আমার বাবাকে শেরপুরের মানুষ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করতেন। সাধারণ মানুষ আব্বাকে চিনত এমন না, কিন্তু যারা এই ধারায় আছে তারা সবাই এক নামেই চিনত। শহরের বড় বড় মসজিদের ইমাম, ইসলাম বুঝে জানে এমন লোকজন আব্বাকে মান্য করত। আব্বার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছি অনেকেই। কোন মসজিদ বা মাদ্রাসায় আব্বার নাম বললে উনার নাম শুনা মাত্র নড়েচড়ে বসত সকলেই। আব্বা আমাদের এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তেন না, কারণ এখানে যে নামাজ পড়ায় তিনি অল্প বয়সই, আব্বা তৃপ্তি পেতেন না তার পিছনে নামাজ পড়ে। হেঁটে দূরের এক মসজিদে যেতেন শুধু মাত্র সেই ইমাম সাহেবকে আব্বার মনে হত উনার মাপের, যার সাথে কথা বলা যায়, আলাপ করা যায়। সেই ইমাম সাহেব আমাকে অনেকবার আমার কাছে আব্বার প্রাণ খোলা প্রশংসা করেছেন। এক বাক্যে স্বীকৃতি দিছেন যে আব্বার মত ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী মানুষ তিনি খুব কমই দেখেছেন। তিনি পরে শেরপুরের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম হয়ে ছিলেন, এবং তখনও উনার আব্বার প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি। আব্বা যখন অসুস্থ, বিছানায় পড়ে গেছেন। তখনও আমি দেখতাম কোথা থেকে কোথা থেকে মানুষ আসত, উদ্দেশ্য আব্বার সাথে দেখা করা আর একটু আলোচনা, ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে গল্প। আমি আব্বার এই দিকের কথা কেন বলছি? কারণ আমি আব্বাকে কোনদিন নববর্ষের বিরোধিতা করতে দেখি নাই। আব্বা নিশ্চয়ই মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ নেয় নাই। কিন্তু মেজোপা যখন নববর্ষ উপলক্ষে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া এনে দিত তখন তিনি আগ্রহ নিয়েই পরতেন, খুশিতে চোখ নেচে উঠত উনার। বাব্বাহ! আমার জন্য আনছ, বলে হাতে নিতেন, হাসতেন। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন ফোন দিয়ে বলতাম, আব্বা, শুভ নববর্ষ, তিনিও সাথে সাথেই শুভেচ্ছা জানাতেন নববর্ষের। নববর্ষ উপলক্ষে ভাল মন্দ রান্না হয়েছে কি না তার খোঁজ নিতেন, আগ্রহ নিয়ে খেতেনও। আমি আমার সমস্ত জ্ঞান বাজি রেখে আপনাদের বলতে পারি যে কাঠ মোল্লা জাহান্নাম যাওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন গলা ফাটাইয়া, আমার বাবা তার চেয়ে বেশি জানতেন, ধর্ম, ইসলাম, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র সম্পর্কে। ... ...
যে দেশে কিছু না করেই অল টাইম দৌড়ের উপরে থাকতে হয় হিন্দুদের, যে দেশে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিকল্পিত ভাবে ম্যাসাকার করা হয় এবং যার কোন বিচার হয় না ,যে দেশে নিয়ম করে প্রতিমা ভাঙা হয়, যে দেশে গুজবের উপরে ভর করে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কোন বিচার হয় না, সেই দেশে কেউ হিজাব পরার অপরাধে মারছে! কোন মাপের মগজহীন মানুষ হলে এইটা বিশ্বাস করা সম্ভব? ... ...
নিছক আবেগ না। তখন প্রশ্নটা ছিল পেটে লাথি খাওয়ার। জীবন জীবিকার প্রশ্ন। রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলে কি হবে তা দেশ ভাগের অল্প দিনেই বুঝে গিয়েছিল বাঙালী। তাই আবেগের প্রশ্ন ছিল না, ছিল জীবনের প্রশ্ন। তৎকালীন বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সবাই বুঝে গিয়েছিল উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে এই জীবনে আর পাকিস্তানের সাথে পেরে উঠা যাবে না। দেশ ভাগের পরেই যখন মানি অর্ডার ফরম, ডাক স্ট্যাম্প, চিঠির খাম সব উর্দু ভাষায় এসে হাজির হল তখনই বুঝা হয়ে গিয়েছিল উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে আসলে কত বড় সর্বনাশ হবে। তাই ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না। ছিল জনগণের আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। তাই শহিদের তালিকায় এক বরকত ছাড়া আর কাওকে ছাত্র খুঁজে পাই না, সবাই কর্মজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ। ... ...
কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে উপরে যে ভিডিওর কথা বললাম তা। আপনারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন ইংরেজিতে! বাংলা আসলে কোথায় মারা যাচ্ছে তা বুঝতে রকেট সাইন্স জানতে হবে না, মাথাটা একটু নরম হলেই খুব বুঝতে পারতেন। ওই ভিডিওটা দেখার পরে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম যে ঢাকায় একুশে বই মেলা প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা হচ্ছে, বিষয় বাংলা সাহিত্য আর কোন এক বাঙালী বক্তা ইংরেজিতে কুস্তাকুস্তি করছেন! কল্পনা করে আমি শিউরে উঠেছি, বেশিদূর যেতে পারি নাই কল্পনাকে টেনে নিয়ে। ... ...
