এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ভূতনাথ

    Nabhajit লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ৩৫৪ বার পঠিত
  • আমাদের পাড়ায় লোকজনের নাম নিয়ে অনেক কাহিনী। ডাকনাম, আদরের নাম, পোষ্য নাম, ভালো নাম। ভানু প্রসাদ আমাদের পুরোহিত। ওর বাবা শ্যামা প্রসাদ আমাদের বাড়ির আদি পুরোহিত ছিলেন, ঠাকুরদার সময় থেকে। তখন ভানু প্রসাদ বাবাকে সাহায্য করতে আসতো। ঠাকুমা ভানুকে আদর করে ডাকতেন ভানী। ঠাকুমা মারফত পাড়ায় ভানুর নামের অপভ্রংশ চালু হয়ে গেলো। শ্যামা প্রসাদ মারা যাবার পর ভানুপ্রসাদ হয়ে গেলো ভানী, পাড়ায় বাড়ি বাড়ি ওর যজমান। কেউ বলে ভানীদা, কেউ বলে ভানীকাকা। দেখতে দেখতে ভানু নিজের নাম ভুলে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুললো ভানী ভট্টাচার্য নামে, তখন তো আর আধার কার্ড চালু হয় নি, নামের বানান নিয়েও কেউ মাথা ঘামাতো না। যে নামে যে পরিচিত সেই নামেই ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা হত। ভানীর বিয়ে হল, বিকেলে ডাগর বৌ নিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরতে যায়, ভানী আর পাড়ায় লোকজন কানাঘুসো করে - 'দেখো প্রায় এক বছর হয়ে গেলো ভানীর বিয়ে হয়েছে, এখনো বাচ্ছা হলো না!'। দু চারবার ভানীর কানেও গেছে কথাটা। তার মাস চারেক এর মধ্যেই পাড়ার লোক দেখলো যে ভানীর বৌ অন্তঃসত্ত্বা। সকলের মুখে চুন কালী দিয়ে ভূত চতুর্দশীর দিন ভানীর বৌয়ের ছেলে হল। ভানী নাম রাখলো ভূতনাথ। ভূতনাথ পাড়ায় সকলেরই আদরের। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন পাড়া বলতে যা বোঝাতো সেটা এখন অবলুপ্ত অধ্যায়। পাড়ায় তখন থাকতো বাড়ি, ফ্ল্যাট নয়। খালি জমি দেখলে প্রমোটররাছীনে জোঁকের মতো জমির মালিকের বাড়ি রোজ রোজ আসতো না। পাড়ার রাস্তায় তখন বাচ্ছারা ক্রিকেট খেলতো, বল দিয়ে লোকের বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙতো, কেউ কেউ বল দিতেন না, রাগারাগী করতেন কিন্তু বাড়ির কাকিমা লুকিয়ে বলটা ফেরত দিয়ে দিতেন। পাড়ার কোনো ছেলেকে কোনো পাড়ার কাকু যদি দেখতেন দুষ্টুমি করতে, মানে লুকিয়ে কেউ সিগারেট ফুকছে বা পাড়ার বাইরে কারো সাথে মারামারি করছে তাহলে কান মুলে দিতেন, কেউ কেউ কানের নিচে কষিয়ে চড় মারতেন, হির হির করে টানতে টানতে বাবা মার কাছে এনে নালিশ জানাতেন ।বাবা মা বলতেন, 'ঠিক করেছেন, আরো দু ঘা দিয়ে দিন'। পাড়ার কোনো ছেলে যদি খেলতে গিয়ে পরে মাথা ফাটাতো বা হাত পা ভাঙতো তাহলে সেই কাকুই কোলে করে ডাক্তারের বাড়ি নিয়ে যেতেন। মা বাবার জন্য অপেক্ষা করতেন না। আমার মা আমাকে আদর করার ডাকতেন 'কচি ছেলে', ঠাকুমা নাম পাল্টে দিয়ে ডাকতেন 'কুঁচে', আমি হয়ে গেলাম পাড়ার কুঁচে। ভাগ্য ভালো আমার ব্যাঙ্ক একাউন্ট কুঁচে নামে খোলা হয় নি। বিজয়া দশমীর পর কার বাড়িতে ভালো নাড়ু হয়েছে বা কাদের বাড়ির ঘুগনীর টেস্ট ভালো, সে খবর ঠাকুর ভাসানের একটু পরেই রটে যেতআর আমরা দল বেঁধে সেই সব বাড়িতে হানা দিতাম। এই ছিল আমাদের পাড়া।

    আমার সেজো মামার নাম সরোজ, হুগলি মহসিন কলেজে পড়াতেন, আমি ছোটবেলায় 'সেজো' বলতে পারতাম না, বলতাম 'ছেদো'।
    সেজো মামা আমাদের বাড়িতে এলে ঠাকুমা ডাকতেন, 'ছেদো এলি নাকি?'। সেই থেকে সরোজ মামার নাম আমাদের বাড়িতে হয়ে গেলো ছেদো। মনে আছে একবার বাবার এক বন্ধু এসেছেন বাড়িতে, সেজো মামাও আছেন, বাবা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে, 'এ আমার শ্যালক, ছেদো'।

    এবার ভূতনাথের কথায় আসি। ভূতনাথ যখন ছোট তখন কেউ ওর নাম জিজ্ঞাসা করলে ও 'ভূতনাথ' বলতে পারতো না, জিভের নিচে কোথাও যেন 'থ' আটকে যেত, বেরোতো শুধু 'ভূতনা', সেই থেকে ওর নাম হয়ে গেলো 'ভূতনা'। বড় হয়ে যাওয়ার পর ওকে কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে ও বলতো ভূতনা। ভূতনা আমার বন্ধু ছিল। এক ক্লাসে পড়তাম, এক সাথে ফুটবল খেলতাম, একসাথে চাকা চালাতাম। ছোটবেলায় আমাদের এক খেলা ছিল, একটা লোহার চাকার পেছনে একটা লোহার শিক বেঁকিয়ে চাকাটা গড়িয়ে গড়িয়ে চালানো। সেই চাকা চালাতে চালাতে কোথায় কোথায় যে চলে যেতাম তার ঠিক নেই। একবার চাকা নিয়ে যেতে যেতে হালিশহর পৌঁছে গেছি খেয়াল হয় নি। হঠাৎ দেখি বিকেলের আলো কমে এসেছে। আমাদের নিয়ম ছিল রাস্তার আলো জ্বলে যাওয়ার আগে বাড়িতে ঢোকার কিন্তু আজ তা হবে না, বকুনি খেতে হবে। এদিকে আমাদের মনে হচ্ছে আমরা হারিয়ে গেছি। হালিশহরের গঙ্গার ঘাটে বসে প্রায় কান্না পেয়ে গেছে, আমাদের দলে ছিল ভূতনা, বলাই আর কল্যাণ। কল্যাণ সাহস যোগালো বললো কেউ হারায় না কুঁচে, ঠিক পৌঁছে যাবো, যদি আসার রাস্তা থাকে তাহলে ফেরার রাস্তাও আছে। আরো একটা কথা বলেছিলো, কেউ যদি হারিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে ফেরানো যায় না। আজ বড় হয়ে বুঝি কত সত্যি কথা কল্যাণ শিখিয়েছিলো ওই কাঁচা বয়েসে।

    একদিন ছেদো মামা আমাদের বাড়িতে এসেছেন। সারা বিকেল আর সন্ধ্যে জুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা গত দু দিন ধরে বাইরে গিয়ে খেলতে পারিনি। বন্ধুরা এ ওর বাড়ি গিয়ে একটু ইন্ডোর গেম খেলার চেষ্টা করছি, যেমন দিনের বেলা আমি গেছিলাম খোকনদের বাড়ি ক্যারাম খেলতে। বিকেলে বাবা বলেছেন যে বন্ধুরা আসলে লুডো খেলতে পারো কিছুক্ষন। সেই আশায় ভূতনা এসেছিলো আমাকে ডাকতে। আমি শুনতে পাইনি। ছেদো মামা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাকে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকছিলেন। নিচে আমাদের বাড়ির বাইরে একটা লোহার গেট ছিল তারপাশে একটা বোগেনভিলিয়ার গাছ, গাছের আড়ালে গেটের কাছে কেউ এলে আলো আঁধারিতে তাকে ভালো দেখা যেত না। ভূতনা এসে আমার নাম ধরে ডেকেছিল। ছেদো মামা জিজ্ঞাসা করলেন,
    - কে রে ?
    - আমি ভূতনা
    - সে তো আমি দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু তোর নাম কি ?
    - আমি ভূতনা
    - আমি জানি তুই ভূত নোস্, কিন্তু তুই কে, কি নাম তোর ?
    - আমি তাই তো বলছি যে আমি ভূতনা ।
    এবার ছেদো মামার ধৈর্য্যচুতি হলো। বললেন,
    - দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা ।
    বলে হনহন করে নিচে নামতে লাগলেন। মামার রাগ দেখে ভূতনা ততক্ষনে পালিয়েছে। নিচে গিয়ে ছেদো মামা কাউকে দেখতে পেলেন না। ওপরে এসে ঠাকুমার মুখোমুখি। ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলেন,
    - কি রে ছেদো, নিচে গেছিলি কেন ?
    - আর বলবেন না কাকিমা, একটা ছোড়া আমাদের কুঁচেকে ডাকছিলো, আমি জিজ্ঞাসা করলাম কে তুই, কি নাম। বার বার শুধু আমাকে বলছেযে আমি ভূত নই। আমি যত বলি যে ঠিক আছে আমি বুঝতে পারছি যে তুই ভূত নোস, কিন্তু তোর নাম কি? আমার সাথে মস্করা করে বার বার বলছে যে আমি ভূত না। তাই ওকে ধরতে গেছিলাম নিচে। গিয়ে কাউকে পেলাম না।
    ঠাকুমা বড় বড় চোখ করে ছেদো মামাকে ভয় দেখিয়ে বললেন,
    - ও যতই বলুক যে ভূতনা, আমার তো মনে হয় তুই ভূত দেখেছিস। বলে মুচকি হেসে চলে গেলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ৩৫৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন