দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-মধু-ইক্ষুরসে স্নান হল। তিলতৈলে-বিষ্ণুতৈলে স্নান হল। সুস্নাতা সানন্দা নবপত্রিকার প্রতি অঙ্গ থেকে স্নিগ্ধ বিভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ব্রহ্মাপুত্র জাম্ভুবান বললেন, "সুলক্ষণ রঘুনাথ। দেবী প্রসন্না হচ্ছেন।"

    মৃত্তিকাস্নান আরম্ভ হল। রাজদ্বার মৃত্তিকা ও চতুষ্পথ মৃত্তিকা-মিশ্রিত জলে দেবী নির্মলা হলেন। বিমলা হলেন বৃষশৃঙ্গ ও হস্তীদন্ত মৃত্তিকার জলে। গঙ্গামৃত্তিকা ও উভয়কূল মৃত্তিকার জলে দেবী হলেন উজ্জ্বলা। শীতলা হলেন তীর্থমৃত্তিকার জলে। আরও কয়েকটি উপচারে স্নান করিয়ে রঘুনাথ থামলেন। বললেন, "মহাস্নান শেষ। অতঃপর পত্রীপ্রবেশ ও চক্ষুর্দান।"

    বানরসেনার মধ্যে থেকেই কে-একজন মৃদুস্বরে ডাকল, "প্রভু, পত্রিকাটি যেন কেমন একটু..."। সবার দৃষ্টি ফিরল নবপত্রিকার দিকে। দেখা গেল, কদলীবৃক্ষের সজীব সতেজ পত্রগুলি অকস্মাৎ বিশুষ্ক হতে আরম্ভ করেছে। কয়েক নিমেষের ব্যবধানে এ কী বিপর্যয় ! রাম সপ্রশ্ন চোখে জাম্বুবানের দিকে চাইলেন। চিন্তান্বিত জাম্বুবান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, "কুলক্ষণ রঘুনাথ। পূজায় কোনও অঙ্গহানি হয়েছে।"

    সকলের মধ্যে উদ্বেগের মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। অঙ্গহানি ! সে যে বড় ভয়ানক ! অনুকূল হওয়ার বদলে দেবী আরও প্রতিকূল হয়ে উঠবেন। রাবণবধের দুরাশা কোনওদিনই বাস্তবায়িত হবে না। "কী অঙ্গহানি হল মহাত্মন জাম্বুবান ?" রামের এই প্রশ্ন আসলে একা রামের নয়, উপস্থিত সকলেরই। জাম্বুবান ভাল করে চোখ চালিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "রঘুনন্দন ! দেবীর মহাস্নানে আপনি বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা অর্পণ করেছেন কি ?"

    যা ছিল গুঞ্জন, তা কোলাহলের রূপ নিল। অনেকেই এই উপচারটির কথা জানত না। তারা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। যারা জানত, যেমনটা জানত, তারা তেমনটা অন্যদের বলতে লাগল। শুনে কারুর কৌতুক হল, কারুর ঘৃণা, কারুর লজ্জা, কারুর কৌতূহল। রাম বিব্রত মুখে বললেন, "যথার্থ আশংকা আপনার, ব্রহ্মাপুত্র জাম্বুবান। সত্যিই তো ! বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা দ্বারা দেবীর স্নান তো আমি করাইনি ! হনুমান ! উপচার-সংগ্রহের প্রধান দায়িত্ব ছিল তোমার। এই দ্রব্যটি কোথায় রেখেছ, শীঘ্র বলো।"

    মহাবীর মারুতি জোড়হস্তে এগিয়ে এলেন। বললেন, "প্রভু, দেবীসেবার যে-সকল উপচার লঙ্কায় উপলব্ধ ছিল না, সেগুলির সবই আমি জোগাড় করে এনেছিলাম। এইটি আনিনি দুটি কারণে। প্রথমত, আমি ব্রহ্মচারী। পতিতালয়ে গমন, তা সে যে উদ্দেশ্যেই হোক, আমার পক্ষে অনুচিত। দ্বিতীয়ত, আমি ভেবেছিলাম, এটি লঙ্কাতেই পাওয়া যাবে। নগর যখন আছে, নগরনটী গণিকা কি সেখানে থাকবে না ? এই ভেবেই ওটি আনিনি।"

    দেখা গেল, ঐ মৃত্তিকা কেউই আনেনি। রাম স্পষ্টত বিরক্ত হলেন। বললেন, "যাও। এক্ষুনি লঙ্কার বেশ্যাগৃহ থেকে মৃত্তিকা নিয়ে এসো। শীঘ্র।" আপনা হতেই সবার চোখ ঘুরে গেল বিভীষণের দিকে। লঙ্কার কোন স্থানে গণিকালয় রয়েছে, তা বানরদের জানার কথা নয়। বিভীষণই সহায়। কিন্তু তার মুখে যে দুশ্চিন্তার আঁধার ! কম্পিত কণ্ঠে তিনি বললেন, "প্রভু ! মার্জনা। লঙ্কা নগরীতে তো কোনও বেশ্যাগৃহ নেই ! না প্রভু, বিস্মিত হবেন না। দেখুন, রাক্ষসগণ রাক্ষসমতে বিবাহে অভ্যস্ত। অর্থাৎ মনোমত নারীকে প্রয়োজনে বলপূর্বক হরণ করে তারা স্বচ্ছন্দে বিবাহ করে। লঙ্কেশ্বর রাবণ নিজেও সেই মতানুসারেই জনকনন্দিনীকে হরণের স্পর্ধা দেখিয়েছেন। ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনও নারীকেই বলপূর্বক বিবাহ বা সম্ভোগ করার অধিকার থাকায় রাক্ষসগণ বেশ্যাগমনের প্রয়োজন কখনও অনুভব করেনি। লঙ্কা তাই গণিকাশূন্যা, প্রভু।"

    রামের দুর্ভাবনা ঘনীভূত হওয়ার আগেই কথা বলে উঠলেন হনুমান, তাঁর চিরাভ্যস্ত অকুতোভয় স্বরে। "আমাকে অনুমতি দিন প্রভু।সাগরলঙ্ঘন করে আমি সেই মৃত্তিকা এনে দিচ্ছি। আপনার সেবার জন্য না-হয় বেশ্যাগৃহ গমনের অনাচারটুকুও করব।"

    রাম আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ ! তৎক্ষণাৎ শোনা গেল জাম্বুবানের খেদোক্তি। "না হনুমান। এখন আর তা সম্ভব নয়।" "কেন ঋক্ষরাজ ! কেন অসম্ভব ?" প্রায় একই বাক্য একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় রাম ও হনুমানের মুখে।

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২১ নভেম্বর ২০১৭ | ২৫৭২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    সতী - Prosenjit Bose
    আরও পড়ুন
    সতী - Prosenjit Bose
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • debu | 180.213.19.227 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:২১59948
  • অপুর্ব
  • সুতপা | 57.11.11.226 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১৮59949
  • মনোগ্রাহী। পরের পর্ব পড়ার অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।
  • AS | 53.251.175.223 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:০৬59952
  • ভালো লাগল । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
  • R2H | 233.186.252.131 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:২০59953
  • রাবণ এই পুজোর পুরোহিত ছিলেন এমন একটা কিছু আছে - সেই হিসেবে রাবণের প্রসঙ্গ।
    কোন ভার্শনে সেসব জানিনা।
  • Arindam | 213.132.214.86 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:২৬59950
  • বেশ বেশ। কিন্তুক একটি কোস্নো - " লঙ্কেশ্বর রাবণ নিজেও সেই মতানুসারেই জনকনন্দিনীকে হরণের স্পর্ধা দেখিয়েছেন।" - বিভীষণ এই কথা কি রাবণের সামনেই বল্লেন? ইয়ে মানে এই ভার্সানে কি রাবণ অকালবোধনের পুরোহিত নন ?
  • শঙ্খ | 52.110.194.44 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:৩৪59951
  • দারুণ!
    অরিন্দমের প্রশ্নের উত্তরে, প্রথম লাইন বলছে পুজো করছেন রাম। রাবণ পিকচারে এলেন কোথায়?
  • pi | 24.139.221.129 (*) | ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৫২59954
  • পরের পর্ব কই ?
  • Arindam | 213.132.214.86 (*) | ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০১:০১59955
  • বারে! নিজে পুজো করলে ও পুরোহিত থাকতে দোষ কোথায়। ও সব এই পোড়া বাংলায় হয়। রাম উত্তর ভারতীয় কি না, ওখানে পুরোহিত যজমানকেও পুজোয় involve করেন, অন্যভাবে বলতে গেলে পুজোয় খটোমটো মন্ত্র পড়তে সাহায্য করেন। ঃ)
  • রুখসানা কাজল | 37.147.204.250 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:৩৬59958
  • দারুণ দারুণ। পরের পর্ব কিছুতেই মিস করতে চাইনে।
  • Blank | 213.132.214.84 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৯:২৩59956
  • খটোমটো মন্ত্র যে পড়ে সে যজমান নয়, তাকে বলে তন্ত্রধারী।
  • Arindam | 213.132.214.87 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৯:৫৪59957
  • ঐ যে বল্লুম , ও সব এই পোড়া বাঙ্গলায় হয় ! ঊত্তর ভারতীয়েরা রীতিমতন পুজোপাটা করেন পুরোহিতের সাহায্যে । তবে থাক, এই তুশ্চু বিষয় নিয়ে আর তক্কো করব না, রসভঙ্গ হবে ঃ)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন