এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • রূপকথা আর তার ভিতর-কথা

    gargi bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ এপ্রিল ২০২০ | ২৬৭৮ বার পঠিত
  • “তারপর সকলে মিলিয়া সুখে দিন কাটাইতে লাগিল” - গল্প এই ভাবে শেষ হলেই আমরা নিমেষে বুঝে নিই ছাঁদটা - খুব চেনা, মনের খুব কাছাকাছি বাস করা একরাশ আশা - এ তো রূপকথা। শহরে আর রূপকথা মেলে কই, এমনকি মনের ঘিঞ্জি বসতিতেও আর ঠাঁই নেই সে সরল, সাদাসিধে গল্পের, যেখানে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে আমাদের প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে থাকে কৌটোয়। সে সব দিন ফুরিয়েছে অনেকদিন। পাড়া জুড়ে তখন হঠাৎ নামত অন্ধকার, মনের দরজা যেত খুলে, আর সে পথে সন্তর্পণে আসত রাক্ষস-খোক্কোস, রাজপুত্তুর-রাজকন্যারা। শুনতে  শুনতে মুগ্ধ হত শিশু-বিস্ময় আর ঘুম নামত চোখের পাতা ভারী করে। যদিও সেসব রূপকথার সন্ধান আর পাওয়া যায় না টিপটপ সাজসজ্জার মধ্যে, তবু সে আজও যাতায়াত করে ভেতরের অলি গলি হয়ে। কাগুজে লেখা বা গল্প দাদুর আসর নাই বা হল, তবু রূপকথা শব্দটা শুনলেই দিগশূন্যপুর রওনা হতে চাই। আসলে এরা থেকে যায় কোন দেশ বা জাতির সামূহিক স্মৃতির (collective memory) ভাঁড়ারে, যে ভাঁড়ার তোমার, আমার, সবার। রূপকথা তাই  আমদের কাছে  দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বইমাত্র নয়, একটা  মনকেমন করা পুরোনো গন্ধ, যার অপেক্ষায় আমরা জীবনভর কাটিয়ে দি - একদিন তো ঘুমন্ত পুরী জাগবে।

    রূপকথার যেমন একটা স্বভাবজাত ছন্দ আছে, তেমনই তার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা অন্যরকমের বেঁচে থাকা, তার বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে থাকে সত্যির উলটো রাস্তায় - বাস্তবের সাথে তার মিল দূরদূরান্তের। সেখানে সোনার গাছে রুপোর ফল ধরে, আর এদিকে আমরা রোজের বাজারে পচা আমের আকাশ ছোঁয়া দামে হেঁচকি তুলি। সেখানে নীল জলে রাজকন্যার ময়ূরপঙ্খী ভাসে, আমরা দশটা-পাঁচটার বাসে গলদঘর্ম হই। এমন কতই না বেমিল, তবু আজও রূপকথারা গল্প শোনায়। 

    আচ্ছা, কখনো-সখনো মনে কি হয় না যে কোন এক খুব গাঢ় সত্যির গোপন নক্সা লুকিয়ে রাখা আছে সেই রূপকথার অতল গভীরে? হয়ত তার সন্ধান পেলে বর্তে যাব আমি, তুমি, সে। যেমন ধরা যাক রূপকথার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাঠামোটা -  কুঁচবরণ কন্যা, তার মেঘবরণ চুল - সে ঘুমিয়ে আছে রাক্ষসপুরীতে। রাক্ষস তাকে রুপোর কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তারপর একদিন পক্ষীরাজ চেপে রাজপুত্তুর আসে। রাজকন্যার ঘুম ভাঙায় সোনার কাঠি দিয়ে। রাক্ষসরা হুড়মুড়িয়ে মরে, আর পক্ষীরাজ চেপে রাজপুত্তুর রাজকন্যাকে নিয়ে চলে। কি সুন্দর লাগছে ভাবতে। কিন্তু সবই তো এখানে অলীক - যা কোনদিন ছিল না, নেই, থাকবেও না। দুর মশাই, কি যে বলেন,  সত্যি না ছাই, যত্ত সব আজগুবি৷   আরে আরে দাঁড়ান একটু, জিরেন দিন, হাঁফিয়ে নি অল্প, বোশেখ মাস, মাথার ওপর সূর্য যে গনগনে। শুনেই আপনি আকাশের দিকে তাকাবেন। জানি তো। আর ঐ আকাশে, ঐখানে ঐ সুয্যির মধ্যেই তো রয়েছে এ গপ্পের চাবিকাঠি। বোধগম্য হচ্ছে না তো? বলছি। অতটাও সহজ নয় যে গুপ্তধনের সন্ধান। 

    আচ্ছা বলুন দেখি, মানুষ ঘুমোয় কখন? মানে সাধারণ নিয়মে আর কি। নাইটশিফট আর চ্যাট-এ ব্যস্ত মানুষদের কথা অবশ্যই বাদ। ঘুমের সময় হল রাত, যখন চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে, যখন ঘন আকাশে তারাদের চাঁদোয়া বেছানো হয়, তখন সেই চাঁদোয়ার নিচে মানুষ ঘুমোয়। চাঁদের রঙ দেখেছেন? রুপোর মতো - সাদা ফিনফিনে। আর সূর্যের রঙ? সোনার মতো ঝকঝকে। সেই রুপোর কাঠি বুলিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ে জগৎ সংসার। আর হলুদ আভায় সোনার কাঠি দিয়ে দিন আসে। ঘুম ভাঙ্গে সকলের। তাই হতেই পারে যে, এটা আসলে রাত আর দিনের একটা রূপক।

    ব্যাখ্যাটা খুব একটা মনে ধরল না বুঝি? আচ্ছা, আরেকটু এগোনো যাক। বলুন তো, রাজকন্যার ঘুম ভাঙ্গাতে কে আসে? হ্যাঁ, রাজপুত্রই। তার বাহনটি খেয়াল করেছেন? পক্ষীরাজ ঘোড়া। যে সে ঘোড়া নয়, এক্কেবারে স্বর্গের ঘোড়া, কারণ তার দুটো ডানা আছে, পলক ফেলতে সে পেরিয়ে যায় লক্ষ যোজন। ঘোড়ায় চেপে আর কে আসে বলুন দেখি? রোজ রোজই আসে, একদিনও কামাই নেই? আসেন আবার সেই সুয্যিঠাকুর। সপ্ত অশ্বের রথে চেপে পুব দিক থেকে উদয় হন। ফের অবিশ্বাস? আরে সূর্যের মূর্তি চেনার জন্য ঘোড়া হল অন্যতম জরুরি iconographic identity। ঐ যা দিয়ে পুরাতত্ত্ববিদরা মাটির নিচে থেকে উদ্ধার হওয়া মূর্তির নাম ধাম ঠিক করেন। না না, এক্ষুনি পুঁথিপত্তর খুলতে যাবার দরকার নেই। বাঙালীর চিরকালিন ভ্রমণ পিপাসার খানিক ধার দিলেই হবে। কোনার্ক বেড়াতে গিয়েছেন নিশ্চয়ই, অন্তত পুরীর জগন্নাথ দর্শনের সাথে ফাউ এর ফুচকার মতো সাইটসিইং-এ? কোনার্কের মন্দিরের গড়ন একটা রথের আদলে। সে মন্দিরের আরাধ্য দেবতা হলেন সূর্য। তবে কোনদিন দেবতার কপালে পুজো জুটল না এই যা। তা সে অন্য গপ্পো। আর একদিন হবে। এখন আমাদের চোখ ঐ মন্দিরের দক্ষিণ, পশ্চিম আর উত্তরে। সেখানে বেশ খানিক ওপরে কালচে সবুজ পাথরে খোদাই করা রয়েছেন সূর্যদেব। আকৃতিতে বিশাল। কখনো সাতটা ঘোড়ায়, কখনো একটাতেই চেপে চলেছেন। দৃপ্ত ভঙ্গী, গম্ভীর মুখ। পায়ের কাছে বসে আছেন সারথি, তার ঊরুর ওপরের অংশ থেকে নেই, তিনি অনূরু। তাঁরই নাম অরুণ, তিনিই সুর্যের প্রথম কিরণ। সে রাঙা কিরণ পড়ল যেই এ পৃথিবীর ধূলিকণাতে, অমনি ঘুম ভাঙ্গল রাজকন্যার, সোনার কাঠি পেয়েছে যে সে। তখনই ধড়মড় করে জেগে গেল সবাই। তাই এ একরকম রাত ঘোচানোর কাহিনী। তাতে লেগেছে স্বপ্নের রঙ, আর কথা সাহিত্যের দখলদারী। বিশ্বের অনেক কথা সাহিত্যই এমন আমাদের রোজনামচার গল্প বলে, গল্প বলে শস্য কাটার, গল্প বলে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার।

    আমার কথার নটে গাছটি মুড়তে আর একটু বাকি। যেটা না বললেই নয় তা হল রাজকন্যাকে রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে রাক্ষস কেন ঘুম পাড়ায়। আসলে সে যে আমাদের মনের ভয়। আঁধারের সাথে ভয়ের বন্ধুত্ব তো চিরাচরিত। অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো, আর যেখানে অজানা সেখানেই ভয়ের রাক্ষস-খোক্কস বাস করে। খেয়াল করার এটাও যে, যে পথে রাজপুত্র আসে সেখানে লুকিয়ে থাকে অনেক বিপদ, যার অনেকটাই আগে থেকে অজানা। কিন্তু যতই ভয় লাগুক পিছনে ফিরে তাকানো যে মানা। সে ভয় জয় করে তবেই তো রাজকন্যার খোঁজ পাওয়া। সে বড় কঠিন, কিন্তু ভয়কে দুপায়ে মাড়িয়ে আসতে না পারলে রাজপুত্রের এত চেষ্টা বিফল হয় যে। অন্যদিকে যা স্পষ্ট, যা আবছায়ার বাইরে, সেখানেই ভয়ের শেষ। দিনের আলোর সাথে ভয় ঘুচে যাবার সম্পর্কটাও ততটাই নিবিড়। তাই এই ভোর আনার গল্পটা আসলে মনের ভয় কাটানোর গল্পও বটে। তাই তো আশা জাগে, তাই তো রূপকথার কথায় বিশ্বাস করতে মন চায়। 

    আজ আমাদের গভীর ঘুম, তলিয়ে আছি কেবল ফেলে আসা দিনগুলোর জাবর কেটে। রাক্ষস যদি রুপোর কাঠি ছুঁইয়েছে, তবে রাজপুত্রও একদিন ঠিক আসবে, খুঁজে আনবে সোনার কাঠি। রাত ভোর হবে। তারপর আমরা সবাই সুখে দিন কাটাতে থাকব। রূপকথারা সত্যি হবে – এটুকু স্বপ্ন জিইয়ে রাখি অন্তত।

    আর ও হ্যাঁ, শুভ পয়লা বৈশাখ, একলা নয়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ এপ্রিল ২০২০ | ২৬৭৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    দরজা - gargi bhattacharya
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০৬:২২92510
  • বাঃ! ভালো লাগল এই বিশ্লেষণ।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন