এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • একটি আপাত পাশবিক গল্প

    মিঠুন ভৌমিক
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৩৭২ বার পঠিত




  • জীবনবন্ধু পালিতের বাড়ি ফিরতে রোজই একটু রাত হয়। নি:সন্তান, বিপত্নীক মানুষ, বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। ছোট বেসরকারী ফার্মের ক্যাশিয়ার, সন্ধ্যে পেরোলে হিসেব মিলিয়ে বাড়ি ফেরেন। জীবনবন্ধু নামটা একটু খটমট, তাই আপিসে সংক্ষেপে ওঁকে জীবনবাবু বলে ডাকেন অনেকে। কেউ কেউ আড়ালে জীবুবাবুও বলেন। এমনকি কানাঘুষোয় শোনা যায়, সদ্য জয়েন করা ছোকরা পিয়ন কানাই নাকি একবার পালুবাবু বলেও ডেকেছিলো। এসবই জীবনবাবুর গভীর দু:খের কারণ। পিতৃদত্ত নাম নিয়ে মস্করা জীবনবন্ধু একেবারেই পছন্দ করেন না। আরো কিছু কিছু ব্যাপার জীবনবন্ধুর ঘোর অপছন্দ। এই যেমন শীতকালে অঝোরধারায় বৃষ্টি, জামরুল, পৈতেবাড়ির নেমন্তন্ন কিংবা শিয়াল। আবার বেদানা, হঠাৎ করে আসা টিপটিপ বৃষ্টি, ছানার ডালনা আর কুকুর জীবনবাবুর খুবই পছন্দের জিনিস। পছন্দ-অপছন্দ নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার- জীবনবাবুর ক্ষেত্রে এই আপ্তবাক্য খাপেখাপ মিলে যায়।

    প্রতি বুধবার জীবনবন্ধু ফেরার পথে একঠোঙা তেলেভাজা কেনেন। পাড়ায় ওঁর একটা ন্যাওটা কুকুর আছে। কুকুরটা, বলাই বাহুল্য, নেড়িজাতীয়। জীবনবন্ধুর একতলা বাড়ির সামনের রোয়াকে রাতে ও দুপুরে গুটিশুঁটি মেরে ঘুমোয়, বাকিসময় এপাড়া-ওপাড়া সারমেয়সমাজের খবরাখবর সংগ্রহ করে। কুকুরটা একেবারেই খেঁকিপ্রকৃতির নয়, এবং অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন বলে জীবনবন্ধু ওর নাম রেখেছেন প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ নামটাও বেশ কঠিন, কুকুর তো কোন ছার, কোন কোন মানুষই ভালো করে উচ্চারণ করতে পারেনা। তাই পাড়ার লোক প্রহ্লাদকে পেলু বলে ডাকে।

    তো, যে কথা হচ্ছিল। জীবনবন্ধু শুধু বুধবার করে একঠোঙা তেলেভাজা কেনেন। তার অর্ধেক পায় পেলু। কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় কিনা তা গবেষণাসাপেক্ষ, তবে বেচুর দোকানের বাসি তেল দিব্যি সয়ে যায়। পেলুকে নধরকান্তি বলা যাবেনা, তবে সুস্থ-সবল-কর্মক্ষম কুকুরের জ্বলন্ত উদাহরণ হতে পারে সে।

    আজ বুধবার। জীবনবন্ধু অন্যান্যদিনের মত ক্যাশবাক্স বন্ধ করে, সমস্ত তালা ভালো করে পরীক্ষা করে, দারোয়ান চৌবেকে ছুটি দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। আগেই বলা হয়েছে, জীবনবন্ধুর বাড়িটা একতলা। পৈর্তৃক এই বাড়িটাই ওঁর একমাত্র স্থাবর সম্পদ। বাড়িটা বেশ পুরোনো, বহুদিন রোদজল খেয়ে কেমন ঘোলাটে রঙের হয়ে গেছে। বাড়ির এক তৃতীয়াংশ পাকা, বাকিটা টিনের চাল। তিনটে ঘরের একটা ব্যবহারের অযোগ্য, সেটায় বর্ষায় জল পড়ে। অন্যদুটির মধ্যে একটা দক্ষিণমুখো, সেইটাই জীবনবন্ধুর শোবার ঘর। অন্যটা গেস্টরুম। কিন্তু সেটা এমনি সময় জীবনবন্ধু রান্না-খাওয়ার জন্য ব্যবহার করেন, কারণ জীবনবন্ধুর বাড়িতে কেউ সচরাচর আসে না। নামের মত এই বাড়িটা নিয়েও জীবনবন্ধুর গর্বের শেষ নেই। নাম ও নামের মালিকের মত এই বাড়িটারও সৃষ্টিকর্তা অনাথবন্ধু পালিত,জীবনবন্ধুর পরলোকগত পিতা। জীবনবন্ধু এই বাড়িকে নিজের পরমাত্মীয় মনে করেন।



