ঘনঘন কান্দিরপাড়ে বসবাসের মধ্যেই নজরুল-আশালতা তীব্র এক সম্পর্কের কুঁড়ি। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস। গোমতীর তীরে দুজন মানুষ মানুষী। প্রকাশ্যে চলে এল প্রেম। অন্যরকম বিরজাসুন্দরী, সাহসিনী তেজস্বিনী মায়ের মতো এই নারী নজরুলের পাশে থাকলেন না। সামাজিকতার বেড়াজাল। ছোবল। গিরিবালা একা। সঙ্গে মেয়ে। অপমান। বাড়ি থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি বিহারের সমস্তিপুরে চলে এলেন মা-মেয়ে। অন্যদিকে ব্যস্ত নজরুল আশালতার সঙ্গে ভালবাসছেন দেশকে। ধূমকেতু। নিষিদ্ধ দিওয়ালি সংখ্যায় ‘ম্যায় ভুখা হু’- মতো প্রবন্ধ লিখে ফেরার। ব্রিটিশ রোষে। একটা সময়ে কুমিল্লায় গ্রেপ্তার। ক্রমশ আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এবং কুখ্যাত হুগলী জেল – অনশন। ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ। যার দোলন খোদ দুলি অর্থাৎ আশালতা। একটা সময়ে মুক্ত নজরুল সমস্তিপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন গিরিবালা-আশালতাকে। বিয়ের সিদ্ধান্ত। তীব্র বিরোধিতা উগ্র মুসলিম সমাজ থেকে। স্বামী ইন্দ্রকুমারের অসম্মতি – উপায়ান্তর না দেখে প্রকৃতই পাশে থাকলেন না বিরজাও। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার দপ্তরের প্রকারান্তরে ‘হিন্দু’ হয়ে পড়া ব্রাহ্মদের থেকেও ক্ষোভের শিকার। প্রবাসীতে নজরুলের লেখা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। বিয়ের দিন। ... ...
অনুভব সিনহা র সিনেমাটির শুরুতে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায় সবার প্রথমে নাম উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর। "সব চরিত্র কাল্পনিক" বলে দেওয়াও আছে। দেখতে দেখতে অনেকবার মনে হবে - এই রকম সিনেমা ছাড়পত্র পেল কীভাবে? সরকার কি এতই প্রগতিশীল যে সিনেমায় খুল্লামখুল্লা সরকারী কর্মচারীদের মধ্যেও জাতপাতের নোংরামি দেখাতে দিচ্ছে। তারপর অবশ্য বোধদয় হয়। আজকাল এইসব সিনেমা সমুদ্রে এক বোতল বিসলেরি ঢেলে তাকে পেয় জল বানানোর চেষ্টার মতো। ২৮ শে জুন মুক্তি পাওয়া সিনেমা ৬ই জুলাই শনিবারের সন্ধ্যায় ফরিদাবাদের মাত্র তিনটে হলে চলছে। যেটায় আমরা গেলাম তাতে টিকিটের জন্য ৩০০ টাকা চাইল। এত দাম কেন জানতে চাইলে জবাব এল - গোল্ড ক্লাস। ... ...
কি রকম বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে পশ্চিমবঙ্গে আজ? ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে বললেন, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে হবে, কিন্তু হয়তো তিন মাস পরে। অপারেশনে কোন ইমপ্ল্যান্ট লাগবে, সেই ইমপ্ল্যান্ট ডাক্তার বাইরে থেকে কেনাতে পারবেন না, এক মাস বাদে ইমপ্ল্যান্ট সরবরাহ হলে অপারেশন হবে। তবু বিনামূল্যে চিকিৎসা র সুবিধা পাচ্ছেন অনেক গরিব মানুষই। আমার মূল ক্লিনিক হাওড়া জেলার উলুবেরিয়া মহকুমায়, রোগীরা প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ।১৯৯৫ থেকে ২০১৪ অব্দি আমার মাত্র দুজন রোগী হার্টের অপারেশন করাতে পেরেছিলেন, বাকিদের ওষুধ পত্র দিয়ে চালিয়ে যেতে হয়েছে। ২০১৪র পরে যাদের প্রয়োজন তাঁদের মেডিকেল কলেজে পাঠালে এনজিওপ্লাস্টি হয়েছে, জনা দুয়েকের বাইপাস অপারেশন ও। ... ...
বহু প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ঘটনার ধারা বিবরণী আপনারা ইতিমধ্যেই বহুবার পড়েছেন। সেই নিয়ে চর্বিতচর্বণ করার পরিবর্তে এই ঘটনার উৎস সন্ধানের চেষ্টা বোধ করি বর্তমান অবস্থায় এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। সিনিয়র এবং জুনিয়র ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন জনিয়েছেন, চিকিৎসকদের উপর লাগাতার হামলা বিশেষত গত আড়াই বছর ২৩০ টি এই ধরণের ঘটনা বহুবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সরকার কার্যত ডাক্তারদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন নি এবং অপরাধীরা কোনো শাস্তিও পান নি। সরকারি ডাক্তারদের সঙ্গে সরকারের আচরণ চূড়ান্ত অমানবিক। এমনকি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত চিকিৎসককেও স্বেচ্ছাবসরের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে কর্তৃপক্ষের হুমকি, অন্যদিকে বিভিন্ন পার্টি আশ্রিত কুকৃতিদের হামলায় ডাক্তাররা চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ফলে তাদের পক্ষে এন আর এসের এই ঘটনা 'উটের পিঠে শেষ কুটো'র মত ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হাসপাতালের পরিষেবার ৮০ শতাংশ শিক্ষানবিশ বলে চিন্হিত জুনিয়র ডাক্তারদের ঘাড় দিয়ে চলে। কিন্তু তারাও ধারাবাহিক লান্ছনার শিকার। যে কোনো রোগীর মৃত্যু হলেই অবহেলা এবং হামলার অভিযোগ ওঠে। অপর পক্ষে কান পাতলেই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে যার মধ্যে অনেকটাই সত্য। ... ...
বিজেপির ‘ভারতীয় মানব’ নির্মাণের বিপরীতে আমাদের দেশের বুর্জোয়া লিবারেল, সরকারী বাম, অনগ্রসরদের প্রতিনিধি সকল পার্টিই মনে করেছিলেন ‘সংবিধান’ হবে একটি সমকক্ষ ভাবনা। ‘সংবিধান’ অর্থাৎ “আম্বেদকর এবং তাঁর রচনা করা আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, সামাজিক ন্যায় সুরক্ষিত করা রাষ্ট্রকাঠামোটিই শেষ হয়ে যাবে বিজেপির হাতে”, এই ছিল তাদের বয়ান এবং প্রধান বয়ান। অর্থাৎ এর মধ্যে দিয়ে যাকে উঁচুতে তুলে ধরা হয় তা হল আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার ভাবনা। বলা বাহুল্য এই আইডিয়াটির গায়ে এখনো পর্যন্ত যতটা পরিমাণ আমদানি করা মালের গন্ধ লেগে আছে এবং ভারতের সিংহভাগ জনমানসে এটা এখন পর্যন্ত এতটাই অসম্পৃক্ত যে, এটার মধ্যে দিয়ে কখনই বিজেপির সাধারণীকৃত ভারতীয়ত্বের ভাবনাটিকে প্রতিহত করা যায় না। এর জন্য ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এবং ভারতবর্ষে বিকৃত এবং অসম পুঁজিবাদী উন্নয়নের ইতিহাস একান্তভাবে দায়ী। বরং বলা যায়, এই সংবিধান যে বিষয়টিকে ভারতবাসীর মনে এবং আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জগদ্দল পাথরের মতন অপরিহার্য করে তুলেছে তা হল সংসদীয় গণতন্ত্র। ... ...
ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার অর্থাৎ সরকার সমস্ত নাগরিকের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব নিক এই দাবি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রচার শুরু হয়েছিল 2013'র ফেব্রুয়ারি মাসে।শুরুতে পিপল ফর হেলথকেয়ার নামে একটি ঢিলেঢালা নেটওয়ার্ক প্রচার শুরু করলেও 2014 থেকে মূল দায়িত্ব ছিল শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ওপর। 26 আগস্ট 2015 গঠিত হয়েছিল সারাবাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি বা অল ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ ফর অল ক্যাম্পেন কমিটি। গত 23 শে জুন রবিবার শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের প্রয়াসে ক্যাম্পেন কমিটির এক শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হলো ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি হেলথ অ্যাসোসিয়েশন এর সভাগৃহে। 2017-তে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য সাথী আর 2018'র দেশ জোড়া আয়ুষ্মান ভারত এই দুটি বীমা প্রকল্প নিয়ে প্রচার রত সংগঠনগুলির বোঝাপড়া পরিষ্কার করাই ছিল শিক্ষা শিবিরের উদ্দেশ্য। ... ...
মহীনের ঘোড়াগুলির যখন জন্ম হয় তখন তাদের সামনে কিছুই ছিল না, শুধু ছিল ধু ধু ফাঁকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল আর ছিল তাদের ফেলে আসা পথের অভিজ্ঞতা। এই ফেলে আসা পথের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বিস্তীর্ণ চারণ ভূমিতে সবাই মিলে এলোমেলো ভাবেই ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোটার আরও ছিল বিভিন্ন ঘরানার জনা তিরিশেক ছুটন্ত ঘোড়া যারা মূলত ছেলেবেলায় একসাথে বেড়ে উঠেছিল কোন অঞ্চলে। ঘোড়াদের আস্তাবল ছিল নাকতলায় এবং তার দেখাশুনো করতেন আমাদের মা ও পিসি, যথাক্রমে বিভা দেবী ও রতনপ্রভা – যাঁরা স্নেহ দিয়ে, ঘোড়াদের সবরকম বেপরোয়া দুরন্তপনাকে উৎসাহ দিয়ে, তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঘোড়াদের কোন কোন বান্ধবীরাও। তারাও সমান তালে ছুটতে শুরু করেছিল দলের বিভিন্ন রকম দায়িত্ব নিয়ে। ... ...
রাগের ভেতর সাপের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঢেলে দেবে সুরের বিষ। তৃষ্ণার্ত পথিক সেই আঁচলা ভরে পান করে নেবে মৃত শহরের সমস্ত ঝরে যাওয়া শোক। দুঃখ। অভিমান। তখনই নিজেকে ঈশ্বর মনে হয়। সমস্ত না-পারার খেদ ধুয়ে মুছে চোখের জলে ভেসে ভেসে সুবর্ণরেখায় মেশে। আর সেই গভীর ধ্যান পথ হয়ে ওঠে লাল বিপ্লবের। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো মোরামের কাঁকর। খালি পা জ্বালা করে। পিচপিচ করে রক্তের স্রোত ছুটে... গানের মত? ... ...
গাউছিয়ার সোনার দোকানগুলো থেকে চান্দা তুলতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সুরা গুণ্ডা। তা প্রায় সাত বছর আগের ঘটনা। মহামান্য আদালত সুরার বিচার করে আজ যাবজ্জীবন ঘোষণা করেছে। সুরা কেবল চান্দাবাজ নয়। পুরানো রেকর্ডগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে সুরা এক দুর্ধর্ষ বোমাবাজ এবং সাংঘাতিক খুনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে বছর কয়েক আগে যে বোমাবাজি হয়েছিল এবং তাতে যে দুজন লোক মারা গেছে তার নেতৃত্ব দিয়েছিল সন্ত্রাসী সুরা। সুরা গুণ্ডা পুরো নাম কী ? টেবিলের ছড়ানো ছিটানো কাগজে নাম খুঁজে পায় কুরাণ। রইসউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী। ক্লাশ এইট পাশ। এরপর ঝরে গেছে। সুরার নীচে তিন ভাই, দুভাই দোকানপাট ব্যবসা করে। ছোট ভাইটা ইঞ্জিনীয়ার। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি। ভাইটা কাঁদে । দেশে আসতে চায় । ... ...
না, কোনও বিখ্যাত চিকিৎসক অথবা বৈজ্ঞানিক নন, এই উপাধি দেওয়া হয়েছে একটি রোগকে। সেই রোগের নাম কলেরা। এই কলেরাই আমাদের জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব ঘাড় ধরে শিখিয়েছে। এই কলেরার ভয়েই রাষ্ট্র তৈরী করেছে উন্নত পয়ঃপ্রণালী, জীবাণুমুক্ত জল সরবরাহ ব্যবস্থা। ভেবেছিলাম কলেরা রোগ নিয়ে লিখব। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন বাঙালী চিকিৎসকের কলেরা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এবং ও আর এস এর প্রচলনের ক্ষেত্রে গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দুই পর্ব লেখার পর মনে হল কুখ্যাত ব্ল্যাক ডেথ’কে এড়িয়ে যাব কি করে। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে প্লেগের এই মহামারীতে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় মারা গেছিলেন প্রায় কুড়ি কোটি মানুষ, যা ছিল এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের তিন ভাগের এক ভাগ। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা এতটাই কমে গেছিল যে পরবর্তী চারশ বছর লেগেছিল আগের জনসংখ্যা ফিরে পেতে। ... ...
এই যাযাবর থিতু হল এমন দেশে যেখানে তারা পেয়েছিল বৃষ্টির গন্ধ । মরুভূমির মধ্যে সেই সুবাস তাদের অভ্যস্ত নাক চিনে নিতে দেরি করলো না। বৃষ্টির জল ধরে রাখার কৌশল রপ্ত হল। তারা বানিয়েছে বাঁধ , জলাধার , সিরামিকের পাইপ লাইন , বিস্ময়ের পর বিস্ময়।মরু অঞ্চলে জলধারাকে তারা ইচ্ছেমত ব্যাবহার করেছে অতুলনীয় মেধা আর দক্ষতা দিয়ে। পাইপ দিয়ে , নালা দিয়ে , পাহাড়ের গায়ে ধাপ বানিয়ে সারা শহরকে জলসিক্ত করে গেছে। পেত্রা আরো রহস্যময় এই কারণে যে এখনো অনেক কিছু আবিষ্কার করা বাকি ! শিলালিপি আর গ্রাফিত্তি কতটুকুই বা ধরে রাখে ? রোমান এবং গ্রিকদের লেখা থেকে অনেক তথ্য জানা যায় , বিশেষ করে ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস আর ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবোর লেখা থেকে। তবে এই কৌশল তারা বেশ ভালো করে গোপন রাখত বলে ডিওডোরাস লিখে গেছেন। ... ...
আমার মাথা এখন কাজ করছে ক্ষিপ্র গতিতে। আমায় যেটা করতে হবে সেটা হল, ওদের দুজনকে আমার ঘরটার মধ্যে রাখা, ভল্টের থেকে টাকা বের করে আনা, এনে মেয়েটার হাতে দেওয়া, তারপর ও আরেকবার বাথরুমে গেলেই ওর ব্যাগ থেকে টাকাটা নিয়ে গ্যেটের ফাউস্টের ভেতরে আবার রেখে আসা। কার্লকে বরং ওর হাতে পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক দিয়ে দিতে বলব, যেটার কথা কার্ল বলছিল আরকি; ওটা ট্যাক্সি ভাড়ায় চলে যাবে। সকালের আগে ও নিশ্চয়ই দুশো ফ্রাঙ্কের খোঁজ করবে না; যদি সত্যিই ওর টাকার দরকার থাকে, তাহলে যেভাবেই হোক তার ব্যবস্থা করে নেবে, আর যদি তা না হয়, তবে খুব সম্ভব নিজেকে বলবে যে টাকাটা হয়তো ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছে। যেটাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা, যে অবস্থায় ও এই বাড়িতে ঢুকেছিল সেভাবেই বেরুবে — একটা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে। ... ...
সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক-অর্থনীতি বা পোলিটিক্যাল সায়ান্সের সামান্য পাঠও আমাদের অবহিত করে যে সামাজিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক সুরক্ষা বা চাকরির সম্ভাবনাহীনতা যখন প্রাধান্যকারী জায়গায় থাকে তখন একদিকে জনমোহিনী রাজনীতির সামান্য অনুদানও জনসমাজ খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চায়, আবার অন্যদিকে শূণ্যদিশা জনসমাজের প্রবল ক্ষোভ এবং অপূর্ণতা mob violence বা গণহিংসার চেহারা নিয়ে আছড়ে পড়ে। স্মরণ করতে পারি সত্যজিতের “জনঅরণ্য”, মৃণালের একাধিক ছবি, শ্যাম বেনেগাল বা গোবিন্দ নিহালনি-র বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কথা। আমরা দেখেছি নিস্ফলা ক্রোধ এবং আক্রোশ কিভাবে জনসমাজে প্রতিবিম্বিত হয়। এখানে ডাক্তারকে স্থাপন করলে দেখবো সে একজন সফল, ঈর্ষণীয়ভাবে স্বচ্ছল এবং ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এর বিপরীতে রোগীটি আর্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপযুক্ত সম্বলহীন এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে থাকা একজন ব্যক্তি মানুষ। একদিক থেকে দেখলে এ দ্বন্দ্ব ক্ষমতা এবং ক্ষমতাহীনতার মধ্যেকার দ্বন্দ্বও বটে। কিন্তু ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও একজন আমলা বা পুলিস বা শিল্পপতি বা রাজনৈতিক নেতার সাথে ডাক্তারের পার্থক্য হল একজন আমলা বা পুলিস বা রাজনৈতিক নেতা সরাসরি ক্ষমতাকেন্দ্রের অংশীদার, এর উপাদান। একজন শিল্পপতি বহুলাংশে এদের নিয়ন্ত্রক। কিন্তু একজন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে যুক্ত নয়। এবং এ অর্থে “ক্ষমতাচ্যূত”, ফলে এরা জনরোষের ক্ষেত্রে একটি soft target যাকে সহজেই আক্রমণ করা যায়, নিজেদের প্রবল ক্ষোভকে সহজে উগড়ে দেওয়া যায় এদের ওপরে। ... ...
২০১৮ সালের জুলাই মাসে অধ্যাপক পান্ডে এবং এবং তাঁর ছাত্র দেব কুমার থাপা একটি গবেষণাপত্রে ঘোষণা করেন যে তাঁরা এমন একটি পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন যা ঘরের উষ্ণতায় অতিপরিবাহী [1]। এইরকম একটি পদার্থের খোঁজ বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই করছেন, কাজেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার পরেই গবেষকমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এবং খুব ভালো কোন কাজের ক্ষেত্রে যেমন হয়, বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করতে থাকেন, যে দাবিটি যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। সেই সঙ্গতি খুঁজতে গিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে যা তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। এই বিতর্কের মীমাংসা এখনও সম্পূর্ণভাবে হয়নি, তবে ২০১৯ সালের মে মাসে ঐ একই গবেষণাপত্র আরো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এই পরিবর্ধিত সংস্করণে পূর্বোক্ত গবেষকেরা ছাড়াও আরো কয়েকজন যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই বিতর্কের আরো গভীরে ঢোকার আগে আমাদের গবেষণার বিষয়টি নিয়ে সামান্য একটু জেনে নেওয়া দরকার। সুপারকন্ডাক্টিভিটি বা অতিপরিবাহিতা খুবই জটিল তত্ত্ব, তাই আমরা যথাসম্ভব সহজ করে, যতটুকু না জানলেই নয় ততটুকুই জানবো। ... ...
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায়, উপনিবেশ গড়া যায়। কিন্তু তা দীর্ঘকালীন হবার সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চোখে আঙ্গুল দিয়ে এ সত্যকে দেখিয়ে দিয়েছে। ফলে মানসিক, বৌদ্ধিক ও চিন্তার উপনিবেশ তৈরি করাও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং চিন্তার ইতিহাস সংক্রান্ত তত্ত্ব নির্মাণেরও কারখানা হয়ে গেলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এডওয়ার্ড সইদ তাঁর সুবিখ্যাত বহু আলোচিত Orientalism গ্রন্থে দেখিয়েছেন কি বিপুল পরিমান অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে শুধুমাত্র ওরিয়েন্টালিজম-এর ধারণা নির্মাণের জন্য। আমাদের জন্য এ আলোচনায় এটা খুব প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু উল্লেখমাত্র। ... ...
অনিমেষ সচরাচর রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে আসে। গোপাল বহুদূর থেকে ওর গন্ধ পেয়ে ডেকে উঠত। সেই ডাক শুনে ভৌ ভৌ করে দৌড়োদৌড়ি করত গলির কুকুর, তারপর বড় রাস্তার কুকুররা ডেকে উঠত -মেক্সিকান ওয়েভের মত কুকুরের ডাক পৌঁছত অনিমেষের কানে। গলি টুকু প্রায় দৌড়ে ঢুকত বাড়িতে। গোপাল দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মুখ চাটত অনিমেষের। লিপি ততক্ষণে ভাত বসিয়েছে। আজ পাড়া নিশ্চূপ, গলি শুনশান -শুধু আলোর তলায় লিপি একলা দাঁড়িয়ে । লিপির দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওর কান মুখ ঢাকা শাল, ওর দীর্ঘ ছায়া, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে আসা মশা অনিমেষকে যেন সমস্ত বলে দিল এক মুহূর্তে। এমনকি অনিমেষ যেন লিপির হাতের হাতের ছেঁড়া শিকলিও দেখতে পেল যাতে গোপালের বকলশ ঝুলে রয়েছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অনিমেষ বলল- -'কখন? কষ্ট পেয়েছিল?' -'ঘরে চলো'। লিপি বলেছিল শুধু। ... ...
ঈদ উৎসবের বিবিধ উপকরণের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ঈদ সংখ্যার সাহিত্য সম্ভার। ঈদ আর ঈদ উপলক্ষ্যে তৈরি সেমাই, পায়েশ, কোর্মা পোলাও আর অন্যান্য আনন্দ সকল ফুরিয়ে গেলেও ওমর খৈয়ামের উপমার আল ধরে অনন্ত যৌবনের তীব্র সম্ভাবনা নিয়ে সাহিত্য প্রিয় পাঠকের জন্য ঈদের আনন্দ যূথবদ্ধ করে নিয়ে আসে ঈদ সংখ্যা সাহিত্যসম্ভার। সারা বছর অপেক্ষায় থাকা লেখক পাঠকের কাছে ঈদের সাহিত্য সংখ্যা ভীষণ আরাধ্যের বস্তুবিশেষ। এক সময় ঘরে ঘরে এই উৎসব কেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রথম পাঠক হবার লড়াই চলতো রীতিমত চর দখলের কায়দায়। তখনকার ঈদ সংখ্যার কারিগরিমান যেমনই থাকুক না কেন গুণগত মান আজকের চেয়ে অনেকগুণ বেশিই ছিল বলে মনে করেন প্রাচীন- বোদ্ধা পাঠক শ্রেণী। আজকের বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক তাঁদের সোনার কলমে সৃষ্টি করেছিলেন কত সব স্বর্ণালী সাহিত্য। তাঁদের মধ্যে শওকত আলী, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন, প্রমুখেরা উল্লেখযোগ্য। ঈদকে ঘিরে শিল্প সাহিত্য বর্তমানেও সংস্কৃতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। ... ...
ঈদের পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে আমার কাছে সেরা লাগে হচ্ছে ঈদের বাড়ি ফেরা। ঈদের দুই একদিন আগে কেউ যদি মফস্বল কোন শহরের বাসস্ট্যান্ডের দিকে খেয়াল করে তাহলে দেখতে পাবে ঘরে ফেরা কিছু মানুষের মুখ। এই মুখ গুলো ভ্রমণের ধকলে ক্লান্ত। সাথে কয়েকটা ব্যাগ, আণ্ডা বাচ্চা নিয়ে বিধ্বস্ত একেকজন। বাস থেকে নেমে রিক্সা নিলো হয়ত, ব্যাগ নিয়ে গুছিয়ে রিক্সায় বসার পরে রিক্সা ছেড়ে দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরে এই যাত্রীদের যে চেহারা হয় তা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ক্লান্ত কিন্তু কী একটা আলাদা আনন্দ, আলাদা সুখানুভূতি খেলা করে যায় একেকজনের চেহারায়। হয়ত ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করে কোন তরুণী, একটা ব্যাগ নিয়ে রিক্সায় ক্লান্ত চেহারা নিয়ে যখন বাড়ির দিকে যেতে থাকে তখন তার মনের অনুভূতি ব্যাখ্যা করে এমন কেউ কী আছে? ... ...
মাজুল হাসানের কবিতা ... ...
রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছিল, আনাজপাতির দাম বাড়ছিল, অটোভাড়া বাড়ছিল, চাকরির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সুমনের পুরোনো গান ভেসে আসছিল, কন্ঠ জোরে ছেড়ে খুব একটা লাভ হচ্ছিল না, কারণ আমরা হেজে গেছি। আমাদের মতো এরকম হাজার হাজার পরিবার যারা দেখেছে কিভাবে ভিড়ের মানুষ ক্রমশ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে বয়ে নিয়ে যায় উলঙ্গ রাজার পোশাক, আমরাই যারা ঝেড়েমুছে সে পোশাক পরিয়েছি বারবার রাজার গায়ে, সেইসব মানুষেরা ততদিনে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আলো আকাশের নীচে যেদিকেই হেঁটে গিয়ে তারা দাঁড়িয়েছে, তারও খানিক আগে এসে পথরোধ করেছে শস্য নয়, মাংস নয়, তাদেরই নিজস্ব ছায়া। বয়েসের তুলনায় অরুণ বড়ো হয়ে গেছিল অনেক, শুনতে পেতাম রাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়ছে, কলেজের দিনগুলো তাকে সময়ের অশনি চিহ্ন ও সংকেতগুলোর মধ্যে সমাচ্ছন্ন করে তুলছিল। মানচিত্রের গায়ে আঁকা দেশ নয়, আমাদের হৃদয়ের গভীরের দেশ পালটে যাচ্ছিল ক্রমশই। মানুষের শ্রম নয়, নিবিড়তা নয়, অন্য কোনো অন্ধকার অনুভূতিকে সম্বল করে দেশের ভেতরে এক দেশ গড়ে উঠছিল, যেখানের জল-আবহাওয়ায় আমার প্রজাতি ক্রমে দানব হয়ে যায়। ... ...