আমি আর ঠাকুমা পা চালিয়ে সাহাপাড়া ছেড়ে গৌর-নিতাই আঙিনার দিকে এগোই। রাস্তার দু-পাশে তাঁতঘরে মাকুর টানা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। বসাকপাড়া ঢুকতেই পিসিঠাকুমার আঙিনা দেখা যায়। ওই তো কুটিপিসি উঠোনে চরকি নিয়ে বসে গেছে। কুটিপিসির কাছে এলেই সোনালি জরির ভাঙা ববিনটা আমার হয়ে যায়। ... ...
মনে পড়ে গেল পরের কথা। বলেই নিই। এখন ফেব্রুয়ারি চলছে। ২১ আসছে। আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা দিবস। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার আগে যত না বাংলাচর্চা ছিল, এখন তা কমেছে। ক্রমশ কমেছে। বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব কম আমাদের এখানে যত সরকার এসেছে, সকলের। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, বা বর্তমান সরকার কেউ বাংলা ভাষাকে আলাদা ভাবে মর্যাদা দেয়নি। ১৯৯৩ সাল ছিল বাংলা ১৪০০ সালের আরম্ভ। নতুন শতাব্দী। আমরা একটি আন্দোলন করেছিলাম, সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার, কলকাতা সহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা স্কুলশিক্ষায় আবশ্যিক করা, বাংলা ভাষাকে দূরদর্শনে হিন্দি ও অন্য ভাষার সম-মর্যাদা দেওয়া। তখন কেবল টিভি আসেনি। দূরদর্শন ভরসা। দূ্রদর্শনে বাংলার সময় কমিয়ে দিয়ে হিন্দির আধিপত্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই আন্দোলনের কথা লিখিত থাকা উচিত। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক আশিস ঘোষ, এবং সমাজকর্মী রতন বসু মজুমদার ছিলেন আন্দোলনের নেতৃত্বে। আমি ছিলাম, আফসার আমেদ ছিলেন, প্রবুদ্ধ মিত্র, কবি গৌতম চৌধুরী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সব নাম এখন আর মনে নেই। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির উদ্যোগে এই আন্দোলন। আমরা দূরদর্শনের সামনে ধর্না দিয়েছিলাম মঞ্চ বেঁধে। স্মারকলিপি প্রদান করেছিলাম। দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে একটি অপূর্ব অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেখানে আমজাদ আলি সরোদে ‘আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…’ বাজিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। এই আন্দোলন সমস্ত কলকাতায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমি শিয়ালদা স্টেশনে পথসভায় বক্তৃতা করেছিলাম। আমাদের আন্দোলনের চাপে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তখন আমি আলিপুরে চাকরি করি সদর মহকুমা ভূমিসংস্কার আধিকারিকের দপ্তরে। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (বর্তমান মুখ্যসচিব) ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক, অতিরিক্ত জেলা শাসক ( ভূমি সংস্কার )। । তাঁর একটি অসামান্য গুণ, এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেও একটিও ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করবেন না। তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এই কাজের দায়িত্ব। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাঁর সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হতে চাই কি না। যুক্ত হয়েছিলাম। আমাদের প্রথম কাজ ছিল পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্লক অফিসে কত বাংলা টাইপ রাইটার লাগতে পারে এই কাজের জন্য, তা হিসেব করা। কম্পিউটার আসেনি তখন। তারপর পরিভাষা তৈরি। বাংলাদেশে পরিভাষা তৈরি আছে, তার সাহায্য আমরা নিতে পারি। কত মিটিং করেছি আমরা। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরেও গিয়েছি। তারাপদ রায় তখন ডিরেকটর অফ কালচার। তিনিও পরামর্শ দিতেন। কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজে আমাকে যুক্ত করে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আদেশনামা বের করতে উদ্যোগী হলেন। এক সকালে অফিসে গিয়ে শুনি এডিএম (এলআর) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এডিএম (জেলা পরিষদ) করে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ... ...
সুদেশের বাড়ি সারপেন্টাইন লেনে। মিনিট তিনেক হেঁটেই ওরা পৌঁছিয়ে যায়। ঠিক এরকম বাড়ি কখনও দেখেনি জয়ি। ছোট দরজাটা প্রায় রাস্তার ওপর। সেটা দিয়ে ঢুকলে সামনেই একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা সিমেন্টের, যথেষ্ট অপরিসর, এবং পুরোপুরি শুকনো নয়। সিঁড়িটার আংশিক ভিজে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগে না। সিঁড়ির পাশেই একটা খোলা জায়গা, জায়গাটা ভিজে, এবং সেখানে দু-তিনটে লোহার বালতি। খোলা জায়গাটার শেষে প্লাস্টার-খসা যে দেয়ালটা ওপরে উঠে গেছে, রং-চটে যাওয়া সেই দেয়ালের নীচের অংশে খানিকটা ক্ষয়ে যাওয়া একটা দরজা। বোঝা যায় ওটার ভেতরটায় স্নান করার জায়গা, যেখানে কোন জানলা আছে বলে অন্তত বাইরের থেকে বোঝা যায় না। খোলা জায়গাটা ভেজা কেন, এবং কেনই বা ওখানে বালতিগুলো, সেটা বোঝা যায় এবার। ... ...
সব ছবি দেখার পর সে একটি ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো৷ ছবিটার গভীরতা দেখে যেন পাথর হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য৷ নরকের দৃশ্যায়নের ছবি৷ কুৎসিত মুখশ্রীর শয়তান উপভোগ করছে কোন এক পাপীর উপর অত্যাচারের ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যে নিজে তার জীবনকালে নানা পাপে নিমজ্জিত ছিল৷ ... ...
ধর্ম যেরকম, কেউ চাইলে মুসলমান থেকে হিন্দু হতে পারে কোর্টে গিয়ে কাগজপত্রের বিধান নিয়ে। তারপরে ধরুন কেউ ভারতীয় থেকে ক্যানাডিয়ান হয়ে যেতে পারে যেমন অক্ষয় কুমার হয়েছে। কেউ আবার ব্রিটিশ থেকে ভারতীয় হয়ে যেতে পারে, যেরকম এককালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী জেবিএস হ্যাল্ডেন হয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি থেকে মাড়োয়ারি হওয়ার কোন কাগজ হয় না কারণ এটা অসম্ভব, তাই বাঙালি হচ্ছে একটি জাতি। ... ...
যদি নিজের জাতির হয়ে কথা বলা প্রাদেশিকতা হয়, তাতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যাঁরা লড়েছেন, তাঁদের কেউ বিপ্লবী বলেছেন, কেউ আতঙ্কবাদী, সুতরাং ওতে কিছু যায় আসেনা। ... ...
গোড়াতেই বলে নিই বাঙালি তিনটে সেগমেন্টে বিভক্ত, ভদ্রলোক ছোটলোক এবং মুসলমান। সেটা কিন্তু যেহেতু ছোটলোক শ্রেণির অন্তর্গত যে বাঙালি, তাদের কাছে বাঙালির ধারণা খুব অপরিষ্কার, বিশেষ করে এই ছোটলোক এবং মুসলমান দুই ধরনের বাঙালির কাছেই। ... ...
প্যারিস। শুধু ছবির দেশ, কবিতার দেশই নয়। চমকে দেওয়া আভঁ গার্দ নাটকের দেশও। তেমনই নাট্যকার আরিয়ান মুশকিন। আজব তাঁর নাট্যশালা। সবাইকে সব কাজ করতে হয়। শৌচালয় পরিষ্কার, আহার প্রস্তুত, পোশাক বানানো, নিজেদের সাজিয়ে তোলা, মহড়ায় থাকা আর মঞ্চ নির্মাণ, সব কর্মে পটু হওয়া আবশ্যক। পোশাকি নাম—Theatre du Soleil। সূর্যের থিয়েটার। হিরণ মিত্র ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ কিস্তিতে এম্সুওয়া নামের একটি গ্রাম পর্যন্ত যাত্রার কথা। তরজমায় স্বাতী রায় ... ...
পিয়ারডোবা— বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর সংলগ্ন একরত্তি গঞ্জ। পরিমলদা-র দোকান— একরত্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। অর্ধশতক পার। সিগনেচার মিষ্টি— ল্যাংচা। বিশেষণ — পরমান্ন। নির্মাণ-রহস্য — অভিজ্ঞ শিল্পীর হাতের জাদু এবং দুধ, ঘি ও ছানা সম্পূর্ণ নিজস্ব। লুকো-ছাপার বদমাইশি নেই। যে-কোনও দিন গিয়ে দেখা যায় সেই শিল্পনির্মাণ। গন্ধ-বর্ণ-স্বাদের তীব্র উৎসব। নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
শুধু বলি, স্পষ্টভাবে বলুন - যা বলতে চাইছেন, দায়িত্ব নিন। উত্তরটি গ্রহণযোগ্য না-ই হতে পারে - সর্বজনগ্রাহ্য তো কখনোই হবে না - তবুও, স্পষ্ট অবস্থান ও উচ্চারণ জরুরি। শুধুই নেতি নেতি করে আধ্যাত্মিক সত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকলেও, রাজনৈতিক লক্ষ অর্জন মুশকিল। বিরোধিতা করার মুহূর্তে বিরুদ্ধ কোনো একটি দলের পক্ষে বোতাম টেপা জরুরি। আমার পক্ষে সেই বোতাম বামেদের - আপনি সিদ্ধান্ত নিন, সেই বোতাম কাদের। ... ...
সারা দেশ জুড়েই এক ফ্যাসিস্ট আবহাওয়া বিদ্যমান। সেই রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় অন্য দল থাকুক না কেন, কেন্দ্রের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে সমস্ত রাজনৈতিক দল, শাসক অংশ একমত। মানবাধিকার লঙ্ঘন সমস্ত শাসকের কাছেই অতি প্রিয় একটা বিষয়। ... ...
টোটোদের না-পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা খানিক সামাল টোটোরা দিতে পেরেছেন নিজেদের চেষ্টায়। কিন্তু আজও বর্ষার দিনে হাউরি, বাংরি, তিতি নদীতে পাহাড়ি স্রোতের ঢল নামে। নদীগুলির উপর সেতু না থাকায় বর্ষার দুর্যোগে টোটোরা বিচ্ছিন্ন থাকেন সংলগ্ন শহরাঞ্চল থেকে। ভোটের আগে আর্থসামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির একাধিক প্রতিশ্রুতির কথা শুনে আসছেন টোটোপাড়ার বাসিন্দারা। ... ...
এখন বুঝতে পারি যে সেবার কানকুনে গিয়ে আমি এই ভিন্নায়নেরই জালে পড়েছিলাম। সেখানে সবই আছে, একেবারে দস্তুরমতো, ঝাঁ-চকচকে, কিন্তু, আমি যেন থেকেও নেই। আমি যেন সব পেতে চাই, কিন্তু কোথায় যেন বাধে। আমার একইরকম পোশাক-পরিচ্ছদ, একই বুলি, একই পড়াশুনো, একই গবেষণা - তবুও আমি আর সবার থেকে দূরে, আর সবার থেকে ভিন্ন। দস্তয়েভস্কির লেখায় যেন এক ভিন্নায়িত মানুষেরই মনের গোপন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ভয়মিশ্রিত বিস্ময়বিষাদের অনুরণন ধরা পড়ে। ... ...
পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার বক্তব্যে প্রাধান্য পায় দাঙ্গা এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা। এই দেশের রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের সচেতন ব্যবহার যে কতটা জরুরি এবং সেই সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সৎ স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কতটা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে প্রসঙ্গও উঠে আসে। ... ...
গৌরী লঙ্কেশ। হিন্দুত্ববাদীদের ষড়যন্ত্রে নিহত অকুতোভয় সাংবাদিক। তাঁর আটটি নিবন্ধের বাংলা তরজমা ও সঙ্গে লেখকপরিচিতি। আবেগের প্রকাশ এবং প্রয়োজনের তাগিদ— এ দুয়ের সমন্বয় ঘটানোর দুরূহ কাজটি সুসম্পন্ন হওয়া একটি জরুরি বই। পড়লেন মীরাতুন নাহার ... ...
মারিও বেনেদেত্তি। উরুগুয়ের সাহিত্যিক। লেখার জগত বহুধা বিস্তৃত। প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান রচনা, গান গাওয়া সব দিকে ছড়িয়ে আছে তাঁর প্রতিভা। রয়েছে একাধিক বহুল পঠিত ও প্রশংসিত উপন্যাস। তবে হিস্পানিক সাহিত্যে ছোটো গল্পের সম্রাট। ১৯৭৪-এ সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে বহু বছর। লিখছেন স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক ও তরজমাকার জয়া চৌধুরী ... ...
হাট। বাঙলার গ্রামীণ ও গঞ্জ-সংস্কৃতির এক দুরন্ত জমায়েত। হরেক কিসিমের সামগ্রী কেনা-বেচা সেই বিচিত্র ক্রিয়াকাণ্ডের একটি অংশমাত্র। তবেই না হাট ঘিরে এমন অজস্র প্রবচন মুখে মুখে ফেরে বাংলা ভাষায়। নদীয়ার হাটের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বোনা এক রঙিন সাংস্কৃতিক ছবি। একটি বই। পড়লেন রামামৃত সিংহ মহাপাত্র ... ...
একসাথে থাকতে গিয়ে ধর্ম কখনও মাঝখানে এসে দাঁড়ায় নি। মতান্তর হয়েছে অনেক সময় অনেক বিষয়ে, যেমন অন্য যে কোন পরিবারে হয়। তাই বলে কেউ কারো ধর্মীয় মত অন্যজনের ওপর চাপিয়ে দেয় নি। ঈদ বা দুর্গাপুজো দুজনের কাছেই ছিল উৎসব। ... ...
সেই পাচক মাশরুম, শৈবাল আর শামুক দিয়ে তৈরি চমৎকার খাবার বানিয়ে সেই বিধবার নজর কেড়ে নিল৷ অনেকে বলে সে সেই খাবারের মধ্যে নেশা বা সম্মোহন সৃষ্টিকারী কিছু মেশাত। অবশ্য এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। ... ...