এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ছত্তিশগড়ের আঁকিবুকি

    ranjan roy
    অন্যান্য | ০৪ জানুয়ারি ২০১২ | ৮৮৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 24.96.125.101 | ২৯ জুলাই ২০১৩ ২৩:১৮527565
  • ফুগ্‌গাদাদা!(বেলুনদাদা!)।
    যেমন নাম, তেমনি চেহারা।গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় গেটের উল্টোদিকে পান-সিগ্রেটের ঠেলা(কিওস্ক), সেটাই এই গুন্ডাটির ঠেক। ন্যাড়া মাথায় ছোট টিকি, অর্থাৎ ইনি ব্রাহ্মণ বা বাহমন বটেন! নাম আলোক পান্ডে। বয়স তিরিশ ছোঁয়-ছোঁয়।
    হলুদ টি-শার্ট ও জিনের প্যান্টে বিশাল মধ্যপ্রদেশটি ঢাকা পড়ে নি,বলতে হয় ফুগ্‌গাদাদা সার্থকনামা।
    ওঁর আয় বলতে কলেজের সাইকেল-স্ট্যান্ড ও ক্যান্টিনের ঠিকেদারি।
    ভর্তির সীজনে ওঁকে রোজই দেখতে পাওয়া যায়।দোকানের সামনে একটি টিনের চেয়ারে উনি বিরাজমান। নতুন কেউ ভর্তি হলে এঁর চেলা-চামুন্ডারা তাকে পাকড়ে সহবৎ শেখায়। তখন সে সোজা পান-দোকান থেকে একটি উইলস্‌ এর প্যাকেট নিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবতার সামনে নৈবিদ্যি চড়ানোর মত করে ফুগ্‌গাদাদার সামনে নিবেদন করে।
    মধুর-মুনাক্কার নেশায় অর্ধনিমীলিত চোখ খুলে দাদা এই মেষশাবকটিকে দেখেন। তারপর দুজনের মধ্যে এবংপ্রকার বাক্যবিনিময় হয়।
    ছেলেটিঃ--প্যার লাগু দাদা! ম্যায় ফার্স্ট ইয়ার মেঁ অ্যাডমিশন লিয়া হুঁ।
    দাদাঃ- লাগে রহো লাগে রহো! (লেগে থাকো, লেগে থাকো।)
    ফাটে ফাটে, ইজ্জত না ঘটে; ভালে প্রাণ চলি জায়, বাকি হরি ইচ্ছা!
    ( নিগলিতার্থঃ
    লেগে থাক মোর বাছা!
    গেলে যাক প্রাণ,
    থাকে যেন মান,
    ফাটলে ফাটুক পাছা।।)

    ব্যস-, নবাগত ছেলেটি দাদার সংঘে দীক্ষিত হয়ে গেল। ওর চ্যালারা ওকে র‌্যাগ করবে না। কলেজ থেকে শহরে যেতে যেকোন অটোয় বসে " হরি ইচ্ছা" বললেই ড্রাইভার ভাড়া চাইবে না।সিনেমা হলে আদ্দেক দামে সিনেমা দেখবে। দর্জির দোকানে সাফারি-স্যুট তৈরি করতে কম চার্জ দেবে। বদলে ইউনিয়ন ইলেকশনে ওকে ফুগ্‌গাদাদার আশীর্বাদ প্রাপ্ত পেনলের হয়ে খাটতে হবে। এই আর কি!
  • ranjan roy | 24.99.168.107 | ১৪ আগস্ট ২০১৩ ০৩:২১527566
  • এই ছত্তিশগড়ি যাত্রাপালায় এবার প্রবেশ করছেন বিমলেশ দ্বিবেদী।
    বাবার বদলির চাকরির সূত্রে সেশন শুরু হওয়ার তিনমাস পরে জবলপুর থেকে এসে বিলাসপুরের সরকারি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএর থার্ড ইয়ারে ভর্তি হল বিমলেশ। সুন্দর মুখশ্রী, ছিপছিপে একহারা চেহারা। আগাগোড়া ভালো রেজাল্ট। মেয়েরা ফিরে তাকায়।
    যথারীতি ফুগ্গাদাদার চ্যালাদের চোখে পড়ল একটি নতুন মুর্গা। ওরা উৎফুল্ল, জবাই করা যাবে।
    একদিন জনাদুই চ্যালা এসে ভারিক্কি চালে বলল-- কি হে! সাতদিন হয়ে গেল এখনো ফুগগা দাদার দরবারে সেলাম বাজাতে যাওনি? তোমার কি ভয়ডর নেই? জানো, উনি চাইলে--। যাকগে, তুমি নতুন ছেলে । যদি র‌্যাগিং থেকে বাঁচতে চাও তো--।
    ---- আমি এখন থার্ড ইয়ার। ফার্স্ট ইয়ার নই, আমার কেন র‌্যাগিং হবে?
    ---ওসব ফুগগাদাদাকে গিয়ে বল, উনি কনসিডার করতে পারেন। এখন চল আমাদের সঙ্গে।
    --- আমি কোথাও যাব না। একজন ছাত্রের লাইফে দু-দুবার র‌্যাগিং হতে পারে না।
    -- আবে দেড়-হোঁশিয়ার! ফুগগাদাদা কে আদমিয়োঁ সে কানুন চোদনা? তেরি মাঁ কী---।

    হঠাৎ কিছু ঘটে যায়। মা নিয়ে চিরপরিচিত গালিটি মুখ থেকে পুরোপুরি বেরোনোর আগেই ও'ওঁক' করে পেট চেপে বসে পড়ে। দুবলা-পাতলা ছেলেটি সোজা ওর তলপেটে একটি মোক্ষম লাথি কষিয়েছে, যেন কোন স্ট্রাইকারের নেওয়া পেনাল্টি কিক।

    চ্যালার দল পত্রপাঠ রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে যায়। নতুন ছেলেটি যায় ক্লাশে।
    কিন্তু নাটক সেখানেই শেষ হয় না।
  • ranjan roy | 24.99.168.107 | ১৪ আগস্ট ২০১৩ ০৪:০১527567
  • ছুটির মুখে সবাই যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে খেলার মাঠের পাশে বিমলেশের রাস্তা আটকায় প্রায় জনা তিরিশেক ছেলে, অনেকের হাতে হকিস্টিক, আর ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফুগগাদাদা।
    ছেলেটা সবাইকে দেখে, ভয় পায়।
    ফুগগা বলিউডি ফিল্মের কায়দায় টেনে টেনে বলে-- কিঁউ বে? চিটি কী পংখ নিকল আয়ী?( কি রে, পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে?) নয়া নয়া আকে ইঁহা ফুগগাদাদা কী কালেজ মেঁ দাদাগিরি চোদনা? মেরে আদমিকো মারা?
    ও ক্ষীণ আওয়াজে বলার চেষ্টা করে--- দাদা, মুঝসে গলতি হো গয়ি, পর উনলোগোঁ নে মুঝকো মাঁ কী গালি দী।
    -- আমি কিছু শুনবো না। তুমি আমার কাছে এসে নালিশ করতে, আমি শাস্তি দিতাম। কিন্তু তুমি আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কেন? হমারে আদমী পর হাত উঠায়া ক্যায়সে? অব ভুগতো।
    আবে চুনমুন! লগা ইসে দো ঝাপড়! সব কে সামনে। লোগোকো সবক শিখানা হ্যায়।

    সকালের মারখাওয়া দুটো চ্যালার একটা এগিয়ে আসে, চোখে পড়ে ওর আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ও পানখাওয়া কালো দাঁতের সারি । সোজাহাত-উল্টোহাত করে দ্রুতলয়ে মারা গোটা কয় থাপ্পড়ে বিমলেশের মাথা ঝিমঝিম করে, চোয়াল নড়ে যায়।
    -- হয়েছে , হয়েছে! এবার বাড়ি যা! আর কাল একশ' টাকা নিয়ে আসবি, তোর বাপ জিগ্যেস করলে বলবি-- ফুগগাদাদার জরিমানা, বেয়াদপির জন্যে।

    ছেলেটা থাপ্পড়ে লাল হওয়া গালে হাত বুলোয়, সামনে এগিয়ে যায়, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাওয়ায় লাফিয়ে উঠে ফুগগাদাদার দিকে ফুটবলের ভলি ,মারার মত করে পা চালায়। তারপর প্রাণপণে রাস্তার দিকে দৌড়য়।
    লাথিটা লাগে ছেলেদের যেখানে মারলে সবচেয়ে বেশি লাগে ঠিক সেইখানে। ফুগগাদাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন এমন বিরল দৃশ্য সবাই অবাক হয়ে দেখতে থাকে।
    তাই ছেলেটাকে চেজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। ও তো একশ' মিটার স্প্রিন্ট এর মত দৌড়চ্ছে। বাকিরা ফুগগাদাদাকে দেখবে, ধরে তুলবে না পাজি ছেলেটার পেছনে দৌড়বে--- সেটা ঠিক করতে করতেই ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।

    বিকেলের মধ্যে স্থানীয় থানায় দুটো ডায়েরি লেখা হয়।
    একটি নতুন ছেলেটির বিরুদ্ধে; অপরাধ--- কলেজে মারপিট করা, ফুগগা, চুনমুন ও আরও কয়েক জনকে মারা ও মা-বাপ তুলে অশ্লীল খিস্তি করা এবং প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া। সাক্ষী প্রায় পনের জন।
    দ্বিতীয়টি, বিমলেশের তরফ থেকে ফুগগার বিরুদ্ধে; অপরাধ--- কলেজে ঢুকে নতুন ছাত্রদের থেকে পয়সা নেয়া, প্রতিবাদ করলে গালমন্দ-মারপিট, সাক্ষী কেউ নেই।

    কিন্তু সন্ধ্যের মুখে ফুগগা ও তার দলবল গ্রেফতার হয়ে থানায় রাত কাটাল এবং ওদের জামিন হতে সাতদিন লেগে গেল।
    কারণ, নতুন ছেলেটির বাবা জেলা কলেক্টরের অফিস সুপারিনডেন্ট।
  • ranjan roy | 24.99.190.39 | ১৫ আগস্ট ২০১৩ ২৩:৪৯527568
  • ব্যস্‌, পুরনো খেলুড়েদের হাতে হ্যারিকেন।
    সমরজিতের ছককষে শিওর সাকসেস ফর্মূলা নতুন দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল।
    নতুন ছেলের জোড়া লাথিতে দুপায়ের ফাঁকে হাত চেপে ফুগগাদাদার মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া অনেক ছেলেমেয়ে গোলগপ্পা চোখে দেখেছে।
    তারপর ফুগগাদাদার সাতদিন হাজতবাস হতেই চ্যালাচামুন্ডারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
    ফার্স্ট ও থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েরা মিলে নতুন প্যানেল তৈরি করল-- প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী জবলপুর থেকে ট্রান্সফার নিয়ে আসা থার্ড ইয়ারের নতুন ছাত্র বিমলেশ দ্বিবেদী যার পিতৃদেব কালেক্টরের স্টাফ হওয়ায় ওর গায়ে হাত তোলার সাধ্যি কারো নেই।
    বলাবাহুল্য যে প্রথম তিন ইয়ারের অধিকাংশ ভোট বিমলেশ দ্বিবেদী পেল আর পুরনো ভাম সমরজিৎ পেল ফোর্থ ইয়ারের ভোট।
    এরপর জেলার কংগ্রেসি নেতারা ফন্দি করে বিমলেশকে ইউনিভার্সিটি প্রতিনিধি করে এগিয়ে দিলেন।
    আর বছরের শেষে যুবশাখা ও মহিলাশাখার রাজ্যস্তরের সম্মেলনের সময় দু'জোড়া চোখের মিলন হল।
    উদীয়মান মহিলা নেত্রী লক্ষ্মীবাঈ ভলপহরী ও যুবনেতা বিমলেশ দ্বিবেদী।
    কংগ্রেস জাতপাত মানে না। কংগ্রেসের একটি অনুসূচিত জাতি প্রকোষ্ঠ বা সেল আছে। দেখা গেল লক্ষ্মীবাঈ ও বিমলেশ দুজনেই বেশ বলিয়ে কইয়ে। আস্তে আস্তে ওদের দুজনের কামরেদারি সবার চোখে পড়ল। বুড়োদের চোখ টাটাল।
    -দেখো, হম সব হ্যাঁয়, কাংরেসি; গান্ধীবাবাকে চেলে। সার্বজনিক জীবন মেঁ জাতপাত নহী মানতে। পর শাদি-বিহাও মেঁ , খান-পান মেঁ, বিরাদরি মেঁ ইয়ে সব তো মাননা পড়েগা। ইয়ে তো ভগবান কে বনায়া হুয়া নিয়ম হ্যায়।
    [ আমরা কংগ্রেসি বটে, গান্ধীবাবার চেলা। পাবলিক লাইফে জাতপাত মানিনে। কিন্তু বিয়েশাদি-খাওয়াদাওয়া-- নিজেদের গুষ্ঠিতে এসব না মানলে চলে? এ তো ভগাবানের তৈরি নিয়ম।]

    ছেলের বাবাকে ব্রাহ্মণসমাজের মাথারা দলবেঁধে বোঝাতে গেলেন-- একটু চ্প্খ মেলে চলুন পন্ডিতজী! শেষে কি মুচি-বৌ এসে ঘরে কুলদেবতার পূজো করবে? ছেলেমেয়ে দুটোর ভাবসাব ভালো বুঝছি নে।

    দ্বিবেদীজি ওঁদের আশ্বস্ত করলেন। -- ওসব কিছুই হবে না। আমার ছেলে সেয়ানা আছে। নীচুজাতের মেয়ে যতই ছলাকলা দেখাক ভবি ভুলবে না।

    কিন্তু হঠাৎ দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বক্স দিয়ে খবর!
    --- আদর্শ বিবাহ! আজকের নতুন প্রজন্ম শুধু মুখে নয় কাজেও করে দেখাচ্ছে।
    বাবাসাহেব আম্বেদকর লিখে গেছেন যে বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিয়ে না হলে শুধু আইন করে অস্পৃশ্যতা ঘুচবে না।
    কংগ্রেসের দুই তরুণ-তরুণী বিমলেশ ও লক্ষ্মীবাঈ এটা করে দেখিয়েছে। ওরা আর্য্যসমাজের মন্দিরে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে মালাবদল করেছে।
    এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে টেনশন হলেও পাত্র-পাত্রী অনড়। আপাততঃ বিমলেশ নিজের শ্বশুরবাড়িতে আছে। বিমলেশ প্রেস কে বলেছে যে আমার বাবা এখন না বুঝলেও শিগ্গ্গিরই বুঝতে পারবেন যে আমরা ভুল করিনি। তখন নিশ্চয়ই আশীর্বাদ দেবেন।

    গোটা শহর উত্তাল।
    কেউ বলল যে মেয়ের বাড়ি ছল করে বিমলেশকে আটকে রেখেছে। ওর স্টেটমেন্ট ব্ল্যাকমেইল করে দেওয়ানো হয়েছে। কেউ ধন্য ধন্য করতে লাগল।
    কিন্তু কিছুদিন পড়ে আরেকটি গুজব শহরের পারা চড়িয়ে দিল। এবার বিলাসপুর শহরের মেয়র হিসেবে লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আঠেরো আনা ছিল। এটা এখন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন হয়ে গেছে। কিন্তু লিস্ট বেরোলে দেখা গেল দেখা গেল যে ওর নাম নেই। গুজব দলের ব্রাহ্মণ লবির চাপে এটা হয়েছে।

    দুমাস পড়ে আবার নতুন হৈ-চৈ। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিমলেশ দ্বিবেদী নাকি শপথ নিয়ে বয়ান দিয়েছে যে ওর কোন বিয়ে হয় নি। আগের খবরগুলো একশ্রেণীর প্রেসের তৈরি করা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্যে বিরোধী দলের চক্রান্ত হতে পারে। ওর আর লক্ষ্মীবাঈয়ের মধ্যে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক বন্ধুত্ব ছাড়া কোন সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনো নেই।
    বর্মাজী এবার থামলেন। ফ্লাস্ক থেকে ছোট গেলাসে করে একটু জল খেলেন।

    --- তারপর?
    -- এর পরেও কিছু হয় নাকি? ইলেক্শনে মেয়েটি নির্দলীয় প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে গো-হারা হারল। দলের লোকেরাই পেছন থেকে ছুরি মেরেছিল।
    -- আর বিমলেশ?
    -- ও হ্যাঁ, বিমলেশ। ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কোরবাতে কন্স্ট্রাকশন কোম্পানি খুলে ফ্ল্যাট আর শপিং কমপ্লেক্স বানিয়ে করে খাচ্ছে।
    একদিন ওর অফিসে উঁকি দিয়েছিলাম। খুব খাতির করল, কফি খাওয়াল। ওদের নতুন প্রোজেক্টের প্রস্পেক্টাস গছিয়ে দিল।
    আমি একটু কিন্তু কিন্তু করে জানতে চাইলাম যে কয় বছর আগের উঠতি যুবনেত্রী লক্ষ্মীবাঈ ভলপহরী এখন কোথায়? আজকাল কি করছেন?
    ওর চেহারা পাল্টে গেল। মুখের চেহারা কঠিন করে বলল--" কে ভলপহরী? আপনি কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। ওই নামে কাউকে চিনতাম না।
    আচ্ছা, আংকল, এখন আপনি আসুন। আমাকে একটু সাইটে যেতে হবে।"

    আমার গল্প শেষ। এবার মিশ্র বলুক।

    কোথায় সুর কেটে গেছে, রোদ্দূর ও চড়েছে।
    সবাই কালকে শুনবো বলে উঠে পড়লেন।
  • ranjan roy | 24.99.190.39 | ১৬ আগস্ট ২০১৩ ০০:২৪527569
  • ডারউইন সাহেব, প্রভুদাস ও চুমু-উৎসব
    ----------------------------------------------
    পরের দিন সাংবাদিক বিমল মিশ্রের পালা।
    উনি প্রথমেই একটি ডিসক্লেমার দিলেন।
    --- এ কদিন ধরে শুধু হিন্দুসমাজের জাতপাত নিয়ে কথা উঠেছে। আমি একটু ইসাই( ক্রিশ্চান) ও পাঠান( মুসলমান)দের নিয়েও গল্প শোনাতে চাই। কারও মনে আঘাত লাগলে আগেভাগে মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কোন ধর্মকে ছোট করে দেখাতে চাইনে। ভালোমন্দ সব জায়গায় আছে।
    --- অ্যাই ব্যাটা মিশির! বেশি জ্ঞান দিবি না তো! আমরা কাউকে অসম্মান করিনে। তুই তোর গল্প শোনা, জম্পেশ হওয়া চাই। নইলে ফাইন।
    দেবাংগন থাকতে পারে না।
    -- একটু খোলসা করবেন কি? জাতপাত তো খালি হিন্দুদের মধ্যে আছে। শিখ-মুসলিম-ইসাইদের মধ্যে জাতপাত কোথায়?
    -- আরে না রে! তুই এখনো ছেলে মানুষ। হিন্দুসমাজের ছোঁয়া সবাই পেয়েছে।
    ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখ-- রামগড়িয়া শিখ ও রণধাওয়া শিখদের মধ্যে বিয়ে হয় না। মুসলিমদের মধ্যে সৈয়দ বা কুরেশিদের পরিবারের সঙ্গে অস্পৃশ্যদের থেকে মুসলমান হওয়া পরিবারের সম্বন্ধ হয় না। ক্রিশ্চানরাও সম্বন্ধ হওয়ার সময় খোঁজ নেয়-- পরিবারটি হিন্দু থাকার সময় কোন জাত ছিল।
    তামসকর বললেন-- চা এসে গেছে। চুমুক দিয়ে শুরু কর দিকি!

    এটা জানেন তো, বছর তিন আগে, এই শহরের নামকরা স্কুলটিতে সায়েন্স এগজিবিশনের সময় ক্লাস টেনের দুটি ছাত্রের তৈরি মডেলটি দ্বিতীয় দিন থেকেই তুলে নেয়া হয়। তারপর ছেলের বাবা কোর্টে কেস করে।
    ---- কেন? কেন?
    -- মিশনারি স্কুল। ফাদার জনের খেয়াল হল যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে তৈরি মডেলটি বাইবেলের সৃষ্টি- তত্ত্বের বিরোধী। উনি সায়েন্সের টিচারকে কড়কে দেন এই বলে যে ঈশ্বর ছয়দিন পরিশ্রম করে এই দুনিয়া বানিয়েছেন। তারপর রোববার বিশ্রাম করেছেন। তার জায়গায় এসব কি হাবিজাবি পড়ানো হচ্ছে? বাঁদর থেকে মানুষ?
    উত্তরে সায়েন্স টিচার ওঁকে বায়োলজির বই দেখিয়ে ইভ্যোলুশনারি থিওরি বোঝাতে গেলে উনি হাত তুলে টিচারকে চুপ করতে বলে নিজে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন যদি টিচার মনে করেন যে ঈশ্বরের ছয়দিন ধরে নির্মাণ ও সপ্তমদিনে বিশ্রাম নেয়ার থিওরিটি মিথ্যে তাহলে তিনি যেন রোববার দিন বিশ্রাম না নিয়ে স্কুলে চলে আসেন।
    পরদিন থেকে ওই মডেল এগজিবিশন থেকে তুলে নেয়া হল।
    মডেল যারা বানিয়েছিল তাদের একজনের বাবা আদালতে নালিশ করলে অনেক জলঘোলা হয়।
  • ranjan roy | 24.99.237.97 | ১৯ আগস্ট ২০১৩ ০১:২৯527570
  • এবার মুখ খুলেছেন কাকা গোপালদাস।
    -- পন্ডিতজী, বাজে কথা বলবেন না। ওটা ভালো স্কুল। আগে আমি পড়েছি, এখন আমার ছেলে পড়ে। আর বিজ্ঞানের ক্লাসে এখন ডারউইনের বিবর্তনবাদ দিব্যি পড়ানো হয়।
    -- দূর ব্যাটা সিন্ধি! নিজেই তো বললি 'এখন' পড়ানো হয়। তার মানেই 'তখন' বা 'কখনো কোন এক সময়" পড়াতে বাধা ছিল। ওটা টিউশনে বা বাড়িতে নিজে নিজে পড়তে হত।
    -- আমি বলছি কি সে হল আদ্যিকালের কথা। হ্যাঁ, ওই ফাদার জন বেশ খিটখিটে গোঁড়া ফান্ডামেন্টালিস্ট ধরনের ছিল।ব্যাটা বিয়ে করেনি, বাচ্চা পয়দা করেনি। ও সৃষ্টিতত্ত্বের কি জানবে? তবে ওতো কবে বদলি হয়ে গেছে। এখনকার ফাদার--।
    --- চুপ কর! তাহলে এ নিয়ে আর একটা গল্প শোনাই।
    তখন সবে একটি স্থানীয় হিন্দি দৈনিকে সাংবাদিক হিসেবে ঢুকেছি। অল্প মাইনে হলেও মাসের দশ তারিখের মধ্যে দিয়ে দিত। কিন্তু ট্যুরের জন্যে মোটর সাইকেলও দিত না। বস বলত-- পেট্রলের পয়সা কে দেবে?
    তাই বাসে-ট্রেনে ভ্রমণ আর শহরের মধ্যে সাইকেল অথবা হন্টন।
    সেসব দিনে আজকের ঝাঁ চক্চকে ভলভো বাস-টাস কোথায় ছিল? সরকারি কি বেসরকারি--- সবার শক আপ খারাপ, বডি মুড়ির টিনের মত ঝরঝরে।
    এমনি এক জষ্টির দুপুরে চাঁদিফাটা রোদ্দূরে শহর ছেড়ে ধমতরি যাব বলে একটি সরকারি বাসে বসেছি। স্থান পেলাম একেবারে পেছনের লাইনে। ,মেজাজ গেছে খিঁচড়ে। বাস গর্তে পড়ে ব্রেক কষলেই এই সীটগুলোর যাত্রীদের ছাদে মাথা ঠুকে যায়। কন্ডাকটার নীচের ঢাবায় দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিচ্ছেন। অধিকাংশ যাত্রী গরমে কাহিল হয়ে ক্লোরোফর্ম নেয়া রোগীদের মত অচেতন ভঙ্গিতে ঝিমোচ্ছে।
    এমন সময় একটা কর্কশ আওয়াজে চটকা ভেঙে গেল।বাসে উঠেছে ঝোলা কাঁধে সাদা জামাকাপড় পরা একজন কুচকুচে কালো লোক। স্পষ্টঃ ওরাওঁ আদিবাসী থেকে ক্রিশ্চান হয়েছে।
    কিন্তু ও কোথাও বসার চেষ্টা না করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যাগের থেকে কিছু চটিবই বের করে নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছেঃ
    " প্রভু কী বাণী! প্রভু কী বাণী! মাত্র এক রুপিয়া, এক রুপিয়া!
    উঠো ভাইয়োঁ! জাগো! পড়ো প্রভু যীশু কী বাণী! সির্ফ এক রুপিয়া! ওনলি ওয়ান রুপি, স্যর!"
    কিন্তু গরমে-ঘুমে ধুঁকতে থাকা অচেতন জনগণ না বই কিনল, ন নড়ে বসল।
    মানবজাতির এই গেঁড়েপনায় যারপরনাই ক্ষুব্দ হয়ে সেই লোকটি লেকচার দেয়া শুরু করলঃ
    --আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। এই অমূল্য মানব জীবন নিয়ে কি করবেন একটুও ভাবছেন না? জীবনের উদ্দেশ্য কী তা জানার আগ্রহ নেই? আরে, প্রভুর বাণীর বই কিনে দেখে নিন, সব বুঝতে পারবেন। শুধু পেটপূজো আর বাচ্চা পয়দা করা? এ তো জ্পশুপাখিও করে।
    এবার লোকজন একটু আড়মোড়া ভেঙে ওর দিকে তাকাল।
    এতে উৎসাহ পেয়ে ও একজন হাটুরে লোককে জিগ্যেস করল-- আপ জরা বতাইয়ে তো, ঈশ্বর ইস দুনিয়া কো কিঁউ বনায়া হ্যায়?
    আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল--- ঈশ্বর কো খুদকো নহী মালুম।
    ভগবান নিজেই জানেনা কেন বানিয়েছে।
    ওর রক্তচক্ষু এবার আমার দিকেঃ
    --" মানে? কি বলতে চান?"
    -- নতুন কিছু বলছি না। মুকেশের গানটা শোনেন নি?
    " দুনিয়া বনানেওয়ালে, ক্যা তেরা দিল মেঁ সমায়ী?
    কাহে তো দুনিয়া বনায়ী, হায়! কাহে তো দুনিয়া বনায়ী?"
    এবার ও উৎসুক জনতার দিকে ফেরে।
    --" শুনলেন তো? দু'পাতা ইংরেজি পড়েছে, হজম হয় নি। বলে কি কেন বানালেন ভগবান নিজেই জানেন না। হুঃ এই যে বাসে আপনারা বসে আছেন এটা । সরকারি বাস। মানে সরকার বানিয়েছে। তো সরকার কি জানেনা কেন বাস বানিয়েছে? নিশ্চয় জানে, তাই তো?
    তেমনি ভগবানও জানেন উনি কেন এই দুনিয়া বানিয়েছেন। শুধু জানিনা আমরা, দু'পাতা ভুল ইংরেজি পড়ে বড় হওয়া লোকজন।
    । ডারউইন বলে এক ইংরেজ সাহেব লিখেছেন যে একজোড়া 'বেন্দরা-বেন্দরি সড়ক পর চুতর ঘিঁষতে ঘিঁষতে ধীরে ধীরে একদিন খড়ে হো গয়ে অউর ইনসান বন গয়ে।
    [ একজোড়া বাঁদর-বাঁদরী রাস্তায় পোঁদ ঘষতে ঘষতে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল আর দুনিয়ায় মানবজাতির আবির্ভাব হল।]
    এমন যুক্তিহীন হাস্যকর কথা কখনো শুনেছে? এইসব আলতু-ফালতু চিজ আধুনিক স্কুলে পড়ানো হয়।

    আমার বাক্যি হরে গেছে। ভাবছি ডারউইনের বিবর্তনবাদের কী গ্রাফিক বর্ণনা! কী অসাধারণ চিত্রকল্প!

    এবার বাসের অধিকাংশ জনগ্ণ প্রচারকের সঙ্গে সায় দিয়ে মাথা নাড়ল, বই বিক্কিরিও শুরু হল।
  • ranjan roy | 24.99.183.153 | ১৯ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৩৩527571
  • হই-হই শুরু হয়ে গেল। দেওয়ানজি হাঁক দিলেন। দু'রাউন্ড চায়ের দাম ওসুল! সবাই মেতে উঠলো ক্রিশ্চিয়ানদের আর পাদ্রিসাহেবদের নিয়ে চুটকি ও ব্যক্তিগত অনুভবের গল্প শোনাতে। বিমল মিশ্রের গল্প আর কেউ শুনছে না।
    কিন্তু মিশ্রজি ঘাঘু সাংবাদিক, স্থানীয় রাজনীতির মোটামুটি নামকরা পত্রকার।
    সবার নজর কাড়তে উনি স্ট্র্যাটেজি বদলে ঠাট্টাতামাশার পরিবেশ বদলে গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে শুরু করলেনঃ
    ---"আসলে ছত্তিশগড়ে ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটি হল সব আড্ডার পাঞ্চিং ব্যাগ। এখানকার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নিক্তিতে ধর্মপরিবর্তন করে ইসাই হওয়া পরিবারের মেয়েরা নিজেদের ফরওয়ার্ড দেখাতে তক্ষুণি পোশাকে আশাকে আচারে বিচারে নিজেদের বদলে ফেলে।
    ছোট্ট সমাজের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে অনেক সহজ ভাবে মেলামেশা করে। রোববার রোববার গির্জেয় যাওয়া-আসার পথে মুচকি হাসি, চোখের চাওয়ার হাওয়া স্থানীয় লিংগোতে আই-টনিকের কাজ করে।
    তাই এই সমাজের মেয়েদের একটি কোড নেম হল চিড়ই। ,মানে চড়াই পাখি। কারণ ওরা নাকি চড়াই পাখির মত তিরিক-তিরিক লাফিয়ে বেড়ায় আর চিড়িক-চিড়িক করে হেটো ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে উচ্চগ্রামে কথা বলে।"
    ব্যাংক ম্যানেজার দেবাংগন দোহার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেঃ
    --"ঠিক বলেছেন আপনি। আমার বদলি হয়েছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর ৬ এর পাশে জগদীশপুর বলে গ্রামে। আসলে ওটা কানাডার মেনোনাইট চার্চের ছত্তিশগড়ের হেড কোয়ার্টার। হাসপাতাল-স্কুল-চার্চ সব আছে। বুঝলেন, সেখানে দেখি স্থানীয় লোকজন ওই জনপদকে বলে নিউ ইয়র্ক। কেন? ওখানকার মেয়েরা নাকি পোশাকে- আশাকে চলনে-বলনে রাজধানী রায়পুরকেও ছাড়িয়ে যায়।"

    বাধা পড়ায় বিরক্ত মিশ্রজি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে আবার নিজের কথার খেই ধরে নিলেনঃ
    -"সাধারণতঃ এই কমিউনিটি গড়ে ওঠে আদিবাসী ও হরিজনদের ধর্ম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। গ্রাম সমাজে দলিতদের স্থান হয় গ্রামের একপ্রান্তে, ভাটা বা রুক্ষ, অনুর্বর জমির ওপর ফ্রি তে চালাঘর তুলে।
    তাই এই প্রান্তিক মানুষগুলো ধর্মান্তরিত হয়ে চার্চের আশ্রয়ে সবচেয়ে আগে পেটভরে খাওয়া পায়। চার্চের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা বস্তা বস্তা গম নাম্মাত্র মূল্যে বা বিনে পয়সায় এদের দেয়া হয়। কেউ কেউ চার্চে বা স্কুলে বা হাসপাতালে আয়া, চাপরাশি বা ড্রাইভারের কাজ পেয়ে যায়। আর পায়-জামাকাপড়। বাইরে থেকে আসা, সম্ভবতঃ সায়েবদের ব্যবহৃত, সেকেন্ড হ্যান্ড মাল। কিন্তু সেগুলোর কাট-ছাঁট এমন যে সবার চোখ টাটায়।

    দেখতে দেখতে রিয়েল ইনকাম বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারটির জীবনযাত্রার মান বদলে যায়। ওরা এক অর্থে জাতে ওঠে।
    আর একটা কথা। এই লোক্গুলো গাঁয়ের হিন্দু মন্দিরে ঢুকতে পারেনি। ওদের ছোঁয়ায় ভগবানও অপবিত্র হয়ে যান। কিন্তু প্রভু যীশুর সামনে সব সমান। তাই একবার কেরেস্তান হয়ে এরা যখন অন্ন-বস্ত্র ও সম্মান পায়, পায় আত্মার আরাম, এদের পুরনো খাঁচায় ঢোকানো মুশকিল হয়ে পড়ে।"
    এবার হাত তুলেছেন লাফটার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তামসকর; ঘোর আর এস এস -পন্থী।
    ---- আমরা কি সাতসকালে কোন পাদরিবাবার বক্তৃতা শুনতে এয়েচি?
    সবাই চুপ। পরিবেশ থমথমে।
    দেওয়ানজি হালকা করার চেষ্টায় বলেন-- আরে কিছু হাতে- গরম অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবে তো বসি, নইলে বাজারে যাই।
    ফক্কড় গোপালদাস বলে-- আরে সেই "চুমায়ন কার্যক্রম" বা সার্বজনিক চুমু খাওয়ার গল্পটা বলুন না।
    সবার মুখে ফিচেল হাসি।
    --সার্বজনিক চুমু? চুমায়ন কার্যক্রম? সে আবার কি!
    মৃদু হাসেন মিশ্রজি।-- কিসিং সেরিমনি! বলছি।
  • ranjan roy | 24.99.33.184 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ০০:২৪527573
  • তখন আমার কার্যস্থল রায়পুর মহাসমুন্দ হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে নং ৬ ধরে ওড়িষ্যার বরগড়-সম্বলপুরের সীমানাঅব্দি। মানে মুম্বাই-কোলকাতা হাইওয়ের রায়পুর ডিভিশন এলাকা।
    সেইসময় এত ট্রেন ও ভলভো বাস দেখা যেত না। আর রাস্তাঘাটের অবস্থাও এত ভাল ছিল না।
    শীতের দুপুরে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম।হঠাৎ দেখি জোসেফ গড়রিয়া।মেননাইট চার্চের কর্মকর্তা। দেখলে মনে হবে কেরালার লোক, আসলে ছত্তিশগড়ি আদিবাসী। ধর্মান্তরিত হয়ে ইসাই হয়েছে। সব সময় একটা মেড ইন ইউ এস এ মার্কা টি-শার্ট বা জ্যাকেট পরে থাকে। আমাকে কিছু কিছু খবর টবর দেয়, অধিকাংশ সরকারি অফিসারদের ঘুষ খাওয়া বা যৌন কেলেংকারি নিয়ে। বেশিরভাগ খবরের কোন সাপোর্ট ডকুমেন্ট বা সাক্ষী পাওয়া মুশকিল, ছাপলে লাইবেল এর দায়ে জেলে যেতে হবে।
    আমাকে দেখে হড়বড় করে মোটরবাইক থেকে নেমে বলল-- কদ্দূর যাবেন? মহাসমুন্দ না সরাইপালী?
    --- মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে ওই বসনা অব্দি।
    --- খুব ভালো হল। আপনাকে বাসে যেতে হবে না। মিশনের জীপ যাচ্ছে। কানাডা থেকে পাদরিবাবা এসেছেন। মানা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে গাড়ি আসছে। এইখানে আর মিনিট পনের দাঁড়ান। সঙ্গে ফাদার মনোহর লাল যাচ্ছেন। কিন্তু আপনি সঙ্গে গেলে গোরাচামড়া পাদরিবাবার ইংরিজি বুকনি ও বকবকের ব্যাখ্যা করে দিতে পারবেন। রাজি হয়ে যান। আমাদের গাড়িতে আরামে যাবেন আর ১২০ কিলোমিটার পথ আড়াই থেকে তিনঘন্টায় পৌঁছে যাবেন। কফি জলখাবার ড্রাইফুট এসবও জুটবে, না করবেন না। আপনি গেলে আমার আর যেতে হবে না। গিন্নির শরীর ভাল নয়।

    যাত্রা শুরু হল। প্রত্যাশামত কফি-নাস্তা-ড্রাইফ্রুট সবই জুটছিল । ষাটোর্ধ্ব গোরা পাদ্রীবাবা ভাঙা ভাঙা হিন্দি শিখেছেন! ফাদার মনোহরের থেকে এখানে চার্চের সেবামূলক কাজ কেমন চলছে,, নেটিভদের মধ্যে প্রভূর মাহাত্ম্য কদ্দূর ছড়িয়েছে সেসব জিগ্যেস করতে লাগলেন। দেশি পাদ্রীবাবা দেখলাম বেশ বাড়িয়ে রিপোর্ট দিচ্ছে।
    শীতের সন্ধ্যে একটু তাড়াতাড়ি নামে।
    মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে পিথৌরা পৌঁছতে পৌঁছতে ঝুপ্পুস করে গাঢ় কালো পর্দার মত অন্ধকার নেমে এল।রাস্তার দুধারে ধানক্ষেত ,একটু কুয়াশার ভাব। ধানকাটা চলছে। এই সময় নানান পোকা ওড়ে , গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পোকারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে য্তক্ষণ সম্ভব আলো জ্বালানো হয় নি। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষের রাত। ড্রাইভারকে বললাম-- হেডালাইট জ্বালিয়ে দাও।একটু ডিপার দিয়ে দেখে নাও।

    গাড়ির আলো জ্বলে উঠতেই এক অদ্ভূত দৃশ্য ফুটে উঠল। রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে বসে থাকা মেয়ের দল গাড়ু হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
    বিলিতি ফাদার পুলকিত। মনে করলেন এই শীতের সন্ধ্যায় ইশুমন্ত্রে নবদীক্ষিত নারীরা দলে দলে চারপাশের গ্রাম থেকে ওঁকে বরণ করতে সারিবেঁধে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে!
    --- প্যাস্টর! টেল য়োর ড্রাইভার টু স্লো-ডাউন।
    গাড়ি এবার ধীরে ধীরে এগোয়। যত এগোয় তত আলোর বৃত্তে ক্রমশঃ গাড়ু হাতে দাঁড়াতে থাকা মেয়ের দলের অপেরা ধরা পড়ে। বিলিতি ফাদার উত্তেজিত, উদ্বেলিত। এবার উনি নীচে নেমে গাড়ুধারিণী মেয়েদের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন-- সিট ডাউন, সিট ডাউন! বইঠো, বইঠো। ডোন্ট স্ট্যন্ড অন সেরিমনি।
    আমি আর প্যাস্টর মনোহর লাল ওঁর দুপাশে চলতে থাকি। কানে আসে লজ্জিত অপ্রস্তুত মেয়েদের ছত্তিশগড়ি ভাষায় গালাগাল।
    -- কেইসে বুরবক হবে ডোকরা! ওকর আঁখি লা ফুটিস কা? দেখে নাই হমন কাবর এম অন্ধেরে মা বৈঠেহন লোটা লেকে?
    ( কেমন বোকাহাঁদা এই বুড়োটা? বলি চোখের মাথা খেয়েছে নাকি? ভর সন্ধ্যেয় আমরা মেয়েছেলেরা কেন অন্ধকারে গাড়ুহাতে রাস্তার ধারে বসেছি বুঝতে পারছে না? বদমাশ, মরুটে!)
    এবার বিলিতি ফাদারকে অনেক করে ' দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেকটা পথ বাকি' এইসব বলেটলে ফিরিয়ে এনে গাড়িতে বসাই, তারপর সোজা জগদীশপুর মিশনের হেডকোয়ার্টার। রাত্তিরে ওদের কাছেই থেকে যাই। কালকের দীক্ষাগ্রহণ সমারোহ দেখবো, সেটাই রিপোর্ট বানিয়ে পাঠিয়ে দেব।
  • ranjan roy | 24.99.33.184 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ০০:২৪527572
  • তখন আমার কার্যস্থল রায়পুর মহাসমুন্দ হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে নং ৬ ধরে ওড়িষ্যার বরগড়-সম্বলপুরের সীমানাঅব্দি। মানে মুম্বাই-কোলকাতা হাইওয়ের রায়পুর ডিভিশন এলাকা।
    সেইসময় এত ট্রেন ও ভলভো বাস দেখা যেত না। আর রাস্তাঘাটের অবস্থাও এত ভাল ছিল না।
    শীতের দুপুরে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম।হঠাৎ দেখি জোসেফ গড়রিয়া।মেননাইট চার্চের কর্মকর্তা। দেখলে মনে হবে কেরালার লোক, আসলে ছত্তিশগড়ি আদিবাসী। ধর্মান্তরিত হয়ে ইসাই হয়েছে। সব সময় একটা মেড ইন ইউ এস এ মার্কা টি-শার্ট বা জ্যাকেট পরে থাকে। আমাকে কিছু কিছু খবর টবর দেয়, অধিকাংশ সরকারি অফিসারদের ঘুষ খাওয়া বা যৌন কেলেংকারি নিয়ে। বেশিরভাগ খবরের কোন সাপোর্ট ডকুমেন্ট বা সাক্ষী পাওয়া মুশকিল, ছাপলে লাইবেল এর দায়ে জেলে যেতে হবে।
    আমাকে দেখে হড়বড় করে মোটরবাইক থেকে নেমে বলল-- কদ্দূর যাবেন? মহাসমুন্দ না সরাইপালী?
    --- মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে ওই বসনা অব্দি।
    --- খুব ভালো হল। আপনাকে বাসে যেতে হবে না। মিশনের জীপ যাচ্ছে। কানাডা থেকে পাদরিবাবা এসেছেন। মানা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে গাড়ি আসছে। এইখানে আর মিনিট পনের দাঁড়ান। সঙ্গে ফাদার মনোহর লাল যাচ্ছেন। কিন্তু আপনি সঙ্গে গেলে গোরাচামড়া পাদরিবাবার ইংরিজি বুকনি ও বকবকের ব্যাখ্যা করে দিতে পারবেন। রাজি হয়ে যান। আমাদের গাড়িতে আরামে যাবেন আর ১২০ কিলোমিটার পথ আড়াই থেকে তিনঘন্টায় পৌঁছে যাবেন। কফি জলখাবার ড্রাইফুট এসবও জুটবে, না করবেন না। আপনি গেলে আমার আর যেতে হবে না। গিন্নির শরীর ভাল নয়।

    যাত্রা শুরু হল। প্রত্যাশামত কফি-নাস্তা-ড্রাইফ্রুট সবই জুটছিল । ষাটোর্ধ্ব গোরা পাদ্রীবাবা ভাঙা ভাঙা হিন্দি শিখেছেন! ফাদার মনোহরের থেকে এখানে চার্চের সেবামূলক কাজ কেমন চলছে,, নেটিভদের মধ্যে প্রভূর মাহাত্ম্য কদ্দূর ছড়িয়েছে সেসব জিগ্যেস করতে লাগলেন। দেশি পাদ্রীবাবা দেখলাম বেশ বাড়িয়ে রিপোর্ট দিচ্ছে।
    শীতের সন্ধ্যে একটু তাড়াতাড়ি নামে।
    মহাসমুন্দ ছাড়িয়ে পিথৌরা পৌঁছতে পৌঁছতে ঝুপ্পুস করে গাঢ় কালো পর্দার মত অন্ধকার নেমে এল।রাস্তার দুধারে ধানক্ষেত ,একটু কুয়াশার ভাব। ধানকাটা চলছে। এই সময় নানান পোকা ওড়ে , গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পোকারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে য্তক্ষণ সম্ভব আলো জ্বালানো হয় নি। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষের রাত। ড্রাইভারকে বললাম-- হেডালাইট জ্বালিয়ে দাও।একটু ডিপার দিয়ে দেখে নাও।

    গাড়ির আলো জ্বলে উঠতেই এক অদ্ভূত দৃশ্য ফুটে উঠল। রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে বসে থাকা মেয়ের দল গাড়ু হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
    বিলিতি ফাদার পুলকিত। মনে করলেন এই শীতের সন্ধ্যায় ইশুমন্ত্রে নবদীক্ষিত নারীরা দলে দলে চারপাশের গ্রাম থেকে ওঁকে বরণ করতে সারিবেঁধে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে!
    --- প্যাস্টর! টেল য়োর ড্রাইভার টু স্লো-ডাউন।
    গাড়ি এবার ধীরে ধীরে এগোয়। যত এগোয় তত আলোর বৃত্তে ক্রমশঃ গাড়ু হাতে দাঁড়াতে থাকা মেয়ের দলের অপেরা ধরা পড়ে। বিলিতি ফাদার উত্তেজিত, উদ্বেলিত। এবার উনি নীচে নেমে গাড়ুধারিণী মেয়েদের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন-- সিট ডাউন, সিট ডাউন! বইঠো, বইঠো। ডোন্ট স্ট্যন্ড অন সেরিমনি।
    আমি আর প্যাস্টর মনোহর লাল ওঁর দুপাশে চলতে থাকি। কানে আসে লজ্জিত অপ্রস্তুত মেয়েদের ছত্তিশগড়ি ভাষায় গালাগাল।
    -- কেইসে বুরবক হবে ডোকরা! ওকর আঁখি লা ফুটিস কা? দেখে নাই হমন কাবর এম অন্ধেরে মা বৈঠেহন লোটা লেকে?
    ( কেমন বোকাহাঁদা এই বুড়োটা? বলি চোখের মাথা খেয়েছে নাকি? ভর সন্ধ্যেয় আমরা মেয়েছেলেরা কেন অন্ধকারে গাড়ুহাতে রাস্তার ধারে বসেছি বুঝতে পারছে না? বদমাশ, মরুটে!)
    এবার বিলিতি ফাদারকে অনেক করে ' দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেকটা পথ বাকি' এইসব বলেটলে ফিরিয়ে এনে গাড়িতে বসাই, তারপর সোজা জগদীশপুর মিশনের হেডকোয়ার্টার। রাত্তিরে ওদের কাছেই থেকে যাই। কালকের দীক্ষাগ্রহণ সমারোহ দেখবো, সেটাই রিপোর্ট বানিয়ে পাঠিয়ে দেব।
  • ranjan roy | 24.99.130.33 | ২২ আগস্ট ২০১৩ ০৬:৪৯527446
  • ধেত্তেরি! এই কল একবার বলল ''আপডেটে অসমর্থ", তাই আবার ক্লিক করলাম, বোঝো ঠ্যালাঃ(((
  • ranjan roy | 24.99.211.183 | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১১:৩৯527447
  • -- আর ধেত্তেরি! চুমু খাওয়ার গল্পটা কখন শুরু হবে?
    -- শুরু হয়ে গিয়েছে, একটু শান্ত হয়ে বস দিকি।
    রাত্তিরে মিশনের গেস্ট হাউসে শুয়েছিলাম, মুরগির ঝোল আর আচার সহযোগে হাতে গড়া রুটি--- খ্যাঁটন মন্দ হয় নি।
    সকালে কাফিলা চললো সিংহনপুর গাঁয়ে, একটি স্কুলের প্রাঙ্গণে দীক্ষাগ্রহণ, ব্যাপ্তিস্মা( ব্যাপটিজম) ইত্যাদি। ইত্যাদি।
    একটা লাল ভেলভেট মোড়া চেয়ারে বৃদ্ধ ফাদার বসলেন। স্থানীয় কয়ার ইংরেজি ও হিন্দিতে 'মসীহী গীত'( ক্রিশ্চিয়ান সং) গাইল। পবিত্র মন্ত্রপূত বারি ছিটোনো হল। শেষে স্থানীয় হিন্দিতে ঘোষণা করা হল--চুমায়ন কার্যক্রম(কিসিং সেরিমনি)।
    সবাই এক এক করে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ফাদারের রোজারি ঘোরানো হাতে চুমু খেল। উনি মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কেমন মনে হল কায়দা কানুন খানিকটা হিন্দুদের মতই। শুধু চুমু খাওয়াটা বাদে। হিন্দুরা বড় পিউরিটান। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিয়ে ওদের কেমন ঘেন্নাপিত্তি আছে। খালি রজনীশের হেরেটিক সেক্টটি ব্যতিক্রম। কোরেগাঁওয়ে দেখেছি চ্যালা-চেলীরা একে অন্যকে 'আমোরে আমোরে' বলে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে সোজা ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে, কখনো আবার কয়েকজন মিলে গণচুমু খাওয়া।
  • ranjan roy | 24.99.211.183 | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১৩:৫০527448
  • --- আরে বাঙালীরা ও এ'ব্যাপারে বেশ কনজার্ভেটিভ। আমার কলকতিহা বন্ধু বলেছিল।
    --অ্যাই বর্মা! তোমার বলা বলা হয়ে গেছে, এখন মিশ্রকে ব্যাটিং করতে দাও। মুখ বুজে রিজার্ভ বেঞ্চে বস।
    -- আরে শুনুন না। ভারতীয় সিনেমায় চুমু খাওয়া এল সেই ১৯৬৯ সালে। সেন্সর লিবারেল হল। আগে দেবানন্দ-- সুরাইয়া বা রাজকাপুর-নার্গিস জুটি স্লো মোশনে ঠোঁট এগিয়ে আনতেন, ক্লোজ আপ! কাট্‌। দুটো কবুতর চোঁচ মেঁ চোঁচ ডালে হ্যাঁয়, নইলে মৌমাছির হুলের চাপে ফুলেরা দুলে দুলে উঠছে।
    সবাই হেসে ফেলে।
    --কিন্তু এর মধ্যে বাঙালীর চুমু খাওয়া নিয়ে আদিখ্যেতার কি হল?
    -- শুনুন তো! বম্বে তে হই হই করে নায়ক নায়িকার চুমা-চাটি হই হই করে শুরু হয়ে গেল। ইউ সার্টিফিকেট দরাজ হাতে দেয়া হতে লাগল। কিন্তু বাংলা সিনেমার মহানায়ক , আরে যিনি 'অমানুষ' সিনেমায় ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। কি যেন নামটা-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, উত্তমকুমার। তিনি প্রেসকে বললেন-- চুমু খাওয়ার আগে নায়িকার মেডিক্যাল রিপোর্ট চাইব।
    বোঝো ঠ্যালা!
    -- অনেক হয়েছে। মিশ্রের গল্পটার একেবারে অ্যান্ড-ব্যান্ড-মোটর স্ট্যান্ড হয়ে গেছে। তবু শেষ হোক।
    মিশ্র বিরস বদনে বললেন- যাক গে, সংক্ষেপে সারছি। সিংহনপুর প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে, উড়িষ্যা বর্ডারের কাছে আদিবাসী এলাকায়।
    আকাশছোঁয়া পাহাড়ের নীচে সুন্দর গাঁ, ঢোকার মুখে বেশ বড় দীঘি। মিশন কম্পাউন্ডে গিয়ে দেখি ফাদাররা থাকেন অ্যাসবেসটসের ছাদের আটপৌরে বিল্ডিংয়ে। ছেলেরা বেশ ভাল পাকা বাড়িতে। জুনিয়র ফাদার নাম জুলিয়েন কিসকু, দেখলাম ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলছেন।
    আমি কৌতুহল চাপতে না পেরে প্রশ্নের ফুলঝড়ি লাগিয়ে দিই।
    -- এই সব ছেলেরা আসে কোত্থেকে? এদের কোন বই বা কোর্স পড়ানো হয়? আপনারা বিদেশ থেকে টাকা পান? কোন দেশ থেকে? এদের ভবিষ্যত কী?
  • ranjan roy | 24.99.42.182 | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ২৩:৪৩527449
  • সাদা জামকাপড়ে তেলচুকচুকে কালো ছোট ফাদার জানালেন যে ওঁরা পাহাড়ের ওপার থেকে গরীব ওঁরাও ছেলেদের বাপ-মার অনুমতি নিয়ে এখানে রেখে সরকারি বোর্ডের বই এবং কোর্স অনুযায়ী পড়ান ও ফুটবল খেলতে শেখান, নিখরচায়। আর সেখান স্বাস্থ্যবিধি, যেমন-- হাত ধুয়ে খাবার খাওয়া, পায়ে চপ্পল, ঠিক ভাবে দাঁত মাজা। খোলা মাঠে পায়খানা না করা, রান্না করা খাবার খাওয়া, তামাক ও মদ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি।
    এর জন্যে টাকা আসে ফ্রান্স ও জার্মানী থেকে, ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রতি ছ'মাসে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ভারত ও রাজ্য সরকারের দফতরে পাঠাতে হয়। বাচ্চাদের মেইনস্ট্রীম কোর্স পড়ানো হয়, তাই পরে সরকারি কলেজে ভর্তি হতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
    নইলে আছে আই টি আই অথবা মিশনেরই হাতের কাজ শেখানোর ওয়ার্কশপ।
    এখানে একটি নতুন ক্রিশ্চান হওয়া মেয়ের জন্মদিন। ফাদারের আশীর্বাদের পরেও চুমাওন কার্যক্রম চলতে থাকে। অনেকে লাইন দিয়ে এসে মেয়েটির হাতে উপহার তুলে দেয় আর দু'গালে চুমো খায়।
    আমি অন্য দিকে মুখ ফেরাই।
    শীতের বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, রায়পুর ফিরতে হবে। মনোহর লাল কে বলি-- গাড়ি কখন ছাড়বে?
    --------------------------****--------------------------
  • ranjan roy | 24.99.42.182 | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ২৩:৫৯527450
  • ছত্তিশগড়ের বাঙালীঃ অম্লমধুর স্মৃতিগুলো
    -------------------------------------------
    [ সেই কবে রবীন্দ্রনাথ " ফাঁকি" কবিতায় "বিনুর যখন বয়স তেইশ রোগে ধরল তারে, ওষুধে ডাক্তারে---" বলে বিলাসপুর রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এক রাত কাটানোর গল্প শুনিয়ে গেছেন। আজ সেই রুমটি তালা বন্ধ, অযত্নে পড়ে আছে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে একটি ফলকে সে কথা মুদ্রিত রয়েছে।
    প্রধানতঃ রেলের চাকরিকে কেন্দ্র করেই বাঙালীর প্রায় এক শতক আগে থেকে ছত্তিশগড়ে আসা, বিলাসপুর ও রায়পুর। তারপর ভিলাই ইস্পাত কারখানা ও আবার বাঙালীর টুকুর টুকুর চাকরি নিয়ে এসে ঘাঁটি গাড়া। বাংলা লাইব্রেরি, কালীবাড়ি ও স্টেজ গড়ে তোলা। তারপর সিটু ও সিপিএম , শেষে মুখ লুকিয়ে নকশাল।
    এরপর চিরিমিরি, বৈকুন্ঠপুর,কোরবা, বালকো ও রায়গড়। কয়লাখনি ও বাঙালী, সৌজন্যে ধানবাদ স্কুল অফ মাইনস্‌।
    না, আমি প্রবাসী বাঙালীর ইতিহাস লিখতে বসিনি, সে যোগ্যতা নেই। আমি লিখে যাচ্ছি স্মৃতির কোলাজ, টুকরো টাকরা ছবি। একটি জনগোষ্ঠী কিছু নিয়ে আসে, বয়ে আনা জিনিসগুলো নতুন জায়গায় রোপণ করে। কিছু চারা বেঁচে ওঠে , কিন্তু নতুন জমির গুণে রঙ বদলায়, কিছু বাঁচে না।
    আরও আছে, মানা উপনিবেশ, মরিচঝাঁপি ট্র্যাজেডির পূর্ব ও উত্তরসূরীরা।
    আসুন চেষ্টা করি ফোঁড় তুলতে একটি নকশিকাঁথায়।]
  • ranjan roy | 24.96.88.126 | ০৬ অক্টোবর ২০১৩ ০০:৩৩527451
  • আহিরণ নদীর জলে ভেসে যায় যত ময়লা কালো
  • ranjan roy | 24.99.135.194 | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০০:২৯527452
  • মুশকিল আসান
    রোববারের বাজারটা সারতে এমনিই আমার একটু সময় লেগে যায়।থলেটা একটু ভারি হয়। একটু আমিষের গন্ধ, একটু ফলফুলুরি, পথেঘাটে কিছু চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি, একটু গল্পগাছা, মোড়ের দোকানে কড়িমিঠি চা। ছোটশহর, তার শেষপ্রান্তে গিয়ে পেট্রলপাম্প থেকে মোটরবাইকে এ সপ্তাহের খোরাক লিটারতিনেক তেল ভরানো। তারপর বাড়ি ফিরে ঘেমোজামা ছেড়ে আরো এককাপ চা খেয়ে ঘরের কাজে একটু হাত লাগানো।
    ধরুন, বাগানের গাছগুলোতে জল দেওয়া বা পাইপ দিয়ে মোটরবাইকটা ধোওয়া; আর মাসের প্রথম রোববার হলে মুদির, থুড়ি কিরানা দোকানের থেকে আসা জিনিসপত্তর, চাল ডাল তেল নুন চিনি মশলাপাতি গুছিয়ে তুলতে গিন্নির সাথে একটু হাত লাগানো। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
    আজকের রোববারটা বছরের অন্য একান্নটা রোববারের থেকে আলাদা হওয়ার কোন কথা ছিল না।কিন্তু ফিরে এসে বাজারের থলিটা নামিয়ে রাখতেই গিন্নি বললেন: জামাকাপড় ছাড়তে হবে না, তোমাকে শ্মশানে যেতে হবে।
    : এত তাড়াতাড়ি! এখন্ও অনেক কাজ বাকি; মেয়ের বিয়ে দেওয়া, ছেলেকে বড় করা।
    : ইয়ার্কি না, তোমার বন্ধু বাচ্চু, মানে বাচ্চু মিশ্রর ফোন এসেছিল। কোন বন্ধু মারা গেছে, চামু না দামু কি যেন নামটা, তোমাকে ডাকছে; দু দুবার ফোন এসেছিল।
    আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে পড়লাম। হঠাৎ যেন কোন ভুলে যাওয়া কাজ মনে পড়ে গেছে।ঘরের হাওয়া কিছুটা কমে গেছে।বললাম চামু নয় চাম্মু, কি তাই না?
    :কি জানি, অমনিই কিছু হবে।
    আমার মুখের চেহারা দেখে গিন্নি পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
    :তোমার কোন স্টাফ? তোমার সাথে কাজ করেছিল? একসময় খুব ক্লোজ ছিল?
    :ক্লোজ? তা ছিল বইকি! তবে স্টাফ নয় বন্ধু, ছেলেবেলার; যাকে বলে লংগোটিয়া ইয়ার।ও ছিল আমাদের সবার মুশকিল আসান!
    :কোনদিন দেখিনি তো? মানে বাড়িতে কখনো আসেন নি, তাই বলছিলাম।
    :হ্যাঁ, ও নিজেই নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তবে গতবছরে একবার এসেছিল, মাত্র পাঁচমিনিটের জন্যে।
    :আলাপ করাও নি!
    :সেদিন তুমি বাড়িতে ছিলে না।

    সত্যি কথাটা বলা খুব মুশকিল। সে রোববারে আমার বসার ঘরে ভারি গ্যাঞ্জাম। কলোনির মহল্লা বিকাশ সমিতির মাসিক বৈঠক। জল আর বিজলির কানেকশন বাড়ানোর জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মেয়রকে পিটিশন দিতে হবে; মুসাবিদা করা হচ্ছে, চা আর পাঁপড় আসছে, এমন সময় কাজের মহিলা মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইয়া, আপনাকে কেউ বাইরে ডাকছে।
    একটু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। বেরিয়ে দেখি চাম্মু, একটা থামের পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    : কী ব্যাপার রে? আয়, ভেতরে আয়।
    চাম্মু যেন আরও সিঁটিয়ে গেল।কিন্তু কিন্তু করে বলল: জানি, ভেতরে তোদের জরুরি মিটিং হচ্ছে, কিন্তু আমার দরকারটাও এমন যে না এসে পারলাম না।
    : আমড়াগাছি ছাড় তো! কাজের কথায় আয়।তার আগে ভেতরে চল, গিন্নির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
    ও নড়ল না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল: সরি বেণু, ওটা আরেকদিন হবে।আমাকে নেক্সট প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পেন্ড্রা যেতে হবে।ভায়রাভাই কাল মারা গেছে।ছোটশালিটা অসময়ে বেওয়া হল।
    তোর কাছে চারশ টাকা হবে?আগামী মাসের মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
    বিনা বাক্যব্যয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাটা বার করে ওর হাতে দিই। বাগানের গেট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে ও ফিরে তাকায়: তাহলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই।
    আমি মাথা নেড়ে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকে আবার সমিতির তর্কবিতর্কের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই।
    চাম্মু আর আসেনি। জানতাম ও টাকা আর ফেরত পাবো না। পথেঘাটে দেখা হয়ে গেলে: কি, ক্যামন? ভাল তো?
    ও দ্রুতগতিতে পাশ কাটাতো:হাঁ ইয়ার, সব ঠিক হ্যায়, বা বঢ়িয়া হ্যায়, সবকুছ ঠিকঠাক চল রহা হ্যায়।
    কিন্তু সবকুছ তো দুরের কথা, ওর কোনকিছুই ঠিকঠাক চলছিল না। টের পাচ্ছিলাম যে আমাদের চাম্মুর মুশকিল আসান ক্ষমতা, সেই বিশেষ শক্তি দিন দিন কমছে; তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপের মত।
  • ranjan roy | 24.99.135.194 | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০১:৪৬527453
  • (২)
    ৹মুশকিল আসানই বটে!
    আজ থেকে বছর কুড়ি আগে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর শহরে চাম্মু বা চমনলাল রোহিদাসকে অনেকেই চিনত, বিশেষ করে উনিশ কুড়ির দল। জাতে মুচি, কিন্তু দুইপুরুষ হল ওরা জাত ব্যবসা ছেড়ে চাকরিপেশা হয়েছে।বাবা কোন মুদি দোকানের কর্মচারি আর ম্যাট্রিকফেল কাকা উকিলবাবুর মুহুরি।পুরনো বস্তিতে ওদের খাপরাছাওয়া মাটির মেজেওলা কোঠাবাড়ি।স্নানের জন্যে ঘরের লাগোয়া চিলতে জমিতে একটুখানি আয়োজন। প্রাকূতিক কম্মটি সারতে ওদের মেয়েপুরুষ সবাই যায় লোটা নিয়ে পাশের খোলা মাঠে, ভোরবেলায় আর সাঁঝবেলায়।
    এই পরিবারের মেজছেলে চাম্মু ছেলেছোকরাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। পাড়ার পাঠশালা বা বালবাড়ি থেকে আমরা একসংগে পড়েছি। আমাদের নাটের গুরু ছিল বাচ্চু মিশ্র আর চাম্মু ছিল ওর কেলে হাঁড়ি।
    হাইস্কুলের সংস্কূতের টিকিধারি পন্ডিত রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চুর সংগে মুচির ঘরের চমনলাল রোহিদাসের গলায় গলায় ভাব বড়রা কেউই ভাল চোখে দেখতেন না।ফলে চাম্মু আমাদের অভিজাত পাড়ার শব্দাবলীতে চাম্মু চামার হয়েই রইল, কোনদিন চমনলাল হতে পারল না।
    অবশ্যি এ নিয়ে চাম্মুর খুব একটা হেলদোল ছিল না। বাচ্চুর বন্ধু হয়েই ও বেজায় খুশি ছিল।অনায়াসে ঢুকে যেত বাচ্চুদের বাড়িতে, বৈঠকখানা পেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে।ঢুকে কোন বলাকওয়ার বালাই নেই, সোজা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মেজেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ত: আঃ চাচি! কি ঠান্ডা তোমাদের জল গো! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
    এদিকে হায় হায় করে উঠেছেন চাচিজী,মানে বাচ্চুর মা।
    : গেল, গেল! জাতধর্ম সব গেল।হতভাগা চামার! দিলে সব ছুঁয়ে। নিজের হাতে নিলি কেন?তেষ্টা পেয়েছে তো আমাকে বলতে পারলি না?
    :তাতে কি হয়েছে গো চাচি?
    চাম্মু একগাল হাসে, বলে:এ কুঁজোটা না হয় আমি নিয়ে যাব, আমাদেরটা গেছে ভেঙে। তোমরা না হয় ঝিকে দিয়ে শনিচরী বাজার থেকে আর একটা আনিয়ে নিও।
    : হ্যাঁ রে, আনিয়ে নিও! কত খায়! কিনতে তো আর পয়সা লাগে না?বলি, হরির লুটের বাতাসা পেয়েছিস?
    : অনেক তো বকাবকি করলে, ঘরে গরম গরম কিছু থাকলে দা্ও না!আজ রোববারের সকাল, তায় মাত্র আটটা বেজেছে। মানে, তোমাদের তো এখনও নাস্তা হয়নি।
    : বলি, নোলা যে খুব! সকাল সকাল ফন্দি করেই এসেছিস। একটা কাজের সময় তোকে পাওয়া যায় না। নিজের মতলবের বেলায় ঠিক আছিস।
    : সে কি চাচি? এ মাসে তোমাদের বিজলি বিলটা শেষদিনে জমা দিল কে? সে কী লম্বা লাইন! অফিসের ভেতরে গিয়ে ভেতরের লোক ধরে আমিই তো ম্যানেজ করলাম। সব ভুলে গেলে!তোমার ছেলেটি তো একটি ধম্মের ষাঁড়। বাপের হোটেলে খায়দায় আর বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়।শেষকালে সব ঝামেলার মুস্কিল আসান বলতে এই চাম্মু ছাড়া আর কে?
    বাচ্চু কূত্রিম কোপে ঘুঁষি দেখায়। মিশ্রগিন্নি একটু নরম হন।: বালাই ষাট! ছেলেদের খুঁড়িস না। তুইও আমার ছেলের মত।
    চাম্মু একটু হাসে।
    : সেই কথাই তো বলছিলাম গো,হিসেব ধরলে আমিও তোমার ঘরের লোক। আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান।
    : নে, নে! এই একথালা ভাজিয়া নে, আর মুখটা বন্ধ রাখ। ভরসকালে আমাকে শাস্তর শেখাচ্ছে!
    চাম্মু ততক্ষণে ভাজিয়ার থালার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।এনামেলের থালা। খাওয়া হলে ও নিজেই থালাটা আঙিনার কলের জলে ধুয়ে একপাশের দেয়ালে খাড়া করে ঠেকিয়ে রেখে দেবে।
  • Ranjan Roy | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ২৩:৫৯527454
  • (৩)
    আমরা ওকে ৹মুশকিল আসান৹ বলেই জানতাম।যে কো্ন লফরা বা সমস্যার কথা শুনলে ওর একটাই জবাব ছিল: হো জায়েগা বা বন্ জায়েগা।
    : চাম্মুভাই, বড়ী মুশকিল মেঁ ফঁস গয়া হুঁ। নাথানী পরিবারের সুমিত্রা, আরে ওই যে রানী লক্ষ্মীবাঈ স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে; কাল রোববার আমার সংগে বিহারী টকিজে শোলে দেখতে রাজি হয়েছে; অনেক কষ্টে।কিন্তু বাড়ির বা পাড়ার কেউ দেখতে পেলে কেস জন্ডিস।আর, আর দশটা টাকা চাই, জোগাড় হচ্ছে না।
    চাম্মু বুঝদারের মত মাথা নাড়ে।
    : আজ বিকেলে চারটে নাগাদ দেখা করিস, কিছু একটা হয়ে যাবে।
    বিকেল বেলা চাম্মু হাতে ধরায় ইভনিং শোর দুটো টিকেট আর দশটা টাকা।
    বুঝিয়ে দেয়: সুমিত্রা যাবে রিকশায়, তুই সাইকেলে।ছটাকা রিকশা ভাড়া, চারটাকা চিনেবাদাম। ও আগে ঢুকবে। তুই পরে, ফার্স্ট বেল বাজলে, হল অন্ধকার হলে তবে।বেরোনোর সময় তুই আগে, ও আলাদা, শেষের দিকে।
    : ভাই, তোকে যে কী বলে ।
    :ব্যস,ব্যস! আর অউর চনে কী ঝাড় মেঁ (ছোলাগাছে)চড়াতে হবে না।চাম্মু যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায়।

    কলেজের দিনে্ও চাম্মু আমাদের মুশকিল আসান হয়ে রইল। কে বাবার থেকে সারা বছর কলেজের ফীস নিয়েও হোটেলে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আর পরীক্ষার সময় ফেঁসে গেছে! তার জন্যে টাকা জোগাড় কর রে। কার হাজিরি খাতায় সংখ্যাটা এত কম যে কলেজের নোটিস বোর্ডে নাম বেরিয়েছে। কলেজ সোশ্যালের দিন মারামারিতে কেউ নামজাদা বড়লোকের নাড়ুগোপালের মাথা ফাটিয়ে কেস খেয়েছে। সমস্যা আপাতত: যতই কঠিন হোক চাম্মুর কাছে তার নিদান আছে।বহুদিন বুঝিনি ওর অদূশ্য জাদুকাঠিটি কী?
    ধীরে ধীরে অনেকদিন পরে বুঝেছি যে ও হল আসলে একজন ভাল পাবলিক রিলেশন অফিসার। আর ও সবার থেকেই গুড টার্ন আশা করে। এছাড়া ও একটা ছোট ফান্ড হাতে রাখে। সে টাকাটা ও জোগাড় হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কমিশন, ওর ভাষায় সার্ভিস চার্জ, আদায় করে।
    ধরুন,জগমোহন শেঠের ইঁটভাটায় দুলাখ ইঁট পড়ে আছে।এদিকে বর্ষা প্রায় এসে পড়েছে।লোকসানের ভয় ষোলআনা। চাম্মুর কাছে খবর আছে যে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হিন্দি টিচারের ছোটখাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তাতে লাখ দেড়েক ইঁট কম পড়েছে। কিন্তু স্যারের পকেটেও যে টান পড়েছে!উনি চাইছেন যে ইঁট কোন ব্যাটা শস্তায় দিক, আবার আদ্দেক মাল ধারে দিক!ব্যস্, চাম্মু অবতীর্ণ হল ওর মুশকিল আসান অবতারে।
    হিন্দিস্যার দুবেজী প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরেন আর কি!আশীর্বাদ করলেন যে যদিও চাম্মু ভদ্রলোকের মত হিন্দি লিখতে শেখেনি, কিন্তু আজকের পূণ্যকাজের ফলে ওর ছেলেরা নিশ্চয়ই বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠবে।আর শেঠজি বাট্টাখাতায় লিখে রাখা মাল সময়মত উঠে যাওয়ায় এমন খুশি যে দু পাঁচটাকা কমিশন টমিশন ? কোন ব্যাপারই না।
    আমার কিন্তু, পরন্তু, অধিকম্তু শুনে চাম্মু একগাল হাসত: ওরে, ডাক্তারবাবুরা কোন বিশেষ ওষুধের দোকানের নাম লিখলে, রক্তপরীক্ষা বা এক্স রে করাতে বললে ওরা কিছু দেয় না? তবে? যত দোষ চাম্মুর বেলায়!
  • Ranjan Roy | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ১৪:৩৬527455
  • মুশকিল আসান
    রোববারের বাজারটা সারতে এমনিই আমার একটু সময় লেগে যায়।থলেটা একটু ভারি হয়। একটু আমিষের গন্ধ, একটু ফলফুলুরি, পথেঘাটে কিছু চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি, একটু গল্পগাছা, মোড়ের দোকানে কড়িমিঠি চা। ছোটশহর, তার শেষপ্রান্তে গিয়ে পেট্রলপাম্প থেকে মোটরবাইকে এ সপ্তাহের খোরাক লিটারতিনেক তেল ভরানো। তারপর বাড়ি ফিরে ঘেমোজামা ছেড়ে আরো এককাপ চা খেয়ে ঘরের কাজে একটু হাত লাগানো।
    ধরুন, বাগানের গাছগুলোতে জল দেওয়া বা পাইপ দিয়ে মোটরবাইকটা ধোওয়া; আর মাসের প্রথম রোববার হলে মুদির, থুড়ি কিরানা দোকানের থেকে আসা জিনিসপত্তর, চাল ডাল তেল নুন চিনি মশলাপাতি গুছিয়ে তুলতে গিন্নির সাথে একটু হাত লাগানো। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
    আজকের রোববারটা বছরের অন্য একান্নটা রোববারের থেকে আলাদা হওয়ার কোন কথা ছিল না।কিন্তু ফিরে এসে বাজারের থলিটা নামিয়ে রাখতেই গিন্নি বললেন: জামাকাপড় ছাড়তে হবে না, তোমাকে শ্মশানে যেতে হবে।
    : এত তাড়াতাড়ি! এখন্ও অনেক কাজ বাকি; মেয়ের বিয়ে দেওয়া, ছেলেকে বড় করা।
    : ইয়ার্কি না, তোমার বন্ধু বাচ্চু, মানে বাচ্চু মিশ্রর ফোন এসেছিল। কোন বন্ধু মারা গেছে, চামু না দামু কি যেন নামটা, তোমাকে ডাকছে; দু দুবার ফোন এসেছিল।
    আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে পড়লাম। হঠাৎ যেন কোন ভুলে যাওয়া কাজ মনে পড়ে গেছে।ঘরের হাওয়া কিছুটা কমে গেছে।বললাম চামু নয় চাম্মু, কি তাই না?
    :কি জানি, অমনিই কিছু হবে।
    আমার মুখের চেহারা দেখে গিন্নি পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
    :তোমার কোন স্টাফ? তোমার সাথে কাজ করেছিল? একসময় খুব ক্লোজ ছিল?
    :ক্লোজ? তা ছিল বইকি! তবে স্টাফ নয় বন্ধু, ছেলেবেলার; যাকে বলে লংগোটিয়া ইয়ার।ও ছিল আমাদের সবার মুশকিল আসান!
    :কোনদিন দেখিনি তো? মানে বাড়িতে কখনো আসেন নি, তাই বলছিলাম।
    :হ্যাঁ, ও নিজেই নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তবে গতবছরে একবার এসেছিল, মাত্র পাঁচমিনিটের জন্যে।
    :আলাপ করাও নি!
    :সেদিন তুমি বাড়িতে ছিলে না।

    সত্যি কথাটা বলা খুব মুশকিল। সে রোববারে আমার বসার ঘরে ভারি গ্যাঞ্জাম। কলোনির মহল্লা বিকাশ সমিতির মাসিক বৈঠক। জল আর বিজলির কানেকশন বাড়ানোর জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মেয়রকে পিটিশন দিতে হবে; মুসাবিদা করা হচ্ছে, চা আর পাঁপড় আসছে, এমন সময় কাজের মহিলা মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইয়া, আপনাকে কেউ বাইরে ডাকছে।
    একটু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। বেরিয়ে দেখি চাম্মু, একটা থামের পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    : কী ব্যাপার রে? আয়, ভেতরে আয়।
    চাম্মু যেন আরও সিঁটিয়ে গেল।কিন্তু কিন্তু করে বলল: জানি, ভেতরে তোদের জরুরি মিটিং হচ্ছে, কিন্তু আমার দরকারটাও এমন যে না এসে পারলাম না।
    : আমড়াগাছি ছাড় তো! কাজের কথায় আয়।তার আগে ভেতরে চল, গিন্নির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
    ও নড়ল না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল: সরি বেণু, ওটা আরেকদিন হবে।আমাকে নেক্সট প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পেন্ড্রা যেতে হবে।ভায়রাভাই কাল মারা গেছে।ছোটশালিটা অসময়ে বেওয়া হল।
    তোর কাছে চারশ টাকা হবে?আগামী মাসের মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
    বিনা বাক্যব্যয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাটা বার করে ওর হাতে দিই। বাগানের গেট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে ও ফিরে তাকায়: তাহলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই।
    আমি মাথা নেড়ে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকে আবার সমিতির তর্কবিতর্কের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই।
    চাম্মু আর আসেনি। জানতাম ও টাকা আর ফেরত পাবো না। পথেঘাটে দেখা হয়ে গেলে: কি, ক্যামন? ভাল তো?
    ও দ্রুতগতিতে পাশ কাটাতো:হাঁ ইয়ার, সব ঠিক হ্যায়, বা বঢ়িয়া হ্যায়, সবকুছ ঠিকঠাক চল রহা হ্যায়।
    কিন্তু সবকুছ তো দুরের কথা, ওর কোনকিছুই ঠিকঠাক চলছিল না। টের পাচ্ছিলাম যে আমাদের চাম্মুর মুশকিল আসান ক্ষমতা, সেই বিশেষ শক্তি দিন দিন কমছে; তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপের মত।

    (২)
    ৹মুশকিল আসানই বটে!
    আজ থেকে বছর কুড়ি আগে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর শহরে চাম্মু বা চমনলাল রোহিদাসকে অনেকেই চিনত, বিশেষ করে উনিশ কুড়ির দল। জাতে মুচি, কিন্তু দুইপুরুষ হল ওরা জাত ব্যবসা ছেড়ে চাকরিপেশা হয়েছে।বাবা কোন মুদি দোকানের কর্মচারি আর ম্যাট্রিকফেল কাকা উকিলবাবুর মুহুরি।পুরনো বস্তিতে ওদের খাপরাছাওয়া মাটির মেজেওলা কোঠাবাড়ি।স্নানের জন্যে ঘরের লাগোয়া চিলতে জমিতে একটুখানি আয়োজন। প্রাকূতিক কম্মটি সারতে ওদের মেয়েপুরুষ সবাই যায় লোটা নিয়ে পাশের খোলা মাঠে, ভোরবেলায় আর সাঁঝবেলায়।
    এই পরিবারের মেজছেলে চাম্মু ছেলেছোকরাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। পাড়ার পাঠশালা বা বালবাড়ি থেকে আমরা একসংগে পড়েছি। আমাদের নাটের গুরু ছিল বাচ্চু মিশ্র আর চাম্মু ছিল ওর কেলে হাঁড়ি।
    হাইস্কুলের সংস্কূতের টিকিধারি পন্ডিত রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চুর সংগে মুচির ঘরের চমনলাল রোহিদাসের গলায় গলায় ভাব বড়রা কেউই ভাল চোখে দেখতেন না।ফলে চাম্মু আমাদের অভিজাত পাড়ার শব্দাবলীতে চাম্মু চামার হয়েই রইল, কোনদিন চমনলাল হতে পারল না।
    অবশ্যি এ নিয়ে চাম্মুর খুব একটা হেলদোল ছিল না। বাচ্চুর বন্ধু হয়েই ও বেজায় খুশি ছিল।অনায়াসে ঢুকে যেত বাচ্চুদের বাড়িতে, বৈঠকখানা পেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে।ঢুকে কোন বলাকওয়ার বালাই নেই, সোজা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মেজেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ত: আঃ চাচি! কি ঠান্ডা তোমাদের জল গো! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
    এদিকে হায় হায় করে উঠেছেন চাচিজী,মানে বাচ্চুর মা।
    : গেল, গেল! জাতধর্ম সব গেল।হতভাগা চামার! দিলে সব ছুঁয়ে। নিজের হাতে নিলি কেন?তেষ্টা পেয়েছে তো আমাকে বলতে পারলি না?
    :তাতে কি হয়েছে গো চাচি?
    চাম্মু একগাল হাসে, বলে:এ কুঁজোটা না হয় আমি নিয়ে যাব, আমাদেরটা গেছে ভেঙে। তোমরা না হয় ঝিকে দিয়ে শনিচরী বাজার থেকে আর একটা আনিয়ে নিও।
    : হ্যাঁ রে, আনিয়ে নিও! কত খায়! কিনতে তো আর পয়সা লাগে না?বলি, হরির লুটের বাতাসা পেয়েছিস?
    : অনেক তো বকাবকি করলে, ঘরে গরম গরম কিছু থাকলে দা্ও না!আজ রোববারের সকাল, তায় মাত্র আটটা বেজেছে। মানে, তোমাদের তো এখনও নাস্তা হয়নি।
    : বলি, নোলা যে খুব! সকাল সকাল ফন্দি করেই এসেছিস। একটা কাজের সময় তোকে পাওয়া যায় না। নিজের মতলবের বেলায় ঠিক আছিস।
    : সে কি চাচি? এ মাসে তোমাদের বিজলি বিলটা শেষদিনে জমা দিল কে? সে কী লম্বা লাইন! অফিসের ভেতরে গিয়ে ভেতরের লোক ধরে আমিই তো ম্যানেজ করলাম। সব ভুলে গেলে!তোমার ছেলেটি তো একটি ধম্মের ষাঁড়। বাপের হোটেলে খায়দায় আর বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়।শেষকালে সব ঝামেলার মুস্কিল আসান বলতে এই চাম্মু ছাড়া আর কে?
    বাচ্চু কূত্রিম কোপে ঘুঁষি দেখায়। মিশ্রগিন্নি একটু নরম হন।: বালাই ষাট! ছেলেদের খুঁড়িস না। তুইও আমার ছেলের মত।
    চাম্মু একটু হাসে।
    : সেই কথাই তো বলছিলাম গো,হিসেব ধরলে আমিও তোমার ঘরের লোক। আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান।
    : নে, নে! এই একথালা ভাজিয়া নে, আর মুখটা বন্ধ রাখ। ভরসকালে আমাকে শাস্তর শেখাচ্ছে!
    চাম্মু ততক্ষণে ভাজিয়ার থালার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।এনামেলের থালা। খাওয়া হলে ও নিজেই থালাটা আঙিনার কলের জলে ধুয়ে একপাশের দেয়ালে খাড়া করে ঠেকিয়ে রেখে দেবে।
    (৩)
    আমরা ওকে ৹মুশকিল আসান৹ বলেই জানতাম।যে কো্ন লফরা বা সমস্যার কথা শুনলে ওর একটাই জবাব ছিল: হো জায়েগা বা বন্ জায়েগা।
    : চাম্মুভাই, বড়ী মুশকিল মেঁ ফঁস গয়া হুঁ। নাথানী পরিবারের সুমিত্রা, আরে ওই যে রানী লক্ষ্মীবাঈ স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে; কাল রোববার আমার সংগে বিহারী টকিজে শোলে দেখতে রাজি হয়েছে; অনেক কষ্টে।কিন্তু বাড়ির বা পাড়ার কেউ দেখতে পেলে কেস জন্ডিস।আর, আর দশটা টাকা চাই, জোগাড় হচ্ছে না।
    চাম্মু বুঝদারের মত মাথা নাড়ে।
    : আজ বিকেলে চারটে নাগাদ দেখা করিস, কিছু একটা হয়ে যাবে।
    বিকেল বেলা চাম্মু হাতে ধরায় ইভনিং শোর দুটো টিকেট আর দশটা টাকা।
    বুঝিয়ে দেয়: সুমিত্রা যাবে রিকশায়, তুই সাইকেলে।ছটাকা রিকশা ভাড়া, চারটাকা চিনেবাদাম। ও আগে ঢুকবে। তুই পরে, ফার্স্ট বেল বাজলে, হল অন্ধকার হলে তবে।বেরোনোর সময় তুই আগে, ও আলাদা, শেষের দিকে।
    : ভাই, তোকে যে কী বলে ।
    :ব্যস,ব্যস! আর অউর চনে কী ঝাড় মেঁ (ছোলাগাছে)চড়াতে হবে না।চাম্মু যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায়।

    কলেজের দিনে্ও চাম্মু আমাদের মুশকিল আসান হয়ে রইল। কে বাবার থেকে সারা বছর কলেজের ফীস নিয়েও হোটেলে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আর পরীক্ষার সময় ফেঁসে গেছে! তার জন্যে টাকা জোগাড় কর রে। কার হাজিরি খাতায় সংখ্যাটা এত কম যে কলেজের নোটিস বোর্ডে নাম বেরিয়েছে। কলেজ সোশ্যালের দিন মারামারিতে কেউ নামজাদা বড়লোকের নাড়ুগোপালের মাথা ফাটিয়ে কেস খেয়েছে। সমস্যা আপাতত: যতই কঠিন হোক চাম্মুর কাছে তার নিদান আছে।বহুদিন বুঝিনি ওর অদূশ্য জাদুকাঠিটি কী?
    ধীরে ধীরে অনেকদিন পরে বুঝেছি যে ও হল আসলে একজন ভাল পাবলিক রিলেশন অফিসার। আর ও সবার থেকেই গুড টার্ন আশা করে। এছাড়া ও একটা ছোট ফান্ড হাতে রাখে। সে টাকাটা ও জোগাড় হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কমিশন, ওর ভাষায় সার্ভিস চার্জ, আদায় করে।
    ধরুন,জগমোহন শেঠের ইঁটভাটায় দুলাখ ইঁট পড়ে আছে।এদিকে বর্ষা প্রায় এসে পড়েছে।লোকসানের ভয় ষোলআনা। চাম্মুর কাছে খবর আছে যে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হিন্দি টিচারের ছোটখাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তাতে লাখ দেড়েক ইঁট কম পড়েছে। কিন্তু স্যারের পকেটেও যে টান পড়েছে!উনি চাইছেন যে ইঁট কোন ব্যাটা শস্তায় দিক, আবার আদ্দেক মাল ধারে দিক!ব্যস্, চাম্মু অবতীর্ণ হল ওর মুশকিল আসান অবতারে।
    হিন্দিস্যার দুবেজী প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরেন আর কি!আশীর্বাদ করলেন যে যদিও চাম্মু ভদ্রলোকের মত হিন্দি লিখতে শেখেনি, কিন্তু আজকের পূণ্যকাজের ফলে ওর ছেলেরা নিশ্চয়ই বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠবে।আর শেঠজি বাট্টাখাতায় লিখে রাখা মাল সময়মত উঠে যাওয়ায় এমন খুশি যে দু পাঁচটাকা কমিশন টমিশন ? কোন ব্যাপারই না।
    আমার কিন্তু, পরন্তু, অধিকম্তু শুনে চাম্মু একগাল হাসত: ওরে, ডাক্তারবাবুরা কোন বিশেষ ওষুধের দোকানের নাম লিখলে, রক্তপরীক্ষা বা এক্স রে করাতে বললে ওরা কিছু দেয় না? তবে? যত দোষ চাম্মুর বেলায়!

    (৪)
    বাচ্চুর সংগে ওর বন্ধুত্ব আগের মতই রয়ে গেল।
    সেবার দূর্গাপূজোর পরে ঈদ। আমরা খবর পেলাম যে মুশায়েরা বা উর্দূকবিতা পাঠের আসরের পরের দিনই কাওয়ালি, মধ্যনগরী চৌকে।আসছে যে সে নয়, কাওয়ালি সম্রাজ্ঞী শাকিলাবানো ভোপালী!আহা, যেমন হাজিরজবাব, তেমনি আদা, তেমনি নাজনখরা; ব্যস্, বিলাসপুর শহরের যৌবনে আগুন ধরে গেল।টিকিট নিয়ে কাজিয়াকেত্তন, মারামারি, আমরা হাল ছেড়ে দিলাম।
    ঠিক দুদিন আগে চাম্মু বিকেলের ঠেকে ঢুকল দাঁত বের করে।
    : তিনটে টিকিট জোগাড় করেছি, দুটো তো বেণু আর আমি, তিননম্বরটা কে বাওয়া?
    আমি অবাক, কেন? বাচ্চু যাবে না?
    :জিজ্ঞেস কর। রামখিলাওন মহারাজ জানতে পারলে আমার আর ওর পিঠের চামড়া তুলে নেবে।
    :বাবা গেছে রায়পুরে, ছোটকাকার শরীর খারাপ,তাই। ফিরতে সেই সোমবার।তার মানে বুঝলি?
    বাচ্চু মিটিমিটি হাসে।
    আমি চেঁচিয়ে উঠি: খুব বুঝেছি। তার মানে আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স যাচ্ছি কাওয়ালি কুইন, মালিকা এ তরন্নুম, ভোপাল কী শাকিলার নাজ নখরা, হুস্ন দেখে দাদ দিতে।
    :ঈরশাদ! ঈরশাদ!
    :তওবা! তওবা!
    এবার বাচ্চু বলে উঠল: উঠাও এক জাম, শাকিলাকে নাম!
    আর আমরা তিনজনে চায়ের গ্লাস একসংগে ঠেকিয়ে মূদু ঠুন্ ঠুন্ আওয়াজ তুলি।
    কাওয়ালি দারুণ জমে উঠল। শাকিলা বানো ফাটাফাটি!প্রায় রাত বারোটায় আমরা বাড়ি ফিরছি, মনে কাওয়ালির রেশ।প্রথমে বাচ্চুর বাড়ি, মশানগঞ্জ পাড়ার শুরুতেই।
    বাচ্চু বাড়ি ঢুকতে যাবে, আমি বললাম যে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ, ভেতর থেকে দুগেলাস জল নিয়ে আসুক।এমন সময় চাম্মু কাওয়ালির মিসরা (প্রথম পংক্তি) গুনগুন করতে করতে বলল,
    : হ্যাঁরে বাচ্চু, রামখিলাওনের কী খবর?কবে বাড়ি ফিরবে?তোর বাবার ঘরে ফিরতে মন নেই কেন রে! চাচি একলা আছেন, এটা ভাবতে হয় না?
    আমাদের পেটের ভেতর থেকে হাসি সোডার মতন বুড়বুড়ি কেটে বাইরে বেরোনোর আগেই অন্ধকারে গর্জন শোনা গেল: হারামজাদা চামার! বাপের বয়সি লোকেদের নামধরে ইয়ার্কি!জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতে হয়।
    রামখিলাওন ফিরে এসেছেন!
    আমি আর চাম্মু জলতেষ্টা ভুলে সাইকেল তুলে হাওয়া।
  • Ranjan Roy | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ১৪:৪৪527457
  • ধ্যাৎতেরি!
    প্রথম তিনটে অধ্যায় ডাবল পোস্ট হয়েছে। ওগুলো ডিলিট করতে পারছি না। করা যায় কি?
    ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবো।
  • Ranjan Roy | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ২৩:৫৬527458
  • (৫)
    যথাসময়ে পরীক্ষা টরিক্ষা দিয়ে আমি ব্যাংকে ঢুকলাম আর চাম্মুও তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের জোরে স্থানীয় বড় পোস্টাপিসের পিয়ন হয়ে গেল। আমার এদিক ওদিক বদলির মধ্যেও খবর পেতাম বেড়ে আছে চাম্মু। বিয়ে করল বুধওয়ারি পাড়ার পার্বতীকে।শ্বশুর মিউনিসিপ্যালিটির চৌকিদার। আমরা সবাই বরযাত্রী গিয়েছিলাম; তাসাপার্টি, মাংসভাত আর গুলাবজামুন।তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওর শ্বশুরের মহুয়া খেয়ে নাচ!
    সংসার চলল বাঁধাগতে।ও প্রমোশন পেয়ে হেড পিওন হল। ওর বাবা বললেন দুলহন বড় পয়মন্ত।এর কমাসের মধ্যেই বাবা চলে গেলেন। ও সাবেকি ঘরের পাশে খাপরার চাল ছাওয়া দুটো পাকা ঘর তুলে আলাদা হয়ে গেল।
    তবে ওর মুশকিল আসান প্রতিভা তখন তুঙ্গে।
    আমি তখন কোরবার কাছে বালকোনগর ব্রাঞ্চে বদলি হয়েছি।মাসের শুরুতে এক শনিবারে বিলাসপুরে এসে বাবার হাতে সংসারখরচের টাকা ধরিয়ে রোববারে বন্ধুদের সংগে আড্ডা দিয়ে সোমবার ভোরে বালকো ফিরে যেতাম।
    এমনি এক শনিবারে কাজের চাপ আর বাসের গন্ডগোলে বিলাসপুর পৌঁছতে একটু রাত হয়ে গেল।বাড়ির সামনে এসে অবাক, দরজায় ঝুলছে বড় তালা, চারদিক বন্ধ। পাশের বাড়ির থেকে জানলাম যে ছোটমামার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে মা তাড়াহুড়ো করে বাবার সংগে নাগপুর রওনা হয়ে গেছেন, ঘরের চাবি ছেড়ে যান নি।
    সে তো হল, এখন আমি যাই কোথায়?পাশের বাড়ির ভাড়াটেরা নতুন এসেছে, আমার সংগে নেহাৎ মুখচেনা।গেলাম মুশকিল আসান চাম্মুর ঠেকে।
    চাম্মু আগের মতই সহজভাবে বলল: হো জায়েগা।তারপর বলল, এখন রাত্তির সাড়ে এগারোটা। সবার বাড়িতে মেয়েরা উনুন নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে।তবে তুই ভাবিস নে বেণু, কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে।
    হয়ে যে যাবে সে নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যা হল তার জন্যে আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না বোধহয়।
    পোস্টঅফিসের হেড পিওন চাম্মু আমাকে নিয়ে চুপচাপ মেনগেটের তালা খুলল।ভেতরের হলঘরে তিনটে টেবিল জোড়া দিয়ে চাদর বিছিয়ে দিল।সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে বলল: নো টেনশন বেণু! তুই আর আমি পাশাপাশি শুয়ে গল্প করব যতক্ষণ ঘুম না আসে।তার আগে তোর খাবারের জোগাড় করি গে।ততক্ষণ তুই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে লাগোয়া বাথরুমে চান পায়খানা সেরে নে।
    আমি বাইরে থেকে শুধু সদর দরজাটায় তালা লাগিয়ে যাচ্ছি। ফিরে এসে থেমে থেমে দুটো টোকা দেব, তবে খুলবি। ভয়ের কিছু নেই।
    সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছল। খালি প্রতাপ হোটেলের বেয়ারাদের তখন্ও খাওয়া শেষ হয় নি।
    সেখান থেকে ও নিয়ে এল গোটা আষ্টেক রুটি, কিছুটা মাংসের ঝোল, আলুর চোখা আর স্যালাড।তাই আমরা দুই বন্ধু মহানন্দে সাঁটালাম।তারপর পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছে টের পাইনি।
  • Ranjan Roy | ০৯ অক্টোবর ২০১৩ ১৬:১৭527459
  • মুশকিল আসান
    রোববারের বাজারটা সারতে এমনিই আমার একটু সময় লেগে যায়।থলেটা একটু ভারি হয়। একটু আমিষের গন্ধ, একটু ফলফুলুরি, পথেঘাটে কিছু চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি, একটু গল্পগাছা, মোড়ের দোকানে কড়িমিঠি চা। ছোটশহর, তার শেষপ্রান্তে গিয়ে পেট্রলপাম্প থেকে মোটরবাইকে এ সপ্তাহের খোরাক লিটারতিনেক তেল ভরানো। তারপর বাড়ি ফিরে ঘেমোজামা ছেড়ে আরো এককাপ চা খেয়ে ঘরের কাজে একটু হাত লাগানো।
    ধরুন, বাগানের গাছগুলোতে জল দেওয়া বা পাইপ দিয়ে মোটরবাইকটা ধোওয়া; আর মাসের প্রথম রোববার হলে মুদির, থুড়ি কিরানা দোকানের থেকে আসা জিনিসপত্তর, চাল ডাল তেল নুন চিনি মশলাপাতি গুছিয়ে তুলতে গিন্নির সাথে একটু হাত লাগানো। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
    আজকের রোববারটা বছরের অন্য একান্নটা রোববারের থেকে আলাদা হওয়ার কোন কথা ছিল না।কিন্তু ফিরে এসে বাজারের থলিটা নামিয়ে রাখতেই গিন্নি বললেন: জামাকাপড় ছাড়তে হবে না, তোমাকে শ্মশানে যেতে হবে।
    : এত তাড়াতাড়ি! এখন্ও অনেক কাজ বাকি; মেয়ের বিয়ে দেওয়া, ছেলেকে বড় করা।
    : ইয়ার্কি না, তোমার বন্ধু বাচ্চু, মানে বাচ্চু মিশ্রর ফোন এসেছিল। কোন বন্ধু মারা গেছে, চামু না দামু কি যেন নামটা, তোমাকে ডাকছে; দু দুবার ফোন এসেছিল।
    আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে পড়লাম। হঠাৎ যেন কোন ভুলে যাওয়া কাজ মনে পড়ে গেছে।ঘরের হাওয়া কিছুটা কমে গেছে।বললাম চামু নয় চাম্মু, কি তাই না?
    :কি জানি, অমনিই কিছু হবে।
    আমার মুখের চেহারা দেখে গিন্নি পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিলেন।
    :তোমার কোন স্টাফ? তোমার সাথে কাজ করেছিল? একসময় খুব ক্লোজ ছিল?
    :ক্লোজ? তা ছিল বইকি! তবে স্টাফ নয় বন্ধু, ছেলেবেলার; যাকে বলে লংগোটিয়া ইয়ার।ও ছিল আমাদের সবার মুশকিল আসান!
    :কোনদিন দেখিনি তো? মানে বাড়িতে কখনো আসেন নি, তাই বলছিলাম।
    :হ্যাঁ, ও নিজেই নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তবে গতবছরে একবার এসেছিল, মাত্র পাঁচমিনিটের জন্যে।
    :আলাপ করাও নি!
    :সেদিন তুমি বাড়িতে ছিলে না।

    সত্যি কথাটা বলা খুব মুশকিল। সে রোববারে আমার বসার ঘরে ভারি গ্যাঞ্জাম। কলোনির মহল্লা বিকাশ সমিতির মাসিক বৈঠক। জল আর বিজলির কানেকশন বাড়ানোর জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মেয়রকে পিটিশন দিতে হবে; মুসাবিদা করা হচ্ছে, চা আর পাঁপড় আসছে, এমন সময় কাজের মহিলা মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইয়া, আপনাকে কেউ বাইরে ডাকছে।
    একটু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। বেরিয়ে দেখি চাম্মু, একটা থামের পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    : কী ব্যাপার রে? আয়, ভেতরে আয়।
    চাম্মু যেন আরও সিঁটিয়ে গেল।কিন্তু কিন্তু করে বলল: জানি, ভেতরে তোদের জরুরি মিটিং হচ্ছে, কিন্তু আমার দরকারটাও এমন যে না এসে পারলাম না।
    : আমড়াগাছি ছাড় তো! কাজের কথায় আয়।তার আগে ভেতরে চল, গিন্নির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
    ও নড়ল না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল: সরি বেণু, ওটা আরেকদিন হবে।আমাকে নেক্সট প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পেন্ড্রা যেতে হবে।ভায়রাভাই কাল মারা গেছে।ছোটশালিটা অসময়ে বেওয়া হল।
    তোর কাছে চারশ টাকা হবে?আগামী মাসের মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
    বিনা বাক্যব্যয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাটা বার করে ওর হাতে দিই। বাগানের গেট খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে ও ফিরে তাকায়: তাহলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই।
    আমি মাথা নেড়ে ফিরে আসি। ঘরে ঢুকে আবার সমিতির তর্কবিতর্কের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই।
    চাম্মু আর আসেনি। জানতাম ও টাকা আর ফেরত পাবো না। পথেঘাটে দেখা হয়ে গেলে: কি, ক্যামন? ভাল তো?
    ও দ্রুতগতিতে পাশ কাটাতো:হাঁ ইয়ার, সব ঠিক হ্যায়, বা বঢ়িয়া হ্যায়, সবকুছ ঠিকঠাক চল রহা হ্যায়।
    কিন্তু সবকুছ তো দুরের কথা, ওর কোনকিছুই ঠিকঠাক চলছিল না। টের পাচ্ছিলাম যে আমাদের চাম্মুর মুশকিল আসান ক্ষমতা, সেই বিশেষ শক্তি দিন দিন কমছে; তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপের মত।

    (২)
    ৹মুশকিল আসানই বটে!
    আজ থেকে বছর কুড়ি আগে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর শহরে চাম্মু বা চমনলাল রোহিদাসকে অনেকেই চিনত, বিশেষ করে উনিশ কুড়ির দল। জাতে মুচি, কিন্তু দুইপুরুষ হল ওরা জাত ব্যবসা ছেড়ে চাকরিপেশা হয়েছে।বাবা কোন মুদি দোকানের কর্মচারি আর ম্যাট্রিকফেল কাকা উকিলবাবুর মুহুরি।পুরনো বস্তিতে ওদের খাপরাছাওয়া মাটির মেজেওলা কোঠাবাড়ি।স্নানের জন্যে ঘরের লাগোয়া চিলতে জমিতে একটুখানি আয়োজন। প্রাকূতিক কম্মটি সারতে ওদের মেয়েপুরুষ সবাই যায় লোটা নিয়ে পাশের খোলা মাঠে, ভোরবেলায় আর সাঁঝবেলায়।
    এই পরিবারের মেজছেলে চাম্মু ছেলেছোকরাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। পাড়ার পাঠশালা বা বালবাড়ি থেকে আমরা একসংগে পড়েছি। আমাদের নাটের গুরু ছিল বাচ্চু মিশ্র আর চাম্মু ছিল ওর কেলে হাঁড়ি।
    হাইস্কুলের সংস্কূতের টিকিধারি পন্ডিত রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চুর সংগে মুচির ঘরের চমনলাল রোহিদাসের গলায় গলায় ভাব বড়রা কেউই ভাল চোখে দেখতেন না।ফলে চাম্মু আমাদের অভিজাত পাড়ার শব্দাবলীতে চাম্মু চামার হয়েই রইল, কোনদিন চমনলাল হতে পারল না।
    অবশ্যি এ নিয়ে চাম্মুর খুব একটা হেলদোল ছিল না। বাচ্চুর বন্ধু হয়েই ও বেজায় খুশি ছিল।অনায়াসে ঢুকে যেত বাচ্চুদের বাড়িতে, বৈঠকখানা পেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে।ঢুকে কোন বলাকওয়ার বালাই নেই, সোজা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মেজেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ত: আঃ চাচি! কি ঠান্ডা তোমাদের জল গো! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
    এদিকে হায় হায় করে উঠেছেন চাচিজী,মানে বাচ্চুর মা।
    : গেল, গেল! জাতধর্ম সব গেল।হতভাগা চামার! দিলে সব ছুঁয়ে। নিজের হাতে নিলি কেন?তেষ্টা পেয়েছে তো আমাকে বলতে পারলি না?
    :তাতে কি হয়েছে গো চাচি?
    চাম্মু একগাল হাসে, বলে:এ কুঁজোটা না হয় আমি নিয়ে যাব, আমাদেরটা গেছে ভেঙে। তোমরা না হয় ঝিকে দিয়ে শনিচরী বাজার থেকে আর একটা আনিয়ে নিও।
    : হ্যাঁ রে, আনিয়ে নিও! কত খায়! কিনতে তো আর পয়সা লাগে না?বলি, হরির লুটের বাতাসা পেয়েছিস?
    : অনেক তো বকাবকি করলে, ঘরে গরম গরম কিছু থাকলে দা্ও না!আজ রোববারের সকাল, তায় মাত্র আটটা বেজেছে। মানে, তোমাদের তো এখনও নাস্তা হয়নি।
    : বলি, নোলা যে খুব! সকাল সকাল ফন্দি করেই এসেছিস। একটা কাজের সময় তোকে পাওয়া যায় না। নিজের মতলবের বেলায় ঠিক আছিস।
    : সে কি চাচি? এ মাসে তোমাদের বিজলি বিলটা শেষদিনে জমা দিল কে? সে কী লম্বা লাইন! অফিসের ভেতরে গিয়ে ভেতরের লোক ধরে আমিই তো ম্যানেজ করলাম। সব ভুলে গেলে!তোমার ছেলেটি তো একটি ধম্মের ষাঁড়। বাপের হোটেলে খায়দায় আর বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়।শেষকালে সব ঝামেলার মুস্কিল আসান বলতে এই চাম্মু ছাড়া আর কে?
    বাচ্চু কূত্রিম কোপে ঘুঁষি দেখায়। মিশ্রগিন্নি একটু নরম হন।: বালাই ষাট! ছেলেদের খুঁড়িস না। তুইও আমার ছেলের মত।
    চাম্মু একটু হাসে।
    : সেই কথাই তো বলছিলাম গো,হিসেব ধরলে আমিও তোমার ঘরের লোক। আমরা সবাই একই ভগবানের সন্তান।
    : নে, নে! এই একথালা ভাজিয়া নে, আর মুখটা বন্ধ রাখ। ভরসকালে আমাকে শাস্তর শেখাচ্ছে!
    চাম্মু ততক্ষণে ভাজিয়ার থালার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।এনামেলের থালা। খাওয়া হলে ও নিজেই থালাটা আঙিনার কলের জলে ধুয়ে একপাশের দেয়ালে খাড়া করে ঠেকিয়ে রেখে দেবে।
    (৩)
    আমরা ওকে ৹মুশকিল আসান৹ বলেই জানতাম।যে কো্ন লফরা বা সমস্যার কথা শুনলে ওর একটাই জবাব ছিল: হো জায়েগা বা বন্ জায়েগা।
    : চাম্মুভাই, বড়ী মুশকিল মেঁ ফঁস গয়া হুঁ। নাথানী পরিবারের সুমিত্রা, আরে ওই যে রানী লক্ষ্মীবাঈ স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে; কাল রোববার আমার সংগে বিহারী টকিজে শোলে দেখতে রাজি হয়েছে; অনেক কষ্টে।কিন্তু বাড়ির বা পাড়ার কেউ দেখতে পেলে কেস জন্ডিস।আর, আর দশটা টাকা চাই, জোগাড় হচ্ছে না।
    চাম্মু বুঝদারের মত মাথা নাড়ে।
    : আজ বিকেলে চারটে নাগাদ দেখা করিস, কিছু একটা হয়ে যাবে।
    বিকেল বেলা চাম্মু হাতে ধরায় ইভনিং শোর দুটো টিকেট আর দশটা টাকা।
    বুঝিয়ে দেয়: সুমিত্রা যাবে রিকশায়, তুই সাইকেলে।ছটাকা রিকশা ভাড়া, চারটাকা চিনেবাদাম। ও আগে ঢুকবে। তুই পরে, ফার্স্ট বেল বাজলে, হল অন্ধকার হলে তবে।বেরোনোর সময় তুই আগে, ও আলাদা, শেষের দিকে।
    : ভাই, তোকে যে কী বলে ।
    :ব্যস,ব্যস! আর অউর চনে কী ঝাড় মেঁ (ছোলাগাছে)চড়াতে হবে না।চাম্মু যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায়।

    কলেজের দিনে্ও চাম্মু আমাদের মুশকিল আসান হয়ে রইল। কে বাবার থেকে সারা বছর কলেজের ফীস নিয়েও হোটেলে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আর পরীক্ষার সময় ফেঁসে গেছে! তার জন্যে টাকা জোগাড় কর রে। কার হাজিরি খাতায় সংখ্যাটা এত কম যে কলেজের নোটিস বোর্ডে নাম বেরিয়েছে। কলেজ সোশ্যালের দিন মারামারিতে কেউ নামজাদা বড়লোকের নাড়ুগোপালের মাথা ফাটিয়ে কেস খেয়েছে। সমস্যা আপাতত: যতই কঠিন হোক চাম্মুর কাছে তার নিদান আছে।বহুদিন বুঝিনি ওর অদূশ্য জাদুকাঠিটি কী?
    ধীরে ধীরে অনেকদিন পরে বুঝেছি যে ও হল আসলে একজন ভাল পাবলিক রিলেশন অফিসার। আর ও সবার থেকেই গুড টার্ন আশা করে। এছাড়া ও একটা ছোট ফান্ড হাতে রাখে। সে টাকাটা ও জোগাড় হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কমিশন, ওর ভাষায় সার্ভিস চার্জ, আদায় করে।
    ধরুন,জগমোহন শেঠের ইঁটভাটায় দুলাখ ইঁট পড়ে আছে।এদিকে বর্ষা প্রায় এসে পড়েছে।লোকসানের ভয় ষোলআনা। চাম্মুর কাছে খবর আছে যে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের হিন্দি টিচারের ছোটখাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তাতে লাখ দেড়েক ইঁট কম পড়েছে। কিন্তু স্যারের পকেটেও যে টান পড়েছে!উনি চাইছেন যে ইঁট কোন ব্যাটা শস্তায় দিক, আবার আদ্দেক মাল ধারে দিক!ব্যস্, চাম্মু অবতীর্ণ হল ওর মুশকিল আসান অবতারে।
    হিন্দিস্যার দুবেজী প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরেন আর কি!আশীর্বাদ করলেন যে যদিও চাম্মু ভদ্রলোকের মত হিন্দি লিখতে শেখেনি, কিন্তু আজকের পূণ্যকাজের ফলে ওর ছেলেরা নিশ্চয়ই বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠবে।আর শেঠজি বাট্টাখাতায় লিখে রাখা মাল সময়মত উঠে যাওয়ায় এমন খুশি যে দু পাঁচটাকা কমিশন টমিশন ? কোন ব্যাপারই না।
    আমার কিন্তু, পরন্তু, অধিকম্তু শুনে চাম্মু একগাল হাসত: ওরে, ডাক্তারবাবুরা কোন বিশেষ ওষুধের দোকানের নাম লিখলে, রক্তপরীক্ষা বা এক্স রে করাতে বললে ওরা কিছু দেয় না? তবে? যত দোষ চাম্মুর বেলায়!

    (৪)
    বাচ্চুর সংগে ওর বন্ধুত্ব আগের মতই রয়ে গেল।
    সেবার দূর্গাপূজোর পরে ঈদ। আমরা খবর পেলাম যে মুশায়েরা বা উর্দূকবিতা পাঠের আসরের পরের দিনই কাওয়ালি, মধ্যনগরী চৌকে।আসছে যে সে নয়, কাওয়ালি সম্রাজ্ঞী শাকিলাবানো ভোপালী!আহা, যেমন হাজিরজবাব, তেমনি আদা, তেমনি নাজনখরা; ব্যস্, বিলাসপুর শহরের যৌবনে আগুন ধরে গেল।টিকিট নিয়ে কাজিয়াকেত্তন, মারামারি, আমরা হাল ছেড়ে দিলাম।
    ঠিক দুদিন আগে চাম্মু বিকেলের ঠেকে ঢুকল দাঁত বের করে।
    : তিনটে টিকিট জোগাড় করেছি, দুটো তো বেণু আর আমি, তিননম্বরটা কে বাওয়া?
    আমি অবাক, কেন? বাচ্চু যাবে না?
    :জিজ্ঞেস কর। রামখিলাওন মহারাজ জানতে পারলে আমার আর ওর পিঠের চামড়া তুলে নেবে।
    :বাবা গেছে রায়পুরে, ছোটকাকার শরীর খারাপ,তাই। ফিরতে সেই সোমবার।তার মানে বুঝলি?
    বাচ্চু মিটিমিটি হাসে।
    আমি চেঁচিয়ে উঠি: খুব বুঝেছি। তার মানে আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স যাচ্ছি কাওয়ালি কুইন, মালিকা এ তরন্নুম, ভোপাল কী শাকিলার নাজ নখরা, হুস্ন দেখে দাদ দিতে।
    :ঈরশাদ! ঈরশাদ!
    :তওবা! তওবা!
    এবার বাচ্চু বলে উঠল: উঠাও এক জাম, শাকিলাকে নাম!
    আর আমরা তিনজনে চায়ের গ্লাস একসংগে ঠেকিয়ে মূদু ঠুন্ ঠুন্ আওয়াজ তুলি।
    কাওয়ালি দারুণ জমে উঠল। শাকিলা বানো ফাটাফাটি!প্রায় রাত বারোটায় আমরা বাড়ি ফিরছি, মনে কাওয়ালির রেশ।প্রথমে বাচ্চুর বাড়ি, মশানগঞ্জ পাড়ার শুরুতেই।
    বাচ্চু বাড়ি ঢুকতে যাবে, আমি বললাম যে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ, ভেতর থেকে দুগেলাস জল নিয়ে আসুক।এমন সময় চাম্মু কাওয়ালির মিসরা (প্রথম পংক্তি) গুনগুন করতে করতে বলল,
    : হ্যাঁরে বাচ্চু, রামখিলাওনের কী খবর?কবে বাড়ি ফিরবে?তোর বাবার ঘরে ফিরতে মন নেই কেন রে! চাচি একলা আছেন, এটা ভাবতে হয় না?
    আমাদের পেটের ভেতর থেকে হাসি সোডার মতন বুড়বুড়ি কেটে বাইরে বেরোনোর আগেই অন্ধকারে গর্জন শোনা গেল: হারামজাদা চামার! বাপের বয়সি লোকেদের নামধরে ইয়ার্কি!জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতে হয়।
    রামখিলাওন ফিরে এসেছেন!
    আমি আর চাম্মু জলতেষ্টা ভুলে সাইকেল তুলে হাওয়া।

    (৫)
    যথাসময়ে পরীক্ষা টরিক্ষা দিয়ে আমি ব্যাংকে ঢুকলাম আর চাম্মুও তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের জোরে স্থানীয় বড় পোস্টাপিসের পিয়ন হয়ে গেল। আমার এদিক ওদিক বদলির মধ্যেও খবর পেতাম বেড়ে আছে চাম্মু। বিয়ে করল বুধওয়ারি পাড়ার পার্বতীকে।শ্বশুর মিউনিসিপ্যালিটির চৌকিদার। আমরা সবাই বরযাত্রী গিয়েছিলাম; তাসাপার্টি, মাংসভাত আর গুলাবজামুন।তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওর শ্বশুরের মহুয়া খেয়ে নাচ!
    সংসার চলল বাঁধাগতে।ও প্রমোশন পেয়ে হেড পিওন হল। ওর বাবা বললেন দুলহন বড় পয়মন্ত।এর কমাসের মধ্যেই বাবা চলে গেলেন। ও সাবেকি ঘরের পাশে খাপরার চাল ছাওয়া দুটো পাকা ঘর তুলে আলাদা হয়ে গেল।
    তবে ওর মুশকিল আসান প্রতিভা তখন তুঙ্গে।
    আমি তখন কোরবার কাছে বালকোনগর ব্রাঞ্চে বদলি হয়েছি।মাসের শুরুতে এক শনিবারে বিলাসপুরে এসে বাবার হাতে সংসারখরচের টাকা ধরিয়ে রোববারে বন্ধুদের সংগে আড্ডা দিয়ে সোমবার ভোরে বালকো ফিরে যেতাম।
    এমনি এক শনিবারে কাজের চাপ আর বাসের গন্ডগোলে বিলাসপুর পৌঁছতে একটু রাত হয়ে গেল।বাড়ির সামনে এসে অবাক, দরজায় ঝুলছে বড় তালা, চারদিক বন্ধ। পাশের বাড়ির থেকে জানলাম যে ছোটমামার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে মা তাড়াহুড়ো করে বাবার সংগে নাগপুর রওনা হয়ে গেছেন, ঘরের চাবি ছেড়ে যান নি।
    সে তো হল, এখন আমি যাই কোথায়?পাশের বাড়ির ভাড়াটেরা নতুন এসেছে, আমার সংগে নেহাৎ মুখচেনা।গেলাম মুশকিল আসান চাম্মুর ঠেকে।
    চাম্মু আগের মতই সহজভাবে বলল: হো জায়েগা।তারপর বলল, এখন রাত্তির সাড়ে এগারোটা। সবার বাড়িতে মেয়েরা উনুন নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে।তবে তুই ভাবিস নে বেণু, কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে।
    হয়ে যে যাবে সে নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যা হল তার জন্যে আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না বোধহয়।
    পোস্টঅফিসের হেড পিওন চাম্মু আমাকে নিয়ে চুপচাপ মেনগেটের তালা খুলল।ভেতরের হলঘরে তিনটে টেবিল জোড়া দিয়ে চাদর বিছিয়ে দিল।সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে বলল: নো টেনশন বেণু! তুই আর আমি পাশাপাশি শুয়ে গল্প করব যতক্ষণ ঘুম না আসে।তার আগে তোর খাবারের জোগাড় করি গে।ততক্ষণ তুই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে লাগোয়া বাথরুমে চান পায়খানা সেরে নে।
    আমি বাইরে থেকে শুধু সদর দরজাটায় তালা লাগিয়ে যাচ্ছি। ফিরে এসে থেমে থেমে দুটো টোকা দেব, তবে খুলবি। ভয়ের কিছু নেই।
    সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছল। খালি প্রতাপ হোটেলের বেয়ারাদের তখন্ও খাওয়া শেষ হয় নি।
    সেখান থেকে ও নিয়ে এল গোটা আষ্টেক রুটি, কিছুটা মাংসের ঝোল, আলুর চোখা আর স্যালাড।তাই আমরা দুই বন্ধু মহানন্দে সাঁটালাম।তারপর পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছে টের পাইনি।
    গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম আমি আর সুমিত্রা রেলওয়ে কলোনির মাঠে চিনেবাদাম খেতে খেতে গল্প করছি।সুমিত্রা বলছে: বেণু, কতদিন পরে এলি!আর এই ফুলপ্যান্টটা পরে তোকে না একদম কার্টুন লাগছে।হাফপ্যান্টেই তোকে বেশি মানায়।
    : তোর তাতে কী? বেশি ইল্লি করলে এক ঝাপড় খাবি।
    ইতিমধ্যে কোত্থেকে চাম্মু এসে হাজির,সংগে এনেছে একটা ঝাঁ চকচকে হার্কিউলিস সাইকেল।সেটা নিয়ে ও খুব কায়দা করে মাঠের মধ্যে চালাতে লাগল।কখনও দুহাত ছেড়ে দিয়ে, কখনও উল্টো মুখ করে,আর কখনও হ্যান্ডেলবারের ওপর দুপা তুলে দিয়ে।সুমিত্রা কথা থামিয়ে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।আমার মধ্যে একটা রাগ জন্মাতে লাগল।
    ঘুম ভাঙল চাম্মুর হাতের ঠেলা খেয়ে।
    : এই বেণু!ওঠ, উঠে পড়।চা এনেছি। হাতমুখ ধুয়ে নে।
    ছটা বেজে গেছে। আজ রোববার, পোস্টাফিস বন্ধ। কিন্তু লোকজন দেখতে পাওয়ার আগে আমাদের দুজনকে কেটে পড়তে হবে।
  • Ranjan Roy | ০৯ অক্টোবর ২০১৩ ১৬:১৮527460
  • ধ্যাৎত্তেরি!
  • Ranjan Roy | ১০ অক্টোবর ২০১৩ ১৪:৩৫527461
  • (৬)
    বছরকয়েক পেরিয়ে গেছে। আমি প্রমোশন পে্য়ে সোহাগপুর ব্রাঞ্চে ম্যানেজার। মাসের শেষে রিজার্ভ ব্যাংকের জন্যে স্টেটমেন্টস্ তৈরি করতে ব্যস্ত, এমন সময়ে পিঠের ওপর থাবড়া খেয়ে মুখ তুলতেই দেখি চাম্মু!
    : কি রে বেণু, ম্যানেজার হয়েছিস বলে ইয়ারদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে নেই নাকি?
    : কী আজেবাজে বকছিস্, ভাল করে চেপে বোস্। চা খাবি তো?
    : শুধু চা? অফিসার হয়ে ভারি কিপটে হয়েছিস দেখছি!
    আমি হেসে ফেলে ব্যাংকের চাপরাশিকে নাস্তা আনতে বলি।
    অনেকদিন পরে দেখা। খোঁজখবর নিই।তাকিয়ে দেখি আমাদের মুশকিল আসানের কানের পাশে কিছু পাকাচুল।চাম্মু হেসে ফেলে।
    : আরে, আমার না হয় দু একটা পাকাচুল, তোর তো আদ্দেক মাথায় চুলই নেই।
    কাজের চাপ ভুলে হো হো করে হেসে উঠি।ব্যাংকের অন্য কর্মচারিরা আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়।
    : তারপর? এদিকে কোথায় এসেছিলি? পথভুলে? আমার প্রেমের টানে নিশ্চয়ই নয়!
    : কী করে বুঝলি?
    : শালীর বাড়ি নয়তো? আমার জন্যে যে বিলাসপুর থেকে এ্যাদ্দূর আসিস নি সে তো বাজি ধরে বলতে পারি।
    : লাগি শর্ত? বাজি ধরিস না বেণু, হেরে যাবি।
    :মানে?
    :সত্যি কথাটা হল আমি তোর কাছেই এসেছি।হ্যাঁ, একটু হেল্প চাই।
    একটু অবাক হই, তারপর হেসে ফেলি।
    : আরে ইয়ার! তুই হলি আমাদের মুশকিল আসান। তোর জন্যে তো জান হাজির।এবার ঝেড়ে কাশ!
    :বুঝলি বেণু, চাকরির পাশাপাশি একটা সাইড বিজনেস শুরু করেছি, রেডিমেড জামাকাপড়ের। কোলকাতার কাছে মংলাহাট বলে শস্তা রেডিমেড কাপড়ের একটা জবরদস্ত বাজার আছে। সেখান থেকে থোক কিনে বিলাসপুরের আশপাশের ছোট দোকানগুলোতে সাপ্লাই দেওয়া।মাস আষ্টেক হয়ে গেল, ভাল মার্জিন পাচ্ছি।কিছু কিছু সাপ্লায়ার একমাসের জন্যে ধারে মাল দেওয়া শুরু করেছে।
    এবার ও একটু দম নেওয়ার জন্যে থামে। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। ও জল খায়। আবার শুরু করে।
    :কিন্তু বিজনেস বাড়াতে হলে পুঁজি চাই। বিভিন্ন হাটবাজারে গিয়ে বসার জন্যে জনাদুই ছোকরা আছে।ওদের হাতখরচা আর কমিশন আছে।একটু সাপোর্ট পেলেই।তাই তোর কাছে এসেছি।বেশি না, হাজার বিশেক হলেই চলবে।মাসে মাসে দুহাজার করে ফেরৎ দেব। একবছরের মধ্যেই ক্লিয়ার।
  • Ranjan Roy | ১০ অক্টোবর ২০১৩ ১৯:৪৫527462
  • আমি বিষম খাই।আমার জমাটাকা বলতে কিছু নেই।বেশকিছু লোন নেয়া আছে।কেটেকুটে যা পাই তাতে বাবা মাকে পাঠিয়ে নিজের খরচা চলে যায়।আমার মধ্যে একটা হীনমন্যতা কাজ করছে।
    আমি ব্যাংক ম্যানেজার আর ও পোস্টঅফিসের পিওন।বোধহয় আমাকে একটা রাজাগজা ভেবে বসে আছে।আমি বুঝতে পারি যে আমি ঠিক মুশকিল আসান নই। ভগবান বলে নাট্যপরিচালক ভদ্রলোক আমাকে ওই রোলটি দেন নি।
    :চাম্মু, অতটা একসংগে পারবো না। হাজার দুই হলে না হয়; বাকিটা অন্য বন্ধুদের থেকে?
    চাম্মু আমার তোতলামি দেখে মিটিমিটি হাসে।
    :ধেৎ, আমি কি তোকে পকেট থেকে দিতে বলছি? তোর ব্যাংক থেকে আমাকে বিশহাজার টাকা লোন দে।বিজনেস লোন।রেডিমেড ধান্ধে কে লিয়ে।এরকম তো তোরা বরবখৎ দিয়ে থাকিস।
    আবার বিষম খাই। চাম্মু থাকে বিলাসপুরে, কামধান্ধা সব বিলাসপুরের আশেপাশে। আর আমার ব্যাংক হল একশ কুড়ি কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে লোন? না,না, এ হয় না।
    চাম্মু যেন আমার মনের কথা পড়ে ফেলেছে। আবার মুচকি হাসে।
    : এত ভাবিস না বেণু। তোর অসুবিধা হবে এমন কোন কাজ করতে বলছি না।তোর ঠিকই মনে আছে আমার শালীর এখানেই বিয়ে হয়েছে।ভায়রাভাইয়ের এখানে একটা কাপড়ের দোকান আছে, ছোটমত।লোনটা ওর নামেই হবে, আমি গ্যারান্টর। মাসে মাসে নিয়মিত কিস্তি জমা হবে। তোর কোন প্রবলেম হবে না।আমি যে তোদের মুশকিল আসান, জিন্দগিভর!
    চাম্মু লোন পেয়ে যায়। মাসে মাসে ইমস্টলমেন্ট জমা হতে থাকে। আর ছমাস পরে আমি ট্রান্সফার হয়ে বিলাসপুরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রাঞ্চে চলে আসি।
  • Ranjan Roy | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ০০:৫৬527463
  • (৭)
    একদিন মা কথাটা পাড়লেন। আমার এখন মাইনেপত্তর মন্দ নয়।আমাদের তিনপুরুষে আমিই প্রথম অফিসার হয়েছি।ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়িও হয়ে গেছে।এবার বিয়ে থা করে থিতু হওয়ার সময়।আমাদের বন্ধুদের মধ্যে শুধু আমিই এখনও ব্যাচেলর।আর বাবা মার শরীরের যা অবস্থা!
    এরপর আর কোন কথা চলে না।
    আমার বিয়েতে সব বন্ধুরা মিলে হেব্বি গ্যাঞ্জাম, কিন্তু চাম্মুর দেখা নেই!ও গেছে হাওড়ার মংলাহাট।ওই কাটাকাপড় আর রেডিমেডের বিজনেস।তা বলে আমার বিয়ের দিনও?একটু অভিমান হল। চাম্মু কি বদলে যাচ্ছে?
    বিয়ের পর বৌকে নিয়ে পুরী গেলাম। নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালীর হলিউড।ফিরে এসে অফিস জয়েন করতেই দেখি টেবিলে একটা গোপনীয় মেমো।আমি যেন পত্রপাঠ রিজিওনাল অফিসে গিয়ে দেখা করি।কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। একটা উৎকন্ঠা নিয়ে পরের দিনই রিজিওনাল ম্যানেজারের অফিসে হাজির হলাম।একঘন্টা ভিজিটার্স রুমে বসিয়ে রেখে উনি যখন আমায় ডাকলেন তখন আমার গলায় থুতু শুকিয়ে গেছে।
    কোন ভণিতা না করে উনি সোজা কাজের কথায় এলেন।
    আমাদের সোহাগপুর ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মি: চন্দ্রাকর জানিয়েছেন যে একটি কাপড়ের দোকান কে দেওয়া লোন ব্যাড হয়ে যাচ্ছে।কয়মাস ধরে কিস্তি আসছে না। ঋণীকে বলায় সে জানিয়েছে যে সে লোন নেয় নি। আসলে লোনটা আগের ম্যানেজার বেণুবাবু তার বিলাসপুরের বন্ধুকে দিয়েছেন, ও হল ডামি। তবে হ্যাঁ, ও হল আসল ঋণী চমনলাল রোহিদাসের ভায়রাভাই।
    :দত্ত, তোমার থেকে এটা আশা করিনি। আগামী সাতদিনের মধ্যে এই লোন এ্যাকাউন্টটি বন্ধ না হলে আমি ইনভেস্টিগেশনের জন্যে নোট পাঠাব।
    আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।হন্যে হয়ে চাম্মুকে খুঁজে বেড়াই।বিকেলের দিকে গোলবাজারের কাছে ওকে পাকড়াও করি।সব শুনে ও গম্ভীর হয়ে যায়।পিচ্ করে থুতু ফেলে। তারপর বলে যে ওর সাড়ুভাই, মানে ভায়রা, হারামিপনা করেছে।
    ঠিক আছে, কিছু খদ্দেরের থেকে বাকি পয়সা আদায় হয় নি,বাজার এখন ঠান্ডা; তাবলে এমন ব্যাভার!অল রাইট, হারামি কো হম নাপ দেঙ্গে।
    : সে তোর ভায়রাকে তুই যা করার করবি; কিন্তু এদিকে এক হপ্তা পরে আমার জি এম আমাকেই নাপ দেঙ্গে।
    : ক্যায়সে নাপ দেগা?আমরা কি মরে গেছি নাকি? অভী ভী মুশকিল আসান জিন্দা হ্যায় দোস্ত, তু ফিকর ন কর!
    :সে না হয় বুঝলাম,কিন্তু তুই করবিটা কী, সেটা আমায় একটু বুঝিয়ে বলবি?
    : শোন বেণু, সাতদিন লাগবে না।সামনের বুধবার ক্যাজুয়াল লিভ নে।তুই আর আমি সোহাগপুর যাবো, তোর চন্দ্রাকর ম্যানেজারের সামনে পুরো টাকাটা গুনে ফেলে দিয়ে আসবো। তু ফিকর্ ম্যৎ কর।
    আমার মনের মেঘ কেটে যায়। না:, মুশকিল আসানই বটে!কিন্তু সত্যি কি এত সহজে ব্যাপারটা মিটে যাবে? এতগুলো টাকা? এত অল্প সময়ে? এবার ও রেগে যায়।
  • Ranjan Roy | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ০১:১৫527464
  • যাহোক, ব্যাপারটা ভালভাবেই মিটে গেল।আমি আর চাম্মু বুধবার বেলা একটা নাগাদ আমাদের ব্যাংকের সোহাগপুর ব্রাঞ্চে একেবারে ম্যানেজারের কেবিনে হাজির। সুদে আসলে প্রায় নহাজার আটশ তিরাশি টাকা দাঁড়াল। চাম্মু একশটাকার নোটের একটি বান্ডিল ম্যানেজারের টেবিলে পরম ঔদাসীন্যে নামিয়ে রাখল।গন্ডগোলটা হল তারপর। ক্যাশিয়ার এসে রসিদ আর খুচরো টাকা পাসবুক সমেত ম্যানেজারকে দেওয়ার পর মি: চন্দ্রাকর আমার সংগে হ্যান্ডশেক করে ওগুলো চাম্মুকে ফেরত দিলেন। কিন্তু ও খুচরো টাকা এবং পাসবুক ম্যানেজারের দিকে ঠেলে দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে উঠলো: কীপ দ্য চেঞ্জ!
    চন্দ্রাকরের চেহারা লাল হয়ে উঠল। বেগতিক দেখে আমি ওকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসি।
    : তুই এটা কী করলি? আজ আমার একেবারে হাতে হ্যারিকেন!
    চাম্মু নির্বিকার।
  • Ranjan Roy | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ১১:২২527465
  • (৮)
    সময় দ্রুত রং বদলায়।চাকরির চাপ আর পরিবারের দায়দায়িত্ব বইতে বইতে আমরা সবাই যে যার নিজস্ব বূত্তে ঘুরতে থাকি।বন্ধুদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমতে থাকে।তবু ছোট শহর, ভালমন্দ খবর হাওয়ায় ভেসে ভেসে কানে ঠিক পৌঁছে যায়।
    টের পাই,চাম্মুর সাইড বিজনেস লাটে উঠেছে।প্রায় সব বন্ধুদের কাছেই ধার নেয়া হয়ে গেছে। ইদানীং নাকি বাজার থেকে চড়া সুদে নিচ্ছে।
    একদিন ওকে বিকেলের দিকে একা পেয়ে গেলাম, নর্মাল স্কুলের সামনে।ধরে নিয়ে গেলাম অরপা নদীর ওপর নতুন তৈরি ইন্দিরা সেতুর দিকে। আমার জেরার জবাবে অম্লানবদনে বলল যে জলে নেমে একটু হাবুডুবু না খেলে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনি এক আধবার লস্ না খেয়ে কেউ বিজনেসের ঘাঁতঘোত শিখতে পারে না।ওর এখন সেই ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে। চিন্তার কোন কারণ নেই।
    কোঈ মুশকিল কী বাত নহী, মামলা আসান হ্যায়।
    তারপর এল এক শনিবার। শনিদেবতা সেদিন বোধহয় আমাদের একটু নেকনজরে দেখেছিলেন।অফিস যাব বলে তৈরি হচ্ছি এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে বাচ্চু মিশ্র এসে হাজির।
    : শিগগির চল বেণু, থানায় যেতে হবে।চাম্মুকে ধরে নিয়ে গেছে। আর বাড়ির কাগজপত্তর যা আছে নিয়ে চল, ওর জামিন করাতে হবে।আজ অফিস যেতে পারবি না, ফোন করে দে।
    মোটরবাইকে ওর পেছনে সওয়ার হয়ে থানার দিকে যেতে যেতে পুরো গল্পটা শুনে নিই।
    চাম্মুর টাকার দরকার বেড়ে গেছে। চাইছিল এজমালি বাড়িটি এবং লাগোয়া জমির টুকরোটা বেচে দিয়ে টাকাটা তিনভাইয়ের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে। ভাইয়েরা রাজি নয়।
    চাম্মু নাছোড়বান্দা।ওর ভাগ চাইই চাই। ভাইয়েরা ওকে অম্তত: ওর অংশটুকু বিক্রি করতে ছাড়পত্র দিক।কিন্তু ভাইদের এতে্ও সায় নেই। মামলা শেষ হল আজকের লাঠালাঠিতে।তিনভাইয়েরই অল্পবিস্তর চোট লেগেছে।তবে অন্য দুভাই চাম্মুর নামে আগেভাগে থানায় ডাইরি করেছে, তাই পুলিশ ধরেছে ওকেই।
    আজ শনিবার। বিকেলের মধ্যে জামিনে ছাড়া না পেলে সোমবার দুপুরে কোর্টে তোলা অব্দি পাক্কা আটচল্লিশ ঘন্টার হাজতবাস হয়ে যাবে।তাহলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে। পোস্টাপিসের চাপরাশি, শত হোক কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি তো বটে!
  • Ranjan Roy | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ১৪:১৪527466
  • (৯)
    সেই যে জামিন করিয়ে ওকে ওর বাড়িতে ছেড়ে এলাম তারপর থেকে ওর সাথে আর বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হত না। কেন?কেন হত না?
    ওই কি আমাদের এড়িয়ে চলছিল,নাকি আমরাই এক হেরে যাওয়া নায়ককে ভুলতে চাইছিলাম, মনের অগোচরে?
    আজ বাড়ির বারান্দায় বাঁশের বাখারি আর কঞ্চি দিয়ে বাঁধা চালির ওপর শোয়ানো ওর নি:স্পন্দ শরীরের দিকে তাকিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি।উলটে পালটে দেখছি, হাতড়াচ্ছি মনের এ্যালবামে সাঁটিয়ে রাখা কিছু পুরনো ছবি।
    চটকা ভাঙলো বাচ্চু মিশ্রের কথায়: বেণু,দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; আর কেউ তো এল না।ওর ভাইয়েরাও না।আমি নিজে ডাকতে গিয়েছিলাম।
    সমু বলল: আর কেউ আসবে বলে মনে হয় লা।যা করার আমাদেরই করতে হবে।
    আমরা কজন মানে আমরা পাঁচজন বন্ধু আর জনা চার ওর পাড়ার ছেলেপুলে।
    বুঝতে পারি আমাদের মুশকিল আসান শেষজীবনে কতটা একলা হয়ে গেছল।
    আস্তে আস্তে মাথা নাড়ি, হ্যাঁ, বডি আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না।
    কেউ একজন জানায় যে মধুবন শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলেই ভাল,পায়ে হেঁটে দুই কিলোমিটারের বেশি নয়।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।ডোমের কাছে কাঠ কিনতে পা্ওয়া যায়।একজন আগে গিয়ে ব্যবস্থা করে রাখলেই হবে।
    সব তো হল। কিন্তু নাপিত আর পুরোহিত যে এখনও এল না! খবর এল ওদের কাউকেই পাওয়া যাবে না।বিনোবানগরে শ্যাম আগরওয়ালের বাবা মারা গেছেন, ওরা সেখানে যাবে।তবে হ্যাঁ, চাম্মুর বডি যদি বিকেল অব্দি রাখা হয় আর দক্ষিণাটা একটু , তাহলে দেখা যেতে পারে। হাজার হোক চামারের মুর্দা, দেশে এখনও জাতধম্মো কিছু বেঁচে আছে।
    আমরা বোবা মেরে যাই। কমবয়সি ছোকরাদের রাগে দাঁত কিটকিট করে। ওদের শান্ত করি। এখন রাগারাগির সময় নয়।আর দেরি করা যাবে না।এদের সবাইকে হাত লাগাতে হবে।তাড়াহুড়ো করে আনা একটা ফুলের মালা আর কিছু ফুল ওর গায়ের ওপর বিছিয়ে দিই।কেউ অগরুর সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়।দুজন ছোকরা ওর শরীরটাকে অভ্যস্ত হাতে চালির সংগে দড়ি দিয়ে আষ্টেপূষ্টে বাঁধে।
    কত তাড়াতাড়ি আমাদের লংগোটিয়া ইয়ার, চাম্মু ওরফে চমনলাল রোহিদাস, পিতা সমারুলাল, সাকিন বিলাসপুর একটা ডেডবডি হয়ে গেল। এবার রওনা দেওয়া যাক।
  • Ranjan Roy | ১২ অক্টোবর ২০১৩ ২৩:৪৪527468
  • (১০)
    আমরা এবার কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই।চালির সামনের দিকে দুজন, শেষমাথায় দুজন আর দুজন মাঝখানে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে।একজন খই ছিটোতে ছিটোতে যাবে, আর বাকি চারজন রিজার্ভ, কাঁধবদল করার জন্যে।
    কিন্তু চালি তুলতে গিয়ে আচমকা কারো ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেলাম।ঘরের ভেতর থেকে আলুথালু পোশাকে বেরিয়ে এসেছে এক মেয়েছেলে, হাতের ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিয়েছে আমাদের দুজনকে, আর দেহের সমস্ত উত্তাপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে চাম্মুর শীতল শরীরের ওপর।
    চাম্মুর স্ত্রী পার্বতী।শোকে প্রায় উন্মাদিনী এই নারীর মুখ থেকে ঝরে পড়ছে আমাদের জন্যে অভিশাপবাক্য।
    :না, না! আমি ওকে নিয়ে যেতে দেব না।এদের সংগে যেতে দেব না, কিছুতেই না। আমার মুন্নির বাপকে এভাবে যেতে দেব না। আমার গুড্ডুর বাপকে এদের হাতে ছাড়ব না।
    আমরা হতবাক; আমরা বোকার মত দাঁড়িয়ে।
    সমু পার্বতীকে বোঝাতে চেষ্টা করে:শান্ত হ ভাবী।ঘরের ভেতরে যা।আমাদের কাজ করতে দে।তোদের পরিবারের কেউ না আসুক আমরাই তো ওর পরিবার,ওর বন্ধু।
    ফুঁসে ওঠে পার্বতী: বন্ধু? কিসের বন্ধু!সারা শহর ঢুঁড়ে ওর জন্যে একটাও পন্ডিতপুরুত জোটাতে পারলে না, তোমরা কিসের বন্ধু? সবকটা হারামি, পাক্কা হারামি!পূজো না করে, মন্তর না পড়ে,জল না ছিটিয়ে ওকে এমনি এমনি নিয়ে যাবে?কোনরকমে দায়সারাভাবে পোড়াবে?আজ যদি ও থাকত আর তোমাদের কারো এমন হত ও হাল ছেড়ে দিত?ও ছিল তোমাদের মুশকিল আসান।আর তোমরা? খুব দেখালে !
    কান্নায় ভেঙে পড়ে পার্বতী।মাটিতে লুটিয়ে কাঁদে, হাহাকার করে বুক চাপড়ে কাঁদে।
    : কে বল্ল কোন ক্রিয়াকর্ম হবে না?কে বলল পন্ডিতপুরুত ছাড়া চাম্মুর শেষকাজ নমোনমো করে হয়ে যাবে?
    সবাইকে ঠেলেঠুলে এগিয়ে এসেছে বাচ্চু, চাম্মুর লংগোটিয়া ইযার, ন্যাংটো বয়সের বন্ধু।
    : আমি শহরের নামজাদা পন্ডিত স্বর্গীয় রামখিলাওন মিশ্রের ছেলে বাচ্চু মিশ্র। যজ্ঞোপবীতধারী।এখানে আমার চেয়ে বড় পন্ডিত কে আছে? আমি করব আমার সাথী চমনলালের সমস্ত বিহিত অনুষ্ঠান।ওঠ ভাবী, উঠে পড়।ওকে এবার যেতে দে। বড় কষ্ট পেয়েছে রে! রাম্তা ছাড়।
    -------------------******----------------------------
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন