এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • কারা সন্ত্রাসবাদী

    গৌতম চৌধুরী
    আলোচনা | রাজনীতি | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ | ১৪০৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • এই লেখায় আমি দেখাতে চাইছি এদেশে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের জাল কতদূর বিস্তৃত আর তা কি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যে কোনো হিংসাশ্রয়ী ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে নিরীহ সাধারণ মুসলমানদের ওপর তার দায় চাপানো, অথবা মাওবাদী কার্যকলাপ বলে সাধারণ মানুষকে ধরপাকড় করা আর জেলখানায় চালান করে তাদের জীবনের অমূল্য দীর্ঘ বছরগুলো কেড়ে নেওয়া — এই জমানায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ যদি কারুর ওপর ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছাপ মেরে দেয় তাহলে আদালতও তার প্রতি সুবিচার করেনা, এমনকি তাদের জামিন পাওয়াও আজ ব্যতিক্রমী ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা, সাধারণ মানুষও আর তাদের কথা ভাবিনা।

    এ এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি, যখন সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পিষে মারা হচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়ানক আরো এই কারণে যে, ঐসব হিংসাত্মক কাজের জন্য প্রকৃত অপরাধী যারা, তারাই দেশপ্রেমের নামে একটা সম্প্রদায়কে দেশের যাবতীয় অকল্যাণের জন্য দায়ী করে রেখে তাদের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। আসলে তারা নিজেরাই যে ভয়ঙ্কর অপরাধী, দেশের সর্বনাশের কাণ্ডারি, সেকথা তথ্য সহ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছেনা। তাই তাদের ভুল বোঝানো সহজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

    তাই তথ্য সহ সেরকম কিছু ঘটনা তুলে ধরার এই সামান্য চেষ্টা। অনুরোধ, আপনারা পড়ুন এবং সমালোচনা করুন।


    পর্ব ১

    “আমি জানি, এই স্বীকারোক্তির জন্য আমার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। তবু আমি তা দিতে চাই”।

    ২০১০ সালের ১৮-ই ডিসেম্বর বিচারকের সামনে দেওয়া এক সন্ত্রাসবাদীর এই স্বীকারোক্তি এক অবিশ্বাস্য রহস্যকাহিনী মেলে ধরেছে। এটা কোনো গল্প নয়, সবই সিবিআই-এর কেস ডায়েরি থেকে নেওয়া, তবু গল্পের চেয়েও অবিশ্বাস্য মনে হয়। একইসঙ্গে ভয়ঙ্কর, এবং মানবিক এক উপাখ্যান। নরেন্দ্র মোদি-র ক্ষমতায় আসার আগের এক দশকে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ভারত আর পাকিস্তান, দুই দেশেরই মানুষ মরেছে পথে ঘাটে, বাজারে, ধর্মস্থানে, ট্রেনের কামরায়। কত যে আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে কতজন, তার সঠিক হিসেব জানা নেই। আর নিজেদের দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলার দায় প্রতিবেশী দেশের ওপর চাপানো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে অন্যায়ভাবে জড়ানো, ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বেড়ে চলা আর বাড়িয়ে চলা অব্যাহত থেকেছে দেশপ্রেমের নামে। এই পটভূমিতেই এই কাহিনী।

    ২০০৮-এর ২৬-শে নভেম্বর (২৬/১১) মুম্বাইয়ে এক ভয়ঙ্কর হামলা চালায় একদল পাক-সন্ত্রাসবাদী। জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবা আর মার্কিণ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, এই দুইয়ের ডবল এজেন্ট ডেভিড হেডলির সহায়তায় আর লস্করের পরিচালনায়। পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার যখন ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের চেষ্টা করছে আন্তরিকভাবে, সেই সময় পাক সেনা বাহিনীর মদতে ঘটল ঐ আক্রমণ। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় নিযুক্ত মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার তথা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী স্কোয়াড (Anti-Terrorist Squad, ATS)-এর প্রধান হেমন্ত কারকারে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ও ATS এর অন্যতম নেতৃস্থানীয় অফিসার অশোক কামতে ও ইন্সপেক্টর বিজয় বিজয় সালাসকর সেদিন নিহত হন। সিবিআই তদন্তে জানা যায়, কামতে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে নিহত হন। বাকি দু’জন? স্পষ্ট নয়। অনেক প্রশ্ন উঠে আসে।

    একই গাড়িতে তিনজন অফিসার কেন, যা প্রোটোকল বিরোধী? মুম্বাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা এসে জড়ো হলেন একই গাড়িতে, কেন? কেউ কি তেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন? দিয়ে থাকলে কে তিনি? কে রাত্রি ৯-৪৫ মিনিটে কারকারেকে ফোন করে? ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (CST)-এ গিয়ে যখন দেখেন তেমন কিছু নেই, তখন কামা হাসপাতালে যেতে কে তাকে ফোনে নির্দেশ দেয়? কোনো অদৃশ্য হাতই যে তাদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডেকে এনে মৃত্যুর দিকে চালিত করেছিল কামা হাসপাতালে পাঠিয়ে, এই অভিযোগও যথাযথভাবে খণ্ডন করা যায়নি। স্টেশন থেকে নিম্নমানের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট পরে তিনি গেলেন কেন? সেই জ্যাকেট কোথায় গেল? (অনেক পরে সেটা পাওয়া গেছে হাসপাতালের আবর্জনা থেকে।) এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি।তার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পুলিশ প্রথমদিকে আদালতে দিতে চায়নি। পাঁচটি গুলি কারকারের শরীরে লেগেছিল তার দু’টি দেহের মধ্যে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলো গেল কোথায়? বাকিগুলোরও খবর নেই। কার বন্দুক থেকে সেগুলো এসেছিল, তারও উত্তর পাওয়া যায়নি। চক্রীদের হাত যে খুব লম্বা, তা বোঝা যাচ্ছিল। ফলে রহস্যের যবনিকা সরছিল না। অনেকটা সরেছে লেখার শুরুতে উল্লেখ করা ঐ সন্ত্রাসবাদীর স্বীকারোক্তিতে।

    ************************************

    দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলাগুলোর তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা পড়লেন মুস্কিলে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে-গোখরোর দেখা মিলতে লাগলো। পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্র আছে, এটা তারা ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন। আর মহারাষ্ট্রের ATS প্রধান হেমন্ত কারকারে সেই প্যাণ্ডোরার বাক্স একেবারে খুলে দেন। দেশে যে হিন্দুত্ব-সন্ত্রাসের জাল বিস্তৃত হয়েছে, যা ভারতীয় সামরিক বিভাগেও ঢুকে পড়েছে, তাকে উন্মোচিত করে দেন কারকারে। মালেগাঁও বিস্ফোরণে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে চার্জশীট তিনি পেশ করেন তাতে সংবিধানের শাসন আর ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতরাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার জন্য আন্তর্জাতিক মদতপুষ্ট মারাত্মক এক দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের দিকে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন (countercurrents.org, ২৬ অক্টোবর, ২০০৯)।

    পর্ব ২

    ২০০৮-এ মালেগাঁও বিস্ফোরণের পর কারকারে তদন্ত শুরু করেন, কিন্তু ২০০২ সাল থেকে দেশে ঘটে চলা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের স্বরূপ খুলে দেয় সেই তদন্ত। ২০০৮ এর মালেগাঁও বিস্ফোরণে জড়িত সন্দেহে তিনি ১১ জনকে গ্রেফতার করেন, যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন কট্টর হিন্দু সম্প্রদায়িক সংগঠনের লোক। ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত যিনি নাসিকের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দয়ানন্দ পান্ডে -- এক স্বঘোষিত ধর্মীয় গুরু যিনি জম্মুতে সারদা সর্বজ্ঞ পীঠ নামে এক আশ্রম চালাতেন। আরও ছিলেন সাধ্বী প্রজ্ঞা -- অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নেত্রী, যিনি সাধিকাতে পরিণত হয়েছেন। মুসলমানদের তোয়াজ করতেই যে এই গ্রেপ্তার, এবং কারকারে 'জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক' -- একথা সজোরে প্রচার করে বিজেপি আর শিবসেনা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কারকারেকে তখন দেশদ্রোহী আখ্যা দেন। ২৬/১১ এর আগে শিবসেনা কারকারের এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১লা ডিসেম্বর মহারাষ্ট্র বন্ধ ডেকে বসেছিল। আর ২৬-এর পর বেকায়দায় পড়ে গোটা সংঘ পরিবার আর তার জ্ঞাতিরা কারকারেকে মহান দেশপ্রেমিক বলতে শুরু করল।

    সংসদে কারকারের মৃত্যু নিয়ে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলেন সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী এ আর আন্তুলে। এইসব প্রশ্ন তোলা দেশবিরোধী, পাকিস্তানের সুবিধা করে দেবার জন্য, এসব বলে থামিয়ে দেওয়া শুধু নয়, এজন্য সদস্যরা অবিলম্বে আন্তুলের পদত্যাগ দাবি করেন। পরে কংগ্রেস নেতা দিগবিজয় সিংহ জানান, সেদিনও মারা যাবার আগে সন্ধ্যা ৭:০০ টায় তার সঙ্গে কারকারের ফোনে কথা হয়। কারকারের সঙ্গে ফোনে তার মাঝেমধ্যে কথা হতো। দুজনেই তারা মধ্যপ্রদেশের লোক, পূর্বপরিচয় ছিল। কারকারে সেদিন আবার তাকে জানান, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর আরএসএস এর পক্ষ থেকে তাকে খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বারবার। তার সততা-নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনাথ, আদবানি, গদকরি, রবিশঙ্কর প্রমূখ বিজেপির শীর্ষ নেতারা। তাদের মুখপত্রে গালাগালি দেওয়া আর নানা কুৎসা প্রচার করা হচ্ছে। দুবাই থেকে নাকি ১৭ কোটি টাকার এক কন্ট্রাক্ট পেয়েছে তার স্কুলে পড়া ছেলে। অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে অফিসার বাবাকেও ওরা হুমকি দিচ্ছে। কারকারে জানান এসবের ফলে তিনি খুব হতাশ। দিগ্বিজয় এসব বললে আবার বিপুল হইচই শুরু হয়। তাকেও পাকিস্তানের দালাল বলা হয়। কংগ্রেস দল ওটা দিগ্বিজয়ের ব্যক্তিগত মতামত বলে এর দায়িত্ব নেয় না। আর মুম্বাই পুলিশ জানায়, সেদিন দিগ্বিজয়ের সঙ্গে কারকারের ফোনে কথাবার্তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দিগ্বিজয় সেই প্রমাণ পরে হাজির করেন এবং দাবি করেন কথাবার্তার রেকর্ড প্রকাশ করা হোক। তা করা হয়নি, এসব 'সংবেদনশীল বিষয়' নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা কারোরই পছন্দ হয়নি। তবে শুধু দিগ্বিজয় একা নন, কিছু সাংবাদিক, পুলিশ অফিসার এবং কারকারের ঘনিষ্ঠ আরো অনেকে জানিয়েছেন, সত্যিই ওই সময় কারকারের উপর হুমকি ছিল এবং মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তের খবর প্রচারিত হবার পর থেকে তার পরিবারের সম্পর্কে যে মিথ্যা অভিযোগগুলো তোলা হচ্ছিল তাতে তিনি খুব বিচলিত (disturbed) ছিলেন। কিন্তু ভয় পাবার লোক তিনি ছিলেন না, যে কোন পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন। (Karkare's response to a death threat: A smiley, Y.P. Rajesh, posted: Thursday, Nov 27, 2008) তবে মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে বাড়ির চারিদিকে দেয়াল তুলেছিলেন আর বাড়িতে একটা কুকুরও এনে রেখেছিলেন। (Indian Express, Tuesday Dec 14, 2010) বিজেপি-শিবসেনা-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বজরং দল-আরএসএস ইত্যাদি, অর্থাৎ সংঘ পরিবার ক্ষিপ্তভাবে "মোহাম্মদ কারকারে" সম্পর্কে তাদের আক্রমণ তীব্র করল। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে, সোস্যাল নেটওয়ার্কে, তাদের যে অসংখ্য ওয়েবসাইট আছে সেগুলোর মাধ্যমে আর ব্যক্তিগত স্তরে। বিভিন্ন নামকরা সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে, সাক্ষাৎকার গ্রহীতার বিরুদ্ধে উন্মত্ত আক্রমণ শুরু হলো।

    মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার মালেগাঁওয়ে বিস্ফোরণের সেই জানা ঘটনা এখানে আরেকবার বলা দরকার।

    মালেগাঁওয়ে দু’বার বড় বিস্ফোরণ হয়। প্রথমটা ২০০৬-এর ৮ সেপ্টেম্বর। “প্রাথমিকভাবে বোমা হামলার জন্য স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া (সিমি)-কে দায়ী করা হয়, কিন্তু 2013 সালে দাখিল করা একটি চার্জশিটে এনআইএ এবং এটিএস (অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড )-এর যৌথ তদন্ত” তাকে নাকচ করে। “এই বোমা হামলায় উঠে আসে অভিনব ভারত নামে একটি চরমপন্থী দলের নাম”।

    বিস্ফোরণগুলি - যার ফলে কমপক্ষে 45 জন প্রাণহানি এবং 125 জন আহত হয়েছে - একটি মসজিদ সংলগ্ন মুসলিম কবরস্থানে, শব ই বারাআতের পবিত্র দিনে শুক্রবারের নামাজের পরে স্থানীয় সময় প্রায় 13:15 এ ঘটে । বিস্ফোরণের শিকার অধিকাংশই মুসলিম তীর্থযাত্রী। নিরাপত্তা বাহিনী "সাইকেলের সাথে সংযুক্ত দুটি বোমার" কথা বলেছিল, কিন্তু অন্যান্য রিপোর্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে তিনটি ডিভাইস বিস্ফোরিত হয়েছে।
    https://en.wikipedia.org/wiki/2006_Malegaon_bombings
    আর দ্বিতীয়টি ঘটে ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর।

    “২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে যে-বিস্ফোরণ ঘটে, তার পেছনে হাত ছিল হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি তথা সাধ্বী-সন্ত-মহারাজদের। অভিযুক্তরা সকলেই ‘অভিনব ভারত’ নামক পুনের একটি উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তদন্তে উঠে এসেছে এমনই বিস্ফোরক (অস্বস্তিকরও বটে) তথ্য”। (পাক্ষিক “দেশ” পত্রিকা, ডিসেম্বর ২০০৮)

    পর্ব ৩

    কারকারের মৃত্যুর পর 'হিন্দুহৃদয়সম্রাট' নরেন্দ্র মোদী, মাত্র কয়েকদিন আগে যিনি হেমন্ত কারকারেকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন, তিনি যখন 'শহীদ' কারকারের বাড়িতে যান শ্রদ্ধা জানাতে, তখন স্ত্রী কবিতা তার সঙ্গে দেখা করেননি, তার আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন। তবে সত্যের সঙ্গে তখন জাতীয় সেন্টিমেন্টের সংঘাত চলছিল। তাই কারকারের স্ত্রী-ও 'পাকিস্তানের সুবিধা হবে' এই একই যুক্তিতে দিগ্বিজয়ের বিরোধিতা করেন। (পর্ব ২ দেখুন) এই সেই 'জাতীয় সেন্টিমেন্ট', যার দোহাই দিয়ে বিচারক আফজল গুরুকে ফাঁসির আদেশ দেন সংসদ আক্রমণে তার ভূমিকা প্রমাণিত না হলেও। যাইহোক, একরোখা অনুসন্ধানী কবিতা কারকারে শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে জানান, হেমন্ত আহত অবস্থায় প্রায় 40 মিনিট পড়েছিল, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।

    সংবাদে প্রকাশ: হেমন্ত কারকারে ও তার সঙ্গীরা সাহায্যের জন্য মরিয়া হয়ে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে বার্তা পাঠাচ্ছিলেন, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে, এদের মৃত্যুর এবং দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যাবার পর, সাহায্য এলো। ('হেডলাইনস টু ডে'-এর হাতে পুরো কল লগ রেকর্ড রয়েছে বলে তারা জানিয়েছে।) ওদিকে এস. এম. মুসরিফ নামে মহারাষ্ট্র পুলিশের এক প্রাক্তন আইজি এক বই লিখেছেন: 'হু কিলড কারকারে? দ্যা রিয়েল ফেস অফ টেরারিজম ইন ইন্ডিয়া', যেখানে তিনি অনেক সহজলভ্য তথ্য দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছেন ভারতে 'ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ'-এর পেছনে প্রকৃত খেলোয়ার কারা, এবং বলেছেন যে, কারকারে এদের মুখোশ খুলে দেওয়ার স্পর্ধা দেখানোর মাসুল দিয়েছেন এদের হাতে প্রাণ দিয়ে।

    বম্বে হাইকোর্টে বিহারের প্রাক্তন বিধায়ক রাধাকান্ত যাদব অভিযোগ জানিয়েছেন, হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন কারকারে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে কারকারের মৃত্যু হয়নি। 'অভিনব ভারত' নামে উগ্র হিন্দু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি কারকারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিল। শ্রী যাদব আরো অভিযোগ জানিয়েছেন যে, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আই বি) আগেই ওই ২৬/১১ এর হামলার পরিকল্পনার খবর পেয়েছিল। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-ও আগেই কয়েকবার জানিয়েছিল (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৬ নভেম্বর ২০১০), যে কথা এদেশের RAW-ও স্বীকার করেছে। ( CIA hid more than it revealed on 26/11: RAW , 10/11/2013)
    তার আরো অভিযোগ, আইবি-র সঙ্গে যোগসাজশে অভিনব ভারত কামা হাসপাতালে কারকারেকে হত্যার জন্য এক সমান্তরাল অপারেশন চালিয়েছিল।

    কারকারেকে পরিকল্পনা মাফিকই পাঠানো হয় কামা হাসপাতালে। বম্বে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ কারকারের মৃত্যুর পেছনে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ গ্রহণ ক’রে কেন্দ্রের উত্তর চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে তা পেন্ডিং হয়ে যায় সরকারের তরফে এই উত্তরে যে, 'তেমন কিছু থাকলে তা পাওয়া যেতো'।

    পর্ব ৪

    আজকে একটা বিশেষ দিন। ২০০৮ সালের আজকের দিনেই (২৬/১১) মুম্বাইয়ে এক ভয়ঙ্কর হামলা চালায় একদল পাক-সন্ত্রাসবাদী--লস্কর-ই-তৈবা আর মার্কিণ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, এই দুইয়ের ডবল এজেন্ট ডেভিড হেডলির সহায়তায়। অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে কাসবদের সেই অভূতপূর্ব হাড় হিম করা আতঙ্কবাদী হামলার কথা। মুহুর্তে সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। সেইসঙ্গে উঠে আসে অনেক প্রশ্ন। কখন ঘটল সেই হামলা? যখন দেশে আগের ছ’বছর ধরে চলা সন্ত্রাসবাদের আসল কলাকুশলীদের ওপর সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী স্কোয়াড (ATS)-এর জাল গুটিয়ে আনার আর সামান্যই বাকি। হেমন্ত কারকারে নামে মুম্বাই ATS-এর প্রধান, নির্ভীক কর্তব্যপরায়ণ এই অফিসারকে লোভ আর ভয় দেখিয়ে যখন তার কর্তব্য থেকে সরিয়ে আনা গেলোনা, ঐসব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের নাটের গুরু সঙ্ঘ পরিবারের সামনে যখন তিনি এক ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে ঘটল পাক জঙ্গিদের হানা। আর সেই পাক সন্ত্রাসীদের হামলার দিনেই খুন হলেন হেমন্ত কারকারে। কিন্তু খুন তিনি পাক জঙ্গিদের হাতে হননি, এটা প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে কে বা কারা তাকে আর তার দুই সাহসী সহযোদ্ধাকে খুন করল? উত্তর মেলেনি। উত্তর পাবার জন্য যতটা পথ হাঁটা দরকার ছিল তা হাঁটা হয়নি। হাঁটতে দেওয়া হয়নি। এসব কথা আগের পর্বে আমরা জেনেছি।

    এই লেখা শুরু হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক সন্ত্রাসবাদীর স্বীকারোক্তির কথা দিয়ে। আরএসএস-এর সেই নেতা নিজের মুখে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন, বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার এক দশক আগে থেকে কিভাবে আরো অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে তারা বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়, যার ফলে নিহত হয়েছেন বহু সংখ্যক নিরীহ মানুষ, আহত হয়েছেন, পঙ্গুও হয়ে গেছেন শতাধিক। কিন্তু তখন দেশে হিন্দুত্ববাদী হাওয়ার দাপাদাপির কারণে স্বতঃসিদ্ধভাবে সন্দেহ এসে পড়ে মুসলিম ‘আতঙ্কবাদীদের’ ওপর। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই ধরা পড়ে মুসলমান লোকেরা। এবং দ্রুত এই ধরপাকড়ের জন্য পুলিশও প্রচুর প্রশংসা পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারকারে দায়িত্ব হাতে নেবার পর হিন্দুত্ববাদী ষড়যন্ত্রের গোটা জালটাকে ধরে ফেলেন। অবশ্য শেষ রক্ষা হলনা। কারকারেকে সরিয়ে দেওয়া হল।

    ২০০৬ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণগুলোর তদন্তের কাজ থমকে যায় কারকারের মৃত্যুর ফলে। কারকারের জায়গায় আসেন কে পি রঘুবংশী, যিনি এর আগেও এই পদে ছিলেন। মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত রামচন্দ্র কালসাংড়া এবং সন্দীপ ডাঙ্গেকে মহারাষ্ট্রের এটিএস, রঘুবংশীর নেতৃত্বে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়। চার্জশিটে নাম থাকলেও এরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। প্রসঙ্গত, অভিযুক্ত শ্রীকান্ত পুরোহিত এই রঘুবংশীর শিক্ষক। চমকে উঠলেন? কোথায়, তা শুনলে আরো চমকে উঠবেন। ভোঁসালা মিলিটারি স্কুল (BMS) নামে ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার নেতা এবং আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, মুসোলিনির শিষ্য ডক্টর বি এস মুঞ্জের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নাগপুরের এই প্রতিষ্ঠানটি সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটির দ্বারা পরিচালিত। এখানেই ২০০১ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিত ও অন্যান্য আরএসএস ও বজরং দলের ১১৫ জন কর্মীকে নিয়ে চল্লিশ দিনের এক ট্রেনিং ক্যাম্প হয়। শিক্ষার্থীদের অস্ত্রচালনা, বোমা ও বিস্ফোরক তৈরী ও সেগুলির বিস্ফোরণের শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানেই শ্রীকান্ত পুরোহিত ছিলেন রঘুবংশীর শিক্ষক। অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান সামরিক অফিসার এবং গোয়েন্দা বিভাগ (IB) অফিসারেরা এই ট্রেনিং দেন—২০০৬ এর নান্দেড় বিস্ফোরণ ও ২০০৮-এর মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তে যা প্রকাশিত হয়েছে। (Indian Express, 16 Nov, 2012. Tehelka Magazine, Vol.9, Issue 12, March 24, 2012). 'আউটলুক'-এর সাংবাদিকের সঙ্গে উপরোক্ত ট্রেনিং ক্যাম্পের অন্যতম প্রশিক্ষক প্রাক্তন বায়ুসেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জয়ন্ত চিতালের সাক্ষাৎকার (Godse's War, 17/11/2008) দেখুন ( 75 years of Bhonsala Military School : Militarising minds Hindutvaising the Nation)। আরো দেখুন "Hindu Extreme Right-wing Groups: Ideology and Consequences" by Ram Puniyani.
    https://www.mediahouse.online/product/hindu-extreme-right-wing-groups/ )

    পর্ব ৫

    আগের পর্বে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার আগের এক দশকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে যার ফলে নিহত হয়েছেন বহু সংখ্যক নিরীহ মানুষ, আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন আরো অনেকে, তখন সেগুলো সবই মুসলিম আতঙ্কবাদীদের কাজ বলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেওয়া হয়। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই ধরা পড়ে মুসলমান লোকেরা। একটি সূত্রের মতে, মালেগাঁও বিস্ফোরণের পর স্থানীয় পুলিশ যখন স্পষ্টতই চাপের মধ্যে রয়েছে তখন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী স্কোয়াড (ATS) তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ন’জন স্থানীয় মুসলমানকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরা প্রায় সকলেই ছিল অত্যন্ত গরীব, আর তাদের মামলা লড়তে তারা ভয় পেয়েছিল। অভিযোগ, পুলিশ তাদের বলে যে, তারা কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাদের মেরে ফেলা হবে। তাদের আরো বলা হয়, মালেগাঁওয়ের মানুষ তাদের ওপর এত ক্ষিপ্ত যে, তারা বেরোলেই লোকেরা তাদের মেরে ফেলবে। “এই মানুষগুলো ক্ষমতাহীন আর এই ব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করার মত সঙ্গতিও তাদের নেই। জোর করে আর অত্যাচার করে তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে বলেই মনে হয়”—জানায় সেই সূত্র।
    (https://frontline.thehindu.com/.../mal.../article8580609.ece)

    তদন্ত আবার গতি পায় ২০১০-এর মে মাসে। রাজস্থান এটিএস আজমের শরিফ বিস্ফোরণ কেসের তদন্ত করতে গিয়ে দেবেন্দ্র গুপ্তা ও লোকেশ শর্মা নামে দু'জন আরএসএস প্রচারককে গ্রেপ্তার করার পর। দেবেন্দ্র গুপ্তা ছিলেন বিহারের মুজাফফরপুরে আরএসএস-এর বিভাগ প্রচারক। কারকারের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া জোশি, কালসাংরা আর ডাঙ্গেকে দেবেন্দ্র লজিস্টিক্যাল সহায়তা যোগান। এসব তথ্য পাওয়া যায় গুরু দয়ানন্দের ল্যাপটপ থেকে। লোকেশ শর্মা ছিলেন জোশীর ঘনিষ্ঠ আরএসএস কর্মী। একে জিজ্ঞাসাবাদ করেই প্রথম জানা যায়, এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম মূল ব্যক্তি ছিলেন আরএসএস-এর কেন্দ্রীয় নেতা ইন্দ্রেশ কুমার। রাজস্থান এটিএস ও সিবিআই এর যৌথ তদন্তে প্রকাশ পায় যে, সন্ত্রাসের কোর গ্রুপে ছিলেন ইন্দ্রেশ কুমার, কালসাংড়া, ডাঙ্গে প্রমুখ।

    পুলিশ বিভিন্ন রাজ্যে তদন্ত আর গ্রেফতারের পর কারকারের অনুসন্ধানের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং মালেগাঁও বিস্ফোরণ যে অভিনব ভারতের কাজ, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। শেষে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে জুড়ে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য ওই সন্ত্রাসবাদীদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে। তারা ধরে ফেলে যে, হিন্দু উগ্রপন্থীরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আর ইজরায়েলের মোসাদ সহ বিদেশের কিছু গোপন ইহুদীবাদী সংগঠনের সঙ্গে মিলে এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল।

    এরা সকলেই ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে এবং ভারতে এক পেশীবহুল হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করার বাসনায় তারা হাত মিলিয়ে ছিল। মহারাষ্ট্র এটিএস এর পেশ করা চার্জশিটে ইস্রায়েলে ইহুদী আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে 'অভিনব ভারত'-এর যোগাযোগ দেখানো হয়েছে।

    অর্থাৎ আজকে দেশের হিন্দুত্ববাদীদের যে প্রেম দেখছি জায়নবাদী (Zionist)-দের সঙ্গে, তা নতুন কিছু নয়। ( কথাগুলোর সপক্ষে অজস্র তথ্য রয়েছে। মাত্র একটিই আপাতত রাখছি, “বিধিবদ্ধ সতর্কতা” সহ: খুব বেশি চমকে উঠবেন না।)

    AANGIRFAN
    TUESDAY, FEBRUARY 14, 2012
    MOSSAD IN INDIA
    .

    Mossad spy turned whistleblower Victor Ostrovsky, stated:
    December 6th 1992: Israel moved into India during the BJP RSS Hindu terrorist attack on the Babri Mosque, Ayodhya. The ancient Mosque, constructed by Mughal dynasty ruler Zaheer-ud-din Muhammad Babur, was ransacked by a horde of Hindu fanatics led by the nose by RAW and RAW's Mossad overlords who were, at this point, still pulling the strings from behind the curtain.
    Hindu extremists were easily manipulated to carry out these attacks as they had been told by the BJP that the site was the birth place of their favourite god; Ram a.k.a Bhagwan. This was one of the first internationally reported cases of Saffron terror or Hindu-Zionism.

    আজ এখানেই থামছি।
    এরকম আরো অসংখ্য রেফারেন্স রয়েছে চমকে ওঠার মতো।

    পর্ব ৬

    ২০১০ এর জুনে সিবিআই গুজরাতের ভরত রীতেশ্বর নামে একজন সাক্ষীকে জেরা করে জানতে পারে আরেকজনের কথা। তার নাম স্বামী অসীমানন্দ। আসল নাম নবকুমার, বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে। ধরা পড়েন ২০১০ এর ১৯ শে নভেম্বর। ইনিই সেই ব্যক্তি যার কথা দিয়ে শুরু করেছি। ইনিই বিচারকের সামনে স্বীকারোক্তি করেন। নিজের মৃত্যুদণ্ডের ভয়কে উপেক্ষা করে বিচারকের কাছে কাছে রাখেন তার মর্মস্পর্শী নিবেদন: "স্যার, আমাকে যখন হায়দ্রাবাদের চন্দ্রগুডা জেলে রাখা হয় তখন আমার এক সহবন্দি ছিল কালিম। তার সঙ্গে কথাবার্তায় আমি জানতে পারি, মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনায় তাকে ধরা হয়েছে। সে ইতিমধ্যে দেড় বছর জেলখানায় কাটিয়েছে। জেলে থাকার সময় কালিম আমাকে প্রচুর সাহায্য করে; আমার খাবার জল ইত্যাদি এনে দিয়ে আমার সেবা করে। কালিমের আচরণ আমার হৃদয় স্পর্শ করে। আমার বিবেক আমায় স্বীকারোক্তি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে নির্দেশ দেয় যাতে প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পায়, কোন নিরপরাধকে যেন ভুগতে না হয়"। হিন্দিতে লেখা ৪২ পৃষ্ঠার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এরপর অসীমানন্দ হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্কের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। (Tehelka Magazine, Vol.8, issue 2, Dated January 15, 2011)

    জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS)-এর বরিষ্ঠ নেতারা এই হামলাগুলো চালাতে অনুমোদন দেন আর উৎসাহিত করেন। পরিকল্পনা করা হয়েছিল গুজরাটের ডাং জেলায় ২০০৬ সালে আদিবাসী খৃস্টানদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য শাবরি কুম্ভে আয়োজিত তিন দিনের এক উৎসবের সময়ে। তার আগের তিন বছর ধরে ঐ উৎসবের প্রস্তুতির পাশাপাশি অসীমানন্দ সঙ্ঘের বিভিন্ন দীর্ঘদিনের কর্মীর (স্বয়ংসেবকের) সঙ্গে দেখা করছিলেন একটা কঠিন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য।

    সেই বছরেরই জুনে তারা আবার মিলিত হন রীতেশ্বরের বাড়ি। জোশি আর প্রজ্ঞা সিং-এর সঙ্গে আসেন নতুন চারজন — সন্দীপ ডাঙ্গে, রামচন্দ্র কালসাংরা, লোকেশ শর্মা আর অমিত নামে আরেকজন। ডাঙ্গে ছিলেন মধ্যপ্রদেশের শাজাপুর জেলার আরএসএস প্রধান, আর কালসাংরা ইন্দোরের একজন প্রচারক।

    চার্জশীট অনুসারে, বিস্ফোরণগুলো ঘটানোর জন্য জোশি তিনটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেন। তাদের বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর জোশি সর্বাধিক সংখ্যক পাকিস্তানিকে হত্যা করার জন্য সমঝোতা এক্সপ্রেসকে টার্গেট করতে বলেন। অসীমানন্দ প্রস্তাব করেন মালেগাঁও, হায়দরাবাদ, আজমের আর আলিগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।

    কোনো খবর ছাড়াই কয়েকমাস কেটে যায়। তারপর দেওয়ালি উৎসবের সময় জোশি আসেন শাবরি ধামে অসীমানন্দের আশ্রমে। অসীমানন্দের স্বীকারোক্তি অনুসারে, জোশি মালেগাঁওয়ে ৮–ই সেপ্টেম্বর বিস্ফোরণ ঘটানোর কৃতিত্ব দাবি করে, যার ফলে ৩১ জনের মৃত্যু হয়। চার্জশীট অনুসারে ডাঙ্গে আর কালসাংরা বোমা তৈরির সরঞ্জাম জোগাড় করতে আর বিস্ফোরণ ঘটাতে জোশিকে সাহায্য করে।

    "এই বিস্ফোরণগুলো সংঘটিত হয়েছে যার নেতৃত্বে, তিনি হলেন আরএসএসের জাতীয় কর্ম সমিতির সদস্য ইন্দ্রেশ কুমার। তিনিই এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ গুলো চালাতে কিছু আরএসএস প্রচারককে তুলে এনে টাকাপয়সা দিয়ে নিযুক্ত করেন"। এরা এরপর মহারাষ্ট্র গুজরাত রাজস্থান ও অন্যান্য জায়গা থেকে আরএসএস, বজরং দল, শিবসেনা আর অভিনব ভারত, জয় বন্দেমাতরম, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম ইত্যাদি সংগঠনের কর্মীদের যুক্ত করেন। সমগ্র সংঘ পরিবারই যুক্ত হয়ে পড়েছিল এইসব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে। অসীমানন্দ নিজেও যুক্ত হন দেশের কিছু মন্দিরে আর অন্য জায়গায় কয়েকটি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলা চালানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে।

    এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, সংসদ নির্বাচনের ফল যেদিন ঘোষিত হল — নরেন্দ্র মোদি ও তার দলের বিজয়ের দিন, ১৬ই মে ২০১৪—সেই দিন অক্ষরধাম মন্দির আক্রমণ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা। ২০০২ সালের ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর গুজরাটের অক্ষরধাম মন্দির আক্রমণ ক'রে বহু সাধারণ মানুষকে হতাহত করে দুজন আত্মঘাতী জঙ্গি। নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তিনি, আর তার রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ।

    এই মামলায় ৬ জন মুসলিম ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে 'পোটা' (POTA) আইন প্রয়োগ করা হয়। বিশেষ (পোটা) আদালতের রায়ে তাদের তিনজনের ফাঁসি, একজনের যাবজ্জীবন এবং অপর দুজনের পাঁচ বছর ও দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। গুজরাত হাইকোর্টও সেই রায় বহাল রাখে। অবশেষে গত ১৬-ই মে সুপ্রিম কোর্টের উপরে উল্লিখিত রায়ে (মোদির বিজয়ের দিন) এরা প্রত্যেকে ছাড়া পেয়েছেন। তাদের চারজন ১১ বছর করে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন আর তিনজন ছিলেন আট বছর ধরে ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে। অভিযোগ: অক্ষরধাম আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে, আর এর নকশা রচিত হয় সৌদি আরব-হায়দ্রাবাদ-আমেদাবাদ এবং জম্মু-কাশ্মীরে।

    পর্ব ৭

    অক্ষরধাম মন্দির আক্রমণের পর প্রায় এক বছর পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু পুলিশ থেকে ATS এর হাত ঘুরে ২৮-শে আগষ্ট ২০০৩ ক্রাইম ব্রাঞ্চের অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার সিংহলের হাতে কেসটা যাবার একদিনের মধ্যেই পুলিশ ষড়যন্ত্রটা ধরে ফেলল! পরদিনই প্রধান পাঁচ জন 'অপরাধী' ধরা পড়ে গেল, আর তার একদিন বাদে চরম নাটকীয়ভাবে ধরা পরল অপরজন: কাশ্মীর পুলিশের আইজি-র কাছ থেকে এক ফ্যাক্স বার্তায় গুজরাত এটিএস নাকি জানতে পারল কাশ্মীর পুলিশের হেফাজতে থাকা এক বন্দী স্বীকার করেছে অক্ষরধাম মন্দির আক্রমণে তার যুক্ত থাকার কথা। দ্রুত সব অপরাধী ধরা পড়ে যাবার এই 'সাফল্যের' প্রধান কৃতিত্ব হল encounter specialist ডিজি বানজারার, সাহায্যকারী হল জিএল সিংহল ও অন্যান্য পুলিশ অফিসার। ইসরাত জাহান নামে এক কলেজ ছাত্রী ও তার তিন বন্ধু (২০০৪), সোহরাবুদ্দিন (২০০৫), এবং অন্যান্য — এদের একের পর এক ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার অভিযোগে বানজারা জেলে রয়েছেন তার কয়েকজন সতীর্থের সঙ্গে। সেইসব পর পর হত্যাকাণ্ড আরেক হাড় হিম করা গল্প। মুখ্যমন্ত্রী মোদি, তার ডান হাত অমিত শাহ ও অন্যান্য নেতা আমলারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। (আর সোহরাবুদ্দিন খুনের মামলায় অভিযুক্ত অমিত শাহ যখন কিছুতেই বিচারপতিকে কিনতে পারছিলেন না, তখনই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটল সেই বিচারপতি লোয়া-র। তার মৃত্যু নিয়ে কোনো তদন্তও হলনা। তার জায়গায় যে বিচারপতি এলেন তিনি বললেন, অমিত শাহকে বিচারের কাঠগড়ায় আনার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। ৩১শে জুলাই ২০১৮ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু নিয়ে কোনো তদন্ত হবেনা।) সেই বানজারাকে কিন্তু সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করাই হয়নি। "নিচের আদালত গুলো পুলিশের পেশ করা তথ্য প্রমাণগুলি নি:সন্দিগ্ধভাবে গ্রহণ করেছে। সেগুলোর চরম কাকতালীয়তা, যেখানে ঘটনার ধারা নিজে থেকেই সরাসরি সমস্ত কিছু উন্মোচিত করেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই তাদের জাগেনি" — সুপ্রিমকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

    বেঞ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, "এরকম এক গুরুতর ধরণের মামলা, যার সঙ্গে দেশের ঐক্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত, সে ব্যাপারে তদন্তকারি সংস্থাগুলি যে রকম অযোগ্যতার সঙ্গে তদন্ত চালিয়েছে", সেইজন্য। "এতগুলো মূল্যবান প্রাণ কেড়ে নিল যে অপরাধীরা, তাদের ধরার বদলে পুলিশ নিরপরাধ লোকেদের ধরে তাদের ওপর গুরুতর অভিযোগ চাপিয়েছে, যার ফলে তাদের সাজা পেতে হয়েছে"! "ভয়ংকর অত্যাচার আর চাপের মধ্য দিয়ে আদায় করা স্বীকারোক্তিগুলো ভীষণ স্ববিরোধী আর অসম্ভব ধরনের" — জানিয়েছে আদালত। ১১ মাস পরে গ্রহণ করা স্বীকারোক্তিগুলো নিতে সময় লেগেছে ১৫ মিনিট! বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় পনেরো পাতার প্রতিটি স্বীকারোক্তি লিখে, সেগুলো অভিযুক্তদের পড়ে শুনিয়ে, তাদের ওপর কোনো অত্যাচার হয়েছে কিনা খোঁজ নিয়ে সমস্ত কাজ সারতে সময় নিয়েছেন আধঘন্টা! সুপ্রিম কোর্টের মতে সেটা অসম্ভব। আবার, সেই স্বীকারোক্তিগুলোর কোন একটিতে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে অন্যগুলোর মিল নেই — এখান থেকেই মামলার মৃত্যু ঘটে যাবার কথা। আরো মজা হচ্ছে, পুলিশ উর্দুতে হাতে লেখা কয়েকটি চিঠি নাকি উদ্ধার করে মৃত জঙ্গিদের একজনের পকেট থেকে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (NSG) কম্যাণ্ডোদের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রাজ সীতাপতির উপস্থিতিতে। জঙ্গিদের পোশাক ছিল রক্তে ভেজা এবং গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া, পকেটও ফুটো। অথচ চিঠি গুলো কিন্তু একেবারে শুকনো এবং পরিষ্কার। অভিযুক্ত মোহাম্মদ কায়ুম বলেন, "পুলিশ অত্যাচার করে আমাকে দিয়ে জোর করে লেখায় চিঠিগুলো। তারা দাবি করে আমার লেখা ঐ চিঠিগুলো মৃত জঙ্গিদের পকেট থেকে পাওয়া গেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট খেয়াল করেছেন...."

    সুপ্রিম কোর্টের মতে চিঠির ব্যাপারে 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী' যে সীতাপতি, তার সাক্ষ্য পুলিশ রেকর্ডই করেনি। বিচারপতিরা বলেছেন, "এই কেসের তদন্ত থেকে শুরু করে অভিযুক্তদের 'পোটা' আইনে বিচার চালানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক (নরেন্দ্র মোদির স্বরাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক) চিন্তাশূন্য অনুমতি দান (without application of mind), পোটা আদালতের দ্বারা তাদের দোষী সাব্যস্ত করা ও দণ্ডদান এবং হাইকোর্টের দ্বারা তাকেই বহাল রাখা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ঘটে যাওয়া নীতিভ্রষ্টতা (perversity) আমরা লক্ষ্য করেছি"। (চলবে)

    পর্ব ৮

    দুঃখের বিষয়, এতদসত্বেও সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু বিনা দোষে ওই মানুষগুলোর এত অত্যাচার সহ্য করার, এতগুলো বছর তাদের জীবন থেকে খসে যাওয়ার জন্য কোন ক্ষতিপূরণের আদেশ দেননি। অন্যায় ও অবৈধভাবে পুলিশ তাদের হাজতে আটকে রাখল, অত্যাচার করল, প্রমাণ গোপন করল আর বিকৃত করল, তাদের বিচারের আদেশও দেননি। সরকারি অফিসার বা মন্ত্রীদের কর্তব্য চ্যুতির বিরুদ্ধেও কোন আদেশ দেননি।

    সুপ্রিম কোর্টের মতে, ২০০৪ সালে 'পোটা' আইন বাতিল হয়ে যায় পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানবাধিকারের ব্যাপক উল্লঙ্ঘন ঘটাতে থাকার ফলে। তবু ওই আইন ইতিমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়েছে তাদের বিচার এখনো চলছে সেই কুখ্যাত আইনেই, বলছেন সুপ্রিম কোর্ট। মানবাধিকার নিয়ে এ দেশে ছেলেখেলা চলেছে।

    সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর আবার গুজরাট সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভিযোগ এবং সমস্ত মামলা রাজ্যের বাইরে স্থানান্তরিত করার দাবি জোরালো হয়।
    ৮ই সেপ্টেম্বর ২০০৬ শুক্রবার (জুম্মাবার) সাব-এ-বরাতের দিন বেলা দেড়টায় মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে ভিড়ে ঠাসা উৎসব পালনরত শহরে চারটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় (যে কথা এই লেখার ‘পর্ব তিন’-এ উল্লেখ করা হয়েছে)। সন্দেহজনক দ্রুততায় তদন্ত শেষ করে মহারাষ্ট্র এটিএস ৯০ দিনের মধ্যে মালেগাঁওয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের নয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। তাদের বিরুদ্ধে 'মহারাষ্ট্র সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন' (MCOCA) নামে ভয়ংকর আইনটি প্রয়োগ করা হয়। এই নয় জন চার বছর জেলে কাটায়। ২০০৮-এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর আবার রমজান মাসে ভিক্কু চকে বিস্ফোরণ হয়। সিমি (SIMI)-র বন্ধ অফিসের সামনে মোটরসাইকেলে রাখা বোমাটি ফাটলে ধরে নেওয়া হয় সিমি-র লোকেরাই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের নামে যে আতঙ্কের পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে কোন প্রমাণের প্রয়োজন কখনোই হয়নি। কয়েকশ' মাইল দূরে, গুজরাতের মোদাসায় একই ধরনের একটি বোমা প্রায় একই সময়ে ফাটে। মুসলিম কলোনি সুক্কা বাজারে যখন মসজিদে রমজানের বিশেষ প্রার্থনা হচ্ছিল সেই সময়ে মসজিদের বাইরে বিস্ফোরণটা ঘটে। মালেগাঁওয়ে তিন বছরের এক বালক সহ ৭ জন মারা যায়। মোদাসায় মারা যায় পনেরো বছরের এক ছেলে, আর বহু সংখ্যক আহত হয়। এখানেও গ্রেপ্তার হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা।

    ২০০৭-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি শান্তি আলোচনার জন্য পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রী খুরশিদ কাসুরির ভারতে আসবার মুখে, দিল্লি আর লাহোরের মধ্যে যাতায়াতকারী সমঝোতা এক্সপ্রেসে মধ্যরাতে দুটো শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কোচগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। আরেকটি কোচের রাখা তৃতীয় বোমাটি ফাটেনি। ঘটনায় ৬৮ জন নিহত আর বহু সংখ্যক আহত হন। শান্তি আলোচনা জোর ধাক্কা খায়। পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ-ই-ইসলাম (হুজি) এবং লস্কর-ই-তৈবা (লেট), এদের দায়ী করা হয। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও একে লেট আর হুজির যৌথ অপারেশন বলে জানায়।

    ২০০৭-এর ১৮ মে, মুসলিমদের সবচেয়ে পবিত্র মসজিদগুলোর অন্যতম হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে শুক্রবারের নামাজের জন্য যখন কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হন, সেখানে ‘অভিনব ভারত’-এর পরিকল্পনামাফিক এক বিস্ফোরণে ন’জন নিহত হন আর ৫৮ জন আহত হন।

    ফিরে আসা যাক স্বামী অসীমানন্দের ওপরে-উল্লিখিত স্বীকারোক্তিতে।
    “রীতেশ্বর, সাধ্বী প্রজ্ঞা জোশি, কালসাংরা, লোকেশ শর্মা আর অশোক ওরফে অমিত, এদের সঙ্গে যৌথ মিটিং করার পর রীতেশ্বর, প্রজ্ঞা, সুনীল জোশি আর আমি আরেকটা মিটিং করি। আমি বলি মালিগাঁওয়ের আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম, তাই প্রথম বিস্ফোরণটা আমাদের ওখানেই ঘটানো উচিত। আমি আরো বলি, দেশ ভাগের পর হায়দ্রাবাদের নিজাম পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিল, কাজেই হায়দ্রাবাদও একটা ভালো টার্গেট। এরপর আমি বলি, আজমের শরীফ দরগায় বিরাট সংখ্যায় হিন্দুরাও ভিড় করে, কাজেই আমাদের আজমেরেও একটা বিস্ফোরণ ঘটানো দরকার যাতে হিন্দুরা ওখানে যাওয়া থেকে বিরত হয়। আমাদের টার্গেট হিসেবে আমি আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির কথাও বলি"।

    পর্ব ৯

    অসীমানন্দ বলেন, ওই টার্গেট গুলো সম্পর্কে সকলেই একমত হয়। "জোশি বলেন, সমঝোতা এক্সপ্রেসে প্রধানত পাকিস্তানিরা ভ্রমন করে, কাজেই আমাদের উচিত ওটাকেও আক্রমণ করা। জোশি নিজে সেই দায়িত্ব নেন এবং বলেন যে, সেজন্যে রাসায়নিকের ব্যবস্থা করবে ডাঙ্গে..." "জোশি হায়দ্রাবাদে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য আমার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেয়। কয়েক মাস পরে জোশি আমাকে ফোন করে বলে খবরের কাগজগুলোর উপর নজর রাখতে, কারণ একটা ভালো খবর শিগগিরই আসছে। কয়েকদিনের মধ্যে কাগজে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের খবর প্রকাশিত হয়। এর ৭-৮ দিন পরে জোশি সাবরি ধাম (গুজরাটে অসীমানন্দের আশ্রম) — এ আসে, সঙ্গে আনে এক তেলেগু কাগজ যাতে ওই বিস্ফোরণের ছবি ছিল। আমি জোশিকে বলি, কাগজে কয়েকজন মুসলিম ছেলেকে গ্রেপ্তারের খবর বেরিয়েছে। জোশি বলে এটা আমাদের লোকেরাই করেছে"।

    অসীমানন্দের জবানবন্দীর গুরুত্ব এখানেই যে, তিনি তার জবানিতে অপরাধী হিসেবে নিজেকেও বারবার প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ঐ সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া এগুলো না। (উল্লেখ্য: অসীমানন্দের স্বীকারোক্তির কুড়ি দিন পরে তার আইনজীবী দাবি করেন, ওই স্বীকারোক্তি জাল। কিন্তু এরপরেও জাতীয় অনুসন্ধান সংস্থা (NIA)-র অনুরোধে অসীমানন্দ পঞ্চকুলা (হরিয়ানা) ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ওই একই স্বীকারোক্তি করেন। আর তারপর ২০১১-র ২৯ শে মার্চ হঠাৎ উল্টে গিয়ে একটা চিঠি লেখেন আজমের আদালতে। বলেন তাকে চাপ দিয়ে NIA ঐ স্বীকারোক্তি করিয়েছিল। কিন্তু তার স্বীকারোক্তি সূত্র ধরে ইতিমধ্যেই যে সত্য গুলি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তারপর এই অস্বীকৃতি আর ধোপে টিকবে না, কারণ সমস্ত তথ্যই তার স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।)

    অসীমানন্দ ২০১৭-র এপ্রিলে জামিন পান। এই জামিনের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য NIA-র হায়দ্রাবাদ ইউনিটের পরিকল্পনা NIA-এর শীর্ষ আধিকারিকরা ভেস্তে দেন বলে অভিযোগ।
    ইতিমধ্যে হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণের মামলায় অসীমানন্দের স্বীকারোক্তির ফাইল হারিয়ে গেছে। দু’পাতার যে মূল ডকুমেন্টে ষড়যন্ত্রের শরিক হিসেবে বেশ কিছু আরএসএস নেতার নাম ছিল, তা ছিল নিম্ন আদালতের হেফাজতে। (The Wire Staff, 16 March 2018)(
    https://thewire.in/politics/disclosure-filed-by-aseemanand-in-mecca-masjid-blast-case-goes-missing )
    আর সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় (৬৮ জন মৃত, ৫০ জন আহত — সরকারি মতে) কাউকে দোষী পাওয়া যায়নি — কেসটা এমনভাবেই সাজানো হয়েছিল। অভিযুক্ত সবাইকে ‘নির্দোষ’ বলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে (মার্চ, ২০১৯) ।

    কারকারের মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, তিনি প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে অনুমতি চেয়েছেন তার তদন্ত থেকে পাওয়া কিছু সূত্রকে ধরে এগিয়ে যেতে। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর মধ্যে এই মতাদর্শ কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তার সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হলো না, তিনি নিহত হলেন।

    সুবিস্তৃত এই হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল এর এজেন্ডা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দানবীয় করে দেখানো এবং তাদের খতম করা (ethnic cleansing)--যেমন হয়েছিল গুজরাটের গণহত্যায় ২০০২ সালে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ আরো গভীর করে তোলা, আর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধানোর প্ররোচনা সৃষ্টি করা।

    এই সমস্ত রহস্যের পুরোপুরি উন্মোচন সম্ভব হতো একমাত্র যদি কারকারের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ঠিকভাবে এগোতো। কিন্তু সেটা অসম্ভব আজকের বাস্তবতায়। সামরিক ও অসামরিক প্রশাসন আর আমলাতন্ত্রের গভীরে এই 'দেশপ্রেমিকদের' অনুপ্রবেশ এবং নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা সেটা হতে দেবে না। বরং হিন্দুর ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার নামে মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেষ্ঠের সেবায় এরা এক পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদি জমানা কায়েম করার দিকেই এগোতে চাইবে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণাকে তীব্রতর করে তুলে, তাদের প্রতি যে কোনো ধরণের অপরাধকে বৈধ করে তুলে।

    পর্ব ১০

    মহারাষ্ট্রের নাসিকের ভোঁসালা মিলিটারি স্কুলের কথা ইতিপূর্বে এসেছে আমাদের চতুর্থ পর্বে, যা ১৯৩০ সালে গড়ে তোলেন বি এস মুঞ্জে, ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ইটালি থেকে ফিরে এসে। এই স্কুল প্রতি বছর কয়েক ডজন ব্যাচকে আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রেনিং দেয় আর মগজ ধোলাই করে। তিনি আরো অনেক ধরণের মিলিটারি স্কুল আর কলেজ খোলেন। সাভারকরও এরকম একটি মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলের ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন। মুঞ্জের মিলিটারি স্কুল আর কলেজগুলি পরিচালিত হয় সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটির (CHMES)-র দ্বারা। ভোঁসালা মিলিটারি স্কুল হচ্ছে জঙ্গি হিন্দুত্বের মেরুদণ্ড। এখানে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আর সঙ্ঘের আদর্শে দীক্ষা দান করা হয়। এরকম আরো অনেক স্কুল খুব দ্রুতগতিতে গড়ে উঠছে। CHMES-এরই এক শাখা নাসিকে তৈরি হয়েছে নারী যোদ্ধাদের পিস্তল ট্রেনিং দেবার জন্য।

    ওদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও এক বিশেষ নারী শাখা গড়ে তুলেছে উগ্র হিন্দু নারীদের যুদ্ধের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে, যার নাম দুর্গা বাহিনী। এই বাহিনীতে আছে প্রধানত গ্রামের, খুব স্বল্প শিক্ষিত মহিলারা। প্রতি বছর এদের ১৫-২০ দিনের ট্রেনিং ক্যাম্প সংগঠিত হয়। সেখানে তাদের ভোজালি আর আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শেখানো হয়। আগে ছয় মাস ধরে তাদের 'দীক্ষিত' করা হয়। এই দীক্ষার অঙ্গ হিসেবে পাকিস্তান বিরোধী সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তোলা হয়। এদের অন্যতম স্লোগান হচ্ছে, “হিন্দুস্থান হিন্দুদের, পাকিস্তান জাহান্নামে যাও”।!” ("Inside an Indian camp for radical Hindu women", BBC, November 09, 2014. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-29798148, accessed on May 20, 2019)

    ‘সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটি প্রকল্পের মুখবন্ধ’ নামক দলিলে মুঞ্জে লেখেন, “মৃত ও আহতদের সম্ভাব্য সর্বোত্তম ক্ষয়ক্ষতি (sic) ঘটিয়ে জয়লাভ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণকে হত্যা করার খেলার জন্য এবং প্রতিপক্ষের পক্ষে সর্বোচ্চ সম্ভব ক্ষতি ঘটানোর লক্ষ্যে”। ( Shamsul Islam, "Mohan Bhagwat Threatens To Overrun Indian Republic With Hindutva Mercenaries" Counter Currents, February 14, 2018, https://countercurrents.org/.../mohan-bhagwat-threatens..., accessed on May 2, 2019 ).

    দুর্গা বাহিনীর একজন আবার উত্তর প্রদেশে ‘হিন্দু স্বাভিমান’ নামে আট-নয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক গ্রুপ তৈরি করে। এরা আবার ‘ধর্মসেনা’ নামে বিরাট এক বাহিনী তৈরি করেছে।
    (23 Sandeep Rai and Uday Singh Rana, "15,000-strong ‘dharma sena’ in Uttar Pradesh readies for war with Islamic State" Times of India, January 20, 2019.
    https://timesofindia.indiatimes.com/india/15000-strong-dharma-sena-in-uttar-pradesh-readies-for-war-with-islamic-state/articleshow/50646587.cms
    , last accessed May 30, 2019)।
    [আগ্রহী পাঠকেরা দেখতে পারেন ধীরেন্দ্র কুমার ঝা-এর “The Shadow Army” (2017)]

    ভারতের স্বরাষ্ট্র দপ্তর আর জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন জানাচ্ছে, ভারতে খৃষ্টানদের ওপর বছরে একশ’র বেশি ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ঘটে, কিন্তু আসল সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই এর থেকে অনেক বেশি। ভারতীয় সাংবাদিকদের হিসেবে, মাত্র দশ শতাংশের মতো ঘটনার রিপোর্ট হয়। (Paul Marshall, "Hinduism and Terror" Hudson Institute, June 1, 2004)। ভারতীয় খৃষ্টানদের আরএসএস ‘পোপের সৈনিক’ বলে দানবীয় করে দেখায় যারা নাকি রোমান ক্যাথলিক ধর্ম মানেনা এমন লোকেদের হিংস্র ও বর্বর উপায়ে ধ্বংস করে। ভারতীয় মুসলিমদের ওপর আক্রমণ নিঃসন্দেহে এর চাইতে অনেক ঘন ঘন আর তীব্র।

    সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আরএসএস-এর বিপুল প্রশিক্ষিত বাহিনী দাঙ্গার সময় খুব কাজে লাগে। ভারতের প্রশাসন যদিও সেই দাঙ্গাগুলিকে স্বতঃস্ফূর্ত হিসেবে দেখায়।
    সঙ্ঘের এই সামরিক প্রস্তুতি কেবল আজ বিজেপি-র আমলে ঘটছেনা, সমস্ত সরকারের আমলে এরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে এদের এইসব কাজকর্ম চালিয়ে গেছে। কি করে তা সম্ভব হল? এতবড় বে-আইনি কাজ এত দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে কি করে?

    এর উত্তর রয়েছে সংখ্যাগুরুবাদের মধ্যে।

    এদেশের গোয়েন্দা বাহিনীর দিকে তাকালে খানিকটা পরিস্কার হবে।
    কেবলমাত্র গোয়েন্দা ব্যুরো (Intelligence Bureau — IB)-তেই মুষ্টিমেয় মুসলিম অফিসার আছেন। গোয়েন্দা বিভাগের অন্য কোনো শাখায় একজনও মুসলিম অফিসার নেই। ভারতের সবচেয়ে গোপন গোয়েন্দা সংস্থা র’ (RAW — Research and Analytical Wing)-এর জন্ম ১৯৬৮-তে। বর্তমানে এর এজেন্টের সংখ্যা দশ হাজার। আজ অবধি এতে কোনো মুসলিম অফিসারকে নিয়োগ করা হয়নি। জাতীয় প্রযুক্তিগত গবেষণা সংগঠন (NTRO — National Technical Research Organisation) নামে বিদেশে অপারেশনের জন্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে, তাতেও কোনো মুসলিমকে কখনো নিয়োগ করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী কেবল হিন্দু(রাজপুত আর জাট)-দের মধ্যে থেকেই নিযুক্ত হয়।

    পর্ব ১১

    ২০১৪ থেকে মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (National Security Advisor — NSA) ডোভাল একজন খোলাখুলি আরএসএসের লোক। এ দেশ আজ চলে আরএসএসের তৈরি, আরএসএসের পয়সায় চলা আটটি ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর পরিচালনায়। তাদের নামঃ ১) বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউণ্ডেশন (VIF), ২) ইণ্ডিয়া পলিসি ফাউণ্ডেশন (IPF), ৩) ফোরাম ফর ইন্টিগ্রেটেড ন্যাশনাল সিকিউরিটি, ৪) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ ফাউণ্ডেশন, ৫) ফোরাম ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ, ৬) পাবলিক পলিসি রিসা্চ সেন্টার, ৭) সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ, আর ৮) ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশন।

    ঐ VIF-এর ডাইরেক্টর হলেন শ্রী ডোভাল। ডোভাল-পুত্র সৌর্য আরএসএস নেতা রাম মাধবের সঙ্গে যৌথভাবে গড়েছেন ‘ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশন’। এরা দেশের রণনীতিগতক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার পায়। এই প্রাতিষ্ঠানিক অনুপ্রবেশ আরএসএসকে শিক্ষা থেকে জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ে ভারতীয় নীতিগুলিকে গঠন ও প্রভাবিত করতে দিচ্ছে। এখন দেশের শিক্ষানীতি থেকে বাণিজ্য এবং খাদ্য পর্যন্ত সব কিছুতেই আরএসএসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

    ওদিকে, হিংস্র হিন্দু আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে বর্তমান এবং প্রাক্তন সামরিক অফিসারদের আঁতাত গেরুয়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির অপারেশনাল সক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
    মুম্বাই ভিত্তিক ‘সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম’ এবং যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ‘মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল’ (MRG), এদের যৌথ রিপোর্ট বলছে, কেবল ২০১৭ সালেই ভারতে ৭০০-র বেশি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ৮৬ জন নিহত আর ২,৩২১ জন আহত হয়েছেন। সংখ্যাটা সম্ভবত বেশিই হবে কারণ অনেক ঘটনাই খবর হয়না। ২০১৫ থেকে ’১৮-র মধ্যে “গো-রক্ষকরা” ৪৬ জন মুসলিমকে পিটিয়ে মেরেছে। আর ২০১৪ থেকে ’১৮-র মধ্যে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ১,৬২০টি হিংসাত্মক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। হিন্দু সংগঠনগুলি যুক্তিবাদীদেরও টার্গেট করেছে। তার বলি হয়েছেন নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশ, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি প্রমুখ।

    কিন্তু শেষ কথা বলে মানুষ। কর্পোরেট-সেবক সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্টরা আজ যতই দাপিয়ে বেড়াক, এই মহান দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা শেষ অবধি এই ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলবেই। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ হল, ধর্মীয় ভাবাবেগ খাওয়া যায়না, পড়াও যায়না। চাকরির প্রতিশ্রুতির ফানুষ ফেটে গেছে, মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে পিষ্ট করছে, কর্ম সংস্থান ধ্বংস হয়ে চলেছে—বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে। নতুন শিল্প নেই। পাশাপাশি আছে ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ের ওপর আঘাত। সাধারণ মানুষের দুর্দশা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চলেছে উচ্ছেদ। ওদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে এসেছে মারণ আঘাত—গোটা ব্যবস্থাটা দেশি-বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে ব্যবসার জন্য তুলে দিতে বিজ্ঞান বিরোধী, প্রগতি বিরোধী, মিথ্যা ইতিহাসের যে “শিক্ষা” ফেরি করার প্রকল্প (NEP-2020) গৃহীত হয়েছে তা দেশের কোনো কাজেই লাগবেনা; উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র ভীষণ সঙ্কুচিত হবে, তা পাবে কেবমাত্র অতি-সচ্ছল ঘরের সন্তানেরা। উচ্চশিক্ষার মতোই স্বাস্থ্যখাতেও বরাদ্দ কমে চলেছে। আজ দেশের গরীব আরো গরীব হচ্ছে আর শীর্ষ ধনীদের ঐশ্বর্যের পাহাড় আরো উঁচু হয়ে চলেছে। কার্যত গোটা দেশটাকেই বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ঐ ধনীদের হাতে। এমনকি, দেশের সমগ্র পরিবেশ (environment)-কেও এরা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। আর এসব করতে গোটা দেশকে ভরিয়ে তুলেছে ঘৃণা আর বিদ্বেষে। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনা। ঢাকনা চাপিয়ে রাখা দগদগে ক্ষতগুলো আগামী লোকসভা নির্বাচনের পর বিস্ফোরিত হতে শুরু করবেই, যদি এরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ | ১৪০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 2406:7400:63:b7d6::102 | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০৮527457
  • আজকে আবার ব্রিগেড আছে। লালুরা জেগে উঠেছে।
  • Aditi Dasgupta | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:১৬527467
  • আমরা ছা পোষা মানুষ, ঝোলে ঝালে অম্বলে, থাকতেই ভালবাসি, সন্ত্রাসবাদ তাড নিয়ে যেন মাথা ঘামানোর দায়িত্ব কিছু বিশেষ পেশা ও গোষ্ঠীর মানুষের!  আমরা কিন্তু পথে ঘাটে চালাক মন্তব্য করতে ভুল করিনা। 
     আমাদের পুরা হ্যায় বিসোয়াস যে, একবার বাড়ি ফিরে মশারী টাঙিয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই সন্ত্রাসবাদ, রক্তচোষা, আরশুলা ইদুর --- কেউ কিস্যু করতে পারবেনা! পরের দিন হয়তো আমাদেরই কেউ ইদুরের মতোই কেতরে পড়ে থাকবো বিচ্ছিরি একটা লাশ হয়ে! 
    তবে এই সব বিপজ্জনক পোস্ট ফোস্ট থেকে নিজেকে দূরে রাখবো!   
    লেখাটি বার বার পড়ার। ভাবার। আলোচনা করার।
    চট করে অন্য প্রসঙ্গে এড়িয়ে যাবার নয়।
    ধন্যবাদ, প্রাসঙ্গিক, সাহসী, তথ্য সমৃদ্ধ... লেখাটির জন্য।
  • | 2406:7400:63:f608::101 | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:৫৭527470
  • ব্রিগেড শেষ, লালুরা এবার ঘুমিয়ে পরবে। আবার মাঝরাতে হিসু করার জন্য উঠবে। তরুণ তুর্কি দের কি করে যেন প্রস্টেট বড় হয়ে গেছে। সবই মার্ক্স্ বাবার ইচ্ছা। 
    কিংবা আরএসএস + সিআইএর চক্রান্ত। 
  • guru | 146.196.47.71 | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:০০527471
  • লেখককে অনেক ধন্যবাদ খুব সুচিন্তিত একটি লেখা উপহার দেবার জন্য |
  • | 2406:7400:63:f608::101 | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:২০527473
  • এই তো, লালুদের প্রিয় বন্ধু হামাস এসে গেছে। এবার সিআইএ, ইসরায়েল আর পুঁজিবাদ এর বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ শুরু হবে।
  • কল্লোল | 2401:4900:7073:8913:6af0:83ff:8766:540b | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৬:৫৮527511
  • যুক্তি ও তথ্য নিয়ে বিরোধীতা করুন। গালাগালি দিয়ে নয়।
  • Ranjan Roy | ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:০০527653
  • মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন