সেই যে কাকটার কথা "যে কলকাতাকে ভালোবেসেছি" বইতে লিখেছিলাম, যে বইটার শেষ পর্যন্ত যে কী হলো প্রকাশক কখনো জানালেন না, বোধহয় বিক্ৰী হয়নি -- সেই কাকটা আমার এবারের কলকাতার প্রথম ভোরে কিন্তু এসে ঠিক উপস্থিত। এবারে সপরিবারে এসেছে ওদিকের সিপিএমের অফিসের দিকের গাছগুলোয়। এ কী, এগুলো কি সিপিএম হয়ে গেলো নাকি? আগে তো তৃণমূলের ক্লাবের দিকটায় থাকতো।
যাক গে মরুক গে, আমার কী? আমি এসেছি আমার কাজ করে চলে যাবো। এই সব পার্টি পলিটিক্স নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
কিন্তু কাকটা আছে দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। পাশের দুটো বাড়ি পরেই চারতলার গিন্নি ঠিক হিসেব করেই সাড়ে পাঁচটার সময়ে তিনবার শাঁখ বাজালেন। আমার কলকাতার প্রথম ভোর। আর সেই কুকুরগুলোর নানা ভাষায়, নানা সুরে একক এবং সম্মিলিত সঙ্গীত। খুব নীচু কিন্তু ওম পুরীর মতো গলায় সেই ভদ্রলোক আর তাঁর "সকালবেলার মর্নিং ওয়াকের" মোহন আগাশের মতো সরু গলার সঙ্গী একটু আগেই নীচের রাস্তা দিয়ে কী যেন দুর্বোধ্য সব কথা বলতে বলতে হেঁটে গেলেন। নিশ্চয়ই সেই অদ্ভুত রঙের মাফলার আর মাংকি টুপি পরে আছেন আগাশেদা।
আর একবার শাঁখ বাজলো এদিকে থেকে এবার। এই শাঁখের আওয়াজ আমেরিকায় কখনো শুনিনা। বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির ঠাকুরঘরের এই শাঁখের আওয়াজ আমাকে নিশ্চিৎভাবে মনে করিয়ে দেয়, আমি আমার নিজের জায়গাটায় আবার ফিরে এসেছি। যে কলকাতাকে ভালোবেসেছি, সেখানে। যে বাংলাকে, ভারতকে সারাটা জীবন ভালোবেসেছি, সেখানে। তা সে আমার বই বিক্রী হোক বা না হোক, সেসব লেখা এভাবেই ভোরবেলায় উঠে শাঁখের পবিত্র আজান শুনতে শুনতে লেখা।
আজান, আওয়াজ, আহ্বান,আব্বা, বা'জান -- কোনো তফাৎ কখনো দেখিনি চোখ খুলে যাবার পর থেকে। এভাবেই ঠিক করেছি কাটাবো বাকী জীবনটা।
আব্বা, বাবার কথায় মনে পড়ে গেলো। এই ফেব্রুয়ারিতে আমার বাবার শতবর্ষ। এই বাড়িতে এই ঘরটাতেই শুয়ে থাকতেন বাবা। চলে যাবার কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সেই তিরানব্বই চুরানব্বই বছর বয়সেও একটানা বই পড়ে যেতেন। চোখটা ছিল।
কিছুটা দেখা নিজের চোখে। বাকীটা বাঙালির তীব্র ইমোশন, ইম্যাজিনেশন।
একটু পরেই ইডেনের উল্টোদিকের ধূলিধূসর মাঠগুলোতে শীতের ক্রিকেট শুরু হবে। গাড়ি নেই আমার। কখনো ছিলোনা। থাকলে একদিন ভোরবেলায় গিয়ে সোয়েটার আর আলোয়ান মুড়ি দিয়ে একটু দেখতাম ফ্লাস্ক থেকে চা খেতে খেতে।
কিছুটা হলো এ জীবনে। যা ভাবিনি কখনো স্বপ্নে, তাও হলো। বাকীটা ... সব কি আর কখনো হয়?
সেই পুরোনো কবি তো কবেই বলে গেছেন, "আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।"
ওঃ সারেগামার কোকিলটাও আবার ডাকছে!
______
১১ই জানুয়ারি, দুহাজার চব্বিশ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।