এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রক্তকরবী, অল্প কথায়

    রুকু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | ৯২৪ বার পঠিত
  • মানুষের স্বতস্ফুর্ততা যখন মরে যায় তখন যন্ত্রে আর মানুষে তফাত থাকে কই! একটা ঘোর মেক্যানিক্যাল সিস্টেমের মধ্যে আবর্তিত হয় তার দৈনিক যাপন, বাকি সমাজের সাথে সম্পর্ক হয় অ্যালগোরিদিমিক্যাল। কাজের সূত্রে সে কথা বলে আবার ঢুকে যায় নিজের মৃত চামড়ার খোলসে।
    ঠিক যেন এই মানুষ গুলোর মতই শিলঙের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন লোহার বিমের তলায় থেঁতলে থাকা টকটকে লাল করবী ফুল সহ ডাল। আবার এই মানুষদের মধ্যে কিছু মানুষ থেকে যায় যারা অপ্রেশানের মধ্যেও মাথা তুলে শ্বাস নেয়, ঐ ডালের মধ্যেই কিছু ফুলের মত, যারা ঐ লোহার বিমের থেঁতলে দেওয়া অত্যাচার সয়েও মুখ তুলেছিলো আকাশের দিকে। ঠিক এই দৃশ্যপট ডেকে আনে সেই কল্পনা কে , যার সাথে সমাজ আর অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের ড্রিম প্লের ভাবধারা মিলে তৈরি হয় বিখ্যাত সাঙ্কেতিক নাটক রক্ত করবী।
    ১৩৩০ সালে যক্ষপুরী শিরোনামে লেখা হলেও, ১৩৩১ সালে প্রবাসীতে প্রকাশের সময় এর নাম হয় রক্তকরবী।
    মানুষের তুমুল লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক অধিকারকে অস্বীকার করে মানুষকে যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করেছে এবং এর ফলে তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কিভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার প্রতিফলন ঘটেছে এ নাটকটিতে। যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ; তার অর্থলোভ দুর্দম, অর্থলোভ না, স্বর্নলোভ আসলে। তার সে লোভের আগুনে পুড়ে মরে সোনার খনির কুলিরা। রাজার দৃষ্টিতে কুলিরা মানুষ নয় তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্র, তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র, যন্ত্রকাঠামোর ক্ষুদ্র অঙ্গ , মানুষ হিসেবে তাদের না আছে কোনো মূল্য না আছে কোনো অধিকার। জীবনের প্রকাশ যক্ষপুরীতে নেই।একমাত্র আছে নন্দিনী আর বিশু পাগল প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক ও তার উপাসক। এ নন্দিনীর আনন্দস্পর্শ যক্ষপুরীর রাজা পাননি তাঁর লোভের মোহে, সন্ন্যাসী পাননি তাঁর ধর্মসংস্কারের মোহে, মজুররা পায়নি অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে, পন্ডিত পায়নি দাসত্বের মোহে। নন্দিনী অপেক্ষায় শুধু রঞ্জনের, রঞ্জন আনবে মুক্তি। কিন্তু রঞ্জন যে নিজেই যন্ত্রের শিকলে বাঁধা হয়ে গেছে। এইভাবে এগিয়ে যায় রক্তকরবীর কাহিনী।
    রক্তকরবী নিয়ে ভাবলেই একটা গানের দুই লাইন মনে আসে আমার;
    “মরি উপায় কি বলো না,
    মরার দেশে ভালো লাগে না।“
    অরূপ রাহী
    এই “মরা” কথাটি রাহী ব্যবহার করেছেন পুঁজি অর্থে, পুঁজি বাদী সমাজের কাঠামো যা। এর কারণ, পুঁজি হলো মানুষের মৃত শ্রম। শ্রমকে ইনপুট ধরলে তার উৎপাদিত বিষয় বা ফসল হলো আউটপুট। ইনপুটের সাথে সম্পর্ক থাকলেও আউটপুটের সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা জমা হয় ওপর তলায়। নিজের সাথে অসম্পর্কে শ্রমের উৎপাদনকে জড়িয়ে ফেলেছে মানবসমাজ।
    মার্ক্স কথিত সাধারণ মজুরীর সংজ্ঞায়, “সাধারণ মজুরী সেই নিম্নদর যা সাধারণ মানবতার সাথে, মানে জন্তু জানোয়ারের মত টিকে থাকার সাথে খাপ খায়।“ (ইকোনোমিক্স অ্যান্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট), কিন্তু যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা( যা এই নাটকে যক্ষপুরী) এই সব নির্ধারণ করছে টা কিন্তু মানুষের সাথে জন্তু জানোয়ারকে গুলিয়ে ফেলেনি, অতি সুক্ষ্ম সুতোর মত স্পেসে সে ঝুলিয়ে রেখেছে আমোদ প্রামোদ আর মানসিক শান্তির কিছু ব্যবস্থা। ঐ যে নাটকে মদের কারখানা আর গোঁসাই ঠাকুরের আগমন!
    মনের মদের নাগাল না দেওয়ার জন্য নেশার মদের যোগান তো বেশি দিতেই হবে, তাই না।
    এই মদ গোঁসাইয়ের বানী ইত্যাদি দিয়ে রাষ্ট্র যন্ত্র বেশ এক খানা উদারতাবাদের ধ্বজা তুলে রেখেছে। ভাবখানা এমন, ফেলো কড়ি, মাখো তেল। আমোদ করো, বিনময়ে শ্রম দাও হে! উদারতার আড়ালে ফ্যাসিবাদের কর্মশালা।

    এসব চালু রাখার জন্য দরকার ক্ষমতা, একটা ব্যবস্থা যা বেকায়দায় চাবুক মেরে শাসন করবে, আবার মদের যোগানও দেবে। দেবতাকে যুগপৎ ভয় ও শান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করবে।
    এই ক্ষমতা কি?
    আদি না অনাদি সেই সময় সূচক প্রশ্নে না দিয়ে মোটা চোখেই দেখা যাক, ক্ষমতা আসলে দুই প্রকারঃ
    ১। বর্তমান ব্যবস্থাকে বহাল রাখার ক্ষমতা
    ২। বিরুদ্ধ ক্ষমতা
    বিরুদ্ধ ক্ষমতা আসলেই বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, বিশুদ্ধ ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সাধারণ মানুষের অধিকারকে। এখানে বলে রাখা ভালো কাঁটাকে তুলতে যেমন কাঁটা বা চিমটির প্রয়োজন হয়,তেমনি রাষ্ট্র অনুমোদিত ক্ষমতাকে তুলতে আরেকটি ক্ষমতার প্রয়োগই চাই, ক্ষমতা শুনে নাক সিঁটকালে চলবে না, সে রোম্যান্টিসিজম কোনোকালেই ছিলো না!
    তো এই বিরুদ্ধ ক্ষমতার স্বতস্ফূর্ততা নিয়ে এসেছে নন্দিনী, তার রঞ্জনের পথ চাওয়া আর বিশু পাগলের গান, প্রত্যেক সংলাপে খুঁজতে চাওয়া হয়েছে অধ্যাপক আসল কিসে ভয় পাচ্ছেন। মানুষ যখন মানুষে ফিরতে চায়, মান আর হুঁশের অধিকার চায়, তখনি অমানুষ বানানোর কারবারীদের সঙ্গে তার সংঘাত আসবেই।
    এ একপ্রকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অনুভূতি, যা দেখানোর জন্যই নাটক টি প্রাসঙ্গিক।
    মানুষের সাথে মানুষের আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই , এরকম অসম্পর্কের দর্শনের ওপর বসে চলুন রঞ্জনের আসার দিকে চাওয়া যাক, ধুলোর আলো সরিয়ে সুর্যালোকের অপেক্ষা নামে…

    “It is night: now do all leaping fountains speak louder. And my soul too is a leaping fountain.

    It is night: only now do all songs of lovers awaken. And my soul too is the song of a lover.

    Something unquenched, unquenchable, is in me, that wants to speak out. A craving for love is in me, that itself speaks the language of love. Light am I: ah, that I were night! But this is my solitude, that I am girded round with light!”
    Friedrich Nietzsche
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | ৯২৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    A room for Two - রুকু
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 192.66.21.55 (*) | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:৫৯64258
  • হুম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন