এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • নেতাজি ও তিনটি আলুর দম - একটি ইতিহাসের বাইরের ঘটনা

    নীনা গাঙ্গুলি লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৬ নভেম্বর ২০১১ | ৫০৭ বার পঠিত
  • বিহারের একটি ছোট্ট শহর মজ:ফরপুর। অনেক ইতিহাসে ফেমাস ও ইনফেমাস বাড়ী ও লোকজনের শহর ছিল এই মজ:ফরপুর। কবিগুরুর বড় জামাই শরৎ চক্রবর্তী এই শহরের বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে। আবার ভাওয়ালের সেই বিখ্যাত (নাকি খুখ্যাত) রানীর বোনঝির বাড়ীও, এবং সেখানে নাকি রানী কিছুদিন ছিলেন (জানিনা, শোনা কথা)।

    সময়, পরাধীন ভারত। বাংলা থেকে অনুশীলন /যুগান্তর দল এক তরুণ বিপ্লবী সৈনিক কে পাঠিয়েছে বিহারে দল গড়তে এই শহরে। সেই সুপুরুষ তরুণ খুব অল্প সময়েই হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয়। চোট শহরে ইয়াং জেনারেশনকে দেশ উদ্ধারের মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়া তাঁর কাজ। তাদেরকে তৈরী করা নানাবিধ ভাবে -- শুরু করেছিলেন একটি ক্লাব ও আখড়া। ব্যায়াম কুস্তি ও নানারকম খেলাধুলা, ক্লাবে নাটক গান ইত্যাদি ছিল ওপরের মলাট -- ভেতরে হত আসল ট্রেনিং। নানা বয়েসের কিশোর ও তরুণের প্রাণে জাগল দেশ স্বাধীনের চেতনা -- কিছু কিশোরী ও এগিয়ে এলেন অতি সাবধানে, বাড়ীর শাসনের আড়ালে, কোনওমতে যতটুকু করা যায়।

    সেই শহরের আর একটি পরিবার। আগে যেমন হত অনেকগুলি ভাই, একসঙ্গে থাকেন। সচ্ছল ব্রাহ্মণ পরিবার। সেই পরিবারের দুই তরুণও যোগ দিয়েছেন আখড়ায়। তাদের বড় দিদিও থাকেন সঙ্গে। স্বামী হারিয়েছেন খুব অল্প বয়সে, চারটি মেয়ে নিয়ে -- তাই ভাইয়েরা তাঁকে একলা থাকতে দিতে মোটেই রাজী হননি। অতএব এই চারটি মেয়ের গার্জেন এই মামারা। বড়টির দেখেশুনে ভাল বিয়ে দিয়েছেন। সেজ মেয়েটি তখন কিশোরী ও ছোটটি নেহাতই ছোট, সে সেজদির ছায়া, পেছু পেছু ঘোরে। সেজটির ঋজু স্বভাব, বেখাপ্পা লম্বা আর তার গায়ের রঙও চাপা (সারা বাড়ীতে) তাই তাকে মামারা ডাকে কালিন্দী। খুব অল্প কথা বলে, পড়াশোনয় খুব ভাল -- বই পড়ার নেশা -- যে বই পায় পড়ে ফেলে। তা এই মেয়েও চুপিচুপি গিয়ে দীক্ষা নিয়েছে দেশ স্বাধীনের মন্ত্রে। বাড়ীতে কেউ জানেনা -- শুধু ঐ ছোট বোনটি ছাড়া। দরকারি কাগজপত্র এমনকি একটু আধটু গোলাগুলি-পিস্তল লুকিয়ে রাখা ও যথাসময় যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়া -- আপাতত এই তার কাজ। বাড়ী থেকে বেরোলে সঙ্গে ছোটটি থাকলে কেউ সন্দেহ করে না। অমনিতে এই দুটি বোনেরই চমৎকার গানের গলা, তাই তারা ক্লাবের ফাংশানে গান গায় -- এই ছিল তাদের মলাট!

    (এই সময় এই কিশোর-কিশোরীরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন -- বয়েসে ছোট বলে অনেক সহজে অনেক জায়গায় গলে যেতে পারতেন -- এই নির্ভীক টিনএজারসরা জোরকদমে পা মিলিয়ে চলতেন তরুন সেনানীদের সঙ্গে।)

    যা বলছিলাম, ছোট বোনটি ছিল বেজায় ভীতু। তার চোরে ভয়, ভুতে ভয়, সাপে ভয় -- রাজ্যের জিনিষে ভয়। সে যায় সেজদির সঙ্গে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে কখনো কোনো কাগজ কিম্বা কীসব কাপড়ে মোড়া ভারীমতন জিনিষ দেওয়ানেওয়া করতে। সারা রাস্তা "রাম রাম' জপে এই বুঝি ভূত, কি চোর কি সাপ, কীসের খপ্পরে যে পড়বে, আর কাকুতি-মিনতি করে, ও সেজদি তুই এসব করিস না। মা কিম্বা মামারা জানতে পারলে রক্ষে রাখবে না -- কিন্তু সেপাই-দিদি অচল-অনড়। তার দীক্ষা দেশ স্বাধীনের মন্ত্রে। আর সেই তরুণ সৈনিক -- তাঁকে সে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করে। তাঁর ডাকে দেশের জন্য কিছু করতে পারার জন্য সে সদাই ব্যাকুল। তিনি কিছু করতে বললে আর সেটা নিখুঁত করে, করে দিতে পারলেই যেন তার জীবন ধন্য হয়ে যায়।

    মজ:ফরপুর শহরে হৈ চৈ -- নেতাজী আসছেন মিটিং করতে সে শহরে। সাজ সাজ রব। সেই তরুণ বিপ্লবীর ওপর ভার সবকিছু তদারকির। নেতাজী সকালে আসবেন, জলখাবার খাবেন, ও তারপর মিটীং।

    তরুণ, সেই কিশোরীকে ডেকে বললেন, শোন, নেতাজী লুচি আলুরদম খেতে খুব ভালবাসেন। তুই ওটা বেশ ভাল করিস। তুই ওটা রাঁধবি আর ওনার জলখাবারের দেখাশোনা ব্যবস্থা সব করবি।

    সে তো ভয়ে অস্থির -- নেতাজী এক ব্যাঞ্জন খাবেন আর সে রাঁধবে সেটা? যদি খারাপ হয়, যদি ওনার না ভাল লাগে -- ভয়ে ঘামতে থাকে বেচারী। অন্ধকার পথে বনে বাদাড়ে গোলা-বারুদ নিয়ে নির্ভয়ে চালাচালি করে এই মেয়ে -- কিন্তু নেতাজীর জন্য আলুর দম রাঁধবে ভেবেই সে ভয়ে অস্থির।

    কাঁপা গলায় বলে, আপনি বড়দের কাউকে বলুন যাঁরা ভাল রাঁধেন--

    তরুণের তখন হাজারটা কাজ -- বেশ বকে বলে ওঠেন, যা বল্লাম তাই করবি। কাল সক্কালবেলা যেন সব রেডি থাকে।

    সক্কালবেলা উঠে সে রাঁধে একপ্রস্থ -- ছোটবোনকে চাখতে দেয়। মুখে দিয়েই সে বলে, এ কীরে সেজদি, এত মিষ্টি দিয়েছিস কেন?

    আবার নতুন করে রাঁধে সে -- বোন চাখে, এম্যা! তোর কী হলরে এটা তো কেয়ং যেন ফ্যাকাসে মতোন --

    আবার সে গোড়া থেকে শুরু করে। বোনের মন্তব্য--তোর হাতে যেমনটি হয় তেমনটি হয়নি তো--কিন্তু এটা চলে যায়।

    ততক্ষণে সময় হয়ে গেছে, তরুণ আসেন -- কী রে, হল? দে, দেখি কেমন করলি।

    ছোটবোন বলে, হি হি হি কোনটা খাবেন আগে --

    সেকী? কোনটা মানে? একটাই তো শুধু আলুর দম ?!

    কিশোরী ভয়ে ভয়ে বলে, চোখ ভর্তি জল -- ভাল হয় নি, তাই তিনবার করেছি।

    তরুণ দরাজ গলায় হা হা হা হা করে হাসেন -- এই হাসিটি আর এই কন্ঠস্বর, এই সুপুরুষ তরুণ -- কিশোরীর বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি সবসমই বাড়িয়ে দেয় এই মানুষটি!!

    তিনি চাখলেন তিনটি -- মুখটা কি গম্ভীর -- ভ্রুটা কি কুঁচ্‌কালেন -- কিশোরী করুণ গলায় বলেন, কী হবে ! সব কটা বাজে হয়েছে। কেঁদে ফেলে সে।

    উনি বলেন -- কী রে, তোকে না কত বড় কাজ করতে হবে জীবনে, আর আলুর দমেই তোর দম বেরিয়ে গেল? আবার সেই হা হা হাসি! বলেন তিনটে তিনরকমের ভাল হয়েছে -- তিনটে মিলিয়ে দিলেই অনেক লোকে খাবে তো।

    কিশোরী হাঁ হাঁ করে ওঠে, কিন্তু ততক্ষণে মিষ্টি, ফ্যাকাসে, আর চলে-যায় -- এক পাত্রে এক হয়ে গেছে।

    নেতাজী খাচ্ছেন লুচি আলুর দম, জলখাবার। কিশোরী ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে ঘেমে যাচ্ছে, লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে -- না জানি কী অখাদ্য হল আজ এই দেবতার ভোগ!

    নেতাজী বলেন -- বাহ:, খুব ভাল হয়েছে আলুর দম। আর একটু আছে?

    কিশোরীর জীবন সার্থক! এই স্মৃতি হয়ে ওঠে তার জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি।

    স্বাধীন ভারত! কিশোরী এখন গিন্নি--আলুর দম যেদিনই রাঁধেন, কত্তা বলেন আজ কোনটি করেছ--এক নম্বর না দুই নম্বর না তিন নম্বর? :-)

    হ্যঁ¡, সেদিনের সেই কিশোরী ঘর বেঁধেছেন স্বাধীন ভারতে সেই তরুণ সেনানীর সঙ্গে -- সেও বেশ একপ্রকার যুদ্ধ করেই -- অব্রাহ্মণ যে সেই তরুণ! -- তা সে এক অন্য গল্প!!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৬ নভেম্বর ২০১১ | ৫০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • amarnath | 226.163.247.2 (*) | ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:৩৭89033
  • খুব ভালো লাগলো লেখা তা পরে। আপনার জীবন সার্থক।
  • amarnath | 226.163.247.2 (*) | ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:৩৭89032
  • বাহ খুব সুন্দর তো লেখা তা। নেতাজি কে আলুর দম খাওআনো চাত্তিখনি কথা!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন