এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • আমার ধর্ম অধর্মবোধ--মুক্ত কর প্রাণ ২

    রুখসানা কাজল
    ধারাবাহিক | ১০ আগস্ট ২০২২ | ১১০৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • দুই

    এমনিতেই জাতপাতের নিয়মে বিশ্বাসী হিন্দুদের কাছে মুসলিমরা ছিল অচ্ছুৎ। ভারতবর্ষে ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্রাম্মাণ্যবাদে বৌদ্ধরা ছিল প্রচন্ড ঘৃণ্য। মনুসংহিতায় মনু বলেন, ‘কেউ যদি বুদ্ধকে স্পর্শ করে তবে সে স্নান করে নিজেকে শুচি শুদ্ধ করে নেবে।’ বিষ্ণু পুরানে বৌদ্ধদের মহামোহ উপাধি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যারা এমনকি বৌদ্ধ সন্তানদের সাথে কথাও বলবে—তাদের নরকে যেতে হবে।’ (প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু- শ্রামণ প্রশিক্ষণ ও সাধণা পরিবেণ, রামু, কক্সবাজার)
    ইতিহাস সাক্ষী, পূর্ববাংলার অধিকাংশ মুসলিমদের পূর্বপুরুষ ছিল, ব্রাম্মণদের কাছে ঘৃণ্য পরাজিত বৌদ্ধধর্ম অনুসারী (বাঙ্গাল ভাষায় ন্যাড়া বলে সেজন্য ) এবং ব্রাম্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নির্যাতিত শুদ্র-নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। তবে কি ঘৃণা তুচ্ছতার এই ফাঁক গলে রুক্ষ, শুষ্ক, আরবীয় ভূমিতে আবির্ভূত হওয়া জাতপাতহীন ইসলাম ধর্ম ঢুকে পড়েছে ভারতবর্ষে ?
    এটি কিন্তু ভেবে দেখার মত একটি বিষয়। এত এত মুসলমান এলো কোথা থেকে ? এ সব কি তলোয়ারের কারিশ্মা ? ঘৃণা নেই ? জাতপাতের বৈষম্যের সুযোগে নীচু বলে দেগে দেওয়ার অহংকারী আস্ফালন আর নিপীড়ন কি ছিল না ?
    তবে কি ঘৃণা একটি ভূমিজ মানসিক সংস্কৃতি ? এরই পরম্পরা বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা ? হিন্দুর হাতে বৌদ্ধ, মুসলমানের হাতে হিন্দু, আবার হিন্দু-মুসলিম, মুসলিম-হিন্দু – অনাদি কালের এই ঘৃণা নদী আমরা কি পেরুতে পেরেছি এই যুগে এসেও ? পারিনি বলেই কি সৃষ্টি হচ্ছে গুজরাট, মুজাফফরনগর, দিল্লী, নাসিরনগর, কুমিল্লা, নড়াইলের মত একের পর এক রক্তাক্ত ক্ষতগুলো ?
    ঘৃণাটৃনা যাই থাকুক না কেন, মোষ্ট ইন্টেরেষ্টিং ব্যাপার হল, নারীদের ক্ষেত্রে সব ধর্মের কিন্তু এক এবং অভিন্ন ফতোয়াবাদী মুখ। এই এক চিমটি উনিশ কুড়ি ছাড়া। একই রকমের তুচ্ছতার নির্দেশনা রয়েছে প্রতিটি ধর্মে। বিধি বিধান আইনকানুন সব নারীদের জন্য। প্রাচীন ধর্মগুলোর কথা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নবীন ইসলাম ধর্মের কথাই বলি। মোল্লা হুজুররা শীত গ্রীষ্ম যখনই ওয়াজে বসে, তাদের মূল টার্গেট থাকে নারী। কসাই যেভাবে মাংস টুকরো করে তেমনি নারীর স্তন, জঙ্ঘা, উরু, নিতম্ব, ভ্যাজাইনা, নাভী ঠোঁট, চোখ মাথা সবই তাদের ওয়াজে থাকে— থাকে না শুধু হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)এর বিদায় হজ্জ্বে দেওয়া মানবিক দিকগুলোর বিশদ আলোচনা।
    ইসলাম ধর্মের সূত্রপাত হয় ৬ শত খ্রিস্টব্দের প্রথম দিকে হয় ( নবীজীর জন্ম আনুমানিক ৫৭০ খৃষ্টাব্দে) সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলামকে নবীন বলতেই হয়। পৃথিবীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়ে গেছে তারও আগে। রাজনীতি, ক্ষমতা এবং জ্ঞানচর্চায় নারীরা প্রকাশ্য ছিল। কিন্তু নবীন ধর্ম ইসলাম এসে পর্দা দুলিয়ে দিল। নারীরা কেবলই হয়ে উঠল, উর্বরা শস্যক্ষেত্রে। পশ্চাৎপদ। অবগুন্ঠনবতী। ধর্মসূত্রে শক্তিশালী মুসলিম পুরুষের ক্রীড়া সামগ্রী। ইচ্ছে অনিচ্ছের দাসানুদাসী। খাও। শোও। এবার চিৎ থাকো। উপুড় হও। হামা দাও আর লাগাতার গর্ভবতী হও। নইলে তালাক ! তালাক !! তালাক !!! এবার দূর হয়ে যাও স্বামীর দেহমনে সুখ যোগাতে না পারা বদনসীব আওরত।
    তাই ত শরিয়া আইনে এত ভয়। বুক কাঁপে আফগানিস্তানের অবস্থা দেখে।
    অথচ মোল্লা হুজুররা একথা কখনও বলে না, নারী-পুরুষ উভয়কেই মুহাম্মাদ (সাঃ) শিক্ষা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, জ্ঞানঅন্বেষণ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ধর্মীয় কর্তব্য । ( যাওয়াদ হাইফা এ ( ১৯৯৮০। দ্য রাইটস অব ইসলাম অ্যান অথেনটিক অ্যাপ্রোচ লন্ডন ইংল্যান্ডঃ পলগ্রেভ ম্যাকমিলান। পৃষ্ঠা ৯। আইএসবিএন ৯৭৮ -০- ৩৩৩- ৭৩ ৪৫৮- ২।)
    চোখের সামনে বাংলাদেশ ডুবে যাচ্ছে। ‘সুজন সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’ জন’ সখ্যতার হিন্দু মুসলিম ঐক্য আর থাকছে না। না জেনে না বুঝে হিন্দু ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ কোরআন এবং নবীজীকে নিয়ে কটুক্তি করছে। আর উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে একদল মুসলিম। জ্বালাও পোড়াও, মারো, কাটো। কেউ ভেবে দেখছে না, এক সময় পৃথিবীতে বহুবিবাহ এবং বাল্য বিবাহের মচ্ছব ছিল। মুহাম্মাদ (সাঃ) কতগুলো বিয়ে করেছে তা দিয়ে ত ভাত জুটবে না। চাকরীও হবে না। থাকুক মুসলিমরা ওদের বহুবিবাহকারী নবী নিয়ে। ওদিকে মুসলিমরাও বুঝতে চাইছে না, এসব কথায় তাদের প্রিয় নবীজী বা ধর্মের কি আসে যায়। ঈমান ঠিক থাকলেই সব ঠিক। বলে বলুক যত খুশী বলে যাক।
    মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এসব বড় কোন যড়যন্ত্রের অংশ নয় ত ! পাতানো খেলা ! বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দেওয়ার ঘরভেদী, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক কোন নীলনক্সারই একটি চুম্বক অংশ।
    এ ষড়যন্ত্র থামানো দরকার। কিন্তু কে বা কারা থামাবে ? রাজনীতি এখন ঠিকাদারি ব্যবসার মতই লাভজনক। নির্বাচনের আগে দেওয়া সম্পত্তির হিসাব আর নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির হিসাব দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। এ দৃশ্য কেবল বাংলাদেশের তা নয়। ভারতে জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা হচ্ছে কোটি কোটি টাকায়। টাকার পাহাড় পাওয়া যাচ্ছে ঘরকে ঘর। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া। পাকিস্তান লাগাতার অস্থিতিশীল। আফগানিস্তান অন্ধকারে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের মোড়কে মোড়া ধর্মবাদী স্বৈরতন্ত্র।
    পৃথিবীতে এক সময় আদর্শের জন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রাণ দিয়ে শহিদ হতেন এখন টাকা টাকা করে প্রাণ ভরে উঠলেও তৃষা মিটছে না বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক চোর ছ্যাঁচ্চোড়দের।
    বাস্তবে সংগঠিত আন্দোলনে যাওয়ার মত কোন রাজনৈতিক দল নেই বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি( ফরহাদ-মনি সিং) নেই হয়ে গেছে। ছুটকো ছাটকা কম্যুনিষ্ট দল বলে যারা আছে তারা রাজনীতিতে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে। ঐক্য নেই তাদের। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তো অনেক আগেই জামাতে ইসলামীর পবিত্র পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আসছে নির্বাচন যদি স্বচ্ছ হয় তবে ধর্মীয় দলগুলোর বিজয় সুনিশ্চিত। তাই যদি হয় তো, দৃশ্যমান ৯ পার্সেন্ট হিন্দু জনগনও হয়ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। কিন্তু প্রগতিশীলদের কি হবে ?
    মুন্ডু কাটা পড়বে ঘরে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে ট্রেনে। নারীরা হবে ঘরবন্দী। মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেমন পাশে ছিল এবার সে সম্ভাবনাটুকু নেই বলে মালুম হচ্ছে। কারণ ভারত জুড়ে যে ধর্মীয় জাগরণের জয়যাত্রা তাতে বাঙ্গালী অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলাও ক্রমশ গেরুয়া রঙে দুলে যাচ্ছে। ৩০ জুন, দমদম এয়ারপোর্ট। যে ট্যাক্সি নিয়েছিলাম, গন্তব্য জেনে ড্রাইভার ছেলেটা বলে উঠেছিল, জয় শ্রীরাম। দিদি বুঝি বুদ্ধিস্ট ?
    জয় শ্রীরাম বলে মাথা যদ্দুর কাত করে হ্যা বলা যায় তাই বলে ওর নাম ধাম, ট্যাক্সি নম্বর জেনে বন্ধুকে জানিয়ে দিলাম। আজকাল সময় এবং জীবন নিয়ে খেলতে আমার ভাল লাগে। আমার চৌদ্দ পুরুষ মুসলিম ছিলেন না। বংশলতিকা পাঁচ ছয় পুরুষ পেছু হাঁটলেই পুরোহিত গন্ধ বেরিয়ে পড়বে হয়তবা। আমি আরামসে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, গোবিন্‌ মুসলিম জানলে তুমি কি আমাকে যাত্রী করতে ?
    গোবিন্দ জানায়, সামনে ইলেকশনটো দেখুন না দিদি।
    বাকি কথাগুলো শুনে দিব্য দেখতে পেলাম ঢাকায় আমার এপার্টমেন্টের নীচে আমজাদ ড্রাইভার আর গোবিন্দের মন আর ভাষার কি অথৈ ঐক্য। এই প্রথম কলকাতাকে কিছুটা ভয় লাগল। এ শহরে আসতে পেলে আমি মামাবাড়ি আসার আনন্দ পাই। হাজার বার শোনা রাস্তাগুলোয় যখন পা রাখি, মনে হয় অই তো আমার তরুণ পিতা কিশোরী মাকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দুটিতে সিওর নাটক দেখবে জমিয়ে।
    আমি গোবিন্দকে একটি স্বপ্ন দেওয়ার চেষ্টা করি, গোবিন মনে কর মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, চার্চ, গুরুদোয়ারাগুলো প্রতিটি শহর বা গ্রামের এক প্রান্তে থাকবে, যে যার মত ধর্মপালন করে ফিরে আসবে নিজের ঘরে --
    মহাবোধী আশ্রমে এসে গেছি। ফিরে যাওয়ার আগে গোবিন্দ বলে যায়, মুসলিম লোগকো সাথ—কাভি নেহি দিদি।




    (ক্রমশঃ)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১০ আগস্ট ২০২২ | ১১০৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • R | 203.18.35.200 | ১০ আগস্ট ২০২২ ১১:০৮510902
  •  
    এই খবর টা ভাল লাগল। 
     .আশায় বসতি করি। 
     
     
     
     
    প ড়ন্ত বিকেল। ডানা মেলে পাখিরা দল বেঁধে ছুটছে। আকাশে সাদা-কালো মেঘের খেলা। সেই মেঘের আড়ালে লুকোচুরি করছে সূর্য। সেই সূর্যের আলো এসে পড়েছিল রঙিন টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা ঘরগুলোতে। এতে ঘরগুলো চকচক করছে।
    এ যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আর এ দৃশ্যের দেখা মিলল রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া বড়করিমপুর গ্রামে। এটি জেলেদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
    গত বছরের ১৭ অক্টোবর ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার একটি পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ তুলে রাতের অন্ধকারে ওই গ্রামের হিন্দু জেলেদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। ওই রাতে উত্তেজিত জনতার হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান জেলেরা। আগুনে পুড়ে যায় ধান-চাল জাল কাপড়চোপড় গরু রিকশা-ভ্যান বসতবাড়িসহ সবকিছু। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন জেলেরা। এ ঘটনায় ওই সময় পীরগঞ্জ থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় চিহ্নিত আসামিদের। পরে নিঃস্ব জেলেদের সাহায্যে এগিয়ে আসে সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা। ব্যক্তিগতভাবেও দেশের অনেকে সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এতে ক্রমান্বয়ে জেলেরা আতঙ্ক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন।

    ওই ঘটনার প্রায় ১০ মাস পর গত সোমবার বিকেলে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রীতিমতো চলছে আনন্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন। গ্রামে নেই আতঙ্ক, ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার নেই কোনো চিহ্ন। যে যাঁর মতো গ্রামে-মাঠে কাজ করছেন, বসে গল্প করছেন। জেলেরা অনেকে মাছ ধরে বাড়িতে ফিরছেন। চকচক করছে গ্রামের রঙিন টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা বসতবাড়িগুলো।
    সরেজমিনে দেখা গেল, পাশের বটেরহাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন দোকানে ও গ্রামের ভেতরে সম্প্রীতির সুবন্ধন। হিন্দু–মুসলমান একই সঙ্গে বসে চা পান করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন এবং বাজার করছেন।
    বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে ওই গ্রামের ননী গোপাল (৬০) তাঁর নতুন বসতঘরের বারান্দায় শুয়ে ছিলেন। এই প্রতিবেদকদের দেখে উঠে বসেন। কেমন আছেন, জানতে চাইলে বলেন, ‘ভগবানের আশীর্বাদে এখন খুব ভালো আছি। দালানের নয়া ঘর পাছি, অনুদান পাছি। অ্যালা হিন্দু–মুসলমান সবায় একসঙ্গে খাওচি-দাওচি-ঘোরোচি কোনো সমস্যা নাই।’ তবে কথা বলতে বলতেই কিছুটা আনমনা হয়ে যান ননী গোপাল।
    এরপরে ওই রাতের ভয়াল চিত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাইতোত খায়াদায়া ছইল-পইল নিয়া ঘুমাছি। হঠাৎ শোরগোল। ঘুম ভাঙ্গিয়া ঘর থাকি বের হয়া দেখি আগুন আর আগুন। হাজার অচেনা মানুষ। লুটপাট, হুমকি–ধমকি কত–কী! জেবন বাঁচাতে কোনরকমে বাড়ি থাকি বের হয়া ধানখেতের মাঝোত নুকিয়া রক্ষা পাছি। পরের দিন সকালে পুলিশের সহযোগিতায় গ্রামোত আসিয়া দেখি, সুখের সংসার পুড়ি শ্যাষ। আশীর্বাদ করেন, এমতোন ভয়ের রাইত যেন আর না আইসে।’

    নিজের পাকা ঘরের মেঝেতে ঝাড় দিতে ব্যস্ত ছিলেন সুমতি রানী। পাশে স্বামী দেবেন্দ্রনাথ বস্তায় ভুট্টা ভরছেন। গালভরা হাসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দাদারা কেমন আছেন? ওই যে গেইছেন আর তো আইসেন নাই।’
    Ad
    225px

    সুমতির এমন চেনাজানা ও প্রত্যাশার কারণ হচ্ছে, তাঁদের জীবনের সেই ভয়াল রাতের ভোর থেকে টানা ১০ দিন সেখানে অবস্থান করেছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকদ্বয়। এ সময় গ্রামে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা এবং পরে তাঁদের আতঙ্ক ও দুঃখ–কষ্টের কাহিনি পত্রিকায় তুলে ধরেছিলেন তাঁরা।
    কেমন আছেন জানতে চাইতেই সুমতি রানী বলেন, ‘খুব ভালো আছি। সরকারসহ সবায় হামাক সহযোগিতা করছে। অ্যালা সবায় মিলিমিশিয়া চলোচি। কোনো সমস্যা নাই।’
    ঘরের বারান্দায় মরিচ শুকাতে ব্যস্ত শ্যামল দাসের স্ত্রী শিল্পী রানী। পরনের কাপড় ছাড়া সবকিছু উত্তেজিত জনতার অগ্নিসংযোগে পুড়েছিল তাঁদের। শিল্পী রানী (৩০) বলেন, ‘সরকার, সাংবাদিকেরা, সব ধর্মের মানুষ হামার পাশে দাঁড়াইছিল বলিয়া হামরা ঘুরিয়া দাঁড়াছি।’
    মাঝিপাড়া গ্রামের পাশে বটেরহাট বাজারে মুদিখানা ও চায়ের দোকানগুলোতে দেখা গেল মানুষের আড্ডা। বাজারের রাসেল মিয়ার চায়ের দোকানে মজনু মিয়া, রিপন ইসলাম ও আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে বসে চা–পানসহ খোশগল্পে মেতেছিলেন মাঝিপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের নির্যাতিত জেলে ক্ষুধা রাম, দেবদাস, প্রভাত দাস ও সাগর রায়। প্রসঙ্গ তুলতেই প্রভাত দাস বলেন, ‘অ্যালা সউগ আগের মতোন হয়া গেইছে।’
    সেই ভয়াল রাতের ঘটনা বর্ণনা করে মজনু মিয়া বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে জেলেদের গ্রামে কিছু বহিরাগত অচেনা লোক হঠাৎ হামলা চালিয়ে লুটপাট ও বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়েছিল। তখন জেলেদের চিৎকার–আর্তনাদে আমরাও খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এখন সেই কষ্ট ও ভেদাভেদ ভুলে আমরা আবারও এক হয়েছি। আর কখনো কেউ হামলা করতে আসলে একসঙ্গে তা প্রতিহত করার জন্য সজাগ হয়ে আছি।’
    ওই বাজারে রিকশা–ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝিপাড়া বড়করিমপুর গ্রামের স্বপন চন্দ্র (২৫) বলেন, ‘ভুল–বোঝাবুঝি যা ছিল, সউগ মিটি গেইছে। কোনো সমস্যা নাই।’
    পীরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মিজানুর রহমান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের টিনের ছাউনিসহ ৪৪টি পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক অনেক সহযোগিতা পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এখন এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির সুবাতাস বইছে।’
    বটের হাটবাজারের জামে মসজিদের সামনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে বসে ছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ওই গ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মামুনুর রশিদ বলেন, ‘গ্রামে হামলার ঘটনার পর থেকে এখানে পুলিশি পাহারা চলছে। আমি দুই মাস থেকে এখানে পাহারার দায়িত্বে আছি। হিন্দু-মুসলমানরা এখন কাঁধে কাঁধ রেখে চলাচল করছে। কেউ কোনো দিন কোনো অভিযোগ করেনি।’
    পীরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ওই দিন রাতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পীরগঞ্জ থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ওই চার মামলায় মোট ১৫০ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। দায়ের করা চার মামলার দুটি সিআইডি এবং দুটি মামলা পীরগঞ্জ থানা–পুলিশ তদন্ত করছে।
     
  • গোপা মুখোপাধ্যায় | 117.197.225.129 | ১০ আগস্ট ২০২২ ২২:৪২510906
  • এই খুশির  খবর ভারতীয় উপনিবেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক
  • aranya | 2601:84:4600:5410:fc9a:8655:f9f1:deff | ১১ আগস্ট ২০২২ ০৬:৩৭510911
  • 'মোল্লা হুজুররা শীত গ্রীষ্ম যখনই ওয়াজে বসে, তাদের মূল টার্গেট থাকে নারী' 
    - মুসলিমদের, বিশেষতঃ মুসলিম মেয়েদের ভিতর থেকে এর প্রতিবাদ হয় কি? 
  • Ranjan Roy | ১১ আগস্ট ২০২২ ০৮:১৯510913
  • "এই খুশির  খবর ভারতীয় উপনিবেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক"
      --অবশ্যই। এর বহুল প্রচার কাম্য।
       
      কিন্তু আমরা কি এরকম উদাহরণ দিতে পারব ? যেখানে মসজিদ ভেঙেছে,  বা যেখানে মুসলমান বলে পেটানো হচ্ছে সেখানে তাদের রক্ষার জন্যে দাঁড়িয়েছি বা প্রতিবাদ করেছি? 
      আমার ছোটবেলায় এমন অনেক দেখেছি। কিন্তু আজকাল চোখে পড়ে না। উল্টোটাই নিও-নর্মাল।
    • Amit | 121.200.237.26 | ১১ আগস্ট ২০২২ ০৮:২৪510914
    • কোনোদিকেই দেওয়ার মতো ভালো কিছু উদাহরণ নেই। সেদিক  দিয়ে দেখতে গেলে সবদিকেই ইন্টলারেন্স এর ব্যালান্স মেন্টেন হচ্ছে। 
    • মতামত দিন
    • বিষয়বস্তু*:
    • কি, কেন, ইত্যাদি
    • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
    • আমাদের কথা
    • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
    • বুলবুলভাজা
    • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
    • হরিদাস পালেরা
    • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
    • টইপত্তর
    • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
    • ভাটিয়া৯
    • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
    গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


    মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
    পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন