এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০০৬

  • পুজো পর্ব, প্রেম পর্ব

    পারমিতা চট্টোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | পুজো ২০০৬ | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৫৫৩ বার পঠিত
  • লতার গলায় চারিদিক আমোদিত। ভালো করে তুমি চেয়ে দেখো ..... দেখো তো চিনতে পারো কি না...। বেশ সময়টা। ভর দুপুর, মৃদু-মন্দ বাতাস। ভীড়-ভাট্টা কম।একদিকের রোয়াকে সব ছেলেরা আর উল্টোদিকের মন্ডপের সামনের চেয়ারে বসে আমরা এক দঙ্গল। দুদল দুদিকে কিন্তু কথা ঠিক চলেছে , চোখে চোখে কথা , হাসিতে হাসিতে কথা। এইদিকের মিঠুর মুখ লজ্জানত হল তো ওদিকের রাজীবদার বাঁদিকের চোখ ঝট করে একবার বন্ধ হয়েই খুলে গেল। "দ্যাখ দ্যাখ তোর প্রেমিক আমাকে চোখ মারছে"। মিঠু এবারে দীপার গায়ে ঠ্যালা মরে , "আহা প্রেমিক হবে কেন। ও পুজোর সময় একটু আধটু ওমনি হয়"। সত্যি পুজো এলেই কেমন যেন চারদিকের ছোঁক ছোঁকানি বেড়ে যায়। হয় টা কি ? "কুকুরের মত মানুষের ও সীজন আসে না কি।" হাসির ফোয়ারা ছোটে এবারে। বটগাছের তলা থেকে হুল্লোড়ে হাসির ঢেউ এর ধাক্কা গিয়ে লাগে সোজা মদনজেঠুদের রোয়াকে।

    ছেলের দল এবার দেখি গা মোচড়ায়। ওদের অনেক কাজ বাকী। মন্ডপের সামনের চেয়ার লাগানো সার দিয়ে , দুটো আরো বক্স আনানো , মন্ডপে আরো আলো , মন্ডপের ভাঙ্গা ঝাড়টা সরিয়ে অন্য কিছু একটা লাগানো ডেকোরেটারকে বলে। আরে কাত্তিক ঘোষের চাঁদাটা কে আনবে।ব্যাটা প্রতি বছর এই দেবো , সেই দোবো করে কাটিয়ে দেয়। এবার ছাড়ান নেই।ছেলেরা সব দল বেঁধে হাঁটে অমলনগরের রাস্তা দিয়ে। কাত্তিক ঘোষের চাঁদাটা সবার আগে আদায় হোক। বাকী কাজ তার পরে। ছেলের দল চলে জেতেই মন্ডপ হঠাৎ কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে। দীপা , মিঠু ঝট করে উঠে পড়ে। "যাই একটু ঘুমিয়ে নিই। রাতে জাগতে হবে আর মুখটাও কেমন শুকনো হয়ে যায় সারা দুপুর আড্ডা মারলে"। আহা বাকীরা যেন বোঝে না। "যা যা , বিউটি স্লীপ দিয়ে আয়। সন্ধ্যেবেলায় ছেলে ধরতে হবে তো"। আবার হাসি। হাসতেই থাকি। পুজোর সময়টা প্রাণ-মন কেমন যেন হাল্কা হয়ে থাকে। বড় বড় সমস্যাগুলো হঠাৎ লঘু লাগতে শুরু করে। কিম্বা হয়তো লঘু হয়েই যায়।বাবা মায়ের কাঠখোট্টা হাবভাবে একটু হলেই যেন চেন্‌জ হয়। দাদা কখোনো সখোনো যেন একটু বেশি সময় নিজের রুমের বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে মাথায় দু একটা গাঁট্টাও মারে। সব সম্পর্কগুলো একটু যেন সহজ হয়ে যায়।

    -- "কি হল একা একা বসে যে"। আমাকে ঘুরে দেখতেও হয় না।গলার আওয়াজেই চিনে যাই। সারা শরীর জুড়ে কিছু একটা হয় , মন জুড়েও।অমিতাভদা। অমিতাভদা। ভালো করে দেখি , সাদা ন্যাতানো পান্‌জাবী গায়ে আর সাদা কুর্তা। একটা বোতামও লাগানো নেই ,এক মাথা চুল উড়ে কাকের বাসা।চক্‌চকে দুটো চোখ , একটু ট্যারা কি ? ধুর বাবা , কি ভাবছি।
    তাড়াতাড়ি উত্তর দিই।
    " সঙ্গী নেই তাই একা।তুমি কোলকাতার থেকে এলে কবে ? এবার সপ্তমীতেই যে। তুমি তো বরাবর আসো নবমীর দুপুরে"।
    বলেই জিভ কাটি। ধরা পড়লাম বলে। না: আমার দ্বারা হবে না। কোনোমতে কটা ভুলভাল গল্প করে উঠে পড়ি। বাড়ি যাই। সন্ধ্যেবেলাতে আবার না বেরোলে সবার রাগ। আসি। চকচকে চোখে মনে মনে দুটো চকাস চকাস চুমু খেয়ে আমি দৌড়াই। হরিণীর মত।যাক বাবা , সপ্তমী অষ্টমী শুধু মিঠু-মনা-টুয়ার প্রেম প্রেম দেখে কাটাতে হবে না।

    সন্ধেবেলায় চরম সেজেছি। সবাইকে বিদ্ধ করব। চারটা রাতেই। প্রতিবার রূপাই এর বাজার ভালো যায় , যা মারকাটারী সুন্দরী রূপাই। তবে এবার আমি আগে প্রস্তুতি নিয়েছি , ফাটাফাটি কটা সালোয়ার। পিঠখোলা।অষ্টমীর রাতে মায়ের চান্দেরী আর নবমীর ঠাকুর দেখতে যাবার জন্যে লম্বা ঘেরের ঘুঙ্গুর লাগানো স্কার্ট। অমিতাভদা সাবধান।আয়নায় নিজেকে একটা হামি দিয়ে বেরিয়ে পড়ি।মা সোফায় বসে একবার আপাদমস্তক জরিপ করে নেয়। আমি ততক্ষণ মন্ডপে। আরতির মাঝে। মেয়ের দল কই ? খোঁজ খোঁজ। ওমা মন্ডপের পেছনে সব বসে সার দিয়ে , এ দঙ্গল ছেলেমেয়ে।ছুটে গিয়ে দাঁড়াই মাঝখানে। আরতির সময় এখানে ফ্লার্ট করা হচ্চে। পুজোটা দুগ্গার ভুলে গেলি।রেশম কনুই দিয়ে ঠ্যালা মারে "আর দুগ্গাকে ডাকার দরকার নেই।শিকার হাতের কাছেই এসে পড়েছে।মার তীর "।

    রেশম ইশারা করে ভীড়ে ভীড়াক্কার মন্ডপের দিকে। এক লক্ষ মাঝবয়সী আর প্রায় বুড়িদের দল হাতজোড় করে আরতি দেখছে আর মাঝে টেরিয়ে টেরিয়ে এর ওর সাজগোজ।একটিও কম বয়সী ছেলে মেয়ে নেই ধারে কাছে। এমনটাই হয়।আমি নিজেই বা ক-বার যাই মন্ডপের ভেতরে? পুজো মানেই প্রেম , পুজো মানেই ফ্যাশন।ব্যাস এইটুকুই। অবশ্য ঠিক প্রেমও না। প্রেম প্রেম। এই সময়টাতেই তো যত্ত সবাই বাড়িতে ফেরত আসে। পুজো শেষ হলেই যে যার নিজের জায়গায়। সেই টিউশন , ক্লাশ , জয়েন্টের প্রিপারেশান আর বাবা-মায়ের কনস্ট্যান্ট ন্যাগিং পড়াশোনা নিয়ে। নিজের অজান্তেই একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের একেবারে ভেতর থেকে। আরতি শেষ। এবারে মাঝবয়সীর দল ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে বিগলিত হাসি হাসি মুখে খোশ গপ্প চালাচ্ছে আর সের ওর শাড়ির পাড় , গলার হার , কানের দুল ছুঁয়ে নিচ্ছে। ভঙ্গী দেখেই বুঝছি শাড়ি কিম্বা গয়নার প্রশংসা করছে। এবারে বাড়ি গিয়েই শুরু হবে উল্টো কেত্তন , এ: দাশবৌদির শাড়ির রংটা দেখলে। বুড়ো বয়সে কাকাতুয়া পাখি সেজে বসে আছে।
    সত্যি দাশকাকীমা কেনেও বেছে বেছে এক একটা রং।

    মুখ ঘোরাতেই চোখ আটকে গেল আর একজোড়া চোখে।সেই অসম্ভব চকচকে একজোড়া চোখ। অমিতাভদা।প্রতিবার পুজোটার জন্যে শুধু এই দুটো চোখের জন্যেই বসে থাকি হাঁ করে।বরাব্বরের গুন্ডা একটা। সেই ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি। দিদিভাইদের ক্লাশেই পড়ত।টীচার্স রুমে বোম ফাটানো থেকে এমন কোনো অপকর্ম নেই যে অমিতাভদা নাকি করত না।আর তেমনি ইন্টেলিজেন্ট। আই আই টি তে পড়া এবারেই বোধহয় শেষ হবে।ছোটোবেলাতে বাড়িতেও আসত , আমি তখন বোধহয় বেশ ছোটো।বাড়িতে এলে দিদিভাইকে ডেকে দিয়ে নিজের কাজ করে বেড়াতাম।মাধ্যমিকের পরের পুজোটাতেই কেমন যেন সব বদলে গেল।যেখানেই যাচ্ছি দেখি একজোড়া চোখ আমাকে দেখেই যাচ্ছে। সেই চোখে চোখ পড়লেই ভেতর পর্যন্ত কেমন গুড়গুড়িয়ে উঠতো। সেই শুরু। এখন তো আমিই শিখে গেছি , চোখের খেলা।আর মাঝে মাঝে একটা দুটো কথার টুকরো।
    শুধু ঐটুকুতেই পুজোটা একটা উৎসব হয়ে যায়।

    অষ্টমীর সন্ধ্যেতে মন্ডপে পৌঁছাতেই মনা এসে গলা জড়িয়ে ধরে।"বাজারের নতুন আমদানী। একেবারে হাতে গরম।শংকর জেঠুরা এসেছে মালপত্র শুদ্ধ।' এবারে আমিও বেশ এক্সাইটেড। "ওমা এবছর দুজনেই ?বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রী??" শংকরজেঠুরা থাকে বম্বেতে। মানে জ্যেঠু , জেঠী , রাজা আর রাণা। জমজ ভাই। ফ্র্যাটার্নাল টুইনস। আমরা বলি মাল আর পত্র। দুজনকেই গা-শিউরানো হ্যান্ডসাম দেখতে। রূপাই অবিশ্যি বলে ডিলিসিয়াস।দু-তিন বছর পরপর জেঠুরা আসে দেশের মানে এই আমাদের দুর্গাপুরের দুগ্গাপুজো দেখতে।সে বছরগুলো সব মেয়েদের সাজগোজ আর ন্যাকামী অ্যাট লিস্ট তিরিশ পার্সেন্ট বেশি হয়।রাজা-রাণা এক একটা ফাটাফাটি পান্‌জাবী পরে মন্ডপে আর আমরা মেয়েরা কুকুরের মত হ্যা হ্যা করি।আমি খবর শুনে মা দুগার দিকে একটা বেশ শব্দ করে ফ্লাইং হামি ছুঁড়ে দিই।"জয় মা দুগ্গা ,প্রতি বাজার বাজার এমনি করেই গরম রেখো মা"।হাসির ফোয়ারার মধ্যেই টুয়ার প্রশ্ন "হ্যাঁ রে, ছেলেগুলো আজ গেল কোথায়। রাত নটা বাজে আর গোটা দলটা বেপাত্তা"।মনার ঝটিতি জবাব , "ক্লাব খোলা না বন্ধ।ভেতর থেকে বন্ধ হলে নিগ্‌ঘাত ভোডকা"। উফ্‌ফ মনাটা না বিদ্যুতের মত ভাবতে পারে। ওর এবারে যাদবপুর বাঁধা।আমার কি হবে কে জানে ।উফ যেন আর ই কলেজ না হয় মা। সেই বাড়িতে থাকতে হবে , সেই মায়ের বিরক্তি আর বাবার গোমড়ামুখ।ও দাদার জন্যেই ভালো। যাদবপুর না জোটে , জল্লুও চলবে। হস্টেলে থাকতে পেলেই হল। ক্লাবের দিকে যেতে যেতে আমি মন্ডপে মা দুগ্গার দিকে মুখ করে একবার মনে মনে প্রণাম করে নিই।

    ক্লাবের দরজায় ঠুকঠুক আওয়াজ করতেই ভেতর থেকে সাবধানী গলা পাপুর। "কে"।আমরা হাতে মুখ চেপে রাখি যাতে হাসির শব্দ না ভেতরে যায়।পাপু দরজা একটা ফাঁক করেছে কি , আমরা হৈ হৈ করে সব ভেতরে ঢুকি। মনা যা বলেছিল তাই। সবার হাতে গেলাস।চুপ চুপ। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ হয় ভেতর থেকে। ছেলেগুলোর মুখ তখন দেখার মত , ধরা পড়ে গিয়ে তস্য বোকা মুখের ভাব।এই সময় মনাই লীড নেয়। "হাতে কি"। রাজীবদা কিছু নয় কোক টাইপে একটা কি উত্তর দিতেই মিঠুর সে কি ধমকানি। "কোক যদি তো লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়া হচ্ছে কেন'।এবারে সব মুচকি হাসে।আমরাও আসল কথাটা পাড়ি প্ল্যান মতন।ভাগ দিলে মুখে কুলুপ। নইলে পাড়ায় ঢি ঢি।এবারে ছেলেগুলো বোঝে , খুব ঝগড়া করি আমরা সবাই। মিথ্যে মিথ্যে নকল ঝগড়া।অবশেষ সন্ধি।একটা বীয়ারের বোতল শুধু মেয়েদের জন্য।বোতল হাত বদলায়।একেক জনের দু ঢোঁকেই বোতল শেষ। রাজীবদার পকেটের পোলো এবার টুকরো টুকরো হয়ে সবার মুখে। আমরা মেয়েরা সব বেরিয়ে আসি ক্লাব থেকে।আরো একটু বড় হয়ে।

    রাত বাড়ছে। ধুনুচি নাচ প্রতিযোগীতা শুরু হল বলে। ছেলেরা সব ধুতি পরে তৈরী। উদোম গা। আমরা ওদের দেখে কানে কানে কথা বলি আর হেসে লুটোপুটি খাই।একটু দুরে আবছা অন্ধকারে একজোড়া চোখ জ্বলতেই থাকে , আর মুখে সিগারেটও।আমি সব হুটোপাটীর মধ্যেও ঐ চোখদুটো মাঝে মাঝে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিই।

    নবমীর সন্ধ্যেটা শুরুতেই মেজাজ গরম।অথচ আজই তো সবচেয়ে এনজয় করার প্ল্যান।পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের একসাথে বেড়াতে যাবার পারমিশন জোটালাম মাকে টুপি পরিয়ে।আর বাড়ি থেকে সেজে বেরতেই অমিতাভদা। "এদিকে শোন , তোর সাথে কথা আছে"।আমি চমকে যাই , থমকে যাই। অমিতাভদার গলাটা কি অসম্ভব অন্যরকম , ভারী অথচ কেমন মায়াময়। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে দাঁড়াই সামনে।"বোস , একটু সময় লাগবে"। আমি তখন প্রচন্ড দ্রুতগতিতে ভেবে চলেছি কি নিয়ে কথা থাকতে পারে। কয়েকটা কারণ ভেবেও নিয়েছি ঔটুকু সময়েই , ভেবে প্রচন্ডা নার্ভাসও বোধহয় হয়েছি আর ওদিকে তিনি শুরু করলেন প্রশ্নবান।জয়েন্ট , উচ্চ মাধ্যমিক , ফিসিক্স আর কেরিয়ার প্ল্যান নিয়ে। উফ্‌ফ।কি অসহ্য কি অসহ্য। আমি কোনোমতে কটা দায়সারা উত্তর দিয়ে যাই।হঠাৎ এসব ছেড়ে আসল কথায় " কাল ক্লাবে গিয়ে বীয়ার খেয়েছিস? অতগুলো ছেলের মধ্যে? ওদের কেউ যদি কাকু-কাকীমাকে বলে দেয় তাহলে কাকু-কাকীমা কিরকম শক্‌ড হবে ভাবতে পারিস"। আমার হঠাৎ কেমন অসুস্থ লাগে। বাবা-মার মুখ মনে পড়ে যায়। অমিতাভদা থামে না"তুই পড়াশুনায় এত ভালো , তোর প্রতি এত এক্সপেকটেশন আমাদের , তুই কেন ঐ অগা ন্যাকা মেয়েগুলোর সাথে এসব করে বেড়াবি"।এবারে দুটো শব্দে আমি আটকে যাই।আমাদের আর ঐ ন্যাকা মেয়েগুলো । দুটো শব্দই কি ভালোলাগা মাখানো।গা শিরশির করে আমার।আমি মুখ তুলে তাকাতেই চোখদুটো যেন ঝলসে ওঠে। আমি চোখে চোখ রাখতে পারি না বেশিক্ষণ।অমিতাভদাও যেন কিছুটা অসহজ এবারে।"এনিওয়ে ,এগুলোর ব্যাপারে এবারে এক্টু কনশাস হ।তুই অন্যদের থেকে আলাদা।এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট।যা কোথায় যাচ্ছিলিস" । আমি উঠে এগোতেই আবার ডাকে "শোন ,এটা কি পরেছিস ? ঘুঙ্গুর দেওয়া লুঙ্গি?"।বলেই মুচকি হাসে চোখদুটো। "দেহাতী তুমি একটা , ফ্যাশনের কিছু বোঝো না। ন্যাতার মত পান্‌জাবী পরে পুরো পুজোটা কাটিয়ে দিলে আর আমার এত সুন্দর স্কার্টকে লুঙ্গী বল।গেঁয়ো ভুত কোথাকার"। ভারী গলার হো হো হাসির মধ্যেই আমি মন্ডপের দিকে ছুটি। মন্ডপের দিকে। সব্বাই দল বেঁধে বুঝি আমার জন্যেও অপেক্ষা করেছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে মনাকে জড়িয়ে ধরি।"অত ফুত্তি কেন রে, রাজা-রাণারা মারুতি চেপে মামাবাড়ি গেছে আজ দুপুরে।সাজানো বাগান শুকিয়ে গেছে।কাঁদ একটু কাঁদ"।আমি রূপাইকে কাঁচকলা দেখাই।ঝলমলে আলোর মধ্যে আমরা একদল ঝলমলে কিশোর-কিশোরী ঠাকুর দেখতে বের হই ।

    দশমীর সকাল থেকেই আমি নিজের রুমে লক্‌ড ইন।প্লেয়ারে গান চালিয়ে আয়্‌নার সামনে এক মনে নাচ প্র্যাকটিশ করছি।এবার পুজোতে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেম ফাংশানে অমি এবারে নেই। পড়াশুনার চাপ।আজ সকালে কি ভেবে রাজীবদার সাথে দেখা করে বলেই এলাম নাচে আমার নাম রাখতে।রাজীবদা অবাক। "কি রে তোর না পড়াশুনার চাপ , সেদিন সটান না বলে দিলি যে"।
    "আমার গ্ল্যামারাস প্রেজেন্স ছাড়া তোমাদের ফাংশান তো ঝুলে ঝোল হবে , সেই ভেবেই দয়া করছি তোমাদের"।হি হি হাসি আমরা।
    বাড়ি ফিরে কি নাচ করি ভেবে কুলই পাই না। এবারে অন্যরকম কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে। অন্যরকম কিছু। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম অদ্ভুত সুন্দর সেই গানটা। ক্ল্যাসিক্যাল বেস্‌ড। এতদিন ধরে শেখা ভারতনাট্যামের কিছু সহজ মুদ্রা ঢুকিয়ে দিলেই জমজমাট। অমিতাভদা একধারে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে দেখবে আমায়। সুতোর কাজকরা কালো-হলুদ রাজস্থানী ঘাগরা পরে আমি সারা গায়ে আলো মেখে নাচব ঐ উজ্জ্বল চোখদুটোর জন্যে।

    "ভোর ভয়ে পনঘটপে
    মোরি নটঘট শ্যাম সাতায়ে.........."।
    আমি বিভোর হয়ে নাচি। নাচ শেষে মায়ের সাথে বাড়ির দিকে যেতে যেতে পেছনে তাকিয়ে দেখি চকচকে চোখে কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টি।

    বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডোরবেল।দাদাই বোধহয় গিয়ে দরজা খুললো। চেনা গলা। ভারী আর মায়াময় গলা। আমি পর্দার পাশে এসে দাঁড়াই। অমিতাভদা মাকে , ঠাম্মাকে প্রণাম করে সোফায় বসে। মায়ের সে কি আহ্লাদ। বোধহয় গোটা সব কেরিয়ার প্ল্যান জানা হয়ে গেল ক মিনিটেই। দাদার সাথে গল্প জোড়ে এবারে।মা বলেই চলে "আমার দুটোর যে কি হবে বাবা।বড়টা তো তবু আর ই তে পেল , ছোটোটার যে কি হবে। সারাদিন কেবল নাচন-কোঁদন। পড়াশোনাতে মনই নেই, তুমিই বোঝাও ওকে"। অতয়েব অমিতাভদা আমাকে বোঝাতে আসে। আমার রুমেই। বোঝায় না মোটেই। এদিক ওদিক স্ক্যান করে , এটা ওটা টান মারে , টুকটাক মন্তব্যও তো আছেই। আমি দেখে যাই আর হেসে যাই। মা মিষ্টি দিয়ে যাবার পর বসে পাশে এসে। " ছোটো একটা খবর আছে। বার্কলেতে পেয়েছি। স্কলও পাবো। ভিসা পেলে সামনের সেপ্টেম্বারের আগেই যেতে হবে"। আমি বুঝি না এটা ভালো না খারাপ খবর। খারপই হবে নিশ্চয়ই। অমিতাভদার মুখ করুণ আর আমার বুকে কান্না-কান্না।আরো কিছু বোধাহয় বলার ছিল কিন্তু অমিতাভদা উঠে পড়ে এবার। যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে। আমার ডানদিকের খোলা কটা চুলের গুছি কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলে "পরে আরও কথা হবে। ঠিক আছে?" আমি ঘাড় নাড়ি। বাইরের হলে আরো কিছু গল্প হয়। আমার কানে যায় সবই , মন পর্যন্ত পৌঁছায় না।

    পুজো শেষই হয়ে গেল। মন্ডপ থেকে ঠাকুর বের করে ট্রাকে চাপানো ও হয়ে গেল সন্ধ্যের মধ্যে। টাইম রেগুলেশান। শুধু এই বিসর্জ্জনের সন্ধ্যেটাতেই মা দুর্গার জন্যে কেমন যেন মন খারাপ করে ওঠে।পুজো শেষ হবার পর। পরশু থেকেই টিউশান। কালই পাড়া ফাঁকা হয়ে যাবে। অমিতাভদাও বরাবর চলে যায় দ্বাদশীর দিন সকালেই। ব্যাস আবার সেই সামনের বছর পুজোতে।কিম্বা হয় তো তাও নয় । মাঝেও তো আসে , কিন্তু ক্লাশ-টিউশানির মধ্যে জানতেও পারি না।পুজো ও শেষ আর আমার প্রেমও। ঠাসা ভীড়ের মধ্যেও নিজেকে হঠাৎ বড় একা লাগে।এই চারদিনে যেটা করতে সময় হয় নি , আজ সন্ধ্যেতে তাই করি। মা দুর্গার লাবণ্যময় হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করি। কিছু চাইতেও ইচ্ছা হয়। অথচ চাইতে নিজেকে দুর্বল আর স্বার্থপর মনে হয়। আর চাইবই বা কি ? যাদবপুরে ইলেক্ট্রনিক্স ? আর ঐ চুম্বকের মত চোখদুটো ?
    বেরিয়ে আসি ভীড় ঠেলে। মেয়েদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। অথচ কালই প্ল্যান হয়ে গেছে ট্রাকে করে দামোদর পর্যন্ত যাওয়া। পরের বছর তো কে কোথায় পড়ব , আর হয়ত কখোনো ই পারবো না এই সব করতে। কিম্বা হয়তো পারবো। কে জানে।

    প্রথম ট্রাক ছাড়ল বলে আর ঠিক সেই সময়ে পেছনে চিৎকার শুনে দেখি মেয়েরা হাজির। সবাই তিন নম্বর ট্রাকে চড়বে। আমরা দল বেঁধে এগিয়ে যাই। দু নম্বর ট্রাক পেরিয়ে যাবার সময় দাঁড়িয়ে যাই আমি। মাথায় সিন্দুরের টিকা ,এক মাথা উড়ো চুল , ঘামে মুখ চকচকে , দুটো চোখও। আমায় দেখেই ডান ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দেয় " বিসর্জ্জনে যাবি তো ? উঠে পড়"। আমি মেয়েদের দল খুঁজি। কোথায় এগিয়ে গেছে আমায় ফেলে। আমি আর ভাবি না। এক ঝটকায় টেনে তুলে নেয় অমিতাভদা আমাকে ছোট্ট একটা পুতুলের মত। বাতাসে আবীর ওড়ে। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। আমি অমিতাভদার চওড়া বুকের কাছটিতে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার খোলা চুল উড়ে গিয়ে অমিতাভদার মুখে গিয়ে লাগে।
    আমি অমিতাভদার হাত ধরেই থাকি।
    বিসর্জ্জন পর্যন্ত এবং বিসর্জ্জনের পরও।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৫৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন