এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ৯

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩০১ বার পঠিত
  • আমাদের কোয়ার্টারের সামনে ছিল একটা ছোট খেলার মাঠ, তারপর একটি মসৃণ পিচের রাস্তা যার উপর অনায়াসে শুয়ে থাকা যায় জামাকাপড় একটুও নোংরা না করে। রাস্তাটি পেরিয়ে একটি বড় খেলার মাঠ আর নিউটন মার্কেট, যার ভিতরেই সব কিছুর দোকান। সবজি, মাছ-মাংসের দোকানগুলো আলাদা আলাদা এলাকাতে। বিক্রেতারা সব বসত সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু পাটাতনের উপর। মার্কেটটির পিছনে সারি দিয়ে মুদির, কাপড়ের, বইয়ের, মিষ্টির, ইত্যাদি দোকান। সাথে একটি বিরাট বড় খোলা জায়গা, যেখানে মাঝ মাঝেই হতো রামলীলা, কৃষ্ণলীলা। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাম দিকে একটু এগোলে যেখানে রাস্তাটি কোমর বেঁকিয়ে ডান দিকে মুড়েছে, সেই কোনায় ছিল নিউটন প্রাইমারি স্কুল। সুন্দর স্কুল বিল্ডিঙের সামনে একটি বড় খেলার মাঠ। আর রাস্তাটি কোমর বেঁকানোর আগেই বাম দিকে ছিল একটি বয়রা গাছ যার তলায় ছিল শিব ঠাকুরের মূর্তি, আর গাছটির চারদিক ঘিরে গোল করে সান বাঁধানো বসার জায়গা। সোজা এগিয়ে গেলেই আর একটি বিরাট বড় খেলার মাঠ, যেখানে হতো যাত্রাপালা। সেইসময় অনেক যাত্রা দেখেছি। বিদ্যাসাগর, সিরাজদৌল্লা, শাজাহান, আনারকলি, আরো অনেক। এই মাঠটির বাম পাশে যেখানে আরেক সারি বাসস্থান, তার মধ্যে প্রথমটি ছিল মায়ের মহিলা সমিতি এবং প্রাক-প্রাইমারি স্কুল। আমাদের বাড়ির থেকে প্রায় পৌনে কিলোমিটার পিছনদিকে পুরো কলোনিটা হেঁটে পেরিয়ে আসলে পড়ত জে.সি.বোস রোড, তার ধার দিয়ে সব বাংলো টাইপের বাড়িগুলি। অনেক বড়, অনেকগুলো রুম এবং গাড়ি রাখার গ্যারাজসহ। শুনেছিলাম দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টের উচ্চপদস্থ অফিসাররা ওখানে থাকেন। জায়গাটা খুব নিঃঝুম ছিল। কিন্তু আমাদের  বাড়ির সামনে এবং পিছন পাড়াতে সবসময় থাকত একটা  চলবলে, কোলাহলমুখর আবহাওয়া। জে.সি.বোস রোডের অন্য ধার দিয়ে বয়ে যেত একটা খাল। খালটা বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে পেরোলেই শাল, অর্জুন, পলাশ, শিমুল গাছে ভরা একটি ঘন জঙ্গল। দিনের বেলায়ও প্রায় অন্ধকারময় হলেও দেখা যেত গাছের ডালপালা-পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য্যের ঝিকিমিকি রশ্মি। আর শোনা যেত পাখপাখালির কিচিরমিচির, কোকিলের কুঞ্জন, পায়রার বাকুম বাকুম ডাক। বাবা অনেকবারই ওনার অফিসের ঝা সাহেবের সাথে যেতেন পাখি শিকার করতে। ঝা সাহেবের শখ ছিল পাখি শিকার করার, বাবাকে সাথ দিতে হতো। অনেকবার পায়রার মাংস নিয়ে এসেছেন বাড়িতে, একবার ঘুঘু পাখিও শিকার করেছিলেন ঝা সাহেব। আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে যেতাম ঐ জঙ্গলে দোলের আগে, পলাশ ফুল পেড়ে আনার জন্য।        
    আমি যখন দুর্গাপুরে আসি তখন বছরের মাঝামাঝি সময়, সম্ভব নয় আমাকে ভর্তি করা প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে। আমাকে ভর্তি করা হয় প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের ডি সেকশনে (উচ্চ বিভাগে)। এই স্কুলটির কথা আমি এরমধ্যে জানিয়েছি। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি অনিমা ম্যাডাম আমার মায়ের পরিচিত ছিলেন কারণ দুজনেই মহিলা সমিতির সদস্যা ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে অনিমা ম্যাডাম স্কুল এবং মহিলা সমিতির পরিচালনার ভারে ছিলেন। 
    কয়েক মাস পর, শ্রীমতি অনিমা ম্যাডাম আমার মাকে জানান আমাকে যেন পরের বছর দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। কারণ উনি অন্যান্য শিক্ষিকাদের থেকে রিপোর্ট পেয়েছেন, প্রথম শ্রেণীতে যা পড়ানো হয় তার সবকিছুই আমার অবগত এবং প্রথম শ্রেণিতে এক বছর নষ্ট করা উচিত নয়। এই প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার স্বল্পকালীন থাকা, সেরকম কোনো ঘটনার প্রাণবন্ত স্মৃতি নেই। তবে  আমার মনে আছে দু-একটি ঘটনা। একটি ঘটনা মনে পড়লে আজ খুব হাসি পায়। একদিন অংকের ম্যাম আমাদের ১ থেকে ১০০ লিখতে বলেছিলেন, কিন্তু লিখতে হবে উল্টো দিক থেকে - অর্থাৎ ১০০, ৯৯, ৯৮ ------ । আমি আমার খাতায় প্রথমেই লাইন টেনে ১০ টি কলাম বানালাম। ১০ তম কলামের অর্থাৎ শেষ কলামের নীচে থেকে উপরে ১ থেকে ১০ লিখলাম। তারপর পরবর্তী কলামে ১১ থেকে ২০। যখন আমি আমার খাতাটি নিয়ে ম্যামের কাছে যাই, তখন তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াতাড়ি ! আমি যখন ওনাকে ব্যাখ্যা করে বোঝালাম, তখন তিনি আমার আচরণের প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করলেন। বললেন, এটা একধরণের অসৎ উপায় ধারণ করা - আবার লিখে নিয়ে আসতে বললেন। কিন্তু যখন উনি চোখ বড় বড় করে আমাকে বকছিলেন, দেখতে পাই ওনার মুখে একটি পাতলা হাসির আভা। ভাবছিলাম তখন, উনি আমাকে বকছেন অথচ রাগের বদলে মুখটাতে হাসিহাসি ভাব কেন। আজ বুঝতে পারি, তাই ভুলিনি এই ছোট্ট ঘটনাটি।
    ****
    বাড়ির কাছাকাছি নিউটন প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে জায়গা না থাকার দরুন আমি ভর্তি হতে পারলাম না এই স্কুলে। প্রথম শ্রেণী থেকে সবাই পাশ করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠে, তাই জায়গা ছিল না। আমাকে তখন তানসেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছিল। তানসেন প্রাইমারি স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৫ / ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমাকে যেতে হতো পাবলিক বাসে,  সে সময় স্কুল বাসের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু আমি স্কুল শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই স্কুলে যোগ দিতে পারি, কারণ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হতে আমার বয়স কয়েক মাস কম ছিল এবং হলফনামার মাধ্যমে আমার বয়স বাড়িয়ে নিয়মিত করতে কিছুটা সময় লেগেছিল।
    মা আমাকে প্রতিদিন আপ এবং ডাউন বাস ভাড়ার জন্য দুটি ১০ ​​পয়সার কয়েন দিতেন এবং আমি স্কুল ড্রেস পরে পাবলিক বাসে স্কুলে যেতে শুরু করি। পিছনে স্কুল ব্যাগ এবং একটি জলের বোতল। তখনকার দিনে প্রাথমিক স্কুলে টিফিন দেওয়া হত। স্কুল শুরু হতো সকাল ১০টায় আর শেষ হতো বিকেল ৪টায়। সেই সময় তিনটি বাস  দুর্গাপুরের বি-জোন এলাকা দিয়ে যাতায়াত করত।
    যেহেতু আমার স্কুলে যোগদান করতে দেরি হয়েছিল এবং ক্লাসগুলি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই আমার কিছু সময় লেগেছিল পরিবেশের সাথে নিজেকে মানাতে, পরিচয় হতে ছাত্র-ছাত্রীদের  সাথে। স্কুলে যোগদানের সাথে সাথেই, ঘোষণা করা হয় সোমবার ইংরেজি ক্লাস পরীক্ষার। বেশ কয়েকটি চ্যাপ্টার পড়ানো হয়ে গেছে, যেইগুলো আমার তখনও ঠিক করে পড়া হয়নি।     ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন