১
একসময় এ বাড়ি ছিল জমজমাট । কালীপুজোর রাতে মহা ধুমধাম করে পাঁঠাবলি, গ্রামের সবাইকে পাত পেড়ে খাওয়ানো, আতশবাজির রোশনাই । পাইক বরকন্দাজের দল ছিল, গুমঘর ছিল । একটা কালি ঝুলি মাখা দোনলা বন্দুক এখনো রয়ে গেছে দোতলার মাঝের বন্ধ ঘরে। এখন বাড়িটা বহুদিন ফাঁকাই বলা যায়, বেশীর ভাগ বংশধররা দূরে চলে গেছে, বিদেশেও থাকে । তবে মাঝে মাঝে আসে । বাড়িটা সারানোও হয়, ভেঙে পড়ার মত অবস্থা নয় । লাগোয়া কালী মন্দিরের জন্য গ্রামের লোকেরাও এ বাড়ির দিকে তেমন নজর দেয়নি কিন্তু পঞ্চায়েত বদলের পর একটা চেষ্টা হয়েছিল এ বাড়ির চাষের জমি দখলের।
সেসব কান্ড যখন হয়েছিল তখনও বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে অগ্নিবেশ এ বাড়িতে থাকতেন না । তিরিশ বছর আগে তিনি উধাও হয়ে গেছিলেন । নিরুদ্দেশ ঠিক নয়, মাঝে মাঝেই তার চিঠি পাওয়া যেত। তাতে সবাই বেঁচে থাকা নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেও তাকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছিল । যাবার সময় যে বাড়ি ভাই বোন জ্ঞাতি গুষ্টিতে গমগম করতে দেখে গেছেন, এখন ফিরে দেখেন শুধু আরেক ভাই প্রণবেশ আর তার পরিবার । দোতলার কোণের নিজের পুরনো ঘরটাতেই তিনি থাকতে শুরু করলেন । নিজের বিড়ি, সাবান, তেলের খরচ ওঠাতে পৈতে বানান, কিছু এদিক ওদিক যজমানি করেন । এই কোণার ঘরের আলমারিতে বহুকালের মোটা মোটা সব বই রাখা আছে। সবই তাদের বাপ ঠাকুরদাদের সংগ্রহ। ভাতঘুম দিয়ে উঠে অগ্নিবেশ মাঝে মাঝে সেসব পুরনো ইতিহাস বই পড়েন ।
ভাইপো প্রথমেশ ওরফে রঘু মাঝে মাঝে ওপরের ঘরে এসে উঁকি মারে । একদিন টেবিলে গাঁজার মশলা দেখে তার বাবাকে গিয়ে বলেছিল, "পৈতে বানাতে বানাতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ছোটকা একটু টেনে নেয়, বুঝলে তো বাবা" । প্রণবেশ ধমক দিয়েছিলেন ছেলেকে - "ওকে শুধু শুধু খোঁচাতে যাস না"।
রঘু গাছগাছালি ভালোবাসে, আধুনিক কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ে গ্রামে ফেরত এসে সে সেসব পদ্ধতি আনতে চাইছে এখানকার চাষে, কিন্তু প্রণবেশ নিজেই ছেলেকে বাধা দিচ্ছেন। আগের বছর গ্রামের সব আলু পোকায় ধসে যাচ্ছিল, রঘু বাঁচিয়েছে, কিন্তু প্রণবেশ আর গায়ের বাকিরা তাতে আমল দেন না । আগের আমলের পঞ্চায়েত প্রধান প্রণবেশের এসব নতুন কায়দা পছন্দ নয় । আর এসব ব্যাপারে গ্রামের বয়স্করা সবাই তারই পক্ষে। তবে অল্পবয়সী কিছু ছেলেকে জড়ো করে রঘু নতুন চাষের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । শুধু রঘুর মার জোরাজুরিতে বাগানটা বাধ্য হয়ে ছেলের পরীক্ষা নিরীক্ষার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন প্রণবেশ।
মাঝে মাঝে সকালবেলা খাবার পর অগ্নিবেশকে বাগানের গাছগুলো চেনায় রঘু । তাদের পায়ে পায়ে রঘুর দুটো পোষা কুকুর ঘোরে যারা ইঁদুর মারার জন্য বাহবা পায় রঘুর থেকে ।
এই বাড়ির একদম ওপরে তেতলার ছাদে উঠলে জমি পুকুর পেরিয়ে দূরে দেখা যায় একটা নদী । গরমকালে শুকিয়ে যায়, শিবেনের লোকেরা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বালি তোলে দিনে রাতে, সেই বালি যায় শহরে বড় বড় বাড়ি বানানোর কাজে ।নদীর ধারে কয়েকটা চালাঘরে সব শিবেনের ছেলেদের আড্ডা |
কিছুদিন ধরেই গ্রামে একটা কানাঘুষো কথা চলছে, রঘুরও কানে উঠেছে কথাটা । সেই একদিন এসে অগ্নিবেশকে ধরলো, "ছোটকা, শিবেনের বৌয়ের সাথে তুমি কি শুরু করেছো?" অগ্নিবেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, খবরটা ছড়াচ্ছে, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন ভালো হচ্ছেনা কাজটা । কিন্তু শিবেন সারা দিন রাত বালির কাজে বাইরেই থাকে, শিবেনের বৌ নিজেই যদি তাকে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ডাকে তাহলে আর তিনি কি করতে পারেন।
২
একদিন সন্ধের যজমানি সেরে নদীর ওপার থেকে ফেরত আসার সময়, শিবেন চালাঘর থেকে মুখ বার করে অগ্নিবেশকে ডাকল "ও জগুদা শোনো " ।
অগ্নিবেশ কাছে যেতে শিবেন আরো পাঁচ ছজনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে চালাঘরের বাইরে । শিবেনের হাতে একটা পাটের থলি, হালকা গন্ধ আসছে ।কাঁধে হাত দিয়ে বললো, "জগুদা তোমার সাথে একটা কথা আছে, হাঁটু গেড়ে বসো"।
হাঁটু গেড়ে বসতে শিবেন, থলিটা দোলাতে লাগলো অগ্নিবেশের মুখের সামনে ।
অগ্নিবেশ বিরক্ত হবার ভাব দেখান - "কি বলবি বল, সন্ধেবেলা হাঁটু গেড়ে বসালি এভাবে!"
শিবেন তার দলের একটা ছেলের দিকে ফিরে বললো "লেড়ো, তোর বাঁশিটা নিয়ে আয় "
এটা শুনেই অগ্নিবেশ চোখ বন্ধ করে ফেললেন, বাঁশি মানে যন্তর? আজকেই তাহলে তার শেষ দিন ।
সন্ধেবেলা হাঁটু গেড়ে বসালো কেন সেটা না বলে শিবেনের মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে । থলিটা ডানহাতে ধূপের মত দোলাতে দোলাতে শিবেন একবার জগুর নাকে ইচ্ছে করে ছুঁইয়ে দিল, ঝাঁজালো গন্ধে বাধ্য হয়ে মাথাটা সরিয়ে নিলেন অগ্নিবেশ । বিরক্তিতে কুঁচকে গেল তার চোখ মুখ।
ছেলেটা যেটা নিয়ে ফিরে এলো, সেটা সত্যি একটা আড়বাঁশি, যন্তর না। অগ্নিবেশ অবাক হন, বালি তোলার ফাঁকে এরা আবার পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে বাঁশিও বাজায় নাকি নদীর চরে?
তিনি মাথাটা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন - "বারবার ওটা নাকে ছোঁয়াচ্ছিস কেন?"
"এ থলিতে কি আছে জানো জগুদা? হিরু সাপুড়ে বলেছে, সর্পগন্ধা গাছের শেকড় অব্যর্থ ওষুধ । এতে সব সাপ দূরে চলে যায় । এবার লেড়ো বাঁশি বাজাবে আর তোমাকে থলিটা শোঁকাব । লেড়ো, শুরু কর!"
"সেসব খেলা তো সাপের জন্য, আমি কি সাপ নাকি? "
"তুমি বাস্তুসাপ, এবার ভিটে চ্যুত করবো তোমাকে । গ্রামের বৌদের দিকে নজর দেওয়া? "
সেরাতে বাড়ি ফিরে রোজকার মতই অগ্নিবেশ খোলা আকাশের নিচে দোতলার আধখানা ছাদে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসেন । ছিলিমে অল্প অল্প টান দিতে থাকেন । আজ আর রাতে খাবার খেতে নামবেন না । শীতকাল আসছে । ঘরে আলোর চারপাশে ভিড় করে উড়ছে শ্যামাপোকার দল। বাইরে অল্পস্বল্প হিম টুপটাপ ঝরে পড়ছে মাটিতে । অন্ধকারে সরীসৃপরা খুঁজে নিচ্ছে শীতঘুমে যাবার নিরাপদ আশ্রয়।
পরেরদিন রঘু সকাল সকাল খাবার জন্য অগ্নিবেশকে ডেকে না পেয়ে দোতলায় এসে খুঁজলো । আধখানা ছাদে ফাঁকা পড়ে আছে মাদুর, অগ্নিবেশ নেই । ঘরে বিছানায় টান টান চাদর, টেবিল ফাঁকা । এখানে কেউ থাকছিল বলে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না রঘুর । অগ্নিবেশ যেন কর্পূরের মত উবে গেছেন হাওয়ায় ।
কিন্তু সে তেমন চিন্তায় পড়ে না। "কাকা মনে হচ্ছে আগের মত আবার কোথাও ঘুরতে চলে গেছে"- ভেবে সে ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় দ্রুত, যদি খুচরো টাকা বা গাঁজার মশলা চোখে পড়ে । কিছুই নেই ।
শুধু, বইয়ের আলমারিটা অন্যরকম লাগে তার কাছে ।
বইয়ের আলমারির কাছে গিয়ে অবাক হয়ে প্রথমেশ ওরফে রঘু দেখে, পুরনো বইগুলো আর আস্ত নেই একটাও । এক রাতের মধ্যে সব যেন খেয়ে গেছে উইপোকা । আলমারির তাক গুলো জুড়ে শুধু তাদের গুঁড়ো করে ফেলা ধুলোর পাহাড় জমে আছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।