এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • রাগ দরবারীঃ শ্রীলাল শুক্লা

    ranjan roy
    বইপত্তর | ২৪ অক্টোবর ২০১২ | ৭১৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 24.97.134.185 | ০৪ নভেম্বর ২০১২ ২১:৩৬574625
  • ওনার দৃষ্টি জানলা দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো আখবোঝই গাড়ির তিনফুট ওপর দিয়ে দিকচক্রবালে হারিয়ে গেল। বিগত যুগের সারাক্ষণ ভাবুক পোজ-দেয়া কবিদের স্টাইলে উনি ধীরে ধীরে বলে চললেন," গোটা এলাকায় একটাই মেশিন ছিল, লোহার বডি, কাঁচের মত ঝকঝকে---"। হটাৎ উনি সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, কিসের যেন কথা হচ্ছিল?"
    ছেলেটা আবার নিজের প্রশ্নটা বলল। কিন্তু সব্টা শোনার আগেই ওনার মনযোগ কেড়ে নিয়েছে একটি শব্দ। ছেলেরাও শুনতে পেয়েছে। বাইরে আখচুরি নিয়ে উঁচু গলার খিস্তি-খেউড়, চাপরাশিকে প্রিন্সিপালের গালমন্দ আর মিউজিক ক্লাসে হারমোনিয়ামের ম্যাঁও-ম্যাঁও--- সব কিছু ছাপিয়ে হটাৎ জেগে উঠেছে একটা বিকট আওয়াজ-- ভক্‌ ভক্‌ ভক্‌ ভক্‌ ! মোতিমাস্টারের গমপেষা মেশিন চালু হয়েছে। এটা তারই আওয়াজ। এটাই আসল আহ্বান। অন্ন-বস্ত্র না জোটার চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা-ঝগড়ার হুংকার, এসব না শুনে খাঁটি নেতারা শুধু আত্মার আওয়াজ শুনতে পান। মোতিমাস্টারেরও সেই দশা। উনি আর কোন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন না, শুধু ওই ভক্‌ -ভক্‌ -ভক্‌ !
    উনি ক্লাস থেকে ছুটে বেরোতে গেলেন।
    ছেলেরা বলল, " কি হল মাস্টারমশাই? এখনো তো ঘন্টা পড়েনি?"
    --" মনে হচ্ছে মেশিনটা ঠিক হয়ে গেছে। দেখি গিয়ে , কেমন চলছে।"
    দরজা অবদি গিয়ে হটাৎ ফিরে এলেন। চেহারায় কষ্টের ছাপ, যেন কেউ খুব জোরে চিমটি কেটেছে। বল্লেন, " বই থেকে পড়ে নিও। আপেক্ষিক ঘনত্বের চ্যাপটার খুব দরকারি।" উনি জিভে জল টেনে নিলেন। একটু থেমে বল্লেন," ইম্পর্ট্যান্ট!" বলেই চেহারায় প্রফুল্ল ভাব।
    ভক্‌ ! ভক্‌ ! ভক্‌ !
    বাইরের জটিল কর্মক্ষেত্র থেকে কর্তব্যের আহ্ববান ভেসে আসছে। ছাত্রের দল আর বইয়ের পাতার মোহ ওনাকে বেঁধে রাখতে পারল না।
  • brcslg | 37.125.200.101 | ১২ নভেম্বর ২০১২ ১২:১৫574626
  • হয়ত অধৈর্য্য হয়ে পরেছি, কিন্তু নেশা ধরিয়ে দিয়েছেন যে।
    পাঠক তো এক পাওনাদারও বটে। তাগাদা তো মারবেই।

    আপনার শারীরিক সাচ্ছন্দ প্রার্থনা করি।
  • ranjan roy | 24.96.150.107 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ০০:২২574627
  • ঘড়িতে চারটে বাজল। প্রিন্সিপাল সাহেব নিজের কুঠুরি থেকে বাইরে বেরোলেন। রোগা-প্যাংলা শরীরের খানিকটা হাফ-প্যান্ট আর খানিকটা শার্টে ঢাকা পড়েছে, বগলে পুলিস এর সার্জেন্টমার্কা বেত, পায়ে স্যান্ডেল। সব মিলিয়ে বেশ চটপটে আর চালাক দেখাচ্ছে। আর যত না দেখায় তার থেকে উনি নিজেকে একটু বেশি ভাবেন।
    ওনার পেছন পেছন চলছে কলেজের ক্লার্ক, রোজকার মতন। প্রিন্সিপাল এবং ক্লার্কের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা সবাই জানে।
    এরা এখন মোতিরাম মাস্টারের ক্লাসের ধারে পৌঁছেচেন। ক্লাস চলছে ওই আস্তাবলের মত ঘরটায়। ক্লাসে যে কোন মাস্টার নেই সেটা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। একটা ছেলে মাস্টারের টেবিলে চড়ে বসে বসে কাঁদছে। ওর পরণের পাজামাটা নীচের থেকে উরূ পর্য্যন্ত ছেঁড়া। প্রিন্সিপালকে ক্লাসের ধার দিয়ে যেতে দেখে ও আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। উনি জিগ্যেস করলেন, " কি হয়েছে? মাস্টারমশাই কোথায়?"
    তাতে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আরেকটা ছেলে জবাব দিল-- " এটা মোতিরাম মাস্টারের ক্লাস।"
    ব্যস্‌, প্রিন্সিপাল তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন মাস্টারমশাই কোথায়। ক্লার্ক বললো," সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন চালাতে হলে চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে হয়। কতবার মোতিরাম মাস্টারকে বলেছি এই আটা-চাক্কিটা বেচে দাও, কিন্তু ওর মাথায় ঢুকলে তো? আরে আমিই একবার হাজার দেড়েক দিতে চেয়েছিলাম।"
    প্রিন্সিপাল বল্লেন," ছাড়ান দাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
    ক্লার্ক একটি ছেলেকে বললো, " যাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
    একটু পরে ওদিক থেকে একটি ভালোমানুষ গোছের অল্পবয়সী তরুণকে আসতে দেখা গেল।
    প্রিন্সিপাল ওকে দেখা মাত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, " ভাই মালবীয়, এই ক্লাসটাও একটু দেখে নিও।"
    মালবীয় কাছে এসে ছাদের একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো," একটা পিরিয়ডে দুটো ক্লাস? কি করে করবো?"
    কাঁদুনে ছেলেটা কেঁদেই চলেছে। কিছু ছেলে ক্লাসের পেছন দিকে বসে জোরে জোরে হাসছে। বাকি সবাই এনাদের সামনে এমন ভীড় করে দাঁড়িয়েছে যেন চৌরাস্তার মোড়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
    প্রিন্সিপাল সাহেব এবার গলার আওয়াজ চড়িয়ে বল্লেন, " বেশি নিয়মকানুন দেখাবে না! যেদিন থেকে তোমার খান্নামাস্টারের সঙ্গে ওঠবোস শুরু হয়েছে , সেদিন থেকেই সব কাজে খালি অজুহাত।"
    মালবীয় অবাক হয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ দেখছিল। ক্লার্ক বলল,"সরকারী বাসের হিসেবে ক্লাস চালিয়ে নাও, মালবীয়। দেখনি, একটা বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লে কেমন যাত্রীদের পরের বাসে তুলে দেয়া হয়? এই ছেলেগুলোকেও অমনি করে তোমার ক্লাসে নিয়ে বসাও।"
    ও বেশ মিষ্টি করে জবাব দিল, " কিন্তু এটা তো ক্লাস নাইন। আমি ওখানে তো সেভেনের ক্লাস নিচ্ছি।"
  • ranjan roy | 24.96.150.107 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ০১:২৩574628
  • প্রিন্সিপালের ঘাড় পেছনে ঘুরলো। যারা জানে তারা বুঝে গেছে যে এবার প্রিন্সিপালের হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকবে আর ওনার চিৎকার শোনা যাবে। হলও তাই। উনি বললেন, " আমি সব জানি। তুমিও খান্নার মত তক্কো করা শুরু করেচো, আমাকে ক্লাস সেভেন আর নাইনের তফাৎ শেখাতে এয়েচো? আমাকে আর প্রিন্সিপালগিরি শেখাতে এসো না। যেমন যেমন হুকুম হবে , তেমন তেমন ক্যারি আউট করে যাও বুঝেচো কি বোঝনি? "
    প্রিন্সিপাল থাকেন কাছের এক গাঁয়ে। লোকমুখে ওনার দুটো গুণের খ্যাতি দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা হল জালি খরচের হিসেব দেখিয়ে ঢের সরকারি ফান্ড আদায় করা। অন্যটা রাগের চরমসীমায় শুদ্ধ হিন্দি ছেড়ে স্থানীয় অবধী বুলি আওড়ানো। উনি যখন জালি হিসেবপত্তর বানান তখন আচ্ছা-সে-আচ্ছা খাঞ্জা খাঁ অডিটরও কলম চালাতে হিমসিম খেয়ে যায়। তেমনি ওনার অবধী বুলির খই ফুটলে বড় বড় তর্কপঞ্চাননেরও বাক্যি হরে যায়।
    মালবীয় মাথা নীচু করে ফিরে গেল। প্রিন্সিপাল ছেঁড়া পায়জামা পরা ছেলেটার পিঠে দু'ঘা বেত কষিয়ে বল্লেন, " যাও, সবকটা গিয়ে চুপচাপ ওই ক্লাসে বসে থাক। একটু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছি কি চামড়া গুটিয়ে নেব।"
    ছেলের দল চলে গেলে ক্লার্ক মিচকি হেসে বলল, " চলুন, খান্না মাস্টারের তামাশাটাও দেখে আসি।"
  • ranjan roy | 24.96.150.107 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ০১:৫১574629
  • খান্নামাস্টারের আসল নাম খান্নাই বটে; যেমনি , তিলক, গান্ধী, প্যাটেল, নেহরু ইত্যাদি কোন জাতিসূচক পদবী না হয়ে লোকের নাম হয়ে গেছে। এই দেশে জাতপাত তুলে দেয়ার এটাই সহজ উপায়। জাতের থেকে ওর নামটা কেড়ে নিয়ে কোন মানুষের নাম বানিয়ে দিলে জাতের হাতে আর থাকে কী? তখন বাধ্য হয়ে জাতিপ্রথা নিজে নিজেই শেষ হয়ে যায়।
    খান্নামাস্টারের চাকরি ইতিহাসের লেকচারারের, কিন্তু এখন উনি একটি ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। দাঁতে দাঁত পিষে বলছেন, " হিন্দিতে তো বড় বড় প্রেমের গল্প লিখে ফেল, কিন্তু ইংরেজির ক্লাসে কোন উত্তর না দিয়ে ঘোড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?"
    ক্লাসের মাঝখানে একটা ছেলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে আমাদের দেশে ঘি-দুধের দুষ্প্রাপ্য হওয়ার আর খেলাধূলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠ্যালায় বেশির ভাগ ছাত্রই ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়ার মত দেখায়, কিন্তু এই ছেলেটার মুখের গঠনে এমন একটা ভাব আছে যে এটা টাইটেল হয়ে ওর নামের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ক্লাসের ছেলেরা জোরে জোরে হাসছে। খান্নামাস্টার এবার ইংরেজিতে জিগাইলেন, " বল, 'মেটাফর' মানে কী?"
    ছেলেটা ঢ্যাঁটার মত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুদিন আগে দেশে গুজব রটে ছিল যে অশিক্ষিত লোক মানে শিং-লেজ ছাড়া পশু। ওই গুজবের ফলে অনেক অশিক্ষিত পরিবারের ছেলে হাল-কোদাল ছেড়ে স্কুল-কলেজে হামলে পড়ল। হাজার হাজার ছেলের পাল এসে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে ঘিরে ফেলে এমন হল্লা শুরু করল যে শিক্ষাক্ষেত্রে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। এখন আর কেউ বলে না যে অশিক্ষিত মানুষ জানোয়ারের মত। বরং ফিসফিস করে বলা হচ্ছে যে উচ্চশিক্ষা সবার জন্যে নয়, এর জন্যে 'স্ক্রীনিং' দরকার। এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেঁয়ো ছেলেদের আবার হাতে লাঙল ধরিয়ে ক্ষেত-খামারে ফেরৎ পাঠানোর ফতোয়া দেয়া শুরু হয়ে গেল।
    কিন্তু বার বার ফেল হয়ে, ক্লাসের মধ্যে নানারকম বকাবাদ্যি-নিন্দেমন্দ শুনে, নেতাদের মুখে কৃষিকাজের মহিমাকীর্তন শোনার পরেও ওই ছেলের দল কিছুতেই লাঙল-কোদালের দুনিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হল না। এরা কানখাজুরার মত স্কুলের গায়ে সেঁটে রইল আর যেভাবেই হোক, সেঁটে থাকতেই চাইল।
  • ranjan roy | 24.96.150.107 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:২০574630
  • ঘোড়ামুখো ছেলেটাও এইরকম একটি ভীড়ের অংশ। ওকে রোজ ক্লাসের ভেতর নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হত কি যাও বাছা! ঘরে গিয়ে তোমার মোষ দোয়াতে থাক, বলদের ল্যাজে মোচড় দাও,-- শেলী - কীটস ঠিক তোমার জন্যে নয়। কিন্তু ছেলে নিজের বাপের থেকে কয়েক শতাব্দী এগিয়ে গিয়েছে, এইসব ইশারা বুঝতে ওর বয়েই গেছে। ওর বাপ আজও দ্বাদশ শতাব্দীর গাঁড়াশি দিয়ে বলদের জন্যে চারা কাটে। ছেলে তখন একটা আধময়লা বইয়ের আড়ালে নিজের ঘোড়ামুখ লুকিয়ে বিংশ শতাব্দীর কোলকাতার রঙীন রাতের দৃশ্য মগ্ন হয়ে দেখে। এই অবস্থার কোন পরিবর্তনে ও আগ্রহী নয়। তাই ও মেটাফরের মানে বলতে পারে না, নিজের ঘোড়ামুখ নিয়ে কোন পাল্টা জবাব দিতে পারে না।
    কলেজের সমস্ত ছাত্রের মত এই ছেলেটারও নিজের পোশাক-আশাক নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ছেলেটার পায়ে জুতো নেই, আর এমন একটা ডোরাকাটা কাপড়ের ময়লা পাজামা পরেছে যেগুলো দিয়ে শহুরে লোকেরা স্লিপিং স্যুট বানায়। ও গাঢ় খয়েরি রংয়ের মোটা জামা পরেছে। ওর বোতাম গুলো ভাঙা। মাথায় শক্ত রুক্ষ্ম চুল। মুখধোয়া হয় নি। গিচ্‌পিচ্‌ চোখ। দেখলেই মনে হয়, ও কোন প্রোপাগ্যান্ডার চক্করে ফেঁসে কলেজে পালিয়ে এসেছে।
    ছেলেটা গত বছর কোন শস্তা ম্যাগাজিন থেকে একটি প্রেমের গল্প নকল করে কলেজের ম্যাগাজিনে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিল। খান্নামাস্টার ওর লেখকখ্যাতিতে কাদা ছিটোতে উঠে পড়ে লেগেছেন। উনি গলার স্বর বদলে বল্লেন, " লেখক মহাশয়, কিছু বলুন। মেটাফর কারে কয়?"
    ছেলেটা ওর উরু চুলকোতে লাগল। মুখটা কয়েকবার আঁকাবাঁকা করে হটাৎ বলে উঠল, " যেমন মহাদেবীজির কবিতায় বার বার বেদনার মেটাফর দেখা যায়।"
    খান্নামাস্টার গর্জে উঠলেন, "শাট্‌ আপ! এটা ইংরেজির ক্লাস।" ছেলেটা চুলকানো বন্ধ করল।
  • ranjan roy | 24.96.150.107 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ০২:৪৪574631
  • খান্নামাস্টার খাকি রঙের প্যান্ট আর নীল রঙের বুশশার্ট পরেন আর স্মার্ট দেখাবে বলে কালো চশমা। চেয়ার ছেড়ে উনি এবার টেবিলের সামনে এসে পাছার একটু ছোট অংশ টেবিলে ঠেকিয়ে কায়দা করে দাঁড়ালেন। ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় চোখে পড়ল পেছনের দরজায় প্রিন্সিপালের চোখ আর বারান্দায় ক্লার্কের কাঁধের অংশ।
    তক্ষুণি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বল্লেন," জী, শেলীর কবিতা পড়াচ্ছিলাম।"
    প্রিন্সিপাল একটি শব্দের গায়ে আর একটি শব্দ চড়িয়ে দিয়ে বল্লেন," কিন্তু আপনার কথা শুনছে কে? এখানে তো এরা ছবি দেখায় মত্ত।" উনি এবার সোজা ক্লাসের ভেতরে ঢুকে এক এক করে দুটো ছেলের পিঠে বেত ছোঁয়াতেই ওরা উঠে দাঁড়াল। একজনের নোংরা পাজামা, বুশশার্ট আর তেল-চুপচুপে চুল; অন্যজনের ন্যাড়ামাথা, কামিজ ও পালোয়ানিমার্কা আন্ডারওয়ার। প্রিন্সিপাল ওদের বল্লেন, " কি, এসবই পড়ানো হচ্ছে?"
    উনি নীচু হয়ে আগের ছেলেটির চেয়ার থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। ওতে ভরপুর সিনেমা সাহিত্য ছিল। একটা পাতা খুলে উনি হাওয়ায় ঘোরালেন। ছেলেরা দেখল, ফটোতে কোন বিলেতি মেমের উদ্ধত বুক ফড়ফড় করছে। এবার পত্রিকাটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে অবধীতে চেঁচিয়েব্ব উঠলেন, " এটাই পড়ানো হচ্ছে নাকি?"
  • ranjan roy | 24.96.46.165 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ২২:৪০574632
  • ক্লাসরুমে সন্নাটা। " মহাদেবী কী বেদনা"র প্রেমিকপ্রবর ছেলেটি মওকা দেখে চুপচাপ নিজের সীটে বসে পড়েছে। ক্লাসের এ-মুড়োয় দাঁড়িয়ে প্রিন্সিপালসাহেব ও মুড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা খান্নামাস্টারকে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বল্লেন," আপনার ক্লাসে ডিসিপ্লিনের এই অবস্থা? ছেলেরা সিনেমার পত্রিকা পড়ছে! এরই জোরে আপনি প্রেসার দেয়াচ্ছিলেন যে আপনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানানো হোক? এই ক্ষ্যামতায় ভাইস প্রিন্সিপালগিরি কোরবেন? ভাইয়া, যদি এমনি চলতে থাকে তো ভাইস প্রিনসিপালি যাক চুলোয়, আসছে বছর জুলাই মাস থেকেই পথে পথে ঘুরে বেড়িও।" বলতে বলতে অবধীভাষার মহাকবি গোস্বামী তুলসীদাসের আত্মা ওনার শরীরের একদিক দিয়ে ঢুকে আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর উনি শুদ্ধ হিন্দিতে ফিরে এলেন," লেখাপড়াই সব নয়, আসল হল ডিসিপ্লিন, বুঝলে হে খান্নামাস্টার!"
    এইসব বলে প্রিন্সিপাল সাহেব ওমর খৈয়ামের নায়কের মত " বৃষ্টিধারার মত এসে ঝড়ের মত যাই" ভঙ্গিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।পেছন থেকে খান্নামাস্টারের ভনভনানি ওনার কানে আছড়ে পড়ল।
    উনি কলেজের ফটকের বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলেন। সাইকেল চড়ে একটি লোক আসছে-- পরনে শার্ট-প্যান্ট। কাছ দিয়ে যাবার সময় ও প্রিন্সিপালকে আর উনি ওকে নমস্কার করলেন। ও এগিয়ে গেলে ক্লার্ক জিগ্যেস করল এটা আবার কোন ইস্কাপনের গোলাম?
    -" ম্যালেরিয়া ইন্স্পেকটর, নতুন এসেছে। শুনেছি বিডিও'র ভাগ্নে। বড্ড চালু। আমি এখনো কিছু বলিনি। ভাবছি, কখনো তো কাজে আসবে।"
    ক্লার্ক বললো," আজকাল এমনিসব ইস্কাপনের গোলাম দিয়েই কাজ হয়। ভালমানুষের দল তো কখনো কিছু করে দেয় না।"
    খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ, শুধু রাস্তায় পা ফেলে চলেছেন। তারপর প্রিন্সিপাল শুরু করলেন," সবরকম মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করা উচিৎ। এই কলেজের জন্যে গাধাকেও বাবা ডাকতে হয়েছে।"
    ক্লার্ক উবাচ, " সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সারাদিন তো এই করেই কাটাচ্ছেন।"
    --- " বলুন, বলুন দেখি! এর আগে পাঁচ-পাঁচজন প্রিন্সিপাল ছিল। কেউ এমন বড় পাকা বাড়ি তুলতে পেরেছে?" উনি এবার শান্ত হলেন," এই কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা তো আমারই পরিশ্রমে সম্ভব হল। ঠিক বল্লাম কি না?"
    ক্লার্ক সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
    একটু পরে উনি কিছু ভাবতে ভাবতে বল্লেন," আমি তো এই তালে আছি যে কোন ব্যাটা চন্ডুল ফেঁসে গেলে এই বিল্ডিং এর আর এক-আধ ব্লক তৈরি করে ফেলব।"
    ক্লার্ক চুপ্চাপ সঙ্গে চলতে চলতে হটাৎ থেমে গেল, " দুটো বিল্ডিং তৈরি হল বলে।"
    প্রিন্সিপাল উৎসাহের চোটে ঘাড় তুলে বল্লেন,"কোথায়?"
    -" একটা তো অস্পৃশ্যদের জন্যে চামড়া সাফ করার কারখানা। ঘোড়ার ডাক্তার বলছিল। আর একটা হল হাসপাতালে কলেরার জন্যে আলাদা ওয়ার্ড। এদিকে খালি জমি পাওয়া কঠিন। কলেজেরই আশেপাসে "টিপ্পস" দিয়ে এই বিল্ডিংগুলো বানিয়ে নিন। তারপর কায়দা করে হাতিয়ে নেব।"
    প্রিন্সিপাল একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন," আগে থেকেই জানতাম, এখানে 'টিপ্পস্‌ চলবে না"।
    খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ চলতে লাগলেন।
  • ranjan roy | 24.96.46.165 | ১৩ নভেম্বর ২০১২ ২৩:০৫574633
  • রাস্তার ধারে একজন লোক গোটা চার মজদুরকে ধরে ভারি বকাঝকা করছিল। প্রিন্সিপালসাহেব ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু-চারমিনিটে বুঝে গেলেন লোকটা কেন বিগড়েছে। মজদুরের দল কাকুতি-মিনতি করছিল। প্রিন্সিপাল বুঝে গেলেন যে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, এসব ঠিকেদার আর মজুরের মধ্যে রোজ-রোজ হতেই থাকে। আজ কথাবার্তায় কিছু খিঁচ ধরেছে। উনি আগ বাড়িয়ে মজুরদের বল্লেন, " যাও রে! সব নিজের নিজের কাজে লেগে যাও। ঠিকেদার সাহেবকে ঠকাবার চেষ্টা করলে জুতো খাবে।"
    মজুরের দল কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো, তারপর সুযোগ বুঝে যে যার কাজে লেগে গেল। এবার ঠিকেদার প্রিন্সিপালকে বেশ আত্মীয়্তা দেখিয়ে বলল," বুঝলেন, সব ক'টা বেইমান! একটু চোখ বুজেছেন কানের ময়লাও চুরি করে সাফ করে দেবে। দেড়গুণো মজুরি চায় আবার কাজ দেখলে পালাই -পালাই করে।"
    প্রিন্সিপাল সাহেব বল্লেন," সবজায়গায় একই অবস্থা। আমার এখানেই দেখুন। কোন ব্যাটা মাস্টার পড়াতে চায়? আমি পেছনে লেগে লেগে তবু একটু--"।
    লোকটা ঠা-ঠা করে হাসল। বলল," আমায় কি বলবে? এই তো করে যাচ্ছি। সব জানি।" তারপর একটু থেমে বলল, " এদিকে কোথায়?"
    জবাব দিল ক্লার্ক, " বৈদ্যজীর ওখানে। চেকে দস্তখত করতে হবে।"
  • ranjan roy | 24.99.150.144 | ১৪ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৪৫574635
  • " দস্তখত করিয়ে আনুন।" ও প্রিন্সিপালকে কেটে পড়ার ইশারা করলো। কিন্তু ওরা পা' বাড়াতেই প্রিন্সিপালকে বল্লো," আর কি খবর? কেমন চলছে?"
    প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে পড়লেন।
    -" এমনিতে সব ঠিকই আছে। ওই খান্না-বান্নার দল লিবির-শিবির করছে। মানে, আপনাদের আর আমার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করে বেড়াচ্ছে।"
    ও জোর দিয়ে বল্লো," আপনি চিন্তা করবেন না। ডাঁটের সঙ্গে প্রিন্সিপালগিরি চালিয়ে যান। ওদের বলে দিন যে প্রোপাগান্ডার জবাব হল ডান্ডা! বুঝিয়ে দিন যে এটা শিবপালগঞ্জ। এখানে ছোট-বড় দেখে চলতে শিখুক।"
    একটু এগিয়ে যাবার পর ক্লার্ক বলল," ঠিকেদারসায়েবকেও কলেজ-কমেটিতে মেম্বার করে নিন। কাজে আসবে।"
    প্রিন্সিপাল ভাবতে লাগলেন। ক্লার্ক বলল," ওনার নামে চার বছরের পুরনো তারিখে পেট্রনের রসিদ কেটে দেব। ম্যানেজিং কমিটিতেও ওনার থাকা জরুরি। তাহলে বেশ হবে।"
    প্রিন্সিপাল সাহেব তক্ষুণি কিছু বললেন না। একটু পরে বল্লেন,"আগে বৈদ্যজীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এসব হাই-পলিটিকসের ব্যাপার। তোমার-আমার ক্ষ্যামতার বাইরে।"
    সাইকেলে চড়ে আর একজন কেউ আসছে। প্রিন্সিপাল ওকে নামতে ইশারা করে বল্লেন," নন্দাপুরে বসন্ত মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে, আর আপনি এখানে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শায়রী করে বেড়াচ্ছেন?"
    বেচারা হাত জোড় করে বলল," কই? কবে থেকে? আমার কাছে তো কোন খবর নেই!"
    প্রিন্সিপালের ভুরু বেঁকে গেল। "তোমার শহরের চক্কর থেকে ফুরসৎ হবে তবে তো খবর পাবে? চুপচাপ ওখানে চলে যাও, গিয়ে টিকে লাগাও। নইলে নালিশ হবে আর তোমায় কান ধরে বের করে দেয়া হবে। ওই টেরিলিনের বুশশার্ট গা' থেকে নেমে যাবে।"
    লোকটি হেঁ-হেঁ করে কেটে পড়ল।প্রিন্সিপাল ক্লার্ককে বল্লেন," এ ব্যাটা এখানের পাব্লিক হেল্থ বিভাগের এ ডি ও। যারই নামের পেছনে অফিসারের লেজ জুড়ে যায় সে'ব্যাটাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে।"
    " এ ব্যাটাও নিজেকে কি যে ভাবে, রাস্তায় দেখা হলে চিনতে চায় না।"
    --" আমিও ভাবলাম দাও ব্যাটাকে ঝেড়ে!"
    ক্লার্ক বলল," আমি জানি, এটাও একটা ইস্কাপনের গোলাম।"
    ---------------------******----------------------
  • ranjan roy | 24.99.150.144 | ১৪ নভেম্বর ২০১২ ০৭:২৩574636
  • অধ্যায়-৪
    ----------
    খানকয়েক কুঁড়েঘর, তার চেয়েও খারাপ অবস্থার গোটাকয় দোকান, তহসীল অফিস, থানা, তাড়ির দোকান, ব্লক অফিস, মদের দোকান, কলেজ--- ব্যস্‌, পথচলতি কারো চোখে এইটুকুই ধরা দেবে। একটু এগিয়ে গেলে একটা আমের বাগান--- বেশ ঘন, তাতে একটা কাঁচা ঘর, রাস্তার দিকে পিট,। আর কবাটহীন দরজাটার মুখ জঙ্গলের দিকে।
    বৃষ্টির দিনে রাখালের দল গাছের ছায়া ছেড়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে জুয়ো খেলে, বাকি দিন এটা খালিই পড়ে থাকে। কিন্তু খালি থাকলেও লোকজন খালি থাকতে দেয় না যে! মেয়ে-পুরুষেরা সময় সুযোগ বুঝে একে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকে।
    শিবপালগঞ্জে এই ঘরটার যা প্রচলিত নাম সেটা শুনলে হেনরি মিলারও ব্যোমকে যাবেন। কলেজের এক মাস্টার তাতে খানিকটে জল মিশিয়ে নাম দিয়েছেন-'প্রেম-ভবন'।
    কুঁড়েঘর আর প্রেম-ভবনের মাঝখান দিয়ে চলা সড়কের এ'পাশটা শিবপালগঞ্জের শুধু একটা কোণাকে ছুঁয়েছে। আসল শিবপালগঞ্জ রাস্তার ওপারে। আসল শিবপালগঞ্জকে পাওয়া যাবে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায়।
    বৈঠকখানার হদিস পেতে হলে একটু গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকতে হবে। দুপাশে খাপরায় ছাওয়া এলোমেলো-ধ্যাবড়া গোছের ঘরবাড়ি। বাড়ির বাইরের রোয়াকগুলো গলা বাড়িয়ে গলির মধ্যে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসেছে। দেখলেই এদের ফিলজফিটা বোঝা যায়--নিজের চৌহদ্দির আশেপাশে খালি জায়গা দেখলেই অন্যের চোখ এড়িয়ে কব্জা কর।
  • ranjan roy | 24.99.226.51 | ১৪ নভেম্বর ২০১২ ২২:৪৭574637
  • এই সবুজে সবুজে ছাওয়া এলাকায় খোলা মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি একটা কোণ আটকে এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে ওদিকে আর এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। ওটি বৈদ্যজীর বাড়ি। বৈদ্যভবনের সামনের দিকটা পাকা আর গেঁয়ো স্টাইলে বেশ সম্ভ্রম জাগানো, কিন্তু পেছনের দিকে কাঁচা দেয়াল আর তার পিছে প্রাতঃকৃত্য হয়, তাই কিছু নোংরা পড়ে থাকে। যেমন ঝিলিমিলি এয়ারপোর্ট আর লকলক হোটেলের সারি দিয়ে এদেশের 'সিম্বলিক মডার্নাইজেশন' মাপা হয়, তেমনি এর প্রভাব এই দেহাতি বাড়িটার আর্কিটেকচারেও দেখা যাচ্ছে।এর থেকে প্রমাণিত হয় যে দিল্লি হোক কি শিবপালগঞ্জ, কাজের ক্ষেত্রে দেশি বুদ্ধি সর্বত্র এক।
    বাড়িটার সামনের ভাগ, যাতে বাঁধানো রোয়াক, বারান্দা আর একটা বড় কামরা রয়েছে সেটা,বৈঠকখানা নামে প্রখ্যাত। ইঁট-বালি মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মজদূরও জানে যে বৈঠকখানার মানে শুধু ইঁট-চূণ-সুরকির তৈরি বাড়িটা নয়। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীট, হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন --এসব বাড়ির নাম না, ক্ষমতার নাম।

    থানার থেকে ফিরে এসে রূপ্পনবাবু দেজ্খতে পেলেন --- দরবার-এ-আম, অর্থাৎ,বারান্দায় খুব ভীড় জমেছে ,অমনি চলার গতি বেড়ে গেল। পরনের ধূতি ফড়ফড় করতে লাগল।
    বৈঠকে ঢুকতেই উনি জানতে পারলেন যে ওনার মামাতো ভাই রঙ্গনাথ শহর থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছে; কিন্তু রাস্তায় ড্রাইভার ওর থেকে দু' টাকা উসুল করে গেছে,
  • ranjan roy | 24.99.156.94 | ১৫ নভেম্বর ২০১২ ০৬:১০574638
  • একটা রোগাভোগা লোক ময়লা গেঞ্জি আর ডোরাকাটা আন্ডারওয়ার পরে এই নভেম্বর বিকেলের শীত-শীত আবহাওয়ার মধ্যেও দিব্যি খুশি-খুশি বসে আছে।
    ওর নাম হল মঙ্গল, কিন্তু লোকে ডাকে শনিচর বলে। চুলে পাক ধরেছে, সামনের দাঁত ক'টা পড়ে গেছে।ওর পেশা বলতে বৈদ্যজীর বৈঠকে বসে থাকা। ও সাধারণতঃ শুধু আন্ডারওয়ার পরেই থাকে, আজ গায়ে গেঞ্জি উঠেছে দেখে রূপ্পনবাবু বুঝে গেলেন যে শনিচর "ফর্ম্যাল" হতে চাইছে। ও রূপ্পনবাবুকে একশ্বাসে রঙ্গনাথের সমস্যাটা বলে দিয়ে নিজের নগ্ন উরূতে তবলার কিছু কঠিন বোল বাজিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, " আজ বদ্রীভাইয়া এখানে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত।"
    রূপ্পনবাবু রঙ্গনাথকে বল্লেন--" তুমি ঠিক করেছ, রঙ্গনাথদাদা। দু'টাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিলে। কথায় কথায় খুন-খারাপি উচিৎ নয়।"
    রূপ্পনবাবুর সঙ্গে রঙ্গনাথের দেখা হল প্রায় দেড় বছর পরে। রূপ্পনবাবুর সিরিয়াস ভাবটাই ওর কাছে সারাদিনের সবচেয়ে মজার ব্যাপার ধরে নিয়ে ও বলল, " আমি তো মারামারি করতেই যাচ্ছিলাম, কি ভেবে সরে এলাম।"
    রূপ্পনবাবু মারপিটের বিশেষজ্ঞ হওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বল্লেন-- তুমি ঠিক করেছ। এইসব ঝগড়া-ঝাঁটিতে ইস্টুডেন্ট কমিউনিটির বদনাম হয়।
    রঙ্গনাথ এবার ওকে ভাল করে চেয়ে দেখলো। কাঁধের ওপর ধুতির কোঁচা,একটু আগে মুখে পোরা পান, চুলে কয়েক লিটার তেল---- স্থানীয় গুন্ডাগিরির যেকোন স্ট্যান্ডার্ডে একদম প্রথমসারির বলে মনে হবে। রঙ্গনাথ কথা পাল্টানোর চেষ্টায় বলল," বদ্রীদাদাকে দেখছি না! উনি কোথায়?"
    শনিচর আন্ডারওয়ার ঝাড়তে লাগল, যেন কয়েকটা পিঁপড়েকে ঘরছাড়া করবে। ভুরু কুঁচকে বলল, " আমিও বদ্রীভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। আজ ও থাকলে এতক্ষণে তো--"।
    রঙ্গনাথ ওর কথায় কান না দিয়ে রূপ্পনবাবুকে বলল," বদ্রীদাদা এখন কোথায়?"
    রূপ্পনবাবু একটু কড়া ভাবে জবাব দিলেন--- শনিচর বলল তো! আমায় বলে যায় নি। হয়তো বাইরে গিয়েছেন। এসে যাবেন। কাল হোক, পরশু হোক বা তরশু--ঠিক এসে যাবেন।"
    ওনার কথার ভাবে বোঝা মুশকিল যে বদ্রী ওনার আপন বড়ভাই, ওনার সাথে এক ঘরেই থাকেন। রঙ্গনাথ জোরে নিঃশ্বাস নিল।
    শনিচর বসে বসেই পা টা লম্বা করল। তারপর শরীরের যে অংশ থেকে বাঁ-পাটা বেরিয়েছে ঠিক সেখানে চামড়ার একটা টুকরোয় চিমটি কেটে চেপে ধরল। ওর চোখ তৃপ্তিতে বুজে গেল। একটু পরে চিমটির জায়গাটায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে বোলাতে ও নেকড়ের মত মুখব্যাদান করে হাই তুলল। তারপর ঝিমধরা স্বরে বলল, "রঙ্গনাথ ভাইয়া শহর থেকে এসেছেন, ওনাকে আর কি বলব? কিন্তু কেউ কোন 'গঞ্জহা'র থেকে দুটাকা তো দূর, একটা কড়ি কেড়ে নিয়ে দেখাক দেখি?"
    'গঞ্জহা' শব্দটা রঙ্গনাথের অপরিচিত নয়। এটা একটা টেকনিক্যাল শব্দ যেটাকে শিবপালগঞ্জের অধিবাসী বেশ সম্মানসূচক টাইটেলের মতন ব্যবহার করে থাকে। আশপাশের গাঁয়ের অনেক 'শান্তির পূজারী'ও কখনো কখনো নীচু গলায় পরামর্শ দেন--- তুমি ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না। জান না তো, ও শালা একজন 'গঞ্জহা'।
  • ranjan roy | 24.99.156.94 | ১৫ নভেম্বর ২০১২ ০৬:১৯574639
  • বৈঠকখানার মেজেতে একটি চোদ্দ-পনের বছরের ছেলেও বসে ছিল। দেখলেই বোঝা যায় যে ও সরকারের শিক্ষা-প্রসারের ফাঁদে পা দেয় নি। শনিচরের কথা শুনে বেশ দম্ভের সঙ্গে বলে উঠলো-" শহুরে ছেলেরা বড্ড সিধেসাদা আর সরল । কেউ আমার কাছে টাকা চেয়ে দেখুক তো---" বলে ও হাতটা হাওয়ায় এমন করে ঘোরাতে লাগলো যেন লরিতে একটা বড় হ্যান্ডল লাগিয়ে প্রাণপণে স্টার্ট করতে চাইছে।সবাই হেসে উঠল, কিন্তু রূপ্পনবাবু আরো গম্ভীর।
  • ranjan roy | 24.99.156.94 | ১৫ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৩৫574640
  • উনি রঙ্গনাথকে জিগ্যেস করলেন," তুমি ড্রাইভারকে টাকাটা নিজের থেকে দিলে কি ও ধমকে-ধামকে নিয়ে নিল?"
    রঙ্গনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "আজকাল তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ, রূপ্পন?"
    প্রশ্নটা যে পছন্দ হয় নি, সেটা ওনার চেহারায় স্পষ্ট।
    -" ক্লাস টেন এ। তুমি বলবে সে তো দু'বছর আগেও পড়ছিলে। কি করব, আমি তো শিবপালগঞ্জে এই ক্লাস টেন থেকে বেরোনোর রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি জান না দাদা, এ দেশের শিক্ষাপদ্ধতি বিলকুল বেকার। বড় বড় নেতারা বলছেন। আমিও সহমত। তারপর ধর এই কলেজের হাল-হকিকত, সেসব তো তুমি কিছুই জান না। যত লুচ্চা ছ্যাঁচড়ের আড্ডা হয়েছে।মাস্টারের দল পড়ানো-টরানো ছেড়ে খালি পলিটিক্স করছে। দিন রাত পিতাজীকে তিতি-বিরক্ত করে ছাড়ছে। খালি এটা করো, সেটা করো, মাইনে বাড়াও, আমার ঘাড়ে তেল মালিশ করো। এখানে কেউ পাশ করতে পারে?
    আছে, কিছু নির্লজ্জ ছেলেপুলে আছে, যারা কখনো কখনো পরীক্ষায় পাশ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে---"।
    কামরাটার ভেতরে বৈদ্যজী রোগীদের ওষুধ দিচ্ছিলেন। আচমকা ওখান থেকেই বল্লেন," শান্ত হও রূপ্পন! এই কু-ব্যবস্থা শীঘ্র সমাপ্ত হবে।"
    যেন আকাশবাণী হল," শান্ত হও বসুদেব! কংসের বিনাশকারী ধরাধামে অবতরিত হল বলে।" রূপ্পনবাবু শান্ত হয়ে গেলেন। রঙ্গনাথ ভেতরের কামরার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বলল, " মামাজী, এই কলেজটার সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক?"
    " সম্পর্ক"? কামরার ভেতর থেকে বৈদ্যজীর হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।" তুমি জানতে চাইছ এই কলেজের সঙ্গে মামার কিসের সম্পর্ক? রূপ্পন, রঙ্গনাথের কৌতূহল নিবারণ কর।"
    রূপ্পন বড় বিজনেসম্যানের ঢঙে বলল," পিতাজী কলেজের ম্যানেজার। মাস্টারদের কলেজে ঢোকা-বেরনো সব এনার হাতে।"
    রঙ্গনাথের চেহারায় এই কথাটার প্রভাব দেখে আরো বলল," এমন ম্যানেজার পুরো তল্লাটে পাওয়া যাবে না। ভালর জন্যে ভাল, আর হারামীর জন্যে খানদানী হারামী।"
    রঙ্গনাথ এই নতুন খবরটা চুপচাপ হজম করল। তারপর কিছু বলতে হবে বলে বলল," তাহলে কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের কি হবে? মামাজী ওটারও কিছু ছিলেন না?"
    " ছিলেন না, আছেন।" রূপ্পনবাবু একটু চড়া সুরে বল্লেন," উনি ম্যানেজিং ডায়রেক্টর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।"
  • ranjan roy | 24.99.216.109 | ১৬ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৫৪574641
  • বৈদ্যজী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
    ইংরেজ- শাসনের যুগে উনি ইংরেজদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিলেন। দেশি সরকার এলে দেশি শাসকদের প্রতি। উনি অনেকদিনের দেশসেবক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় , যখন এই দেশ জাপানী আক্রমণের ভয়ে কাঁপছিল, তখন উনি ফার-ইস্টে লড়ার জন্যে অনেক সেপাই রিক্রুট করিয়েছিলেন। আজকাল দরকার পড়লে নিজের রাজনৈতিক ফ্যাকশনে রাতারাতি অনেক সদস্য ভর্তি করাতে পারেন। আগেও উনি নানাভাবে জনগণের সেবা করেছেন--- যেমন জজের এজলাসে জুরির সদস্য এবং 'অ্যাসেসর' হওয়া, দেওয়ানি মোকদ্দমায় সম্পত্তির রিসিভার হওয়া। ইদানীং উনি কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের ম্যানেজিং ডায়রেক্টর এবং কলেজের ম্যানেজার।
    গল্পটা হল উনি এই সব পোস্টে কাজ করতে চান না, কেন না ওনার পদের লালসা নেই। কিন্তু এ'তল্লাটে এইসব দায়িত্বপূর্ণ পদে সাহস করে দায়িত্ব নেবে-এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর এলাকার যত নব্যযুবক? সবগুলো গোটা দেশের নব্যযুবকদের মতই অকম্মার ঢেঁকি। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে ওনাকে এই বৃদ্ধবয়সেও এই সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে।
    বৃদ্ধবয়স! বৈদ্যজীর জন্যে এই শব্দটি মাত্র পাটিগণিতের ফাঁদে পড়ে করতে হল। কর গুনলে ওনার বয়েস বাষট্টি ছাড়িয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে থেকে দেশসেবায় রত অগুনতি মহাপুরুষদের মত ওনারও বয়স বেড়েছে, তবু উনি বুড়ো হন নি।
    ওই মহাপুরুষদের মত উনিও পণ করেছেন যেদিন মরবেন সেদিনই বুড়ো হবেন, তার আগে নয়। আর সেদিনই মরবেন যেদিন লোকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে সত্যি সত্যি মরে গেছেন। তার আগে নিজেকে জীবিত ধরে নিয়ে দেশসেবা করেই যাবেন।
  • ranjan roy | 24.99.216.109 | ১৬ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৪৬574642
  • সমস্ত বড় পলিটিশিয়ানদের মত উনি পলিটিক্সের মা-মাসি করে থাকেন এবং পলিটিশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েন না। গান্ধীজির মত উনিও নিজের রাজনৈতিক দলে কোন পোস্ট নেন নি, কারণ উনি দলের মধ্যে তরুণদের উৎসাহ দিতে চান। কিন্তু কো-অপারেটিভ আর কলেজের ব্যাপারে লোকেরা ওনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করল আর উনি সেই চাপ মেনে নিলেন।
    বৈদ্যজীর একটি পেশা হল কবরেজি। এই পেশায় দুটো ফর্মূলা ওনার একেবারে ঠোঁটের ডগায়; একটা হল ' গরীবের দাতব্য চিকিৎসা ' আর অন্যটা ' রোগ না সারলে পয়সা ফেরৎ'। এই দুই ফর্মূলায় রোগীদের কতটা আরাম হয় তা বলা বাহুল্য, কিন্তু বৈদ্যজী যথেষ্ট আরাম পাচ্ছেন।
    উনি সমস্ত রোগকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন,-- প্রকট রোগ আর গুপ্ত রোগ। প্রকট রোগের চিকিৎসা প্রকট ভাবে হয় আর গুপ্ত রোগের চিকিৎসা গুপ্ত ভাবে। সমস্ত রোগের জন্যে ওনার একটাই থিওরি---সব রোগের মূল কারণ ব্রহ্মচর্য্যের ক্ষয়। কলেজের ছেলেদের কান্তিহীন, শিড়িঙ্গে চেহারা দেখলে প্রায়ই উনি এই থিওরি ঝাড়তে থাকেন । কেউ যদি বলে যে ছেলেদের অপুষ্টির কারণ গরীবি এবং ঠিকমত খেতে না পাওয়া তো উনি ধরে নেন যে ব্যাটা আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্বকে ছোট করে দেখছে। আর কে না জানে যে কেবল চরিত্রহীনেরাই ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্ব মানে না। তাই কেউ দারিদ্র আর আধপেটা খাওয়ার কথা যে তুলবে সেই চরিত্রহীন!
  • ranjan roy | 24.99.216.109 | ১৬ নভেম্বর ২০১২ ০৭:৪৮574643
  • ডিঃ শেষ লাইনটা হবে-- দারিদ্র ও আধপেটা খাওয়ার কথা যে তুলবে সেই চরিত্রহীন।
  • ranjan roy | 24.99.216.109 | ১৬ নভেম্বর ২০১২ ০৮:০৮574644
  • ব্রহ্মচর্য ক্ষয়ের ফলাফল নিয়ে উনি বেশ ভয়-জাগানো লেকচার দিয়ে থাকেন। সক্রেটিস, সম্ভবতঃ ওনাকে কি অন্য কাউকে, বলেছিলেন যে জীবনে তিনের পর চতুর্থবার ব্রহ্মচর্য ক্ষয় করার আগে নিজের কবর খুঁড়ে নেয়া ভাল। এই ইন্টারভিউয়ের উনি এমন ছবির মত বর্ণনা করেন যে লোকে ভাবে সক্রেটিস ব্রহ্মচর্যের ব্যাপারে আজও ওনার অবৈতনিক কন্সালট্যান্ট। ওনার মতে ব্রহ্মচর্য নষ্ট করার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল লোকে পরে চাইলেও নষ্ট করতে পারে না। সংক্ষেপে, ব্রহ্মচর্য নষ্ট করতে হলে আগে ব্রহ্মচর্যকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
    ওনার এইসব লেকচার শুনে কলেজের তিন-চতুর্থাংশ ছেলে জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে গেছল। কিন্তু ওরা যে একসাথে আত্মহত্যা করেনি তার কারণ বৈদ্যজীর ঔষধালয়ের একটি বিজ্ঞাপনঃ
    " হতাশ নবযুবকদের জন্যে আশার বার্তা"।
    এই 'আশা' যদি কোন মেয়ের নাম হত তাহলেও ছেলের দল এতটা উৎসাহিত হত না। কিন্তু ওরা জানে যে এই আশার বার্তা আসছে একটি 'গুলি' থেকে , যেটা দেখতে ছাগলের নাদির মত, কিন্তু পেটে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে শিরায় শিরায় নাচে রক্তধারা।
  • ranjan roy | 24.99.178.216 | ১৮ নভেম্বর ২০১২ ০১:৩৪574646
  • একদিন বৈদ্যজী রঙ্গনাথকে চেপে ধরে ব্রহ্মচর্য্যের গুণ বোঝাতে শুরু করলেন। উনি এক উদ্ভট বায়োলজি আওড়ালেন যার হিসেবে কয়েক মণ খাবার খেলে কয়েক ছটাক রস তৈরি হয়। তারপর রস থেকে রক্ত, রক্ত থেকে আরো কিছু, এই ভাবে চলতে চলতে শেষে গিয়ে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি হয়। উনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে এক ফোঁটা বীর্য বানাতে যা খরচ হয় সেটা একটা অ্যাটম বোমা বানানোর খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। রঙ্গনাথের বোধোদয় হল যে এ পোড়ার দেশে অমূল্য কিছু রয়েছে তো তা হল বীর্য। উনি বললেন যে বীর্যের অনেক শত্রু, সবাই চায় অন্যের বীর্য লুঠ করতে। কোন রকমে যদি তোমার বীর্য করতে পারো, তো ধরে নাও যে তোমার চরিত্র বেঁচে গেল।
    ওনর কথা থেকে বোঝা গেল যে আগে হিন্দুস্থানে বীর্যরক্ষার ওপর খুব জোর দেয়া হত। একদিকে ঘি-দুধের নদী বয়ে যেত, তো অন্যদিকে বীর্যের। লেকচারের শেষে উনি একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনালেন যার অর্থ হল -- এক ফোঁটা বীর্যের পতন হলে মানুষ মরে যায়, কিন্তু এক ফোঁটা তুলে নিতে পারলে জীবন ফিরে পায়।
    সংস্কৃত কানে যেতেই শনিচর হাতজোড় করে বলে উঠলো---" জয় ভগবান কী!"
    ও মাথা নুইয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা ও আবেগের বশে নিজের পশ্চাৎদেশকে প্রায় ছাতের দিকে উঁচু করে তুলল। বৈদ্যজী আরো বার খেয়ে রঙ্গনাথকে বললেন," ব্রহ্মচর্য্যের কথা নিজের মুখে কি বলব! কিছুদিন যাক, আয়নায় মুখ দেখলে নিজেই বুঝতে পারবে।"
    রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে ভেতরবাড়িতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। মামার এই স্বভাবের কথা ও আগে থেকেই জানত। দরজার পাশে রূপ্পনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঙ্গনাথকে ফিসফিসিয়ে বললেন," চেহারায় কান্তি আনার জন্যে আজকাল ব্রহ্মচর্য্য লাগে না। ক্রিম-পাউডার লাগালেই কাজ হয়ে যায়।"

    --------------------********-------------------------
  • ranjan roy | 24.99.178.216 | ১৮ নভেম্বর ২০১২ ০২:০৭574647
  • অধ্যায়-৫
    ------------
    মনে হয় পুনর্জন্মের ধারণা দেওয়ানি আদালতেই জন্মেছিল। অর্থাৎ, বাদী-প্রতিবাদী দু'পক্ষই যাতে মরার সময় আফশোস না করে যে মামলার ফয়সালা হওয়ার আগেই ইহলোক ছেড়ে যেতে হচ্ছে। জানে, মোকদ্দামার রায় শোনার জন্যে এখনো আগামী জন্ম, হাতে আছে।

    বৈদ্যজীর বৈঠকখানার বাইরের বাঁধানো চবুতরায় এখন যে লোকটি বসে আছে , ও প্রায় সাতবছর আগে একটা দেওয়ানি মামলা শুরু করেছিল। স্বাভাবিক, যে ওর মত লোক এখন কথায় কথায় পূর্বজন্মের পাপ, ভাগ্য, ভগবান, আগামী জন্মের নির্ধারিত কাজকম্ম এইসবের কথা তুলবে।
    ওকে লোকে ডাকে ল্যাংড়া বলে ।
    ওর মাথায় কবীরাপন্থী তিলক, গলায় তুলসীমালার কন্ঠি, অনেক ঝড়-ঝাপটা সয়ে আসা দেড়েল চেহারা। রোগাভোগা শরীর, পরনে মেরজাই। একটা পা' হাঁটুর নীচ থেকে কাটা, তাই একটা লাঠির সাহায্যে সেই অভাব পূর্ণ করা হয়েছে। ওর চেহারায় পুরনো দিনের ক্রিশ্চান সেইন্টদের মত ভাবভংগি, ওই যারা রোজ নিজের হাতে নিজের পিঠে চাবুক মারতেন।
    শনিচর ওর দিকে একটা ভাঙের গেলাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল," নাও ভাই ল্যাংড়া, খেয়ে ফেল। এতে বড় বড় মাল রয়েছে।"
    ল্যাংড়া চোখ বুঁজে মানা করল। তারপর দুজনের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ তর্কবিতর্ক হল যার বিষয় ছিল ভাঙের মর্য্যাদা, বাদাম-মনাক্কা খাওয়ার লাভ, ক্ষণ-ভঙ্গুর নশ্বর জীবন এবং ভোগ ও ত্যাগ গোছের দার্শনিক বিষয়। শেষে শনিচর ওর গেলাস না-ধরা অন্য হাতটি আন্ডারওয়ারে মুছে নিয়ে সব তর্ক-টর্কের থেকে ছাড়া পেল আর সামাজিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে উদাসীন ভাব দেখিয়ে বিড়বিড় করে বলল,"খেতে হয় তো চোঁ-চোঁ করে একবারে গেলাস খালি কর, না খেলে আমার কাঁচকলা !"
  • ranjan roy | 69.161.183.107 | ১৯ নভেম্বর ২০১২ ০৬:৩৫574648
  • ল্যাংড়া জোরে নিঃশ্বাস টেনে চোখ বুজে ফেললো,--- এটা আসলে আত্মকরুণায় কষ্ট পাওয়া থেকে ঠেসে খেয়ে কষ্ট পাওয়া গোছের সবরকম ভাব প্রকাশের জনপ্রিয় ভঙ্গি। শনিচর ওকে ছেড়ে একলাফে বৈঠকখানার ভেতরে চলে গেল। ওর বাঁদরের মত লাফ দেখলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
    বেলা দশট। বৈঠকখানার ভেতরে বৈদ্যজী, রঙ্গনাথ, প্রিন্সিপাল সাহেব, কলেজের ক্লার্ক, সবাই উপস্থিত।
    শনিচর এবার ভাঙের গেলাসটা প্রিন্সিপালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল," খেয়ে নিন মাস্টার সাহেব, এতে বড় বড় মাল রয়েছে।"
    প্রিন্সিপাল বৈদ্যজীকে বল্লেন," কলেজের কাজ ছেড়ে এসেছি, এটা সন্ধ্যের সময় হলেই ভাল।"
    বৈদ্যজী মিষ্টি করে বল্লেন," সন্ধ্যাকালে আবার খাবেন না হয়।"
    " কলেজ ছেড়ে এসেছি যে!"
    রূপ্পনবাবু কলেজ যাবেন বলে ঘর থেকে সেজেগুজে বেরোচ্ছেন। অন্যদিনের মতই ধুতির খুঁটটি কাঁধের ওপর। গায়ে বুশশার্ট, যেটা ময়লা হলেও ওনার ফিলজফিতে দামী বলে গায়ে চড়ানো যায়। হাতে বাঁধা ঘড়িটি দেখলে বোঝা যায় যে জুয়ো খেলতে ঘড়িও বাঁধা রাখা যায়, আর যার কাছে বাঁধা রাখা হয় , সে দামী ঘড়িও দশ টাকায় পেতে পারে।
    রূপ্পনবাবু বাইরে যেতে যেতে প্রিন্সিপালের ডায়লগ শুনে ফেলেছিলেন। উনি ওখান থেকেই বলে উঠলেন--" কলেজ তো আপনি কবেই ছেড়ে দিয়েছেন, শুধু কলেজই আপনাকে এখনো ছাড়েনি।"
  • ranjan roy | 69.161.183.107 | ১৯ নভেম্বর ২০১২ ০৭:১৩574649
  • প্রিন্সিপাল অপ্রস্তুত হয়ে দাঁত বের করলেন," রূপ্পনবাবু খাঁটি কথা বলেন।"
    অমনি শনিচর লাফিয়ে উঠে প্রিন্সিপালের হাতে ভাঙের গেলাস ধরিয়ে দিল।" নিন, এই কথার সম্ম্মানে মেরে দিন এক গেলাস!"
    বৈদ্যজী তৃপ্তিভরে প্রিন্সিপালের ভাঙ খাওয়া দেখছিলেন। গেলাস শেষ করে প্রিন্সিপাল বল্লেন," কোন সন্দেহ নেই এর মধ্যে বড় বড় সব মাল পড়েছে।"
    বৈদ্যজী বল্লেন, " ভাঙ তো এতে নামমাত্র, আছেও, আবার নেইও। আসল দ্রব্য হল বাদাম, মোনাক্কা আর পেস্তা। বাদাম বুদ্ধি ও বীর্য বৃদ্ধি করে। মুনাক্কা পাচক, হজম করায়। এতে এলাচও দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব শীতল। তাই বীর্য ফাটে না, গাঢ় ও স্থির হয়ে যায়। আমি তো এই পানীয়র একটা ছোট্ট প্রয়োগ ভাগ্নে রঙ্গনাথের ওপর করছি।"
    প্রিন্সিপাল ঘাড় উঁচু করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওনার বক্তিমে বন্ধ হয় নি।" কিছুদিন ধরে ওর বারবার জ্বর হচ্ছিল। শক্তি ক্ষীণ । তাই এখানে এসে থাকতে বলেছি। এর জন্যে এক নিত্য দিনচর্চা ঠিক করে দিয়েছি।পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বাদাম, ভাঙের দুটো পাতা। দেখতে চাই ছ'মাস বাদে ফিরে যাওয়ার সময় কি চেহারা নিয়ে যায়।"
    কলেজের ক্লার্ক বলে উঠল,"। দেখে নিও চাচা! ছুঁচো হয়ে এসেছিল, গন্ডার হয়ে যাবে।"
    ক্লার্কের মুখে বৈদ্যজীর জনে 'চাচা' ডাক শুনলে প্রিন্সিপাল বড় কষ্ট পান। আহা! উনি যদি বৈদ্যজীকে 'বাপ' ডাকতে পারতেন। তাই গোমড়ামুখে ফাইল ওল্টাতে লাগলেন।
  • brcslg | 37.125.203.75 | ২১ নভেম্বর ২০১২ ১৪:১৩574650
  • উপরে তুলে দিলাম।
  • ranjan roy | 24.99.7.205 | ২৮ নভেম্বর ২০১২ ০০:২৩574651
  • ইতিমধ্যে 'ল্যাংড়া' দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। শূদ্রের জন্যে শাস্ত্রসম্মত আচরণবিধি মেনে ও বৈদ্যজীকে দরজার চৌকাঠের সামনে মুর্গী হয়ে প্রণাম করল। এর থেকে প্রমাণ হল যে আমাদের দ্যাশে আজও শাস্ত্রের কথা সর্বমান্য আর জাতিভেদ দূর করার সমস্ত আন্দোলন হয় ছল-কপটতায় ভরা, নয় রোম্যান্টিকতায়।
    ল্যাংড়া প্রায় ভিক্ষে চাওয়ার মত করে বলল," তো চললাম বাপুজী!"
    বৈদ্যজী বল্লেন, " যাও ভাই, তুমি ধর্মযুদ্ধ করছ, করতে থাক। এতে আমি আর কি সাহায্য করব!"
    ল্যাংড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলল," ঠিক বলেছ বাপু! এ লড়াইয়ে তুমি আর কি করবে? যদি কোন সুপারিশের বা ধরা-করার দরকার হত তো নিশ্চয় তোমার চৌকাঠে মাথা কুটতাম।"
    এবার ও প্রায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে এক ঠ্যাং লাঠির সাহায্যে লটকাতে লটকাতে চলে গেল। বৈদ্যজী জোরে হেসে উঠলেন। বল্লেন," বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে ছেলেমানুষের মত।"
    ওনাকে কদাচিৎ কেউ হাসতে দেখেছে। রঙ্গনাথ চমকে উঠে দেখল যে হাসতে গেলেই বৈদ্যজীর মুখের ভাব কোমল নরম-সরম হয়ে যাচ্ছে, ঘাগু রাজনীতির খেলোয়াড়ের জায়গায় ফুটে উঠছে কেমন ভালোমানুষি চেহারা। আর তাতে ওনাকে দেখাচ্ছে একেবারে পাকা লম্পটের মত।
    রঙ্গনাথ জিগ্যেস করল, " ও কিসের লড়াই লড়ছে?"
    প্রিন্সিপাল সাহেবের সামনে ছড়ানো রয়েছে একগাদা ফাইল, চেকবুক,---- যার অজুহাতে উনি কখনো সখনো এদিকে এসে দু-এক গেলাস সিদ্ধির সরবত খেয়ে যান। উনি কাগজপত্তর গোছাতে শুরু করেছিলেন। এবার হাত গুটিয়ে বলতে শুরু করলেন," তহসীলদারের আপিস থেকে এ ব্যাটার কোন দলিলের নকল নেয়ার দরকার ছিল। ও দিব্যি গেলেছে যে একপয়সা ঘুষ না দিয়ে নিয়ম-কানুন মেনেই ও নকল আদায় করে ছাড়বে। এদিকে নকলনবীশ কেরাণীও কিরে কেটেছে যে ও ঘুষ নেবেনা, ল্যাংড়াকে সব নিয়ম কানুন মেনেই নকল নিতে হবে। ব্যস্‌ , এরই ঝগড়া অথবা ধর্মযুদ্ধ চলছে।"
    রঙ্গনাথ ইতিহাসে এম এ পাশ করেছে আর সেজন্যে ওকে না জানি কতশত যুদ্ধের কারণ নিয়ে পড়া মুখস্থ করতে হয়েছে। আলেকজান্ডার ভারতে রাজ্যদখল করতে যুদ্ধ করেছিল আর পুরু যুদ্ধ করেছিল সেই প্রচেষ্টা বিফল করতে। আলাউদ্দিন বললো-- আমার পদ্মিনী চাই।
    রাণা বললো-- পদ্মিনীকে দেব না। তাই যুদ্ধ হল। সমস্ত লড়াইয়ের মূলে এই,-- একপক্ষ বলে নেব, আরেকপক্ষ বলে দেব না। তাই এত যুদ্ধ হয়।
    কিন্তু এখানে তো ল্যাংড়া বলে-- নিয়ম মেনে নকল নেব, আর ক্লার্ক বলে-- নিয়ম মেনেই নকল দেব। তবে কিসের ঝগড়া?
    রঙ্গনাথ এবার প্রিন্সিপালকে এই ঐতিহাসিক প্যারাডক্সের রহস্যভেদ করতে বলল।
    উত্তরে উনি একটি অবধী লোকোক্তি শোনালেন যার শব্দগত অর্থ হলঃ হাতি-ঘোড়া এল-গেল,
    উট বেচারা ডুবে ম'ল।।
    এই প্রবাদটি হয়ত কোন জ্যান্ত মিউজিয়ামের সম্বন্ধে রচিত হয়েছিল।, রঙ্গনাথ বুঝে গেল ইংগিতটি কোন সরকারি দপ্তরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও গভীরতা নিয়ে। কিন্তু ও কিছুতেই ল্যাংড়াব্যাটা আর নকলবাবুর ধর্মযুদ্ধের ডিজাইনটা বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই ও ওর প্রশ্নটি আরও সোজাসাপটা গোদা বাংলায় প্রিন্সিপালের সামনে তুললো।
    উত্তরটা দিল ওনার ক্লার্ক, " এসব হল গঞ্জহাদের পাঁয়তাড়া, বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
    ল্যাংড়া থাকে পাঁচকোশ দূরের এক গাঁয়ে। বৌ মরেছে, এর যত রাগ ছেলেদের ওপর। তাদের ও নিজের জন্যে মৃত ধরে নিয়েছে। ভগত মানুষ, কবীর ও দাদু'র ভজন গেয়ে বেড়ায়। গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে হালে ও একটি দেওয়ানি মামলা শুরু করেছে,
  • ranjan roy | 24.96.61.187 | ৩০ নভেম্বর ২০১২ ০২:৪৭574652
  • " মামলাটার জন্যে আদালতের একটি পুরনো রায়ের নকল চাই, তাই ল্যাংড়া প্রথমে মহকুমা আদালতে দরখাস্ত করেছিল। দরখাস্তে কিছু ভুল ছিল, তাই খারিজ হয়ে গেল। তখন ও আরেকটা দরখাস্ত জমা করে কিছুদিন পরে মহকুমা অফিসে নকল নিতে গেল। নকলনবীশ অতি চালু, সে ব্যাটা পাঁচটাকা চেয়ে বসল। ল্যাংড়া বলল--- রেট তো দু'টাকা!
    ব্যস্‌ এই তুলকালাম ঝগড়া!
    ওখানে দু-চারটে উকিল দাঁড়িয়ে শুনছিল। ওরা প্রথমে ল্যাংড়ার পক্ষ নিয়ে বলল,--- ভাই, দু'টাকায় মেনে নাও, বেচারা ল্যাংড়া যে! নকল পেয়ে তোমার গুণ গাইবে।
    কিন্তু সে ব্যাটার কোন হেলদোল নেই। একেবারে সাততাড়াতাড়ি জোয়ান-মরদ হয়ে গেল। বলল-- মরদের এক কথা,--- যা বলেছি তাই নেব।
    " তখন উকিলের দল ল্যাংড়াকে বোঝাতে শুরু করল। বলল যে নকলনবীশও গেরস্ত মানুষ। ওর ঘরে বিয়ের যুগ্যি মেয়ে বসে আছে, তাই রেট বাড়িয়ে দিয়েছে। তুমিই মেনে নাও আর ওকে পাঁচটাকা দিয়ে রফাদফা কর। কিন্তু ল্যাংড়াও জিদ ধরে বসেছে। বলল-- হ্যাঁ, আজকাল তো এই সবই হচ্ছে। মাইনের টাকা মদ-মাংসে খরচা করে এখন মেয়ের বিয়ের জন্যে ঘুষ চাই!
    " শোনামাত্র নকলনবীশ গেল ক্ষেপে।রাগে গরগর করতে করতে বলল--ঠিক আছে, আমি এই কাজটায় আর ঘুষ নেব না। যা করব নিয়মমাফিক করব। উকিলরা খুব বোঝাল,-- ভাই এমন করে না। ল্যাংড়া ভক্ত মানুষ, ওর কথায় দোষ ধরতে নেই।
    কিন্তু ওর রাগ চড়লে আর নামার নাম-গন্ধ নেই।
    " রঙ্গনাথবাবু, সত্যি বলতে কি ল্যাংড়া খুব-একটা ভুল বলেনি। এই দেশে মেয়ের বিয়ে দেয়াও আজকাল চুরির অজুহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক ব্যাটা ঘুষ খায়, তো আরেকজন বলে--কি করবে বেচারা? বংশমর্য্যাদা আছে, ঘরে বিয়ের যুগ্যি মেয়ে!
    সমস্ত বদমায়েশির অজুহাত হল মেয়ের বিয়ে!
    " সে যাই হোক, ল্যাংড়া আর নকলনবীশের মধ্যে খুব ঝামেলা হল। আজকাল ঘুষটুষের ব্যাপারে বড্ড হুজ্জতবাজি হয়। আগে একেবারে সোজাসাপটা কাজ হত। পুরোনো লোকজনের কথার দাম ছিল। একটি টাকা ধরিয়ে দাও, পরের দিন নকল তৈরি। আজকাল স্কুলটুল থেকে নতুন নতুন ছেলেপুলে আদালতে আসছে আর লেন-দেনের রেট নষ্ট করে দিচ্ছে। এদের দেখাদেখি পুরোনো লোকজনও যা-খুশি করতে শুরু করেছে। তাই ঘুষ দেয়া আর ঘুষ নেয়া-- দুটোই আজকাল বড্ড ঝকমারি।
  • ranjan roy | 24.96.107.12 | ০১ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:৪৬574653
  • " ল্যাংড়াও রেগে গেল। নিজের কন্ঠি ছুঁয়ে বলল--- যাও বাবু, তুমি নিয়ম মেনে কাজ করবে, আমিও তাই। এবার তুমি একটা কানাকড়িও পাবে না। আমি দরখাস্ত দিয়েছি,লাইনে আছি,--- কোন-না-কোন দিন তো নম্বর আসবে।
    তারপর ল্যাংড়া গিয়ে তহসীলদারের কাছে পুরো বিত্তান্ত খুলে বলল। তহসীলদার খুব হাসল, বলল--সাবাস্‌ ল্যাংড়া! ঠিক করেছ। তোমায় এইসব দেয়া-নেয়ার চক্করে পড়তে হবে না। নম্বর আসলে নকল ঠিক পেয়ে যাবে।
    এবার সাহেব গিয়ে পেশকারকে বলল,-- দেখ, এই ল্যাংড়া বেচারা চারমাস ধরে হয়রান হচ্ছে। এখন তোমরা কেউ আর ওর পেছনে লেগো না। নিয়মমত ওকে ওর নকল দিয়ে দাও।
    তখন পেশকার বলল,--- সরকার! ওই ল্যাংড়া ব্যাটা ছিটেল। আপনি ওর ক্যাচালে নাই পড়লেন!
    এবার ল্যাংড়া পেশকারের ওপর খচে গেল। দুজনে মিলে ঝাঁয়-ঝাঁয় হতে লাগল। তহসীলদার কোনমতে দুজনকে চুপ করালো।
    " ল্যাংড়া কিন্তু বুঝে গেছল যে নকলনবীশ ওর দরখাস্ত কোন-না-কোন অজুহাতে খারিজ করিয়ে দেবে। দরখাস্ত বেচারার তো পিঁপড়ের প্রাণ। এমন প্রাণ নিতে কোন যমদূতের দরকার নেই। যে কোন সময় খারিজ করা যায়। ফীসের টিকিট কম লাগানো হয়েছে, আবেদনকারীর ঠিকানা ভুল লেখা হয়েছে, একটা চৌখুপি ঘর খালি রয়েছে, ভরা হয় নি--- এইসব কিছু-না-কিছু আপত্তি আগে লিখে নোটিস বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হয়। আর ওতে দেয়া নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ভুল শোধরানো না হলে দরখাস্ত খারিজ করে দেয়া হয়।
    "তাই ল্যাংড়াও এবার কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। ও নিজের পৈতৃক গাঁয়ে ফিরে গিয়ে প্রথমে ঘরের দরজায় তালা ঝোলাল। তারপর জমাজমি-ফসল-গরু-বলদ সব ভগবানের ভরসায় ছেড়ে এল।এখানে এক আত্মীয়ের ঘরে আস্তানা গেড়ে বসল আর রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে তহসীলদারের নোটিস-বোর্ডের কাছে ঘুরঘুর করতে লাগল। ওর ভয়, কোনদিন নোটিস-বোর্ডে ওর দরখাস্ত নিয়ে কোন ওজর-আপত্তি টাঙানো থাকবে আর ও দেখতে ভুলে গেলে শোধরানোর সময় চলে গিয়ে দরখাস্ত খারিজ হয়ে যাবে, একবার এমনি হয়েও গেছে
    " ইতিমধ্যে ও নকল নেবার যত নিয়ম-কানুন সব মুখস্থ করে ফেলেছে। লোকে কপালের গেরোয় থানাপুলিশ-কোর্ট-কাচারি করে। ল্যাংড়ারও কপাল ফেটেছে। তবে এবার যেমন আঁটঘাট বেঁধে লেগেছে মনে হচ্ছে ব্যাটা এবার নকল নিয়েই ছাড়বে।"
  • ranjan roy | 24.99.72.133 | ০৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:০২574654
  • রঙ্গনাথ ওর জীবনে খুব বেশি বোকামি করে নি। কাজেই ওকে 'বোকামির' ব্যাপারে অভিজ্ঞ বলাটা একটু চাপ হয়ে যাবে। ল্যাংড়ার ইতিহাস শুনে ও বেশ সেন্টু হয়ে গেল। আর সেন্টু হতেই ওকে "কিছু একটা করতে হবে" এমন একটা চিন্তা পেয়ে বসল। কিন্তু সেই 'কিছু একটা' যে কী সেটা নিয়ে ওর কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
    যাই হোক, ভেতরে ভেতরে যখন মামলা সহ্যের বাইরে হয়ে গেল তখন ও বিড়বিড় করতে লাগল--" এ সব অন্যায়--- যা তা---- কিছু একটা করতেই হবে।"
    ক্লার্ক শিকারী কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা তুলে নিল। বলল," কি করবে রঙ্গনাথবাবু? কে কী করবে? কী করতে পারে? যার পেছনে আছোলা যায়, তারই জ্বালা চরচরায়! লোক যদি নিজের দুঃখ-কষ্টের ভার সামলাতে পারে, তাহলেই অনেক। অন্যের বোঝা কে বইবে? আজকাল যা দাঁড়িয়েছে তাতে তুমি তোমার দাদ ওদিক দিয়ে চুলকোতে থাক, আমি আমারটা এদিক দিয়ে।"
    ক্লার্ক যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রিন্সিপাল চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন--" বদ্রীভাইয়াকে দেখছি না যে!"
    বৈদ্যজী বল্লেন," একজন আত্মীয় ডাকাতির মামলায় কেস খেয়েছে। পুলিসের লীলা অপরম্পার, জানই তো! বদ্রী ওখানেই গেছে, আজ ফিরবে মনে হয়।"
    শনিচর চৌকাঠের পাশে বসেছিল। ও মুখ দিয়ে সিটি বাজানোর মত আওয়াজ বের করে বলল," যতক্ষণ না ফেরে ততক্ষণই ভাল।"
    ভাঙের নেশায় প্রিন্সিপাল সাহেব 'আরাম হারাম হ্যায়" নামক ঋষিবাক্যটি ভুলে গিয়েছেন। উনি একটি বড় তাকিয়া টেনে নিয়ে জাঁকিয়ে বসে বল্লেন,"ব্যাপারটা কী?"
  • ranjan roy | 24.96.151.158 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ ১৩:৫৮574655
  • শনিচর বা শনিগ্রহ একটু চাপাস্বরে বলল,' কোঅপারেটিভ ইউনিয়নে তবিল তছরূপ হয়েছে। বদ্রীভাইয়া টের পেলে সুপারভাইজারকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে।"
    প্রিন্সিপাল ঘাবড়ে গেলেন। উনিও অমনি ফিসফিসিয়ে বললেন,' এই ব্যাপার?'
    শনিচরও মাথা নীচু করে কিছু বলতে লাগল। এটা কথাবার্তার সেই অখিল ভারতীয় স্টাইল যা পার্সি থিয়েটার অমর করে দিয়েছে। এই স্টাইলে একজন পাশের লোকটাকে কিছু বলে, কিন্তু পাশে দাঁড়ানো তৃতীয় ব্যক্তিটি কিছুই শুনতে পায় না। অথচ একশ'গজ দূরের দর্শকেরা সবই শুনতে পারে, বুঝতে পারে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছাড়া গোটা হলের সমস্ত দর্শক এটাও বুঝে ফেলে যে এবার কি ঘটবে।
    সংক্ষেপে, কথা গোপন রাখার আমাদের ট্র্যাডিশনাল স্টাইলেই শনিচর প্রিন্সিপাল সাহেবকে কিছু কিছু বলতে থাকে।
    কিন্তু বৈদ্যজী কড়া সুরে বললেন,' কি মেয়েদের মত ফুসুর-ফুসুর করছ? কো-অপারেটিভে তবিল তছরূপ হয়েছে তো কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? কোন ইউনিয়নে এসব হয় না?'
    এবার একটু থেমে খানিকটা যেন ছাত্রকে পড়াচ্ছেন ভাবে বললেন,' দেখ, অ্যাদ্দিন আমাদের ইউনিয়নে কোন তছরূপ হয় নি, তাই সবাই আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। এবার তো বুক ফুলিয়ে বলতে পারি যে আমরা সাচ্চা আদমী। গবন হয়েছে তো লুকোই নি। যা হয়েছে, জানিয়ে দিয়েছি।'
    উনি একটু শ্বাস টেনে কথা শেষ করলেন,' চল, একটা কাঁটা তো বেরল, চিন্তা মিটল।'
    প্রিন্সিপাল এতক্ষণ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে স্ট্যাচু হয়ে বসেছিলেন। এবার এমন একটা কথা বললেন যা সবাই জানে,' আজকাল মানুষ বড্ড নেমকহারাম হয়ে গেছে।'
  • ranjan roy | 69.161.184.110 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:৪৪574657
  • এই কথাটা ওষুধের মত কাজ দেয়। তাই যত ভালমানুষের দল মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটের মত এটাকে দিনে তিনবার খাওয়ার পরে নিয়ে থাকে। কিন্তু ক্লার্কের মনে হল যে কথাটায় যেন একটু ব্যক্তিগত খোঁচা আছে? তাই ও পাল্টা জবাব দিল,' মানুষে মানুষে তফাৎ আছে, কই? আমাদের কলেজে তো আজ অবধি এ'রম কিছু শোনা যায় নি!'
    বৈদ্যজী ওর দিকে 'ঘরের লোক' গোছের চাউনি দিয়ে মুচকি হাসলেন। কো-অপারেটিভওলা তছরূপ বীজ-গুদামের থেকে গম ঝেড়ে দিয়ে হয়েছিল।সেদিকে ইশারা করে উনি বললেন,' কলেজে তছরূপ কী করে হবে? ওখানে তো গমের গুদাম নেই।'
    এটা পরিহাস। প্রিন্সিপাল সাহেব হাসলেন। একবার হাসি শুরু হতেই সিদ্ধির শরবত বাকিটা চালিয়ে গেল। উনি হেসেই চললেন। কিন্তু ক্লার্কের মনের মেঘ কাটে না। বলল,' কিন্তু চাচা, কলেজে তো গোবরের গুদাম কম নেই। সব কটার মাথায় গোবর পোরা।'
    এবার হাসির হররা ছড়িয়ে পড়ল। রঙ্গনাথ এবং শনিচরও হেসে উঠলেন। হাসির ঢেউ চৌকাঠ পেরিয়ে আঙ্গিনায় পৌঁছে গেল। ওখানে মিনি-মাগনায় বসে থাকা দু-একজনও না বুঝে হেসে উঠল।
    ক্লার্ক এবার চোখে চোখে প্রিন্সিপাল সাহেবকে গা' তুলতে বলল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন