এই কথায় ঝর্নার জলের মত স্রোতস্বিনী আমিনা থমকে দাঁড়াল যেন কোন জিন পরী ওকে হঠাৎ পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে, তার আর নড়াচড়ার তাকত নেই, যেন শুধু আমিনা না তার চারপাশের পৃথিবীটাই ওমনি চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বলল আমিনা যার অর্ধেক কথা নোনা বাতাস চুরি করে নিয়ে গেল, আর বাকি আধখানা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেল। তারপর আমিনা ধীর গতিতে নিজের দুই হাতের পাঞ্জা এক করে নিজের মুখের উপর পান পাতার মত ছড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই এক দমকা হাওয়ার মত কোথায় চলে গেল আমিনা, আলেফ আর দেখতে পেলো না। ... ...
শনিবার বাড়ি থেকে সরাসরি ডাক্তারের কাছে গিয়েছে মিঠু। বিপ্লব আর ছন্দা ওর সঙ্গে আজ; ফেরার পথে কেনাকাটা র প্ল্যান রয়েছে- পুজোর বাজার এখনই শুরু না করলে পরে বড় ভীড় হয়। আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি হয়ে গিয়েছিল; টিস্যু স্যাম্পল কালেকশন হয়েছে । সমস্ত রিপোর্ট এখন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে। আজও সেই কনকনে ঠান্ডা চেম্বার, অপেক্ষারত জনা পনের মানুষ, চশমা চোখে ছেলেটি আর তার কমপিউটার-ঘড়ির কাঁটা টিকটিক ঘুরছিল। -সেদিনও এতক্ষণ তোকে বসতে হয়েছিল? -হ্যাঁ "একা একা বসে ছিলি-ইশ, বড্ড স্লো না এই ডাক্তার" ছন্দা বিজবিজ করল। -স্লো কেন? যত্ন করে পেশেন্ট দেখেন- সময় লাগে। -বেশি দেরি হলে, আজ আর কেনাকাটা হবে না, সব বন্ধ হয়ে যাবে। শনিবার না? পাঁচ নম্বরে ডাক পড়ল মিঠুর। ডাক্তার আজ গম্ভীর। মাথা নামিয়ে মিঠুর রিপোর্ট দেখছিলেন। "সব রিপোর্ট এসে গেছে" এই বলে সামান্য থামলেন ডাক্তার "ভালো তো সব?" ছন্দা আগ বাড়িয়ে বলল। মুখ তুলে তাকিয়ে চশমা ঠিক করলেন ডাক্তার। ... ...
আমাদের বিক্রম রাজা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলে তার যুক্তিটাও বলে দিতেন। কিন্তু জর্জিয়াবাসী এই বাচ্চা সেসবের ধার দিয়ে গেলোনা। শুধু উত্তর। তা তাই সই। রাজা সবার অলক্ষ্যে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ... ...
এই বক্তিয়াররা আরেকটি কাজ খুঁজে পেলেন। দেখা গেলো রাজা বা আমলাদের সামনে সকল নাগরিক নিজেদের কেস ঠিক ভাবে উপস্থিত করতে পারছেন না। বাদী বা বিবাদী তো আর্ট অফ পাবলিক স্পিকিং শেখেন নি। আন্তিফন নামক গরগিয়াসের এক চেলা পরামর্শ দিলেন দুই বিবদমান পক্ষের প্রয়োজন এমন একজন মানুষের যিনি মোটামুটি লেখাপড়া জানেন এবং আদালতে দাঁড়িয়ে কোন পক্ষের যথাযথ বয়ান দিতে পারেন।এই মানুষটি হবেন একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু মাত্র যাঁদের কাজ অশিক্ষিত বাদী বিবাদীদের সহায়তা করা। অন্য অর্থে বলা যেতে পারে ইতস্তত ভ্রমণরত বাগ্মীরা একটা কাজের কাজ খুঁজে পেলেন! গ্রিকরা সেটি মেনে নিলেন কিন্তু সাব্যস্ত হলো মামলায় এই সহায়তার জন্য কোন পারিশ্রমিক দেওয়া বা নেওয়া চলবে না। বন্ধু রূপে যদি তাঁরা বিচারকের সামনে অবতীর্ণ হন, টাকা পয়সার প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে। মামলা জিতে কোন পক্ষ যদি সেই বক্তাকে আগোরার কোন শুঁড়ি খানায় দু পাত্তর সুরা পান করায় সেটাকে অবশ্য উকিলের ফি বলে ধরা হবে না। ... ...
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, কোনও আন্দোলন অহিংস না সহিংস হবে – এই প্রশ্ন অবান্তর। হিংসা তো সর্বত্র, সর্বব্যাপী; রাষ্ট্র তো সামান্য অজুহাতে নিরীহ, অসহায় নাগরিকদের দমন-পীড়ন করে, গুলি চালায়, হত্যা করে। আসল ব্যাপারটা হল, ‘কীভাবে’ জিততে হবে। তিনি কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ উত্থাপন করেন, কীভাবে তাঁরা সম্পূর্ণ অহিংস পন্থায় রাষ্ট্রকে নতজানু হতে বাধ্য করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম্যুনিস্টরা কোনদিনও এসব নিয়ে ভাবেনি। তারা ভীষণ গোঁড়া, সংকীর্ণমনা, উদ্ভাবনী চিন্তাকে আমল দেয় না; বাস্তবে কোনও নতুন চিন্তাকে নেতৃত্ব বিপজ্জনক মনে করে এবং সেই ব্যক্তিকে দলে টার্গেট করে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। সাংগঠনিক ব্যবস্থা ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র কথা ধরা যাক। তত্ত্বগতভাবে এর থেকে বেশি গণতান্ত্রিক কিছু হয় না, কিন্তু বাস্তবে নেতা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নিজেদের খুশি মত যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ... ...
বৃত্তরৈখিকের শেষ পর্ব আজ। লেখকের কথায়ঃ "বৃত্তরৈখিককে উপন্যাস বলেছি, কিন্তু হয়তো ইতিহাসও বলা চলতো। মোটামুটি বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের গোড়ায় যাঁদের যৌবনের শুরু এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বেড়ে ওঠা, বাংলাভাষী সেই মধ্যবিত্তদের একদলের ইতিহাস এই রচনার রসদ। পাঠযোগ্যতার খাতিরে একটা গল্পের বুননের চেষ্টা এতে আছে – উপন্যাস নামের আকাঙ্খা সেখানেই – সেটা কতটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে পাঠকই তা বলতে পারবেন। কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের পুর্ববর্তী প্রজন্মের কথা কোন কোন ক্ষেত্রে গল্পের খাতিরে এসে পড়লেও এই ইতিকথার প্রধান চরিত্ররা মোটামুটি ভারতের স্বাধীনতার সমবয়েসী। এবং এই স্বাধীনতার মতই আশাবাদিতা এবং নৈরাশ্য, আদর্শ এবং আদর্শচ্যুতি, মেধানিষ্ঠা এবং নিম্নগামী মেধা এখানে পাশাপাশি উপস্থিত।" ... ...
প্রথম যে কথা বলছিলো সে-ই শুরু করে আবার, ঠিকই, তবে এই সব পরিবর্তন আজকাল হয়েছে। একেবারে প্রথমের দিকে কিন্তু এখনকার ডাইনিং হলটায় শুধুমাত্র কয়েকটা বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলটা শুরু করেছিলেন জয়িদি। তারপর বাস এলো। বাসটা আসার পর থেকে একটা দারুণ কাজ শুরু করলেন উনি, একেবারে জঙ্গলমহলের ভেতরের গ্রামগুলোর থেকে একটা একটা করে বাচ্চাকে ধরে নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আমরা স্কুলের বাসে গিয়েও দেখেছি কেমন সব গ্রাম। শুনেছি তখন জলধর নামে এক সাঁওতাল যুবক ছিলো জয়িদির সঙ্গে, সে নাকি পড়াতোও ভালো। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর থেকে আর নিয়মিত পড়াবার মতো ভালো লোক জোগাড় করা যায়নি। ... ...
মিনতি, মিনতির মতো মুখচোরা মেয়ে, সে-ও জিজ্ঞেস করেছে, কতো তাড়াতাড়ি? কতো তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে হবে? তখনো ধৈর্য হারায়নি উৎপল, বলেছে আটটার মধ্যে। তখন লক্ষ্মীকান্ত বলেছে, ঠিক আছে, আমরা ছটার সময় পড়তে বসে যাবো, আটটার মধ্যে পড়া হয়ে যাবে। উৎপল তো কখনও এরকম জবাব দিতে শোনেনি ওদের, ও রেগেমেগে বলেছে, কী পড়তে বসে যাবো পড়তে বসে যাবো করছো, একজনও বসবে না ডাইনিং হলের চেয়ারে। তখন নাকি তিন-চারজনে মিলে একসাথে বলেছে, ঠিক আছে স্যর, আমরা মেঝেতে বসবো। আর তারপর আস্পর্ধা দেখুন, ক্লাস সেভেনের নবীন ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছে তখন, স্যরকেও কী মেঝেতে বসতে হবে ! বিশেষ কোরে নবীনের এই প্রশ্নে উৎপল খুবই আপসেট। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমিও একটু শঙ্কিত। ... ...
দুপুরে খাওয়ার সময় পুলকেশও বসেন ওদের সাথে, এবং পুলকেশের বিশেষ অনুরোধে জয়মালিকাও। য়্যোরোপের গল্প হয়, পাঁচ জায়গায় সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছে জয়মালিকা, ধরণী মাতার আরাধনা যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর ভারতের ইণ্ডিজেনাস পপুলেশনের দার্শনিক চিন্তার মহাসম্মিলনের ফসল, ভারতীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রতীক, আদিবাসী ধর্ম আর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মিলনস্থল, এ চিন্তা নাকি আলোড়ন তুলেছে যেখানে যেখানে গেছে ও সেখানেই। ও যে বক্তৃতা দিয়েছে তার ইংরিজি অনুবাদ, এক একটি কপি পাঁচ য়্যুরো হিসেবে একশো কপি – যা ও সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়েছিলো – সবই বিক্রি হয়ে গেছে ! এসব আলোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলে না সোমেশ্বরের ওপর, ও মনে মনে ভাবছিলো জয়মালিকা কী বাচ্চাদের পাদুকাবিহীন ফাটা-পাগুলো লক্ষ্য করেছে আজ ! ... ...
দুপুরের খাওয়া চল্লিশজন ছেলেমেয়ের জন্যে, ফাইফ সিক্স সেভেন আর এইট। পেট-ভরা ভাত দেওয়া হয় ওদের, সকালের মতো ফ্যানা-ভাত নয়, ফ্যান-গালা ভাত। আর মনে রাখবেন, ওদের পেট-ভরা মানে আপনাদের পেট-ভরা নয়। ভাত ওরা অনেক বেশি খায়, এবং যতটা খায় ততটাই দেওয়া হয়। আমার মনে হয় না পেট-ভরা নিয়ে কোন দুঃখ ওদের আছে। পেট ভরে। রোজই। তবে হ্যাঁ, তরকারির একটা মাপ আছে, সে মাপটা বুঝিয়ে দেওয়া আছে নিমাই আর সুনীলকে। সেটা যে যথেষ্ট নয়, তা আমরা সবাই জানি, নিমাই আর সুনীলও জানে। ... ...
পরিবেশটা সহজ করার জন্যেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক উৎপল ঘোষণা করে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখন একটা সাঁওতালি গান শোনাবে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত পরিবেশিত হয় ধারমু উদুঃক্ আকাৎ লেকা গানটি। গান শেষ হলে জয়মালিকা আবার তুলে নেয় মাইক। সে ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের থেকে যারা এসেছে তাদের উদ্দেশে এবার বলে তোমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। তারা লেখাপড়া যেমন শিখবে সব ধরণের কাজও শিখবে তেমনি। এই যে আজ এখানে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, মাইক লাগানো হয়েছে, এসব তোমাদের ছেলেমেয়েরাই করেছে। বড়ো বড়ো শহরের ছেলেমেয়েরা যেমন শেখে সেরকমই ভালো ইংরিজি আর বাংলা শেখাবার জন্যে আমাদের স্কুলে এখন কলকাতা থেকে এসেছেন সোমেশ্বর স্যর আর সম্ভৃতা ম্যাডাম। ... ...
বিক্রম চাঁদে পৌঁছে গেলে, মিঠু ফিরে আসবে - এ ধারণা সনতের মনে বদ্ধমূল হচ্ছিল দিন দিন। ধারণার গোড়ায় কোনো শিকড়বাকড় নেই- সনৎ সেদিকে চোখ ঠেরেছিল বরং আগায় ঝুলে থাকা ফুল ফলের সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরছিল- যতই সে' সম্ভার তার দিকে নুয়ে আসছিল; তাদের স্বাদে গন্ধে ক্রমশ সে গোড়ার কথা বিস্মৃত হচ্ছিল, চন্দ্রযানের লঞ্চিংএর জন্য নিজেও প্রস্তুত হচ্ছিল - একটা বড় উৎসবের আগে যা করে মানুষ। লঞ্চিংএর ডেট জুলাই মাসের চোদ্দোই । সনৎ ঐ সময় দুদিন ছুটি নিয়ে নিল। নিজের বিয়ের কথা মনে হচ্ছিল সনতের। যেন বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে, কার্ড ছাপা হচ্ছে, সনৎ লজ্জা লজ্জা মুখে অফিসে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিচ্ছে। সে ইদানিং সর্বত্র এই উৎসবের প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছিল যেন। ... ...
আমিও সেদিন তাই করলাম। পাশ দিয়ে ওয়েটার যাচ্ছিল, তাকে বললাম, “আচ্ছা ওমলেট পাব কোথায়”? সে বলল ওমলেট স্টেশনে চলে যান! ওমলেটের যে আবার স্টেশন হয়, তা কে জানত! তো যাই হোক, যেন বেমানান না লাগে – এমনভাবে দুলকি চালে ওমলেট স্টেশন খুঁজতে বেরুলাম। সেই প্রকাণ্ড জায়গা পাক দিয়ে, প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় দেখতে পেলাম, এক শেফ এক গাদা ডাঁই করে রাখা ডিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম এই সেই মোক্ষ স্থান! গিয়ে চাইলাম ওমলেট – ব্যস, প্রশ্নবাণে গেলাম ফেঁসে! প্রায় ৫ মিনিটের ইন্টারভিউ দিয়ে, ১০ মিনিট বাদে ওমলেট নিয়ে টেবিলে ফিরলাম। ... ...
অস্বস্তিকর নীরবতাটা ভাঙাতেই বোধ হয় কবিদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, আচ্ছা জয়মালিকাদি, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে? আমরা তো অনেকদিন ধরেই আসছি এখানে, দুটো পরিবর্তন খুব চোখে পড়ে আজকাল। প্রথমটা হলো আপনার রুচির পরিবর্তন। আমরা বরাবর দেখেছি আপনি মাছ-মাংস ভালোবাসতেন, বিশেষ কোরে খাসির মাংস। এখানে খাসির মাংস ভালো পাওয়া যায় না, কতোবার বেড়াতে বেড়াতে কোন গ্রামের হাটে ভালো মাংস দেখে আমরাই নিয়ে এসেছি আপনার জন্যে, মনে আছে? অথচ এখন সেই আপনিই মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, এটা কেন? আর দ্বিতীয় যে পরিবর্তন সেটা তো একেবারে মূলে। ... ...
আগস্টের শেষে যখন তিন-চারদিনের জন্যে কলকাতায় গেলো সোমেশ্বররা, ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের এই উপলব্ধির কথাই বললো ওরা। অতল দারিদ্রসীমারও নীচের মানুষ যারা, তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসে পড়াতে গেলে – এবং তা-ও সরকারি সাহায্য ছাড়া – হয়তো জয়মালিকা সেনের রাস্তাই ঠিক ঠিক রাস্তা, এই পথে চলতে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবে সহজ-খ্যাতির যে চোরাগলিগুলো, সেগুলোকে অতিক্রম করাই এখন সাধনা ওদের। যে ছেলেমেয়েদের কাছাকাছি পৌঁছোবার ক্ষমতাই ছিলো না ওদের, জয়মালিকা সেন তাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ তো কোরে দিয়েছেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগাতেই হবে। ... ...
ঠাকুমা আর মানিক কাকুর কথার মাঝেই আমি দেবদারু বাগানের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। হাতে গামছায় বাঁধা খাবার আর গায়ে চাদর জড়িয়ে সাদা কুয়াশার ভেতর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁতিরা। সেই ছায়া থেকে আমি খুঁজে খুঁজে বের করি কলিম তাঁতি, মকবুল তাঁতি, পরেশ তাঁতি, নিবারণ তাঁতি, মান্নান ড্রাম মাস্টার সবাইকে। আজ অন্যদিনের মতো এগিয়ে গিয়ে আমি ওদের সাথে গল্প জুড়ি না। আমি পা বাড়াই গোলেনূর দাদির বাড়ির দিকে। সে বাড়ির উঠোনে এখনো নিঃস্তব্ধতা। শুধু গোলেনূর দাদির বড়ঘরের টিনের বেড়ায় ঝুলানো কবুতরের খোপ থেকে ভেসে আসছে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ... ...
বাড়িটার প্রতি যেন আমরা একটি টান অনুভব করছি। অমলেরও একই অবস্থা। কী মনে হল আমরা আবার একদিন রাতে সেই বাড়িতে গেলাম। এবার মনে হল কিছু একটা ঘটছে। সেই বাড়িতে ওই দুটি ঘর ছাড়া অন্য একটি ঘরে ঢুকলাম এবং সেখানে প্রচুর ভৌতিক কান্ড ও আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমরা ভয় পাই নি, কারণ বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম ভয় পেয়ে গেলেই আমাদের মৃত্যু অবধারিত। আজ অমলকেও একটা মাদুলি পড়িয়ে এনেছিলাম – তাই ওর ভয়ও অনেকটা কমেছে। আমরা দেখি একটি উড়ন্ত চৌকি ও তাতে দেখলাম অস্পষ্ট একটি ধুঁয়া দিয়ে তৈরী একটি লোক – তার জামায় লেখা – কার্তিক পাল। ... ...
প্রতুল বাবু বলেন, ঠিক রুটিন কিছু নেই সোমদা, আপনি আর সোমদি যে যে ক্লাসে পড়াতে চান, চলে যান। তারপর আমি আর মুজফ্ফর যাবো। ইংরিজি প্রায় পড়ানোই হয়নি কখনো, যে দুয়েকজন একটু-আধটুও জানে তাদের মুজফ্ফর আর আমি আলাদা করে ক্লাসের বাইরে গাইড করার চেষ্টা করেছি। বাকিরা কিছুই জানে না প্রায়। বাংলার অবস্থাও খুবই খারাপ, তবে বোধ হয় ইংরিজির মতো অতটা নয়। ক্লাস ওয়ানে রাজীবই যাক, ওটা ও-ই ম্যানেজ করতে পারে ভালো। ... ...
সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন, বড় চৌবাচ্চায় টাইম কলের জল আসছে- উঠোন থেকে দু ধাপ সিঁড়ি, তারপর দোতলার মতই টানা বারান্দা, পর পর ঘর- কোনো ঘরের দরজা খোলা- ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে আসছিল বারান্দার দিকে। পাশাপাশি দুটো বন্ধ দরজা একতলায়, বারান্দার দিকের জানলার পাটও ভেজানো। প্রফুল্ল তাকিয়ে আছে- কপাল বেয়ে ঘাম নামছে, মাথা চুলকোচ্ছে আর চোখ পিট পিট করছে; একটা দরজা খুলে গেল আচমকা - ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে গেল অনেকখানি- প্রফুল্ল তখন একটা মেয়েমানুষ দেখ্ল সেই ঘরে- স্রেফ শায়া পরা মেয়েমানুষ- ঘরের ভেতর থেকে বারান্দার দিকে আসছিল যেন। এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল কপাট । ... ...