আমরা কাকের ডাক শুনছি। আমি আর ঝুনু। আর কোনো পাখি নেই, একটাই কাক কেবল কাঁটা কুলগাছের ডালে। ছাদের কার্নিসে বসে দু’জন তাকিয়ে আছি পশ্চিম আকাশের দিকে। গাঁথনি করা দুটো ফ্ল্যাটবাড়ির তরতর উঠে যাওয়ার ফাঁকে খণ্ড আকাশ, কয়েকটা লাল আঁচড় তার গায়ে। এত মন দিয়ে আমরা শেষ কবে কাকের ডাক শুনেছি? কাকটা একবার করে ডাকছে, পরের ডাকের আগে এক দীর্ঘ নিশ্চুপ। সেই স্তব্ধ আমাদের ভেতর অস্থির করছে। আমি একটা খুন করতে যাচ্ছি। ... ...
সে পেছন দিকে আর না তাকিয়ে একা উস্কোখুস্কো হয়ে যবুথবু পা ফেলতে থাকে রেল লাইন ধরে। তার ডানহাতের দিকে রেল পাঁচিল আর কয়েকটি ভাঙাচোরা রেল কোয়ার্টার, কোয়ার্টারগুলো এখন মালিকানাহীন ভূতুড়ে আস্থানা; কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, মনে মনে বলে সে “হে আল্লাহতালা! যেসব ডাক্তাররা আমার কালুয়ার চিকিৎসা ঠিক মতো করেনি; তাদের তুমি হেদায়েত দান করো, ক্ষমা করে দিও তাদের।” ... ...
এ তল্লাটে কে না জানে, আজুদের বাড়ির পাশের ঢিবির উত্তর পশ্চিম কোণে চালা পড়ো পড়ো ভিটেয় ঘাপটি মেরে বাস-করা আকালু আসলে এক ভয়ানক গুনিন। যতো গরু ছাগল মরা বাচ্চা বিয়োয়, যতো মেয়েছেলের অসময়ে গর্ভজল খসে, সবের পেছনে ঐ আকালু শালা। ওর নজর পড়লে ফলন্ত লাউ কুমড়ো অব্দি বিলাই কুত্তার শুকনো নাদির মতো খটখটে হয়ে যায়। আবার ভ্যান চালানো ছেড়ে দিয়ে কেউ যদি বিপুল বিষয়আশয়ের মালিক বনে যায় রাতারাতি, ঠিক জানবে তার পেছনে রয়েছে আকালুর দেওয়া মাদুলি আর কবচের কেরামতি। ... ...
কিছু ঠিকই, কিন্তু সেই কিছুটা কী? খুলেই দেখা যাক, বলতে বলতে বাটিটা তুলে নিয়ে চাপা দেওয়া থালাটা সরিয়ে দেয় নজরুল। এক বাটি আলুর দম, কড়া মশলায় বেশ লালচে দেখাচ্ছে। দে গোরুর গা ধুইয়ে – উচ্ছ্বসিত নজরুলের চিৎকৃত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাহ্মুদের দোকান থেকে রুটি নিয়ে আয় শৈলজা, রাত্তিরের ডিনারটা জমে যাবে। তারপর মোহিতলালের দিকে ফিরে বলে, স্যার, ক’খানা রুটি আপনার জন্যে? ... ...
আমরা কি অপরাধী? এমনটা গোয়েন্দা সিনেমাতে দেখেছি। যন্ত্রের মত মানুষেরা এসে মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। কোনো কথা নেই। পাখিরা ডাকে না সেখানে। আকাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মত। ষোল বছর বয়েসে সন্ধেবেলা বিনা বাতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে বরানগরের স্কুল থেকে পাইকপাড়া ফেরার পথে চিড়িয়া মোড়ে পুলিশ আমাকে ধরে। অতি স্নেহের সঙ্গে, “এ ববুয়া, বতিয়া বিনা সাইকিল চলাতে হো?” – এই বলে সাইকেলটি বাজেয়াপ্ত করে থানায় জমা করে। সেটি যে থানার জিম্মায় রইল, সেই মর্মে স্বাক্ষরিত একটি চিরকুট হাতে নিয়ে দমদম রোড ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরি। পরের দিন শিয়ালদা কোর্টে দশ টাকা জরিমানা দিয়ে সাইকেল ফেরত পেয়েছি। সে পুলিশকে দেখে ভয় হয়নি। এখানে হল। কোনো অপরাধ না করেও। চিড়িয়া মোড় থানার পুলিশের মুখটা মানুষের বলে মনে হয়েছিল। ... ...
তা এই নাটক নিয়ে লেগে গেল গণ্ডগোল। তখন সিপিএমের পরিচালন সমিতি পরাজিত। কংগ্রেস ও আর এস এস জোট জিতেছে। স্কুল চালান কার্যত আর এস এস নেতা জগজ্জ্যোতি মিত্র। তিনি ১৯৮৩তেই পুরস্কার হিসেবে বাছাই করতেন-- 'তাজমহল কি হিন্দু মন্দির' গোছের বই। বাংলায় প্রথম হলে এই বই বাঁধা পুরস্কার। তা জগজ্জ্যোতি বাবু বললেন এই নাটক রাষ্ট্রবিরোধী। করা যাবে না। সৌম্য সৌমেন ওরা কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে। ওঁরা জেদ ধরল, এই নাটকই হবে। নাটকটা খারাপ কিনা বলুন। সৌমেন সৌম্য দুজনের বাবাই পরিচালন সমিতির সদস্য। তাঁরা পড়লেন ফাঁপড়ে। ছেলে বড় না কমিটি? শেষে প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু চক্রবর্তী আসরে নামলেন। বললেন, নাটক হবে। তবে কিছু অংশ বাদ দিতে হবে। উনি বললেন, তুই এইগুলো কেটে দে। অমলেন্দুবাবুর বাংলা ক্লাস আমরা দুই পিরিয়ড ধরে করতাম। ছুটি হয়ে গেছে কখন। আমরা উঠছি না। উনিও থামতেন না। আমি বললাম, স্যার, আপনি কেটে দিন। বললেন, কী সমস্যায় ফেললি। ... ...
- মেয়েদের ইসকুলে মারপিট হয়? কই আমাদের নিবেদিতা ইসকুলে তো এমন হত না। - তুমি হাসালে মা। মারপিট শুধু ছেলেরা করবে? মেয়েরা পারবে না? এমন প্যাঁচ আমি জানি, একদম শুইয়ে দেব। ইসকুলে সুরক্ষার ভিডিও দেখিয়েছে। অনেক বন্ধু কারাটে শেখে। আমরা দল করে প্র্যাকটিস করি। চুটিয়ে মারপিট করি। - ভগবান! মন্দ বলতে পারছি না। এ বেশ ভাল কথা। তবে কেউ আহত না হয়, সেটা দেখতে হবে। আমি কী বলছিলাম সব গুলিয়ে গেছে। - সেনবাড়ি আর মিত্র বাড়ির সম্পর্ক আর তার সঙ্গে মোহনবাগান - এটাই বলছিলে। ... ...
একটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ গিয়েছিল। এখানেই সেই সেবল হরিণটি দেখা গিয়েছিল। এই জঙ্গলে শিকারের ছড়াছড়ি। পশ্চিম-বায়ু কোণ বরাবর একটি দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ব্যাপী পদযাত্রা আমাদের একটা নদীর কাছে নিয়ে এলো। নদীটি বয়ে গেছে একটা উঁচু শঙ্কু-আকৃতি পাহাড়ের গোড়া দিয়ে, এই পাহাড়ের ঢালে গজিয়েছে পালকের মতন বাঁশের ঘন বন। ... ...
জাহাঙ্গিরপুরী সি-ব্লক যেখানে মূলত ঝামেলা হয়েছে সেখানে প্রধানত বাঙালি মুসলিমদের বাস। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই চার দশক আগে রুটিরুজির টানে বাংলা ছেড়ে এখানে এসে বসবাস করছেন। এঁরা মূলত ছাঁট এবং অন্যান্য ছোট ব্যবসায় যুক্ত। যেমন আনোয়ার যাঁকে প্রধান অভিযুক্ত বলা হচ্ছে, তাঁর আদিবাড়ি হলদিয়ায়। আরেক অভিযুক্ত শেখ সোহরাবের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাগর অঞ্চলে। দুটি জায়গায় দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক এসে ঘুরে গেছেন। এঁদের সবার বৈধ ডকুমেন্ট আছে। সোহরাব দিল্লি পুরসভার কর্মী, তাঁর বাবাও দিল্লি উন্নয়ন পর্ষদে কাজ করেছেন। তবুও তাঁদের ভারতীয়ত্ব সন্দেহের মুখে; তাঁরা নাকি বাংলাদেশি; তাঁদের নথিপত্র সবই নাকি জাল, ভোটে ফায়দা নেওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের তৈরি করে দেওয়া। আজকের ভারতে মুসলিমরা নিত্য নতুন সংকটে জর্জরিত হচ্ছেন; আর যে মুসলিমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছেন তাঁদের সংকট তো আরও গভীর, তাঁদের তৎক্ষণাৎ বহিরাগত, বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে যাঁরা এই দেশে বাস করছেন তাঁদেরও বিদেশী তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে! শুধু দিল্লি নয়, সারা ভারতে আজকে এটাই ট্রেন্ড! এক ধর্মগুরু তো নিদান দিয়েই দিয়েছেন যে, বাঙালি হলেই সন্দেহের! ... ...
ভালো লেখা যে পাঠকের চোখে পড়বেই, কখনোই তাকে উপেক্ষা করে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না – তার প্রমাণ বহুদিন ধরে নিজের লেখালেখির জগতে নীরবে কাজ করে যাওয়া প্রতিভা, যাঁকে আবিষ্কার করতে আমাদের বাঙালি পাঠকের বেশ দেরি হয়েছে। দেরিতে হলেও, প্রতিভা has arrived – এ কথা তো অনস্বীকার্য। ইতিমধ্যেই গল্প বাদ দিয়েও, আমি তাঁর প্রচুর নন-ফিকশন নিবন্ধ পড়েছি নেট দুনিয়ার এদিকে ওদিকে, কোথাও কোথাও বিষয়ের প্রচণ্ড অভিঘাতে স্তব্ধ হয়েছি। গুরুচণ্ডালির পাতায় তাঁর এই বইয়ের অধিকাংশ নিবন্ধ আগে পড়া ছিল, তথাপি তারা আবার আক্রান্ত করল আমাকে, পাঠক হিসেবে। বৃক্ষহত্যা, জল নষ্ট করা, নদীখনন/ নদী হনন, বে-আইনি খাদানে মাইনিং, নিলামে তোলা কয়লা ব্লক, পরিবেশ দূষণ, আলোক দূষণ, অতিমারী, অতিমারীতে মেয়েদের অবস্থা, অতিমারীর লকডাউন ও তাতে প্রশাসনের ভূমিকা, পরিযায়ী শ্রমিকদের চূড়ান্ত দুরবস্থা। নানা বিষয়ে লিখিত ১৯টি লিখন এখানে এক মলাটে। ... ...
এই যন্ত্রণা হওয়ার একটা ইতিহাস আছে। খিদে যন্ত্রণা ও অপমানের ইতিহাস। ১৯৮২। মাধ্যমিক দিয়েছি। ম্যালেরিয়া নিয়েই। পরীক্ষা ছিল ২ মার্চ। এক অমানবিক অবৈজ্ঞানিক অমার্কসিয় সিদ্ধান্ত ছিল তখন ২৩ কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া। আমাদের স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি ছয় কিলোমিটার। স্কুল থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র আরো ১৭ কিলোমিটার। বাসে তখন লাগতো ঘন্টাখানেক। এখন বোধহয় চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট। রাস্তা ঝরঝরে। বাস লঝঝরে। প্রায়ই চাকা পাংচার হয়ে যায়। তাতে আরো আধঘন্টা। দিনে দুটো করে পরীক্ষা। ... ...
শেষ বয়সে জনগণের ওপরে কেশবচন্দ্রের প্রভাব দৃশ্যত কমে গিয়েছিল; কিন্তু তাঁর প্রচারিত আর্যতত্ত্বের রেশ থেকে যায় বুদ্ধিজীবি মহলে। আর্যতত্ত্ব প্রচারে কেশবচন্দ্রের প্রভাব আজও এতটাই গুরুত্বের, যে এখনও প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় দল/গোষ্ঠীকে আর্যতত্ত্ব বিষয়ে নির্ণায়ক অবস্থান নিতে হয়। কেশবচন্দ্র সেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই। মুলার শেষ বয়সে তার সন্তান আর্যতত্ত্বকে নিয়ে কী করবেন সে বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, যদিও তিনি আর্যতত্ত্বের দাঁত-নখ উপড়ে দিয়েছেন। আধুনিককালে আর্যতত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তার দ্বিধা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর্যতত্ত্বকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার, সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার কাজে সফল হয়েছে। খ্রিস্ট মিশনারি, প্রাচ্যবাদী এবং ব্রিটিশ সরকার যৌথভাবে মুলার এবং কেশবচন্দ্রের এই তত্ত্বকে তাদের স্বার্থে বারংবার ব্যবহার করেছে ... ...