এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ছাঁটা ফুলের আসন

    d
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০০৯ | ১৪৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • d | 117.195.33.180 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২১:৪৮411670
  • দমুকে বললাম দেখ নিজের জীবন থেকে একটা কিছু লিখতে হবে, যা কোনোদিন কাউকে বলা হয় নি । দমু বলল লিখে ফেলো, সমস্যা কি? আমি বললাম না মানে --- না বলা কথা । দমু বলল তাতেই বা সমস্যা কি? খুকীর গল্প লিখে দাও না । ও গল্প তো কেউ জানে না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোন খুকী? দমু বলল:
    খুকীটা আমি-খুকী হতে পারে, তুমি-খুকী হতে পারে , অথবা সেই-খুকীও হতে পারে । আসলে আমাদের এখানে তো আমি-খুকী, তুমি-খুকী বা সেই-খুকীর গল্পগুলো উল্টেপাল্টে এরটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও খুব একটা ভুল হয় না । কোথায়ও না কোথায়ও গিয়ে সব খুকীদের গল্পগুলৈ একইরকম হয়ে যায়।

    ঠিকই তো .... মনে পড়ল, খুকী যখন ছোট্ট ছিল, তখন একটু ট্যালা ছিল । মানে একটু হাবলিমত আর কি ............. খুকীর দিদা ভারী সুন্দর আসন সেলাই করতেন । কিছু ছিল এমনি দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য, চটের ওপরে ক্রচেট সুতোয় ফুল লতাপাতা আঁকা । আর কিছু ছিল তোলা-আসন । এগুলো ছিল ছাঁটা ফুলের আসন । ঐ চটের ওপরেই বোনা হত উল দিয়ে । তারপর আবার সেই নকশার ওপর কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে দেওয়া হত । ফলে আসনের ওপরটা পুরো একটা গালিচার মত চেহারা নিত । তাতে কিন্তু সেলাই আলগা হয়ে খুলে যেত না । ঐ ক্রসস্টীচে বুনে তারপর ওপরটা ছেঁটে দিয়ে ফাইনাল নকশা ফোটানো হত । সবটা শেষ হলে পেছনটা লাল টুকটুকে শালু দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত । খুকীর ভারী পছন্দ ছিল এই আসনগুলো । ওকে কেউ ওতে বসতে দিত না বলেই ওর আরো বেশী বেশী পছন্দ ছিল । ভাইফোঁটার দিনে মামারা সব, দাদাভাই আর খোকা বসত লাইন দিয়ে , প্রত্যেকে একেকটা আসনে । মা, মাসিমনি, ছোটদি আর খুকী মাটিতে হাঁটুমুড়ে বসে ফোঁটা দিত ।
  • d | 117.195.33.180 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২১:৫৪411681
  • ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    আজ হল গিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসের ষষ্ঠীপুজো । কাগজে লেখে জামাইষষ্ঠী । খুকীদের বাড়ী বলে অরণ্যষষ্ঠী । আজকে মা, মামীরা, মাসিরা, দিদিরা, খুকীরাও আসনে বসে ষষ্ঠী নেবে । মা, মাসিমনি, বড়মামা, বড়মামী, মেজমামা, মেজমামীকে ষষ্ঠী দেবে দিদা । ছোটদি, দাদাভাই, খোকা, খুকীকে ষষ্ঠী দেবে মা, মাসিমনি, মামীরা । খুকী মনে মনে ভারী খুশী হয় । আজ তো আসনে বসার দিন । আজকে ও-ও ঐ গালিচার মত নরম সুন্দর ঝলমলে রঙের আসনগুলোতে বসবে । বেগুণী, গোলাপী, নীল দিয়ে নকশা করা যেটা, ঐটা নেবে খুকী বসতে । খুকী ওটার দিকে এগোতেই দিদার ধমক - "আরে ধরিস না , ধরিস না -- ঐটা ছুঁইস না, ঐটায় বাচ্চু বইব' । খুকী একটু মন খারাপ করে । "ছোটমামা বসবে ওটায়, কেন বাবা আমি একদিন বসলে কি এমন অসুবিধে হত ছোটমামার! এইটাই তো সবচেয়ে সুন্দর' । কিন্তু সুন্দর কিম্বা অসুন্দর কোন ছাঁটা ফুলের আসনেই ওকে বসতে দেওয়া হয় না । ওদের জন্য আছে তো ক্রসস্টীচে নকশাকরা চটের আসন । মা, মামীরা, মাসিমনি মাটিতেই বসে, খুকী আর দিদিরা কেউ কেউ ঐ চটের আসনে ।
    খুকী ভাবে গালচের মত আসন মাত্র অল্প কয়েকটা তো, তাই ওদের বসতে দেওয়া হয় না । দিদা তো আরো বানাচ্ছে । সেগুলো শেষ হলেই এক এক করে ওরা বসতে পাবে । দিদা বানিয়ে চলে আর বিড়বিড় করে "অহন আর ভাল দেহি না চক্ষে -- কতটি বাকী আসে অহনও ---- বাচ্চুর বিয়া আইতাসে -- অর লাইগ্যা একটা বানানি লাগব --- মুন্নিরও বিয়ার বয়স হইসে --- অর জামাইয়ের লাইগ্যাও একখান লাগব -- রাজার লাইগ্যা একটা বানানি লাগে ---- খোকাও বড় হইতাসে ------ ' দিদার বকবকানি চলতে থাকে । খুকী শুনতে থাকে ---- শুনতেই থাকে । না: ওর নাম উচ্চারিত হয় না --- এক আধবার অবশ্য ওর "বর' নামক এক অনির্দিষ্ট কারো কথা শোনা যায় ---- আবার "সে অনেক দেরী' বলে চাপা পড়ে যায় ।

    খুকী দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে --- শুনতে থাকে --- বুঝতে থাকে---- খুকী নেই ---- কোত্থাও নেই ----- ঐ সুন্দর রঙচঙে গালিচার মত দেখতে আসনগুলোর জীবনচক্রে খুকী নেই । খুকীর ভেতরটা হঠাত খালি খালি লাগতে থাকে । ঠিক মন খারাপ নয় কিন্তু । দু:খ , রাগ ষষ্ঠীর দিন যেমন হয়েছিল, সেসব কিচ্ছু নয় । শুদ্ধু ফাঁকা লাগে ।
  • d | 117.195.33.180 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২১:৫৯411692
  • ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    খুকী আর খোকা খেতে বসেছে । দিদার সঙ্গে বড়মামী আসে একটা ছোট্ট খুরিতে দই আর চামচ নিয়ে । দাঁড়িয়ে থাকে । মা খোকাকে খাইয়ে দিচ্ছে । খোকার ভারী বায়না, মাছ খেতে চায় না কিছুতে । মা ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়াচ্ছে । খুকী এমনিতেই চটপট খায় । শেষ করে থালাটা হাত দিয়ে চেটে পরিস্কার করে বড়মামীর দিকে তাকায় । কিন্তু বড়মামী তো ওর দিকে তাকাচ্ছেই না । খুকী তাই বলে "হ্যাঁ এইবারে দাও' । বড়মামীমা হঠাতই কিরকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে । মা বলে "আরে ওটা তোর জন্য নয়' । খুকী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ওঠে "আমি তো দই খুব ভালোবাসি' । বড়মামীমা অপ্রস্তুতভাবেই "আচ্ছা আচ্ছা' বলে ওর পাতে ১ চামচ দই তুলে দেয় । মা খোকার পাতের পাশে জায়গা করে বলে "তুই আর কতক্ষণ দাঁড়াবি বৌদি! এইখানে দিয়া যা গা '। বড়মামী বাকী সমস্ত দইটা খোকার পাতে দিয়ে বাড়ী চলে যায় । পাশাপাশিই বাড়ী ওদের । দিদা কটমট করে খুকীর দিকে তাকিয়ে বলে "এত লোভ কেন তোর?"

    খুকী অবাক হয়ে যায় --- ভীষণ অবাক হয়, "অপমানবোধ' নামক অনুভুতিটার সাথে তখনও চেনাজানা হয় নি, তাই বুঝতে পারেনা এরকম লাগছে কেন? কিরকম যেন একটা লাগে ......
    কানগাল সব গরম, হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে আবার হাতপা নাড়াতে ইচ্ছে করছে না । এক্ষুণি এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, অথচ উঠে গিয়ে আঁচাতেও ইচ্ছে করছে না । খুকীর ভিতরটা হঠাৎই আবার খালি হয়ে যায় । ফাঁকা হয়ে যায় ।
  • d | 117.195.33.180 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:০৮411701
  • ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    খুকী বড় হতে থাকে আর খুকীর পিঠে একটা ডানা গজিয়ে যায় পাতলা ফিনফিনে জলরঙের ডানা, তাতে সোনালী রুপোলি ফুল ------ খুকী একদিন মস্তবড় হয়ে যায় ---- বড় হয়ে ডানা মেলে উড়ে যায় । "সে' চলতে থাকে ------ চলতেই থাকে ---- পথ শেষ হয় না --- ঠ্যাঙাড়ে হীরুরায়ের বটতলা পেরিয়ে, সোনাডাঙার মাঠ ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা চলে এসেছিল -- সে রাস্তার তো শেষ নেই -- শেষ থাকতে নেই তার --- আমি-খুকী, তুমি-খুকী , সেই-খুকীরা সেই পথ ধরেই চলতে থাকে, যতদিন না তাদের একজোড়া ফিনফিনে পাতলা ডানা গজায় । খুকীরা জানে, নিজেনিজেই জেনে যায়, যে জায়গা ছেড়ে আসা যায়, সেখানে আর কখনও, কক্ষণো "ফেরা' যায় না । সেখানে আবার যাওয়া যায়, কিন্তু "ফেরা' যায় না ।

    ছাদে ইজিচেয়ারে কফি আর বই নিয়ে আয়েস করে বসে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে ---- সেই-খুকী কোনোদিনই আর ছাঁটা ফুলের আসনে বসে নি, কি এক প্রবল অনীহায় এই আসনবোনার বিশেষ পদ্ধতিটা শেখার চেষ্টাও করে নি । কোন দু:খও নেই তার জন্য । খোকার জন্য বানানো আসনটা আছে মায়ের কাছে, ভাইফোঁটার দিন ভাইয়ের জন্য পেতে দেয় মা । একদিন সেটার ছবি তুলে অর্কুটে লাগালো, এক বন্ধু একেবারে মুগ্‌ধ ; জানতে চায় আসনবোনার পদ্ধতি । সেই-খুকী চীৎকার করতে চায় "জানিনা , জানিনা , জানিনা, জানতে চাইও না' , বলা যায় না । ভদ্রভাবে বলে "জানি না' । বন্ধু খুব দু:খ করে আগেকার এইসব শিল্পসৃষ্টি সব হারিয়ে যাচ্ছে বলে । সেই-খুকী হাসে । এখন ও জানে, টের পায়, ওকে আসনে বসতে দেয় নি যে, সে নিজেও কোনোদিন বসে নি নিজের সৃষ্ট ঐ রূপকথার টুকরোগুলোয় । অল্প অল্প হাসি পায় ---- আসনের চেয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে আরাম অনেক বেশী । করুণা হয়, মায়া হয় দিদার জন্য । তাও কোথায় যেন একটা তেতো স্বাদও লেগে থাকে --- বলা হয়নি ---- "তুমি জানতেই পারনি, টেরও পাও নি, কত্তদিন আগে ঐ ছোট্ট লোভগুলো টুপ টুপ করে মরে গেছে, সাথে নিয়ে গেছে তোমার জন্য রাখা ভালবাসাটুকুও' ।

    * লেখাটি সচলায়তন ডট কম প্রকাশিত "কাঠগড়ায় গল্প' নামক e- বুক-এ ছাপা হয়েছিল। খুব সামান্য কিছু পরিবর্তন করে এখানেও তুলে রাখলাম।
  • dd | 122.167.13.149 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:১৪411702
  • খুব মন খারাপ করা গল্প।

    এই ধরনের লেখায় বিশদ ন্যাকামী ও গলা কাঁপানোর লোভ সামলানো খুব মুশকিল।

    কিন্তু এই লেখাটায় শব্দের সার্কাস কিছু নেই, যেনো নিজের মনেই কথা বার্ত্তা, সেই জন্যেই পড়ে এতো ভালো লাগলো।
  • kali | 160.36.241.173 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:১৮411703
  • ইশ, এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো কেন?
  • a x | 143.111.22.23 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:২৩411704
  • দ, বুকের ভেতরে হাড়ে গিয়ে লাগল।
  • pi | 69.255.233.93 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:২৭411705
  • ছুঁয়ে গেল।
  • san | 123.201.53.131 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:৩৩411706
  • আরো একটু ....
  • arjo | 168.26.215.13 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:৩৬411671
  • এইতো গতকালই এটা পড়ে এলাম। ভালো হয়েছে। সেরম কিছু বিশ্লেষণ তো করতে পারি না, তাই ডিডিদাকে ডিটো দিলাম।
  • Binary | 198.169.6.69 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:৩৭411672
  • হয়ে গেল!! আজকে আর কাজকম্ম হবে না। ভাবলাম একটু ঢুঁ মেরে যাই, কিন্তু এখন আর আমার চেয়ারের পেছনের জানাল থেকে ঘুরে বসতে ইচ্ছা করছে না।

    যে এমন লেখে সে এত কম কেন লেখে ? আগেই বলেছি।
  • Du | 65.124.26.7 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:৪৪411673
  • আমিও ডিডিদাকে ডিটো।
  • Tim | 198.82.167.98 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২২:৪৫411674
  • আগেই পড়েছিলাম। বড্ড ভালো হয়েছে। শেষ লাইনটা একটা কবিতা হতে পারত।
  • bb | 117.195.179.98 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২৩:১৬411675
  • এই গল্পগুলি পড়লে মনে হয় ছেলে হয়ে জন্মেছি বলে এই বৈষম্যগুলির কখন সম্মুখিন হতে হয়নি।
    গল্পটি মনে নাড়া দিয়ে গেল।
  • sayan | 115.108.25.26 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২৩:১৬411676
  • সেই মেয়েটা ভেলভেলেটা ই এমন লিখতে পারে কিন্তু রেগুলার ল্যাখে না।

    খুকি'র জন্য মাছ-লজেন্স আর দাঁতের-লড়াই রইলো।
  • Blank | 170.153.65.23 | ২২ এপ্রিল ২০০৯ ২৩:৩৭411677
  • খুব মন কেমনের ... আর শুধু ছেলে বা মেয়ে বলেই নয়, সব ছোট্ট দেরই মনের মধ্যে অনেক গুলো এমনি না পাওয়া লুকিয়ে থাকে, আর সেগুলো মরে যাওয়ার সাথে সাথে অন্য অনেক কিছুকে নিয়ে চলে যায়।
  • Paramita | 63.82.71.141 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০০:১৭411678
  • এই গল্পটা এখানে শেষ হয় না। চলতেই থাকে। চলতেই থাকে।
  • rokeyaa | 203.110.246.230 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০১:৫৮411679
  • পড়তে শুরু করার আগে সবার কমেন্ট দেখে ভয় লাগলো। এমনিতেই খুব চাপ, এখন মন খারাপ করলে বাজে কেস। আমার পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি এইটা পড়বো না।
  • tania | 65.115.93.98 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০৩:০২411680
  • অদ্ভুত ভালো!!!
  • pepe | 74.192.194.238 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০৭:০৩411682
  • মেয়ে বলে এরকম কিছুর সামনে না পড়লেও অনেক কিছু পাওয়া না পাওয়া কে ছুঁয়ে গেল।
  • sucheta | 202.63.56.114 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০৯:২৫411683
  • এই লেখাটা পড়ে রীতিমত ঘেঁটে গেলাম, এক্কেবারে ঘেঁটে গেলাম। যাস্ট ঘেঁটে গেলাম। সারাদিনের সব প্ল্যান আজ চৌপট হয়ে গেল। কারও মাথায় গরম জল ঢেলে দিতে পারলে হয়তো একটু শান্তি হলেও হতে পারতো। হাতের কাছে কেউ নেই অগত্যা ---
    এই ধরণের লেখা কী ভীষনভাবে উলঙ্গ করে দেয় আমাদের সমাজকে, পরিবারকে। তবুও কজনের টনক নড়ে। পাহাড়প্রমান জগদ্দল অর্দ্ধেক সমাজ তাই হাত বদল করতেই থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

    খাওয়াদাওয়ার জন্য এই রকম বৈষম্যর শিকার আমাদের হতে হয়নি আমার মায়ের জন্যই। যদিও আমাদের ঠাকুমা বড় দুজনের (ছেলে ও মেয়ে) জন্য সব সময়ের বিশেষ ব্যবস্থা করেই যেত। তখন এনজয় করলেও এখন বুঝি যে সেটা কেমন ছিল। আর বোন বা ছোটোভাই এর সাথে ঠাকুমার যুদ্ধ যে অনিবার্য ছিল এখন বেশ মনে হয়। সে অন্য কিস্যা।

    তবে মেয়েদের প্রতি বেশি রক্ষণশীল মনোভাব যে কত ভুলভাল সেটা কখোনও বোঝাতে পারিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো আমাদের পুরনো পরিবার তাই পুরনো নিয়মকানুন যেতে গিয়েও যেতোনা। একসময় মনে হত যে মফস্বলের লোকজনেরা হয়তো এরকম। তাও নয়, কেননা আমরা যাই করতে চেয়েছি তারই সমর্থন পেয়েছি। কিন্তু সবই ঘেরাটোপের মধ্যে। এখন ভাবলেই কেমন লাগে। আমাদের জন্য ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙানো উঠানের মধ্যে। এদিকে দুইভাই সারাদিন গেটের বাইরে নেচে বেড়াচ্ছে। চুলে চিরুনি দেওয়ার নামগন্ধ নেই। আমাদের সবসময় ফিটফাট থাকতে হতো। ছাড়ান নেই। দুইভাই দিব্যি চলে গেল সাইকেল নিয়ে মহানন্দার জল কতটা বাড়লো দেখতে। আর আমরা বসে আছি ছাদে দুই এর পথ চেয়ে। আমি হষ্টেলে যাওয়ার আগে কখনো মুদির দোকানে যায়নি। এখন ভাবলে হাসি পায়। আমাদের কোন কিছুতেই বাধা ছিলোনা কিন্তু স্কুল কলেজ বাদে সব বাড়ির ভেতরে। তবে ভাইদেরও সন্ধ্যে ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হতো নইলে নিজেদের বাঁচাতে গল্প বানাতে হতো। এই যেমন, গতরাতে গৌর এক্সপ্রেস অল্পের জন্য বেঁচে গেছে ডাকাতির হাত থেকে। কিংবা সর্বমঙ্গলাপল্লিতে আগুন লেগেছে এই সব আর কী। গল্প বানানো আমাদের জন্য সহজ ছিলোনা।

    তবে মেয়েরা যে শুধুই মেয়ে সেটা টের পেয়েছিলাম বিয়ের পর প্রথম। যখন দেখলাম মেয়েরা মেঝেতে বসে খায় ছেলেরা টেবিলে। মেয়েরা সকালের জলখাবারে হাফ কলা খায় ছেলেরা পুরো। মেয়েরা হাফ ডিম খায় ছেলেরা গোটা। মেয়েদের জন্য একরকম চাল রান্না হয় ছেলেদের জন্য আরেকরকম। আশ্চর্য নয় যে আমিও হাফ হয়ে গেছিলাম এক মাসের মধ্যে। আরও নানারকম। ক্রমে প্রাক্তন হলে শান্তি। আমার ধারনা হয়েছিল যে বাঙাল পরিবারেই মেয়েদের এরকম অবস্থা। এখনও আমি ধন্দে আছি এই নিয়ে। কেননা আমার বেড়ে ওঠার সময়ের বাঙাল পরিবারের মেয়েদের অন্যরকম দেখেছিলাম। আসলে এরকম সাদাকালো ভাবে আঙুল দেখানো চলেনা আমি জানি। কিন্তু এরকমও দেখিনি আগে।
    যাকগে, শেষে আমার বোনের বিশেষ একটা জয়ের গল্প বলে শেষ করি এই আবোলতাবোল। ছবুর খুব শখ অনেক দিনের একখানা সাইকেলের। তখন আমাদের শহরে মেয়েরা সাইকেল চালাচ্ছে অকল্পনীয় ঘটনা একটা। ভাইদের জন্য কেনা হয়েছে সাইকেল ওরা যখন স্কুলে। বোনের ঘ্যানঘ্যানিকে থোড়াই কেয়ার করে সাইকেল চলছে। বোন বিএসসিতে গোল্ড মেডেল পেল। আর স্কলারশিপের সাথে বেশ কিছু পুরস্কারও। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর আগেই টাকা পেয়ে গেল অনেক (সেই সময়ের নিরিখে)। হষ্টেলে পৌঁছনোর সাতদিনের মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে একখানা সাইকেল কিনে শিখেও ফেললো দুদিনের মধ্যে। বাপি শনিবার বাড়ি যাওয়ার আগে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। বোন তখন এক বন্ধুকে সাইকেলএর সামনে বসিয়ে বৈকালিক বিহারে গেছেন। বাপিকে দূর থেকে দেখে সব গুলো দাঁত বার করে একেবারে সামনে। বাপির মুখ সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। মাকে শত নালিশেও কিচ্ছু করতে পারেনি। ও হ্যাঁ, বাপি ছেলে মেয়েদের বকুনি দেওয়া পছন্দ করেন না। তবে নালিশে গোল্ড মেডেল পেতেই পারেন।

    কী যে সব বলে ফেলছি অপ্রাসঙ্গিক। আসলে এরকম চলছেই চক্রবৎ।

    এরকমই নগ্ন আসলে সব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মেয়েদের অবস্থান কোননা কোনভাবে। এমনভাবে মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে কত কিছু যে নিজেরাও হয়তো বুঝিনা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। তাই এখনও অপেক্ষায় থাকতে হয় অনেককে নিজেরটা বুঝে নিতে অন্যের ওপর।

    বি:দ্র: ঐ আসন বুনতে আমিও জানতাম একসময়। দারুন হয় দেখতে।

  • shrabani | 124.30.233.101 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০৯:৩২411684
  • সকালে এসেই এটা পড়ে ফেললাম, এবার কাজে লাগব। তবে সারাদিন বোধহয় ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা মনখারাপ রয়ে যাবে!
  • Arijit | 61.95.144.123 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ০৯:৩৯411685
  • খুকীকে একটু জিগ্গেস কোরো তো এই লেখাটা আমার ব্লগে রাখতে পারি কিনা?
  • intellidiot | 220.225.245.130 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ১২:২৯411686
  • পারমিতার সাথে একমত, গল্পটা চলতেই থাকে। গল্পের সব খুকীরা যেন ভাল থাকে।
  • dipu | 121.243.161.234 | ২৩ এপ্রিল ২০০৯ ১৩:২৮411687
  • ভারি ভালো হয়েছে।
  • Shn | 123.201.130.118 | ২৮ এপ্রিল ২০০৯ ১৪:৪৭411688
  • খুকির নরম গালে আলতো হাতে আদর... ভালো থাকো খুকি।
  • d | 59.161.6.148 | ০২ মে ২০০৯ ০৯:৫৯411689
  • সুচেতাদি,

    ঠিক করতে পারছিলাম না তোমাকে এখানেই লিখে দেবো, নাকি মেল করবো। শেষ পর্যন্ত মনে হল এখানেই লিখি।
    ঐ ছেলেদের জন্য আস্ত ডিম আর মেয়েদের জন্য অর্ধেক --- আমি আবার অতটা এক্সট্রীম দেখিনি কোথাও, এমনিতে মোটামুটি সব সমান সমান, তবে রিসোর্স, বিশেষত একটু দামী রিসোর্স যখন লিমিটেড, তখনই বৈষম্যটা সাধারণত বেরিয়ে আসে। আর হঠাৎ করে বুঝে ফেলা, এইসব নিয়েই লিখতে চেয়েছিলাম।

    আর বাঙাল, ঘটি, বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে - জান আমার অনেকদিন, মানে ধর, সেই ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল যে ঘটিবাড়ীতে মেয়েদের বেশী পড়াশোনা করতে দেওয়া হয় না। আমাদের আশেপাশে তাই দেখতাম যে। তারপর বেশ অনেকটা বড় হয়ে যাওয়ার পর দেখলাম যে ঐভাবে সাদাকালো দাগ সত্যিই টানা যায় না। অজস্র ধূষর এলাকা আছে, সবপক্ষেই।

    তুমি ঐ আসন বুনতে জানো? তোমার কত্ত গুণ গো। ঐগুলো বোনা ভারী কঠিন, খুব কম লোকেই পারে দেখেছি।

    ---------------------------------

    আরো যারা যারা পড়েছে, সক্কলকে ধন্যবাদ।
  • debu | 72.130.158.122 | ০২ মে ২০০৯ ১১:২৬411690
  • আরো আরো লেখা হোক
  • ranjan roy | 122.168.71.62 | ০৩ মে ২০০৯ ১৬:১৩411691
  • লেখাটি সচলায়তনে পড়েছিলাম। আবার না পড়ে থাকা গেল না।
    এই লেখার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি সুচেতার পোস্ট।
    আমি, ডিডি, অরিজিৎ, ব্ল্যাংকি সবাই, অর্থাৎ যত বুড়োখোকা-ধেড়েখোকা-ছোটখোকারা, বড়জোর এ-খুকি, সে-খুকির পাশে দাঁড়িয়ে আহা-উহু করতে পারবো, কিন্তু ওর ব্যাথার যায়গাটা ছুঁতে পারবো না।
    তাহলে অনেকদিনের ভোগকরা সুবিধেগুলো ছাড়তে হবে।
  • sucheta | 202.63.56.114 | ০৫ মে ২০০৯ ১১:৩০411693
  • দময়ন্তী,

    তোমার অনুভূতি বুঝেছি। বৈষম্যই যে আসলে তাও তো বোঝা যায় না অনেক সময়। উচবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এই রকম বিভিন্ন খোপে খোপে আজন্মলালিত ধ্যানধারণা-সংস্কার বসে থেকে থেকে নিয়মই হয়ে গেছে কত পরিবারেই প্রশ্নহীন। বৈষম্য যে কত প্রকট হয় বাড়ির বাইরে গিয়েই দেখলাম প্রথম। আর ঘটি-বাঙাল ব্যাপারেও আমাদের ছোটো বেলায় তেমন ধারণা ছিলনা। যত বড় হলাম তত জানলাম। আর এখনও যতদিন যাচ্ছে তত দেখছি জান্তে পারছি। যদিও এভাবে বিভাজনে আমার আপত্তি আছে প্রবল। যাকগে, তোমার লেখাটা ভালো হয়েছে, ছুঁতে পেরেছো অনেকের অনুভূতিকে।

    রঞ্জনবাবু,

    আপনার empathy দেখে ভালো লাগলো। আসলে ঠিক ব্যাথা নয়, প্রকট বৈষম্যের শিকার হয়েও অনেক সময় কিছু না করলে বা পারলে নিজের প্রতি দায়িত্ব পালন করা হয় না। আর এই দায়িত্ব পালন না করতে পারলে অনেক অনুভূতি ধামা চাপাও পড়ে যায়। ঠিকঠাক action নেওয়ার পরেও এখন সেই সব অনুভূতি অন্যের অনুভূতির সাথে রিলেটেড হলে বেরিয়ে আসে সময় সময়। এই আর কী।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন