'সোজা তাকাও, এবার চোখের পাতা বন্ধ করো, আবার সোজা তাকাও চোখের পাতা বন্ধ করো, শরীরকে রিল্যাক্স করে রাখো, একদম লুজ। এক মিনিট, দু মিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট - এভাবে একসময় চোখের পেশি ক্লান্ত হয়ে যাবে, ধীরে ধীরে ঘুম এসে যাবে। রাতে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছে না? একবার চেষ্টা করে দেখো' - বলেছিল আমার এক ফিজিওথেরাপিস্ট বন্ধু।
আগে আমার ঘুমের সমস্যা ছিল না, শুলেই ঘুম এসে যেতো। ইদানীং ঘুম আসে না সহজে, আমি পাশ ফিরে শুয়ে খোলা জানলা দিয়ে আকাশ দেখি, চোখ বন্ধ করি, আবার আকাশ দেখি, চোখ বন্ধ করি, শরীর রিল্যাক্স করার চেষ্টা করি - তবু ঘুম আসে না। ঘোলাটে তারাহীন আকাশ যেন আমার জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। উঁচু ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে আকাশকে বড় কাছে মনে হয়। ইলেক্ট্রিকের খুঁটি গুলো দলাপাকানো তারের জঞ্জাল নিয়ে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে জানলার পাশে। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির মাথা ঘুমিয়ে আছে। শুধু সিঁড়ি ঘরে দু'একটা আলো দেখা যায়। ওরাও কি সবাই ঘুমোচ্ছে? কে জানে মানুষ কি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোয়?
আমার ফ্ল্যাটের পাশেই জাতীয় সড়ক। কোন গাড়ির আওয়াজ নেই লকডাউনের কারণে। নইলে আগে সারা রাত গাড়ি চলাচলের শব্দ, হর্ণ - বিরক্ত লাগতো। কে জানে এখন কি সেসব মিস করছি? রাত বাড়তে থাকে, শান্ত চারপাশ - তবু ঘুম আসে না। মাঝে মধ্যে দু'একটা বাইক দুরন্ত গতিতে বিকট শব্দে ছুটে যায় নিস্তব্ধতার বুক চিরে। এই অল্পবয়সী ছেলেগুলো বেশ আছে -নো চিন্তা, নো ভাবনা। বাপের খেয়ে, বাপের পয়সায় বাইক কিনে, তার আবার সাইলেন্সার খুলে তবে চালায়। মাঝরাতে পাড়া কাঁপিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে বিকট গর্জনে উল্লাস করতেই তারা পছন্দ করে।
শুয়ে শুয়ে উল্টো পাল্টা চিন্তা আসে মনে। এই যে প্রিয় মানুষগুলো একের পর এক চলে যাচ্ছেন, দূরে মিলিয়ে যাচ্ছেন - তাঁরা আর ক'টা দিন পৃথিবীর রূপ রস রঙ গন্ধ ভোগ করলে কার কি যেতো আসতো? কত শিক্ষা, মেধা, গুণ আরও ক'টা দিন সমাজের কাজে ব্যবহৃত হতে পারতো !
বাবার কথা মনে পড়ে যায় তক্ষুণি। এই যে পরিবারে আমরা সবাই আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি, কাজ করছি, চলে ফিরে বেড়াচ্ছি - শুধু তিনি অনুপস্থিত। আমরা সবাই এপারে- আর বাবা একা ওপারে। বাবার কষ্ট হয় না একা থাকতে? কেমন আছেন কে জানে? হয়তো ভালোই আছেন নিজের মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। পুরনো বন্ধু দের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁদের নিয়ে হয়তো ভালোই আছেন।
আচ্ছা, সত্যিই কি ওপারে কোন দেশ আছে? 'না ফেরার দেশ'!! যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। আমরাও ইচ্ছে করলেই ওপারে গিয়ে প্রিয়জনকে দেখে ফিরে আসতে পারি না। যতক্ষণ না মৃত্যু এসে হাত ধরে একেবারেই সে দেশে নিয়ে যায়! সেখানে কি খুব শান্তি? বোধহয় শান্তি। আমি যত মৃত ব্যক্তি দেখেছি, তাঁদের প্রত্যেকের মুখে দেখেছি কি প্রশান্তি! অথচ যাওয়ার আগের মুহুর্তেই কি যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করেছেন, অথচ মৃত্যুর পর মুহুর্তেই সারা মুখ জুড়ে শান্তি আর শান্তি!! সত্যিই কি তেমন শান্তির জায়গা? নাকি বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী ওসব বলে কিছু হয় না, আত্মা বলে কিছু হয় না। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব কিছুর বিনাশ হয় চিরকালের মতো?
আজকাল ঘুম না এলে এসব এলোমেলো ভাবনা এসে গ্রাস করে আমাকে। কেন জানি না। কবে আবার সব ঠিক হবে, কবে আবার সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বো।