এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্মৃতির বাতিঘর 

    Abin Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২০১ বার পঠিত
  • যতোই ভাবি শিক্ষক দিবসের দিনে নিজের জীবনের নানা পর্যায়ে পাওয়া অসামান্য শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু স্মৃতি ভাগ করে নেবো, পঞ্চাশটা কাজের ঠেলায় সব যাই ভুলে। তবু দেরি করে হলেও ভুল সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত।

    আমাদের স্কুলজীবনের যে শিক্ষকের প্রভাব নিজের জীবন ও সাহিত্যচর্চার জগতে প্রতি পদক্ষেপে হামেশাই অনুভব করি তিনি হলেন দূর্গা স্যার - দূর্গা দত্ত। ওনার ক্লাসের নানা কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনার সূত্রে যে কত যে মণি মুক্ত আহরণ করেছি তার হিসেব পাওয়া দুষ্কর। পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে উনি আমাদের নিয়ে যেতেন এক বিরাট পরিক্রমায় যার কোণায় কোণায় ছড়ানো ছিল বিশ্বসাহিত্যের নানা দিকপালের অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টি। অন্নদামঙ্গল কাব্যের অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনীর অংশের শেষে ঈশ্বরী পাটনী বলে "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"। বাঙালির আড়ম্বরহীন, সরল, সাবেকি জীবনযাত্রার যে আন্তরিক সুর এই পংক্তিতে ধরা আছে, তার সাথে দূর্গা স্যার মিলিয়ে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষের লেখা ' বাবরের প্রার্থনা ' - " আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক "। কর্ণ কুন্তী সংবাদের শেষে যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েও যে কর্ণ কুন্তীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তার সাথে তিনি মিলিয়ে দেন সিসিফাসের মিথ। মহাভারতের কর্ণ হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর কিমিতিবাদী নাটকের নায়কের পূর্বসুরী। এইসব যোগাযোগের সূত্র খুঁজে পাওয়ার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে এক তুরীয় নান্দনিক উচ্ছাস তেমনি রয়েছে বিশ্লেষণমূলক ভাবনার নানা প্রাথমিক উপাদান যার গুরুত্ব অবশ্যই বুঝেছি অনেক পরে। প্রেসিডেন্সিতে যখন শিক্ষকেরা এলিয়ট পড়াতে গিয়ে বারবার বিষ্ণু দে, ব্যোদলেয়ার বা রবীন্দ্রনাথ টেনে আনতেন, তখন অবাক লাগেনি মোটেই। বরং মনে হয়েছে মনের দরজা জানালা খুলে দেওয়ার যে শিক্ষা টা দূর্গা স্যার দিতে চেয়েছিলেন, তারই নিরন্তর প্রয়াস যেন শিক্ষণের প্রক্রিয়ায় চলেছে অবিরাম। এই যোগাযোগের বুননের অংশ হিসেবেই উঠে এসেছে আরো কত কথা। শিখেছি না - কথার উপযোগিতা, অন্ধকারের মায়া বা আরণ্যকের আদিবাসী জীবনের subaltern ভাষ্য। আরণ্যকের আলোচনাতেই উঠে এসেছে অরণ্যের অনবদ্য বিবরণের " suffocating sensuousness " যার উৎস ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড। একইভাবে পরে কখন মিলে গেছে জীবনানন্দ আর Yeats বা কর্ণের কাহিনী শুনে অপুর কান্নার অনুভূতিতে অ্যারিস্টটল এর Catharsis। ওনার পড়ানো ১৯৪৬-৪৭ কবিতাটির বিশ্লেষণ এতটাই সুগভীর ছিল যে পরবর্তীকালে Modernist সাহিত্যের বিবিধ প্রসঙ্গে বারবার ফিরে এসেছে ঐসব বিশ্লেষণের প্রতিধ্বনি।

    প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের সাথে বিশ্বসাহিত্যের এহেন নানা অলিন্দ খুলে দেওয়া মানুষটির মধ্যে না ছিল অহমিকা না ছিল কোন ছদ্ম - গাম্ভীর্যের মুখোশ। বেশির ভাগ সময় সাদা, ঢোলা পাঞ্জাবি পায়জামা পরা এই মানুষটির মুখে লেগে থাকতো স্মিত হাসি। " এই যে মহারাজ " বলে যখন অবাধ্য ছাত্রদের হাঁক দিতেন, তখন বকা খাওয়ার ভয়ের পাশাপাশি সহজাত ভাবেই মুখে কেন জানি হাসি চলে আসতো। চূড়ান্ত ছাত্রবৎসল এই মানুষটি কৈশোর জীবনের বিচিত্র আবেগের নানা উত্থান পতনের মাঝে বিভ্রান্ত ছাত্র ছাত্রীদের বিবিধ সমস্যার সহায় হয়ে দাঁড়াতেন। পিতৃবিয়োগের শোক বা একতরফা প্রেমের ব্যাথা - উভয়ই সামলাতেন সমান দক্ষতায়। এর পরেও কিন্তু উনি আমাদের মনে করিয়ে দিতেন যে চেয়ার এর এপার আর ওপারের মধ্যে একটা ফারাক আছে এবং সেই ফারাক কখন মুছে যাওয়া উচিত নয়। আজকাল ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক অবনমনের যেসব দৃষ্টান্ত খবরে আসে, ওনাদের মূল্যবোধ ও শিক্ষা মাথায় থাকলে তা কখনোই সম্ভব হতনা। আমি শুধু মনে মনে প্রার্থনা করি যাতে ওনাদের শিক্ষা ও উদাহরণ সর্বদা আমাকে দিকনির্দেশ করে চলে।' ধারাবাহিক অবক্ষয় ও শিক্ষক সমাজ সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান অবজ্ঞা ও অসূয়ার মাঝে, ওনাদের অবদানের স্মৃতিই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে দিশাহারা নাবিকের কাছে সুউচ্চ বাতিঘরের আশ্বাসের মত জোরালো হয়ে বলে ওঠে ' চরৈবেতি, চরৈবেতি '।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন