একটি নির্বাসন কথা
#মৌসুমী_ঘোষ_দাস#
নদীর এই দিকটাতে কোন লোকালয় নেই। ঘন জংগল, মাঝেমধ্যে দু-একটি ক্ষুদ্র পাতার কুটির রয়েছে । এই নিরালায় নির্জনে এই কুটিরগুলোতে স্বল্পসংখ্যক তপস্বীর বাস। নদীর এই ঘাটেই একটি নৌকো এসে ভিড়ল।
নৌকা থেকে নেমে এলো এক অসামান্যা সুন্দরী নারী আর সুন্দর এক পুরুষ। সম্পর্কে তাঁরা দেবর বৌদি। দেবরটি অতি সন্তর্পণে এক হাঁটু কর্দম পেরিয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বৌদিকে এনে বসালো ঘাট থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত একটি ছায়াশীতল বৃক্ষের নিচে। নিজে দাঁড়িয়ে রইল শুষ্ক, বিষন্ন, বিচলিত মুখে। যেন কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না।
দেবরের শুষ্ক বিষন্ন মুখ দেখে এবারে মেয়েটি ভারি চিন্তিত হল। সে তাঁর এই দেবরটিকে দীর্ঘ বছর ধরে দেখে আসছে। তাঁর মুখের ভাষা অনায়াসেই পড়তে পারে। যাত্রাপথে একটি কথাও বলেনি, সর্বক্ষণ শুস্ক চিন্তিত মুখে থেকেছে। কিছু কি লুকোচ্ছে? প্রথমেই আশংকা হল স্বামীর জন্য! শরীর ভালো আছে তো মানুষটার?
এবারে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেই ফেলল মেয়েটি , “কি ব্যাপার বল তো? সেই তখন থেকে তোমাকে শুকনো বিষন্ন দেখছি! দীর্ঘ নৌকা যাত্রায় তুমি কি অসুস্থতা অনুভব করছো?
নির্বাক নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো দেবর।
মেয়েটি আবারও বলল _” আমাকে কি কিছু লুকোচ্ছো তুমি ? বাড়ির সব খবর ভালো তো? আসবার সময় তোমার দাদা আমাকে বিদায় জানাতে আসে নি। তাঁর কিছু হয় নি তো? ঈশ্বরের দিব্য তুমি আর চুপ থেকো না, আমাকে সত্যি কথা বল”।
এতক্ষণ, সংযত রেখেছিল নিজেকে। এবারে ভেঙে পড়লো,
বৌদির পাদুটি জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বলল, “ঘৃণ্য কাজের আদেশ হয়েছে আমার ওপর! কেন যে আপনি এখানে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বৌদি? দাদার আদেশে আজ থেকে আপনি নির্বাসিত হলেন। আমি আপনাকে এখানে একেবারে রেখে যেতে এসেছি”।
কিছুই বুঝতে পারলো না মেয়েটি! কাল স্বামীর কাছে এখানে একটু ঘুরে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ঠিকই । কিন্তু তার সাথে নির্বাসনের কি সম্পর্ক? বিস্ফারিত চক্ষে কিছুক্ষণ চেয়ে তারপর অস্ফুটে বলল - নির্বাসিত? কেন বলো তো? আমার অপরাধ?
-সমাজের লোকেরা যে আপনার চরিত্রে অপবাদ দিয়েছে। বলেছে পর-পুরুষ আপনার হাত ধরে টেনেছে, তাদের ঘরে আটকে রেখেছে। তাই আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। আপনি তো জানেন, দাদা সমাজের মাথা! তিনি যা করেন, সেটাই সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তিনি যদি অপবিত্র স্ত্রী নিয়ে ঘর করেন, তবে অন্যেরাও কলঙ্কিত স্ত্রী নিয়ে ঘর করবে! তখন সমাজটা যে উচ্ছন্নে যাবে! তাই তিনি আপনাকে পরিত্যাগ করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
এই আকস্মিক সর্বনাশে মেয়েটি নির্বাক প্রস্তর মূর্তি হয়ে গেল!
দেবরটি বলে যেতেই থাকল, আমরা অন্য ভাইয়েরা দাদার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তিনি তো কোনোদিনই আমাদের মতামত গ্রাহ্য করেন না। কিছু নিচমনা মানুষের কুটিল সন্দেহকেই তিনি অধিক গুরুত্ব দিলেন। হায়! একে আপনি সন্তানসম্ভবা, তার মধ্যে আমাদের মাও এই সময় বাড়িতে নেই, ঠিক এমনি একটি সময় বেছে নিলেন দাদা আপনাকে পরিত্যাগ করার জন্য!!
এবারে ধীরেধীরে মেয়েটি বলল, তিনি তো আমাকে নির্বাসন দিয়েছেন! আমার গর্ভস্থ সন্তানের কি হবে? নাকি সেও বঞ্চিত হবে বাপ-ঠাকুরদার অর্জিত সম্পদ থেকে?
কোন উত্তর না দিয়ে মাথানত করে রইলো দেবর।
মেয়েটি আবারও বলল, তিনি কি কোন নির্দেশ দেননি এই অরন্যে আমার গ্রাসাচ্ছাদন হবে কি করে? সন্তানের যখন মাতৃদুগ্ধে পেট ভরবে না, তখন তাঁরই বা পেট ভরবে কি করে? আমাকে স্পষ্ট করে বল তো আমার এই নির্বাসন কতদিনের জন্য?
ব্যাকুল হয়ে বলল দেবর, সমাজের লোকের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি আপনাকে সারাজীবনের মত ত্যাগ করেছেন- আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না? আপনার এবং সন্তানের সারাজীবনের ভরণপোষণের কোন দায়িত্বই তিনি আর নেবেন না বলেছেন ।
স্তম্ভিত হয়ে গেল মেয়েটি। বাহ! যাকে অগ্নিসাক্ষী রেখে একদিন বিয়ে করেছিল, সমাজের লোকের সামনেই যার সারাজীবনের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বীকার করেছিল! যার গর্ভে তাঁরই ঔরসজাত সন্তান আছে, সেই গর্ভবতী স্ত্রীকে এমন অসহায় অবস্থায় জংগলে নির্বাসন! এ আবার কোন বিচিত্র ধর্ম?
এক রাত্তিরেই এতোটা বদলে যেতে পারে একটা মানুষ!! বিগত এতগুলো বছর যে মানুষটার সাথে সুখে দুঃখে পাশে থেকেছি, সেই মানুষ আসবার আগে একটি বারের জন্যও বুঝতে দিল না তাঁর বদলে যাওয়া মনের ভাব! এত নিপুন ছলনা !
মেয়েটি চোখ মুছে দৃঢ় কন্ঠে বলল, বেশ! আমাকে যখন একেবারেই ত্যাগ করেছে, তবে শোনো, তোমাদের ধর্মনিষ্ঠ, সমাজের মাথাকে অবশ্যই এই প্রশ্নটা কর , "আজ তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, এবারে অন্যরাও যদি ছলছুতোয় তাঁদের স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে- তখন তাঁর সমাজ উচ্ছন্নে যাবে না"?
"তাঁকে বল, এই আকস্মিক ছলনায়, আঘাতে যতই ভেঙে পড়ি না কেন, আত্মহত্যা আমি করবো না। সন্তানের জন্ম দেবো, তাকে মানুষও করবো একা। শত কষ্টেও যে মা সন্তানের দায়িত্ব ত্যাগ করে না। সেই মা যুগে যুগে সমাজে শ্রেষ্ঠ, শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবে ।
আর বোলো, তোমাদের ন্যায়ের অবতারকে কেবল সমাজের চোখে মহান সাজাটাই যার ধর্ম, অথচ বিবাহিত স্ত্রী, ঔরসজাত সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া -যার ধর্মের আওতায় পরে না- সেই মানুষ যুগযুগ ধরে নিন্দিত ধিকৃত হবেন তারই সমাজের কাছে । অবশ্যই বলো"।
-----------------------------------+++++++++++++------------------------------