এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হোটেল ম্যানেজার - ১২

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৩২৩ বার পঠিত
  • বুধবার পড়ন্ত বেলায়  মনীষা পাল হৈ হৈ করে এসে পড়ল তিলোত্তমা লজে। হোটেলে খাওয়ার দাওয়ার পাট চুকে গেছে ততক্ষণে। সুরেশ, ননীরা তাস খেলতে বসেছে চৌকির ওপর। দুলাল কাউন্টারে বসে হিসেব মেলাচ্ছে।
    এই সময়ে মনীষা পাল এক গাল হেসে সেখানে আবির্ভূত হল।অপ্রত্যাশিতভাবে ওকে দেখে দুলাল বলল, ‘ আরে .... বৌদি ! কি ব্যাপার ? খাবেন তো ? এ..ই ননী.... ‘
    — ‘ না না .... খাব না । আমি ভাত খেয়েই বেরিয়েছি। .... রুম নেব না। রাত্রেই ফিরে যাব । ‘
    — ‘ ও আচ্ছা .... এখানে বসুন তা’লে। চা খাবেন তো ? ‘
    — ‘ না এখন না । পরে খাব। ‘
    — ‘ ঠিক আছে ।’ দুলাল আবার খুচরো পয়সা গোনায় মন দেয়। ননীগোপালরা তাস খেলতে থাকে তাসের দান ফেলা নিয়ে উচ্চৈস্বর তর্কবিতর্ক করতে করতে।
      এই সময়ে পিনাকপাণি আর অর্ণাশ্রী লজ থেকে বেরিয়ে কোথায় একটা গেল। বাপি ওদের সঙ্গে কিছুটা গিয়ে একটা রিক্শায় তুলে দিল। রিক্শায় ওঠার আগে পিনাক বাপিকে কি সব বলছে।শুনে বাপি কোন কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ছে।
    ওরা চলে গেলে বাপি দোতলায় উঠে ননীদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাস খেলা দেখতে লাগল। 
    এদিক থেকে মনীষা ডাক দিল, ‘ কি রে বাপি , কেমন আছিস ? ‘
    দুলালের কাউন্টারের দিকে নজর ঘোরাতে বাপি দেখল মনীষা বসে আছে।
    — ‘ আরে বৌদি .... কখন এলেন ? দাদা কোথায় ? ‘
    — ‘ দাদা আসেনি । আমি একাই এসেছি। আজকেই চলে যাব। এ..ই তোদের দেখতে ইচ্ছে করল তাই চলে এলাম।’
    — ‘ খুব ভাল করেছেন। আজকের রাতটা থেকে গেলে ভাল করতেন।’
    — ‘ না রে .... আজকে হবে না। ছেলেটাকে রেখে এসেছি। শুভঙ্করও বাড়ি নেই। হলদিয়ায় গেছে ব্যবসার কাজে। বান্টিকে পাশের বাড়িতে ছোট জা-এর কাছে রেখে এসেছি। আর একদিন এসে থাকব’খন।’ 
    বাপি মনে মনে বলল, ‘ শালা হলদিয়ায় গেছে ব্যবসার কাজে না ছাতার মাথা। খুব শিগ্গীর খেল খতম হবে । মনীষা বৌদির জন্যে কষ্ট হয়। ইশশ্ ..... এত ভাল লোক।’

      অমিতাভদের ভি আর এস অ্যাপ্লিকেশান ফর্ম ভর্তি করা হয়ে গেল আজকে। তিরিশে সেপ্টেম্বরই এ কোম্পানিতে শেষ দিন। দুশ্চিন্তার ঢেউগুলো খানিক ঘুমিয়ে পড়েছিল মনীষার কথা শুনে ।আবার জেগে উঠছে মন উথাল পাথাল করে। অন্যদিন অলোকের সঙ্গে অফিস থেকে বেরোয় অমিতাভ। রাস্তায় নানারকম কথা বলতে বলতে আসে। বেশির ভাগই অফিস সংক্রান্ত কথাবার্তা। আজকে আর কথাবার্তা বলার মেজাজে নেই অমিতাভ। সে একাই বেরিয়ে এল পৌনে ছটা নাগাদ। আপন মনে নানারকম আবোলতাবোল চিন্তা করতে করতে। এলোমেলো দিশাহীন জট পাকানো সব ভাবনা। হাঁটতে হাঁটতে তিলোত্তমার সামনে পৌঁছে গেল অমিতাভ। 
    দেখল গেটের মুখে দাঁড়িয়ে সামনের রোল চাওমিনের দোকানদার শরতের সঙ্গে কি সব বকবক করে চলেছে মনীষা পাল। দোকান সামলাচ্ছে শরতের খুড়তুতো ভাই গনেশ। মনীষা অমিতাভকে দেখে হারানিধি ফিরে পাবার স্টাইলে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বলে উঠল— ‘ আরে কেমন আছেন মশায় ! ....’ তারপর অম্লানবদনে বলল, ‘ এতক্ষণে সময় হল ?আমি সেই কখন থেকে বসে আছি আপনার অপেক্ষায়। আমাকে তো ফিরতে হবে নাকি ?’ এমন খোলামেলা সম্ভাষণ  শুনে শরৎ আর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মোগলাই পরটার খরিদ্দার মিটিমিটি অর্থবহ হাসি হাসতে লাগল।  হাটের মাঝে এই অতি আন্তরিকতার উচ্ছ্বাসে অমিতাভ বেশ বিব্রত বোধ করতে লাগল। কিন্তু মনীষা যথারীতি নির্বিকার।
       অমিতাভ খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘ এক্ষুণি যাবেন কেন ? আজ রাতটা থেকে যান।’
    — ‘ না : থাকা যাবে না। বান্টিকে রেখে এসেছি ছোট জা-এর কাছে। ও বান্টিকে সামলাতে পারবে না। জানেন তো ও কিরকম দুরন্ত ....’
    অমিতাভ মনে মনে ভাবল— তা আর জানিনা ! যার কাছে আছে, নিশ্চয়ই তার হাড় ভাজা ভাজা করে দিচ্ছে ।
    মনীষা বলতে লাগল, ‘ তাছাড়া শুনলাম, কোন ঘর খালি নেই। সাত নম্বরে, মানে ওই যে ঘরটায় আমরা ছিলাম সেটায় নাকি কলকাতার কোন ঝাঁ চকচকে স্মার্ট মেয়ে ঢুকেছে। সে যাকগে, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভাল হল। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই তো এলাম।’ 
    অমিতাভ এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল কেউ শুনছে কিনা। মনীষার ওসবের কোন প্রয়োজন নেই। সে তার কথা থামাল না— ‘হ্যাঁ ভি আর এস-এর কথা কি বলছিলেন ? সেটা কবে হচ্ছে ? ‘
    অমিতাভ বলব না বলব না করেও মনীষার দুর্লভ আন্তরিকতা ও বিচিত্র সারল্যের কাছে হার মেনে বলেই ফেলল— ‘ এই তো এসেই গেল.... তিরিশে সেপ্টেম্বর ।’
    মনীষা বেশ বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ভঙ্গীতে বলল, ‘ ও আচ্ছা । কি করবেন ভেবেছেন কিছু ? ‘
    — ‘ ন্ ..... ন্না .... মাথা এত ঘোঁট পাকিয়ে আছে যে এখনও কিছু ভেবে উঠতে পারিনি। ‘
    মনীষাকে আবার অন্যরূপে দেখা গেল। ‘সিরিয়াস’ গলায় অফিসের বড় কর্ত্তার স্টাইলে  বলল, ‘ ঠিক আছে , দেখছি .... একদম চিন্তা করবেন না। ফ্যামিলিকেও চিন্তায় রাখবেন না। আমি দু সপ্তাহের মধ্যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব । ‘
    মনীষার বক্তব্য ঠিক পরিষ্কার হল না অমিতাভর কাছে। সে বলল, ‘ মানে ... কি ব্যাপারে .... ঠিক.... ‘
    — ‘ কি ব্যাপারে আবার ! এই ... অন্য কোন কাজকর্মের ব্যাপারে.... আবার কি ? বসে থাকলে কি আপনার চলবে ? দেখা যাক .... ‘
    এ কথার প্রত্যুত্তরে কি বলা উচিৎ অমিতাভ ঠিক করে উঠতে পারল না। প্রথমত তার ওপর মনীষার এই অদ্ভুত স্নেহ বা যত্নশীলতা তার মনে বারবার জটিল ধাঁধার জন্ম দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত শুভঙ্কর পাল সম্বন্ধে বাপির কাছে যা শুনেছে তা যদি সত্যি হয় তা হলে এদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখা মোটেই নিরাপদ ব্যাপার নয়। তৃতীয়ত মনীষা যদি সত্যিই সদুপায়ে কোন উপকার করতে সক্ষম হয় সেটা গ্রহণ করে ওর কাছে ঋণী থাকা উচিৎ হবে কিনা। 
    এত প্রশ্নের ফয়সালা এক লহমায় করা যায় না। সে আপাতত: অসংলগ্নভাবে বলল, ‘ হুঁ .... তাই তো ...  ঠি..ক  ঠি..ক .... ‘ 
       মনীষা আরও ঘন্টা দেড়েক ধরে এর সঙ্গে ওর সঙ্গে আড্ডা মেরে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাসে উঠে গেল।
                     ...........      ..........    ..........
       
        ওদিকে, তার পরদিন সকাল প্রায় সাতটায় শান্তিনিকেতনে কোপাইয়ের ধারে গভীর ঘন স্তব্ধ বাতাবরণে  নিখিল বাসিমুখে একাকী গিয়ে দাঁড়াল । এত সকালে এখন কেউ নেই এখানে । সড়সড় করে শুধু সরস বাতাস লুটোপুটি খাচ্ছে আপনমনে। এদিক থেকে ওদিক। নীরব অঙ্গনে  অমল বাতাসের ফিসফিসে চুপি চুপি অশ্রুত সুরধারা বয়ে যাচ্ছে অষ্টপ্রহর নিরন্তর। নিখিল ওখানে 
    একা একা দাঁড়িয়ে রইল।নিখিলের মনে হল সে যেন নিখিলের বাণী শুনতে পাচ্ছে। তার মন প্রাণ মনোরম আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। ভৈরবী আভোগে একটা অশ্রুত সুর যেন  বাতাসে হংসপাখার মতো ভেসে এসে তার শিরায় এসে বাজতে লাগল— ‘ আজি নিখিলের বাণীমন্দিরে খুলেছে দ্বার ...... তাই কি বীণায় লাগালি যতনে নূতন তার ..... ‘। লুটোপুটি খাচ্ছে বন্ধনহীন হাওয়া। খোয়াইয়ের শুকনো নদীর বুকের ভিতর বাঙ্ময় নুড়িগুলো পড়ে আছে অলস বিশ্রামে। বোধহয় দিন গুনছে কলকল ছলছল আগামী বর্ষার প্রতীক্ষায়।
    সব সুর তাল কেটে দিয়ে এই মুহুর্তে বেমানান কর্কশতায় নিখিলের মোবাইল বেজে উঠল। নিখিল স্ক্রীনে চোখ রেখে দেখল— ‘অনিন্দিতা কলিং ‘
    নিখিল তাড়াতাড়ি লাইন কেটে দিল এবং মোবাইল সুইচড অফ করে দিল।
    ( ক্রমশ : )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন