মধ্য আফ্রিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপজাতি হল ন্যামওয়েজিরা। আমার কাছে একজন ন্যামওয়েজির সৌন্দর্যের আদর্শ হল একজন লম্বা দীর্ঘপদ কালো মানুষ, ভালো মানুষের মতন সদা হাসিভরা মুখ, হাসির ফাঁকে দাঁতের উপরের সারির মাঝখানে একটা ছোট গর্ত দৃশ্যমান। সে যখন বালকমাত্র, তখন তার গোত্র বোঝাতে এই গর্তটা তৈরি করা হয়েছিল। তার গলার থেকে শত শত লম্বা তারের ঝুমকো ঝুলছে; মানুষটা প্রায় নগ্ন হওয়ায় তার গোটা সুন্দর শরীরটা দেখতে কোন অসুবিধা নেই। ... ...
উকাওয়েন্দি জায়গাটা দেখা গেল প্রায় জনবসতিহীন। এবড়োখেবড়ো জমি, জঙ্গলে ভরা, অগণিত সূক্ষ্ম জলধারা-জালিকা অঞ্চলের সব জল বয়ে নিয়ে যায়। উর্বর, অজস্র প্রাণী ও উদ্ভিদের ভরা একটা অনুকূল ক্ষেত্র। জন বসতিগুলোর মধ্যে তবু উল্লেখ যোগ্য উত্তরের মানা মেসেঙ্গে বা টাঙ্গানিকার ধারে, পশ্চিম দিকের এনগোন্ডো এবং টংওয়ে; মাঝখানের রুসাওয়া; দক্ষিণে পামবুরু ও দক্ষিণ-পূর্বে উটান্ডা। ... ...
এখানকার উপজাতিরা ধাতুর মধ্যে চেনে বলতে তামা আর লোহা। তামা আসে রুয়া থেকে, আর উপকূলের থেকে। আর রট আয়রন আসে উসুকুমা বা উন্যামওয়েজির উত্তরের এলাকা থেকে, ও উভিরা থেকে। আফ্রিকার অন্দরের বাসিন্দারা যে সমস্ত পিতলের অলঙ্কার পরে, কাফেলাগুলোর সঙ্গে আনা মোটা পিতলের তার থেকে স্থানীয়রা সেই সব গয়না তৈরি করে। যদিও লৌহ আকর প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, এমনকি উন্যামওয়েজি ও উজিজির মধ্যে অনেক জায়গায় মাটির উপরে দেখাও যায়-তবুও তা খুব কমই কাজে লাগে; যদিও উকোনঙ্গো ও উভিনজাতে, স্থানীয়রা আকরিক লোহা গলিয়ে নিজেদের দরকারের লোহা তৈরি করে এমন উদাহরণ আছে। ... ...
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসছিল – এমন চিত্রকর্মের সলতে পাকানো পর্বটি কেমন ছিল এবং গুহার দেওয়ালে, পিলারে এবং ছাদে এমন মসৃণ চিত্রকর্ম কীভাবে সম্ভব হল? বিভিন্ন চিত্র গবেষণা থেকে যেটুকু জানা গেছে, তা হল মাটি-কাদার সঙ্গে গোবর ও তুষের গুঁড়োর মিশ্রনের প্রলেপ দিয়ে প্লাস্টার হত, তার ওপর চুণের আস্তরণ দিয়ে মসৃণ করে তার ওপর চিত্রিত হয়েছে সেইসব অমূল্য চিত্রাবলী। রং তৈরি হত মূলত বিভিন্ন লতাগুল্ম, গাছের রস, খনিজ পদার্থ, iron oxide, manganese di oxide এবং কাঠকয়লা। এইসব মিশ্রিত রং টেম্পারা পদ্ধতিতে চিত্রায়ণ হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, প্রায় ২ হাজার বছর ধরে সময়ের ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করে এখনও অনেকটা রয়ে গেছে। ... ...
প্রথমটা হল সিলুরে, জিজিরা যাকে সিংগা বলে। স্থানীয়দের কথা অনুসারে চার, এমনকি ছ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। আমি যেটার ছবি এঁকেছিলাম, সেটা সাড়ে আটত্রিশ ইঞ্চি লম্বা, ওজন দশ পাউন্ড, তবে কিনা এটা ছোট মাছ হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিল। অত্যন্ত চর্বিযুক্ত মাছ, পিঠের রং গাঢ়-বাদামী, আর পেটের দিকটা হালকা বাদামী, প্রায় সাদাই হয়ে যাওয়া। এই মাছ আঁশবিহীন। নদীতে হ্রদে যেরকমটা আমরা পেয়ে থাকি, এটা সেই রকমেরই। গোম্বে নদীতে শ’য়ে শ’য়ে এই মাছ ধরা হয়, কাটাকাটি করে শুকানো হয় আর আরব, আচারে-ব্যবহারে মুসলমান হয়ে যাওয়া নিগ্রো ও সোয়াহিলিদের কাছে বিক্রির জন্য উন্যানেয়েম্বেতে নিয়ে যাওয়া হয়। ... ...
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাং-এর বর্ণনায় এই গুহামালার উল্লেখ আছে। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রাসঙ্গিকতা ক্ষীণ হয়ে আসে, ফলে অজন্তার গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। ইসলামিক অভ্যুত্থানের পর এই শিল্পসম্পদ সম্পূর্ণ ঢেকে যায় গভীর জঙ্গলে এবং অনাদৃত পড়ে থাকে প্রায় ১১০০ বছর, ফলে গুহার ভেতরকার অমূল্য চিত্রমালার ক্ষতিসাধন শুরু হয় তখন থেকেই। গুপ্তধনের মত এই সম্পদের পুনরাবিষ্কার ঘটেছিল হঠাৎই, ১৮১৯ সালে এক ইংরেজ সামরিক ক্যাপ্টেন জন স্মিথ বাঘ শিকারের নেশায় পৌঁছে গেছিলেন গভীর জঙ্গলে ঢাকা অজন্তা গুহামালার উত্তরদিকের এক পাহাড়ের মাথায়। ওয়াঘুর নদীর অন্য পারে স্মিথ লক্ষ্য করলেন—জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট এক গুহার আভাস। উৎসাহী স্মিথ স্থানীয় এক কিশোরকে সঙ্গী করে চললেন গুহামুখের অন্বেষণে। নদীর অপর পারের দুর্গম জঙ্গলের অনেকটা পার হয়ে আবিষ্কার করলেন সেই অনাদৃত সম্পদ। ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এর খবর এবং ১৯৮৩-তে অজন্তা গুহামালা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেল। ... ...
কত রকমের যে ঝাউ আর বাবলা পাওয়া যায় সে একেবারে দেখার মত, একটু খানি জায়গা পেলেই হল। বাবলা গাছ তো সর্বত্র আর এমন ভাবে তারা ডালপালা ছড়ায় যে কাফেলাগুলোর জন্য তারা ভারি যন্ত্রণার! কাঁটাগাছ ও গঁদের গাছগুলো অভিযাত্রীদের জন্য সবচেয়ে ঝামেলার। কাঁটাগাছের প্রজাতিগুলো সমস্ত রকমের মারাত্মক কাঁটায় ভরা! আমার দোভাষী সেলিম একদিন আমাশায় কাতর হয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল, তার ঘাড়ের একেবারে শিরার খুব কাছে বাবলার কাঁটায় এমন বিচ্ছিরি ভাবে কেটে যায় যে সেই দাগ তার মৃত্যুদিন অবধি রয়ে যাবে। ... ...
উন্যামওয়েজিতে মাত্র দুটি জলধারাই নদী নামের যোগ্য। সেগুলো হল উত্তর ও দক্ষিণ গোম্বে। উত্তরের নদীটা কোয়ালা নামে পরিচিত। কখনও কখনও একে ওয়াল্লাও বলা হয়। কুবুগার দক্ষিণে এর উৎসমুখ। উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি বাঁক ঘুরে তাবোরার উত্তরে গোম্বেতে গিয়ে ঢোকে। এখানেও এটা বেশ বড় মাপের, গুরুত্বপূর্ণ একটা নদী। বর্ষার শেষদিকে ভালো হালকা নৌবহর নিয়ে, একজন খুব সহজেই - তাবোরা থেকে আট মাইল বা তারও বেশি দূরের থেকে দলবল নিয়ে নৌকা চেপে সানন্দে টাঙ্গানিকা হ্রদ অবধি ভেসে যেতে পারে; অবশ্যই, যদি সমস্ত উপজাতির লোকেরা ইচ্ছুক হয়। একটা সঠিকভাবে প্রস্তুত অভিযান এইরকমভাবে বিস্ময়কর কাজ করতে পারে। ... ...
ক্যাপ্টেন বার্টন বলেছেন যে মিঃ ডেসবোরো কুলি মনে করতেন উন্যামওয়েজি শব্দের অর্থ হিসেবে 'বিশ্বের প্রভু' শব্দটাই বেশি যোগ্য। তাঁর মতে, এর বানান অবশ্য 'মোনোমোইজি'। ক্যাপ্টেন বার্টনের কথার চেয়ে আমার নিজের মিঃ কুলির ব্যাখ্যা বেশি পছন্দ, তবুও আমার ধারণা মিঃ কুলির বক্তব্যের থেকেও আলাদা। ন্যামওয়েজিদের থেকে যতদূর যা জানতে পেরেছি, সেই সঙ্গে এদেশের লোকগাথার থেকে আরবরাও যা শিখেছে, সেটা এইরকম। ... ...
সবচেয়ে বড় দ্বীপের মাথাটা মাপ নেওয়ার জন্য সুপ্রশস্ত। আমরাও সুযোগের সদব্যবহার করলাম - এখান থেকে লম্বা-চওড়া হ্রদ ও তাকে ঘিরে থাকা সুউচ্চ পর্বতমালাটি ভালভাবে দেখা যাচ্ছিল। এখান থেকে উত্তর-ঈশান কোণে রামাতা পাহাড় - সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অগ্নি কোণ আর দক্ষিণ অগ্নিকোণের মাঝবরাবর কাতাঙ্গা কেপ, সেন্টাকেয়ী পূর্ব-অগ্নি কোণে; পূর্ব আর পূর্ব-ঈশান কোণের মাঝখানে মাগালা; মুজিমুর দক্ষিণ-পশ্চিম বিন্দুটি দক্ষিণ দিক বরাবর, মুজিমু দ্বীপের উত্তর বিন্দুটি দক্ষিণ-অগ্নি দিকে। ... ...
একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট। আর আমার ধারণা ডাক্তারও তাই মনে করেন। স্যার স্যামুয়েল বেকারকে আলবার্ট এন'ইয়ানজার দৈর্ঘ্য অক্ষাংশ বরাবর ২° যদি বা নাও হয়, ১° কমাতেই হবে। এই বহু পরিচিত অভিযাত্রীটি হ্রদটিকে রুয়ান্ডাদের এলাকার অনেকটা বেশি ভিতরদিকে করে দেখিয়েছেন। আর রুয়ান্ডাকে দেখিয়েছেন তার পূর্ব দিকে। আসলে কিন্তু রুয়ান্ডার পুরোটা না হলেও একটা বড় অংশই হ্রদের উত্তরাংশ জুড়ে, তাঁর মানচিত্রে তিনি সেই জায়গাটাকে উসিগে বলে বর্ণনা করেছেন। ... ...
তার গ্রামে আস্তানা গাড়ার পরেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে রুহিঙ্গা এসেছিল। অতিশয় সহৃদয় লোক, সবসময়ই হেসে ওঠার কারণ খুঁজছে; সম্ভবত মুকাম্বার চেয়ে পাঁচ - ছ বছরের বড় - যদিও তার নিজের মতে তার একশ বছর বয়স - তবে সে তার ছোট ভাইয়ের মত অত সম্মানিত নয়, আর ভাইটিকে তার নিজের লোকেরা যেমন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, একে তত কিছু করে না। রুহিঙ্গা অবশ্য মুকাম্বার চেয়ে দেশের সম্পর্কে বেশি জানে। আর তুখোড় স্মৃতি শক্তি! খুব বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে তার দেশ সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল। সর্দার হিসাবে আমাদের যথাযথ সম্মানও দেখিয়েছিল - একটা ষাঁড়, একটা ভেড়া, দুধ আর মধু উপহার দিয়েছিল - আমরাও তার থেকে যতটা সম্ভব তথ্য বের করার চেষ্টা করতে পিছপা হইনি। রুহিঙ্গার থেকে যা জেনেছিলাম তার সংক্ষিপ্তসার অনেকটা এইরকম। ... ...
উজিজি থেকে রওনা হওয়ার নবম সকালে মুগেরের বিস্তৃত ব-দ্বীপ পেরিয়ে গেলাম। সূর্যোদয়ের প্রায় দু ঘণ্টা পরে। মুগেরে নদীর নামেই মুকাম্বা শাসিত পূর্ব দিকের এলাকার নাম। এর তিনটে মুখের দক্ষিণতমটির সামনে এসে দেখলাম জলের রঙটা বেশ আলাদা। নদীর মুখ থেকে পূর্ব-পশ্চিমে একটা প্রায় সোজা দাগ কাটলে দুপাশের জলের রঙের পার্থক্য বেশ চেনা যাবে। দাগের দক্ষিণ দিকে হালকা সবুজ বিশুদ্ধ জল, আর উত্তরে কাদাঘোলা জল, উত্তরমুখো স্রোত স্পষ্ট দেখা যায়। প্রথম মুখটি অতিক্রম করার পরপরই দ্বিতীয় মুখের কাছে পৌঁছলাম আর তারপরেই তিন নং মুখের কাছে এসে পড়লাম, সব কটাই মাত্র কয়েক গজ চওড়া, কিন্তু প্রতিটা স্রোতধারাই পর্যাপ্ত জল বয়ে আনছে । ফলে আমরা সংশ্লিষ্ট নদী মুখের থেকে অনেকটাই উত্তরে, জলের স্রোত বরাবর চললাম। ... ...
আশেপাশের সব জায়গার থেকে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু। মাগালা কেপের থেকে উত্তর দিকে, দুটো পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে হ্রদের জল বয়ে যাচ্ছে। এই পর্বতশ্রেণি দুটো আমাদের অবস্থানের প্রায় ত্রিশ মাইল উত্তরের একটি বিন্দুতে এসে মিলেছে। মাগালার রুন্ডিরা খুবই সভ্য ভব্য। অবশ্য নিষ্পলক হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেও এদের জুড়ি নেই। তাঁবুর দরজার কাছে ভিড় করে এরা আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল, যেন আমরা অতীব কৌতূহলের বস্তু, আর ঝপ করে উবেও যেতে পারি। ... ...
সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি বেশ কটা গ্রাম রয়েছে। সমুদ্রের তীরে লোকের ভিড় দেখলে জায়গাটা কত জনবহুল তা বোঝা যায়। কিসুনওয়ে ও মুরেম্বওয়ে নামের অন্তরীপ দুটোর মাঝামাঝি বিকারি নামের একটা জায়গা আছে - আসলে বেশ কটা গ্রামের সমষ্টি। সেখানকার এক মুটওয়ারের আবার ভারি নজরানার উপর লোভ। বদবুদ্ধিওলা কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে দর কষাকষি করতে পারব না। তাই জিজিদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না এমন গ্রামগুলো এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু আমাদের জিজি পথপ্রদর্শকও পথ ভুল করল আর একাধিকবার আমাদের এইসব বিপজ্জনক জায়গাতে নিয়ে গিয়ে হাজির করেছিল। ... ...
পঞ্চম দিনের ভোরে ন্যাবিগ্মা দ্বীপের আশ্রয় ছেড়ে আমরা বেরলাম। এক ঘণ্টারও কম সময়ে কেপ কিতুন্ডাতে পৌঁছলাম। এই অন্তরীপটি স্তূপাকার বেলেপাথরের তৈরি একটা নিচু ছাদের মত। যে বিশাল বক্ররেখ পর্বতশ্রেণীর থেকে লুয়াবা বা তার অন্যান্য সঙ্গী নদীদের জন্ম, সেই শৈলশ্রেণীর গোড়া থেকে প্রায় আট মাইল দূর পর্যন্ত এই ছাদের মতন বেলেপাথুরে জমি বিস্তৃত। এরপর আমরা গভীর উপসাগর পেরিয়ে কেপ কাসোফুতে এলাম। লুয়াবার ব-দ্বীপ এই উপসাগরের মাথায়। এই চত্বরে অসংখ্য গ্রাম রয়েছে। মুকুঙ্গুর অবস্থান খুব সুন্দর। এখান থেকে পরপর কিগোঙ্গো, কাটুঙ্গা ও বুগুলুকা ইত্যাদি অন্তরীপ বা কেপগুলো সব দেখা যাচ্ছে। এখানে পৌঁছাতে সবকটা জায়গাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ... ...
একটা বটগাছের নিচে ছাউনি খাটানো হল; চারপাশে টাঙ্গানিকার হালকা-ধূসর জলরাশি, তার পাশে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পাহাড়ের সারি। পাম-কুঞ্জ, কলাঝাড়, সাবু-সহ শস্যখেত দিয়ে সাজানো নিয়াসাঙ্গা গ্রামটি অবস্থিত নিয়াসাঙ্গা নদীর মুখে। তাঁবুর কাছেই গ্রামবাসীদের ছোট-বড় আধা ডজন ক্যানো ছিল। তাঁবুর দরজার সামনেই যতদূর চোখ যায় মিষ্টি জলের রাশি মৃদু বাতাসকে ডাক পাঠাচ্ছে— দূরের উগোমা, উকারাম্বা চোখে পড়ে। ঘন-নীল-শিরা-লাঞ্ছিত মুজিমু দ্বীপপুঞ্জও ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আমাদের পায়ের তলায় পরিষ্কার, জলে-ধোয়া নুড়ি, সমুদ্রের অস্থির ঢেউয়ে ভেসে ভেসে কূলে এসে সারি বেঁধে জমা হয়, কোথাও বা স্তূপের আকার নেয়। আমাদের ডাইনে বাঁয়ে পিছনে যে পাহাড়ের রাশি সেগুলো কি দিয়ে তৈরি তা এই পাথরগুলোর থেকেই হদিশ পাওয়া যাবে। ... ...
আমাদের জাহাজটা উগোমার একটি বিশাল এমভুলে গাছ থেকে বানানো। এটা একটা নড়বড়ে ক্যানো ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা আফ্রিকান আর্গো। এর গ্রীক দেশীয় বিখ্যাত প্রতিরূপের থেকে অবশ্য এই জাহাজ অনেক বেশি ভাল কাজে নিযুক্ত। আমরা সোনার লোম আনতেও যাইনি, কোন ভাড়া খাটতেও যাইনি। বরং একটা বাণিজ্যপথ খুঁজতে গিয়েছিলাম যার মারফত নীলনদের জাহাজগুলো উজিজি, উসোওয়া এমনকি আরও দূরের মারুঙ্গু অবধি আসতে পারে। ... ...
লিভিংস্টোন ও আমি, টাঙ্গানিকা হ্রদের উত্তর প্রান্ত দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করার পরে যদি জিজিদের অযৌক্তিক দাবি বা ভয়ের কাছে নতি স্বীকার করে, রুসিজি নদীর সমস্যার সমাধান না করেই উন্যানয়েম্বেতে ফিরতে বাধ্য হতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশে ফিরে সকলের ঠাট্টা তামাশার পাত্র হতাম। কিন্তু জানতাম যে জিজিদের, বিশেষ করে ওই হাস্যকর বর্বর কানেনা সর্দারকে দলে নেওয়ার জন্যেই ক্যাপ্টেন বার্টন ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই আমরা সতর্ক ছিলাম। বুঝেছিলাম যে এই ভৌগলিক সমস্যাটার সমাধানের ক্ষেত্রে এই ধরনের লোকেরা আমাদের কোন সাহায্যই করবে না। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন ভাল নাবিক ছিল, খুবই অনুগত। ভাবলাম, শুধু একটা ক্যানো ধার করতে পারলেই সবকিছু ঠিকঠাক হবে। ... ...
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আবিষ্কারকরা যেটাকে অবিসংবাদিত সত্যি বলে জেনেছেন, সেটাও বলতে পারবেন না, বললেই তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হবে যে তাঁরা দেশের ভৌগোলিকদের প্রিয় তত্ত্বগুলির বিরোধিতা করার জন্য দল বেঁধেছেন। বা অভিযোগ করা হবে যে সুপরিচিত তথ্যগুলোকে তাঁরা বিকৃত করছেন। বিদগ্ধ মিঃ কুলি' একজন আরবের কথার ভিত্তিতে একটা গোটা মধ্য আফ্রিকা জোড়া বৃহৎ হ্রদের রূপরেখা এঁকেছিলেন। সেই হ্রদ নিয়াসা, টাঙ্গানিকা ও এন'ইয়ানজা ইত্যাদি বেশ কয়েকটা হ্রদকে জুড়ে রয়েছে। এদিকে লিভিংস্টোন, বার্টন, স্পেক, গ্রান্ট, ওয়েকফিল্ড, নিউ, রোশার, ইয়োন্ডারডেকেন এবং বেকার যখন প্রমাণ করলেন যে, এগুলো একটা না অনেকগুলো আলাদা আলাদা হ্রদ, আলাদা আলাদা নামের, দূরে দূরে ছড়ানো, তখন কেন তিনি একবারও স্বীকার করবেন না যে তিনি ভুল করেছেন? ... ...