খোয়াবে তারা দেখতে পেয়েছে শওকত আলীর পরীর মতো মেয়েটিকে। শুনতে পেয়েছে পায়ে নূপুরেরও ঝুমঝুম শব্দ। সেই শব্দ করে মেয়েটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে কোনো ফটো স্টুডিওতে ঢুকতে গিয়েছে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার হোঁচট খাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে তার করুণ শঙ্খের মতো মুখটিও দেখে ফেলেছিল। সেই মুখ দেখে তারা অজান্তে গেয়ে উঠেছিল -- রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি…। এই গানটি গাইতে গাইতে তাদের গলা ধরে এসেছিল। সেটা মনে করে আজ এই ক্ষণে পাপবোধ ঘিরে ধরে। সেই পাপবোধ থেকেই তারা নিজ নিজ স্ত্রীদের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর প্রবল নদীর মতো কান্নার স্রোতধারা তাদের চোখ থেকে নেমে এসে ধুলোমাখা পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে লেগেছে। আর এই স্ত্রীগণ সহসা হাওয়া থেকে পদ্মঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে। সেই গন্ধে তাদের মনে হয় তারা আজ আর বহুগর্ভধারী শিথিল স্ত্রীগণ নয়। তারা সবাই অনাঘ্রাতা কিশোরীরত্নে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আর তাদের পদতলে নত হওয়া লজ্জিত কিশোরটির প্রতি স্নেহ মমতা এবং ভালোবাসা বোধ করতে করতে ছায়ার মতো নরম করে নিজেকে মেলে দেয়। কয়েকটি শিশুর জন্মসূচনাধ্বনি সব কিছু ভেদ করে চারিদিক প্লাবিত করেছে। ... ...
সত্যবতী চাঁপাডাল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে এক টুকরো জিরো ডিগ্রি পাড়বে ভেবেছিল সন্ধের মুখে। তখন আকাশ পিঙ্গল বর্ণ। সত্যবতীর তলপেটে রজঃকালীন ব্যথা মাঝে মাঝে চাগাড় দিচ্ছিল। চাঁপা ডালে-ডালে আঁধার এলে চম্পকনগরে নৈশকালীন আয়োজন। পাতায় দালানে খোলাছাদে পরাগধানীতে প্রাত্যহিক নিজ হস্তাক্ষরের উৎসব শুরু হয়। রোজ রোজ উৎসব। রোজ রোজ নির্বাক কার্নিভাল। দিনমান গেলে একশরীর সহস্রারে সহস্রধারে ফেটেফুটে শালুকে ক্রিসান্থিমামে কুচি কুচি শরীরে ভেঙে ভেঙে উতল ফ্লেমিংগো। খোলাছাদে ঝুঁকে পড়া ডাল থেকে টুপ টুপ চাঁপা ঝরে আর-- আর মাংসখেকো হায়নার মতো ক্ষুধিত শরীরেরা এক শরীরকে উদ্দেশ করে খিস্তি মারে, শিঁষ দেয়, কোমরে পাক মারে বলে সে এক নকটার্নাল বৈকি! ... ...
তিনি জানালেন, আমাদের বাসায় যে চুরি হইছে, আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন। আমার বড় ভাই হাসানুর রহমান সাহেবের স্ত্রী যেইভাবে ঘটনাটি বর্ননা করছেন, আপনারা দেখেছেন উনি কিরকম মিথ্যাবাদী। উনি বলতে চাইছেন আমার ছোট ভাই মিজানুর রহমান কোনভাবে এই চুরির সাথে দায়ী। কিন্তু এইটি পুরা মিথ্যা কথা। আমার ভাই মিজানুর রহমান পাঁচ অক্ত নামাযী মানুষ। তিনি বিড়ি সিগারেট কিছুই খান না। আমরা যখন ছোট আছিলাম, তখন ঝড়ের দিনে আমগাছের নিচে আম, জামগাছের নিচে জাম পড়ে থাকত, অনেক পড়ে থাকত। আমার ভাই মিজানুর রহমান মিজান কোনদিনই ঐসব আম জাম হাতে নেন নাই। তিনি কীভাবে চুরি করবেন? তাও নিজের ঘরে তিনি কেনোই বা চুরি করতে যাবেন? আপনারা কস্মিনকালে শুনেছেন কেউ নিজের ঘরে চুরি করে? ... ...
কুফরি থেকে ফাগু দুই বা সওয়া দুই কিলোমিটার রাস্তা ঘোড়া চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট। বোধহয় পৃথিবীর নিকৃষ্টতম রাস্তা এটা! পুরো রাস্তা এক – দু বিঘৎ পরিমাণ পাথরে ভরা। উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা ছয় সাড়ে ছয় ফুট চওড়া রাস্তার দুধারে কোথাও কোথাও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিছুটা রাস্তা গেলে দেখা গেল পাঁচিল আর নেই, তবে সে জায়গায় রাস্তা বলেও কিছু নেই। পাথরের চাঙর ভর্তি ঢালু ভূমি,আর পাইনের জঙ্গল। রাস্তা কর্দমময়। বেশ খানিকটায় ঘোড়ার পুরীষ আর কাদা মেশানো ঢলঢলে একটা স্তরে প্রায় হাঁটু ডুবে যায়। সীতারামের হাঁটু তক গামবুট থাকলেও সওয়ারিদের পায়ে সেই কাদা ছিটকে আসে। প্রতি মুহূর্তে ভয়। একটি ঘোড়া পড়লে সওয়ারীসহ বাকিগুলোও সেই কাদার নালায় পপাত ধরণীতল হবার সমূহ সম্ভাবনা ষোলো আনা। ... ...
বাদশা আকবর ফুফুর হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “গল্প শুনতে এসেছি ফুফু হজরত।” ফুফু এবারে একটু দুষ্টু মিষ্টি হেসে বলে ওঠেন, “কেন রে? দরবার খানকে ছুটি দিয়েছিস নাকি? দরবার খান ছেড়ে শেষে আমাকে নিয়ে পড়লি কেন?” জালালুদ্দিন আকবর বললেন, “সে আলাদা আর আপনি আলাদা। সে আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় আমি তার হদিশ রাখতে পারি না। উড়িয়ে নেয়, ভাসিয়ে নেয়। একরাশ রঙে সাঁতার কাটি। কখনো রক্তে টগবগে তুফান ছুটিয়ে দেয়। আমাকে খেপিয়ে দেয়, মাতিয়ে দেয়। কিন্তু কখনো মন চায় গাছের ছায়ায় বসতে, শান্ত হতে চায়। জিরোতে চায়, ঘরে ফিরতে চায়, পিদিমের আলোয় বসে থাকতে চায়। আপনি আমার সেই জিরেন, সেই ছায়া, ফুফু হজরত। তা ছাড়া দরবার তো বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনায় শুধু। আমাদের ঘরের কথা, বাবার কথা, দাদুর কথা – এসব আপনি ছাড়া আমাকে আর কে শোনাবে ফুফু হজরত?” ... ...
পানু পাল আঠারোতেই দানা ভরতে শিখে গিয়েছিল। প্রথমবার মাথা ফাটে ষোলোতে। সে আদতে বকুলতলার। সদ্য অ্যাক্সিলেটর গিয়ারের রহস্যভেদ করতে শিখে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল। ধাবার মালিক হরদয়ালের ভেস্পা নিয়ে মুচিপাড়ায় গিয়েছিল রং ওড়াতে। কিন্তু বেশি উৎসাহে ভুল জায়গায় আওয়াজ দিয়ে ফেললে তরুণতীর্থ ক্লাবের ছেলেরা তাকে ধরতে আসে। সে ভেবেছিল একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেলে ঝড়ের বেগে উড়ে যাবে। কিন্তু স্ট্যাটিক পজিশন থেকে একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেললে ভেস্পা প্রয়োজনীয় গতিজাড্য পায়না, সামনের চাকা উঠে যায় এবং প্রাণেশ মাটিতে পড়ে যায়। ক্লাবের ছেলেরা এই নবকর্ণকে আচ্ছাসে বানিয়েছিল। প্রথমবারের মত তার মাথা ফাটল। ... ...
চোখা চোখের তলায় ছিলবিল করছিল ব্যঙ্গ। সন্তুর শান্ত চোখেও এবার হাসি ছড়াচ্ছে, মৃদু, খুব মৃদু। তপোব্রত অপ্রস্তুতের মত, সামান্য। অপরার সংগে সন্তুর প্রেম বোধ হয় কয়েক মাসের। অপরাকে সঙ্গে নিয়ে সন্তু দিল্লি এসেছে। এটা ঠিক, সন্তুই বেসিক্যালি তপোব্রতর বন্ধু, আর অপরাকে ও প্রায় চেনেইনা, এটাও ঠিক। তাহলে? প্রশ্নটা সন্তুকে করায় কি দোষ হয়েছে কিছু? সরাসরি অপরাকেই করা উচিত ছিল? অপরার কি খারাপ লাগল ব্যাপারটায়? না এমনি, ফচকেমি করছে শুধু? মুখ দেখে ত বোঝা যাচ্ছে না, অথচ কথাটা আলটপকা বল্লেউ তার মধ্যে এক ধরনের ঠেশ আছে। সামান্য ঝাঁঝালো। "আমি"র ওপর একটু বেশি জোর। তপোব্রত একটু অফ হয়ে গেল, একটু অন্যমনস্ক। আমি -টা বেশি এই মেয়েটার। কেমন, মেয়েটা? এই অপরা? একটু কৈফিয়ত দেবার মত করে তপোব্রত বলল, আসলে প্যাট্রিয়ারকাল সোসাইটি ত। তাছাড়া তুমি ওর সঙ্গে এসেছো। তাই ওকেই জিজ্ঞেস করা সমীচীন হবে ভাবলাম, বুঝলে না? ... ...
প্রথমদিন তিস্তা লাহিড়ি’র দিকে একঝলক তাকিয়েই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল শুভশ্রী’র। ভদ্রমহিলাকে যখন দেখে সে, একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, এমনিই ব্যক্তিত্ব তাঁর। পরনে ছিমছাম একটি তাঁতশাড়ি, মুখে হালকা প্রসাধন, চোখে শৌখিন ফ্রেমের চশমা। গায়ের রঙ এই বয়সেও যেন ফেটে পড়ছে। চুল কালার করা, কালোর সঙ্গে মেরুন রঙ। বেশ লাগে তাঁকে দেখতে। তিনি ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর বসাটা এমন জায়গায় ছিল, যেখান থেকে বাইরে-ভেতর দেখা যায়। তিনি দু’হাত বাড়িয়ে তাকে গ্রহণ করলেন। শুভশ্রী দু’হাত তুলে ‘নমস্কার ম্যাডাম’ বলতেই তিনি এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এসো এসো, আমার সই। ... ...
আমি চান ঘরে গিয়ে নিজের গায়ের গন্ধ শুঁকতে লাগলাম। হুঁ, পচা ইঁদুরের গন্ধ লেপ্টে গেছে গায়ে। এই গন্ধ কি যাবার? গঙ্গায় ডুব দিলে হয়তো যেত। নাকি আমাদের গাঙ মাতলায়? আমি জল ঢালতে লাগলাম। সাবাং ঘষতে লাগলাম। শ্যাম্পু দিলাম মাথায়। কিন্তু গন্ধ যেন যায়ই না। বুঝতে পারলাম গা থেকে তারা বেরিয়েও নাকের কাছ থেকে সরছে না। চানঘরে মরা ইঁদুরের গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগল। তার মানে আমার গা থেকে তারা মুক্তি পেয়ে চানঘরে ভাসছে। জলে গুলে যাচ্ছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে। শেষ অবধি আমাকে বেরতে হলো। দরজায় ধাক্কা মারছিল হুজুরের চেলা। আমার চান হলো। খোলতাই হয়ে বেরিয়ে এলাম। দুটো সাবাং গায়ে ঘষে ঘষে শেষ করে দিয়েছি। শ্যাম্পুর শিশি উপুড় করে মাথায় ঢেলে চুলের জট ছাড়িয়েছি। বাইরে কাচা জামা কাপড় ছিল। পরে নিলাম। ভগবানের বাহন বাবু এসে গায়ে সেন্ট ঢেলে দিতে দিতে বলল, তোর গা দিয়ে এখনো পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। ... ...
বাদন এবার প্রায় চুপ করে খাবার বানানোর কাজ করছে। শানুর এই বকবকানি নতুন নয়, এর আগে পেটে লালজল পড়লেই এসব কাহিনী মুড়িয়ে মুড়িয়ে তার মুখ থেকে বেরোয়। এসব বাদনের কাছে নতুন নয়। তবে এই বিয়ের কথাটথা যেন শানু একটু বেশিই বলে এখন। কে জানে, শানুর হয়ত বিয়ের ফুল ফুটেছে। একেকটা সময় আসে যখন ছেলে মেয়ে বিয়ে পাগল হয়ে যায়। শরীরের সুখ যেসব ছেলে মেয়েরা পায়নি তাদের ক্ষেত্রে না হয় এই বিয়েপাগল ভাবটার কথা তবু কিছুটা বোঝা যায়। কিন্তু শানুর তো আর তা নয়, বাদনের গায়ের আর কোনও জায়গা তার অচেনা নয়। তবু এত একসাথে থেকেও কেন যে শানু শুধু বিয়ের কথা বলে তা বাদন বুঝতে পারে না। ... ...
আমি বিমলের দিকে চেয়েছিলাম। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। প্রায় কদমছাঁট। একটু ভিতরে বসা চোখ। গোঁফজোড়া এতদিনে বেশ জম্পেশ, মিলিটারি কায়দায় পাকানো। ভুঁড়িটা না থাকলে বেশ মিলিটারি মিলিটারি লাগত। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল বিমল। স্কুলের রেসে ভাল দৌড়াত। ব্যায়ামমন্দিরে গিয়ে হাত-পা বেশ তাগড়া করেছিল। কে জানে, বাবার দোকান না থাকলে হয়তো আর্মিতেই নাম লেখাত ছেলেটা। বাবার দোকান না থাকলে, এরকম অনেক কিছুই হয়তো করতে চাইত, মাঝে মাঝে প্রেসার কুকারের সিটি মারার মত মুখ ফুটে সেকথা বেরিয়ে আসত। কিন্তু জোরের সঙ্গে অন্যকিছু করতেও দেখিনি বিমলকে। ... ...
বাইরে ডাক্তার ও সুঁইকুমারীর সমবেত গগনভেদী আর্ত্তনাদ, লোকজনের হৈচৈ,পাড়াতুতো কুকুরবাহিনীর উচ্চস্বরে প্রতিবাদ - এতসবের মধ্যেও চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ডাক্তারবাবুর ফোনটি( ততক্ষণে আমরা নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেচি, এ দরজা ভেঙে ঢোকার ক্ষমতা গরুর হবে না)। অকম্পিত হাতে ফোন তুলে দৃঢ়স্বরে বাড়ীতে বলে দিলাম বাচ্চাদের ক্যারাটে ক্লাশ থেকে নিয়ে আসতে। কর্ত্তা যথারীতি সামান্য প্রতিবাদ করছিলেন, তোমরা কোথায় আছ? আমি তো ঠিক চিনি না ক্যারাটে ম্যাডামের বাড়ী (পড়ুন - টিভিতে ম্যাচ চলছে) এইসব। তার উত্তরে আরও দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিলাম যে আমাদের গরু তাড়া করেছে, এ জীবনে বাড়ী ফেরা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ফিরতে না পারলে সবুজ ব্যাগে ব্যাংকের পাশবই ও টাকা রাখা আছে (সেই সেলফোন, এটিএম কার্ডবিহীন সময়ে ব্যাংকের বইয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল)। ... ...
নিনি দৌড়াচ্ছে, নিনি দৌড়াচ্ছে, খুব দৌড়াচ্ছে স্কুলের মাঠে। সামনেই স্পোর্ট্স। ওর খুব ইচ্ছে রিলে রেসে নাম দেয়, খুব একটা ভাল দৌড়াতে পারে না বলে বাকীরা ওকে রাখতে চাইছে না। তা দিদিমনি বলেছেন ও যদি সবিতা আর রিমার সাথে সমানে সমানে দৌড়াতে পারে তবেই ওকে নাম দিতে দেবেন। ... ...
সুমনের কোন গন্ধবাতিক নেই। যেখানে সেখানে যে কোন গন্ধ তার নাকে লাগে না। বিশেষত যে গন্ধ যেখানে লাগবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। ভালো কিংবা মন্দ হোক যে কোন রকম। গন্ধ তার প্রাত্যহিকতাকে কোনো ভাবেই প্রভাবিত করে না। গন্ধকে প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার বাতিক ও তার নাই, যেমন ছিল দুলালের। দুনিয়ার তাবৎ ভালো গন্ধকেই তার লাগতো হাসনাহেনা ফুলের মতো। কিন্তু এই ঝামেলা সুমনের নাই, পাশের দোতালা বাসায় পোলাও রান্না হলে ঘি গরম মশলা ফোড়নের গন্ধই নাকে লাগে তার, মেসে শুঁটকি রান্না হলে শুঁটকির। রোজ রাতে মধুবন রেস্তোঁরার পাশ দিয়ে ফেরার সময় ড্রেনে জমে পচে উঠা বাসি খাবারের নাড়ি-ভুড়ি উল্টে আসা গন্ধ আর বারান্দায় শিককাবাব ভাজার পেটের তীব্র ক্ষুধা জাগিয়ে দেয়া গন্ধ মিলেমিশে যে খানিক গন্ধময় ঘোর তৈরি করে তার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শ্রান্ত দেহ ঘিরে, তাও খুব স্বাভাবিকই বোধ হয় সুমনের। মোটেই তা বাতিকগ্রস্ততার পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু আজ ২৫ মাইল সি এন জি চালিত যান আর বর্ষার কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তায় ১০ মাইল রিক্সায় আদিত্যপুর গ্রামে দুলালের বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই তার চোখ যায় বাড়ির শেষ মাথায়। ... ...
—না কিছু করতে পারবে না ওরা। বাড়ি গিয়েই আমার ফেসবুকে পোস্ট করব প্রমাণটা। সবাই দেখবে, জানবে। তখন ওরা বাধ্য হবে আমাদের, মানুষদের গণিতের সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দিতে। উচ্চকোটির গণিত যে শুধু ওরাই একচেটিয়া পারে সেই ভুল ভাঙবে। এবং সাথে সাথে সমস্ত গণিতের দরজা আমাদের জন্যও খুলে দেবে। ন্যায্য অধিকার হিসেবেই দিতে বাধ্য হবে। —এইটা তোমার মহান প্ল্যান? —এইটাই আমার মহান প্ল্যান। ... ...
লোকটা হাত নেড়ে বলে, বাতাস না, বাতাস না—ওসব হল গুহ্য কথা—বুঝলেন কিনা! কানের পাশ দিয়ে ফিসফিস করে বয় আর বলে যায়, সাবধান, সাবধান! লোকটা চোয়াল শক্ত করে বলে, হোমে দুটি ছেলে থাকে না? মাজু আর কেল্টু? হারামির হাড় একটা! এই তো সেদিন এদিকের পরিচিত পাগল, নিত্যকে পিটিয়ে মেরে দিল—কেউ কিছু করল না, জানল না, বুঝল না—মেরে খালের জলে ভাসিয়ে দিল দেহ—গুহ্যকথা, গুহ্যকথা! ... ...
শূন্যতা আসলে নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি। সক্রিয় জীবনযাপনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য লাগে। ধরা যাক, যে লোকটা মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে, খাড়া বরফের উল্লম্ব দেওয়ালে চেপে গেঁথে নিচ্ছে স্নো বুট, সে জানে এখানে তার অক্সিজেন সীমিত, মেপে পা ফেলতে হয়, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। এখানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে একটা তুমুল এভালান্স, এখানে এমনকী তার মৃত্যুর পরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই এতসব ঝুঁকি তাকে এমন একটা জিগীষা দিয়েছে, যা তাকে পৃথিবীর উচ্চতমে নিয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, তার মৃত্যু আশঙ্কা বেশী, কিন্তু ওই ঝুঁকি আছে বলে তার জীবন সুন্দর। এমনকী, এই আরোহীর মৃত্যুও, আহা, কত দুঃসাহসিক-লিরিক্যাল। ... ...
কলকাতার ধোঁয়া, ধুলো, শব্দ-ব্রহ্ম ও ব্যস্ততা থেকে বাঁচতে দক্ষিণ শহরতলির এক নিরালা অঞ্চলে নতুন ফ্ল্যাট নেয় ত্রিদিব ও বন্যা। কিন্তু তাদের নিরুপদ্রব জীবনে নেমে আসে এক নতুন উপদ্রব। তাদের শান্তি ও স্বস্তি ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। অস্থির ত্রিদিব ভেবে পায়না কী করবে? গুরুচণ্ডা৯তে পূর্বপ্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্যর লেখা ছোট গল্প 'আউশভিত্স' এর শ্রুতি কাহিনী বা অডিও স্টোরি প্রকাশ পেল ইউটিউবে স্টোরিওয়ালাস প্রোডাকশনস-এর হাত ধরে। ... ...
ভোরের দিকে শীতবোধে সোমনাথের ঘুমটা ভেঙে গেল। পায়ের কাছের চাদর টেনেও শীতটা কমছে না। নিজের গলায়-কপালে হাত দিয়ে দেখল, গা বেশ গরম। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। হয়তো গত সন্ধ্যার ঠান্ডা জলের ঝাপ্টাটা বসে গেছে। কিন্তু বুকটায় চাপ ধরে আছে। দম আটকে আসছে। উঠে বসে জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে কাশি উঠল। অন্য সময় হলে গা করত না সোমনাথ। ঝড়-বাদলের দিনে, তাপমাত্রা ওঠানামার মধ্যে এমন তো হয়েই থাকে। তার উপর সিগারেট-বিড়ি খায়। ফুসফুস এমনিতেই কমজোরি। গ্যাস-অম্বল নিত্যসঙ্গী। তার উপর চিংড়ি খেয়েছে। কিন্ত এখন খুব ভয় পেয়ে গেল সোমনাথ। এসব কীসের লক্ষণ? তবে কি দত্তদার ঘরে খাবার পৌঁছোনোর ভালোমানুষিটাই কাল হল? ওদের মুখে তো মাস্ক ছিল না। ঘরে এসে হাত ধুতে ভুলে গিয়েছিল কি? মনে পড়ছে না। ভয়টা বাড়ছে। ... ...