    হিরণের মন আজকাল প্রায়ই বেশ খারাপ থাকে। আকাশ মেঘলা হোক বা রোদে ঝলসাক, বাড়িতে ভোজ হোক বা উপবাস, হিরণ কেমন যেন গুমরে থাকে। ব্যাপারটা জনার্দন সাহু অনেকদিন লক্ষ করেছেন, কিন্তু ভেবে পাচ্ছেন না কিভাবে হিরণের ঠোঁটে হাসি ফিরবে। হিরণের মন ভালো রাখা জনার্দনের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। মাস দুই আগে একবার হিরণ মন খারাপ থাকায় হিসেবে গোলমাল করে ফেলে। সেদিন জনার্দনের ভারি লোকসান হয়েছিলো। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে জনার্দন ফাঁকি আর ঝুঁকি একেবারে বরদাস্ত করতে পারেন না। জনার্দনের নানান কারবার, নামে বেনামে লক্ষ টাকার যাতায়াত। খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে আজ তিনি কোটিপতি, ব্যবসায়ী সমাজের মাথা।

    গত তিনদিন ধরে হিরণ কিছুই খায়নি। জনার্দন চিন্তিত। অসময়ে, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের চিন্তা ব্যবসার ক্ষতি করে। জনার্দন ব্যবসার ক্ষতি টের পান। হিরণের সাথে তাঁর নীরব দৃষ্টিবিনিময় ঘটে। নির্বাক ও ইঙ্গিতবাহী সেই চোখাচোখির পরেও হিরণের হিরন্ময় নীরবতা ভাঙেনা। জনার্দন আরো-ই অধৈর্য্য হয়ে ওঠেন। এইভাবে চক্রাকারে মনখারাপ-ফাঁকি-ক্ষতি-আরো মনখারাপ, চলতে থাকে। জনার্দন বোঝেন হিরণের কাজে মন নেই। এই বেইমানি তাঁকে বিস্মিত করে। তবু জনার্দন রাগেন না। জনার্দনের মাথা চিরকালই ঠান্ডা।

    আজ অনেকদিন পরে হিরণের মনটা একটু অন্যরকম। চুপিসারে সে জানলার দিকে তাকায়। বন্ধ জানলার ফাঁকফোঁকর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া আলো দেখা যায়। বাইরে বোধহয় দুপুর এখন। হিরণ ঝিমোতে থাকে। এই ঝিমধরা দুপুর ওর ভারি পছন্দের। জানলার চোরাগোপ্তা ফোকর আর ঘুলঘুলির ভাঙা কাচ দিয়ে আলো ঢুকে দেওয়ালে পড়ে কারুকাজ হয়। হিরণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। বিমূর্ত শিল্প কি জিনিস সে জানেনা, সভ্য মানুষের যাবতীয় গুণাগুণ সম্পর্কে সে কিছুই জানেনা। সভ্য মানুষের প্রতিভূ হিসেবে ওর কাছে একজনই আসাযাওয়া করে। সে হলো জনার্দন সাহু। লোকটাকে হিরণ যে পছন্দ করে তা না। তবে খুব একটা অপছন্দও করেনা। বহুদিন ওর আদরে আছে সে। ওর পয়সায় খিদে মেটে তার। ওর বাড়ির ছাদ আর দেওয়াল ওকে শীত-গ্রীষ্ম ঢেকেঢুকে রেখেছে। কম দিন তো হলনা। হিরণ ভাবতে চেষ্টা করে। পারেনা। সে সংখ্যা জানেনা, সময় জানেনা, ভালোমন্দ, সুখ-দু:খ, ন্যায়-অন্যায় এইসব, আর আরো অনেক বোধই তার নেই।

    বেশিক্ষণ ভাবতে পারেনা হিরণ। আসলে সে ভাবতেও জানেনা। এসব সে ভাবে, না স্বপ্ন দেখে, না স্বপ্ন দেখার কথা ভাবে, কে জানে? এই এত্তটুকু অবস্থা থেকে সে এই পরিবারে আছে, সবাই জানে সে বাঁধা পড়ে গেছে এইখানে। জনার্দনও তাই ভাবেন।

    কিন্তু হিরণের মন কেমন উচাটন হয়। কুঁকড়ে যাওয়া পায়ের দিকে চেয়ে তার কেমন যেন লাগে। বাঁধনের বালাই নেই, তবু কিসে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে পা দুটো। জানলায় একটা দড়ি বাঁধা ছিলো। যদিও সে দড়ি রোদেজলে হাড় জিরজিরে। বহুক্ষণের অধ্যবসায়ে সেই দড়ি কেটে যখন চারতলার কার্নিশে নেমে দাঁড়ালো সে, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো সে। তারপর জড়সড় পায়ে লাফিয়ে চলে গেল পাশের বাড়ির ছাদে। গা-ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িদুটো। এই বাড়িটা তিনতলা, এই প্রতিবেশীদেরও সে চেনে ভালো-ই। ছাদের এককোণে কয়েকঘন্টা কাটিয়ে যখন সে ডানায় বল পেলো, ততক্ষণে ঘন অন্ধকার নেমে গেছে ঐ ছোট জনপদে। একবার ভালো করে পুরোনো বাসার দিকে দেখে নিয়ে, ডানা মেলে দিলো হিরণ। গাঢ় অন্ধকারে কেউ খেয়াল করলোনা তার পক্ষবিস্তার। একেবারে কেউ করলোনা বললেও ভুল হবে। জনার্দনের খাস চাকর ভোলার চার বছরের ছেলেটা হা-ঁচাউনি মেলে দেখলো বুড়ো প্যাঁচাটা সাদা ডানায় ঢেউ তুলে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।



    জীবনবন্ধু তেলেভাজা খেতে খেতে, ও পোষ্য প্রহ্লাদকে খাওয়াতে খাওয়াতে ফিরছিলেন। দিনের এই সময়টা জীবনবন্ধু প্রহ্লাদের সাথে অল্পস্বল্প হালকা আলোচনা করে থাকেন। ত্বকের ওপর
    অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব, খেজুর গুড়ের দর, উত্তরমেরুর সদ্য আবিষ্কৃত তিনপেয়ে বেজি বা রবীন্দ্রনাথের মত বহু আলোচিত বিষয় থেকে শুরু করে স্থানীয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদসমূহ, সবকিছু নিয়েই কথা হয়। বেশিরভাগই একতরফা কথাবার্তা, বুধবার ব্যতীত অন্যদিন প্রহ্লাদ মাঝেমধ্যে ঘৌ করে একটু আওয়াজ করে সমর্থন বা আপত্তি জানায়। বুধবার সেটুকু আওয়াজও পাওয়া যায়না। তেলেভাজার প্রভাবে কিনা কেজানে, বুধবার প্রহ্লাদ সমস্ত কথাতেই মৌনভাবে সম্মতি জানায়। জীবনবন্ধু একনাগাড়ে বকে যান। একেবারে বাড়ির দরজা এলে ওঁর বক্তৃতা থামে।

    তবে আজকে সামান্য ব্যতিক্রম হলো। জীবনবন্ধু অর্ধেকটা পথ এসে ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। বুধবার, তেলেভাজা, সময়, রাস্তা - সবই ঠিক আছে। তাঁর একতরফা বকবকানিরও কামাই নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম, প্রহ্লাদ আজ মৌন হয়ে নেই। দিব্যি অ-বুধবারীয় ভঙ্গীতে ঘৌ করে করে সঙ্গত করে যাচ্ছে! একমাত্র জীবনবন্ধুই প্রহ্লাদের দুটো ঘৌ-ডাকের তফাত করতে পারেন। সেই দুটো বিশেষ শব্দই, জীবনবন্ধুর মতে, প্রহ্লাদের হ্যাঁ এবং না।

    - আজ তোর কি হয়েছে রে? মন খারাপ?
    -ঘৌ
    -হুম। আরেকটা বেগুনি খাবি?
    -ঘৌ
    - হুম। কি বলছিলাম যেন?

    উত্তরে প্রহ্লাদ চুপ করে থাকে। ভাবে বোধহয়। অন্তত জীবনবন্ধু তাই ভাবেন। তিনি নিজেও তখন চিন্তার শাখা-প্রশাখায় হারিয়ে যাচ্ছেন। বক্তৃতার বিষয়, প্রহ্লাদ, এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে যায়। বাড়িটা দেখেও জীবনবন্ধুর মনে হয়, চিন্তান্বিত। অন্ধকারে অপ্রস্তুত হয়ে আগাছার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনবন্ধু ও তাঁর একতলা বাড়ি পরষ্পরের প্রতি চেয়ে লজ্জায় অধোবদন হন। দুজনেই নিজ নিজ ভূমিকায় ব্যর্থ হয়েছেন বলে কিনা, জানা যায়না। পুরোনো, নিত্যকার ব্যবহারে জীর্ণ দাম্পত্য প্রেমের মত দুজনেই নিজের কাজ করে সন্তর্পণে সরে থাকেন। জোড়াতালি দেওয়া চাহনি মেলে পরষ্পরকে আড়চোখে দেখে পালিয়ে যাওয়ার মত অনুভূতি হয় জীবনবন্ধুর। প্রহ্লাদের অবশ্য বিশেষ হেলদোল দেখা যায়না। কলহনিরত দম্পতির অবোধ শিশুসন্তানের মত সে সামনের রোয়াকে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে। বাড়িটাও, বলা বাহুল্য, নড়ে না।

    জীবনবন্ধু বাড়ি ফিরে একটু অবাক হন। একটু অন্যরকম লাগে বাড়ির পরিবেশ। মাটিতে পাতা ময়লা বিছানাটায় বসেন তিনি। কোন কাজেই তাড়াহুড়ো করা জীবনবন্ধুর স্বভাববিরুদ্ধ। মনে মনে পর্যালোচনা করে, স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে, তবেই তিনি নিজে নড়েন। সেদিনও ব্যতিক্রম হলোনা। অন্তত মিনিট চল্লিশেক বসে ভেবে, তারপর জীবনবন্ধু উঠলেন। উদ্দেশ্য, ঘরগুলো একবার পরীক্ষা করে নেওয়া। দামী জিনিসপত্র না থাকলেও বাড়িতে চোর আসে, এরকম শুনেছেন তিনি সহকর্মীদের কাছে।

    কিন্তু দু:খের বিষয়, দুটো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া গেলনা। এমনিতেই প্রায় খালি ঘর, দেখার তেমন কিছু ছিলো-ও না। তবু হা-ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে জীবনবন্ধু তৃতীয় ঘরটার দিকে চললেন। এই সেই ঘর, যেটা সারা বছর তালা দেওয়া থাকে। এখানে অনাথবন্ধুর ব্যবহৃত কিছু বাতিল জিনিস আছে। পুরোনো বই-খাতা-কলম, লাটাই, হিসেবের খাতা, ভাঙা পাইপ আর আসবাবের টুকরোটাকরায় ভর্তি সেই ঘর দিনের বেলাতেই দূর্ভেদ্য দূর্গের মত লাগে জীবনবন্ধুর। রাতের অন্ধকারে, টিমটিমে একটা টর্চ হাতে সেই ঘরে কি খুঁজবেন তিনি? তবু কর্তব্য বলে কথা। তাই দরজাটা খুলে ধুলোর মেঘ হাতড়ে আলোর সুইচটা টিপলেন। একবার বিদ্যুৎ চমকানোর মত করে বাল্বটা কেটে গেল। টর্চের আলোয় দেখলেন, দশদিক ব্যেপে ধুলো উড়ছে। হাঁচি ও ধুলোঝড়ে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার আগে কোনক্রমে দরজাটা বন্ধ করে জীবনবন্ধু পালিয়ে এলেন। ঐ ঘরে, অন্ধকারে, অত ধুলোর মধ্যে চোর কেন, একটা সাদা হাতি বসে থাকলেও তিনি দেখতে পাবেন না।



    সকাল হতে না হতেই খবরটা পান জনার্দন। খবরটা যে নিয়ে আসে, সেই ভোলাই সাথে ওষুধের শিশিটা এনে দেয়। জনার্দনের বুকে একটা ব্যথা ওঠে মাঝে মাঝে। সকালে খালিপেটে ঐ বড়ি গিলে তবেই তিনি বিছানা ছাড়েন। জনার্দনের স্ত্রী সুষমার বাতের ব্যামো থাকায় সুÙথ-সবল জনার্দন ওঁকে আলাদা ঘর দিয়েছেন। কুলোকে বলে সুষমার বাতের ব্যথা বাড়ার পর থেকেই নাকি সাহুবাড়িতে ডাগরডোগর ঝি-দের ভারি রমরমা, কিন্তু সবাই জানে সেসব ডাহা মিথ্যে। লোকের স্বভাবই এই। হিরণের অস্তিত্ব ঢেকেঢুকে রাখা সত্ত্বেও লোকের নজর এড়ায়নি। তারা সন্দেহ করে জনার্দনের বাড়িতে অবৈধ একটা কিছু আছে। সব বড়োলোকেরই অনেক শত্রূ থাকে। সব বড়োলোকের নামেই অমন বহু রহস্যময় কেচ্ছা থাকে। অনেক উঁচুতে ওড়া পাখি দেখলেই লোকে চিল-শকুনের কথা ভাবে- এ মানুষের স্বভাবের দোষ।

    জনার্দন সাতসকালে স্নান সেরে থানায় যান। সেখানে তাঁর বিস্তর জানাশোনা, তাই সরকারীভাবে নথিভুক্ত হওয়ার অযোগ্য বিষয়ও সেখানে পাত্তা পায়। তাছাড়া, বাড়িতে প্যাঁচা পোষা যে কুকুর-বিড়ালের মত সহজ ও আইনানুগ নয় সেকথাও জনার্দন বিলক্ষণ জানেন। হিরণ এমনিতে পালিয়ে গিয়ে যা দাগা দিয়েছে তা-ই জনার্দনের হার্টফেল করার জন্য যথেষ্ট হত, উপরি পাওনা হিসেবে এখন জেলের কথাও ভাবতে হচ্ছে। বছর চারেক আগে জনার্দন হিরণকে একটা আংটি পরিয়েছিলেন। সোনার জল করা আংটি, খোদাই করে জে এস লেখা। ওঁর এইসব আদিখ্যেতা করতে মন চায়নি, সুষমার জেদেই ঐ কাজ। সেই আংটি দেখে যে কেউ বুঝে নেবে প্যাঁচা কার। জে এস টেক্সটাইল্‌স, জে এস জুয়েলারি, জে এস ইত্যাদি ইত্যাদি নামের ব্যবসা ফেঁদেই জনার্দন মেলা টাকা করেছেন। সব জায়গাতেই কর্মীরা জে এস লেখা মনোগ্রাম করা টি-শার্ট পরে। এখন সেই মনোগ্রামই ওঁর মৃত্যুবাণ হয়ে উঠতে পারে।

    থানার দারোগা সদানিরন্ন ঘোষের মেজাজ কখনও ভালো থাকেনা। লোকে আড়ালে বলে দ্বিতীয় পক্ষের সাথে টালমাটাল যৌনজীবনই নাকি এর কারণ। সদানিরন্ন ঘোষ নিজের নাম নিয়ে একটু বিড়ম্বনায় ভোগেন বলে নেমপ্লেটে এস এন ঘোষ লেখা থাকে ও সর্বত্র সরকারী কাজে ঐ নামেই স্বাক্ষর করেন। শোনা যায় চাকরির প্রথম দিকে জনৈক সহকর্মীকে নাকি পুরো নাম জিজ্ঞাসা করার অপরাধে ঠেঙিয়েছিলেন তিনি। এখন অবশ্য সেসব অতীত। অম্বলে ও অন্যান্য সম্ভাব্য মুখরোচক কারণে সদানিরন্নর চেহারার দিকে তাকানো যায়না। জনার্দনকে দেখে তিনি, বলা বাহুল্য, মোটেই খুশি হন না। ঘুষখোর পুলিশ মাত্রেই এই দিনগুলোকে ভয় খায়। তারা জানে, এইসব ""বিপ্লবের"" দিনে ঘুষদাতা তার পয়সার দাম কড়ায়-গন্ডায় উসুল করে নেবে। ফাঁকিবাজ ছাত্রের কাছে বার্ষিক পরীক্ষা যেরকম, সদানিরন্নর কাছেও সেইরকম বিপজ্জনকভাবে অনিবার্য্য এইসব অন্যরকম দিন।

    - কি খবর ? এত সকাল সকাল? বাড়ি থেকে কেউ ইলোপ করলো নাকি?
    বলে নিজেই নিজের রসিকতায় হাসেন দারোগা। মনে মনে রসবোধের তারিফ করেন নিজের।
    - হি-- মানে, আজ ভোররাত থেকে প্যাঁচাটাকে পাওয়া যাচ্ছেনা।
    - বলেন কি? একেবারে বেপাত্তা? ঘর থেকে পালালো?
    - আর বলেন কেন স্যার। সবই বরাত। ভাবলাম বুড়ো হয়েছে, জানলার একটা পাল্লা ঢিলে, তা থাক। একটু আলোবাতাস খেলুক। শালা সেই ঢিলে পাল্লার দড়ি কেটে পালিয়েছে!
    বলে মনে মনে সদানিরন্নকে একটা খিস্তি দেন জনার্দন। দরকারের সময় পা-চাটা দারোগাকে স্যার বলতে হওয়ায় একটু একটু রাগ হয় তাঁর।
    - আচ্ছা হারামি তো! এতদিন খাওয়ালেন, তার একটা ইয়ে নেই?
    বলে আবার আনমনা হয়ে যান সদানিরন্ন। মনে মনে প্যাঁচাটাকে নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই পেরে ওঠেন না। তাঁর ভোঁতা কল্পনায় বারবারই হিরণকে নিজের মত লাগে। একই লোকের পয়সায় খেয়েপরে বেঁচে থাকা দুজন। কে নেমকহারামী করেছে ভাবতে গিয়ে নাজেহাল হন। খুবই জটিল হিসেব। খালি মনে হয় জনার্দনের আঙুলের গাঁটে গাঁটে কটা কাঠের রুল গুঁজে দলাইমলাই করলে ভালো হত! সদানিরন্ন কোনদিন অভিনয় করেন নি। তাই বেশি ভাবতে সাহস পান না। প্যাঁচাটার উদ্দেশ্যে দুটো অশ্রাব্য খিস্তি দিয়ে দুজন কনস্টেবলকে গাড়ি রেডি করতে বলেন। জনার্দনও গুম মেরে থাকেন। এখন পুলিশের মাধ্যমে প্যাঁচার ব্যাপারটা পাঁচকান হবে।



    বৃহস্পতিবার দিনটা জীবনবন্ধুর বেশ অপছন্দের। সোম, বুধ আর শুক্রবার তাঁর ভালো লাগে। শুভাশুভ বিচার না করেই তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। পছন্দ অপন্দের ব্যাপারে জীবনবন্ধু খুবই ধারাবাহিক। পনেরো বছর আগে যে দিনগুলো তাঁর ভালো লাগতো, আজও সেগুলো-ই ভালো লাগে। অন্যদিকে মঙ্গল আর বৃহস্পতিবার ওঁর দুচক্ষের বিষ। শনিবার আর রবিবার দিনগুলো ওঁকে আলাদা করে ভাবিত করেনি, তাই সেই দুটো দিন পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধে।
    তো, এহেন এক বৃহস্পতিবার আসা মাত্রই জীবনবন্ধু ভ্রু কুঁচকে শয্যাত্যাগ করলেন। গত রাতের কথা তাঁর আর এখন মনে নেই। বাইরে এসে দেখলেন প্রহ্লাদ বেপাত্তা। এখন সকাল। এই সময় সে অন্যপাড়ায় সর্দারী করতে যায়। জীবনবন্ধু সাতপাঁচ ভেবে আপিস যাওয়ার জন্য তৈরী হলেন। তারপর সদর দরজাটায় শিকল তুলে বেরোলেন। কিন্তু আজ কিনা বৃহস্পতিবার, মনটা খুঁতখুঁত করছিলো তার। আপিস যাওয়ার সময় প্রহ্লাদ কাছে থাকে কোন কোন দিন, ওকে দেখে মনে বল পান জীবনবন্ধু। বাড়িটা একলা পড়ে রইলো না ভেবে ভরসা পান। আজ প্রহ্লাদটা বাড়ি থেকে না বেরোলেই পারতো।

    আপিসে নির্বিঘ্নে পৌঁছে কাজে ডুবে যান জীবনবন্ধু। খেয়াল করেন না রাস্তায় ওঁকে দেখে কতজন মুচকি হেসেছে, কতজন চক্ষুলজ্জা ভুলে চেঁচিয়েই টিটকিরি দিয়েছে। জীবনবন্ধু এসব কোনদিনই গায়ে মাখেন না। বহু বছরের অভ্যাসে এসব মশা-মাছির মতই গা-সওয়া হয়ে গেছে ওঁর। আপিসেও চাপরাশি মুখ টিপে হাসে, পাশের টেবিলের টাইপিস্ট উনি আসা মাত্রই ডুকরে ডুকরে উঠে বাথরুমের দিকে চলে যায়। এসবই জীবনবন্ধুর রোজকার দেখা জিনিস। আজকাল চোখেও পড়েনা। চাপরাশিকে হাসাহাসি শেষ হলে চা আনতে বলেন, টাইপিস্টের টেবিলে একটা জরুরি ভাউচার কাগজচাপা দিয়ে রেখে দেন। তারপর অযুত হিসেবে আত্মসমর্পণ করেন।
    এইসব হাসাহাসি, পা-টানাটানি গা-সওয়া বলে, একটা জিনিস খেয়াল করতে ভুলে যান জীবনবন্ধু। ওঁর মত বাকিরাও ওঁকে দেখে বহুদিন আর তেমন করে হাসাহাসি করে না। কালেভদ্রে এইসব হয় আজকাল, খুবই বিরল মুহূর্তে। এই সেদিন তিনি একপায়ে মোজা পরতে ভুলে গেছিলেন, কেউ হাসেনি। তারও আগে, একদিন দুপুরের খাওয়ার সময় কি যেন মনে পড়ায় অর্ধেকটা খাবার ঠোঙায় ভরে তুলে রেখেছিলেন, আর পরে সবাই দেখেছিলো সেই ঠোঙায় লেখা আছে ""প্রহ্লাদের জন্মদিনের ভোজ"", সেদিনও কেউ আওয়াজ টাওয়াজ দেয়নি। আজ সেই হিসেবে একটা বিশেষ দিন। খেয়াল করলে হয়ত দেখতে পেতেন কেন আজ সবাই হাসছে। খেয়াল অবশ্য হলো, আরেকটু পরেই যখন বড়োবাবু ডেকে পাঠালেন।
    - আমায় ডেকেছিলেন স্যার?
    - হ্যাঁ। বসুন।
    জীবনবন্ধু বসেন। এসব সময় যেমনটি হওয়া দস্তুর, তাই হয়। বড়োবাবু, ব্যস্ত মানুষ, আরো খানিক কাজ সারেন। জীবনবন্ধু বসে বসে ওঁর বাহারি কাগজচাপা দেখেন, কোনের ফুলদানি দেখেন, তারপর আর কিছু খুঁজে না পেয়ে পর্দায় আধঢাকা কাচের জানলা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করেন।
    - আপনার বাড়িতে কি কোন গেস্ট এসেছেন? বাচ্চাকাচ্চা সমেত?
    - কই নাতো? জীবনবন্ধু হতবাক হন।
    - পাড়ার ছোট বাচ্চার সাথে ভাব আছে?
    - না। কেন বলুন তো?
    - জামায় আঁকিবুঁকি কেটেছেন কেন?
    জীবনবন্ধু আকাশ থেকে পড়েন।
    -আঁকিবুঁকি?
    - ইয়ার্কি মারছেন? সারা পিঠে অঙ্ক কষেছেন কেন? আপনি কি ভাবেন, এইসব করলে লোকে আপনাকে ইম্পর্টেন্স দেবে? আর, ঐসব কি লিখেছেন? জে এস খচ্চর? আপনি জানেন আমি আপনাকে আজই তাড়িয়ে দিতে পারি? জানেন জে এস কে?
    জীবনবন্ধুর আকাশ থেকে পড়া শেষ হয়না। অবাধে পতনশীল বস্তুর মত পড়তেই থাকেন। অনেক অনেকক্ষণ গালাগাল করে বড়োবাবু শান্ত হয়ে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেন। জীবনবন্ধু বাথরুমে গিয়ে দেখেন অভিযোগ মিথ্যে নয়। কে যেন সাদা জামার পিঠজুড়ে কালো প্যাস্টেল অঙ্ক কষেছে। সহজ যোগবিয়োগের অঙ্ক। আর সাথে সদ্যস্বাক্ষরের হাতের লেখায় ঐ তিনটি বিস্ফোরক শব্দ - "" জে এস খচ্চর""। তিনি জানেন জে এস কে? জে এস ঐ বেসরকারী আপিসের মালিক। জীবনবন্ধু ওঁকে কোনদিন দেখেন নি, পুরো নামও জানেন না। খুব জোর বেঁচে গেছেন ভেবে জীবনবন্ধু কাজে মন দেন।

    কিন্তু আদপেই তাঁর ভাগ্য অতটা ভালো না। কোনদিনই। তাই অনতিবিলম্বে বড়োবাবু একটা টেলিফোন করে মালিকের কানে ব্যাপারটা পৌঁছে দেন। বড়োবাবুর সত্যিই খুব টানাটানি চলছিলো তখন। ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, প্রাইভেট টিউটর আর বউয়ের নানান দাবি মেটাতে বেচারা হিমসিম। জে এস খবরটা শোনেন মন দিয়ে। তারপর জীবনবন্ধু সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জেনে নিয়ে বড়োবাবুকে একটা হালকা করে দাবড়ানি দেন। অবশ্য মাইনেটা সামান্য বাড়িয়ে দিতেও ভোলেন না।

    ফোন রেখেই জনার্দন তড়িঘড়ি ছোটেন থানায়। ঠিক হয়, পরেরদিন চুপিসাড়ে গিয়ে হিরণকে ছাড়িয়ে আনা হবে। তক্ষুনি কাজটা হলোনা দেখে জনার্দন মনে মনে বিরক্ত হন, ও দারোগার যথাসাধ্য বাপের শ্রাদ্ধ করেও আক্রোশ মিটলোনা দেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, ভোটের পরেই সদানিরন্নর কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেবেন।



    শুক্রবার সকালে ঘুম ভেঙে থেকেই জীবনবন্ধু উসখুশ করেন। আগেরদিন অতরাত্রে বাড়ি ফিরে তাঁর আর কিছু খেয়াল ছিলোনা। প্রহ্লাদ ছিলো, যেমন থাকে, তার ক্রমবর্ধমান ঘৌ-রবে তেমন কান দেননি জীবনবন্ধু। পাড়ার লোক রাতের দিকে ঢিলও ছুঁড়েছে কয়েকটা, তবু প্রহ্লাদ কাল একটু বেশিই ডাকছিলো। জীবনবন্ধুর অবাক হওয়ার কোটা গতকাল সকালের দিকেই শেষ হয়ে যাওয়ায়, তিনি আর অবাক হননি। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেও শুনলেন প্রহ্লাদ চাপা আওয়াজ করে রোয়াকে পায়চারি করছে।

    অতএব জীবনবন্ধু একটু আচ্ছন্নের মত দরজা খুলে প্রহ্লাদকে ঘরে ডাকলেন। প্রহ্লাদ ওঁর ঘরে এমনি সময় ঢোকেনা, ডাকলে তবেই আসে। সে আজ কিন্তু ডাকা মাত্রই একছুটে ভেতরে এলো, দুয়েকবার এদিকসেদিক শুঁকলো, তারপর বন্ধ, বাতিল ঘরটার সামনে গিয়ে তারস্বরে ডাকতে শুরু করলো। জীবনবন্ধু বুঝলেন ওঁর অবাক হওয়ার পালা আজকেও অব্যাহত থাকবে। কি খেয়ালে সদর দরজাটা বন্ধ করে এলেন। তারপর সেই পুরোনো টর্চটা হাতে বাতিল ঘরের দিকে এগোলেন।

    প্রথমটা সব একইরকম হলো। সেই একই ধুলোর মেঘ, সেই শস্তার টর্চে আবছায়া বানিয়ে দেখার চেষ্টা। একটু পরে অবশ্য ধুলো কমে এলো। আলো-ও একটু বেশি মনে হলো। ছাদের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন কেন। ফুটো ছাদের একটা অংশ খাবলা করে ভেঙে পড়েছে। তাই অত ধুলোবালি ঘরময়।

    জীবনবন্ধু অ্যাডভেঞ্চারের বইপত্র কস্মিনকালেও পড়েননি। অন্যকেউ হলে এতক্ষণে একটু স্নায়ুচাপে ভুগতো। ওঁর সেসব কিছু মনে হলোনা। ধুলো একটু কমতেই গটগটিয়ে টর্চ নিয়ে ঢুকে পড়লেন ঘরে। প্রহ্লাদও এলো, একটু কিন্তু কিন্তু করে। কুকুরের ইতস্তত ভাব লক্ষ করে জীবনবন্ধু চমৎকৃত হলেন। ক্রমশই প্রহ্লাদের সমস্ত অভিব্যক্তি ওঁর কাছে জলের মত সরল হয়ে আসছে।

    আবছায়ায় চোখ সয়ে এলেই ঘরটা ভালো করে দেখা গেল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে দেখলেন পুরো ঘরটাই অজন্তা-ইলোরার গুহার মত। চারটে দেওয়াল জুড়েই অসংখ্য অঙ্ক কষা আর এলোমেলো হস্তাক্ষরে জনৈক জে এস নামের ব্যক্তিকে খিস্তিখাস্তা করা হয়েছে। এমন এমন গালাগাল, যা জীবনবন্ধু আগে কোনদিন শোনেননি। মানেও জানেন না। তবে পড়ে মনে হলো লক্ষ্যব্যক্তির ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে ঐ শব্দগুচ্ছ। অঙ্কগুলো খুবই সহজ, শিশুকৃত চার নিয়মের অনুশীলন বলে ভুল হয়

    আরেকটু খুঁজলেই লেখক আবিষ্কৃত হলো। দিনের আলো দেখে হিরণ একটা পুরোনো সেলাই বাক্সের পেছনে লুকিয়ে ঝিমোচ্ছিলো। অবিলম্বে ধরা পড়ে গেল। তার ঠোঁটে কালো প্যাস্টেলের দাগ লেগে বেশ একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা হয়েছে। সামনেই পড়ে ছিলো প্যাস্টেলের বাক্স। অনাথবন্ধুর স্ত্রী, জীবনবন্ধুর মা, সুধাময়ী দেবী সেলাইয়ে দড় ছিলেন। ঐসব তাঁরই সম্পত্তি।

    জীবনবন্ধু অবাক হলেন না। বলা বাহুল্য, ওঁর সেদিনের অবাক হওয়ার কোটাও ফুরিয়ে গিয়েছিলো। বরং কোথাও একটা অন্যরকম লাগছিলো ওঁর। অন্যরকম কিছু, ছটফটানি, কেমন যেন বুকের কাছটা দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রহ্লাদের দিকে তাকানো মাত্রই সেও একটা সমর্থনসূচক ঘৌ করলো। হিরণ ততক্ষণে ধীরেসুস্থে দেওয়ালের কাছে গিয়ে নিজের নামের নিচে আন্ডারলাইন করে পরিচয় ঘোষণা করে ফেলেছে। নামটা সে আগেই লিখে রেখেছিলো। এখন ঝিমোতে ঝিমোতেই একটু মাথা দোলালো সে। জীবনবন্ধু, এবং খুব সম্ভবত প্রহ্লাদও, লক্ষ করলেন, প্যাঁচার মুখটা হাসিহাসি।

    যেকোনো পরিস্থিতিতেই হঠাৎ করে কিছু করে ফেলা জীবনবন্ধুর ধাতে নেই। কিন্তু আজ কিভাবে যেন কি হয়ে গেল। জীবনবন্ধু এক মুহূর্তেই কর্তব্য স্থির করে ফেললেন।



    দুপুরের একটু আগে জনার্দন সাহু আর সদানিরন্ন ঘোষকে জীবনবন্ধুর বাড়ির সামেন দেখা গেল। সাথে একজন কনস্টেবল আর খাঁচাহাতে জনৈক হাবিলদার। চারজনের দল সদর্পে হাট করে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলো সামনের ঘরে একটা ন্যাতন্যাতে বিছানা পাতা। নোংরা কাঁথাটাথা দিয়ে করা বিছানা, সাতজন্ম কাচা হয়নি। ঘরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে পশমের মত কি যেন। ইতস্তত ভাঙা নখের কুচি, আর একটা জল খাওয়ার ছোট গামলার মত।

    পরের ঘরটা, লোকে বলে জীবনবন্ধুর রান্নাঘর। সেখানে গিয়েও দেখা গেল একটাও বাসন নেই। প্রচুর তেল চিটচিটে ঠোঙা স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে। এই ঘরেও কিছু পশমের মত কিসব দেখা গেল। পরের ঘরটার দেওয়ালচিত্র দেখে চারজন লোকের চাররকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। জনার্দন মুখ লাল করে প্যাঁচার উদ্দেশ্যে গালাগাল দিতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে চুপ করে গেলেন। সদানিরন্নর অট্টহাসি পাশের বাড়ি থেকেও শোনা গেছিলো বলে লোকে দাবি করে। যদিও সামান্য পরে সেও চুপ করে যায়। সামনেই ভোট আসছিলো, আর জনার্দনের জেতা একরকম সময়ের অপেক্ষা। কনস্টেবল আর হাবিলদার যে যারপরনাই আমোদিত হয়েছিলো তাতে সন্দেহ নেই। এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী না হলেও দীর্ঘপ্রভাবী। মনের গাঁটে-গিঁটে জমে থাকা ক্ষোভ আর ঘেন্না ধুয়ে দিয়ে নতুন ক্ষতস্থানের জায়গা করে দেয়। প্যাঁচার সাহিত্যকর্ম যে ঘরে শোভা পাচ্ছিলো, সেই বাতিল ঘরেও আর তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ফাঁকা ধুলোবালি ভর্তি ঘর, বাকি দুটোর মতই। জনার্দন বেরিয়ে এসে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে একবার বাড়িটার দিকে তাকান। জীবনবন্ধুর একতলা বাড়িও, তার ভাঙাচোরা ফোকলা চেহারা নিয়ে মূর্তিমান রসিকতার মত চেয়ে থাকে ওঁদের দিকে।

    জীবনবন্ধু, প্রহ্লাদ এবং তাদের সদ্য আলাপী হিরণ, এদের কাউকেই আর ঐ এলাকায় দেখা যায়নি।

    ছবি- সায়ন করভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৩৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন