এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ছেঁড়াকাঁথা

  •  ছেঁয়াবাজীর ছলনা  - ১৪ 

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ছেঁড়াকাঁথা | ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ৭৫৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পুজোর ছুটি যেদিন পড়ে, সেদিন এই স্কুলটায় হাফ ছুটি হয়, আর সবাই সেদিন স্কুলড্রেসের বদলে অন্য জামাকাপড় পরে আসে। এইটা বেশ মজার ব্যপার, আমার কলকাতার ইস্কুলে ছুটি পড়ার দিনও দিব্বি ড্রেস পরে যেতে হত। এখানে বড়ক্লাসের দিদিরা সবাই কেমন নানারঙের শাড়ী পরে এসেছে, আমাদের ক্লাসেও অনেকেই শাড়ী পরেছে। শুধু আমি, রীমা আর রিতা মন্ডল ফ্রক পরেছি। গরমের ছুটি যেদিন পড়ল, আমি ড্রেস পরেই এসেছিলাম, জানতাম না তো, এইবারে মা একটা কমলা রঙের সুন্দর জামা পরিয়ে দিয়েছে। এই জামাটা বাবা বম্বে থেকে এনে দিয়েছিল। বাবা বম্বে গেলেই আমার জন্য সুন্দর সুন্দর ফ্রক নিয়ে আসত, মা ওগুলো খুব যত্ন করে স্যুটকেসে রেখে দিয়েছে, সহজে পরতে  দেয় না, নষ্ট করে ফেলি যদি। ক্লাস ফোরের মেয়েরা ক্লাস টীচার প্রতিমাদির জন্য মিষ্টি আর সিঙারা এনেছে। ফাইভের মেয়েরাও ওদের ক্লাস টীচার রেবাদির জন্য রসগোল্লা আর ফুলুরি এনেছে, আমরা কিচ্ছু আনি নি।  কিন্তু কি করব! আমরা তো জানতামই না, আর আমাদের কারো কাছেই পয়সা নেই।

    আমাদের ক্লাস টীচার অনুরেখাদি ফোর ফাইভের মেয়েদের খুব প্রশংসা করেন, ওরা খুব লক্ষ্মী আর বাধ্য, মন দিয়ে পড়াশোনা করে, আমাদের মত খেলে বেড়ায় না। স্কুল খুললেই অ্যানুয়ালি পরীক্ষা, আমরা মোটেই পড়ি না তো, নির্ঘাৎ সব বড় বড় রসগোল্লা পাব।  আজ অঙ্ক ক্লাসে প্রতিমাদি আর বকাবকি করেন না, পরীক্ষার জন্য ছুটিতে মন দিয়ে অঙ্ক প্র্যাকটিস করতে বলে চলে যান। টিফিনের ঘন্টা পড়তেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়্। শিপ্রারা রীমাদের বাড়ী যায় ওর পুজোর জামা দেখতে, আমারও খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু দাদু নিতে আসবে। না বলে কয়ে অন্য কোথাও চলে গেছি দেখলে ধুন্ধুমার কান্ড হবে। অবশ্য আজকে বাড়ী আসার সময় দাদু ঘুরিয়ে মনসাতলা থেকে বাঞ্ছারাম মিত্র লেন দিয়ে নিয়ে আসে, মিতালী সঙ্ঘ আর কালীতলার পুজোর প্যান্ডেল প্রায় শেষের মুখে, আজ  রাত্রে ঠাকুর আসবে, তার আগেই প্যান্ডেল শেষ করতে হবে। এবারে আমরা আর মুক্তদল, সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, মুদিয়ালির ঠাকুর দেখব না, বিজয়ার দিন বাবুঘাটে ভাসান দেখতে যাব না, এবারে আমরা কালীতলা, মিতালী সঙ্ঘ, মনসাতলা ব্যায়াম মন্দির, অগ্রদূত এইসব ঠাকুর দেখব। আজ  পঞ্চমী, কাল ষষ্ঠী।

    অ্যানুয়ালি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো আমার বেশ সোজা লাগে, হাপিয়ার্লির প্রশ্নগুলোর মত কঠিন নয়। এখানে কেমন প্রশ্নগুলো বাড়ীতে দিয়ে দেয়! হলদেটে রঙের খবরের কাগজের মতন কাগজে ছাপা প্রশ্ন, ওপরে লেখা থাকে ‘কোন্নগর কল্যাণ পরিষদ' 'বালিকা শিক্ষা সদন' 'জুনিয়ার বেসিক’। ছোটমামা যখন ক্ষেপায় ‘তোদের তো স্কুলই নেই, নাম নেই কিছু না', তখন এই প্রশ্নগুলো দেখানো যাবে; এতে দিব্বি স্কুলের নাম লেখা আছে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই, তারপর একমাস খুব মজা; যত ইচ্ছে খেলো, গপ্পের বই পড়ো কেউ বকবে না।জিজির কেনা শারদীয়া আনন্দমেলা মা পুজোর ছুটিতে পড়তে দেয় নি, এইবারে পড়ে ফেলি।  ফল বেরোবে ২৪ তারিখ, সেদিনই বাবার ‘বাৎসরিক কাজ' তাই জিজি, ছোড়দি, দাদা আসবে কলকাতা থেকে, পিসামশাই আর মিনামা কল্যাণী থেকে। সকাল থেকে মা কিরকম শক্ত মুখে কিসব করছে, শচীন্দ্র পুরুতমশাই এসে বসে আছেন, সঙ্গে আরেকজন রোগামত পুরুতমশাই। সেজমামা, মামীমা খুকুকে নিয়ে ব্যারাকপুর থেকে এসেছে, মেজমামারা কুচবিহার থেকে আসতে পারে নি, ছুটি পায় নি।

    সকাল আটটায় বেরোবে ফল, দাদু আমাকে নিয়ে গেল রিপোর্ট কার্ড আনতে। আজকে আর কেউ খেলছে না, চুপটি করে ক্লাসে বসে আছে। ওয়ান, ট্যুতে সাধনাদি গিয়ে সবার নাম ডেকে ডেকে কার্ড দিয়ে আমাদের ক্লাসে এলেন, সঙ্গে বাকী দিদিমণিরাও।  সবাই এসে বোর্ডের সামনে লাইন করে দাঁড়ালেন আর তারপরই সাধনাদি আমার নাম ধরে ডাকলেন। শিপ্রা এই ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, হাপিয়ার্লিতেও ওর রিপোর্ট কার্ডই আগে দিয়েছিলেন অনুরেখাদি। আমার নাম ডাকছেন কেন, তার মানে কি অনুরেখাদির কথাই ঠিক হয়েছে ... সবকিছুতে গোল্লা পেয়েছি আমি! ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, মা যা মারবে না আজকে, ওরে বাবারে ... জানলা দিয়ে পুকুরটায় লাফ দিলে কেমন হয়? কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না ডুবে মরে যাব যে! প্রতিমাদি এবারে এগিয়ে এসে বললেন ‘কী হল এসো'; আস্তে আস্তে গিয়ে কার্ডটা হাতে নিলাম, সাধনাদি চুলে হাত দিয়ে বললেন ‘খুব ভাল করেছ তুমি, এই ক'মাসেই খুব উন্নতি করেছ, অনেক বড় হও', প্রতিমাদি বলছেন ‘তুই কিছুতেই অঙ্কটা মন দিয়ে করিস না, নাহলে একশো পেতিস’।  

