এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • বই ও মেলার আড়ালে

    Bhattacharjyo Debjit লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪৯৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  •   সবে চা-এ চুমুক মেরেছেন অনিমেষ’বাবু(নাম পরিবর্তিত), এই মুহূর্তে ডাক এলো। রাস্তায় ঝাড়ু দিতে হবে। কোনরকমে  চা’য়ের কাপটা অন্য আরেক সহকর্মীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ালেন। এবারের বইমেলায় উনারা এসেছিলেন মোট পঁচিশ'জন। কাজ ছিল, বইমেলা প্রাঙ্গণের রাস্তাঘাট থেকে বাইরে সল্টলেক সিটিসেন্টার পর্যন্ত নোংরা, আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার।
      
      অনিমেষবাবু-রা প্রতিবারই এ-কাজ করেন বিধাননগর পৌরসভার তরফ থেকে। তাঁদের সাথে পৌরসভার চুক্তি হয় বইমেলা শুরু হওয়ার ঠিক দশ-পনেরো দিন আগে থাকতে। শুরুর আগে মাঠ পরিষ্কার করা থেকে মেলার শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার দায়িত্ব থাকে। মেলা প্রাঙ্গণের ময়লার বড় বড় ড্রাম বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে রাস্তাঘাট ঝাড়ু মেরে সাফ করা- সবটাই করতে হয় তাঁদের। এই কাজ তাঁরা করেন দুই ভাগে; একেক ভাগে পঁচিশ'জন করে। মজুরি খুব একটা তেমন কিছু মেলেনি, চারশো সাতটাকা মোটে। তবে গতবারের তুলনায় এবারে সতেরো টাকা বেড়েছে। সাথে বেড়েছে কাজের খাটুনিও। এবারে পৌরসভা থেকে মাঠ পরিষ্কারের পরে, মেলা শুরুর আগে বহু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে, তাই কাজ অনুযায়ী কর্মী’র সংখ্যা কম ছিল। ফলে একেক জনের কাঁধে কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড।
      
      এছাড়াও এবারের বইমেলার মাঠের দায়িত্ব ‘রিলায়েন্স নেটওয়ার্ক’-সংস্থার কাঁধেও ছিল। এঁরাই  সিকিউরিটি গার্ড প্রদান করেছিলেন মেলার চত্বর জুড়ে। এই সংস্থাটি মোট একশো চল্লিশ'জন গার্ড-কে এনেছিলেন বইমেলা দেখভাল করবার জন্যে। নয়টি গেটের মুখ থেকে মেলার ভেতর, গাড়ি পার্কিং লট-সহ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল এঁদেরই লোক ইউনিফর্ম পরে। তাঁদের মধ্যে থেকে কিছু জন জানালেন, এসেছেন বহুদূর থেকে। কেউ এসেছেন বনগাঁ থেকে তো কেউ আবার ডায়মন্ড হারবারের সুদূর ভেতরের পঞ্চায়েত থেকে। মেলা চলাকালীন দিনগুলোতে সেখানেই থেকেছেন। বিশেষ আফশোস, খাওয়া দাওয়া সংস্থার কর্তারা ঠিকভাবে দিলেও ঘুম হয়নি শান্তিতে। এঁদের মধ্যে অনেকেই আট ঘণ্টা করে দুই শিফটের কাজ করেছেন। আবার বারো ঘণ্টা করেও কাজ করেও করেছেন বহুজন। আট ঘণ্টায় রোজ মিলেছে সাড়ে তিনশো টাকা আর বারো ঘণ্টায় পাঁচশো টাকা মোটে। এই সংস্থার হয়ে কিছুজন সারা বছর ‘সিকিউরিটি গার্ডে’র কাজ করলেও সংস্থার কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ কর্মী’কেই বইমেলা চলাকালীন সময়ে চোদ্দদিনের জন্য ভাড়া করা করেছিল। তাঁরা বলছেন, বইমেলা শেষ হলে অন্য কোন বেসরকারি সংস্থায় কাজের খোঁজ করতে হবে। নয়তো গ্রামের জমিতে চাষের কাজও করে থাকেন।
      
      তবে এবারে সব থেকে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন ‘এসবি এন্টারপ্রাইজ’ সংস্থা’র কর্মী'রা, একদমই নিম্নমানের মজুরির বিনিময়। তাঁদের কাঁধে দায়িত্ব ছিল বইমেলা প্রাঙ্গণে যান্ত্রিক গোলযোগের দিকগুলো দেখাশুনা করবার। এই সংস্থা থেকে মোট এসেছিলেন পঁচিশ’জন। এঁরা প্রত্যেকেই চুক্তিভিত্তিক কর্মী। সবাই মিলে বইমেলাতেই কাটিয়েছেন চব্বিশ ঘণ্টা। সংস্থা'র পক্ষ থেকে খাওয়াদাওয়া-সহ রোজ পেয়েছেন সাড়ে পাঁচশো টাকা। এঁদের মধ্যেকার একজন কর্মী(দলের প্রধান), প্রসেনজিৎ আইচ’বাবু জানালেন, আমাদের কাজ চব্বিশ ঘণ্টার। মেলার ভেতরে কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ে। মেলার ভেতরে কেউ ধূমপান করছে কিনা কিংবা কোথাও কোন আগুন লাগলো কিনা সেটাও দেখভালের দায়িত্ব আমাদেরই কাঁধে। তাই এই কয়েকদিন খাওয়া-ঘুম ছেড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। আমরা সারাদিন কেবল দৌড়ে বেড়িয়েছি গোটা বইমেলা চত্বর জুড়ে। কাজের তুলনায় সঠিক মজুরি মেলেনি। এঁদেরও এই সংস্থা ভাড়া করেছে বইমেলার চোদ্দদিন ধরেই। এরপর এঁরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবেন বিভিন্ন প্রান্তের নানান কাজে – এমনটাই জানালেন সংস্থার বাকি কর্মীরাও। অর্থাৎ উপর থেকে  কলকাতা বইমেলাকে যতটা সুন্দর, শান্ত, রঙিন দেখায় অথবা সরকার এই মেলা জুড়ে যতটা নাম কামান, নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচার করতে পারেন তার পেছনে লেগে থাকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের দিনরাত এক করা কালঘাম ছুটানো বিপুল শ্রমের কাহিনী। যাঁরা কম পয়সায় নীরবে কাজ করে যান, পর্দার পেছনে।
      
      কলকাতা বইমেলার স্মৃতি অনেক ভারী। একেক জন, একেকটি সংগঠন, একেকটি প্রকাশনার কাছে একেকরকমের। নামী-দামী  শিল্পী, সাহিত্যিক, খ্যাতি-সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের কাছে আরেকরকম, বহু বছর ধরে। এই বইমেলা শুরু হওয়ার ইতিহাস জুড়েও লুকিয়ে রয়েছে সত্তর দশকের নানান ধরনের গণ-আন্দোলনের উঠা নামার ঐতিহাসিক ঢেউ; ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া ছোট্ট কলকাতা বইমেলা-ই আজকের ‘আন্তর্জাতিক’ কলকাতা বইমেলার মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৮৪ সালে এই বইমেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। একথা ঠিকই  যে, শীতের মরশুমের শেষ লগ্নে দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিবছরই বইমেলা হয়ে ওঠে বইপ্রেমী, ছোট ছোট প্রকাশনা, পত্র-পত্রিকা, লেখক-লেখিকাদের কাছে এক প্রাণের উৎসব। ঠিক এই কারণেই কলকাতা বইমেলাকে বলা হয়ে থাকে বাঙালির ‘চতুর্দশ পার্বণ'-ও। সরকারও এই মেলা ধরে প্রচুর ব্যবসাবাণিজ্য করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো এই মঞ্চকে তাঁদের রাজনীতির প্রচারের কাজে লাগায়।
      
      এবারের বইমেলাও এসবেরই মধ্য দিয়ে কেটেছে। সরকারের পছন্দের থিম ছিল ‘গ্রেট বিটেন’। আগেরবারের থেকে বইয়ের স্টল ছিল বেশি, প্রায় ১০৩৫টি। বিদেশ থেকে প্রচুর প্রকাশনি সংস্থাও এসেছিলেন। গিল্ডের তথ্য অনুসারে, গতবারের তুলনায় লোকসংখ্যাও তিন লাখের(২৯ লক্ষ) মতন বেশি হয়েছে। কিন্তু শহর তথা রাজ্য, বিশ্ববাসীকে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা উৎসরের এই চোদ্দদিন নির্বিঘ্নে, সুষ্ঠভাবে উপভোগ করানোর পেছনে থেকে গেছে কয়েকশো মানুষের অক্লান্ত সস্তা-শ্রমের গল্প। এ-খবর কোন বই কিংবা মেলার কোন কর্তৃপক্ষ ছেপেছে? নাম কামানো সরকার কী রেখেছে?  এখনো পর্যন্ত শোনা যায়নি এমন কিছুই। 
      
      বইমেলার শেষদিনে পৌরসভার চুক্তিভিত্তিক সাফাইকর্মী’রা জানালেন, বইমেলা শেষে আবার অন্য কোন মেলায় কিংবা অন্য কোথাও তাঁদের কাজ খুঁজতে হবে। কিন্তু পরেরবার তাঁরা পৌরসভার কর্তাদের বলবেন খানিক মজুরি বাড়াতে। কিন্তু এঁদের কথা মানবে কে? সরকারতো সব ব্যাপারেই বলেন বিরোধীরা উস্কিয়েছে এঁদের। আর গিল্ড  কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন রাজনীতি করা চলবে না বইমেলা নিয়ে অথবা বইমেলা প্রাঙ্গণের ভেতরে। আর বেশি কিছু করলে, সামনেই উত্তর বিধাননগর থানার পুলিশবাবু’রা আছেন, আশা করা যায় সবটা সামলে নেবেন। এইরকম কয়েকশো উদাহরণ বইমেলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে সাজানো রয়েছে। 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন