বরযাত্রীরা হিন্দুদের বিয়েতে ছাদনাতলাতেই খেতেন। মাথায় শামিয়ানা টাঙানো হতো। চারদিক সমান মাথা। সেখানে। গ্রামের মানুষদের বাড়ির দাওয়া বা আঙিনায়। কেউ কেউ গোয়াল ঘর পরিষ্কার করেও খাওয়াতেন। হিন্দু মুসলমান আলাদা বসানোর রীতি তেমন ছিল না, কিন্তু জাতপাত মানা হতে দেখেছি। শ্রাদ্ধ বাড়িতে বামুন তো আগে খেতোই, বিয়ে বাড়িতে শেষে খেতে দেওয়া হতো তফশিলি জাতির মানুষদের। বিশেষ করে বাগদি মুচিদের। আমাদের গ্রামের প্রশান্ত মজুমদার নামে ব্রাহ্মণ সন্তানের বিয়েতে এই ভেদ উঠে যায়। ... ...
স্নানের আগে মাথায় ঢালা হবে তেল। সর্ষের তেল। একটা ছোট নোড়া দিয়ে গড়িয়ে সেই তেল পড়বে সিঁথিতে সেখানে ঠেকানো থাকে পান পাতা। সেই পাতা দিয়ে তেল পড়বে কুলোয়। কুলোয় রাখা থাকে চাল আর বিউলির ডাল। বর বা কনে তেল দিয়ে তা মাখাতে হয়। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েই এই রীতি। গায়ে হলুদের আগে হিন্দু মুসলিম দুই বাড়িতে বর বা কনে পক্ষ থেকে তত্ত্ব আসে। তত্ত্ব নিয়ে আসা লোক হয় ধুরন্ধর। আসলে গোয়েন্দাও। বুঝে নিয়ে যায় আসল হালচাল। বন্দোবস্ত। নাপিতদের পাঠানো হতো বেশিরভাগ জায়গায়। মুসলমানদের বেলায় হাজাম। রঙ্গ রসিকতায় চাপান উতোরে এই লগ্নযাত্রীরা মাত করে দিতেন। বিকেল হলে মেয়ে বঊদের দল আসতো লগন দেখতে। কী কী দিয়েছে--কী কী দেয়নি তার বিদেন বা টীকা ও ব্যাখ্যান চলতো। ... ...
শালপ্রাংশু চেহারার নানাজি এসে আমার ছোট্ট খাট্টো চেহারার নানিকে এসে বহু ডাকলেন, সম্মান থাকবে না। এমন করো না, সালমা। চিরকাল বলেন অমুকের মা। মানে বড়মেয়ের মা বলে ডাকেন। আজ স্ত্রীকে সন্তান হওয়ার আগের ডাকে ডাকলেন। দরজা ঈষৎ ফাঁক করে সালমা উত্তর দিলেন, ওঁদের ভালো করে খাইয়ে ফেরৎ পাঠাও। ওই ছেলের সঙ্গে আমার সোনার মেয়ের বিয়ে দেবুনি। অনড় স্ত্রী। কন্যা। বড় আদরের মেয়ে। সুন্দরী। বিদূষী। ভালো ছড়া লেখে। এমন মেয়েকে ওই পাত্রের হাতে দিতে তাঁরও মন চায় না। দেখতে কালো। কিন্তু পয়সা আছে। পড়ালেখা জানে। ভালো পরিবার। কিন্তু মা মেয়ে অনড়। ... ...
আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবার প্রধান আনন্দ ছিল মাঘ মাসের ওলাইচণ্ডী পূজার মেলায়। দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা আছে-- আছে ইদ বকরিদ মহরম--- কিন্তু মাঘ মাসের মেলাই আসল মিলবার জায়গা। সেটা হলেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ। আত্মীয় স্বজন কুটুম আসার এই তো আসল সময়। দুর্গাপূজার সময় অনেকের ঘরেই অভাব। ইদ বকরিদ ধান ঝাড়ার সময় কবার আর হয়? পৌষ মাসে ধান কাটা শেষ। মাঘ মাসের ১৯ তারিখ মেলা। হাতে পয়সাও ম্যালা। ফলে আনন্দের অর্থই আলাদা। কাঠের নাগরদোলা, পাঁপড় চপ বেগুনি পেঁয়াজি ঘুগনি, জিভে গজা পান্তুয়া লেডিকেনির দোকান বসে মেলায়। দুর্গাপূজা বা ইদে তো সেসব অনুপস্থিত। বাঁশি কেনা, ঘড়ি কেনা, টিকটক কেনা, লাট্টু কেনা, রঙিন চশমা-- সেতো ইদ বকরিদ দুর্গাপূজায় সবার সম্ভব নয়। ... ...
একদিন রয়টারে খবর এলো (মে ১৯৮৯) - ম্যাকডোনালডকে বেজিঙ্গে দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে আমাদের অর্থলগ্নির কোন সুযোগ নেই। এ সামান্য টাকা তাদের শিকাগো অফিস দেবে। শোনা গেলো অনুমতি পেতে বছর খানেক সময় লেগেছে (দোকান খুলতে আরও ছ মাস)। পরের মাসে এই খবরকে ছাপিয়ে গেলো একটি আশ্চর্য ছবি – একটা গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে একজন একটি ট্যাঙ্কের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে – স্থান তিয়ানানমেন স্কোয়ার (স্বর্গীয় শান্তির দ্বার)। তারপরে আর কোন খবর নেই টেলিভিশনে। ... ...
আমরা কি অপরাধী? এমনটা গোয়েন্দা সিনেমাতে দেখেছি। যন্ত্রের মত মানুষেরা এসে মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। কোনো কথা নেই। পাখিরা ডাকে না সেখানে। আকাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মত। ষোল বছর বয়েসে সন্ধেবেলা বিনা বাতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে বরানগরের স্কুল থেকে পাইকপাড়া ফেরার পথে চিড়িয়া মোড়ে পুলিশ আমাকে ধরে। অতি স্নেহের সঙ্গে, “এ ববুয়া, বতিয়া বিনা সাইকিল চলাতে হো?” – এই বলে সাইকেলটি বাজেয়াপ্ত করে থানায় জমা করে। সেটি যে থানার জিম্মায় রইল, সেই মর্মে স্বাক্ষরিত একটি চিরকুট হাতে নিয়ে দমদম রোড ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরি। পরের দিন শিয়ালদা কোর্টে দশ টাকা জরিমানা দিয়ে সাইকেল ফেরত পেয়েছি। সে পুলিশকে দেখে ভয় হয়নি। এখানে হল। কোনো অপরাধ না করেও। চিড়িয়া মোড় থানার পুলিশের মুখটা মানুষের বলে মনে হয়েছিল। ... ...
ডানজিগে জার্মান অধিবাসনের ইতিহাস হাজার বছরের বেশি পুরোনো। হের রিখটারের পূর্বপুরুষ ছিলেন সেখানকার বাসিন্দা। ১৯৪৫ সালে ছিন্নমূল রিখটার পরিবার কিশোর মাক্সিমিলিয়ানকে নিয়ে হেঁটে জার্মানি এসেছেন। মাক্সিমিলিয়ান কখনো ফিরে যাননি ডানজিগে। লৌহ যবনিকার সময় সেটা শক্ত ছিল। হের রিখটার ডানজিগকে ভুলেই গিয়েছিলেন বা মনে রাখতে চাননি। ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড সামলানোর ব্যাপারে আমার দক্ষতার অভাবে তাঁর একটা সূত্র যোগ হয়ে গেল ডানজিগের সঙ্গে। আমাদের সংক্ষিপ্ত সংলাপের পরে তাঁর মন নিশ্চয় চলে গিয়েছিল ডানজিগের অলিতে গলিতে। ঠিক যেভাবে আজ এপার বাংলার অনেক অশীতিপর মানুষের মন চলে যায় বিক্রমপুরের গ্রামে। ... ...
ধীরে ধীরে পোল্যান্ডের জার্মান বিদ্বেষ কমতে থাকে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি উষ্মা এবং তার প্রকাশ বৃদ্ধি পায়।সাতের দশকে উইলি ব্রান্ডের পশ্চিম জার্মান সরকার ওডার / নাইসে নদীকে পোল্যান্ডের সীমানা বলে মেনে নিলেন। রিয়াল পলিটিক শুরু । তারপর একদিন চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড এলেন ওয়ারশ ঘেটোর স্মারক বেদি দর্শনে। । ১৯৪৪ সালে ৬৩ দিন ধরে এই ঘেটোর ইহুদিরা লড়েছিলেন মহা পরাক্রান্ত জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে এক নিতান্ত অসম লড়াই । সেই সময় রাশিয়ান লাল ফৌজ সহজেই ওয়ারশ ঢুকে শহরের দখল নিতে পারতেন। করেন নি । ভিসতুলা নদীর অপর পারে সমবেত হয়ে ভদকা সহযোগে এই হত্যাকাণ্ড উপভোগ করছিলেন শুনেছিলেন আহতের আর্ত চিৎকার। আজকের ওয়ারশর পুরনো শহরের দেওয়ালে দাঁড়িয়ে নদীর পানে তাকালে সেটা সহজেই কল্পনা করে নেওয়া যায়। সাত হাজার ইহুদি প্রাণ হারালেন। জার্মানরা সেই প্রতিরোধ শেষ করে দিলে নদী পার হয়ে লাল ফৌজ বিজয়ীর বেশে নিরঙ্কুশ ভাবে ওয়ারশ প্রবেশ করে জার্মানদের পিটিয়ে মারলেন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। ... ...
তিরিশ বছর আগে দু দিনের পরিচয়ে হলুদ, ধূলি ধূসরিত ওয়ারশ দেখেছি । রাস্তায় রাশিয়ান লাদা কিছু ট্রাবান্ত গাড়ি। তাদের কেশে যাওয়া ধোঁয়াতে উৎকট গন্ধ - সেগুলো টু স্ট্রোক এঞ্জিনের মোটর। যুদ্ধে আশি শতাংশ ওয়ারশ বিচূর্ণ হয়। সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ কিছু হয়েছে তবে দেওয়ালে অনেকদিন চুনকাম হয়নি। সেনাটোরস্কা ১৬ নম্বরে আমাদের অফিস । জাতীয় থিয়েটারের প্রায় উলটো দিকে। সে বাড়িও পঞ্চাশ বছর রঙ চুন দেখেনি। রাস্তা থেকে একটা গেট দিয়ে যেন কারো উঠোন পেরিয়ে দোতলায় অফিসে ঢোকা। ঝাকশেভো থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে। সেই যে বেয়াতা, সন্ধ্যেবেলা একাকী ভারতীয়কে প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেখে সন্দিহান হয়েছিলেন, তিনি অ্যালানের খাস সেক্রেটারি। বেয়াতা মিটিং রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। কর্পোরেট ব্যাঙ্ক আর ব্যাঙ্কিং সম্পর্ক বিভাগ নিয়ে কুল্লে পনেরো জন এলেন আমার বাণী শুনতে । ... ...
কিঞ্চিৎ অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে কাঁটাকলে অর্থনীতি পড়ার সময় বাড়িতে দু জনকে পণ্ডিতি টোলের ধরনে পঠন পাঠন করিয়েছি। এখন পঁচিশ জন প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র ছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে কোন কায়দায় বিদ্যা বিতরণ করব? টেবিলে গাদা খানেক প্লাস্টিক অ্যাসিটেট। প্রজেক্টরে এক নম্বর স্লাইড গুঁজে বেয়াতে আলোক সম্পাতের জন্য প্রস্তুত। কেবল আমার ইঙ্গিতের অপেক্ষা। গুরু বাক্যি স্মরণ করে জেনে নিলাম কে কোন ব্যাঙ্কের কোন বিভাগে কতদিন কাজ করেছেন। প্রশ্নোত্তরের সুযোগে তাদের কথিত ইংরেজি বিদ্যার পরিচয় পাওয়া গেল। সিঁথি বরানগরে লালিত আমার ইংরেজি উচ্চারণ তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে কিনা সে হদিশ নেওয়াটাও জরুরি ছিল। নিজের ব্যবসার তরিকা অন্যকে বোঝাতে হয় নি।কাঁটাকলের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্টেট ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে কাজ শিখেছি কাজ করে, ক্লাস রুমে বক্তৃতা শুনে নয়। পাতাটি ছিল সাদা। টাবুলা রোজা। কাগজে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে! ... ...
সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে, একটি অখ্যাত গ্রামে ব্যাঙ্কিং শিক্ষাদানের সুযোগে, আমার যে শুধু পোল্যান্ড-সহ লৌহ-যবনিকার আড়ালে ঢাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল, তা-ই নয়, অ্যালান হার্স্টের মত এক অসাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দেবার আগে তিনি আমেরিকার ডেমোক্রাট দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হোয়াটসঅ্যাপ এবং আই টি সেল নামক আধুনিক জনসংযোগের তুখোড় মাধ্যম ভোটারদের তখনও অজানা। পার্টির ইস্তাহার, ম্যানিফেস্টো এবং বক্তৃতার ড্রাফট লিখতেন লেখাপড়া জানা ভদ্র মানুষজন। গুজব শুনেছি, উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন নামক এক যুবকের নির্বাচনী ভাষণের খসড়া করেছেন অ্যালান। বত্রিশ বছর বয়েসে ক্লিনটন লিটল রক, আরকানসাসের (মতান্তরে আরকানস’) রাজ্যপালের অফিসে অধিষ্ঠিত হলে, আপন রাজনৈতিক কর্তব্য সমাপ্ত হয়েছে মনে করে অ্যালান ব্যাঙ্কিং-এ এলেন। সিটি ব্যাঙ্কে সিকি-শতাব্দী কর্ম করেন, মুখ্যত উন্নয়নশীল পূর্ব ইউরোপে। ... ...
বিগত উনিশটি কিস্তিতে বর্ণিত রসিকতার বেশির ভাগ বক্তা, নায়ক বা খলনায়কের নাম আমাদের অচেনা। কোন গল্পটা কে যে কাকে বলল তা কারো জানা নেই। সবটাই মুখে মুখে প্রচলিত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ঘরানার মতো। তার ওপর কখনো রঙ চড়ানো হয়েছে, স্থান কাল পাত্র বদলে গেছে। সঠিক ফ্যাক্ট চেকিঙ্গের কোন উপায় নেই। তাতে অবিশ্যি স্বাদের কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হয় নি। কৌতুকের কোন তকমা লাগে না। ... ...
বাঁকুড়া, বরিশাল হোক আর বার্লিন কি বের্ণ হোক, ভাষা বা শব্দ ব্যবহারের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সেই জনগণের ওপরে বর্তায় না। অস্ট্রিয়ান পাবকে বলে বাইসল। জার্মান তাকে চেনে সম্পূর্ণ অন্য নামে ( Kneipe) । আজকের ফরাসি ভাষায় উইক এন্ড বা বিজনেস অনায়াসে ঢুকে পড়েছে (বিশ বছর আগে একজন ফরাসি সি ই ও তাঁর বক্তৃতায় বিজনেস শব্দ ব্যবহার করায় ক্রুদ্ধ রাষ্ট্রপতি শাক শিরাক দ্রুতবেগে সে সভাস্থল পরিত্যাগ করেন)। জর্জ বারনারড শ বলেছিলেন ব্রিটেন এবং আমেরিকা এই দুটি দেশ একই ভাষার দ্বারা বিভক্ত (টু কান্ট্রিস ডিভাইডেড বাই এ কমন ল্যাঙ্গুয়েজ) । এই বিভাজনের ব্যাখ্যা আমেরিকার অভিবাসনের ইতিহাসে নিহিত। ১৫২০ সালে মে ফ্লাওয়ার জাহাজ যাদের নিয়ে আমেরিকার পূর্ব তটে পৌঁছুল, তাঁরা সবাই ইটন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করে থাকলেও মোটামুটি ইংরেজি বলতেন। পরের কয়েকশ বছর ইউরোপ থেকে যারা এলেন তাঁদের মধ্যে কেবল আইরিশদের মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি (কেন যে আমেরিকার কথিত ইংরেজি আইরিশ উচ্চারণের উপর আধারিত হল জানি না। এঁদের বৃহত্তর দলটি আসতে শুরু করেন দেরীতে, আলু দুর্ভিক্ষের পরে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি)। ... ...
হাজার বছর ধরে ইহুদি পেটানো, পোড়ানো এবং খ্যাদানো এক জনপ্রিয় ক্রীড়ায় পরিণত হয়েছে। যিশু খ্রিস্টকে ক্রুসে চড়ানোর অপরাধের কলঙ্ক ইহুদিদের মাথায় লাগানো রইল। তার ওপরে ইউরোপের গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় কেউ রটিয়ে দিলো ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশুর রক্ত দিয়ে তাদের পুজো আচ্চা করছে (ব্লাড লাইবেল) অথবা তারাই ভয়ঙ্কর প্লেগের (ব্ল্যাক ডেথ) কারণ। আম জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি সোঁটা নিয়ে ইহুদি হত্যায় লেগে গেলো। খুন কা বদলা খুন। নাৎসিরা কোনমতেই এই খেলাটির পেটেন্ট দাবি করতে পারে না। বরং ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মত আরেকটি নতুন ক্রীড়া উদ্ভাবনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ইংল্যান্ডের প্রাপ্য। জাতি ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করে কি ভাবে একটা গোটা টিমকে রেড কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করা যায় সে খেলা দেখাল ইংরেজ। সিনাগগ বন্ধ হয়েছে, আত্ম পরিচিতির জন্য ইহুদিদের বিশেষ ব্যাজ পরা আবশ্যক (সাড়ে ছশো বছর বাদে নাৎসিরা এঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে)। ... ...
এই বক্তিয়াররা আরেকটি কাজ খুঁজে পেলেন। দেখা গেলো রাজা বা আমলাদের সামনে সকল নাগরিক নিজেদের কেস ঠিক ভাবে উপস্থিত করতে পারছেন না। বাদী বা বিবাদী তো আর্ট অফ পাবলিক স্পিকিং শেখেন নি। আন্তিফন নামক গরগিয়াসের এক চেলা পরামর্শ দিলেন দুই বিবদমান পক্ষের প্রয়োজন এমন একজন মানুষের যিনি মোটামুটি লেখাপড়া জানেন এবং আদালতে দাঁড়িয়ে কোন পক্ষের যথাযথ বয়ান দিতে পারেন।এই মানুষটি হবেন একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু মাত্র যাঁদের কাজ অশিক্ষিত বাদী বিবাদীদের সহায়তা করা। অন্য অর্থে বলা যেতে পারে ইতস্তত ভ্রমণরত বাগ্মীরা একটা কাজের কাজ খুঁজে পেলেন! গ্রিকরা সেটি মেনে নিলেন কিন্তু সাব্যস্ত হলো মামলায় এই সহায়তার জন্য কোন পারিশ্রমিক দেওয়া বা নেওয়া চলবে না। বন্ধু রূপে যদি তাঁরা বিচারকের সামনে অবতীর্ণ হন, টাকা পয়সার প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে। মামলা জিতে কোন পক্ষ যদি সেই বক্তাকে আগোরার কোন শুঁড়ি খানায় দু পাত্তর সুরা পান করায় সেটাকে অবশ্য উকিলের ফি বলে ধরা হবে না। ... ...
রাশিয়াতে তখন বাস করেন ছ লক্ষের বেশি ইহুদি। ইজরায়েল চাইল তাঁদেরও আপন দেশে ফেরাতে। রাশিয়ান সরকার জানালেন কোন ইহুদি যদি স্বেচ্ছায় এই সাম্যবাদী সমাজ ত্যাগ করে ইজরায়েলে যেতে চান, সোভিয়েত ইউনিয়ন সে আবেদন অবশ্যই সযত্নে বিবেচনা করবে। তবে তাদের ভরন পোষণ বাবদ যে ব্যয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এযাবৎ বহন করেছে তার একটা অংশ বিদেশি মুদ্রায় দিলে এই নির্গমনের অনুমতি সহজলভ্য হতে পারে। কৃষক শ্রমিকের স্বর্গরাজ্য থেকে বিদায় নেওয়ার মাথা পিছু দক্ষিণা কি ভাবে নির্ণীত হত তা জানা শক্ত। ... ...
মল্লিকবাজার মোড়ে প্রথমে অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায়, পরে বাচ্চা কোলে ভিক্ষা করত যে মেয়েটি, মেয়ো রোডের ছেলেটিরই বয়সি সে। কিশোরীর ওই পরিণতি কে করল? কেনই বা সে ওই বয়সে বাড়ি ছাড়া? জানা হয়নি। ফুটপাথে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে শিশুর সারল্যে কিশোরী মায়ের সন্তানের সঙ্গে খেলা, মাতৃস্নেহে শিশুর যত্নআত্তি করার দৃশ্য যানজটে আটকে থাকা গাড়ির আরোহী, পথচলতি মানুষের চোখ টানত। প্রেস স্টিকার সাঁটা গাড়ির আরোহীর মনে প্রশ্ন তোলপাড় করে দিয়ে যেত, এই কিশোরী মা মৌলালির সেই নাবালিকা নয়তো? ... ...
অন্যদিকে ফ্রান্সের পুরনো ইহুদি বিদ্বেষ তার কণ্ঠ খুঁজে পেলো। কট্টর জাতীয়তাবাদী ফরাসিরা জেগে উঠলেন - ইহুদিদের জন্য ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা, ফরাসি সভ্যতা বিপন্ন । সে ক্রোধ এমনি রুদ্র রূপ নিয়েছিল যে এমিল জোলা আনাতোল ফ্রাঁসের মত মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি । একশোর বেশি জেলায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ , তাদের সম্পত্তির বিনাশ চলল -পুলিস নির্বাক দর্শক মাত্র ( হিটলারের বয়েস তখন ন বছর , গোয়েরিঙের ছয় : আইখমানের জন্মাতে আট বছর দেরি আছে )। কোন প্রমাণ ছাড়াই পুনর্বিচারে দ্রাইফুসের সাজা আরও দশ বছর বাড়ানো হল । তাঁকে জানানো হল তিনি মুক্তি পাবেন যদি অপরাধ স্বীকার করেন। পাঁচ বছর ডেভিলস আইল্যান্ডের কঠোর জীবনে ক্লান্ত দ্রাইফুস তাতেই সই করে মুক্ত হলেন ( ডাসটিন হফমান অভিনীত পাপিলন ছবিতে ডেভিলস আইল্যান্ড চিত্রায়িত হয়েছে)। সামরিক বাহিনীতে পুনর্বাসন হল দ্রাইফুসের। তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। । ... ...
আমরা তো কাজ করতাম কোম্পানি থেকে দূরে। জঙ্গল পাহাড়ের ভিতর। ওইসব কোম্পানির ব্যাপার। কোম্পানি বডি নিয়ে কি করবে, বডি পাঠাবে কিনা, সেসব খবর আমাদের কাছে আসত না। কে খবর দেবে! আমরা তো বোরিং করার জন্য ঘুরছি। শ্মশান মশান কোনও বাছাবাছি নেই। গু মুত যা থাক! যেইখানে বোরিং করে বোম ফাটিয়ে তেল আছে জানতে পারবে আমাদের সেইখানেই থাকতে হবে। কোম্পানির লোক যেখানে থাকতে হবে বলেছে, সেইখানে একটু পরিষ্কার করে জঙ্গল কেটে সাপ কোপ মেরে তাম্বু টানিয়ে থেকে গেছি। দু হাজার কুড়ির বাইশে মার্চ ওরা শ্মশানে জঙ্গলে পাহাড়ের ঠিক কোন খাঁড়াইতে ছিল সে জায়গার নাম ওদের জানা হয়নি। ওই জঙ্গল পাহাড় থেকে দূরে টি ভি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা গেল। ঘোষণা হল লকডাউন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, যে যেখানে আছেন সে সেখানেই থাকুন। খবর হল সারা দেশের ট্রেন বাস বর্ডার সবকিছু বন্ধ হল একুশ দিনের জন্য। ... ...
জুলাই ও নভেম্বর ১৯৩২ পর পর দু বার নির্বাচন হয়। কোন দল সরকার গঠন করতে পারে না। জানুয়ারি ১৯৩৩ আবার নির্বাচন। কোন দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে নি (নাৎসিরা পায় ৩৩% ভোট) । ভোট ক্লান্ত জনগণকে রেহাই দেবার জন্য ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হিনডেনবুরগ হিটলারকে কোন রকমে একটা জোড়া তালি দিয়ে সরকার গঠনের অনুমতি দিলেন। ক্ষমতা দখল করেই মার্চে আবার নির্বাচন ডাকলেন হিটলার। ক্রুপ থুসেন সহ যাবতীয় শিল্পপতিরা তাদের কোষাগার খুলে দিলেন – প্লেনে চড়ে এই প্রথম কোন রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনী প্রচার করলেন। বিপুল অর্থ ব্যয় করেও সংখ্যা গরিষ্ঠ হল না নাৎসি পার্টি -তারা পেলো ৪৩% ভোট। জার্মান জাতীয় দলের সঙ্গে একত্রে হিটলার আবার সরকার গঠন করলেন। দু মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের দরোজা বন্ধ হল। সে দরোজা আবার খুলবে দেড় দশক বাদে। ... ...