    আমি ভয়ে ভয়ে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে দেখি কালো কালিতে লেখা রয়েছে ‘স্থান ::প্রথম'| চোখের কাছে এনে আরও  ভাল করে দেখি, নাঃ ঠিকই দেখছি, ক্লাসে ততক্ষণে শিপ্রা, রীমার নাম ডাকা হয়ে গেছে দ্বিতীয় আর  তৃতীয় হিসেবে।  ওদের কি মন খারাপ হয়েছিল একটু করে পিছিয়ে যাওয়ায়? কি জানি! আমার দেখা হয় নি, আমি দাদুর হাতে কার্ড দিয়ে প্রায় উড়তে উড়তে বাড়ী আসি, আজ  আর দাদুকে ছেড়ে এগিয়ে গেলেও দাদু বকে না। বাড়ীতে ততক্ষণে ‘কাজ’ শুরু হব হব করছে, আমি এসেই চেঁচামেচি লাগিয়ে দিই, নিজের সম্পর্কে আমার এবং অন্যদের এতই খারাপ ধারণা ছিল যে প্রত্যেকে আমার এই কীর্তিতে আমার মতই অবাক হয়ে যায়। ক্লাস ফোর হল গিয়ে সেই লম্বা টানা পাকা ঘরে, মাঝে মাঝে চাটাইয়ের বেড়ার পার্টিশান দিয়ে ক্লাস ভাগ করা।  সবগুলো পার্টিশানেরই বাঁদিকে খানিকটা করে খোলা, ফলে একদম শুরুর ক্লাস ফাইভে ঢুকলে ভেতর দিয়ে দিয়ে একদম শেষে ছেলেদের ক্লাস ফোর অবধি চলে যাওয়া যায়, মাঝে পড়ে মেয়েদের ক্লাস ফোর, ওয়ান, ট্যু, ছেলেদের ক্লাস থ্রী আর ফোর।

    টিফিনের সময় চোর চোর খেলায় খুব সুবিধে হয় এদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে ক্লাসের মধ্যে দিয়ে দিয়ে গলে গিয়ে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে আবার ঘুরে আসা ... দরকারমত বেঞ্চির ওপর দিয়েও দৌড়াতে হয় আর তাই করতে গিয়ে পা পিছলে মাঝে মাঝে পড়েও যাই। তা খেলার সময় কি আর অত খেয়াল থাকে! আর এই ইস্কুলেই যা রোজ খেলা হয়, বাড়ী থেকে বিকেলে তো রোজ বেরোতেই দেয় না। বাবুদের বাড়ীর সামনের মাঠটায় আমরা মেয়েরা খেলি আর আমাদের বাড়ীর পাশের মাঠটায় ছেলেরা বল খেলে। মাঠটার শেষে একটা মস্ত পুকুর, বর্ষাকালে ঐ পুকুরটা ভাসলে ছোট ছোট মাছগুলো রাস্তায়, দিদাদের উঠোনে চলে আসে। বুড়ির-মা মাসি বড় গামছা দিয়ে কেমন খপাৎ করে ধরে ফেলে। কিন্তু মাঝে মাঝে ছেলেরা এই সামনের মাঠেও খেলতে চলে আসে আর তখন মেয়েরা সবাই শুভ্রাদের উঠোনে খেলে। দিদা আমাকে শুভ্রাদের বাড়ী খেলতে যেতে দেয় না। কারণটা আমি কিছুতেই ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। ছোটদিও ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই ভাগাড়পাড়া স্কুলেই পড়েছে, ছোটদি নাকি ওয়ান থেকেই ফার্স্ট হত।

    ছোটদিরাও মাঝে মাঝে শীলাদিদের উঠোনে খেলতে যেত; তখন নাকি শীলাদির কাকিমা মানে শুভ্রার মা ছোটদিকে জিগ্যেস করত ছোটদির সাথে সেকেন্ড গার্লের কত নম্বরের তফাৎ? ছোটদি নাকি বলত ২০ বা ২৫ আর তখন নাকি শুভ্রার মা মুখ টিপে টিপে হাসত আর বলত ‘ওমা মাস্টারপাড়া স্কুলে ফার্স্ট হয়েও মাত্র এই কটা নম্বরের তফাৎ!'  ছোটদি সিক্স থেকে গঙ্গার ধারের ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়'এ ভর্তি হয়, সেখানে আর কোনোদিন দশজনের মধ্যে আসে নি। শুভ্রাদের উঠোনে খেলতে যাব বললেই বড়মামীমা এই গল্পটা বলবে আর অমনি দিদা একেবারে জ্বলে উঠে না করে দেয়। আমি তেমন দৌড়াতে পারি না, বাড়িতেও সবাই ঢেপসি ঢ্যাঁড়শ এইসব বলে, খেলাতেও কেউ খুব একটা দলে নিতে চায় না। আমাকে যেতে দেয় না তাই ওরাও শুভ্রাদের বাড়ী খেলতে গেলে আমাকে আর ডাকে না। পারি না, তাও আমার দৌড়াতে, খেলতে ইচ্ছে করে খুব, তাই ইস্কুলের খেলাটা আমি একদম মিস করি না।

    বোম্বে থেকে বাবার অফিসের মিস্টার নানাবতি এসেছিলেন কলকাতার অফিসের দাশগুপ্তকাকাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কোন্নগরের বাড়ীতে। বলে গেছেন ভাই যদি এক্ষুণি স্কুলে ভর্তি হয় তাহলে অফিস থেকে মাসে আড়াইশো টাকা করে খরচ দেবার ব্যবস্থা করে দেবেন ভাইয়ের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। ভাইকে তাই তাড়াতাড়ি শিশু শিক্ষা সদনে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, মা সকালে গিয়ে দিয়ে আসে আর দাদু দশটার সময় গিয়ে নিয়ে এসে তারপর আমাকে আনতে যায়। আমার ট্যাবলা টোবলা ভাইটা এমনিতে খুব একটা কাঁদে টাদে না, ট্রেনে ভীড়ের মধ্যে খুব গরম লাগলেও চুপ করে মা'কে ধরে বসে থাকে, আমার মত উফ্ আফ্ করতে থাকে না। কিন্তু ইস্কুলে যেতে যে ওর কি ভয়! স্কুলে ঢুকলেই হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে, কিছুতেই মা'কে ছাড়বে না, জোর করে নিয়ে গেলেও চীৎকার করে কাঁদতে থাকে। দাদু অনেকসময় পাঁচ দশমিনিট আগেই পৌঁছে যায়, দাদুকে দেখলেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসে, স্কুলেও নাকি সারাক্ষণ কেঁদে চলে।
    একবছর ও এমনিভাবে কেঁদেই গেল, কোনও ক্লাসে খেলল না, ছড়া বলল না,

    শুধু নাকি অমিতাদি'র কাছে একটু চুপ করে থাকত, অন্য দিদিমণিদের দেখলেই কাঁদত। বাড়ীতে ওকে বুঝিয়ে, আদর করে, বকে ভয় দেখিয়ে কিছুতেই মানানো যায় নি। অথচ স্কুল ছাড়ানো যাবে না তো, ঐ আড়াইশো টাকাই তখন একমাত্র নিয়মিত আয় যে। মা'র নাকি আমাদের স্কুলে একটা চাকরি হবে, গোপালবাবু বলেছেন দাদুকে, কিন্তু একটু সময় লাগবে। অনেক বড় হয়ে চাকরিসূত্রে বাড়ীছাড়া হবারও বেশ অনেকবছর বাদে জানতে পেরেছিলাম মা ঐ টাকা কোনোদিন খরচ করে নি। ভাইয়ের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত পাওয়া টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট বা পোস্টাপিসে কিষাণ বিকাশপত্র করে রেখে রেখে বরং বাড়িয়েছে, ভাই সাবালক হয়ে পড়া শোনা শেষ করার পরে ভাইকে দিয়েছে।পড়াশোনার বিভিন্ন পর্যায়ে মা যখন বারেবারে আমাকে বলত খরচ চালানো খুব কঠিন আর আমি ভাবতাম ভাইয়ের পড়ার টাকা তো আসে আমারটাই মা পেরে উঠছে না, ভয়ে লজ্জায় কোন প্রাইভেট টিউশন, কোনওকিছু শেখার কথা বলতে পারতাম না, মা তখন আসলে ভাইয়ের জন্য কর্পাস ফান্ড তৈরী করছিল। তাই ভাইয়ের ক্লাস ট্যু থেকে বাড়ীতে মাস্টার রেখে পড়ানো, দুজনের খরচ, সামলে উঠতে পারত না।   

    বাড়ীতে ভাই আমাদের সবার কোলে কোলে থাকে আর মনের আনন্দে বাছুর দাম্বের সাথে খেলে বেড়ায়। লালীর যত বাছুরই হোক, ভাই তাদের নাম দিত 'দাম্বে', আর বাছুরগুলোও ওকে খুব ভালবাসত, ও  উঠোনে খেলতে না নামলে চারটে সিঁড়ি টপকে উঠে আসত বারান্দায় ওকে খুঁজতে। তারপর একটা খুব মজা হত, বাছুরগুলো উঠে তো পড়ত দিব্বি, কিন্তু তারপর আর সিঁড়ি টপকে নামতে পারত না, তখন ওদের ক্ষুরগুলো সিমেন্টে স্লিপ করত আর ভয় পেয়ে ওরা বারান্দায় বসে পড়ে চীৎকার জুড়ে দিত। এদিকে বাছুরকে বারান্দায় উঠতে দেখলে ছোটদি সাংঘাতিক ভয় পেত। ছোটদি ভয় পেয়ে চীৎকার জুড়লেই দিদা খুব রেগে যেত আমাদের ওপর, আমরাই নাকি এই বাছুরগুলোকে বারান্দায় উঠিয়ে ছোটদিকে ভয় দেখাই। তখন হয় দাদু নয় আমি গিয়ে বাছুরটাকে কোলে করে নামিয়ে দিতাম। বাছুর কোলে নিলেই টের পেতাম থরথর করে কাঁপছে, ওই থিরথির কাঁপুনিতে পেটের কাছে সুড়সুড়ি লাগত আর খিলখিল করে হাসতাম। দিদা আরো রেগে যেত। ছোটদি অবশ্য যাবতীয় পশুপাখিকেই ভয় পেত।

    কিন্তু এইসব হই হ্ট্টগোলের মধ্যে কেউ খেয়াল করল না ভাই আস্তে আস্তে কিরকম একাচোরা হয়ে যাচ্ছে, অচেনা লোকের সামনে আসতে চায় না, খাটের তলায় গিয়ে লুকিয়ে থাকে। খুব বেশী কথাবার্তা বলে না, কেউ খেয়াল করল না ও ‘বাবা' শব্দটা কখনও উচ্চারণ করে না, কেউ খেয়াল করল না অ্যালবামে বাবার ছবি দেখলে ও ঐ পাতাটা তাড়াতাড়ি উল্টে দেয়। কতদিন, কতবছর পরে যেন জিজি বলেছিল সেই ভয়ংকর খ্রীস্টমাস ঈভের দিন নাকি জিজি ভাইকে কোলে নিয়েই দাদা, পিসামশাই, বাচ্চুকাকা, হারুকাকাদের সঙ্গে সঙ্গে হাজরামোড় পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, পিসামশাই হঠাৎ খেয়াল করে জিজির কোলে ভাই রয়েছে। একবার করে সামনের দিকে তাকাচ্ছে, ঐ কমলা খাট আর তাতে বাবার দুই পায়ের পাতা দেখছে আবার মুখ ফিরিয়ে জিজির গলা শক্ত করে জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজছে। পিসামশাই তখন প্রায় ধমক দিয়ে জিজিকে বাড়ীতে ফেরৎ পাঠায়| ভাইয়ের তখন দু'বছর বয়স। কি মনে হয়েছিল, মনে হত  তখন,  এখনই বা কী মনে হয়, এসব কিছুই আমরা কেউ জানি না আজ পর্যন্ত। ‘ট্রমা’ শব্দটার মানেই তো বুঝলাম মাত্রই এই ষোলো সতেরো বছর আগে।

    ক্লাস ফোরে পড়তে পড়তেই শব্দভান্ডারে আরো দুটো শব্দ ঢুকে গেল, ‘নকশাল' আর ‘ওয়াগনব্রেকার’। আমার দাদু, অরবিন্দ বিদ্যাপীঠের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আর রমণীদাদু, কোন্নগর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক, দুজনে রোজ বিকেলে খবরের কাগজে বেরোন খবর, ইংরিজিভাষার বিভিন্নরকম প্রয়োগ এইসব নিয়ে আলোচনা করে। যেদিন মাঠে না খেলে শুভ্রারা ওদের উঠোনে খেলে সেদিন আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি। একদিন বিকেলের দিকে হঠাৎ হিউম পাইপের দিক থেকে হো-ও-ও করে চীৎকার শোনা যেতে লাগল, এমনিতে এত ভেতরে শোনা যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সেদিন দক্ষিণদিক থেকে খুব হাওয়া দিচ্ছিল। গন্ডগোলটা ভাগ্যলক্ষ্মী বস্ত্রালয়ের দিক দিয়ে কোন্নগর স্টেশানের দিকে চলে গেল মনে হল। সব বাড়ী থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে এ ওকে জিগ্যেস করতে লাগল কী হয়েছে? অল্প কিছুক্ষণ বাদেই স্টেশনের দিকে থেকে মিঠু বুম্বার বাবা আসতেই মোড়ের লাইটপোস্টের সামনে সবাই ঘিরে ধরল ওঁকে। উনি তখনও থরথর করে কাঁপছেন, বললেন চার পাঁচটা  ছেলেকে আরও আট দশটা ছেলে তাড়া করে নিয়ে চলেছে।  

    এর মধ্যে একটা ছেলে হোঁচটা খাওয়ায় তাকে পেছনের ছেলেরা বড় ছোরা দিয়ে ঘাড়ে কোপ মেরেছে ... ছেলেটা সেইভাবেই উঠে দৌড়েছে ... ভাগ্যলক্ষ্মীর সামনে নাকি রক্ত আর রক্ত। সব দোকান ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে গেছে। রিক্সাওলারা ভাগ্যলক্ষ্মীর সামনের স্ট্যান্ডে রিক্সা যেমন কে তেমন ফেলে রেখে কোথায় পালিয়ে গেছে। উনি আর দু চারজন যাঁরা ট্রেন থেকে নেমে ফিরছিলেন তাঁরা কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পা চালিয়ে ফিরেছেন। ব্ঙ্কাকাকু বলে ‘ও তার মানে এরা নির্ঘাৎ নকশাল’।  রুমাকাকীমা বলে ‘ওফ! আবার শুরু হল’। বঙ্কাকাকু আবার বলেন ‘নকশালগুলো তো আসলে ওয়াগনব্রেকার, দ্যাখো গে মালের বখরা নিয়ে খুনোখুনী শুরু করেছে’। রমণীদাদু বারবার জিগ্যেস করেন যারা পালাচ্ছিল তাদের মধ্যে কেউ চেনা কিনা? মিঠু বুম্বার বাবা জোরে জোরে মাথা নাড়েন ‘না না কাউকে চিনি না আর যারা ধাওয়া করছিল তাদের সবার মুখ কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো ছিল, শুধু চোখটুকু খোলা’। রমণীদাদু তাও বারবার একই কথা জিগ্যেস করছেন দেখে দাদু আস্তে করে হাত ধরে টেনে ওঁকে বাড়ীরে ভেতরে এনে বৈঠকখানায় বসায়| উনি কেমন দিশেহারাভাবে বলেন রঞ্জু? রঞ্জু কোথায়? আমি বাড়ী যাই বরং’।

    তখনও ওঁর হাত পা কাঁপছে, দাদু তাই উঠতে দেয় না, আমাকে বলে একগ্লাস জল আনতে। জল খেয়ে একটু পরে রমণীদাদু বলেন ওঁর নাতি রঞ্জু মানে রঞ্জুদা নাকি নকশাল হয়ে গেছে, বাড়ী আসে নি আজ  দশ মাসের ওপর| স্টেশনে যে মালগাড়ীগুলো দাঁড়িয়ে থাকে সুযোগমত তার ওয়াগন ভেঙে জিনিষ লুট করে কোথায় নিয়ে যেত, দুইবার নাকি করেছে। তারপর থেকেই নিরুদ্দেশ। দাদু আস্তে আস্তে বলে ওরা তাহলে নকশাল নয়, কিছুতেই নয়। তারপর জিগ্যেস করে রঞ্জু কি নিজেই বলেছে ও ওয়াগন ভাঙত? রমণীদাদু প্রায় কেঁদে ফেলে বলেন না ওর এক বন্ধু বলেছে। দাদু চুপচাপ হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে, পাখাটা মাঝে একটু একটু ফেটে গেছে, নাড়ালেই আওয়াজ হচ্ছে পট পট। সন্ধ্যের পর ছোটমামা এসে বলল শিশুভারতীর মাঠে ছয়জনকে নাকি কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। নকশালদের নিজেদের ভেতর মারামারি। পরের দিন শুভ্রা আর রিঙ্কু বলল স্কুলে যাওয়ার সময় দেখেছে রাস্তায় নাকি ম্যাপের ছবির মত হয়ে রক্ত শুকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে খবর পাওয়া যায় রঞ্জুদা ছিল না ওদের মধ্যে, কিন্তু নিয়োগী বাড়ীর শঙ্কুদা ছিল; পুলিশ এসে ‘বডি' নিয়ে গেছে।  কিছু আধাচেনা, অচেনা দাদারা রাস্তায় রক্ত ঝরিয়ে ম্যাপের মত ছবি বানিয়ে ‘বডি' শব্দটাও শিখিয়ে দিয়ে গেল।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ৭৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৭ আগস্ট ২০২৩ ০৯:১৬522988
  • সঙ্গে আছি।
  • Kuntala | ২৮ আগস্ট ২০২৩ ০৬:০৬523033
  • দ, পড়ছি, বেশ লাগছে। 
    কিন্ত শাড়ি ও জামা পরতে হয়, পড়তে নয়। সামান্য জিনিস, খেয়াল রাখবেন। আপনি এধরণের জিনিস লক্ষ্য করেন বলেই বললাম, অপরাধ নেবেন না।
  • | ২৮ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৪৮523034
  • কুন্তলা, হ্যাঁ জানি তো। 'পরা' ই লিখি। কোথায় ভুল আছে একটু বলবেন প্লীজ। 
  • অটোকারেক্ট | 117.194.72.29 | ২৮ আগস্ট ২০২৩ ০৯:২৫523038
  • এই লাইনে বোধ হয় : "মা ওগুলো খুব যত্ন করে স্যুটকেসে রেখে দিয়েছে, সহজে পড়তে দেয় না, নষ্ট করে ফেলি যদি"। সম্ভবত: অটোকারেক্টের ফল, কারণ এরই আর কয়েকটা লাইন আগে দেখছি " আমাদের ক্লাসেও অনেকেই শাড়ী পরেছে।
     
  • | ২৮ আগস্ট ২০২৩ ১২:৪২523039
  • ও আচ্ছা এই লাল দাগ দেওয়াটা তো? ঠিক করে দিলাম। ধন্যবাদ।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন