এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • দক্ষিণের কড়চা

    Parthasarathi Giri লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০২ আগস্ট ২০১৮ | ১৬৪৪ বার পঠিত
  • দক্ষিণের কড়চা

    যদি ভাবো জবালা মেঘ সঞ্চরমান, তবে চোখ মুছে ফ্যালো ঘাসে, নদীঘাটের শরবনে।
    যদি ভাবো জবালার কোলে জল, তবে চোখ মেলে দ্যাখো এই পূর্বাশা অন্তরীপ। এখন ঘন আলকাতরায় লেপে গেছে আকাশের মনস্তাপ।

    মনস্তাপই তো। সাড়ে তেরো মাইল দূরে শেষ বাস এসে থেমে যায় তেলোর চকে। তারপর পায়ে হেঁটে রোজ জবা কাঁকড়ার ঝোড়া নিয়ে বাড়ি ফেরে, ফিরতে ফিরতে যেদিন তার ঋতুঃক্ষরণ হয়, মাতুয়া খালের জলে থাই ধুয়ে ছেঁড়া ন্যাকড়া পরে নেয়। কোমরের ঘুনসিতে মাদুলির মধ্যে হাড়গিলের হাড় নড়ে ওঠে। ধনেশ পাখির বিরল ঠোঁটের জীবাশ্ম বলে গুছিয়ে গেছিল গাঙপারের ক্ষুদি। ক্ষুদিরাম হেলা।

    ক্ষুদি বলে গিয়েছিল, নাভির ডানদিকে যেন ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে, তবে মাসিক রেগুলার হবে, পেটে যন্তন্না কম হবে। দখিন-ঘেঁষা তেমুখী জলার ঝিরিঝিরি জলে যে রাতে চাঁদের সর্বাধিক আলো চিকাবে, সে-রাতের ঠকঠকিতে পেট বাঁধবেই বাঁধবে।

    তেলোর চকের আড়তের পাল্লায় সের সের মাতলার কাঁকড়া জবা বেচে ফেলল বছরের রোদে জলে শীতে, পেট বাঁধেনি। নীলামের পর ভোরে বাড়ি ফেরার সময় তার মন বড় উইউই করে। শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জবার বড় দিগদারি লাগে। গলার কাছে কাঁকড়া খলবল করে। দূরের এককোণে বিভূতি ধুয়ে যাওয়া এক চাপড়া ঘাসের দিকে তার চোখ যাবেই যাবে। ওখানে যেন কারা শুয়ে আছে ছাইয়ের ওপর।

    জবার ভাতার ছিল নেতাই বরা। নেতাই আন্ত্রিকে মরেছে গত চার সন আগে এক ভোরে। সেই মৃত্যুও যেন একটা কাঁকড়ার মতো জলের খোঁদলে জবার হাতের লোহার শিকের খুঁজে ফেরার ডগা ছুঁয়ে দিয়েছিল।

    ঘন্টা তিনেক ধরে ল্যাঙটের মতো গামছা পরে উন্মুক্ত উর্ধাঙ্গে ক্ষুদি একটা গরান গাছ কাটছিল দাহ কার্যের তদবিদে। জবা এখন স্থির। জবার ঠোঁটের কোণে শ্যাওলার মতো সবজে সবজে কিছু। হাসির মতো মনে হতে পারে কিংবা শরের ছেঁড়া পাতা। জবা বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল।

    ভোর কামড়ে ধরেছে মাটির দাওয়ায় শোয়ানো নেতাইয়ের নিথর বুকের দাঁড় ডালপালা জড়ুল। গত সপ্তাভর ধুতুরার বিচি বেটে খাওয়ানো অন্ত্র গলে গলে অবিরল শোণিতস্নাত দাস্ত শেষে এখন শবের নাভিতে ভোর জিভ বোলায়। লোকে জেনেছিল আন্ত্রিক। নেতাই পোড়ার সময় লোকে বলেছিল, "হাগি হাগি শরীলটায় কিছো নাই। শোয়া ঘন্টায় আগুন নিভাতে লাগবে।"

    ক্ষুদি গরানের শেষ লগটার ধড় কুড়ালের এক বাঘা ঘায়ে ফালা করে ফেলে একটু মুচকি হেসেছিল।

    "জবা, তেমুখীর চরে পুন্নিমেতে ন্যাংটো করব তোকে।"

    সহসা লোনাজলে ভুস করে ভেসে উঠেছে অচিন শুশুকের তলপেট। তলপেটে একটি লন্ঠন, একটি নষ্ট ভ্রুণ এবং একটি গোখরোর দাঁত।

    ক্ষুদির খোলা পিঠ থেকে শরের পাতার পরে গড়ানো শিশিরের মতো ঘাম গড়াচ্ছে। গোটা একটা গরান গাছকে ভূতলশায়ী করে ফালা ফালা করার উদ্গত বাসনার প্রবল লাবডুব এবং পাগল ক্ষুধার উদর। পোড়া লংকাসহ এক তিজেল পান্তা পোড়া সপাসপ উড়ে যাবে।

    কিছু যেন অস্থির আচ্ছন্ন জবা দাওয়া থেকে নেমে ধানসেদ্ধ করার বড় তিজেলে মাথা ঠুকে বসেছিল। এতক্ষণ একটানা কাঠ কাটার ঠক ঠক ঠক ঠক শব্দ শুনছিল। তার তন্দ্রা এসে এসে কাটে বারবার। কানের ফোকরে উদলা বাতাস ফসফস ফিসফিস করে। কে বারবার নেতাইয়ের পান্তায় অল্প অল্প ধুতুরার বিচি বেটে মেশাত? কে? কে সে? কোন সে উতলপক্ষ ধনেশের হাড়? কোন সে রাতের জলের টিকায় টিকায় লাফানো চাঁদের প্রেত?

    কুহক রাতে ট্যাঁ ট্যাঁ করে হাড়গিলের ছানা ডেকে উঠত অশ্বত্থের মাথায়। যেন স্তনের বোঁটায় ঠোঁট রেখে দুগ্ধখেলার শিশু হঠাৎ দেয়ালায় মুখর, স্ফুট-অস্ফুট ভেসে আসে গাঙের হাওয়ায়। উঠানের বেড়ার আগল নড়ে ওঠে। আনবাতাস? কে ওখানে? নাকি অতৃপ্ত ব্যাঘ্রের ভূত? কেবল থাই ভিজে যায় মাসান্তে, ভিজবেই। ন্যাকড়া দিয়ে যেন ঠেসে ধরতে ইচ্ছে করে জবার। দূর হ হারামি রক্তধারাস্রোত। কেন হাড়গিলে ঠুকে যায় না পেটে? কেন হাড় পালক ঠোঁট ঢুকে বাসা বাঁধে না?
    শন শন বাতাসে ট্যাঁ ট্যাঁ ক্রোঁ ক্রোঁ। এবং বেড়ার পাশে একটি মানুষের সিল্যুয়েট অবয়ব।

    ক্রমে ক্রমে আকাশের তলপেটে আলো নড়ছে ধীরে ধীরে। উঠানের শবে একটি দুটি তিনটি ভনভনে মাছি। তাকে ঘিরে আছে পুরীষের পাতলা দুর্বাস। আলো এসে নেতাইয়ের হাঁ মুখে লাফাল বারেক। জবা চোখ চেয়ে দেখল। আলো নেতাইয়ের বুকে লটকাচ্ছে মাতলার জলের অতর্কিত ঘূর্ণিতে বন বন ডিঙিপাকের মতো। মধ্যাঙ্গে এক চিলতে গামছার নিচে শীর্ণ পুরাতন ব্যর্থ শীতলষষ্ঠী। প্রলম্ব হাতের পায়ের আঙুলে নদীর দাগ। বনবেড়ালের থাবার মতো আলো দাগে দাগে জমাট।

    জবা মাতলার জলে তারা খসার প্রতিবিম্বিত তিরের মতো ছিটকে উঠল ক্ষুদির কথা শুনে। তার বুকের জনতা শাড়ির মায়া খসে গেল মাটিতে। উদলা বুকে ঝুলছে দুটো সুদৃশ্য কাঁকড়া। মিটিমিটি বোতামের মতো চক্ষু কাঁকড়া দ্বয়ের। ক্ষুদি নিঃশব্দে বসনহীন জবাকে দেখে দাঁত খুটছিল। উঠানের শবের গা থেকে আলো পিছলে ফিরে যাচ্ছিল ক্ষুদির গুড়াকু-সেবিত আধমুক্ত কালচে বাদামী দাঁতের সারির দিকে। আলো পিছলায় আলো দাঁড়ায়। আলো হাঁটছে কিসের মতো যেন। আলো হাঁটছে। যেন হাড়গিলে। যেন শিশু। যেন হাড়গিলের শিশু। যেন টলমল পায়ে নেতাইয়ের কাটামুন্ড। যেন ছোট্ট ছোট্ট হাতে পায়ে টলমল টলমল ক্ষুদ্র থেকে আরো ক্ষুদ্র হতে চাওয়া কতদিনের পুরাতন একটি শিশু।

    আলো পিছু ফিরে তাকাল। পিছে তার সমগ্র পুর্বাশা অন্তরীপ সোনার মুকুটের মতো আধোজাগরিত।

    কুড়ালটা পলকে স্যাঁৎ করে উড়ে এল ক্ষুদির উন্মুক্ত কৃষ্ণবর্ণ দাঁতের সারির দিকে। গলার আধাআধি ভেদ করে বেরিয়েও গেল।

    জবার খোলা বুকে এখন আলো হাঁটছে শিশুর মতো টলমল টলমল। কর্কটে অরুণাংশুতে এখন শিশুখেলা হচ্ছে। ট্যাঁ ট্যাঁ ক্রোঁ ক্রোঁ চ্রিঁ চ্রিঁ। জবার বুক এখন নেতাইয়ের শবের মতো উদাসীন ভোর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০২ আগস্ট ২০১৮ | ১৬৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 670112.51.1223.191 (*) | ০৪ আগস্ট ২০১৮ ০৩:৪১63805
  • কী ভয়ংকর লেখা।

    পড়তে পড়তে গা ছম ছম করে
  • | 670112.210.9003412.174 (*) | ০৪ আগস্ট ২০১৮ ০৪:৩৮63806
  • সাংঘাতিক
  • b | 4512.139.6790012.6 (*) | ০৫ আগস্ট ২০১৮ ০৬:৪৯63807
  • শেষ লাইনটা। উফ।
  • শাক্যজিৎ | 2345.110.234512.184 (*) | ০৭ আগস্ট ২০১৮ ০৩:১৪63808
  • অদ্ভুত লেখা। জাস্ট অদ্ভুত !
  • Abhishek Sharma | 237812.68.454512.84 (*) | ১৪ আগস্ট ২০১৯ ১০:০৫63809
  • nice
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন