এ নয়, কুমুদি, অর্থাৎ জয়ন্তী অধিকারি, কেবল কেবলির কথাই লিখেছেন। আসলে তো তিনি কেমিস্ট্রির পন্ডিত। ডাকসাইটে বিজ্ঞানী। রীতিমতো গম্ভীর প্রবন্ধও লিখেছেন বিস্তর। গুরুতেই লিখেছেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারি, কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে নিয়ে। কিন্তু তিনি এমনই কেবলিময়, যে, চোখে দেখার আগে, এসব বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। যেমন কঠিন ছিল বিশ্বাস করা, যে, কুমুদি আর নেই। জলজ্যান্ত জয়ন্তী অধিকারি হঠাৎই একদিন দিল্লি শহরে নেই হয়ে গেলেন। দিল্লি শহর দাঁড়িয়ে রইল শুধু খটখটে কুতুবমিনারকে নিয়ে। যিনি গেলেন, তিনি অবশ্য ডঃ জয়ন্তী অধিকারি। ডাকসাইটে বিজ্ঞানী। কেবলি তো অজর অমর অক্ষয়। তার মৃত্যু নেই। নামে কেবলি হলেও আসলে যে স্মার্ট, স্কলারশিপ পেয়ে রিসার্চ করে। কটকট করে কথার উত্তরও দেয়। সত্তরের দশকের সবুজ শাড়ি পরা সেই মেয়েটি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের পাশ দিয়ে এখনও তো হেঁটেই যাচ্ছে, সবুজ শাড়ি পরেই। অবিকল একই রকম ভঙ্গীতে। ... ...
মনে হয়, আন্তরিকতা একটা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। এ ঠিক অভ্যাসসাধ্য নয়, বরং জন্মসূত্রে অর্জিত। সেই আন্তরিকতার সোনার কাঠির যাদু-স্পর্শ যেখানে যেখানে ছোঁয়, তারা সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ভালো লেখা থেকে মহৎ সাহিত্যে উত্তরণের হয়ত একটা ধাপ এটা। আন্তরিকতাটুকু তার কমণ্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল ঢেলে দিল তার লেখার খসড়া খাতায় – আর তাতেই সে লেখার ভিতরের স্কুল ঘরের ভিত খোঁড়া হ’ল, গাঁথনি হ’ল সিমেন্টের, ছাত ঢালাই, দেওয়ালের ইট, প্লাস্টার, দরজা-জানলা স্থাপন, চুনকাম, জানলার বাইরের মাঠ, তাতে মাঝখানের নিমগাছ – স-ও-ব। অন্য দিকে, সেই স্কুলে পড়া সব ক্লাসের সব সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্কুলের অন্যান্য কর্মচারী, মায় হজমি-ওয়ালা। স্কুলে পৌঁছনোর রাস্তা, স্কুল যাওয়ার বাস, বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর – সব সব কিছু জ্যান্ত হওয়ার পর, তবে সেই স্কুলের অনুষ্ঠানে একটি রিহার্সালের দিন আসবে। আমরা গোগ্রাসে পড়তে পড়তে যাতে হারিয়ে যেতে পারি, এত স্পষ্ট যে ছুঁয়ে দেখতে পারি সেই স্কুলের দেওয়াল। আর সেই একটা ঘর থেকে ভেসে আসা আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের রিহার্সালের শব্দ। আর এমনই এক রিহার্সালে হঠাৎ চলে আসেন ভুলো-দিদিমণি চিত্রলেখাদি - আমরা প্রতিটি পাঠক নিজ নিজ ভাবে অনায়াসে প্রবেশ করি “একটি ত্রেতাযুগের ইশকুলের গল্প” তে। অবাধ। অনায়াস। ... ...
কুমু নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতে খুব পছন্দ করতো। নিজের বয়স বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলতো, নিজের ওজনও। সবেতেই হাসিখুসি। ওর লেখা ওর ছোটোবেলার চোরের গল্পটা তো বাংলা সাহিত্যেরই একটা সম্পদ। হ্যাঁ, শুধু ভাটের মধ্য দিয়েই নয়। দু বার দেখাও হয়েছে। একবার ব্যাংগালোরে। কল্লোলের বাড়িতে বিরাট আড্ডায় কুমুদিনি এলেন এক প্লেট ফিস ফ্রাই নিয়ে। নিমেষে ফর্সা। আরেকবার, লাস্ট বার বইমেলায়। শ্যামল আর কুমু। শ্যামলের সাথে প্রথম মোলাকাত। কিন্তু আমি তো শ্যামলকে চিনি। কুমুর সাথে বিয়ের আগের থেকেই চিনি। সবই কুমুর ঘরোয়া লেখার কল্যাণে। তাই আলাপ থেকে আড্ডা- সেটা নিমেষেই হয়ে যায়, রেসিং কারের মতন। কতোজনের সাক্ষাত হলো। অনেক গল্প গুজব হলো। তারপরে বাড়ি ফেরার পালা। তারপরে বাড়ি ফেরার পালা। "আবার দেখা হবে" - এই রকমই অঙ্গীকার ছিলো। ... ...
উনি কি আমাদের পি জি উডহাউস? না; উনি একান্ত ভাবে আমাদের অনাবিল বাঙালি হিউমারের ঘরানার। অল্প শিব্রাম, অনেকটা পরশুরাম আর একটুখানি প্রভাত মুখুজ্যে। ওঁর ধর্মবিশ্বাস কী ছিল জানিনা, কিন্তু সমস্ত রচনার শেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ আমাদের ভাবতে বাধ্য করে –আছে দুঃখ আছে মৃত্যু; কিন্তু এ’সবের মধ্যেও আনন্দ ও সুন্দরের খোঁজ পাওয়া যায়। লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে লেখকের প্রশান্তি । এই প্রশান্তির খোঁজ আমি আজও পাইনি, কিন্তু উনি আমার চেয়ে বয়েসে অনেকটা ছোট হয়েও পেয়ে গেছলেন। কীভাবে? সে রহস্য সমাধানের চাবি বরাবরের মত হারিয়ে গেছে। ... ...
আরো অনেক গল্প শোনার ছিলো কুমুদি'র কাছে। ভেবেছিলাম একদিন সময় করে বসে বলবো "বলো এবার বড়কুমার ছোটকুমারের তারপর কী হলো'। আর আরো বাকিসব। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই, কুমুদি গিয়ে উঠলেন তাঁর নৌকোয়। এখন আমাদের এই ঘাটে আর খেয়াতরী বাইবেন না! এর কোনো মানে হয়? তবে তারার পানে চেয়ে তাঁকে ডাকতে হয়না আমার। যে অমন করে মনের ভেতরের কলসীটা ভরে দিতে পারে, তাকে আবার বাইরে কোথাও খুঁজতে যেতে হবে নাকি? ... ...
এই হচ্ছেন কুমুদি! সেই প্রথম আলাপের দিন থেকে শুরু, তারপরেও বহুবার দেখা হয়েছে বিভিন্ন আড্ডায়, আর বারবার দেখেছি আমরা সবাই যখন আড্ডা-হা-হা-হি-হি তে মশগুল হয়ে যেতাম, কুমুদি বরাবর ওই নরম গলায় আমাদের কর্তব্য-কর্ম মনে করিয়ে দিতেন, যদিও গুরুজনসুলভ হম্বিতম্বির লেশমাত্র দেখিনি কখনো। নারী-স্বাধীনতা নিয়ে গুরুগম্ভীর কথাও বলতেন না কখনো, নিজের কৃতিত্বও ঢাক পিটিয়ে বলেননি কখনো – কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে, সংসার, গবেষণা, লেখালেখি ... এই প্রবাসে একা হাতে কত কী-ই না সামলেছেন! কোথাও কোনও মেয়ের কৃতিত্ব দেখলে বা অন্য কারুর কাছে শুনলেও কী অপরিসীম খুশি হতেন। মনে আছে ... ছন্দা গায়েন যখন হিমালয়ের বুকে হারিয়ে গেল চিরতরে, তা নিয়ে ভাটিয়ালির পাতাতে কুমুদির লেখায় যে হাহাকার দেখেছি, তা একেবারে মনের গভীর থেকে উঠে আসা, কোন কৃত্রিমতা ছিলনা তাতে। ... ...
২০১৯ র দিল্লি বইমেলাতে কুমুদির এতাবৎ প্রকাশিত লেখাগুলোর থেকে কিছু লেখা একসঙ্গে করে একটা বই বেরোল। কুমুদির রোমহর্ষক গল্পসমূহ। গুরুচন্ডা৯-র থেকেই। এই বইতে সব গল্পই অতি প্রিয়। আর বইটা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার ইচ্ছে করে পুরো বইটাই কোটেশন হিসেবে তুলে দেই। গল্পগুলো মানে প্লটগুলো মজাদার তো বটে, কিন্তু প্লটের অন্তর্নিহিত মজা আর চরিত্র বর্ণন কুমুদির অননুকরণীয় সরস বর্ণনায় যে কোথায় উঠে গেছে তা আর কি বলব। ই যেমন ধরুন না সাইকেল চালাতে শেখার গল্পটাই – প্রথম সাইকেল চালাতে শেখার অনেক মজার মজার গল্প আমাদের অনেকেরই স্টকে আছে, কিন্তু সেই গল্পই একবারটি পড়ে দেখুন কুমুদির বয়ানে, “একটি সাইকেল ও দেহলিজ” । দেখবেন কখন যেন আপনিও আওড়াতে শুরু করেছেন, “ডরাইলেই ডর”। কোন গল্প ছেড়ে কোন গল্পের কথা বলি! কেবলীর কলেজ জীবন, গোবু মহারাজের সঙ্গে তার প্রেম জীবন এবং বিবাহপর্ব - এসব তো আমাদেরই গল্প, শুধু নিজেরা যেন দেখতে শিখি নি – কুমুদি হাতে ধরে দেখিয়ে দিলেন। ... ...
আমি কুমুর প্রেমে পড়েছিলাম। শুধু আমি নয়, আমরা সবাই, যারা গুরুতে লিখতাম, গল্প করতাম, ২০০৯ ও তার পরবর্তী কিছু বছর। কী ইচ্ছে ছিল, দিল্লী যাব, সামাসামনি আড্ডা মারব, অনেক অনেক ক্ষণ। তা হল না, গুরুতে আড্ডার স্মৃতি-ই রয়ে গেল। অমন বন্ধু আর হয় না। কুমু-র লেখা ছিল মজাদার, রসে টইটম্বুর। মজার আড়ালে থাকত এক প্রীতিময়, মানবিক মুখ, স্নেহার্দ্র, ভালবাসায় জরজর - মানুষের ওপর বিশ্বাস ছিল অটল। মন খারাপের দিনে, বহু আঘাতে রক্তাত্ত সময়ে, ওর লেখা বিশল্যকরণীর কাজ করত ... ...
কুমুদি চলে গেলেন, ছয় মাস হল। কুমুদি রয়ে গেলেন। তাঁর গ্রন্থিত , অগ্রন্থিত গল্পে, প্রবন্ধে, কবিতায়। কুমুদি রয়ে গেলেন স্মৃতিতে। আজ গুরুচণ্ডা৯ র 'মনে রবে' তে কুমুদি, এবং শুধুই কুমুদি। ... ...
পা রসবোধ তো টইটম্বুর হয়ে চলকে চলকে পড়ছে। যাকে এতদিন সাহিত্যের মনযোগী ছাত্রী জানতাম সে তো একেবারে সরস গল্পের পাত্রী। রম্যরচনার মূল কথা হল, উইট বা হিউমার কখনওই টস্কাবে না যেন বলশয় ব্যালে। তেড়ে বুড়ো আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে তিন চার পাক খাবেন কিন্তু তাতেও আপনার পায়ে ব্যথা হবে না, কপালে সামান্যতম্য ভাঁজ দেখা যাবে না। লেখিকার নিবেদন থেকে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। “ ‘তবুও শান্তি, তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে, তবু প্রাণ নিত্যধারা…’ বারে বারে আর আসা হবে না, এমন মানব জনম আর পাবে না। মাত্র একবার পাওয়া এই মরজীবনের সময়সীমাও বড়ো কম। ভালোবেসে তৃষ্ণা মেটে না, বিরহদহনে পূর্ণতা আসে না, দুঃ দিয়ে বা পেয়ে তৃষ্ণা যায় না…” এতোগুলো নঞর্থক বাক্যবন্ধনী দিয়ে আসলে জীবনকেই প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। “তবু ক্লান্ত পথিক ক্ষণকালের জন্য আনন্দ পাক, কয়েকটি মুহূর্ত ভরে উঠুক স্মিতহাসির প্রসন্নতায়- বহু পথ পার হয়ে এসে এখন এইটুকু সাধন নিয়েছি।“ বইটা কেমন সেটা নিয়ে আলাদা করে আর বলে দিতে হবে না, তবে রসবোধ যখন জীবনবোধের হাত ধরে চলে তখন ক্ষণিক সরে সেলাম করে যেতেই হয়। ... ...
বুদ্ধিদীপ্ত বেজায় মজাদার একটি বই যেখানে কল্পনা, বাস্তব, রহস্য আর খ্যাপামি দিব্যি মাখামাখি হয়ে বসে আছে! পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল লীলা মজুমদার, নবনীতা দেব সেন, শিবরাম, জেমস থারবারকে... কিন্তু ওইটুকুই, বাস্তবে স্টাইলটা লেখিকার একান্তই নিজস্ব। আমি বলি কি, ভূমিকা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না; ঝাঁপিয়ে পড়ুন মূল বইয়ের পাতায়। একটা সতর্কবার্তা – সিরিয়াস রামগরুড়ের ছানাদের জন্য এই বই নয়।' ... ...
অন্য সবাই বসার ঘরে গল্পে ব্যস্ত, তিনি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে খিড়কির দরজার দিকে গিয়ে দেখেন বেশ কজন অঙ্গনওয়াড়ি মহিলাকর্মী বসে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। জানা গেল দুইমাস ভাতা পান নি, উপরন্তু আজকের খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাঁদেরই থেকে সংগ্রহ করা চাঁদার টাকায়। লজ্জায় দুঃখে কোনমতে নিজের ব্যাগে যেটুকু যা টাকা ছিল বের করে ভাগ করে দেন ওঁদের মধ্যে। পরবর্তীতে অবসর নেওয়া পর্যন্ত আতিথেয়তার ভার নিজেই বহন করেছেন, আর কখনো চাঁদা সংগ্রহ করতে দেন নি মিটিঙের নামে। সেই আই এ এস অফিসার, প্রখ্যাত লেখক ও দক্ষ প্রশাসক অনিতা অগ্নিহোত্রী, পড়ছিলাম তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিকথা ‘রোদ বাতাসের পথ’। ... ...
বিদ্যাসাগর ও রামমোহনকে কোম্পানি তথা বৃটিশের ঘৃণ্য দালাল হিসেবে থিসিস দাঁড় করাতে গিয়ে গোটা বইটিতে বারবার ধ্রুবপদের মত উঠে এসেছে একটি কথাঃ হিন্দু সমাজে সম্পত্তির অধিকার/ভাগ / বাঁটোয়ারার ব্যাপারে বাংলায় প্রচলিত ছিল পন্ডিত জীমুতবাহনের ‘দায়ভাগ’ পদ্ধতি আর বাকি ভারতে ছিল পরাশর সংহিতার উপর বিহারের বিজ্ঞানেশ্বর প্রণীত টীকা ‘মিতাক্ষরা’। মিতাক্ষরায় বিধবাদের সম্পত্তির অধিকার ছিল না। ‘দায়ভাগে’ ছিল। (?) অর্থাৎ বঙ্গদেশে বিধবারা মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। হ্যালহেডের জেন্টু ল’ এবং পরবর্তী হিন্দু ল’ মুড়িমিছরির এক দর করে বঙ্গের বিধবাদের স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করল। বিধবাবিবাহ আইনে বিদ্যাসাগর সেই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে এই ব্যাপারটায় মোহর লাগিয়ে দিলেন। তাই বিধবাবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে বিদ্যাসাগরের নারীদরদী ভূমিকা নিয়ে যাও বলা হয় সব দুষ্প্রচার। আসলে উনি নারীহিতৈষী নন, ঔপনিবেশিক এজেন্ডার দাস মাত্র। ... ...
বাস্তবিক, কুড়ি বছর আগে, ২০০১ সালে আমেরিকা ও যৌথবাহিনী যখন তালিবান ও আল-কায়দাকে ধ্বংস করতে আফগানিস্তান অভিযান চালিয়েছিল, তারা এমন একটি ভাব করেছিল যেন শুধুমাত্র তালিবানদের উৎখাত করাই নয়, ‘রক্ষণশীল’ আফগান সমাজের আধুনিকীকরণ এবং সেখানকার নারীদের রাতারাতি পশ্চিমী নারীতে পরিণত করাই তাদের অগ্রাধিকার। সেই সঙ্গে একটি মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি পশ্চিমী ধাঁচের উদার গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও প্রগতির পতাকা তুলে ধরাও ছিল তাদের প্রতিশ্রুতির তালিকায়। কিন্তু গত দুই দশকে যে-সব ছবি উঠে এসেছে, তাতে এ-কথা আজ স্পষ্ট যে, শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা উন্নয়ন কোনটাই তাদের লক্ষ্য ছিল না। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে, রাশিয়া, চীন ও ইরান— মার্কিন সাম্রাজ্যের প্রতিস্পর্ধী এই দেশগুলির চারপাশে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করাই ছিল আফগানিস্তান দখলের প্রধান উদ্দেশ্য। ... ...
"স্টিফেন হকিং এর কোনো বই পড়তে গেলেই বোঝা যায় যে উনি একজন দুর্দান্ত শিক্ষক। ওঁর ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম পড়তে গিয়েই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। কোনো জটিলতম বিজ্ঞানের তত্বকে সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা,সরস পরিবেশন এবং অন্তর্দৃষ্টি—এসবই তাঁর সম্পদ। ্মৃত্যুর আগে লিখিত সর্বশেষ বই ব্রিফ আনসারস টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেনসও তার ব্যতিক্রম নয়। দু একটি দুরূহতম জায়গা ছাড়া প্রায় সবটাই সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার ভিতর নিয়ে আসতে পারেন তিনি। সাধে কি আর ব্রিফ হিস্ট্রি বেস্ট সেলার হয়েছিল।" পড়লেন সন্দীপন মজুমদার। ... ...
"মেয়েরাই উঠে এসেছে এ বইতে কথার পর কথায়, কিন্তু এ বই শুধু মেয়েদের বই নয়। এর মরমিয়া কথন, বিষয়ের ব্যাপ্তি সবাইকে দিয়ে পড়িয়ে নেবে গল্পগুলোকে। উপরি পাওনা মনস্তত্ত্বের নিখুঁত মিশেল আর শ্লেষের নির্দয় চাবুক। ব্যথা নিরোধক যন্ত্র গল্পটি খুব নাড়া দেয়। দত্তক, একটি মেয়েলি দুপুর, গোধূলিসন্ধি, সবগুলোই গতানুগতিকতার বাইরে অন্য গল্প। আর রয়েছে কল্পবিজ্ঞান টিট্টিভ । তাকে সার্থক গল্প করে তোলার কাজটি যশোধরা করেছেন অবলীলায়।" পড়লেন প্রতিভা সরকার ... ...
একের বিপরীতে অন্য কাউকে দাঁড় করানো যে আমাদের শেষ পর্যন্ত ঠেলে দেয় ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের ঢাকা শহরে, ইলিয়াসের মতো সর্বদ্রষ্টা লেখক তা জানতেন। তিনি কেবল করেছেন সেই কাজটিই, যা করতে পারেন সৎ এবং মহৎ সাহিত্যিকেরাঃ ভাষাহীনকে ভাষা দেওয়া। কালাম মাঝি হোক, কি শরাফত মণ্ডল; কম্যুনিস্ট পার্টির ছোকরারা হোক কিংবা মুসলিম লীগের চ্যালারা; ইলিয়াস ব্যাক্তির ওপর কোনো সত্য আরোপ করেননি। তিনি কেবল সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির আকাঙ্খার সাথে সমাজের বৈষম্যের পার্থক্যটাই এঁকে গেছেন। লেখার টেবিলকে ইলিয়াস পল্টনের ময়দান করে তোলেননি। ফলে, উদ্দিষ্ট এই উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের এন্টি-থিসিস; এমন কথা যে ইদানিং শুনতে পাই, সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তখন আহত না হয়ে আর উপায় থাকে না। ... ...
৭৫ বছরে কিছু পাল্টায়নি, কারণ আমাদের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে আছে ঘৃণার পাহাড়। পাল্টাতে হলে সেটাকে সরাতে হবে। দাঙ্গার আগুন আর রক্ত সত্য, সত্য মানুষের নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তাকে পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো 'তবু', যেগুলোর কাছে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এমন মানুষ তো বিরল নন, যারা দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়েছেন, কিন্তু তবু সাম্প্রদায়িকতাকে মনে স্থান দেননি। এখনই মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াতা সীমা দাসের কথা যাঁর আত্মজৈবনিক "দ্যাশ থেকে দেশে" বইটি প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল। মিহির সেনগুপ্তের সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, অমর মিত্রের দেশভাগ-বেদনার উত্তরাধিকার পড়লেই বোঝা যায় উভয় পক্ষেরই দাঙ্গা-উত্তর মানসিকতা কী হওয়া উচিত। এই আগুন ও রক্ত আর ঐ 'তবু'র মধ্যে নিরন্তর দোল খায় যে পেন্ডুলাম তার নাম মানুষের মন। যখন সে থামে, দেখা যায় তা নিশ্চিত হেলে আছে 'তবু'-র দিকেই। ... ...
হায়দারের উপন্যাসের পাঠক-মাত্রেই জানেন, অজস্র চরিত্র ও দ্রুতগামী ঘটনাক্রমের সাথে তাল রাখতে গেলে পাঠককে সদা সতর্ক থাকতে হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, তাদের সামাজিক অবস্থা, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরগুলির মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া – এমন অনায়াস বয়ানে বুনে চলেন, যেন এক মহানদী – যাতে এসে মিশছে শাখানদীরা, বেরিয়ে যাচ্ছে উপনদীরা, আবার ঘুরে এসে হয়ত মিশছে মূল নদীতে। এই বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক স্তরের চরিত্রগুলো এত নিখুঁত বিস্তারিত – তাদের প্রায় রক্ত-মাংসের মানুষের মতই অনুভব করা যায়। এই উপন্যাসে রসবোধ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। এক প্যারাগ্রাফ পড়ে হেসে ফেলতে না ফেলতেই, পরের প্যারাগ্রাফ প্রায় বিধ্বস্ত করে দেয়। অথচ কোথাও একটুও তাল কাটে না, একটুও আরোপিত মনে হয় না। ... ...