তরঙ্গার বিদায়গাথা শুনতে পেয়ে সমুদ্রের দেবতা টাঙারোয়া জেলি ফিশ, সমুদ্রের ফেনা, আর সমুদ্রের শৈবালকে পাঠিয়ে দিলেন শিশুটিকে রক্ষা করার জন্য | তারা তাকে নিয়ে গেল শিশুটির পূর্বপুরুষ টামানুই-টে-রা’য়ের দেশে | সেখানকার লোক শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলল। তারপর টামানুই মাউইকে অদেখা জগতের কত রহস্যই না শেখালেন। মাউই পাখিদের সঙ্গে কথা বলতে শিখল, পাখিরা তাকে দিল ওড়ার ক্ষমতা। মাছেরা তাকে দিল শ্বাস, মাছেদের সঙ্গে সে সাঁতার কেটে বেড়াত। হাওয়া তাকে দিল স্বর, মাটি তাকে দিল আপন পরিচয়, তারারা তাকে দিল দিকনির্ণয়ের ক্ষমতা, আর আকাশের কাছে সে পেল উচ্চাভিলাষ। যখন সে বড়ো হল, একদিন টামানুইয়ের সঙ্গে তার যুদ্ধ হল, সে-যুদ্ধে তার বজ্রের মতন দণ্ড দিয়ে সে আঘাত করল টামানুইকে, টামানুই পড়ে গেলেন। এখন মাউই হল নেতা। তখন টামানুই মাউইকে বললেন, “দ্যাখো, তুমি তো পৃথিবীকে টাঙারোয়ার দেওয়া উপহার। এবারে তুমি নিজেকে নিজে খুঁজে পাও, যাও বেরিয়ে পড়ো, সর্বত্র তোমার নাম প্রচারিত হোক মাউই-টিকি-টিকি-আ-তরঙ্গা বলে।” ... ...
এবার পুজোয় চলুন তেপান্তর। দেখুন তেপান্তরের দুর্গাপুজো। বাংলার গ্রামীণ দুর্গোৎসবের সাবেক চেহারাটি ফুটে উঠবে আপনার চোখের সামনে। মনে পড়বে বাড়ির বড়দের কাছ থেকে শোনা, পালকি নিয়ে কলাবৌ স্নান, আরতি, ভোগ, অঞ্জলি, সিঁদুর খেলা এবং বিসর্জন মিলিয়ে পুজোর চেনা ছবিটি। মন্ডপ সংলগ্ন মাঠে বাউল-ফকিরি গান, ছৌ নাচের সঙ্গে থাকবে পুরনো দিনের পুজোর সান্ধ্য অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ থিয়েটার। ভোগ ছাড়াও অতিথিদের জন্য রয়েছে খাওয়াদাওয়ার এক আন্তরিক আয়োজন। ছড়ানো সবুজ আর নানারকম পাখির ডাক আপনার মন ভালো করে দেবে। অজয় নদের তীরে সাদা বালির প্রান্তর এখন কাশফুলে ঢাকা। কাছেই রয়েছে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষিত ইছাই ঘোষের দেউল। ইতিহাস পাগল মানুষেরা চলে যেতে পারেন সেখানেও। ৪একর জোড়া এলাকায় ছড়ানো ছোট ছোট কটেজে অতিথিদের থাকার চমৎকার ব্যবস্থা। এমনিতে এখানে প্রায় ১০০ জন অতিথি থাকতে পারেন। তবে পুজোর সময় ভিড় এড়াতে এখানে ৬০জন পর্যটকদের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দশমীর দিন স্থানীয় আদিবাসীদের দাঁসাই পরব। দেখুন তাদের দাঁসাই নাচ, শহুরে সংস্কৃতি পেরিয়ে এক অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। ঘরে ফিরলেও তেপান্তর জেগে থাকবে আপনার অন্তরে। ... ...
‘বউদি অত টাকা পাবে কোথায়—।’ ‘বউদি আর পাবে কোথায়!’ মানিক হাসে, ‘বউদির অনেক কাজের বাড়ির বাবু ধরা আছে। তাদের কাছ থেকে পাঁচ দশ করে কালেক্ট করবে। মাসে মাসে আমি দিলে তাদের শোধ করে দেবে। আর সুদটা বউদির পকেটে ঢুকবে। প্ল্যান আমার ছকা ছিল। ওই হারামির বাচ্চা বাবু সাহা সব লাগিয়ে দিল মল্লিক ঠিকেদারকে। নইলে আমার সব প্ল্যান পাক্কা।’ মানিক আবারও হাসল। ‘আমাকে চুরির বদনাম দিয়ে বাড়ি চলে এল—থানায় গেল না। চুরির মাল খুঁজল না। শুধু হল্লা, নে সাহস থাকে আমাকে পুলিসে দে। দু দুটো টুলু পাম্প, আচ্ছা আমিও ছাড়ব না। ওরা ভয় পেয়ে গেছে রূপা বুঝেছে—আমি যদি ঠিকেদারি লাইনে নামি ওরা আমার সঙ্গে পারবে না।’ রূপার মনে হল, মানিক ঠিক কথাই বলেছে, সত্যি সত্যি চুরি হলে ওরা থানা পুলিশ করত না—ছেড়ে দিত? কেউ ছেড়ে দেয়? ... ...
কৌশিক বাজারীর চারটি কবিতা ... ...
১৯৭৫। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন দুই তরুণ। দুনিয়া ঘুরে দেখার আগে সাঙ্গ করছেন ভারতভ্রমণ ইন্দিরা গান্ধির পরামর্শ মতো। সাইকেলে। কিছু পরে হাল ছাড়লেন দ্বিতীয় জন। ঘুরতে থাকে তৃতীয়জনের সাইকেলের চাকা। ১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪ টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। এ পর্বে দিল্লিতে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় আর শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের স্নেহের স্মৃতি। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা। ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হবে আফ্রিকার গভীরে অভিযান। আপাতত তিনি সেই শহরে। স্থানীয় ব্রিটিশ কনসালকে একদিন প্রশ্ন করলেন—লিভিংস্টোন সম্বন্ধে আপনার কী মনে হয়, এখন তিনি কোথায়? তারপর? স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। তরজমায় স্বাতী রায়। ... ...
চলছে খিচুড়ি মহারহস্য অ্যাডভেঞ্চার। জাহাঙ্গির নন, মুঘলাই শাহি দস্তরখওয়ানে খিচড়ির রমরমা মহামতি আকবর বাদশার জমানা থেকে। কিন্তু তেমন খিচুড়ি আর কোনও দিন রসনা-রসিকের পাতে পড়বে না। গৃহস্থালি, ভোজবাড়ি, রেস্তোরাঁ কোত্থাও তা আর মিলবে না। ভ্যানিশ! নীলাঞ্জন হাজরা। ... ...
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে। চোখের সামনে আকাশ ধীরে ধীরে বেগুনি হয়ে ওঠে। আলতা রঙের পোঁচ পড়ে তার উপর। শুধু জনারণ্যে কিছু ঘুড়ি, পাখিদের প্রতিনিধি। গঠন নয়, ঘুড়ি চেনা যায় তার উড্ডয়ন-কৌশলে। উদ্বাস্তু কলোনি থেকে চাক চাক ধোঁয়া, যেন নোয়াঠাকুমার আর্তি, খুঁজে নেয় আলপথ—ফরিদপুর। তাদের গতিপথ বিভ্রান্ত সরল, অর্থাৎ বক্র। গুলের আঁচ ওঠা উনুন—খানিক উপরে বুড়ির দু'টো চোখ আর ফুলে ওঠা টিকোলো নাক এক প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে, যা আকারে ক্রমশ বড় হতে থাকে। মাথার ভিতর শৃঙ্খলিত ধ্বনি, রঙ আর হঠাতই কালো হয়ে ওঠে আকাশ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু, সব সত্যি। সবচেয়ে বড় সত্য এই রাত, তার বেদনা, যা কেবল অনুবাদে সাবলীল... কুকুরেরা জেনে গেছে সব। সন্ধ্যার আজান আর মিলিটারি রুট মার্চ পরপর শুনে নমনীয় করে তোলে নিজেদের। স্থির হয়। সঙ্গম স্থগিত রাখে আজ। ... ...
মানসের গলায় কী কিছু উত্তেজনা ! তার হাতের সংকেতে মাথা ডাইনে বাঁয়ে ঘোরায় রিণি। সত্যি বাঁ দিকে বিশাল বেনাবনের কতো কিলোমিটার ভেতরে কে জানে দেখা যাচ্ছে এক ভৌতিক উচ্চতা। যেন এই রোদের আঁচে দূরবর্তী নদীর দিক থেকে ছুটে আসা উষ্ণ বাতাসে লি লি করে কাঁপছে সেই মন্দিরের চূড়ো। রিণি আর তার মাঝখানের প্রান্তর জুড়ে শক্ত মোটা বেনাঘাস। সে শুনতেই ঘাস,দেখতে সরু বাঁশের মতোই গুল্ম,শক্ত আর ছুঁচলো। ভেদ করে যাওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ইয়াকুব বলল,বাগালরা গরু চরাবার অসুবিধের জন্য প্রায়ই নাকি শুকনো বেনাঘাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তা হলে অবশ্য অতটা দুর্ভেদ্য হবে না। ... ...
টেবিলে আমার স্ত্রী সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “শ্রাবন্তী কে?” আমি অবাক হয়ে গেলাম এই প্রশ্নে। আমিও জিজ্ঞেস করলাম, “শ্রাবন্তী কে?” এবং এরপরেই আমার মনে পড়ল শ্রাবন্তী কে। এ নিয়ে আমাদের কথা কাটাকাটি হতে লাগল। আমি আমার বউকে বোঝাতে পারছিলাম না যে শ্রাবন্তী আমার লেখার একটা চরিত্র। লেখার ড্রাফট দেখিয়েও আমি তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। সে বলল, অনেকবার সে বেইজমেন্টে এসে দেখেছে আমি এই মেয়ের সাথে কথা বলছি। তার কথা মিথ্যে নয়। আমি এরকম অনেক কথা বলেছি ওই মেয়ের সাথে। এবং সৎ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ওই মেয়ের প্রতি আমার বড়ো রকম দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। কারণ সে ঠিক আমার মনের মতো। এটা কি আমার লেখার চরিত্র সেই জন্যে? কেবল লেখার চরিত্র হলে সে কীভাবে উঠে আসবে? এইভাবে হাসবে, আর আমার পাশে বসে আমারই লেখা নিয়ে এমন সব কথা বলবে যা আমি নিজেও কখনও ভাবিনি? এসব নিয়ে আমি নিজেও দ্বিধায় ছিলাম। এর মধ্যে শুরু হল বউয়ের সাথে ঝামেলা। ... ...
আমাদের ছেলেবলায় যখন দূর থেকে দেখতাম দুটি ছেলে আসছে তখন কথা না বলেই তাদের শিক্ষা দীক্ষা টের পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় ছিলো ছোটো ঢিল ছুঁড়ে মারলেই যে উঃ বলতো সে পাতি বাংলা মিডিয়াম, আর আউচ বললে জানতাম এ তো কোনো সেন্ট মার্কা স্কুলের ছেলে। ৭১' বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ছেলে পিলে এসেছিলো এপাড় বাংলায়। একটা বড় গ্রুপের সাথে আলাপ হয়েছিলো। নাম বলতেই সহাস্যে ঝুঁকে পড়ে হ্যান্ড শেক করে জিগালেন 'আপনি কেমন আছেন'? আমি তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হই, বলি পেট কামড়াচ্ছিলো, ভুটভাট, তো এখন ভালো আছি। তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ওম্মা, দ্বিতীয় ও তৃতীয়্জনও একই কায়দায় আলাপ করার পর টের পেয়েছিলাম উটি আসলে হাঊ ড্যু উ ড্যুর বাংলা সংস্করণ। এখন বোধহয় তাও নেই। উদাসীন হাই আওয়াজ ওঠে দু পক্ষেই। নমস্কার আর কে কবে করে? ... ...
সেপ্টেম্বরের এক রাত্রিবেলা যাদবপুর শ্রমজীবী ক্যান্টিনে স্বেচ্ছাশ্রমিকরা প্যাকেট তৈরির কাজ শেষ করে ক্যান্টিন থেকে বেরোচ্ছে, তখন তিনি এলেন। দরজার সামনে রাস্তার ওপর জটলার মাঝে এসেই বললেন- 'আপনারা কি কমরেড?' সম্মতিসূচক উত্তর পেয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে রেড স্যালুট দিয়ে জানালেন - 'আমিও কমরেড।' ... ...
বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য ব্যতিরেকেই বলতে পারি সংকটের সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস বাংলার সমাজে আছে এবং তা পাপপুণ্যের ভাবনার বদলে সামাজিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করার বিষয়টাই বাঙালির মনে ঢুকে আছে। অতীতেও দেখেছি হরেক কিসিমের সামাজিক সংগঠন, বিদ্যালয়, ক্লাব, রাজনৈতিক দল কিংবা গণসংগঠন এই কাজে নেমে পড়ে, হয়তো বা কোনো রাজনৈতিক দিশা ছাড়াই। ... ...
আগে লকডাউন, পরে আমফান। পরপর দুই ভয়াবহতায় আক্রান্ত বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেল বহু মানুষকে। এ ব্যাপারে কেউ অভিজ্ঞ, কারও প্রথমবার উদ্যোগী হওয়া। সব মিলিয়ে সোশাল নেটওয়ার্কে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব হাত ধরার ছবি। এরকম উদ্যোগ ছিল অসংখ্য। সেসব উদ্যোগের প্রত্যেকটিই অন্তত পৃথক রচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। এখানে কেবল কয়েকটিমাত্র তেমন উদ্যোগের কথা বিধৃত থাকল, রইল না অনেক বেশি সংখ্যক উদ্যোগের কথা। এ বাছাইয়ের কোনও নির্দিষ্ট হেতু নেই, সাধ্য ও সাধের ফারাকই রয়েছে কেবল। ... ...
আগের পর্বে বলেছিলাম, বিশিষ্ট শিক্ষকদের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছি এই শিক্ষানীতির ওপর তাঁদের মতামত নিয়ে। কারণ আমার মনে হয়েছে, এই গবেষণামূলক প্রবন্ধটির জন্য একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের মতামত জানা। তাঁদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যবহারিক জীবনে এই প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ভূমিকা তাঁরা সর্বতোভাবে অনুধাবন করতে পারেন। তাঁরা নির্ণয় করতে পারেন যে কীভাবে ও কতটা এই প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি কার্যকর করা যায়। অতএব, আমি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতা শহর এবং জেলা থেকে দুজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে আমার প্রশ্নমালা পাঠিয়েছিলাম। অনেক কর্মব্যস্ততার মধ্যেও যে তাঁরা আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য সময় বার করতে পেরেছেন তার জন্য আমি তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ... ...
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে যে সেলফের বিষয়টা আদতে আধুনিক। আজকের আধুনিক মানুষ যেভাবে তার সেলফ নিয়ে ভাবে মধ্যযুগের রাজা বা দাসেরা কিন্তু সেভাবে ভাবিত ছিলেননা। আধুনিক যুগের একদম গোড়ায়, মোটামুটি ১৫০০-১৮০০ শতকের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক সেলফের একটা পার্থক্যের ধারণা গড়ে উঠতে থাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে মূল্য দিতে আর মানবিক বিকাশ ও পরিবর্তনের ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে যে “know thyself” এর ধারণা গড়ে উঠেছিল সেটা ছিল একজনের প্রতিভা আর দক্ষতাকে সঠিকভাবে যাচাই করার জন্য যাতে সে তার কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং উপযুক্ত বিচার করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। একে আজকের আধুনিক মানুষের সেলফের ধারণার সাথে এক করে দেখা যায় না। ... ...
অ্যাম্বুলেন্সের বদ্ধ জায়গার মধ্যে একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পুরো ব্যাপারটা মিটে যায়। প্রথম রাতে ডক্টরস' কেবিন খালি পাওয়া যায় নি। জেনারেল ওয়ার্ডেই রাত্রিবাস। আহা! 'জেনারেল ওয়ার্ড' বলে নাক শিঁটকোবেন না যেন.. এই হাসপাতালের 'জেনারেল ওয়ার্ড' বহু কর্পোরেট হাসপাতালকে গুনে গুনে খান পাঁচেক গোল দেবে। এসি ওয়ার্ড, দামী বেড, পরিষ্কার চাদর, পাশে ড্রয়ার সহ র্যাক। বেডগুলোর মাঝে ছ'ফুটের বেশি দূরত্ব বজায় রাখা। সিল করা পানীয় জলের বোতল, কৌটোয় সাজানো খাবার, দু-বেলা চা। সাথে স্টাফেদের আন্তরিক ব্যবহার। নিজের কথা বলছি ভেবে বাঁকা হাসি দেবেন না। সবার কথা ভেবেই বলছি। যেহেতু সাথে বাড়ির লোক কেউ নেই তাই বয়স্কদের বকেঝকে নিজেদের হাতে করে খাইয়ে দেওয়া, সময়মতো ওষুধ-জল পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি সবটাই অত্যন্ত দক্ষতা আর মানবিকতার সাথে তাঁরা করে চলেছেন। নিয়মিত জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তাররা দেখভাল করছেন। সবটাই ওই পিপিই-র অসহ্য কষ্ট নিয়ে। প্রাথমিক অব্যবস্থা কাটিয়ে সরকার কোভিড নিয়ে যে রকম ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছেন তাতে তাঁদের অকুন্ঠ প্রশংসা প্রাপ্য। এখনো অনেক অভাব, অনেক অভিযোগ আছে জানি। তবু, এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা যতখানি করেছেন সেটাও অনেক। ... ...
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে (এখানে ইউরোপ ধরে নিতে হবে) ১৮৪৮-এর রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন (বিশেষ করে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে) স্বাস্থ্যের জন্য একটি জাতীয় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। নতুনভাবে জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আইন-কানুন, সোশ্যাল মেডিসিন এবং এপিডেমিওলজির মতো স্বাস্থ্যের নতুন শাখা তৈরি হল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল মেডিসিনের দর্শনের জগতে – নতুন করে বিশিষ্টতা পেলো প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বা আগাম রোগ-প্রতিরোধের বিষয়। টমাস কুনের অনুসরণে বলা যায় মানুষের গণ আন্দোলন এবং স্বাস্থ্যের দাবীতে সোচ্চার হওয়া মেডিসিনের দর্শন ও ভাবনার জগতে একটি “প্যারাডাইম শিফট” ঘটালো – বেড সাইড মেডিসিনকে অতিক্রম মেডিসিন এলো জনসমাজে এবং জনস্বাস্থ্য একটি আলাদাভাবে চিহ্নিত অবস্থান হল। ... ...
ভারতবর্ষের সংবিধান যখন লেখা হয় তখন হাতে ছিল আমেরিকা (১৭৭৬ সাল), আয়ারল্যান্ড(১৯৩৭ সাল) এবং ইউনাইটেড নেশন চার্টারের (১৯৪৫ সাল) অন্তিম পান্ডুলিপি । ফলে ভারতের সংবিধান পাশ্চাত্য প্রভাবে যে ভাষায় লেখা হল তা আধুনিকতম গণতন্ত্রের উচ্চারণ করেছিল ঠিকই । কিন্তু, ভারতবর্ষের ভাবমননে অধিষ্ঠিত ছিল সনাতনী ধারার প্রবাহ । যে ধারা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা সম্রাট অশোক কিংবা আকবর এঁদের মধ্যেও একটা গণতান্ত্রিক মনোভঙ্গির স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিল, কেননা এঁরা গায়ের জোরের চেয়ে ন্যায়পরায়ণতাকে বেশি মর্যাদা দিতেন । গান্ধীজীর মধ্যেও এই ধারার একটা প্রভাব দেখা যায় যখন তিনি কংগ্রেসকে বলেন, “স্বাধীনতা কংগ্রেস পায়নি, পেয়েছে ভারত । মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে সবচেয়ে দক্ষ লোকেদের দিয়ে, তাঁরা যে-পার্টিরই লোক হন”। তাই যতই নেহেরুর প্রধানমন্ত্রীত্ব বিনা-গণনির্বাচনে স্থির হোক স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারায় ডাক পড়েছিল সকলের । এমনকি আর. কে. ষন্মুখম চেট্টি, বি. আর. আম্বেডকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মত ব্রিটিশ-অনুরাগী মানুষেদেরও। গান্ধীজীর অভিভাবকত্বে মন্ত্রীসভা গঠনে উদারতায় ত্রুটি ছিল না, অন্তরে শুধু অভাব ছিল গণতান্ত্রিকতার। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই ঔদার্যটুকুর কথাও বেমালুম ভুলে গিয়ে জাতীয়তাবাদের আড়ালে বর্বরতার রাজত্ব কায়েম হয়েছে । নেতৃবর্গের মধ্যে এক ধরণের অদ্ভুত প্রবণতা দেখা গেছে ও যাচ্ছে - পথপ্রদর্শকের ভূমিকা ছেড়ে ক্ষমতালোভী রক্তচক্ষু বাহুবলীর ভূমিকায় উত্তরণ । ... ...