কাজীদার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন নবাব। যতদিন তিনি কলম চালু রেখেছিলেন ততদিন তিনি নবাবি করে গেছেন। সেই ষাট সাল থেকে শুরু, এর মধ্যে তিনি রাজ্য ছাড়েন নাই! আজকে নবাবের প্রস্থান হল। বিদায় নবাব। আজকে আর কিছুই বলার নাই আই লাভ ইউ ম্যান বলা ছাড়া! আই লাভ ইউ ম্যান, মানুষ হিসেবে নিজেকে আলাদা জায়গায় দাঁড় করাতে সাহায্য করার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ আপনার কাছে! রঙিন একটা শৈশব দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, ধূসর শৈশব নিয়ে বড় হওয়া অনেককে যখন দেখি তখন বারবার বলতে ইচ্ছা করে কাজীদা, আই লাভ ইউ ম্যান! ভাল থাকুন। ... ...
আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আমাদের দর্শক। নানা কারণে আমাদের সেই শক্তি এখন বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বাহিরেও আমাদের সমর্থকরা এখন সবচেয়ে অশিক্ষিত খারাপ সমর্থক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের খেলোয়াড়দেরও ছাড় দেই না। ট্রল করতে করতে, মজা নিতে নিতে ক্রিকেটাররা যে মানুষ তা ভুলে যাই। ক্রিকেটারদের তো আছেই তাদের পরিবারকেও ছাড় দেই না। আমরা আশা করি আমরা যা ইচ্ছা বলব করব তারা খুব পেশাদার ভঙ্গিতে সব মেনে নিয়ে খেলে যাবে। না, আমরা এখন ওই পর্যায়ে যেতে পারি নাই। আমাদের ক্রিকেটের ইতিহাস খুব বেশিদিনের না। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের আগের প্রজন্মই তো এদেরকে শিখিয়েছে? ... ...
এখন, এই কয়েকদিনের উত্তাল সময় পার করার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ক্ষমতায় জামাত বিএনপি থাকলে কত সুবিধা হত আমার মত মানুষের। স্বপ্ন দেখতে পারতাম। ভাবতে পারতাম লীগ ক্ষমতায় থাকলে এমন হত না। স্বপ্ন দেখতাম আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেই সাম্প্রদায়িকতার বিষকে নির্বিষ করে আমাদের মুক্ত করবে। কিন্তু তা আর হওয়ার না। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এবং সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী সরকার। তাহলে এখন আমরা কার কাছে যাব? কিসের স্বপ্ন দেখব? আমাদের সমস্ত আশার আলো নিভে যাচ্ছে, গেছে! ... ...
যখন সততা দেখানোর সময় আসে, যখন আপনার নৈতিকতার পরীক্ষার সময় আসে তখন আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি দ্বিধায় ফেলে 'সুযোগ' নামের শব্দটা। আমরা ওই মুহূর্তে বেশির ভাগ সময়ে ডাহা ফেইল মারি। আমরা এইটাই তো সুযোগ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সততা, নৈতিকতা সব একদিকে ঠেলে ফেলে দিয়ে সুযোগটাকে কাজে লাগাই। এই পরিস্থিতি দেশের বেশির ভাগ মানুষের। যতক্ষণ পর্যন্ত সততার পরীক্ষা না দিতে হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সৎ, অসৎ হওয়ার জন্য শুধু সুযোগের অপেক্ষা। ... ...
আমি আগ্রহ আরও হারিয়ে ফেললাম কারণ তিনি তখন মরিয়া হয়ে প্রথা ভাঙতে চাচ্ছেন। মৌলবাদের প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশ তৈরি হয়েছে, ফলে ধর্মকে নানান ভাবে আঘাত করছেন, আঘাতের অস্ত্র সব সময় সুবিধার না। গাছে মাছে আক্রমণ চলছে তখন। এবং তখনই সম্ভবত দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ধর্মকে আক্রমণ করে এর আগেও অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। তাদের প্রতি মানুষ এই রকম বিরক্ত হয়নি। তাদের কথা পছন্দ হয়নি, হয়নি, চুপ করে থেকেছে। কারণ তাদের বলার ধরন অন্য রকম ছিল, তাতে সম্ভবত সাহিত্যের গুণাগুণ বেশি ছিল। তসলিমা নাসরিন কোনমতেই আহমেদ শরীফের চেয়ে বড় নাস্তিক ছিলেন না, হুমায়ুন আজাদের চেয়ে কঠোর কথা তিনি বলেন নাই তাও হয়ত বলা চলে। এরপরেও তাঁকে এঁদের চেয়ে বেশি গালাগালি শুনতে হয়েছে। এর কারণ এক যা বললাম, বলার ধরন অনেকের পছন্দ হয়নি আর দ্বিতীয়ত তিনি নারী! নারীর মুখে এই সব শুনতে আমরা রাজি না। ... ...