ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে বড় হয়েছি। আসলে সবটাই যে আমার বাবা - মায়ের জন্য তাও বলা যাবে না, কারণ সেই সময়টাও অন্য রকমের ছিল। সভ্যতা, ভদ্রতা, শালীনতা, রুচিশীলতা ইত্যাদি অনেকগুলো শব্দের আধিপত্য ছিল সেই সময়ে। আমার গুরুজনেরা হয়তো বলবেন আমাদের সময়ে এই আধিপত্যের মাত্রা কমতে কমতে শূন্যের কাছাকাছি চলে এসেছিল, তবুও আমরা বলব আজকের সময়ের তুলনায় সেই আধিপত্যের উপস্থিতি যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। ফলে আজকের ছেলেমেয়েরা যে পরিমাণ স্বাধীনতার স্বাদ ছোটবেলা থেকেই পায় তার এক কণাও আমরা পাইনি। বলতে গেলে আমরা বিয়ে করার পরেও অনেক কিছুর স্বাধীনতা পাইনি। হুট করে বউকে নিয়ে কোথাও বেরোতে পারিনি, হুট করে বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ী চলে যেতে পারিনি এবং এই ধরনের অনেক বিধিনিষেধ ছিল আমাদের কালে। স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পেতে খেয়াল হলো বয়সটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তবে বাকী জীবন আমাদের আর উশৃঙ্খল হওয়া আর হলো না, ছোটবেলার সেই পায়ের বেড়িগুলো বোধহয় অদৃশ্য হলেও থেকেই গেছে। তবুও সভ্যতা, ভদ্রতা, শালীনতা, রুচিশীলতা বজায় রেখেই স্বাধীনতা উপভোগ করে চলেছি। আবার এটাও চেষ্টা করে চলেছি যে আমার উপভোগের ফলে সংসারের বাকীদের জীবন যেনো দুর্বিষহ না হয়ে ওঠে। আবার স্ত্রী, কন্যারাও যেনো স্বাধীনভাবে জীবন ধারণ করতে পারে। চেষ্টা করি মনে রাখার যে, আমি যেমন স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখি, তেমনি তারাও রাখে। তবুও হয়তো মাঝে মধ্যে এর বিচ্যুতি ঘটে, সেই কারণেই এর নাম সংসার।
কিন্তু যতদিন যাচ্ছে আমার বা আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এটা অবশ্য সংসার বা সমাজগত দিক থেকে নয়, এটা সম্পূর্ণই চাকুরীগত দিক থেকে। অবশ্য চাকুরীতে স্বাধীনতার মাত্রা যে খুবই কম সেটা বোঝার মত বয়স বা অভিজ্ঞতা হয়েছে। সাধারণভাবে এটা সন্মানের প্রশ্ন। চাকুরীতে ছোট, বড় পদ আছে। সবাই ছোট বা সবাই বড় পদে কাজ করে না। আবার কর্মচারীর কাজের মূল্যায়নের অনেক পদ্ধতি আছে, এমনকি কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়ারও নিয়ম বা পদ্ধতি আছে। আমি উচ্চ পদে কাজ করি মানেই তো আমার যারা অধস্তন কর্মচারী তাদের কোনো মান সন্মান নেই বা কাজের স্বাধীনতা নেই, তা নয়। আবার প্রতিটি কাজেরই নিয়ম নীতি আছে, প্রত্যেকটি কর্মচারী সেই নিয়ম নীতি মানতে বাধ্য। নইলে শাস্তি হতেই পারে। প্রতিটি কর্মচারীর কাজের ধরন আলাদা, ফলে আসল বিষয় হলো, আমরা আমাদের মত করে নিয়ম নীতি মেনে প্রতিটি সরকারী কাজ করবো, সরকারের প্ল্যান বা পলিসি বাস্তবায়িত করবো। না পারলে আমার কাজের মূল্যায়ন খারাপ হবে, আমার ভবিষ্যত অন্ধকার হবে। এটা সব সরকারী কর্মচারীই জানে। এর বাইরে একটা পথ আছে যা সাধারণত উচ্চ পদে যারা কাজ করেন তারা হামেশাই নিয়ে থাকেন সেটা হলো, অধস্তন কর্মচারীদের ধমক দেওয়া। এটা একটা সহজ রাস্তা। ধমক খেলে যে কোনো কর্মচারীই ঘাবড়ে যায় এবং এতে যদি আসল কাজটা হাসিল হয়ে যায় তাহলে সেই কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে হয় না। এটা অধস্তন কর্মচারীর পক্ষেও হিতকর, কারণ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হলো না আবার কাজটাও হয়ে গেলো। কিন্তু এই ধমক দেওয়ার ক্ষেত্রেই যত গন্ডগোল ঘটে যায়। উচ্চপদস্থ কর্মচারীর খেয়াল থাকে না যে অধস্তন হলেও তার মান - সন্মান বলে কোনো অনুভূতি আছে। সে যে উচ্চপদস্থ কর্মচারী, তার পদমর্যাদা যে অনেক বেশী এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী তার আচরণ করা উচিত সেটা প্রায়শই সে ভুলে যায়। এতে যেমন অধস্তন কর্মচারীর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে তেমনি সেই উচ্চপদস্থ কর্মচারীও হাসির খোরাক হয়।
স্বাধীনতার অর্থ জীবনের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ভাবনার ক্ষেত্রে, যাপন পদ্ধতির ক্ষেত্রে নিজস্বতা থাকবে এবং অবশ্যই বিবেক ও আত্মসম্মান বজায় রেখে। আমি যেমন আমার আত্মসম্মান বজায় রেখে জীবনযাপন করবো তেমনি অন্যের সম্মানও বজায় রাখবো। নইলে তার স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ হয়ে যাবে। এটা সংসার বা সমাজের ক্ষেত্রে বলতে পারলেও চাকুরী জগতে বলা যায় না। কারণ উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা অধস্তন কর্মচারীর স্বাধীনতায় অর্থাৎ বলা যেতে পারে আত্মসম্মানে অহরহ হস্তক্ষেপ করে।
আবার সংসারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, একজন সদস্য অন্য সদস্যদের আত্মসম্মানে আঘাত করে অহরহ। যদিও সংসারটা সং সেজে থাকার জায়গা তবুও সেই আঘাত অনেকক্ষেত্রেই সহ্যসীমার মাত্রা ছড়িয়ে যায়। তখন মনে হয় সংসার ছেড়ে চলে যাই অন্য কোথাও। আবার চাকুরী জগতের প্রভাব বা রেশ সংসারের মধ্যেও ঢুকে পড়ে হামেশা। ছেলে বা মেয়ে যেই চাকুরী করুক, বা কোনো পেশাগত জগতের লোক হোক, সেই জগতের টানাপোড়েন সংসারে চলে আসে অনাহুতের মত। তখন সংসার আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
এবার প্রশ্ন হলো এইরকম যদি ঘটে তাহলে পরিত্রাণের উপায় কি? নিজের স্বাধীনতা এবং আত্মসম্মান নিয়ে কোনরকম আপস করা যায়না। যারা করতে পারে তারা এই আলোচনার বাইরে থাকবেন। যারা পারেন না তাদের জন্য এই পরিস্থিতি খুব ভয়ংকর। অনেককেই দেখেছি তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক দূরে থাকে এবং বাবা, মাকে তাদের কাছে নিয়ে যায়নি। হয়তো নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাবা, মা তাদের বাড়ীতে থাকেন একা একা। এরপরে বাবা বা মায়ের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্যজন সেই বাড়ীতে একা থাকেন। আমার শ্বশুর মশাই মারা যাওয়ার পরে আমার শ্বাশুড়ী আর শালী থাকতো তাদের বাড়ীতে। এরপরে শালীর বিয়ে হয়ে গেলে শ্বাশুড়ী একা একাই থাকতেন সেই বাড়ীতে। শালীর অনেক দূরে বিয়ে হওয়ায় তার পক্ষে শ্বাশুড়ীকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু আমি বা আমার বউ অনেক চেষ্টা করেছি আমাদের কাছে নিয়ে এসে রাখতে, কিন্তু তিনি রাজী হননি কোনোদিন। একাকীত্ব ছিল তাঁর, মাঝে মাঝে প্রকাশ করতেন, কিন্তু নিজের স্বাধীনতার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেন না এবং স্বাধীনভাবেই থাকতে চাইতেন। আমার বাবা, মা তাদের বাড়ীতে থাকতো। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা সেই বাড়ীতে একাই থাকতো। বাবাকেও আমার কাছে চলে আসার কথা বললে এড়িয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে আসতেন আমার কাছে, কিছুদিন থাকতেন আবার চলে যেতেন। তাঁরও একাকীত্ব ছিল কিন্তু নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চাইতেন না। আমার এক বন্ধুর মা একাই থাকেন তাঁর বাড়ীতে। দুই ছেলেই বাইরে থাকে, মাকে নিয়েও যেতে চায়। কিন্তু মাসীমা যেতে চাননা। এখানেও সেই স্বাধীনতার বিষয়, তাঁরও একাকীত্ব আছে কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকতে চান তিনি।
বয়স বাড়লে ছেলেমেয়েরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে চলে যাবে, তাদের নিজেদের সংসার হবে এটাই বাস্তব। সেই সংসারে বাবা, মায়েরা অনাবশ্যক হয়ে যেতে পারেন আবার নাও হতে পারেন। কিন্তু যেটা অবশ্যই হবেন সেটা হলো অন্যের সংসারে আপনি অতিথি। সংসারের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব চলে যাবে, মানে সেই স্বাধীনতা চলে যাবে। ফলে অনেকেই এই ব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলেন। একাকীত্ব আর স্বাধীনতার মধ্যে স্বাধীনতাকেই বেছে নেন। এতে পারস্পরিক সম্পর্কও বজায় থাকে, স্বাধীনতার প্রশ্ন এসে গেলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চলে আসতে বাধ্য।
নিজের স্বাধীনতা এবং একাকীত্ব মিশিয়ে ভাবতে গেলে সবচেয়ে ভালো জায়গা বৃদ্ধাশ্রম। নিজের বাড়ীতে একাকীত্ব একটা বড় প্রশ্ন, আবার অনেকখানি অসহায় অবস্থার কথাও একটা বড় প্রশ্ন। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি নিজের বাড়ীতে অসুস্থ হয়ে পড়লে অসুবিধার সন্মুখীন হতে। তখন আপনজনেরাও বিপদে পরে। আর বেশী বয়সে হামেশাই শরীর বিগড়ে যায় এবং তখন আপনজনেদেরও অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। কারণ তারা না পৌঁছনো অব্দি চিকিৎসাই শুরু হয়না। এরমধ্যে সেই মানুষটি মারা পর্য্যন্ত যেতে পারে। বৃদ্ধাশ্রমের ক্ষেত্রে তারা অন্ততঃ হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়, ন্যূনতম চিকিৎসাটা শুরু হতে পারে। স্বাধীনতার দিক থেকে দেখতে গেলে সেখানে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ঘরে থাকে, যেখানে নিজস্বতা রক্ষা হয়। আবার সকালের চা, জলখাবার, দুপুরের খাওয়া, বিকেলের চা, রাত্রের খাওয়ার সময়ে সকলে একত্রিত হয় এক জায়গায়। গল্পগুজব চলে, যাকে আমরা আড্ডা বলি। বৃদ্ধাশ্রমে তাদের দেওয়া জিনিসের পাশাপাশি নিজের জিনিসও রাখার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। নিজের ঘরে চায়ের ব্যবস্থা, টিভি দেখার ব্যবস্থা, স্নানের জল গরম করার ব্যবস্থা ইত্যাদি কিছু অতিরিক্ত পয়সার বিনিময়ে করে নেওয়া যায়। ফলে বৃদ্ধাশ্রমের চা বা খাওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও যদি মন চায় তাহলে নিজে চা করে খেয়ে নেওয়া যায়। নিজের সময় মত স্নান করে নেওয়া যায়। নিজের পছন্দমত টিভির চ্যানেল দেখা যায়। যদি বড় মাপের বৃদ্ধাশ্রম হয় তাহলে তাদের ডাক্তার এবং ওষুধের ব্যবস্থাও থাকে। ছোটখাটো শরীর খারাপ হলে তারাই চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়। বড় কিছু হলে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় এবং আপনজনদের খবর দেয়। ফলে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যেরকম ধারণা মানুষের মনে প্রোথিত আছে বাস্তব কিন্তু সেইরকম নয়। আপনজনদের কাছ থেকে দূরে থাকার বেদনা বয়স বাড়লে হবেই, এটাই বাস্তব। কেউ যদি ভেবে থাকেন বয়সকালেও ছেলেমেয়েদের সংসারে থাকবেন তাহলে এই যুগে মানিয়ে নেওয়া খুব মুশকিল। কারণ প্রত্যেকেই এত ব্যস্ত, সময়ের সাথে তাল মেলাতে ব্যস্ত, আপনার দিকে খেয়াল রাখতে পারবে না। ছেলেমেয়ের সংসারে থাকলেও সেই একাকীই পরে থাকতে হবে। আসলে আমরা আগের যুগের সাথে এখনকার সময় মেলাতে চাই। আগের যুগে এত ব্যস্ততা ছিল না, সময় এত দ্রুত ছিল না, সংসার এত ক্ষুদ্র ছিল না।
মূলতঃ আজকের এই সমস্যার মূলে রয়েছে সংসারের বিভাজন। ক্ষুদ্র হতে হতে এখন যা অণুতে পরিণত হয়েছে। এরপরে ইলেকট্রন, প্রোটন বেড়িয়ে পড়বে। দেশ যেমন বিভাজিত হয়েছে তেমনি সংসারও বিভাজিত হয়েছে। আবার আমাদের মনও বিভাজিত হয়েছে। এখন সব কিছুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বলা যেতে পারে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক। অন্যের সমস্যা নিজের কাঁধে নেওয়ার মতো মানসিকতা আমরা বহুকাল আগেই হারিয়েছি। এখন এই অন্যের তালিকায় নিজের পরিবারের অন্য সদস্যরাও চলে এসেছে, আমাদের জগৎ এতটাই ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছে এখন। দেশ বিভাজন মানে যেমন শিকড় থেকে উৎপাটিত হয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে পড়া, যেখানে চেনা - পরিচিত কেউ নেই, নিজস্ব মাটির গন্ধ নেই, চেনা আকাশ - বাতাস নেই, রুটি - রুজির সংস্থান নেই, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার রসদ নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই, বারান্দার টবে বেলি ফুলের শুভ্রতা নেই, চেনা মানুষ - চেনা ভূমির গন্ধ নেই। আছে শুধু হাহাকার, চোখের জল, উদাত্ত খিদে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, টিকে থাকার লড়াই আর নতুন জায়গায় নতুনভাবে আবার বেঁচে ওঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
সংসার বিভাজন দেশ বিভাজনেরই একটি ক্ষুদ্র রূপ। সংসার বিভাজনেও একই সমস্যা তৈরী হয় সেই সংসারের সকল সদস্যদের মধ্যে। তবুও আমরা মেনে নিয়েছি আমাদের সংসার বিভাজনকে। তৈরী করেছি আমাদের নিজস্ব স্বার্থকেন্দ্রিক বৃত্তকে, যেখানে অন্যের প্রবেশ নিষেধ। এরপরেও কিন্তু আমরা বৃদ্ধাশ্রমের নাম শুনলেই নাক সিটকে উঠি। কাউরির বাবা বা মা বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছে শুনলেই সেই ছেলে বা মেয়ের বাপান্ত করি। আমরা প্রত্যেকেই ভাবি ছেলেমেয়ে আমার বিলেত থেকে ডিগ্রি অর্জন করে আসবে, উচ্চপদে চাকুরী করবে, গাড়ী - বাড়ী করবে, অঢেল সম্পত্তির মালিক হবে আবার সংসারের প্রত্যেক সদস্যদের সাথে অঢেল সময় ব্যয় করবে। বাবা, মায়ের বা সংসারের প্রত্যেক সদস্যের সুখে - দুঃখে সবসময় পাশে থাকবে। অথচ এটা ভাবি না যে ছেলেমেয়ের কাছে আমাদের চাহিদার যে লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছি তাতে তারা টাকা রোজগারের মেশিনে পরিণত হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ক্রমশই ভোঁতা হয়ে পড়ছে। তারা যে বাঘের পিঠে সওয়ারি হচ্ছে সেখান থেকে নেমে আসার কোনো উপায় নেই। তাহলে আমাদের ভবিতব্য তো আমরাই ঠিক করছি, অযথা ছেলেমেয়েকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
এই সুন্দর পৃথিবীতে এসেছি সুন্দরের পূজারী হতে, অযথা নিজের স্বাধীনতা, মান - সন্মান নষ্ট করে লাভ কি? বরং নিজের গণ্ডির মধ্যে থেকে নিজের স্বাধীনতা এবং মান - সন্মান বজায় রেখে চলাটাই শ্রেয়। সংসারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও তাদের স্বাধীনতা উপভোগ করতে দেওয়া উচিত। বৃদ্ধাশ্রম সেক্ষেত্রে এক আদর্শ না হলেও উৎকৃষ্ট জায়গা। ছেলেমেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বরং নিজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার। ছেলেমেয়েরা তাদের সময়মতো বাবা - মায়ের খোঁজ নেবে, ভিডিও কল করবে আর বাকী সময় স্বাধীনভাবে বাঁচা যাবে। একাকীত্ব অনেকটাই কেটে যাবে বাকী সদস্যদের সাথে আলাপচারিতায়, গল্পগুজব আর হৈ চৈ করে।
যদিও ওপরের কার্যকারণগুলোতে মধ্যবিত্ত মানসিকতা স্পষ্ট, তবুও খরচের দিক থেকে দেখতে গেলে সবটা অবশ্যই উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ইচ্ছে থাকলেও হয়তো উপায় থাকবে না খরচের জন্য। আর প্রান্তিক লোকেদের জন্য এটা স্বপ্নস্বরূপ। আবার এটাও বাস্তব যে, প্রান্তিক লোকেদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার মাপকাঠি অন্য, উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের সাথে মেলে না। ফলে তাদের স্বাধীনতা বা মান - সন্মান বা একাকীত্বের জন্য বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। সবাই মিলে একই ছাদের তলায় তারা দিব্যি থাকে। একাকীত্বের কোনো প্রশ্নই নেই, আর স্বাধীনতা বা মান - সম্মানও বিঘ্নিত হয় না। সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের স্বাধীনতা বা মান - সন্মানের মাপকাঠি প্রান্তিক মানুষগুলোর মাপকাঠির সাথে খুব এমন ফারাক থাকে না। এদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় ছেলেমেয়েরা যখন উচ্চপদে চাকুরী করে বা ব্যবসায় প্রচুর পয়সার আগমনের ফলে উচ্চবিত্তের পর্যায়ভুক্ত হয় তখন। বাবা - মা আর ছেলেমেয়ের চিন্তা - ভাবনার ক্ষেত্রে বহু পার্থক্য হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের সাথে বাবা, মায়েরা তাল মেলাতে পারে না (যাদের গজিয়ে ওঠা উচ্চবিত্ত বলা যেতে পারে)। আর উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বা মান - সন্মানের সাথে মর্যাদা, ঠাটবাট, অহং ইত্যাদি অনেক শব্দ যুক্ত হয়ে যায়। ফলে বাবা - মায়ের সাথে ছেলেমেয়েদের সেই অর্থে একটা দূরত্ব ছোটবেলা থেকেই তৈরী হয়ে থাকে এবং চিরকাল বজায় থাকে। তাই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আলোচনা শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত আর গজিয়ে ওঠা উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে কারণ এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ। আবার এটাও সঠিক যে, বৃদ্ধাশ্রম গুলোতে যত না উচ্চবিত্তদের ভীড় তার চেয়ে বেশী মধ্যবিত্তদের ভীড়।
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
কবিগুরুর কথা আজও প্রাসঙ্গিক, মধ্যম চিরকালই উত্তম ও অধমের থেকে আলাদা। সে সবসময়েই দ্বন্দ্ব ও সংশয়ে ভোগে এবং উত্তম ও অধমের থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রাখে। আসলে মধ্যম জায়গাটা চিরকালই অসচ্ছ, স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল। সেই দ্বিধা, দ্বন্দ্বের বা সংশয়ের জায়গা থেকেই বোধহয় স্বাধীনতাহীনতা, ঠুনকো আবেগের বশবর্তী হয় খুব অল্পতেই। সেই কারণেই বৃদ্ধাশ্রমে মধ্যবিত্তদের ভীড় বেশী।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।