এভাবে বিদেশি শব্দ ধার করায় বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে না উচ্ছন্নে যাচ্ছে সেই বিতর্কে যাবার আগে একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখা যাক এইরকম পরিস্থিতিতে আগের যুগের মানুষেরা কি করত। কিভাবে অভ্যর্থনা জানাত, বিদায় জানাত, কিভাবেই বা অনুতাপ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত? ... ...
মানুষের বাসনার ইতিহাস বড় বিচিত্রপথে প্রবাহিত। সমাজ ও ধর্ম তার যে অনুমোদিত রূপগুলি গড়ে তোলে তাকে ফাঁকি দিয়েই গড়ে ওঠে তার বিচিত্র প্রকাশ। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই তাতে অবদমনের মাত্রা আরো বেড়েছিল। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও এই অবদমন যে সামাজিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের অংশ হিসেবে টিঁকে থাকে তা পিতৃতন্ত্রের হাতকেই আরও শক্ত করে। তাই তাকে চিনে নেওয়া আজ জরুরী। ... ...
আমাদের অনেকের বাড়িতেই টেপ রেকর্ডারে বেজে গেছে হেমন্তের গান, একের পর এক। কখনও ঘোরের মধ্যে শুনেছি, কখনও বহুদিন পর, কখনও কিছুদিনের তফাতে। কিছুটা আলো-আঁধারের গান গেয়েছেন হেমন্ত; কখনই শোকে সম্পূর্ণ নিমজ্জন নেই সেই কণ্ঠে, আবার আনন্দের পাল তরতরিয়ে ছুটেছে, এমনও নয়। একটি একটি করে গান গাইতে গাইতে তিনি এগিয়েছেন, জড়িয়ে গেছে আশেপাশে কত নাম তাঁর সঙ্গে। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ বললেই এঁদের মানিকজোড় নামটি হেমন্তের; এমনকি মহানায়ক উত্তমকুমার বললেও হেমন্তই মহানায়কের কণ্ঠ। ... ...
কৈশোরে গড়ের মাঠে (তখন মনুমেন্ট ময়দান নয়, গড়ের মাঠই বলা হত) ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে মাউন্টেড পুলিশের তাড়া খেয়ে (ঘোড়সওয়ার পুলিশ) গ্যালারিতে বসার পর টের পেলাম — এটা ঘটিদের, থুড়ি মোহনবাগান সাপোর্টারদের এলাকা। মুখে কুলুপ এঁটে ওদের কথোপকথন শুনতে গিয়ে জানলাম — খেলার মাঠে বাঙালদের কোড নেম ‘জার্মান’! কেন? কে জানে! ... ...
এইসময় আমি আস্তে আস্তে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম নাচ কে। দিদি মানে আমার নাচের গুরু শিখিয়েছিলেন পি.সি. সরকারের বলা সাফল্যের তিনটি মন্ত্র প্র্যকটিস, প্র্যাকটিস,আর প্র্যাকটিস। তাই দিদির ক্লাসের আর এক ছাত্র এগিয়ে এল তালিম দিতে। সপ্তাহে আরও একটা দিন করে বাড়ল প্রথাগত অভ্যেস। শুরু হল তার বাড়ীতে আলাদা করে যাওয়া। কোনও একদিন দিদির নাচের অনুষ্ঠানের শেষে বেশ রাত হওয়ায় তার বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাম। আর রাতের বেলা আমার শরীরে উঠে এসেছিল সে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম তাকে। হিসহিসিয়ে উঠেছিল, "তোমার রণ তো তোমায় এর আগেই এতদিন ধরে ভোগ করেছে। আর আমার বেলায় এত সতীপনা!" ঘেন্নায় কুঁকড়ে উঠেছিলাম। এখানেই শেষ হয়নি টলিউডি সংলাপ! হিসহিসিয়ে বলে উঠেছিল, "কি মনে করিস আমরা কেউ কিছু বুঝিনা, দিদির ওখানে আমরা সবাই তোকে নিয়ে আলোচনা করি, বেশী নাটক করিস না। এরপর তুই ওখানে কি করে মুখ দেখাস দেখবো।" লজ্জায় কুঁকড়ে গেছিলাম সেরাতে, ভোর হতেই বেড়িয়ে এসেছিলাম। সেদিন কেন জানিনা মনে হয়েছিল "নাচ শেখা" আমার জন্য না। ওদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নিজের কেরিয়ার নিয়ে ভাবাটাই ভাল বলে মেনে নিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে নিজের নাচ নিয়ে স্বপ্ন আর দেখিনি। আজকাল টিভির চ্যানেলে চানেলে নাচের রিয়েলিটি শো, কত সুন্দর সুন্দর কোরিওগ্রাফি। আমার বাবা মা ভাই সবাই দেখে। শুধু আমিই দেখিনা... ... ...
আসলে তাদের দুঃখ কষ্ট আমরা কোনদিনই সেভাবে বুঝতে পারব না হয়ত। কারণ, স্বাধীনতার নামে পাওয়া এইরকম মুক্তি ভারতের কোন মানুষই চায়নি বোধহয়। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে হয়েছিল এপারে। তথাকথিত মুক্তিতে মেতেছিল এক শ্রেনির মানুষ আর এক শ্রেনি নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এক রাতেই বিদেশি, উদবাস্ত তকমা নিয়ে ফিরেছিল এদেশে। "কাঁটাতার" তাদের সেই সময়কার সেই বেদনা অভিমান প্রকাশ করার একটা চেষ্টা মাত্র। ... ...
লিঙ্গসাম্যযুক্ত এক সমাজের আবাহন যতদিন আমরা না করতে পারছি কিংবা লিভ ইন এর মত অপ্রচলিত সম্পর্কের রাজনীতিটাকে এই বৃহত্তর রাজনীতির জন্য প্রতীক্ষায় থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারছি ততদিন এ নিয়ে আমাদের কেচ্ছাচর্চা চলবে, নতুন কোনো অবস্থানের সূচনা হবে না যাতে পিতৃতন্ত্রের শেকলটা একটু ঢিলে হয়। ... ...
রণকে ভালবেসে ওর কাছে বারবার দৌড়ে গেলেও ওর বিয়ের পর থেকে পারতপক্ষে শারীরিক সম্পর্কটা আমি এড়িয়ে চলতাম৷ খালি মনে হত আমি রণ-র কেউ না। আমি কি রণ-র রক্ষিতা না ভালবাসা ! রণ বোঝাতে চাইত সমাজ না মানলেও আমিই আসলে রণ-র সব। বিশ্বাস করতে পারতাম না কিছুতেই। বিয়ের আগে কোনও একদিন মজা করে রণ সিঁদুর পড়িয়ে দেখতে চেয়েছিল আমায় কেমন লাগে। এ মজায় সেদিন সাধ দিইনি। ঠাসিয়ে একটা চড় মেরে বলেছিলাম," আমি তো তথাকথিত বৌ হতে পারব না তবে কেন এ প্রহসন ! " অথচ মনে মনে কতবার নিজেকে সিঁদুর পড়ে দেখতে চেয়েছি সে তো কেবল আমিই জানি। আজন্ম লালিত সংস্কারের সিঁদুর আসলে যে মর্যাদার পরিচয় বহন করে সে মর্যাদা পেতে চেয়েছিলাম মনে মনেই... ... ...
দেশভাগের ঠিক মাস দুয়েক আগে মেয়েটির জন্ম অবিভক্ত বাংলার অবিভক্ত রাজশাহীর শহরে। মেয়েটি যখন পৃথিবীর প্রথম আলো বাতাসে হাত পা মেলে, তখন সেখানকার আকাশ বাতাস, একদিকে যেমন দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণার আশঙ্কায় কুঁকড়ে উঠছে, তেমনি আরেকদিকে কৃষক আন্দোলনের এক সর্বোচ্চ পর্যায়কে বুকে ধারণ করে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। ... ...
১১ই মার্চ ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ কোভিড-১৯কে অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করলো, আর ঠিক দু’ দিন পর, ১৩ই মার্চ আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রক বললেন, কোভিড-১৯ ‘জরুরি স্বাস্থ্যাবস্থা’ নয়। অবশেষে, ১৯শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। তাঁর সরকার এই সঙ্কটমুহূর্তে কী করতে চলেছে – সে নিয়ে কিছুই খোলসা করলেন না, কিন্তু মানুষদের বললেন বারান্দায় বেরিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে, থালা, বাসন পিটিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের স্যালুট জানাতে। ... ...
ছাতের কামরার সামনে টিনের শেড, টিনের নীচে রংগনাথ, ওর নীচে খাটিয়া। বেলা দশটা, এখন শুনুন আবহাওয়ার খবর।কাল রাত্তিরে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, এখন কেটে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বিগত দিনে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, এখন সেসব পরিষ্কার হয়ে যেতেই পৌষের শীতের কামড় টের পাওয়া যাচ্ছে। বাজারের নব্বই প্রতিশত মিষ্টি যেমন দেখতেই ভাল, খেতে নয়, তেমনই রোদ্দূরও পিঠে লাগানোর ছেয়ে দেখেই বেশি আরাম।রোদ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখলে মনে হচ্ছে শুধু নীমগাছের মাথাতেই আটকে রয়েছে। ... ...
নিজেকে নিয়ে তখন হাজার রকম প্রশ্ন আমার। মনে মনে সেদিনও জানতাম ছেলে হয়েও আর একটা ছেলেকে ভালবাসা অন্যায় নয়।তবুও বুঝতে পারিনা, কি করব। কি করা উচিত? এসব ভাবতে ভাবতে একদিন মনে হল "কাউন্সেল ক্লাব" এ ফোন করলে হয়। এই সংস্হা তখন কোলকাতায় সমকামী মানুষদের নিয়ে কাজ করছে জানতাম । কাউন্সেল ক্লাবের কথা শুনেছিলাম ‘তারাবাংলায়’ রঞ্জনের সমকামিতার ওপর সাক্ষাতকার শুনতে শুনতে। তারও পরে আমার কলেজ যাতায়াতসুত্রে হয়ে ওঠা বিভিন্ন বন্ধু দের সুত্রে তখন হাতে এসেছে " বোম্বে দোস্ত", "নয়া প্রবর্ত্তক" পত্রিকা। সমকামিতা নিয়ে কিছু তথ্য পেলেও আমার প্রশ্নের উত্তর সেখানে মেলেনি। একদিন ফোন করলাম কাউন্সেল ক্লাবের হেল্পলাইনে... ... ...
আজ হঠাৎ কী মনে করে বিলু ঠিক করল আজ সে গণেশ গুহ হয়েই ফোনের উত্তর দেবে। ফোন তুলে বলল, বলুন। উল্টোদিক থেকে সেই চেনা গলা ভেসে আসে, “গণেশ গুহ বলছেন?” “বলছি”, বিলু উত্তর দেয়। মহিলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলেন, “ গণেশ বাবু, আমার বন্ধু সমরেশের কাছে আপনার কাজের প্রশংসা শুনেছি। ও একবার আপনার সাহায্য নিয়েছিল। আমিও একটা খুন করাতে চাই। আপনার যা রেট তাই দেব”। কথাটা শুনে বিলু খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে ফোন নিয়ে, কী বলবে বুঝতে না পেরে। ফোনের ওদিক থেকে “হ্যালো, গণেশবাবু, হ্যালো…” ভেসে আসতে থাকে। ... ...
আব্বাকে নিয়ে একলা থাকার সময়টা আব্বা অসুস্থ হয়ে থাকার পুরো তিন বছর দশ মাস সময়ের মধ্যে অন্যতম সেরা সময় ছিল আমার। বারান্দায় বসায় দিতাম। উনি নানান দিক নির্দেশনা দিতেন আমাকে, ওই গাছের গোরায় একটু পানি দেও, এইখানে একটু পানি দেও, পাখিরা খাবে, গোসল করবে! আমি বলতাম, আল্লার দুনিয়ায় পাখির গোসলের জায়গার অভাব? আমি এইখানে পানি না দিলে গোসল হব না পাখির? উনি বলতেন হব, তবে তাতে তোমার কোন অবদান থাকব না, এই যা! আমি পানি দিতাম। আরেকদিন মাটির নিচে কি জানি একটা মাথা উঁচু করে রয়েছে, ওইটা উনার চোখে পড়ছে। ওইটা কী? আমি কী জানি ওইটা কী? বললাম আমি। কিন্তু কাজ হল না, ওইটা তুলে আনো! হুকুম হয়ে গেছে, তুলে না এনে গতি নাই। তুলে আনলাম, কী জানি একটা আবর্জনা জাতীয় কিছু ছিল। উনি হতাশ হয়ে বললেন, ধুর! আমি ভাবছি অন্য কিছু! লেবু গাছটা মরে গেল কেন এই চিন্তা সম্ভবত মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত করে গেছেন। কেউ না বলে চুরি করে লেবু নিছে বুঝছ? এই জন্য লেবু ধরা বন্ধ হয়ে গেছে! আমি এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিলাম। চুরি করলে লেবু গাছ মাইন্ড করে নাকি? উনি হা হা করে হাসি দিয়ে বললেন, তুমি বুঝবা এগুলা, দেও, পিঠটা একটু চুলকায় দেও! ... ...