এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সিনেমা

  • বাংলা সিনেমার পিতৃব্যের সঙ্গে আমাদের যাপনকাল

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সিনেমা | ১৪ মে ২০২৩ | ৫৬৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • প্রথম দৃশ্য ঃ এক ভদ্রলোক সিনেমা পরিচালনায় প্রায় চোদ্দ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম একটি ছবিতে একই সঙ্গে শৈল্পিক এবং বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছেন। মুম্বাইয়ের (তখনকার বোম্বে) বেশ কয়েকজন নামী প্রযোজক তাঁর কাছে ঝুলোঝুলি করছেন এরকম আরো ছবি বানিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি তাঁদের প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন। আগের ছবি সাফল্য পেয়েছে বলে একই ছকে পরের ছবি তিনি বানাতে চান না। নিজের কাজেও সেই প্রমাণ রাখলেন। এরপরই যে ছবিটি বানালেন সেটি রাজনৈতিক আবহে, পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টায়, সামাজিক সম্পৃক্তিতে অনেকটাই আলাদা গোত্রের। আজকের কোনো বাঙালি পরিচালক হলে হয়তো প্রথম সফল ছবিটির সিকোয়েল ১, ২ নেমে যেতো।
     
    দ্বিতীয়  দৃশ্য ঃ ঐ দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভাবী চলচ্চিত্র পরিচালকদের সামনে বক্তব্য রাখছেন। বলছেন, নবীন বন্ধুরা, ভয় পেওনা কোনো কিছুকে। প্রতিক্রিয়া দেখাও সামাজিকভাবে। যদি পারো, প্রথাভাঙার সংস্কৃতিকে অনুশীলন করো। তোমার মাধ্যম এবং বিবেকের প্রতি অনুগত থেকে ঝুঁকি নাও। এটা করতে গিয়ে এগিয়ে যাও বা ধ্বংস হও। I wish you all a very tough time.
    আজ মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ  শুরু হল। আধুনিক বাংলা সিনেমার পিতা এবং জ্যেষ্ঠতাত হিসেবে আমি কাদের কথা ভাবছি সেটা পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন( এই বিবেচনা বয়সের বিচারে আদৌ নয়,কারণ এঁদের মধ্যে একজনের জন্মশতবর্ষ আসতে আরো দুবছর বাকি )।  সেক্ষেত্রে মৃণাল সেন যেন আমাদের অন্তরঙ্গ ছোটোকাকা যার প্যাকেট থেকে সিগারেট শেয়ার করে আমরা অনায়াসে সিনেমা নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পরিবর্তমান সময় ও বাস্তবতা নিয়ে  কথা চালাচালি করতে পারি। উল্লেখযোগ্য যে মৃণাল সেন যেভাবে আত্নজীবনী লিখেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ত্রিমূর্তির বাকি দুজন তো সেরকম কিছু লেখেন নি (তৃতীয় ভুবন, প্রথম আনন্দ সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১১)। সেখান থেকে যে মানুষকে আমরা আবিষ্কার করি তিনি এমন একজন শিল্পী যিনি দূরতর গ্রহের বাসিন্দা অসম্ভব প্রতিভাবান কেউ নন, বরং তাঁর প্রতিভা ব্যর্থ হতে হতে, ভুল করতে করতে, ভুল সংশোধন করে নিজেকে আরো নিখুঁত করতে করতে নিজেকে বিকশিত করেছে। তাঁর নিজের ভাষায়, I  travelled a long and difficult way-difficult, because I did not know how to walk. I learnt through experience.
    এই আন্তরিক উচ্চারণ শোনার পর আমাদের মনে হয় প্রতিভাকে যাঁরা রহস্যময়তার আড়ালে রাখতে পারেন, তাঁরা ছাড়াও অন্য মানুষ, অনেক সাধারণ জায়গা থেকে শুরু করেও একটা উচ্চতাকে ছুঁতে পারেন। এর মানে কিন্তু এই নয় যে মৃণাল সেনের প্রতিভা ছিলো না। এর মানে এটাই যে প্রতিভা যে সাধনা, পরিশ্রম ও আত্নবিশ্লেষণের ফসল তাকে তিনি কখনো আড়াল করে রাখতে চান নি। প্রথম ছবি ‘রাতভোর’(১৯৫৫) এর বিপর্যয় দিয়ে শুরু করে ভুবন সোমের (১৯৬৯) সাফল্য পর্যন্ত যে পর্যায়, যেখানে ‘নীল আকাশের নীচে’ র (১৯৫৯) বা ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫) এর মোটামুটি বাণিজ্যিক সাফল্য বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) এর শৈল্পিক সাফল্য পৃথক আলোচনার বিষয়,  সেখানে আমরা অবাক হয়ে যাই তাঁর রাজনৈতিক চিত্ররাজির প্রথম ছবি ‘ইনটারভিউ’ (১৯৭০) এর নিরীক্ষাশীলতা দেখে। সিনেমার ভাষার এই রাজনৈতিকতা তিনি একদিনে অর্জন করেছেন বা শুধু সিনেমার  থেকেই পেয়েছেন এমন নয়। তাঁর বই পড়লে, তার সম্পর্কে অন্যদের লেখালেখি পড়লে বোঝা যায় মৃণাল সেন নিরন্তর সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা নিয়ে কথা বলে গেছেন, বহু আড্ডা ও তর্কবিতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র বন্ধু গড়ে তুলেছেন যার মধ্যে সিনেমা জগতের তাবড় ব্যক্তিত্বরা তো আছেনই, আছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মত সাহিত্যিক। এই যাবতীয় অভিজ্ঞতা আর সময়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আর্তি তাঁকে বিশিষ্ট করেছে।
     
    ইনটারভিউ  ছবিতে এমন অনেক কিছুই হয় যা ভারতীয় সিনেমায় প্রথম। সিনেমাটির প্রধান চরিত্র রঞ্জিত মল্লিককে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয় সেটাই ভারতীয় ছবিতে নতুন। যাঁরা চলচ্চিত্রের আগ্রহী ছাত্র তাঁরা হয়তো সিনেমা ভেরিতে স্টাইল, ব্রেখটিয় অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের প্রয়োগ (অনেক বার এই ছবিতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি চরিত্রদের কথা বলতে দেখা যায়) ইত্যাদির কথা বলবেন। মৃণাল সেন এই ছবিতে  ভুবন সোমের কৌতুকময় স্টাইলের অনুবৃত্তি  দিয়ে শুরু করেও সমসাময়িক ক্রোধের রাজনীতি, প্রতিবাদের রাজনীতির আবহকে বোঝার চেষ্টায় পৌঁছে যান। এখানে ইনটারভিউয়ের জন্য প্রধান চরিত্র রঞ্জিত মল্লিক (এটি তাঁর প্রথম ছবি এবং এখানে তিনি নিজের নামেই অভিনয় করেছেন আবার অভিনয় যে করেছেন সেটাও দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে,  ক্যামেরাম্যান কে কে মহাজনের উপস্থিতি সহ) একটি কোট জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। চাকরিটি শুধু এই কারণে না পাওয়ায় তার ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে একটি শোরুমের কাচ ভেঙ্গে একটি ম্যানিকিনের গা থেকে কোট খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর সঙ্গে আমাদের কলোনিয়াল হ্যাংওভারের ইতিহাস, ভিয়েতনাম সমেত  দেশে দেশে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই, কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদের মিছিল — সবকিছুকেই একটা ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করা হয়। এই ছবি থেকে পরবর্তী ছবি ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) ছবিতে ক্রোধের বিস্তারকে আরো বৈপ্লবিকভাবে ধরার চেষ্টা তাই অনিবার্য ছিলো। এই ছবি শুরু হয় এক কাল্পনিক বিচারশালার দৃশ্য দিয়ে যেখানে শপিং উইন্ডো ভাঙ্গা এবং ম্যানিকিনকে বিবস্ত্র করার অপরাধে রঞ্জিৎ মল্লিকের বিচার হয়। সেখান থেকে ১৯৩৩, ১৯৪৩, ১৯৫২ – এই তিন সালের পটভূমিকায় তিনটি কাহিনীকে হাজির করেন লেখক যেগুলো ১৯৭১ সালের পটভূমিকায় বিদ্রোহ, ও পরিবর্তনের আকাঙ্খায় পরিণতি পায়। এই চারটি আখ্যানের মাঝে ধুয়োর মত ফিরে আসে একটি কুড়ি বছরের ছেলের ধারাভাষ্য যে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে আর দারিদ্র, বঞ্চনা এবং শোষণের  ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করে  চলেছে। মৃণাল সেন জানতেন দারিদ্র আর ক্ষুধার স্বাভাবিক পরিণতি ক্রোধ — সামাজিক ক্রোধ। মৃণালের একটি প্রিয় উদ্ধৃতি ছিলো ‘ক্ষুধা আর ক্রোধের মধ্যে বিভাজক রেখাটি খুবই সরু’। তাই সেই ক্ষুধার আখ্যানকে ক্রোধের চিত্রণে বদলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ‘কলকাতা ৭১’ সর্বার্থেই একটি সার্থক রাজনৈতিক ছবি হয়ে ওঠে।  এরপর পদাতিক (১৯৭৩) আর কোরাস (১৯৭৪) – এই রাজনৈতিক সিনেমার বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করে। এর মধ্যে পদাতিকে মূল বিপ্লবী চরিত্রটির আত্নসমালোচনার বয়ান শুনে অনেকে ছবিটিকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিতেও পেছপা হননি, বিশেষত নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মানুষজন। এই ছবির প্রধান চরিত্র সুমিত (অভিনয়ে ছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ) পার্টি নেতৃত্বের কাছে বিপ্লবের অনিবার্যতাকে স্বীকার করেও যে প্রশ্নগুলি তোলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো শত্রুমিত্র চিনতে ভুল করা, শিক্ষাঙ্গনে আগুন লাগানো, মূর্তিভাঙ্গার রাজনীতি ইত্যাদি। এই সমালোচনা বা মৃণাল সেনের বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত না হতে পারেন। কিন্তু পরবর্তী সময় প্রমাণ করেছে আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা, যেটা সেই উত্তাল সময়ে রাখার সাহস অন্তত মৃণাল সেন দেখিয়েছিলেন।
    ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার আসীন হয়। মৃণাল সেন তার কিছুদিন পর থেকে তাঁর সমালোচনা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দিকে নিবদ্ধ করেন। তিনি নিজেই যেহেতু এই শ্রেণীর অংশ তাই এটা এক অর্থে আত্মসমালোচনাও বটে। এই পর্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হোলো একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯), আকালের সন্ধানে (১৯৮০), খারিজ (১৯৮২) এবং খণ্ডহর (১৯৮৩)। মৃণাল সেন কিন্তু বিশ্বাস করতেন সমাজ পরিবর্তনের লড়াইতে, বিশেষত শিল্প ,সংস্কৃতি এবং মতাদর্শের প্রচারে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেকে ভাবলেন মৃণাল সেন বুঝি সোচ্চার প্রতিবাদের পথ ছেড়ে আপোষপন্থার দিকে হাঁটছেন। বিষয়টা আদৌ তা নয়। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর  প্রগতিবাদী সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগে সিনেমায়, নাটকে এবং সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিবাদের ধ্বজা ওড়ানো এবং শ্রেণী সংস্কৃতির  রুটিন উপস্থাপন কর্তাভজা সংস্কৃতির এবং সহজসাধ্য সাফল্যের মেড ইজি হয়ে দাঁড়ায় অনেক ক্ষেত্রে।  নগরে, মফস্বলে থিয়েটারের মঞ্চে কতবার যে উদীয়মান লাল সূর্যের আভায় কত নাটকের যবনিকাপতন হয়েছে সেই সময় তার হিসেব রাখা ভার। তা, মৃণাল সেন যে আরো একবার সেই সহজ সাধনার পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথ বাছবেন, সমাজের  সমালোচনার মতই গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন পরিবর্তনকামীর আত্মসমালোচনাকে তা আর বিচিত্র কি? ইতালির এক বামপন্থী তাত্ত্বিককে কোট করে মৃণাল এইসময়ই বলেছিলেন, সত্যকে পকেটস্থ করাই আসল ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে সত্যের পশ্চাৎধাবন করা (chasing the truth)। যে সামাজিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাঁরা নিজেরা নিয়মিত আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছেন কি? একদম প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে নিজেদের শ্রেণীগত দূরত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকছেন কি? সমাজে মেয়েদের অবস্থানগত যে বৈষম্য তা নিয়ে এঁরা কতটুকু সচেতন? এই প্রশ্নগুলিকে মৃণাল সেন সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
    একদিন প্রতিদিন ছবিতে একটি কর্মরতা মেয়ের একদিন রাতে কোনো কারণে বাড়ি ফিরতে না পারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবার এবং সমাজের বাকি লোকদের প্রতিক্রিয়াকে মৃণাল যেভাবে তুলে ধরেন সেটা অভিনব। এমন নয় যে পরিবারের লোকদের উদবেগের যাথার্থ্য নিয়ে মৃণাল কোনো আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু যেভাবে এই রাতে বাড়ি না ফেরাকে কেন্দ্র করে সবাই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সেখানেই যেন উঠে এসেছে আমাদের ভেতরের পঙ্কিলতা। মেয়েটির বদলে এটা যদি একটি ছেলের রাতে বাড়ি না ফেরার কাহিনী হোতো তাহলে কি এই প্রতিক্রিয়া তৈরি  হোতো? ছেলেটি কেন বাড়ি ফেরে নি সেটা জানার এই উদ্গ্র আগ্রহ তৈরি হত? ছবির শেষে ভোরবেলায় মেয়েটি (অভিনয়ে মমতাশংকর) যখন ফিরে আসে তখনও মৃণাল যে মেয়েটির ফিরতে না পারার কারণ দর্শককে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন না সেটা ঠিক এই কারণেই।  
    এর পরের ছবিতেও মৃণাল বেছে নিয়েছিলেন অমলেন্দু চক্রবর্তীর কাহিনী। এখানে ‘ফিল্ম উইদিন ফিল্ম’ ঘরানায় মৃণাল  প্রগতিবাদী শিল্পীর সঙ্গে তাঁর বিষয়ের দূরত্ব, গ্রাম শহরের দূরত্ব এবং এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সচেতনতা --- এই বিষয়গুলিকে যেভাবে ধরেছেন তাতে আত্মসমালোচনার এমন এক বয়ান তৈরি হয় যেখানে তিনি নিজেকেও সম্ভবত রেহাই দেন না। ধৃতিমান  চট্টোপাধ্যায় অভিনীত পরিচালকের কেন্দ্রীয় চরিত্রটিতে সব প্রগতিবাদী শিল্পীর ছায়াই দৃশ্যমান। ১৯৮০ সালের সময়বিন্দুতে  দাঁড়িয়ে ১৯৪৩ এর মন্বন্তর নিয়ে  ছবি করতে চাওয়া একটি শুটিং ইউনিটের গল্প শুধু নয়, এই ছবি অনেক দূরত্ব, অনেক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশকও বটে। দুই সময়কে মিলয়ে দিয়ে  বহমান অবশ্য সেই ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের ইতিহাস যা মানুষকে পণ্য করে, তার অবমূল্যায়ন ঘটায়। এই ছবির একটি আইকনিক সংলাপ একটি গ্রামীণ চরিত্রের মুখে, ‘শহর থেকে বাবুরা এয়েছেন আকালের ছবি তুলতে। আকাল তো আমাদের সর্বাঙ্গে’ -- তাই ইতিহাসের অভ্যন্তর থেকেই যেন উঠে আসে ।আমরা কি এই গ্রামীণ, প্রান্তিক মানুষদের ব্যবহারই করেছি শুধু শিল্পে, রাজনীতিতে? আমরা কতটা আন্তরিকভাবে তাঁদের কাছে পৌঁছোতে পেরেছি? কতটা তাদের বুঝতে চেয়েছি? এই প্রশ্নগুলো সেই সময় থেকে তোলাই জরুরী ছিলো যেটা মৃণাল করেছিলেন।
     
    রমাপদ চৌধুরীর ‘খারিজ’ উপন্যাস অবলম্বনে সমনামী যে ছবিটি মৃণাল সেন বানিয়েছিলেন সেখানেও এই গ্রাম শহরের দূরত্ব, মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রান্তিক সর্বহারার শ্রেণীগত দূরত্ব ছিলো তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক গল্প প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ অবলম্বনে তিনি যখন ‘খণ্ডহর’ ছবিটি  করলেন তখন এই সমস্যাগুলোকে যেন এক নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার, সমালোচনা করার  সাহস দেখালেন মৃণাল। ভগ্নস্তুপের মত বাড়িটিতে রুগ্ন, শয্যাগত জনৈক মা (গীতা সেন) যিনি বেঁচে আছেন শুধু এই ভরসায় যে তাঁর মেয়ে যামিনীকে (শাবানা আজমী)  বিয়ে করবে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। যদিও সেই ছেলেটি যে দূরে কোথাও বিয়ে করে সংসার পেতেছে ইতিমধ্যেই সেকথা তিনি জানেন না। সেখানে বেড়াতে আসা সুভাষ (নাসিরুদ্দিন শাহ) সেই কথা না রাখা আত্মীয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধাকে সান্ত্বনা দেয়। সুভাষের এই ভূমিকা, যেখানে হয়তো যামিনীর অনেক অনুচ্চারিত বেদনার শুশ্রূষা ছিলো তা কিন্তু তার শহরে প্রত্যাবর্তনের পরই পরিবর্তিত হয়। যামিনীকে মনে রাখার তার যে আর প্রয়োজন পড়বে না সেকথা বোঝা যায়। সে যখন ডার্করুমে সেই ভগ্ন বাড়ির পটভূমিকায় যামিনীর ছবি ডেভেলপ করে তখন মনে হয় ডার্করুমের সেই অন্ধকারই বুঝি যামিনীর  স্মৃতির ভবিতব্য। সুভাষের কাছে তা তখন শিল্পের, হয়তো বাণিজ্যেরও উপজীব্যমাত্র। কোথায় যেন বিশ্বাসভঙ্গ আর উদাসীনতার  পাপ  আকীর্ণ হয়ে থাকে সেলুলয়েডের ফ্রেমে, আমাদের জীবনেরও ফ্রেমে। আমরা নিশ্চিত জানি এই পাপেই পুড়েছে আমাদের কত দেবালয়, জন্মেছে কত রক্তবীজ।
    ১৯৯১ সালে মহাপৃথিবী ছবিটি যখন মৃণাল বানান তার অব্যবহিত আগে ঘটে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইওরোপে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিপর্যয়। ভেঙ্গে গেছে বার্লিন প্রাচীর।
    গড়পড়তা বামপন্থী মানুষের মত মৃণাল সেনের ওপরও এই ঘটনার অভিঘাত ছিলো প্রচণ্ড। আঁকড়ে ধরার মত সামাজিক প্রত্যয়ভূমি যে অবলুপ্ত হচ্ছে সেই বোধ তাঁকে পেয়ে বসেছিলো। এই ছবিতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মা, যিনি তার বিপ্লবী শহীদ ছেলের স্মৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন --- তাঁর আত্মহত্যা এই বিপন্নতার ঈঙ্গিত দেয় যার শরিক স্বয়ং মৃণাল নিজেও। শুধু মতাদর্শ নয়, সিনেমার নিজস্ব সম্ভাবনার অপমৃত্যুর ভাবনাও মৃণালকে এই সময় পেয়ে বসেছিলো। সিনেমা যে একটি মাস মিডিয়া, এই ভাবনার প্রাধান্যকে তিনি ভয় পেতেন। চারিদিকে, এমনকি বিশ্ব জুড়ে সেই প্রবণতার আধিক্য, যা সিনেমার শিল্প সম্ভাবনার বিপরীতে দাঁড়ায়, সিনেমার বস্তুগত উপস্থিতিকে চৈতন্যগত সম্প্রসারণে উত্তরিত হতে দেয় না সেটা তিনি ক্রমাগত লক্ষ্য করছিলেন। মৃণাল তাই বোধহয় আর ছবি করতে পারছিলেন না। যে আশাবাদ, যে প্রাণবন্ত চলমানতা, যে চৈতন্যের সাধন তাঁকে সৃষ্টিশীল রেখেছিলো তার অভাবেই এর দুবছর বাদে একটি অকিঞ্চিৎকর ছবি নির্মাণের পর বারো বছর আর ছবি করেন নি তিনি। আর শেষ যে ছবিটি করেছিলেন তাতেও কোনো নতুন ভুবনের পথে চলার নির্দেশিকা ছিলো না।  কিন্তু প্রতিবাদ আর আত্মসমালোচনার যে যুগল সাধনার পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন তার কোনো বিকল্প আজ পর্যন্ত পাই নি আমরা। এমনকি সেই পথে সঠিকভাবে হাঁটার  সাহসটুকু পর্যন্ত দেখাতে পারিনি ঠিকভাবে, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই দুঃসময়ে।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ মে ২০২৩ | ৫৬৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন