এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  শিক্ষা

  • অনলাইনের ফস্কা গেরো

    কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত
    আলোচনা | শিক্ষা | ২১ জুলাই ২০২১ | ২৩১২ বার পঠিত
  • বিগত দুদশক ধরে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষণের বিকাশ আমরা দেখেছি। বিগত কয়েকবছরে MOOC (Massive Open Online Course) একটি জনপ্রিয় শিক্ষামাধ্যম হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কলেক বিশবিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে। এবং বিগত দিনগুলিতে আমরা বহু মঞ্চে এই বিতর্ক দেখেছি যে অনলাইন ক্লাস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিস্থাপিত করতে পারবে কি না? শিক্ষা কি তার গুরুমুখাপেক্ষী চেহারাটা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু, এও দেখেছি যে এই সমস্ত বিতর্কের শেষে সভার মত এই থেকেছে যে অনলাইন শিক্ষা চমৎকার জিনিস, কিন্তু তা প্রথাগত ক্লাসরুমের প্রতিস্থাপক নয়, পরিপূরক বড়জোর। এই আবহে এল করোনা অতিমারী, যার প্রেক্ষিতে এই চলমান বিতর্কটা সরিয়ে ফেলে সমস্বরে নীতিনির্ধারকেরা ঘোষণা করে দিলেন- ভারত পড়ে অনলাইন। আর, শেষ দেড়বছর, অন্ততঃ আমাদের দেশে পড়াশুনো মানেই অনলাইন। মজার ব্যপার, প্রথম বিশ্বের দেশগুলি, অনলাইন পড়ানোর প্রকৌশল ও রেস্তঁ যাদের বেশি, তারা কিন্তু যেভাবে হোক ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষতঃ প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে স্কুল সেভাবে অনেকে বন্ধ হতেই দেয় নি। আমাদের দেশে শিশুশিক্ষাও ক্লাসরুম বন্ধ রেখে চলছে, উল্টোদিকে। যেখানে তর্কাতীত ভাবে এইদেশে সর্বস্তরে অনলাইন পড়াশুনোর প্রযুক্তি-পরিকাঠামো নেই। এবং তর্কাতীত ভাবে ইস্কুলের পড়াশুনো স্কুল বন্ধ রেখে চালানোর মূল ধাঁচাটাই এখনও তৈরি হয় নি। ফলে, যে প্রশ্নটা সবার আগে জাগে, যে কী হতে যাচ্ছে? ইস্কুল-কলেজের পড়াশুনোকেই আমরা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের মূল স্তম্ভ হিসেবে এতদিন জেনে এসেছি, সেইখানে এই বিপর্যয়ের ফল কী হবে? নাকি বিপর্যয়ই দেখিয়ে দেবে নতুন ভবিষ্যত? সেইসব প্রশ্ন নিয়েই রইল করোনাকালের লেখাপড়া নিয়ে এই আলোচনাগুলি।

    দিনকাল বদলে যাচ্ছে। এ কথা শুধু আমরা কেন, আমাদের বাবা, ঠাকুরদা, তস্য ঠাকুরদা পর্যন্ত চাপা দীর্ঘশ্বাস সহযোগে বলে আসছেন সেই কোন স্মরণাতীত কাল থেকে। এই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলে নেওয়াই একালের পরিভাষায় হল -- 'আপডেটিং'। ওই তালটি কাটলেই অনাসৃষ্টি! পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই এখন যেমন অফিস, ইস্কুল সবই ঢুকে এসেছে শোবার ঘরে, আর আমরাও বুঝতে শিখে গেছি ন'টার মধ্যে প্রাতরাশ পর্ব সারতে না সারতেই বাড়ির ছাত্র/ছাত্রী, আপিস-বাবু/বিবি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ বা নিদেন মোবাইল ফোনের সামনে 'ইয়েস প্লিজ' বলে যেই না হাজির হয়ে যাবেন, ঘরের বাইরে ঝুলে যাবে অদৃশ্য 'নো এন্ট্রি' বোর্ড -- বিনা নোটিসে অনুপ্রবেশ বন্ধ। সীতা-মিতা-অনিমা বা শেফালিকে দিয়ে তার আগেই সারিয়ে রাখতে হবে দিনগত পাপক্ষয়, 'অপারেশন ঝাঁটা-বালতি'। জামাকাপড়, ওষুধবিষুধ থেকে শুরু করে টাকাপয়সা, চিরুনি কিংবা মশলার কৌটোর মতো জরুরি বা আপাত-তুচ্ছ যাবতীয় জিনিসপত্র আগে থেকে সরিয়ে রাখতে হবে সেইসব রূপান্তরযোগ্য ঘর থেকে। অভ্যেস করতে হবে ঘরের বাইরে শব্দহীন ক্যাট ওয়াক, ইশারায় বা নিচু ডেসিবেলে মৃদুভাষণ, কিংবা রান্নায় শুকনোলঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বন্ধ দরজার ওপারে কর্মরত মানুষদের হাঁচির উদ্রেক না-করা। ফ্ল্যাটবাড়ির অল্প পরিসরে প্রতিদিনের এই অনলাইন ড্রিল বড় সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু গৃহস্থ নাচার।

    যতদূর জানা যায়, এ জাতীয় ভার্চুয়াল ক্লাসরুম বা আপিসঘরে দৃশ্যমানতা কিঞ্চিৎ উচ্চস্তরের, মানে পর্দার ক্যামেরার নজর ব্যক্তির ঊর্ধ্বাঙ্গটুকুতেই সীমাবদ্ধ। ‘বিলো দ্য বেল্ট’ ইনফরমাল হলে সমস্যা নেই। বাঁকুড়ার গামছার সঙ্গে শার্ট-টাই-ব্লেজার পরে উচ্চপর্যায়ের মিটিং চলছে দেখলে অতএব ভিরমি খাওয়া নিষ্প্রয়োজন। মিটিংধারী দাঁত খিচিয়ে বলবেন, "তাতে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হচ্ছে,শুনি! আমি তো আর এই পোশাকে সমুদ্রসৈকতে সেলফি তুলতে যাচ্ছি না।" ক্যামেরা চালু করা যে ক্লাসে জরুরি নয়, তার ড্রেস কোডে আবার রংচটা, ফুটোফাটা ভেন্টিলেটেড গেঞ্জিও নাকি চলতে পারে। তা বলে পরীক্ষার দিনেও? দইয়ের ফোঁটা অবসোলিট হয় হোক, পাটভাঙা জামাটুকু তো অন্তত পরবে!

    চাদর দিয়ে পরিপাটি করে বইয়ের তাকে ঢাকতে ব্যস্ত পুত্র পিছিয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষমাসুন্দর হাসে, "আরে বাবা, এ হল 'এ আই প্রক্টরড' পরীক্ষা। কোন হিউমান ইনভিজিলেটরই নেই। রোবটিক আই কি আমার জামা দেখবে?" কৃত্রিম মেধার যন্ত্রচক্ষুর নজরদারিতে লিখতে বসা, সেও কি খুব সুখের ব্যাপার? মশা মারতে বা পা-চুলকাতে নড়াচড়া করলেও সেসব কার্যকারণ বোঝার দায় যন্ত্রমগজের কি আর থাকে? কে জানে! অথচ সে নিয়মভঙ্গের সিগন্যাল দিলেই তো ব্যস, পরীক্ষা বাতিল। এদিকে পরীক্ষায় বসার আগে মঞ্চসজ্জা চলছে তখন-- "একটা কিছু সাপোর্ট দাও তো, 'থার্ড আই'-টা রাখব।" তৃতীয় চক্ষু? সে তো জানি দুই ভ্রূর মাঝ বরাবর... বেচারি মায়ের থতমত দৃষ্টি কপালের দিকে ধাবিত হয়। "আরে ধ্যাত্তেরি, থার্ড আই মানে হল মোবাইল ফোন। ল্যাপটপের ক্যামেরা আমাকে দেখবে, আর থার্ড আই নজর রাখবে আমার হাতের দিকে। মানে, লেখা ছাড়া আর কিছু যদি --।" পুত্র ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

    পরীক্ষার যে নিয়মাবলী অন্তর্জালে দেখা গিয়েছিল, তাতে বলা ছিল, লিখতে লিখতে কোনকিছু খাওয়া, পান করা, ধূমপান, এমনকি চিউইং গাম চিবোনো পর্যন্ত বারণ। এক ক্যান্ডিডেটের মাই ডিয়ার বাবা বললেন, "একা ঘরে বসে পরীক্ষা দিতে হলে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া, জল বা অন্য কিছু সিঞ্চনের দরকার পড়াটা তো আশ্চর্য কিছু নয়। অবশ্য পরীক্ষার সময়ে নেশা টেশা--।"
    ছাত্র পিতার অজ্ঞতায় মজা পায়, "ইউ আর টু ইনোসেন্ট, বাবা। সবকিছুকে ভ্যালুজের সঙ্গে গুলিয়ে ফ্যালো। আসলে স্মোকিং, ইটিং, ড্রিংকিং, সবগুলোতেই মেজর রিস্ক ফ্যাক্টর হল 'চোথা'। সিগারেটের পাকানো কাগজ, খাবারের প্যাকেটেও টুকলির ইনপুট থাকতে পারে। চিউইং গাম বলে কাগজ চিবোলে কে বুঝবে?"
    --"তা বলে চা, কফি কিংবা 'ইয়ে'তে?"
    --"হ্যাঁ, রিস্ক তাতেও আছে। কাপ বা গ্লাসের তরলে যে ওয়াটার-প্রুফ কালিতে লেখা 'চিট' ভাসছেনা, সে গ্যারান্টি কে দেবে!"

    এমন পরীক্ষার সাক্ষী থাকাও এক অভিজ্ঞতা বটে। সাত কিংবা আটের দশকের পরীক্ষার দুরু দুরু স্মৃতি মানসচক্ষে ভাসে। বাসে, ট্রামে বা রিকশা চড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে পরীক্ষার সেন্টারে যাওয়া। সিট পড়ত অচেনা স্কুলকলেজে। গার্ড দিতেন অপরিচিত মুখের শিক্ষকেরা। টিফিনেই সময়ে সন্দেশ আর ডাব হাতে অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভিড় গেটের সামনে। পরীক্ষা শেষের ঘন্টা বাজলেই সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত অস্পষ্ট গুঞ্জন আর কাগজের খসখস। খাতা জমা দেবার জন্যে ইনভিজিলেটরের অসহিষ্ণু তাগাদা। গার্ডকে জল্লাদ মনে হত সেসব মুহূর্তে। আজকের এই নববিধানে ছবিটা কত আলাদা। ঘড়ির কাঁটায় সময় ফুরোয় আপন মনে। ছাত্র 'সাবমিট' বোতাম টেপে। দু'দশ মিনিট এদিক ওদিকও যে হয়না তা নয়। খাতার পাতা স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট মেল আই ডি-তে। খেল খতম। প্রযুক্তির কায়দা কানুন দেখে আমাদের মতো পুরনো জমানার মানুষদের চোখ কপালে ওঠে। তখন কি ছাই জানি, পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়! কপালে তোলা চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হবে আর একটু পরেই।

    হাল আমলের কায়দাকানুনের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদে একদিন উঁকি দিয়েছিলাম ইউ টিউবের জ্ঞানভাণ্ডারে। একটি ভিডিওতে বেশ পরিষ্কার করে বলা আছে দেখলাম, প্রশ্নপত্র ধরে ধাপে ধাপে কীভাবে এগোতে হবে, নিজেকে পরিদর্শকের চোখে দৃশ্যমান রাখতে পরীক্ষার্থীর কী কী করণীয়, ইত্যাদি। এইরকম শ্যেনদৃষ্টির সামনে এত কম সময়ে এত বেশি সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর যারা দেয়, দিয়ে মুঠো মুঠো নম্বর পায়, তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আর ওই নত হতে গিয়েই বোধহয় চোখ পড়ে যায় ঠিক নিচেরই আর একটি ভিডিওতে -- নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারিনা, ঠিক দেখছি তো? সে ভিডিওর শিরোনাম, 'চিট ইন অনলাইন টেস্ট'। ঝকঝকে এক তরুণ চমৎকার আত্মবিশ্বাসে প্রাঞ্জলভাবে শেখাচ্ছে বজ্র আঁটুনিকে ফস্কা গেরো করে তোলার কৌশল। আগের ভিডিওতে সাহস দেওয়া হল, ক্যামেরার সামনে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বলে ভয় পাবার কিছু নেই। এটিতে সেই সাহসটাকেই দুঃসাহস করে তুলতে বলা হল, হাল ছেড়ো না বন্ধু, শুধু শিখে নাও কম্পিউটারের ক্যামেরাটিকে 'ফ্রিজ' করে হাতসাফাইয়ের কায়দা। তোমার 'প্রক্টর' বা গার্ড জলজ্যান্ত বা যন্ত্রচালিত,
    যা-ই হন, তাঁর বাবারও সাধ্যি নেই তোমাকে বমাল সমেত পাকড়াবার! বাইরে থেকে 'শুভানুধ্যায়ীদের’ পাঠানো প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয় একটি মোবাইলের পর্দায় দেখে নিতে তাকে ঠিক কোন কৌণিক অবস্থানে রাখতে হবে আমার মতো নিতান্ত অযান্ত্রিকেরও দেখলাম বেশ সড়গড় হয়ে গেল সেটা। বাধ্য হলাম প্রযুক্তিকে যুক্ত-করে প্রণাম জানাতে।

    এ জীবনে যত টুকলি চর্মচক্ষে দেখার সুযোগ ঘটেছে বা রোমহর্ষক যত টুকলির গল্প এযাবৎ শুনেছি, তারা যে এর কাছে নস্যি সে বিষয়ে আর সন্দেহ রইল না কোন। কলেজে দেখেছি ক্লাসরুমের দেওয়ালে বেঞ্চির উচ্চতা থেকে ওপরে কয়েক হাত পর্যন্ত পেন্সিলে লেখা নোট দূর থেকে আল্পনার মতো শোভা পায়। পরীক্ষার সময়ে দেওয়ালের কাছাকাছি বসার জন্যে সে কী কাড়াকাড়ি। একবার ছুটির পরে পরীক্ষা। কলেজ খোলার দিন দেখা গেল পুরো বিল্ডিংয়ে রং হয়েছে। ক্লাসে সেদিন বুকফাটা হাহাকার --"হারামজাদারা চুনকাম করার আর সময় পেল না !" কাঠের কালো হয়ে যাওয়া হাই বেঞ্চে সেবার কে যেন ‘লাইসেন্সিং পলিসি’ লিখে রেখেছিল। একটু বেঁকেচুরে আলোর সাহায্য নিয়ে তবেই পড়া যাবে, দূর থেকে বোঝা দুষ্কর। ওই বছরে সে প্রশ্ন নাকি শিওর শট। তক্কে তক্কে ছিল ডাকাবুকো ছেলের দল। গায়ের জোরে যার সিট তাকে সরিয়ে প্রশ্নপত্র দেখার আগেই খাতায় টুকে ফেলেছে সেটা। কোন চান্স নেওয়া নেই। যদি তাদেরও তুলে দেয়! যে পেপার যত শক্ত, তাতে ছাত্রদের বাথরুমে যাবার দরকার পড়ে ততই ঘন ঘন। তাদের সাহায্যার্থে অ্যাকাউন্টেন্সি, অডিটিং-এর মোটা মোটা বই বোঝাই করে রাখা কমোডের সিস্টার্নে। রসিক অধ্যাপক গার্ড দিতে এসে বললেন, "বাড়ি থেকে বইগুলো বরং বালতি করে আনিস। বালতিতে জল থাকবে আর সিস্টার্নে বই। নাহলে তো টয়লেটে ঢোকা যাচ্ছে না।" আমাদের উঁচু পাঁচিল ঘেরা মেয়ে ইস্কুলে টোকাটুকির অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ বিশেষ ছিল না। তবে একবার এক টুকলি দেখে যুগপৎ এতটাই মুগ্ধ এবং উত্তেজিত হয়েছিলাম যে নিজে বেশ কটা প্রশ্ন লিখতেই পারিনি। আমাদের চেয়ে নিচু ক্লাসের একটি মেয়ে দেখি দুলে দুলে লিখছে। পরীক্ষার হলে এরকমটা ঠিক চোখে পড়ে না। হঠাৎ নজর গেল ওর ডেস্কে। সেখানে আস্ত ইতিহাস বই খোলা। গার্ড যেই কাছে আসছেন, সে দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে আর পেটের ধাক্কায় বই ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে, গার্ড এগিয়ে গেলে আবার চেয়ার পিছিয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে বই।

    মেয়েদের শাড়ির প্লিটে, ছেলেদের কলারের কিংবা হাতার ভাঁজে চিরকুট রাখার কথা সবাই জানে। কোন এক টুকলিসম্রাটের জুতোর সুকতলা থেকে পাওয়া চিরকুট ইনভিজিলেটর এসে কেড়ে নেবার পর তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "ওটা তো শুধু ইনডেক্স ছিল, স্যার। কোথায় কোন নোটটা রেখেছি তার সূচিপত্র।" আবার কেউ কনুইয়ের ওপর তাগা পরার কায়দায় বেঁধে রেখেছে মোটা গার্টার, যাতে রোল করে রাখা নোট লেখা লম্বা কাগজ। ফুলহাতা শার্টের কব্জির কাছে সেই কাগজের ল্যাজ নেমে আসছে দরকার মতো, আবার কাজ মিটলে গোল হয়ে গুটিয়ে ফিরে যাচ্ছে গার্টারের তাগায়। টোকাটুকি নিয়ে এমন মিথ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বাবার মুখে শুনেছিলাম, টুকলির চোথা সাপ্লাইয়ের জন্যে এক টুকলিবিশারদ নাকি বাড়ি থেকে ইস্কুল অবধি সুড়ঙ্গই কেটে ফেলেছিল। অর্থাৎ এই শিল্পটি বয়সে নেহাত নবীন নয়। এক অঙ্কের মাস্টারমশাই তাঁর সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে পাশের বন্ধুর খাতা দেখে নকল করতে গিয়ে ভারি হেনস্থা হয়েছিল তাঁর। তখন টোকা ব্যাপারটাও হয়ত ঠিকমতো জানেন না। অন্যের খাতায় মনোযোগ দিতে গিয়ে খেয়ালই করেননি কখন স্যার চুপিচুপি এসে তাঁর নিজের খাতাটাই নিয়ে চলে গেছেন। হুঁশ ফিরেছে ক্লাশসুদ্ধ ছেলেমেয়ের হাসিতে। সেদিনের পর থেকে লজ্জায় বহুদিন স্কুলেই যেতে পারেনি ছোট্ট ছেলেটি। বাড়িতেও লেখাপড়ার তেমন চল ছিল না, চাষির ঘরের 'ফার্স্ট জেনারেশন লিটারেট', তাই বাড়িতেও কেউ অত খেয়াল করেনি ছোট ছেলেটির ভাবান্তর। কিন্তু সেই ইস্কুলের স্যারই একদিন বাড়িতে এসে ডেকে নিয়ে গেছিলেন তাকে। আলাদা করে ইস্কুলের পরে পড়িয়ে অঙ্কের ভীতি কাটিয়ে আত্মবিশ্বাসে বদলে দিয়েছিলেন সেটাকে।

    অঙ্কের মাস্টারমশাই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন, তাই নিজেকে শুধরে নেবারও সুযোগ পেয়েছিলেন। আজকের শিক্ষা বাজারের এই 'হাই টেক' চুরি আদৌ ধরা পড়ে কি না জানা নেই। জানা নেই তাৎক্ষণিকভাবে জিতে যাবার পর এই মূলগত অক্ষমতা আর বিন্দুমাত্রও লজ্জিত করে কিনা শিক্ষার্থীকে। খামতিটা পরে হলেও পুষিয়ে নেবার কোন বাসনা তৈরি করতে পারে কিনা। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে যে কোন উপায়ে তাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে মরিয়া হয়ে দৌড়চ্ছে, পৌঁছানোটাই সেখানে বড় কথা, পদ্ধতিটা নয়। সব ছাত্রছাত্রী কখনওই অসৎ নয়, কিন্তু অল্প কিছুর ভুল পন্থা তাদের প্রতি সাধারণ বিশ্বাসটা নষ্ট করে দেয়। 'এরা তো সব টুকে পাস করেছে'-- এ জাতীয় দায়িত্বহীন, অসম্মানজনক উক্তি করে ফেলতে শোনা যায় অনেককেই। আজ যারা উচ্চশিক্ষার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, কিছুদিন পর সমাজ এবং সিস্টেমের সার্বিক দায়িত্ব তাদেরই ওপর বর্তাবে। ভয় হয়, আজকের যে অভিমন্যুরা চক্রব্যূহে ঢোকার অনায়াসলব্ধ রাস্তাটা চালাকির সাহায্যে চিনে নিল, সেই একই উপায়ে ব্যূহ থেকে বেরতে তারা পারবে তো?


    ছবি: র২হ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ জুলাই ২০২১ | ২৩১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Anindita Roy Saha | ২২ জুলাই ২০২১ ১৫:২৭495986
  • অনলাইন পরীক্ষা ওপেনবুকএক্সামিনেশন (OBE)নয়? 


    সেক্ষেত্রে তো কেবল বইয়ের কোথায় কী রয়েছে সেটা জেনে রাখলেই হয়। 


    দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত OBE হচ্ছে। 

  • সুদেষ্ণা মৈত্র | 42.110.154.140 | ২৩ জুলাই ২০২১ ২০:৩৭496020
  • ভালো লাগল 

  • সুদেষ্ণা মৈত্র | 42.110.154.140 | ২৩ জুলাই ২০২১ ২০:৩৭496021
  • ভালো লাগল 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন