এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হালখাতার সেকাল-একাল

    স্বনন্দিনী Swanandini লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ এপ্রিল ২০২৪ | ৯৩ বার পঠিত
  •             "আমাদের ছিল ধুলোকাদামাখা
                                একখানা ছোট গ্রাম,
                       আমাদের ছিল কালবৈশাখী 
                               আম, লিচু কালোজাম।"
                                               'দুই বাংলা' 
                                                         
                                                -অপূর্ব দত্ত।
     
    ফেলে আসা ৩৭ টি বৈশাখকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনের খিড়কি থেকে এক লহমায় উঁকি দিল লাইন ক'টি। বাহারি চৈত্র বিদায় নিল। মঞ্চে এবার দাপুটে বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথমার মুকুট তার মাথায়। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। ব্যবসায়ী পরিবারে বড় হওয়া, নববর্ষ বলতেই নতুন পোশাক ও খাওয়া- দাওয়ার সঙ্গে তাই মনে আসে হালখাতার কথা। 

    ভোর ভোর উঠে শুরু হয়ে যেত লক্ষ্মী-গণেশ পুজোর আয়োজন। বাবার সঙ্গে দোকানে যেতাম। লালসালু কাপড়ে মোড়া খেরোর খাতায় পুরুতমশাই এর আঁকা স্বস্তিক চিহ্ন, সিঁদুরে মাখানো চাঁদির টাকার ছাপ, পূজো উপলক্ষে করা হোম-সবকিছু মন দিয়ে লক্ষ্য করতাম। বিকাল হলেই মায়ের হাত ধরে বের হতাম দোকানে দোকানে হালখাতা করতে। সেসব দিন ফিরে পাবার নয়!

    তবে আজ ১৪৩১ বঙ্গাব্দের সূচনা লগ্নে দাঁড়িয়ে চিরপরিচিত হালখাতার কথা ভাবতে গিয়ে হালখাতার ইতিহাস জানতে মন বড় উদগ্রীব হলো। 

    ইতিহাস বলছে বঙ্গাব্দের সূচনাকালে নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে হালখাতার কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রাচীনকালে ঋতু হিসাবেই বছর গণনা হতো। বছরের গণনা শুরু হতো হিম বা শরৎকাল থেকে।

    আমরা জানি, আদিম মানুষ ছিল যাযাবর। এক সময় তারা চাষাবাদ শুরু করে ও স্থায়ী বসত গড়ে। তখন থেকেই শুরু হয় বিনিময় প্রথা। লাঙ্গল বা হালের দ্রব্যের বিনিময়ে পাওয়া জিনিসের হিসেব রাখা হতো তৎকালীন কোন বিশেষ খাতায়। সেই খাতা থেকেই 'হালখাতা' শব্দটির প্রচলন।

    হাল শব্দটি সংস্কৃত ও ফারসি- দুটি থেকেই এসেছে। সংস্কৃত অর্থ লাঙ্গল। ফারসিতে নতুন। হালখাতা উৎসবের সঙ্গে দুটি অর্থই সাজ্জ্যপূর্ণ। 

    সম্রাট আকবর আঞ্চলিক নবাব ও জমিদারদের থেকে সম্রাটের রাজস্ব আদায় এবং কৃষকদের জমি থেকে ফসল তুলে, জমিদারদের বকেয়া খাজনা মেটানোর সময়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতে এক সর্বভারতীয় ইলাহি সনের প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলায় এটি প্রথমে 'ফসলি সন' হিসাবে পরিচিত ছিল। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসাবে পরিচিতি পায়।

    এই হিসাব মত চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর আদায় করতেন জমিদার। আর পয়লা বৈশাখের দিন হতো পূণ্যাহ অনুষ্ঠান। সম্রাট মুর্শিদকুলি খাঁ-ও পূণ্যাহ অনুষ্ঠান পালন করতেন। পরবর্তীতে এই পূণ্যাহ অনুষ্ঠানই নববর্ষ উৎসবে বদলে যায়। এদিন জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। সেই সঙ্গে শুরু হতো নতুন বছরের নতুন হিসেব হিসাব- নিকাশ। এভাবেই সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে হালখাতার ইতিহাস জড়িয়ে যায়

    আজ আর জমিদারি নেই; খাজনা আদায়ও নেই। তবুও বেঁচে রয়েছে হালখাতার সংস্কৃতি। কারণ পরবর্তীকালে বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির ধাঁচাকে সে সুন্দরভাবে অবলম্বন করে নিয়েছে। কৃষক হোক কিংবা সাধারণ মধ্যবিত্ত- জীবনের প্রয়োজনে কাঁচা টাকার দরকার পড়লেই মানুষ হাত পাততো ব্যবসায়ীর দরবারে। আজকের দিনটিতে নিমন্ত্রণপত্র সহযোগে তাকে ঋণ পরিশোধের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো। খাতক আসতেন। মিষ্টিমুখ ও সৌজন্য বিনিময় হতো। সেই সঙ্গে চলত পাওনা- গন্ডা বুঝে নেওয়ার পালা।

    আমাদের কিশোরী বেলায়, প্রায় প্রত্যেক মধ্যবিত্ত গেরোস্তর সম্বৎসরের বাজার আসতো যে মুদির দোকান থেকে তার একটা 'বাকির খাতা' থাকতো। বাড়িতে কোন বিয়ের আয়োজন, বা বিশেষ প্রয়োজনে গহনার দোকানে চলতো ধার-নগদ। মাসের শেষে ঋণ পরিশোধ করলেও খানিক বকেয়া থেকেই যেত। বৈশাখের প্রথম দিনে, হালখাতার অনুষ্ঠানে সেই বকেয়া সাধ্যমত মিটিয়ে নতুন খাতায় হিসেব তুলে দেয়া হতো। দোকানদার মিষ্টির প্যাকেট, ঠান্ডা পানীয় এবং বাংলা ক্যালেন্ডার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। বৈষয়িক সম্পর্কে সঙ্গে সঙ্গে তাতে লেগে থাকত আত্মীয়তার ওম।

    আজ ফ্লিপকার্ট, জিওমার্ট, ব্লিঙ্কিটদের দাপটে পাড়ার দোকানের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমেছে। বাড়ির কাছের গহনার দোকানে ছেড়ে আমরা পি.সি.চন্দ্র বা সেনকোতে 'মান্থলি স্কিমে' টাকা জমিয়ে গহনা কিনতে বেশি ভালোবাসি। হঠাৎ নগদের দরকার পড়লে মুথুট ফাইনান্স বা মান্নাপুরাম গোল্ড লোন আছে। হিসাবও আজ আর খেরোর খাতায় রাখা হয় না। কম্পিউটার কিম্বা মোবাইল অ্যাপেই কাজ সারা হয়। দৃশ্যতই, নাগরিক সংস্কৃতিতে তাই হালখাতার জনপ্রিয়তা কমে এসেছে। 

    তবে আজও যে বৃহত্তর বঙ্গদেশ কর্পোরেট সংস্কৃতির গ্রাসে পুরোপুরি তলিয়ে যায়নি, সেখানে বেঁচে রয়েছে ক্রেতা- বিক্রেতার অম্ল-মধুর সম্পর্কটি। বছরের প্রথম দিনটিতে ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যেকার এই সম্পর্কটিকে ঝালিয়ে নেওয়ার ঐতিহ্যটির নাম হল হালখাতা। যতদিন এই সম্পর্কটির গায়ে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার ওম লেগে থাকবে; ততদিন সগৌরবে বেঁচে থাকবে হালখাতার ঐতিহ্য।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন