এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কুহু কেকা ডাকে

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ | ৮৪২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নিমো গ্রামের বাকি ছেলেদের মতন আমারও হৃদয়ে আপন করে নেবার ক্ষমতা ভালোই ছিল। কিন্তু একটা জিনিস বাদ দিয়ে, আর সেটা আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম – সেগুলি ছিল সো কলড্‌ প্রফেশ্যানাল লাইফে ‘সফট স্কিল’ জাতীয় ট্রেনিং। আগে এমন ট্রেনিং-এর শুরুতে বেশ ফালতু টাইপের জিনিস পত্র করতে হত – এখন তা আবার ‘সফট’ থেকে ডিফিউজ করে হার্ডকোর টেকনিক্যাল ট্রেনিংতেও ঢুকে গেছে। মাঝে মাঝে তাকে বলা হয় – ‘আইস ব্রেকিং’। আরে ভাই যদি বুঝতে, এই আইস ব্রেক হবার নয় – পুরো হিমবাহ স্বরূপ শীতলতা জমা আছে আমার বুকে।

    বিশাল কিছু অ্যাম্বিশ্যান নিয়ে আমি খেলতে নামি নি – বাপের অ্যাডভাইস ছিল, সৎপথে থাকার চেষ্টা করতে। সেই চেষ্টা মোটামুটি বজায় রাখতে পেরেছি জ্ঞানত। তবে বাপের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইস থেকে একটু বিচ্যুত হয়েছি – তাই নিয়ে মাঝে মাঝে মরমে মরে থাকি। বাপ আমাকে বার বার বলেছিল, টাকা থাকবে পোষ্ট অপিস, স্টেট ব্যাঙ্ক, কিষাণ বিকাশ পত্র আর এল আই সি – এই চার ভাগে ভাগ হয়ে। প্রথম চাকুরী করতে গিয়ে এইচ ডি এফ সি ব্যাঙ্কে স্যালারী অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল – সেই নিয়ে বাপের যা চিন্তা ছিল, আলুর দাম নিয়েও বাপকে কোনদিন অত ভাবতে দেখি নি। ইদানিং আবার আই সি আই সি আই ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি, আমার সেই অধঃপতন দেখা যাবার জন্য বাবা আজ আর বেঁচে নেই। সরকারী চাকুরী পাওয়া ছিল বেঞ্চ মার্ক – ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে সেই মার্ক আমি ক্রশ করে ফেলেছি, ধাতুবিদ্যা কি জিনিস তা দিয়ে বাপকে চিরকাল ধোঁয়াশায় রেখে। বাপকে একবার উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, বললাম, “ধাতুবিদ্যা এক প্রাচীন ইঞ্জিনিয়ারিং – ওই যে দিল্লীর লৌহস্তম্ভ দ্যাখো, সেটা সেযুগের ধাতুবিদ ইঞ্জিনিয়াররা বানিয়েছিল”। বাপের পালটা প্রশ্ন এল, “তাহলে তোর আর কামারদের নেউল-এর মধ্যে পার্থক্য কি”। আমি চেপে গেলাম -

    পিওর চাষার ছেলে হিসাবে বিশাল কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই – আর বলতে কি, তেমন এলেমও নেই। ‘স্ট্যাটিসস্টিক্যালি স্পিকিং’ বলা ছাড়া স্ট্যাটিস্টিকস নিয়েও যেমন আমার কোন জ্ঞান নেই। আমার অবস্থা ভারতীয় ক্রীড়াবিদ-দের অলিম্পিকে অংশ গ্রহণের মত। এক্সপেটেশন এতই কম যে, যা করি তাতেই ওভার-অ্যাচিভ হয়ে যায়! মাঝে মাঝে যদি কোম্পানিতে ম্যানেজার বলে, “তোমার মধ্যে পোটেনশিয়াল আছে” – আমার খুব চাপ আসে। অনেক বাড়তি কথা ও পরিশ্রম করতে হয় এটা প্রমাণের জন্য যে আমার কিস্যু পোটেনশিয়াল নেই – ওটা তেনার ইল্যুউশন। কিন্তু ওই যে, তেল ইন্ডাষ্ট্রি হল গিয়ে মোটামুটি রিলেটিভ অশিক্ষিত দ্বারা ভর্তি। প্রচুর অন্ধের মাঝে আমি কানা - তাই চাইলেও নিস্তার নেই, আমাকে যেতে হয় তেমন কিছু অদ্ভূত ট্রেনিং-এ। নিজেকে নন-টেকনিক্যালি আপডেট করতে। আমি আবার এখন ম্যানেজার! বারো-চোদ্দ নাকি আরো বেশী মিলিয়ন ইউ এস ডি ধরিয়ে দিয়ে রিসার্চ করতে করতে হবে এমন কিছু দাবী করছে। আমি ম্যানেজার হিসাবে প্রথম যেটা করলাম তা হল, একটা হোয়াস-গ্রুপ খুললাম আমার আন্ডারে থাকার লোকজন দিয়ে। তার মধ্যে আবার এক অসমিয়া আছে, যে বাংলায় লেখা বই পড়ে! আমাকে বলে কি সে নাকি ফেলুদা সব বাংলায় পড়ে ফেলেছে! একদিন জানা গেল সে তরুণ ভাদুড়ীর লেখা ‘চম্বলের দস্যু’ও পড়ে ফেলেছে! সেটা জানার পর আমার কাছে টিম-মিটিং এবং ওই গ্রুপ হোয়াটস্যাপ গ্রুপটার এক অর্থ এল – গ্রুপে দেদার নিজের লেখার লিঙ্কগুলি ফরোয়ার্ড করি এবং টিম মিটিং-য়ে এক নির্ধারিত সময় আমি ব্যোমকেশ নিয়ে ব্যায় করি। সেই আসামী-কে ফেলুদা থেকে উত্তীর্ণ করে ব্যোমেকেশে এনে ফেলাটা আমি ২০১৯ এর নিজের কর্পোরেট টার্গেটে এনে ফেলেছি। মিটিং ছাড়া অনেকটা সময় আমি গুগুল সার্চ করে মেশিন আর ইন্সট্রুমেন্ট কিনি। এই সব বাদ দিয়ে যেটুকু সময় থাকে, তখন আমি ট্রেনিং করি, মানে যেগুলিতে আমাকে ট্রেনিং-য়ে ঠেলেঠুলে পাঠানো হয় আর কি।

    এমন একটি ট্রেনিং-এ প্রথম শুনলাম ছবি এঁকে নাকি নিজের নাম-পরিচয় বোঝাতে হবে! ছবি আঁকতে হবে আমাকে! সেই আমাকে, যার ক্লাস এইটে বায়োলজি অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ব্যাঙ আঁকা হলে, আনোয়ার স্যার ছুটে গিয়ে হেড স্যার-কে ডেকে আনলো। আমার আঁকা জিনিস্টা ব্যাঙ নাকি ঝোপের উপর থেকে চিতা বাঘ ঝাঁপ দেবার জন্য তৈরী হচ্ছে, সেই নিয়ে দুই স্যারের মধ্যে প্রবল আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই আমাকে নিজে এঁকে বোঝানোর চ্যালেঞ্জ দিয়ে যে ট্রেনিং শুরু হয়, তা যে আমি ভালো মনে নেব না, সেটা বলাই বাহুল্য ছিল! ট্রেনিং-এর শুরু গুলি ক্রমশঃ ফালতু থেকে ফালতু তর হতে থাকল। এমনি একবার আমাদের জিজ্ঞেস করা হল – বিশাল চমকে দিয়েছে বা অবিশাস্য হয়েছে তোমার নিজের অভিজ্ঞতায় এমন এক ঘটনার উল্লেখ করতে। ট্রেনিং হচ্ছে ‘দি হ্যেগ’ শহরের থেকে কিছু দূরে ‘ডেলফট’ নামক যে আর এক শহর আছে তার পাশে আমাদের কোম্পানির ট্রেনিং সেন্টারে। পাবলিক কি সব একজাম্পেল দিচ্ছে – কেউ বলছে সে নাকি পোলার বিয়ারকে সামনা সামনি পেচ্ছাপ করতে দেখেছে, কেউ বলছে নরওয়ে নাকি ওদিকে ছেলে মেয়েদের চেঞ্জ রুম এক, কেউ বলছে কোথায় আকাশে সবুজ টাইপের লাইট দেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবছি বলব কিনা যে আমাকে চমকে দিচ্ছে একরুমে এত চমকিত ঘটনার মুখোমুখি হওয়া পাবলিকের সাথে বসে থাকাটাই!

    নানা দেশের পাবলিক, ভারত থেকে এসেছে এক সিনিয়ার এমপ্লয়ী – সারা জীবন ভারতীয় কোম্পানীতে কাজ করে এই শেষ বেলায় ঢুকেছেন মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীতে। এই দুই-য়ের মিশ্রণ কি যে জটিল জিনিস, তা কেবল যাঁরা অনুভব করেছেন তারাই বলতে পারবেন। তবে সেই ভদ্রলোকের চমকে যাবার ঘটনা একমাত্র আমার রিয়্যালিটির কাছাকাছি এল – তিনি সরল মনে বললেন যে, “১৯৮৩ সালের ফাইন্যালটা যে আমরা জিতব এটাই আমার কাছে অবিশাস্য ছিল”! ট্রেনিং রুকে গেল – ১৯৮৩ সালে কি ফাইন্যাল সেটা বোঝাতে হল। আসতে আসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে বলার পালা – আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। আমার জীবনে বিষ্মিত হবার মত ঘটনা খুব একটা ঘটে নি। মানে ওই যে এক লেখক বলেছিলেন না যে সবার মধ্যে বিষ্মিত হবার ক্ষমতা থাকে না। সেটা খুব সত্যি কথা এবং আমি যে কেন কিছুতেই বিষ্মিত হতে পারছি না, তাই নিয়ে দোলচালে ছিলাম। অনেক ভেবে আমি বললাম যে, “মেমারী থেকে যে কোনদিন সিপিএম চলে যাবে, এটা আমার কাছে অবিশাস্য ছিল”। আবার ট্রেনিং রুকে গেল – মমতার নাম উচ্চারিত হল মনে হয় সেই প্রথম ট্রেনিং সেন্টারে।

    ওই ভদ্রলোক বেশ সাদা মনের বলেই মনে হল – ব্রেক হলেই ঘুরে ফিরে আমার কাছে এসে ‘ভাই কোথায় ভারতীয় নিরামিষ পাওয়া যাবে’? আমার সাথে আবার নিরামিষের কোন সম্পর্ক নেই সেটা বোঝাতে গেলে প্রবলেম। কিন্তু ওই যে, উনি তো আর নিমো গ্রামের নন! তাই অ্যাক্সেপ্টেন্স ক্ষমতা নিয়ে স্ট্রাগল দিচ্ছেন।

    নিমো গ্রামের ছেলেদের হৃদয় যে খুবই প্রসারিত এবং উন্মুক্ত তা নিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহই প্রায় ছিল না। নানা মন্তব্য, যেমন “বাপের পয়সায় বসে বসে খাচ্ছিস”, “ অকর্মণ্যের ঢেঁকি সব”, “শিং ভেঙে বাছুরের দলে” ইত্যাদি ইত্যাদি প্রবাদ বাক্য এবং টিম্পনীর সংমিশ্রণ বিভিন্ন সময়ে আমরা শুনে থাকলেও হৃদয় নিয়ে সামাজিক খোঁটা আমাদের কেউ দিতে পারে নি। কেবলমাত্র প্রেমিক প্রেমিকাদের দীর্ঘশ্বাস আমি হিসাবের মধ্যে ধরছি না – কারণ “তোমার কি হৃদয় নেই” এই কঠিন শব্দ সমূহের ব্যবহার আমাদের দিকেও প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত হয়ে গিয়েছিল কালক্রমে।

    যাই হোক, নিমোর ছেলেদের হৃদয়ের গ্রাহ্যতার গুণগান প্রসারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল গ্রামের সমন্ধি এবং শালারা। অর্থাৎ, আমাদের গ্রামের বৌদিদের ভাই বা দাদারা। গ্রামের দিকে নিয়ম মেনেই, সমস্ত পূজা পার্বণে বিয়ের পর পর বাপের বাড়ি থেকে আত্মীয় পরিজন আসার নিয়ম আছে – তা সে নিমোর গাজন বা মনসা পুজো, বা বাঙালীদের স্ট্যান্ডার্ড পার্বন যাই হোক না কেন। তা বৌদিদের ভাই-দাদারা এসে তো আর সারাদিন শাশুড়ির কোলে বসে থাকতে পারে না! তাই তার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার হত নিমো স্টেশন, তার পর স্টেশন সংলগ্ন ক্লাব এবং বাকিটা ইতিহাস। ওই সব সমন্ধি/শালা/কুটুম্বদের নিমোর ছেলেরা এমন আপন করে নিত যে, অনেক উদাহরণ আছে সেই ছেলেরা পরবরর্তী সময়ে নিমোর মেয়েকেই বিয়ে করে ফেলে! তেমন সব বিয়ে প্রবল ভাবেই সামাজিক ছিল – আর এই সব কারণেই নিমো গ্রামে জামাই-দের আগমণ স্ট্যাটিস্টিক্যালি আশেপাশের অন্য গ্রামের তুলনায় অনেক বেশী ছিল।
    মোদ্দা কথা কিছুদিন পরে এমন ঘটনার সামনা সামনি হতে হত, যেখানে সমন্ধিরা গ্রামে এসে ফিরে ঘুরে ফিরে চলে গেল, কিন্তু তার দিদি জানতে পারল না! জানতে পারল না বললে ভুল হবে, জানতে পারত নিম্নরূপে

    -কি বৌমা, কাল ভাইকে কি রান্না করে খাওয়ালে?
    বৌমা পড়লে আকাশ থেকে ওপাড়ার নন্দরাণীর প্রশ্নে!
    -ভাই কোথায় এল জ্যেঠিমা যে তার জন্য রান্না করব?
    -ভাই আসে নি, তবে যে বাবুল বলল তোমার ভাইয়ের সাথে কাল অনেক গল্প করেছে!
    -না জ্যেঠিমা, ভাই তো আসে নি!

    নন্দরাণী ফুঁসছে তাকে মিথ্যেবাদী ইঙ্গিতকরণের জন্য – গজগজ করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে

    -তিপান্ন বছর হল নিমো গ্রামে এসেছি, কিন্তু এমন হুবাহু মিথ্যে কথা বলতে শিখি নি বাপু! এক বছর বিয়ে হয়ে এল না ছুঁড়ি, মুখের উপর মিথ্যে কথা!

    হয়েছে কি, ভাই তো বিকেলের ট্রেনে নেমে ডাইরেক্ট পাপুলের বাইকে করে এ, কে, মণ্ডলের দোকানে মদ কিনতে চলে গিয়েছিল। তার পর রাতের বেলায় নিমো ভারত সেবক সমাজের সরস্বতী ঠাকুর বিসর্জন করে সে রাজুর বাড়িতে শুয়ে পড়ে এবং সকাল বেলা হাওয়া! গোটা আগমণ-প্রস্থানের স্কিডুলে দিদির কোন উল্লেখ নেই! দিদি ফোন লাগালো ভাইকে-

    -তুই কাল নিমো এসেছিলি?
    -এই রে, তুই শুনে ফেলেছিস!
    -একবার এলি না বাড়িতে, কি করে আমি মুখ দেখাবো – রাতে ঠাকুর বিসর্জনের পর আসতে পারতিস
    -তুই কি চাস আমি ওই অবস্থায় তোদের বাড়িতে গিয়ে উঠি! তখন তো আরো মুখ দেখাতে পারবি না রে!

    দিদি গ্যছে এবার দমে – ভাই খাঁটি কথা বলছে। এখন তো নন্দরানী থার্ডপার্টি কিছু বলছে – ওই অবস্থায় ভাইকে দেখলে খোদ শ্বশুর শাশুড়ির কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে! ব্যাপার হল, পূজোর বিসর্জনের জন্য মদ খেয়ে খবর আছে যে ভাই নাকি রাত সাড়ে নটার মধ্যে আউট হয়ে গিয়েছিল। ঠান্ডার মধ্যেও তাকে শিবতলার টিউবওয়েলের তলায় জলের ছেটা দিতে হয়েছে। সামান্য ব্রেক নিয়ে তারপর ভাই রাত একটা পর্যন্ত নেচেছে তাসার সাথে। বলছে বটে রাজুর বাড়িতে শুয়েছিলাম, কিন্তু আদপে পড়েছিল তাদের গোয়ালে চটের বস্তার উপর – জামা ছেঁড়া, সারা গায়ে তেলতেলে সিঁন্দুর লেপ্টানো! এ তো গেল অনেক অনেক বছর আগের কথা – এখন ফেসবুক এসে গিয়ে আর পাড়ার নন্দরাণীদের প্রয়োজন হয় না গ্রামে ভাইয়ের আগমণী জানানোর জন্য। দিদি ভাইয়ের ফেসবুক আপডেট দেখে নিজেকে আপডেট করে মোবাইলে গোঁসা, “ওই তোর ছবির পিছনে ওটা নিমো শিবতলা না? কবে এসেছিলি তুই এখানে!”

    ঘটনা ডাইগ্রেস করে যাচ্ছে – আমি যে ওই বলেছিলাম মেমারী থেকে সিপিএম চলে যাবার ব্যাপারটা, সেটা কিন্তু কোন চমক দেবার জন্য নয়! ২০১৫ সালের আগে আমি তার থেকে অবিশাস্য ব্যাপার চট করে ভেবে বের করতে পারি নি। সে কি যুগ ছিল – কালচারাল মেমারী পুরো কাঁপছে কালচারে কালচারে। ললিত স্যার গ্যাট চুক্তি নিয়ে একক অভিনয় করে ফেলল মেমারী বাসস্ট্যান্ডে – প্রবল গরমের মধ্যে ইস্কুল থেকে পদযাত্রা করে আমাদের গোটা মেমারী ঘোরানো হল সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। রাতের বেলায় আবার নানা একাঙ্ক নাটক বা পূর্ণ নাটকের প্রতিযোগীতা – রেল গেটের এপারে অভিযান সংঘ তো ওপারে ফারবিড ক্লাব। এদিকের রামপুরহাট-বোলপুর থেকে শুরু করে ওদিকে বাঁশদ্রোণী-হুগলীর ভালো ভালো নাটকের দল আসত। সি পি এম আমলে আর যাই হোক কোনদিন দর্শকের অভাব হয় নি নাটকের, স্পেশালি তা যদি কালীতলা পাড়ার পার্টি অফিসের আশীর্বাদধন্য হত।

    মেমারী থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আমাদের নিমোতে একাঙ্ক নাটক হত না – যা হত তাকে বলা হত থিয়েটার, যাত্রা এবং ফাংশান। সারাদিন মাঠের কাজ করে এসে সন্ধ্যেবেলা আঁতলামো মারানোতে কারো ইচ্ছা বা সায় কিছুই ছিল না। যাত্রা পুরানো দিন হতে আমাদের রক্ত মিশে গেলেও, থিয়েটারের জোয়ার আমাদের গ্রামে আনল ঘোষ পাড়ার মেজোদের অরুণদা। বার্ণপুর থেকে অরুণদার গ্রামে ফিরে আসার মত ইমপ্যাক্টফুল রিটার্ণ আমরা তখনও ইতিহাস বইতে পড়ি নি। নিমো ভারত সেবক সমাজে সেই প্রথম গাঁজা ঢুকল। মদের প্রচলন কমে গিয়ে গ্রামের যৌবন বরণ করে নিল গাঁজা। মদের খালি বোতলে ভরা ক্লাব ঘরে আমাদের ছোটদের প্রবেশ মোটামুটি প্রচলিত থাকলেও, গাঁজার গন্ধ আর ধোঁয়ায় ভরা ঘরে প্রবেশ ক্রমশঃ ট্যাবু-র মত হয়ে উঠল। অরুণদা গাঁজা খেয়ে কবিতা লিখতে শুরু করল প্রবলভাবে – এবং সময় পেলেই নাটক। দূর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নিমো শিবতলায় সাহিত্য সভায় অরুণদার “শূয়োর” সিরিজের কবিতাপাঠ নিয়ম হয়ে উঠল। উৎপল ‘পুরী” সিরিজের জন্য বাহবা পেলেও অরুণদার “শূয়োর” সিরিজ এখনও পেন্ডিং আছে – ভবিষ্যৎ বলবে হয়ত।

    অরুণদার নাটকে বরুণদা জাদু বিস্তার করতে লাগল তার অভিনয়ে। ভাইয়ের জন্য চমকপ্রদ সব ডায়লগ লিখতে তোলপাড় ফেলে দিল অরুনদা। একদিন পরে স্বীকার করতে বাধা নেই যে বরুনদা অভিনয় ভালোই করত – কিন্তু তার চেহারা তাকে সহযোগিতা দেয় নি। একে তো রোগা, তার পরে গাঁজা খেয়ে খেয়ে শরীরে আর কিছু নেই। কথায় বলে গাঁজাখোর – কিন্তু আপনাদের যাদের গাঁজা নিয়ে ডিল করার অভিজ্ঞতা আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন যে যদি সে অ্যাডিক্ট না হয়ে যায়, তা হলে গাঁজা খায় বলে গায়ে আলাদা করে কোন ছাপ থাকে না – যেমন থাকে না টেররিষ্ট বলে আলাদা কোন অ্যাপিয়ারেন্স। সেই সময়ে নিমো ভারতে সেবক সমাজের অন্তর্ভূক্ত সব নওজোয়ানই গাঁজার কম বেশী সরগর থাকলেও যে দুজন ‘গাঁজাখোর’ তকমা বহন করতে অ্যাপিয়ারেন্সে তারা হল – বরুণ এবং সুবান। ওই যে বরুণ নিজের বাড়ি থেকে মাথা নীচু করে বাড়ি থেকে বেরুল, ছিলিমে দম দেবার আগে তাকে কেউ মুখ তুলে তাকাতেই দেখে নি প্রায়। থিয়েটারের প্রত্যেক দৃশ্যের শেষ হত বরুণের এক চমকপ্রদ ডায়লগে – সে ডায়াসে উঠে আঙ-বাঙ ডায়লগ গলা কাঁপিয়ে বলবে, সেই উত্তেজনায় গ্রাম কাঁপত এমনকি গ্রামের বউদিরাও। সেবার লাইটম্যান উদয় ক্যালানি খেয়ে গেল – লাইট কণ্ট্রোলে নতুন লোক রেখে – দৃশ্য শেষ হয়ে আছে, বরুণ আস্তে আস্তে ডায়াসের দিকে এগুচ্ছে – গ্রাম বাসী বৃন্দ উত্তেজনায় উঠে বসেছে প্রায়, এমন সময়ে উদয়ের লাইটম্যান দিয়েছে স্টেজের লাইট অফ করে! সে এক মার মার কাট কাট সিচ্যুয়েশন। পাবলিক ডিম্যান্ডে বরুণকে পরের দৃশ্যে গলা কাঁপিয়ে এমন ডায়লগ দুবার দিতে হল পর পর।

    অরুণদা নাটক লিখলেও, নাটক পরিচলনার জন্য তখনো বাইরের মাষ্টার ভাড়া করে আনাটাই দস্তুর ছিল। কখনও তপন মাষ্টার, নদ-মাষ্টার, মধু-মাষ্টার ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সেই থিয়েটারে ফিমেল ভাড়াদের আর আলাদা করে কি বলব। মহিলা প্রগতি নিয়ে অনেক কথা হয় – কিন্তু এই আজকে অবধি আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে নাটকে অভিনয় করে নি। ফিমেল আসত বাইরে থেকে – ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের পাশেই নিমো ভারত সেবক সমাজের ঘরে রিহার্সেল দিয়ে আবার তারা ফিরত। মেয়েগুলোর নামও মনে নেই আর – তাদের অভিনীত চরিত্র দিয়েই তাদের নামকরণ হত গ্রামে। এইভাবেই শেফালী ফেমাস হয়ে গেল আমাদের মনে “ভোরের শিউলি” নাটকে অভিনয় করে।

    ক্লাবে নাটকের রিহার্সেল চলছে – মধু মাষ্টার টর্চ জ্বেলে নাটকের ডায়লয় পড়ে নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে খালি কোলগেট বা পেপ্সোডেন্টের কাগজের প্যাকেট গুলো – ওগুলো নাকি সিম্বলিক স্পীকার। স্টেজে কে কিভাবে পজিশনিং করে মাইক নেবে সেই প্র্যাক্টিস হচ্ছে। সমস্যা হত যখন নাটকের থেকে ক্যারাম বেশী ভালোবাসে এমন পাবলিক দলভারী করে ক্লাবে আসত রিহার্সেলের সময়। ক্লাবের এক কোনে থাকত ক্যারাম – ক্যারাম খেলা আর রিহার্সাল এই দুয়ের মধ্যে স্পেসের দখল ছাড়া আর যা নিয়ে কনফ্লিক্ট ছিল তা হল স্ট্রাইকারের আওয়াজ। মাষ্টার যেত রেগে – এই ভাবে রিসার্সেল হয়!

    একদিন ডায়লগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, অরুণদার লেখা ঠিক জামছে না থ্রো করতে গিয়ে। ঘোষেদের লাল্টু কেবল ক্যারাম খেলতেই আসত ক্লাবে – বিড়ি মুখে থেকে নামিয়ে সে প্রস্তাব দিল, মাষ্টার, লিখে দাও “কুহু কেকা ডাকে”! বরুণ তখন সবে সোনাগাছি থেকে শিউলিকে উদ্ধার করে নিয়ে ফিরে আসবে বলছে, সেই শিউলিকে যে নাকি তার বাবার অসুখের টাকা জোগাড় করার জন্য সোনাগাছিতে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে। বরুণ সেই দৃশ্যের শেষে ডায়াসে উঠে কি ডায়লগ দেবে সেই নিয়ে মাষ্টার ভাবছে, ঠিক তখনই লাল্টুদার “কুহু কেকা ডাকে” ব্যবহারের প্রস্তাব। মাষ্টার গেল বিশাল রেগে – উঠে লাইটটা নিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরার জন্য পা বাড়ালো “এটা ফাজলামো হচ্ছে”। বেগতিক দেখে লাল্টদা বলল, ও মাষ্টার রাগছ কেন, আচ্ছা ব্যাথার কথা লিখে দাও – “হু হু করে উঠছে”। সাধাসাধির পর মাষ্টার ফিরে এল – রিহার্সাল শুরু হতে যাচ্ছে, লাল্টুদা বিড়ি মুখে বলল, “মাষ্টার, শিউলির ব্যাথা কোথায় হচ্ছে লিখলে”? আবহাওয়া আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল – আমরা ছোটরা ঘাবড়ে গেলাম – এত সহজ প্রশ্নে মাষ্টারের রেগে যাওয়া উচিত হয় নি বলে আমরা রায় দিলাম জানালার এপাশ থেকে।

    [ক্রমশঃ]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ | ৮৪২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ন্যাড়া | 890112.217.782323.153 (*) | ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:৫৪65173
  • হোক, হোক।
  • শঙ্খ | 2345.110.9004512.161 (*) | ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:০৭65174
  • অনেকদিন পরে
  • Tim | 89900.253.8956.205 (*) | ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:১০65175
  • পড়ছি, পরের পর্বের অপেক্ষায়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন