সালটা ১৮৪২। কলকাতার বুকে তখন পুরোদমে বেজে চলেছে নবজাগরণের দামামা। প্রতি মুহূর্তে পালটে যাচ্ছে কল্লোলিনী তিলোত্তমার চালচিত্র, বদলে যাচ্ছে শহর কলকাতার আট থেকে আশির রোজকার যাপন। চিৎপুর রোড, যা বর্তমানে পরিচিত রবীন্দ্র সরণি নামে সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর হাঁটলেই চোখে পড়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি যা ছিল তৎকালীন কলকাতার বুকে নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল। শুধুমাত্র সাহিত্য সংস্কৃতি নয়, সেই সময় বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল এই ঠাকুরবাড়ি। ... ...
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬৮, ৬৯ আর ৭০ সালে তিনটে বড়ো গল্প লেখেন, তিনটে দেব সাহিত্য কুটীর পূজাবার্ষিকীতে। আপাতভাবে ভূতের গল্প হলেও, এই ট্রিলজির অনেক স্তর, আর অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইউনিক। এই 'ভূতপুরাণ' নিয়েই আমার চিন্তাভাবনা। ... ...
কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে মিডিয়া আর বেশি কিছু কথা বলেনা। মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়ার খেলা, দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার খেলা চলেছে নিরন্তর। এ এক নতুন ধরনের "জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন" -- সুকৌশলে বর্জন করার সাংবাদিকতা। আমার নতুন বই "আপনি কি দেশদ্রোহী?" (RBE, কলকাতা, ২০২১) থেকে এই বিষয়ে একটা ক্ষুদ্র অংশ এখানে পোস্ট করলাম। ... ...
সেই ঘনায়মান আঁধারে এক সময় বালুদা এসে বসে ছিল আমার পাশটিতে। নেশা মেশানো নীচু গলায় বলেছিল : দাদাবাবু, আমার বড় সপপন ছিলো লালন মুর্দাফরাশ হবে না। জিন্দা আদমি তুলবে... ইলাজের জন্য হাসপাতাল আনবে এম্বুলেন্স চাপিয়ে। .... হল না । শালা মর্গে ডিউটি পেল -- অ্যানাটমি ঘরেও নয়। সবাই বলে ওখানে পয়সা আছে। ডেড দের গায়ের আংটি-হার ঘুরিয়ে দিলেই হলো। আমি লেকিন হেরে গেলাম দাদাবাবু। ..... মুর্দাফরাশের বেটা ডাক্তার হবে তো ভাবলাম না -- এটেন্ড্যান হবে... এটা তো ভাবা যায় বলুন? লালন তো ইন্টার পাশ ভি করল! তবুও.... "। স্তোকবাক্য শুনিয়েছিলাম বালুদাকে। বলেছিলাম : আরে, লালনের বিয়ে হবে... ছেলেমেয়ে হবে...তাদের ভালোভাবে পড়িয়ো... হয়ত একদিন কেউ ডাক্তারই হবে ! সেদিন যেন জানাতে ভুলোনা দাদা! " বালুদা ম্লান হেসে বলেছিল : দাদাবাবু, আর একটু মানসু নিতেই হবে লেকিন । ... ...
বাবু বিলাসের মধ্যমণি রায় দিলেন : দোয়াতদানি বরফ জলে চুবিয়ে আনা হোক... তারপর সেই বিকচ স্ফটিক-সম দ্রাক্ষারিষ্ট ঢেলে দেওয়া হলো তাতে। যেন বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ জল-বারান্দায় বসা মানুষ জনের শহুরে বোধের মরম ছুঁয়ে গেল ! এলো ইলিশ-কেভিয়ার ! নাহ, সেই Royal Mother Of Pearl এর চামচ দিয়ে নয় -- দু আঙ্গুলের মধ্যে নিয়ে তাকে চেখে দেখার নিদান দিলেন সেই ঋজু-পুরুষ । স্বাদ কোরক গুলি বুঝি এক অজ্ঞাতপূর্ব আশ্লেষে... আবেশে অশেষ হয়ে উঠেছিল সেই প্রথম পরশনে... দরশনেও বটে ! ইলশে গুঁড়ির আনন্দে ততক্ষণে বারান্দার মেহগিনি কাঠের রেলিং সেজে উঠেছে - "রোদ্দুরে রিমঝিম"। সেই মাটির পাত্র যখন স্বাদে -আনন্দে - সুরে আর সুরায় উচ্ছল, লালাদা কেন জানি গেয়ে উঠেছিলেন -- : বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা -- পিয়ো হে পিয়ো। : গান শেষে চোখ মুছে বললেন : : এটা কেন গাইলাম ? ইলিশ মাছের "এলিজি " ! এই মানুষ "কোয়েলের কাছে" লিখবেন না তো কে লিখবে ? ... ...
ছুঁতে ছুঁতেই মনে হচ্ছে অনেকটা ছুঁয়ে ফেললাম, একটা উনিশ বছর। এই চরাচর এর মতো ছুঁয়ে যাওয়া আমায় একটা পাড়া, শৈশব , বড়ো হওয়া বেঁধে দেয়। যেই পাড়াতে নাগরিকত্ব পেতে পাড়াতুত দাদাদের চোঁখ আমাকে স্বজনের মৃত্যু মনে করায়। তবুও কি সহজেই বেপাড়া গুলো নিজের হয়ে যায়। আসলে সেইসব পাড়ারা বাঁধ মানেনা। তাই এই বসে থাকা বদ্রীদাস টেম্পল রোডেও মাঝে মাঝে চরাচর এসে ধরা দেয় পূর্ণিমার আগের রাতে। আমি দীনেন্দ্র স্ট্রিট, গৌড়িবাড়ী লেন হয়ে এক একটা নতুন পাড়া খুঁজে ফিরি। ... ...
প্রতিটা তারের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে ঝুলতে থাকা সারি সারি ছোট বড় জলের ফোঁটা। বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে, তবে হাওয়া দিচ্ছে না বলে এখনও ফোঁটাগুলো আটকে আছে, মনে হল আমার জন্যই আটকে আছে। একটা ফোঁটায় আঙুল ছোঁয়াতে গিয়ে হাত লেগে গেল তারে, জলের বিন্দুরা ভিজে ছাদের ওপর টুপটুপ করে ঝরে পড়ল। ... ...
হিন্দি সিনেমার গান শুনে বাঙালি কেন উলুতপুলুত হয়, আপাতদৃষ্টিতে বোঝা মুশকিল। যে ঘরানার গানের শ্রেষ্ঠ লিরিক নাকি 'মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়', অর্থাৎ কিনা 'আমার কিছু মালপত্তর তোমার কাছে পড়ে আছে' আর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লিরিক তর্কযোগ্যভাবে 'বিড়ি জ্বালাইলে', অর্থাৎ কিনা 'সিঁড়ির নিচে বিড়ির দোকান', সে গান শুনলে এমনিই ভদ্রজনের মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা। হিন্দি বলয়ের কথা আলাদা, ওদের এরকমই কপাল। ইউপি-বিহারে আধুনিক কালে কোনো জীবনানন্দ জন্মাননি। আর অতীতের গৌরব যা ছিল, সেসব স্টিমরোলার চালিয়ে কবেই ফ্ল্যাট ... ...
রিভিউ এর আগে কখনো লিখিনি। সিনেমার রিভিউ লেখার যোগ্যতা আমার এমনিতেও নেই, কিন্তু বই এর রিভিউও লিখিনি কখনো। তাহলে হঠাৎ এই চেষ্টা কেন? কারণ মূলতঃ দ্বিমুখী। প্রথমতঃ এই বইটা আমার নিজের খুব ভাল লেগেছে, কিন্তু সেভাবে আলোচিত হতে দেখিনি – এর দুরকম কারণ হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে – হয় বইটা লোকে বিশেষ পড়েনি, অথবা পড়ে খুব একটা ভালো লাগেনি। এবং দ্বিতীয়তঃ, যদিও এটা কিছুটা রিলেটেড, আমি কয়েকটা রিভিউ পড়লাম, যেগুলো সবই নেগেটিভ রিভিউ – তো আমার মনে হল আমার যে ভাল লেগেছে, সেটা ডকুমেন্টেড করে রাখি। ও হ্যাঁ – বইটা। এক ... ...
আমি অসৎ হলে বলতাম ওর গায়ের রং ছিল আবলুশ কাঠের মতন কালো। কিন্তু আমি সৎ, আর আমি জীবনে আবলুশ কাঠ দেখিনি। অনিতার গায়ের রং কালো ছিল নিঃসন্দেহে, তবে ওরকম কালো শেডের কাঠ আমি কখনো দেখি নি। ... ...
আমার বাবা আজিজ মেহের (৮৬) সেদিন সকালে ঘুমের ভেতর হৃদরোগে মারা গেলেন।সকাল সাড়ে আটটার দিকে (১০ আগস্ট) যখন টেলিফোনে খবরটি পাই, তখন আমি পাতলা আটার রুটি দিয়ে আলু-বরবটি ভাজির নাস্তা খাচ্ছিলাম। মানে রুটি-ভাজি খাওয়া শেষ, রং চায়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে বাবার কথাই ভাবছিলাম।আজ তাকে কাছেই সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। দুদিন আগে তিনি পর পর তিনবার বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। ৮৬ বছর বয়সে এই প্রথম তার পা ফস্কে গেল। নইলে এতো বছর ধরে সব কাজ তিনি একাই করেছেন। অস্বাভাবিক প ... ...
পৃথিবীতে কিছু শিশু নানান ধরনের সমস্যা/অক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এবং বড় হয়। যাদের আমরা "বিশেষ শিশু" বলে থাকি। তাদের সম্পর্কিত বিষয়ে ইংরাজী ভাষার বইপত্তর থাকলেও সহজ বাংলায় তার বেশ অভাব। যেটুকু আছে তাতে সবসময় সব সঠিক তথ্যও থাকে না। নিজের বহুবছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে এবং এক শুভান্যুধায়ীর অনুপ্রেরনায় নানান ধরনের সমস্যা/অক্ষমতা নিয়ে সহজবোধ্য ভাবে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিক হিসেবে লেখার প্রচেষ্ঠা করেছি৷ আজ প্রথম পর্ব৷ ... ...
এত বছর পর গতমাসে ফোনে শিবুদার গলা শুনে অবাকই হয়েছিলাম! যোগাযোগ নেই প্রায় সিকি শতক! সে বছর মাঝ শ্রাবণে ভাসতে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছেছি মহানগরের স্নায়ু কেন্দ্রে। ঠাঁই নাড়া হবার পর সেই আমার নতুন ঠিকানা! সেখানে হাত বাড়ালেই প্রসিদ্ধ স্মৃতি-সৌধ, গির্জাঘর, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, কৃষ্টি-কেন্দ্র আর অজস্র-ধারা-বৃষ্টির মতন মানুষ! শিকড় সমেত উপড়ে এনে আমাকে বলা হয়েছে, ডালপালা ছড়াও হে, এই তোমার নতুন আকাশ! ... ...
কোনো চাকা আবিষ্কার, বড়শির হুক আবিষ্কার, এমনকি আগুন ব্যবহার করতে শেখার জ্ঞান থেকেও এই সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়নি, অপরকে সাহায্য করবার মন-মানসিকতা তৈরি হওয়া থেকেই শুরু হয়েছে এই যাত্রা। ঠিক এভাবেই অপর সম্পর্কে উদাসীনতাই যে এই যাত্রাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই আজ আর। ... ...
প্রায় মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রফেশ্যনাল ম্যাসাজের বলতে আমার দৌড় ছিল ওই সিধু জ্যাঠা অবদিই। বাড়ির উঠোনে সেই সকাল থেকে বাড়ি শুদ্ধু পাবলিকের দাড়ি, চুল কাটা চলছে। প্রথমেই বাবার দিয়ে শুরু, বাবা দাড়ি কেটে নিমো ফটকগোড়ায় নারানের চায়ের দোকানে রোজকার প্রাতঃকালীন আড্ডায় চলে গেল। কাকা রবিবার ছূটির দিনে দাড়ি ইত্যাদি কেটে একবার গেল চাষের জমিতে রাউন্ড মারতে, সে রাউন্ড মারা অবশ্য সিম্বলিকই ছিল। কাজের কাজ বলতে কাকা মাঝে মাঝে জমি থেকে গোটা কতক মূলো তুলে এনে বলত, মূলো গুলো খাবার মত হয়ে গ্যাছে, মুড়ি দিয়ে খাব বলে নিয়ে এলা ... ...
কৃষিকাজের জন্য হেবার-পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া উৎপাদন আজ একটি বিশাল শিল্প। প্রতিটি মানুষের দেহে যে নাইট্রোজেন, তার সবচেয়ে বড় অংশটাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়। এটা খুবই সম্ভব যে, আমি এবং আমার মতো অধিকাংশ মানুষই জন্মাতই না, যদি না ফ্রিটজ হাবের, হেবার প্রসেস আবিষ্কার করতেন। ... ...
আমার একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। যার বেশীরভাগ প্রবন্ধই এই ব্লগে প্রকাশিত। সেই বই বিষয়ে দু'চার কথা ভাগ করে নিলাম আমার পাঠকদের সাথে। নিজের বই নিয়ে ফেসবুক জাতীয় সমাজমাধ্যমে আলোচনা করাটাই রীতি। কিন্তু আমি ফেসবুক বা অন্য প্রচলিত সমাজমাধ্যম থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। গুরুচন্ডালিই আমার একমাত্র মাধ্যম নিজের কথা বলার জন্য। আশা করি নিজের ব্লগে, নিজের বই নিয়ে লেখা একটু রীতি বহির্ভুত হলেও নীতি বহির্ভুত বলে বিবেচিত হবে না। ... ...
আচ্ছা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এই যে আমাদের এত কান্নাকাটি, এইটা আদৌ করছি কেন আমরা? শুধুই ওটা আমাদের সংবিধানে সসম্মানে উল্লিখিত আছে বলে? শুধুই কি এই কারণে যে, পশ্চিম একে এক অবশ্য-পালনীয় আদর্শ বলে মনে করে, এবং আমরা পশ্চিমকে অনুকরণ করতে ভালবাসি? শুধুই কি এই কারণে যে, ওর মধ্যে ‘নিরপেক্ষতা’ কথাটা আছে এবং সেটা শুনতে বেশ চমৎকার লাগে? ... ...
কাবলিওয়ালার ঝোলা যেমন হিং-সুর্মার গন্ধে আমোদিত হতো, এই সব ডাক্তার জ্যেঠুদের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ --- না, ব্রিফ কেস নয় -- কালো বা বাদামি চামড়ার হাতে ঝোলানো গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুললেই ছড়িয়ে পড়ত স্পিরিট -- টিংচার আয়োডিন আর ইউকিলিপ্টাস অয়েলের মিশে যাওয়া একটি ঘ্রাণ। আর তখনই মনে হত -- এই তো আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মা আজ বিকেলেই খেলতে যেতে দেবেন। ... ...