এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • রাগ দরবারীঃ শ্রীলাল শুক্লা

    ranjan roy
    বইপত্তর | ২৪ অক্টোবর ২০১২ | ৭১৬৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 24.96.117.198 | ২০ ডিসেম্বর ২০১২ ০০:১৬574658
  • এটা আমাদের মহান ট্র্যাডিশন যে আসল কথাটা দু-চার ঘন্টা গালগল্প করে একেবারে শেষ সময়ে শুরু হয়। তাই বৈদ্যজী এবার প্রিন্সিপাল সাহেবকে জিগাইলেন,' আর কোন কিছু? বিশেষ কিছু কথা?'
    ' এমন কিছু না, ওই খান্নাওলা মামলাটা। পরশুদিন ক্লাসে কালো চশমা পরে পড়াচ্ছিল, আমি একেবারে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছি।ছেলেদের ওসকাতে থাকে। আমিও বললাম, নে ব্যাটা! তোকে এখানেই রগড়ে দিচ্ছি।' প্রিন্সিপাল সাহেব নিজেকে সংযত করে রেখেছিলেন। কিন্তু বলতে বলতে শেষে ওনার মুখ থেকে 'ফিক্‌- -ফিক্‌' মার্কা কিছু আওয়াজ বেরল।
    বৈদ্যজী গম্ভীর হয়ে বললেন,' এমন করতে নেই। বিরোধীপক্ষের সঙ্গেও সম্মান দেখাতে হবে। দেখ নি, প্রত্যেক বড় নেতার এক-এক জন বিরোধী থাকে। সবাই নিজের ইচ্ছায় একজন করে বিরোধী খুঁজে নেয়। এটাই গণতন্ত্রের নীতি।আমাদের নেতারা কেমন শালীনতার সঙ্গে বিরোধীদের সহ্য করে যান! বিরোধীরা নিজের নিজের বক্তব্য রাখতে থাকেন। আর নেতার চুপচাপ নিজেদের ্চাল চালতে থাকেন। কেউ কাউকে প্রভাবিত করে না। আমাদেরও অমনি করা উচিত।'
    কিন্তু রাজনীতিশাস্ত্রের এই মৌলিক সিদ্ধান্ত শুনে ক্লার্কের কোন হেলদোল হল না। ও বলল,'এসবে কিচ্ছু হবে না, চাচা! খান্না মাস্টারকে আমি ভাল করে চিনি। ইতিহাসে এম এ, কিন্তু নিজের বাপের নামও জানে না।জানে শুধু দলবাজি করতে। ছেলে-ছোকরাদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে জুয়ো খেলায়।ওকে ঠিক করার একটাই রাস্তা,- একবার ধরে ভাল করে দনাদন্‌ -দনাদন্‌ লাগাতে হবে।'
    এই কথায় বৈদ্যজী আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন, কিন্তু লোকজন বেশ উৎসাহিত হল। কথার মোড় ঘুরে গেল জুতোপেটা করার পদ্ধতি ও নিয়মকানুন নিয়ে। শনিচর উৎফুল্ল হয়ে বলল,' যখন খান্নামাস্টারকে দনাদন - দনাদন জুতোপেটা করা হবে তখন আমাকে খবর দিতে ভুলিসনে যেন! অনেক দিন হল কাউকে জুতোই নি। আমিও দু-চার ঘা লাগিয়ে দেব'।
    একজন বলল যে জুতো যদি ফাটাওলা হয় আর তিনদিন ধরে জলে ভেজানো থাকে তো মারার সময় চমৎকার আওয়াজ বের হয়, তাতে দূর দূর পর্য্যন্ত খবর ছড়িয়ে যায় যে এখানে জুতোপেটা চলছে। দ্বিতীয়জন বলল যে শিক্ষিত লোককে জুতোপেটা করতে গোরক্ষক-জুতো দিয়ে মারা উচিৎ। কারণ, এতে মার খাবে কিন্তু অপমান কম হবে। আঙিনায় জমিয়ে বসে থাকা তৃতীয় ব্যক্তির মতে জুতো মারার সঠিক কায়দা হল গুণে গুণে একশ' ঘা জুতো মারা চাই। কিন্তু নিরানব্বই পর্য্যন্ত পৌঁছনোর আগেই আগের গোণাটা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে নতুন করে এক থেকে গুণতে শুরু করে জুতোমারা চালিয়ে যেতে হবে।
    চতুর্থ ব্যক্তি এই প্রস্তাব সমর্থন করে বলল,' সত্যি, জুতোপেটার এটাই ঠিক পদ্ধতি। আমি তাই একশ' অব্দি গোণা শিখছি।

    ---------------------************------------------------------------
  • ranjan roy | 24.99.130.2 | ২১ ডিসেম্বর ২০১২ ০৯:৩৬574659
  • অধ্যায়-৬
    ----------
    শহর থেকে গাঁয়ে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে একটি সাইকেল রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। রিকশা চালাচ্ছে পরনে রঙীন গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট রোগাপ্যাংলা লম্বাচুলো এক নব্য যুবক । ওর ঘামে ভেজা চেহারা দেখলে 'বেদনার ফোটোগ্রাফ' এর বদলে 'যন্ত্রণার কার্টুন' মনে হয়।
    রিকশায় সওয়ার বদ্রীপালোয়ান, জঙ্ঘার ওপরে মুঠিপাকানো দুই আর পায়ের কাছে একটি সিন্দুক। দুই পা সিন্দুকের দুপাশে চেপে রাখা যাতে পা ভেঙে গেলেও সিন্দুক পড়ে না যায়।
    সন্ধ্যারাগ, অর্থহীন মনোরম সময়। পালোয়ানের গাঁ এখনো তিন মাইল দূরে। ও বাঘের
    মত মুখ ব্যাদান করে হাই তুলল আর সেই মেজাজে বলল,' এ'বছর ফসলের অবস্থা ভাল নয়।'
    রিকশাওলা কৃষিবিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে সেমিনার করার মুডে ছিল না। ও চুপচাপ রিকশা চালাতে লাগল। পালোয়ান এবার ওকে সোজাসুজি জিগ্যেস করল--' কোন জেলার হে? তোমাদের দিকে ফসলের কী খবর?'
    রিকশাওলা ফিরে তাকালো না। চোখের ওপর এসে পরা চুলের গোছাকে ঘাড়ের এক ঝটকায় মাথার ওপরে এনে বলল,' ফসল? আমি গেঁয়ো নই ঠাকুরসাহেব, খাস শহুরে লোক।'
    তারপর ও পাছা নাড়িয়ে নাড়িয়ে রিকশা চালাতে লাগল। সামনে চলতে থাকা অন্য রিকশাকে দেখে জোরে জোরে ঘন্টি বাজাল।
    পালোয়ান দ্বিতীয়বার হাই তুলে চারপাশের ফসলের শোভা দেখতে লাগল। সওয়ারির উপেক্ষায় কাতর রিকশাওলা একটু রং জমানোর চেষ্টায় সামনের রিকশাচালককে খিঁচিয়ে উঠল,' আবে ও বাঁগড়ু! চল্‌ বাঁয়ী তরফ!'
    সামনের রিকশা বাঁয়ে সরে যেতেই পালোয়ানের রিকশা ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে পাশে সরে যাওয়া রিকশাওলাকে বলল,' কোন জেলার? গোন্ডা না বহরাইচ?'
    এ রিকশাওলা তার সওয়ারি, তার বোঁচকা-বুঁচকি আর বোঁচকামার্কা গিন্নিকে টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে একটু ধীরে ধীরে যাচ্ছিল।এমন ভাই-ভাই ভাব দেখে খুশি হয়ে বলল,' আমার গোন্ডায় বাড়ি, ভাইয়া!'
    শহুরে রিকশাওলা সিনেমামার্কা সিটি বাজিয়ে বলল," তাই বলি!'।
    পালোয়ানের এতেও কোন হেলদোল নেই। বলল,' একটু ইস্পীড বাড়াও মাস্টার!'
  • ranjan roy | 24.99.130.2 | ২১ ডিসেম্বর ২০১২ ১০:২২574660
  • রিকশাওলা দাঁড়িয়ে প্যাডল মারতে মারতে গতি বাড়াল আর সঙ্গে সঙ্গে কমেন্ট্রি চালিয়ে গেল।
    ' এই গোন্ডা-বহরাইচের আর আনাচে-কানাচের থেকে আসা রিকশাওলাগুলো এখানকার চালচলন নষ্ট করে দিচ্ছে। কোনো ডান-বাঁয়ের জ্ঞান নেই, এদের চেয়ে কয়লার বস্তা টানা গরুর গাড়ির বলদগুলোর বুদ্ধি বেশি। এরা মেথর-মুচিকেও রিকশায় বসিয়ে আপনি-আজ্ঞে করে।এরা ইংরেজি বাজারেও বিরহাগীত গাইতে গাইতে যায়। কেউ যদি বলে যে মাল এভেনিউয়ের ফ্র্যাম্পটন স্কোয়ার চলো তো দাঁত ক্যালাবে। এদের বাপও এইসব জায়গার নাম----'।
    পালোয়ান মাথা নেড়ে বলল,' ঠিক বলেছ মাস্টার! ওদিকের লোকজন বড্ড হাভাতে। ছাতু খায় আর ছোলা চিবিয়ে রিকশা চালায়। চার ব্ছরেই অসুখে পড়ে কাতরাতে থাকে।'
    রিকশাওলা নাক সিঁটকে বলল,' চমড়ী চলি যায় পর দমড়ী না যায়, ব্যাটারা বড় মক্ষীচুষ, একেবারে পিঁপড়ের- পোঁদ- টিপে- চিনি- খাওয়ার দল। গত বছর লু চলার সময় এক শালা রিকশা চালাতে চালাতে রাস্তার ওপরেই ট্যাঁ হয়ে গেল। গায়ে গেঞ্জি ছিল না, কিন্তু কোমরের কষি থেকে বাইশ টাকা বেরল।'
    পালোয়ান মাথা নাড়িয়ে বলল,' লু খুব খারাপ। যখন লু'য়ের গরম হাওয়া চলে তখন ঘর থেকে বেরোতে নেই। খেয়েদেয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে ভেতরে থাকতে হয়।'
    রিকশাওলা ঢিটের মত বলল,'আমি তো তাই করি।গরমের দিনে শুধু সিনিমার টাইমে গাড়ি বের করি। কিন্তু ওই শালা দেহাতি রিকশাওলাগুলো? ওদের কথা আর কি বলব ঠাকুরসাহেব? বললে পেত্যয় যাবেন না শালারা জান নিয়ে খেলা করে। চার আনা আট আনার জন্যে ভর দুকুরে মুখে ফেনা তুলে মাইল-মাইল রিকশা চালায়। এক্কাগাড়ির ঘোড়াও ওই সময় গাছের ছায়া ছেড়ে নড়ে না। কিন্তু ওই শালারা----'।
    ঘেন্নার চোটে রিকশাওলার মুখ থুতুতে ভরে গলা বুজে এল। ও এবার থুতু ফেলে রামায়ণ শেষ করল,'ব্যাটারা একটু গরম হাওয়া লাগতেই রাস্তায় ট্যাঁ হয়ে যায়।'
    পালোয়ানের এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোন আগ্রহ ছিল না। ও চুপ। তাই দেখে রিকশাওলা বলল,' একটু সিগারেট খেয়ে নিই?'
  • ranjan roy | 24.99.130.2 | ২১ ডিসেম্বর ২০১২ ১০:৪৭574661
  • পালোয়ান নামল, তারপর রিকশার এক দিকে শরীরের ভার দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। রিকশাওলা সিগ্রেট ধরায়। খানিকক্ষণ চুপচাপ সিগ্রেট খায় তারপর গোল গোল রিং ছাড়তে ছাড়তে বলতে শুরু করে,'ওদিকের দেহাতি রিকশাওলারা বিড়ি ফুঁকে ফুঁকে দাঁত খারাপ করতে থাকে।'
    ততক্ষণে পেছনের রিকশাও এসে পড়েছে। চালকের পরনে ছেঁড়া ধুতি, খালি গা,-- কুঁকড়ে ককিয়ে চালাচ্ছে। শহুরে রিকশাওলাকে দেখে ও একটু ভাই-বেরাদর ভাবনায় বলল,'ভাইয়া, তুমিও গোন্ডা জেলা?'
    এই রিকশাওলা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল,' আবে! সর বলছি! বল্লি কী তুই?'
    এই রিকশাওলা খিরর-খিরর করতে করতে এগিয়ে গেল।
    আজকালকার সেন্টিমেন্টাল লেখকেরা না জানি কিসের ভিত্তিতে বার বার বলতে থাকেন যে দুঃখ মানুষকে উন্নত করে, মার্জিত করে। কিন্তু সত্যিটা হল দুঃখ মানুষকে প্রথমে দ্রবিত করে, তার পর ভাল করে নিংড়ে দেয়। শেষে নিংড়ে-নিংড়ে ওর চেহারাটা রক্তশূণ্য সাদাটে করে ওর ওপর দু'চারটে কালো-সাদা লাইন টেনে দেয়। তারপর ওকে লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তায় চরে খেতে ছেড়ে দেয়।দুঃখ মানুষের সাথে যা করে থাকে গোন্ডাওলা রিকশাওলার সাথেও তাই করেছে। কিন্তু শহুরে রিকশাওলার ওপরে এর কোন প্রভাব চোখে পড়ল না। ও সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে কোনদিকে না তাকিয়ে রিকশায় উঠে স্পীডে চালাতে শুরু করল।
  • ranjan roy | 24.96.83.178 | ২২ ডিসেম্বর ২০১২ ০১:৩১574662
  • আবার রিকশাওলার লেকচার শুরু হলঃ
    ' আমার এক কথা ঠাকুর সায়েব! চোখা কাম, চোখা দাম! একবার আট আনা বললে আর সাত আনায় নেমে আসি না। যেটা একবার বলেছি তো, ব্যস্‌। একবার এক সায়েব আমার রিকশায় চড়ে ঘরের অবস্থা জানতে চাইলেন। বল্লেন, সরকার তোমাদের এমন অবস্থায় রেখেছে? রিকশা চালানো নিষিদ্ধ করছে না কেন? মানুষের পিঠে মানুষ চড়বে, কি অন্যায়? আমি বল্লাম-- তাহলে না চড়লেই পারেন। উনি বলতে লাগলেন যে ওনারা রিকশাকে বয়কট করলে বেচারা রিকশাওলারা খেতে না পেয়ে মরে যাবে। তারপর উনি রিকশাওলাদের জন্যে কান্নাকাটি শুরু করলেন। খুব কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে সরকার কে গাল দিতে লাগলেন। বলতে লাগলেন--তোমরা ইউনিয়ন বানাও, মোটর-রিকশার দাবি কর, আরো কি কি সব হাবিজাবি! কিন্তু ঠকুরসায়েব ! আমিও বললাম যে ব্যাটা চালিয়ে যাও। আমার জন্যে যতই কান্নাকাটি কর আমি ভাড়া আট আনা থেকে এক পয়সাও কম নেব না।'

    পালোয়ান চোখ বন্ধ করে বসেছিল। হাই তুলে বলল,' একটু সিনেমা-টিনেমার গান-টান শোনাতে পার? নাকি বকবক করে মাথা ধরিয়েব দেবে?'
    রিকশাওলা বলল,' ঠাকুরসাহেব, এখানে তো দুটোই কাজ-- রোজ সিনেমা দেখা আর ফটাফট সিগারেট খাওয়া। গানও শোনাতাম, কিন্তু আজ গলা খারাপ।'
    পালোয়ান হেসে ফেলল,' তবে আর কি! শহরের নাম ডোবালে।'
    রিকশাওলা এই অপমান বেশ ভদ্র ভাবে মেনে নিল। তারপর কী ভেবে নীচু আওয়াজে 'লারে-লপ্পা, লারে -লপ্পা' গুনগুন করতে লাগল। পালোয়ান পাত্তা দিল না। ও ভাবল সোয়ারির শরীর ভাল নেই। তাই আবার বকবক শুরু করল,' আমার ভাইও রিকশা চালায়, খালি কিছু খাস পাড়াতেই সোয়ারি নিয়ে যায়। একবার এক সুলতানপুরীর রিকশাওলাকে ও দু-চারটে দাঁও-প্যাঁচ শেখাতেই ব্যাটা কাঁদতে লাগল।বলল, আমার প্রাণ যাক, আমি ধরম ছাড়ব না। আমি কক্ষণো এইসব কাজের জন্যে সোয়ারি নিয়ে আসবো না। আমি বল্লাম,ছাড়ান দে ভাই! গাধাকে চাল বদলে ঘোড়া করা যায় না।'
    শিবপালগঞ্জ প্রায় এসে গেছে। পালোয়ান রিকশাওলাকে সার্টিফিকেট দিচ্ছিল,' তুমি মানুষ ভাল। সবার সঙ্গে মেশামেশির কী দরকার? তোমার কায়দাটা খাসা।'
    তারপর কী ভেবে বলল,' কিন্তু তোমার শরীর একটু ঢিলেঢালা গোছের। কয়েকটা মাস দন্ড-বৈঠক কর। তারপর দেখ কেমন হয়।'
    'ওতে কি হবে?' রিকশাওলা বলল,' বড়জোর আমি একটা পালোয়ান হব। কিন্তু আজকাল পালোয়ানিতে আছেটা কী? যুদ্ধের সময় আকাশ থেকে বোমা পড়লে মাটিতে তাব্ড় তাবড় পালোয়ান চিৎ হয়ে যায়। হাতে পিস্তল থাকলে পালোয়ান হলেই কী ? আর না হলেই বা কী?' একটু থেমে রিকশাওলা বেশ শান্ত ভাবে বলল,'পালোয়ানি-টানি আজকাল গাঁয়েগঞ্জে চলে ঠাকুরসাহেব! এদিকে তো আজকাল ছোরাবাজির ধূম।'
  • ranjan roy | 24.96.155.59 | ২২ ডিসেম্বর ২০১২ ১৭:২১574663
  • এতক্ষণ পরে বদ্রী পালোয়ানের গায়ে লাগল। ও হাত বাড়িয়ে রিকশাওলার গেঞ্জি টেনে ধরে বলল,' আবে, একঘন্টা ধরে কী ঠাকুর-সাহেব, ঠাকুর সাহেব শুরু করেছিস? জানিস না আমি বামুন?'
    শুনে রিকশাওলা চমকে উঠল। তারপর সর্বোদয়ী নেতাদের মত মুখ করে বলল--' ঠিক আছে, পন্ডিতজী, ঠিক আছে।'
    -------------------

    রামাধীনের পুরো নাম বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ী।একসময় ভীখমখেড়া নামে শিবপালগঞ্জের গায়ে লাগা একটি গ্রাম ছিল যা 'গ্রীস-রোম-মেসোপটেমিয়া'র মত কালের অতল গর্ভে মিলিয়ে গেছে। আসলে মিলিয়ে যায় নি, কেবল শিবপালগঞ্জবাসীরা নিজেদের বোকামির ফলে ওকে মিলিয়ে গেছে ভাবে। আজও ভীখমখেড়া গ্রাম কিছু ঝুপড়িতে, মাল-বিভাগের কাগজে আর বাবু রামাধীনের পুরনো ডায়রিতে বেঁচেবর্তে রয়েছে।
    ছেলেবেলায় বাবু রামাধীন ভীখমখেড়া গ্রাম পেরিয়ে রেলের লাইন ধরে শহরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কোন ট্রেনে ওঠার প্ল্যান করে রেলগাড়ি চরে কিছু না ভেবেই কোলকাতা পৌঁছে গেলেন। কোলকাতায় উনি প্রথমে এক ব্যবসায়ীর ডাক পৌঁছনোর কাজে লেগে গেলেন, তারপর মাল নিয়ে যাওয়ার। এরপর ধীরে ধীরে পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করে শে্ষে গোটা ব্যবসায়ের মালিক হয়ে গেলেন।
    ব্যবসাটা ছিল আফিমের। কাঁচা আফিম আসত পশ্চিম থেকে। সেগুলোকে নানা ভাবে কোলকাতায় কিছু ব্যাবসায়ীর গদিতে পৌঁছানোর নেটওয়ার্ক ওনার হাতে ছিল। কিন্তু উনি মহত্বাকাঙ্খী ছিলেন না। চুপচাপ নিজের আড়তের কাজ করতেন খালি সময়ে আর পশ্চিমদেশ থেকে আসা লোকজনের সঙ্গে ভাব জমাতেন। এইভাবে ওদিকের লোকজনের মধ্যে উনি বেশ পরিচিত নাম হয়ে উঠলেন। লোকেরা ওনার অশিক্ষার তারিফ করত, উদাহরণ হিসেবে বলত আকবরের মত অশিক্ষিত বাদশাও তো কত ভালভাবে রাজত্বি করে গেছেন।
  • ranjan roy | 24.99.127.155 | ২৩ ডিসেম্বর ২০১২ ২৩:৫৪574664
  • আফিমের ব্যবসায় হাতে বেশ পয়সা-কড়ি আসে আর অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় এটাতে কম্পিটিশন একটু কম, কিন্তু এতে ছোট্ট একটা খুঁত আছে।। ব্যবসাটা ঠিক আইনসম্মত নয়। এ নিয়ে কথা উঠলে বাবু রামাধীন বন্ধুদের বলেন,' তা আমি কি করব? আইন তো আর আমাকে জিগ্যেস করে বানায় নি?'
    যখন বাবু রামাধীনকে আফিম আইনে গ্রেফতার করে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে দাঁড় করানো হল তখনও তিনি এই সুরেই কথা বললেন। উনি ইংরেজের তৈরি আইনের নিন্দা করতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ দিলেন আর বললেন যে বিদেশি আইন না বুঝে ইচ্ছেমত বানানো হয়েছে। ছোট ছোট জিনিসকে খামোখা অপরাধের শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
    উনি বললেন,' জনাব, আফিম একটি চারাগাছ থেকে জন্মায়। চারাগাছ বেড়ে উঠলে তাতে সুন্দর সাদা ফুল ফোটে। ইংরেজিতে ওকে বলে পপি।ওরই এক অন্য ধরণ আছে , তাতে লাল ফুল ফোটে। সেগুলো সায়েবরা নিজেদের বাংলোয় লাগায়। আর একটা তৃতীয় রকমও হয়, তাকে বলে ডবল পপি। হুজুর , এ'সব হল ফল-ফুল-পাতার মামলা। এর মধ্যে অপরাধ কোত্থেকে এল? ওই শ্বেতপপি থেকে পরে কালো কালো কিছু বেরয় যা ওষুধ তৈরি করতে কাজে আসে। তাহলে এর ব্যবসা করা বেআইনী কেন ? যে আইনে এই ব্যবসাকে অপরাধ বলা হয়েছে তা কালা আইন। এটা আমাদের সমাজের সর্বনাশ করতেই তৈরি করা হয়েছে।
    এমন সারগর্ভ বক্তৃতার পরেও রামাধীনকে দু'বছরের জন্যে জেলে যেতে হল।
    সেই সব দিনে আফিম আইন ভাঙলে জেল হতই।আসল ব্যাপার হল হল জেলে যাওয়ার আগে বক্তৃতা দেয়াটা। বাবু রামাধীন জানতে যে এভাবে বক্তৃতা দিয়ে শ'য়ে শ'য়ে লোক (বিপ্লবী হোক ব অহিংসাবাদী) শহীদ হয়েছে। উনিও এভাবে সহজে শহীদ হবেন। কিন্তু দু'বছর জেল খেটে বেরিয়ে এসে বুঝলেন শহীদ হওয়ার জন্যে আফিম আইন নয় , লবণ আইন ভঙ্গ করা দরকার ছিল। কিছু দিন কোলকাতায় ঘুরে টের পেলেন যে বাজারে ওনার পায়ের নীচে মাটি নেই। আফশোসের চোটে উনি দু'চারটে শের আউড়ে গাঁয়ে ফিরে এলেন। তারপর শিবপালগঞ্জে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে লাগলেন।।
  • ranjan roy | 24.99.160.156 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:০০574665
  • উনি কিন্তু গাঁয়ের মানুষজনকে এটুকু সত্যি বলে ফেললেন যে ওনার আড়তের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, আর কিছু বলার দরকার ছিল না। ব্যস্‌, উনি একটা ছোটোখাট কাঁচাপাকা বাড়ি বানিয়ে ফেললেন, কিছু চাষের জমি কিনে চাষবাস শুরু করলেন আর গাঁয়ের ছেলেছোকরাদের কড়ির বদলে তাসের জুয়ো ধরালেন। আর সদর দরজার সামনে খাটিয়া পেতে জমিয়ে বসে কোলকাতার গল্প শুনিয়ে নাম কিনলেন। সেই সময় গ্রাম-পঞ্চায়েত বানানো হল। আর উনি কোলকাতায় শেখা দাঁও-প্যাঁচের জোরে নিজের এক খুড়তুতো ভাইকে সভাপতি বানিয়ে দিলেন। গোড়ায় লোকে বুঝতেই পারেনি যে সভাপতি ব্যাপারটা কি! তাই ওনার ভাইকে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয় নি। তবে অল্প কিছু দিনেই লোকেরা বুঝে গেল যে এই গাঁয়ে সভাপতি একটা নয়, দুটো। একজন বাবু রামাধীন যাঁর কাজ হল গ্রামসভার অধীন জমির পাট্টা দেয়া , আর অন্যটি ওনার খুড়তুতো ভাই যাঁর কাজ হল তবিল তছরূপের দায় কাঁধে নিয়ে জেল যাওয়া।
    একসময় গাঁয়ে বাবু রামাধীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি ভালই ছিল। ওনার ঘরের সামনে একটি ছপ্পরওলা বাংলোবাড়ি মত ছিল। তার একপাশে গাঁয়ের নবযুবকের দল জুয়ো খেলত আর অন্য পাশটায় চলত ভাঙ্গের তাজা পাতা বাটা । পরিবেশ বেশ কাব্যময় ছিল। উনিই এই গ্রামে প্রথম ক্যানা,নেস্টার্শিয়াম, লার্কস্পার ধরণের বিলিতি ফুলগাছ লাগিয়ে ছিলেন। একটা ছিল ঘন লাল রঙের। ওগুলোর দিকে আঙুলের ইশারা করে উনি বলতেন---" এটা হল পাপী( পপি), আর এইটা শালা ডবল পাপী!
  • ranjan roy | 24.99.160.156 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:১৮574666
  • ভীখমখেড়বী নামেই বোঝা যায় যে উনি নিশ্চয়ই কবিতা-টবিতা লেখেন। ইদানীং ছেড়ে দিয়েছেন কিন্তু যখন ওনার দিন ছিল তখন কোলকাতায় একাধ-বার শায়রও হয়েছিলেন।
    উর্দূ কবিদের সবচে বড় বৈশিষ্ট্য হল ওনাদের মাতৃভূমির প্রতি টান। এইজন্যে বোম্বাই হোক কি কোলকাতা, ওনাদের নামের লেজে গাঁয়ের নামটি থাকবেই। এ নিয়ে ওনাদের কোন হেলদোল নেই।
    আসলে নিজেদের নামের সঙ্গে গোঁডবী,সলোনবী, আমরোহবী জুড়ে ওনারা কোলকাতা-বোম্বাইয়ের কূয়োর ব্যাংদের মেসেজ দিতে চান যে গোটা দুনিয়া শুধু তোমাদের শহরের সীমায় বাঁধা পড়েনি। যেমন বোম্বাই আছে তেমনি গোন্ডাও আছে।
    এক হিসেবে এটা ভালই বলতে হবে। কারণ জন্মভূমির টান থেকেই দেশপ্রেম জন্ম নেয়। যারা বোম্বাই শহরে নিজেদের ' সেন্ডেলবী" বলতে লজ্জিত হয় না, কেবল তারাই পারে কুর্তা-পাজামা পরে মুখে চার চারটে পান আর চার লিটার থুতু ঠুঁসে নিউইয়র্কের ফুটপাথে নিজের দেশের সভ্যতার পতাকা তুলতে। যে ব্যাটার কোলকাতায় নিজেকে 'বারাবাঁকি' বলতে সংকোচ হয় সে ব্যাটা বিলেত গেলে নিশ্চয়ই নিজেকে হিন্দুস্তানী বলতে কিন্তু-কিন্তু করবে।
  • ranjan roy | 24.99.160.156 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৪:৫৪574668
  • এই সিদ্ধান্ত অনুসারে রামাধীন কোলকাতার বন্ধুদের মধ্যে 'বাবু রামাধীন ভীখমখেড়বী' নামে প্রসিদ্ধি পেলেন।
    তবে সইত্যের খাতিরে বলতে হয় যে এসব হল কবি দানিশ টান্ডবীর সঙ্গে ওঠাবসার ফল। ইনি দানিশ টান্ডবীর দেখাদেখি উর্দূ কবিতায় রুচি দেখাতে লাগলেন। আর যেহেতু কবিতায় রুচির শুরুটাই হয় নিজে কবিতা লিখে, তাই অন্যদের দেখতে দেখতে উনি একদিন একটা 'শের' লিখেই ফেললেন। ওটা যখন টান্ডবী সাহেবকে শোনালেন তখন উনি, যেমন এক কবির কবিতা শুনে অন্য কবির বলার দস্তুর, বললেন , ' সুন্দর শের বলেছেন।'
    রামাধীন বললেন," আমি তো লিখেছি, বলিনি তো?"
    উনি বললেন," ভুল বললেন, শের লেখ যায় না।"
    " কিন্তু আমি তো লিখে ফেলেছি!"
    " না, তুমি শের বলেছ, শের বলা হয়, এটাই প্রচলিত বাগভঙ্গী।"
    এরপর উনি রামাধীনকে শের বলার কিছু কাজের টিপস্‌ দিলেন। যেমন, শের প্রবাদের হিসেবে তৈরি হবে, প্রবাদ শেরের হিসেবে নয়। দু'নম্বর, কবি বা শায়রের কোন উপনাম থাকতে হবে। টান্ডবী পরামর্শ দিলেন ,'তুমি তোমার উপনাম " ইমান শিবপালগঞ্জী" রাখ।
    কিন্তু ইমান বা বিশ্বাস শব্দের ওনার এমন অপছন্দ যে উনি তার মানেটাই ভুলে গে্ছেন। আর " শিবপালগঞ্জী" কেন? ওনার আদি গ্রাম তো ভীখমখেড়া। আসল কথা হল কোন উপনাম নেয়াতেই ওনার আপত্তি, আফিংয়ের কারবারের চোটে এমনিতেই ওনাকে বেশ কয়েকটা উপনাম নিতে হয়েছে, আবার একটা? ফলে উনি শায়েরীর জগতে বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ী হয়ে রইলেন।
  • ranjan roy | 24.99.160.156 | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১৫:২৬574669
  • " সাঁঝের বেলায় চোখ মারে হায়, কেলটে ছুঁড়ির দল"। এই মুখড়া দিয়ে শুরু হওয়া একটি কবিতা উনি আফিমের কৌটোর ওপর লিখে ফেললেন।
    এই শায়েরি লেখার ভূত শুধু দানিশ টান্ডবীর সাগরেদি করার দিন পর্য্যন্ত টিঁকে ছিল। জেলযাত্রার সময় ভেবেছিলেন অন্য মহান কবি ও সাহিত্যিকদের মত উনিও কারাবাসের দিনগুলোতে কোন কালজয়ী রচনার জন্ম দেবেন আর তারপর একটা বড়সড় ভূমিকা লিখে জনগণের সামনে পেশ করবেন। কিন্তু ওই দুই বছর শুধু জেলখানার খাবার নিয়ে নালিশ,অন্য কয়েদিদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা , ওয়ার্ডারের খিস্তি শোনা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার মধ্যেই কেটে গেল।
    শিবপালগঞ্জে ফিরে এসে 'গঞ্জহা' লোক্জনের সামনে নিজেকে আলাদা দেখানোর চেষ্টায় উনি আবার নিজের নামের সঙ্গে একটা লেজ জুড়ে নিলেন-- ভীখমখেড়ী।। তারপর একদিন, যখন শুধু গাঁয়ের নয়, গোটা ভারতীয় সভ্যতার দোষে উনি দলাদলির শিকার হলেন, তখন এক-আধটা শের লিখে প্রমাণ করে দিলেন যে 'ভীখমখেড়বী' শুধু ভূগোলের পাতায় নয়, কাব্যজগতেও একটি শব্দ বটেক। কিছু দিন হল বদ্রী পালোয়ান শিবপালগঞ্জ থেকে দশ মাইল দূরে একটা গমপেষার কল বসিয়েছে। কল চলছে ভালই, কিন্তু বৈদ্যজীর শত্রুরা বলে বেড়াচ্ছে যে স্কুলের বাজেটের সঙ্গে এই গম-পেষাই কলের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। জনগণের এই ভাবনা ফুটে উঠল রামাধীনের এই অমর কবিতায়, থুড়ি শের এর মাধ্যমে।
    " শোন রামাধীন ভীখমখেড়ী, এ যে বিষম রঙ্গ,
    কলেজ খুলতে আটার মেশিন? স্বপ্ন হল ভঙ্গ।"
  • ranjan roy | 24.99.182.197 | ১২ জানুয়ারি ২০১৩ ০৭:৩৫574670
  • গাঁয়ের ঢোকার মুখে বদ্রীপালোয়ানের রিকশা কেউ হাত দেখিয়ে থামাতে বলল। একটু অন্ধকার হয়ে এসেছে, তাই লোকটার চেহারা দূর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে না। বদ্রী বলল," কৌন হ্যায় বে"?
    " আবে-তবে করবে না পালোয়ান! আমি রামাধীন।" বলতে বলতে বক্তা এসে রিকশার পাসে এসে দাঁড়াল। রিকশাওলা একেবারে মাঝরাস্তায় রিকশাটাকে দাঁড় করিয়েছে। লোকটির পরনে ধুতি-কুর্তা। কিন্তু আধো-অন্ধকারে ওকে ধুতি-কুর্তা দিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনা কঠিন, বরং ন্যাড়া মাথার সৌজন্যে চেনা যেতে পারে। ও রিকশার হ্যান্ডেল ধরে বদ্রীকে বলল," শুনেছ, আমার ঘরে ডাকাত পড়বে?"
    পালোয়ান রিকশাওলার পিঠে একটা আঙুল বাঁকিয়ে চাপ দিতে দিতে বলল," তো এখন থেকেই চিঁ-চিঁ শুরু? ডাকাত পড়লে পরে খবর দিও"।
    রিকশাওলা প্যাডেলে জোরে চাপ দিল। কিন্তু রামাধীন ওর হ্যান্ডেল এমন জোরে চেপে ধরেছে যে দুটো বিপরীত জোরের চাপাচাপিতে রিকশা নিজের জায়গায় স্থির।
    বদ্রী পালোয়ান বিড়বিড় করতে লাগল," আমি ভাবলাম না জানি কী বিপদ হয়েছে যে এমন করে রাস্তার ওপর রিকশা আটকিয়ে রাঁড়ের মতন কাঁদছে !"
    রামাধীন বলল," কাঁদছি না, নালিশ করছি। বৈদ্যজীর ঘরে তুমিই একটু মানুষমত। বাকিগুলো সব শাখামৃগ। একটা চিঠি এসেছে। ডাকাতের দল আমার থেকে পাঁচহাজার টাকা চেয়েছে। বলছে অমাবস্যার রাতে দক্ষিণের টিলার ওপরে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।"
    বদ্রী পালোয়ান নিজের উরূতে চাপড় মেরে বলল," ইচ্ছে হলে দিয়ে এস, আর ইচ্ছে না হলে একটা কড়িও দেবার দরকার নেই। এ নিয়ে আর কী বলব? চলো রিকশাওলা!"
  • ranjan roy | 24.99.182.197 | ১২ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:০২574671
  • কাছেই ঘর। ঘরের বাইরে ভাঙ পিষে এতক্ষণে তৈরি। ওটা খেয়ে, চান-টান সেরে, ল্যাঙট কষে, গায়ের ওপর কুর্তা চাপিয়ে, বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় এসে জমিয়ে বসা যাবে। লোকজন জানতে চাইবে,--পালোয়ান! আজ কী করে এসেছে, দেখ! ও চোখ বন্ধ করে অন্যের প্রশ্ন শুনবে, অন্যদের উত্তর দিতে দেবে। শরীরের শক্তি আর ভাঙের ঝিমঝিমের চোটে সমস্ত সাংসারিক শোরগোল মশার পিনপিনের মত মনে হবে।
    স্বপ্নের জগতে ডুব্সাঁতার কাটার সময় রাস্তার মাঝখানে পথ আটকে দেয়াটা বদ্রীর একেবারে ভালো লাগেনি। ও রিকশাওলাকে ধমকে উঠল।
    " বলছি না, চল!"
    কিন্তু চলে কি করে! রামাধীনের হাত যে এখনো রিকশার হ্যান্ডেলে।
    ও বলল" কথাটা টাকা দেয়া-না-দেয়ার নয়। আমার থেকে কে কিসের টাকা নেবে? আমি তোমাকে শুধু বলছি যে রুপ্পনকে একটু কড়কে দাও! ও নিজেকে একটা বিরাট কিছু ভাবছে আজকাল। একটু মাটিতে নেমে আসুক, আকাশে---"।
    বদ্রী পালোয়ান এবার নিজের জানুদেশে জোর দিয়ে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামলেন! রামাধীনকে চেপে ধরে ঠেলতে ঠেলতে রিকশাওলার থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললে," কেন খামোকা ফালতু কথা বলছ? কী করেছে রুপ্পন?"
    রামাধীন বলল,"আমার ঘরে ডাকাতির চিঠিটা ওই পাঠিয়েছে। আমার কাছে প্রমাণ আছে।"
  • ranjan roy | 24.99.182.197 | ১২ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:২৫574672
  • পালোয়ান বিড়বিড় করতে লাগল,"দু-চার দিনের জন্যে বাইরে যাওয়াও মুশকিল! আমি ওদিকে গিয়েছি কি না এদিকে এই আপদ !"
    তারপর একটু ভেবে বলল," তোমার কাছে প্রমাণ আছে তো ঘাবড়ানোর কি আছে"? তারপর রামাধীনকে অভয়দান করে বলল," যাও, এদানি তোমার ওখানে ডাকাতি-টাকাতি হবে না। যাও, নিশ্চিন্তে ঘুমোও গিয়ে। রুপ্পন ডাকাত নয়, ফচকে ছোঁড়া, একটু চ্যাংড়ামি করেছে।"
    রামাধীন একটু রুক্ষ্মস্বরে বলল," সে তো আমিও জানি--- রুপ্পন চ্যাংড়ামি করেছে। কিন্তু এটা কি ধরণের চ্যাংড়ামি?"
    বদ্রী পালোয়ান একমত। " ঠিক বলেছ। এটা একেবারে ছ্যাঁচড়া ধরণের চ্যাংড়ামি"।
    রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক খুব জোরে আসছিল। ওর হেডলাইটের আলোয় ধাঁধিয়ে গিয়ে বদ্রী রিকশাওলাকে বলল," রিকশা এক সাইডে কর। রাস্তা তোমার বাপের নয়!"
    রামাধীন বদ্রীর স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত। এই ধরণের কথা শুনে বল," রাগের কথা নয় পালোয়ান! ভেবে দেখ, এটা কোন কথা হল?"
    বদ্রী রিকশার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, চড়ে বসতে বসতে বলল," য্খন ডাকাতিই হবে না, তখন কিসের এত কথা? চলো রিকশাওলা!" চলতে চলতে বলল," রুপ্পনকে বুঝিয়ে দেব। এসব ভাল কথা নয়।"
    রামাধীন চেঁচিয়ে বলল," ও আমার বাড়িতে ডাকাতির চিঠি পাঠালো আর তুমি খালি বুঝিয়ে দেবে? এখানে বোঝানো নয়, জুতোনো উচিৎ।"
    রিকশা এগিয়ে গিয়েছিল। পালোয়ান মাথা না ঘুরিয়ে উত্তর দিল," যদি খুব খারাপ লাগে তো তুমিও আমার ঘরে ওমনি একটা চিঠি পাঠিয়ে দিও।"

    ---------------------------------*****------------------------------------------
  • ranjan roy | 24.96.136.242 | ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৫৯574673
  • অধ্যায়-৭
    ----------
    ছাতের ওপর একটা ঘর। ওর দরজাটা সংযুক্ত পরিবারের পাঠ্যপুস্তকের ধাঁচে সারাক্ষণ হাট করে খোলা পড়ে থাকে। কোণের দিকে রাখা একজোড়া মুগুর। তাইতে বোঝা যায় যে সরকারি ভাবে এই ঘরের অধিকার বদ্রী পালোয়ানের। তবে পরিবারের অন্য মেম্বাররাও নিজের নিজের ইচ্ছেমত ঘরটি ব্যবহার করে থাকে। ঘরের মহিলারা কাঁচ আর মাটির বয়ামে করে নানারকম আচার দিনের বেলা রোদ্দূরে ছাদে শুকোতে দেন। বেলা গড়িয়ে গেলে সেগুলো সব তুলে ঘরটার ভেতরে জমা করে রাখেন। ছাতে শুকোতে দেয়া কাপড়গুলোরও একই অবস্থা। ঘরটার ভেতরে এপাশ থেকে ওপাশ আড়াআড়ি ভাবে একটা দড়ি বাঁধা আছে। সন্ধ্যের পরে তার থেকে ল্যাংগোট ও চোলি, ফতুয়া ও পেটিকোট একসাথে ঝুলতে থাকে। বৈদ্যজীর ঔষধালয়ের একগাদা ফালতু শিশি একসাথে একটি আলমারিতে তোলা রয়েছে। বেশিরভাগই খালি।
    ওগুলোর গায়ে কিছু ছবিওলা বিজ্ঞাপন সাঁটা।
    তাতে 'ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে' আর ' ব্যবহারের পরে" টাইটেলের নীচে আলাদা আলাদা ছবি।
    প্রথমটার নীচে এক অর্ধমানব। আর ওষুধ ব্যবহারের পরে হেডিং এর নীচে গোঁফে তা' দেয়া কষে ল্যাংগোট বাঁধা স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির ছবি।বোঝা যায় যে এই শিশি'র ওষুধের গুণেই হাজার হাজার পুরুষ ক্রমশঃ বাঘের মত বলশালী হয়ে উঠেছেন। যদিও এদের ব্যাঘ্রবিক্রম স্নানের ঘরে আর শোয়ার ঘরেই সীমিত, বাইরে এঁয়ারা যেমন ছাগল ছিলেন তেমনি আছেন।

    কিছু সাহিত্য আছে যাদের " গোপনসাহিত্য" বলাই দস্তুর। সেগুলো " ভারতে ইংরেজ শাসন" ধরনের সাহিত্যের থেকে বেশি ভয়ংকর। কারণ এগুলো ছেপে প্রকাশিত করা ১৯৪৭ সালের আগেও অপরাধ ছিল, এখনো আছে।
  • brcslg | 37.125.203.57 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ ২২:২১574674
  • অপেক্ষায় আছি।
  • ranjan roy | 24.96.150.66 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৬:০৬574675
  • @brcslg,
    লজ্জিত । আমার বিছানায় একপাশে গোটাকয়েক বইয়ের মধ্যে 'রাগ দরবারী' রাখা থাকত। গত সাতদিন ধরে ঘর গোছানোর পরে(আমি গোছাইনি) সব এলোমেলো। বইটা পাচ্ছি না। প্রাণপণে খুঁজছি।
    আচ্ছা, এটা কি নেট এ দেখা যেতে পারে? তার স্টেপ গুলো কি কি? তাহলেও চেষ্টা করতে পারি।
  • brcslg | 37.125.202.241 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:২০574676
  • @ranjan roy

    আমার বাড়িতে , আমার study table, book rack , ঘরময় ছড়ানো বই কাগজ ইত্যাদি অতীতে বেশ কয়েকবার
    এই "operation-গোছানো" -র পাল্লায় পড়েছে--এবং কোনক্ষেত্রেই আমার বিন্দুমাত্র্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইচ্ছা-প্রকাশ/উৎসাহ/অংশ গ্রহন -- কোনকিছুই ছিলনা।

    প্রতি ক্ষেত্রেই , এই "operation-গোছানো"-র ফলে , যে বই,জার্নাল বা অন্য কিছু আমি চোখ বন্ধ করে বা অন্ধকারেও পেয়ে যেতাম, সেগুলো আলোতেও চোখ খুলে তৎ ন ... তৎ ন করে খুঁজেও বিফল হতাম। সে অন্য এক বিষাদ-সিন্ধু।

    যাই হোক, আশা করি আপনার হারানিধির সংখা একটিতেই সীমাবদ্ধ আছে।

    আমি হিন্দী একদমই জানিনা। তাই এই লিংকটি আপনার কাজে লাগবে কিনা বুঝতে পারছি না।

    আপনার অনুবাদ আমায় নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। অপেক্ষায় থাকব।

    ভাল থাকবেন।

    http://www.scribd.com/doc/19062291/Shrilal-Shukla-Rag-Darbaari
  • ranjan roy | 24.99.86.93 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ ২৩:৩১574679
  • brcsig,
    আজকে উনি (রাত্রে যে নাম করতে মানা) সাত দিন পরে বাড়ি আসায় ওনাকে নম্রভাবে নিবেদন করলাম যে---। এও বললাম যে যদি বইটি কোন কারণে ওনার বাড়ির কোন আনাচে কানাচে চোখে পড়ে যায় তবে আমাকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো। তৎক্ষণাৎ রান্নাঘর থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে লেবু পেড়ে আনার মত করে একটি ঢাকা চাদরের নীচের থেকে একটি প্যাকেটে কিছু বই বের করে দিলেন, সবার ওপরে 'রাগ দরবারী'।
    তবু আপনাকে ধন্যবাদ! কথা দিচ্ছি রোজ অল্প করে হলেও কিছু অনুবাদের চেষ্টা চালিয়ে যাবো।
  • Abhyu | 138.192.7.51 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:১১574681
  • আচ্ছা রঞ্জনদা, এই বইটার বাংলা অনুবাদ তো পাওয়া যায়, না?
  • ranjan roy | 24.99.86.93 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০০:১১574680
  • এই তথাকথিত গুপ্তসাহিত্য অফিস-কাছারির অনেক গোপনীয় খবরের মতই গুপ্ত হয়েও গুপ্ত থাকে না, একেবারে গোপন-কথটি-রবে-না-গোপনে হয়ে যায়। এই সাহিত্য আহার-নিদ্রা-ভয় ইত্যাদিতে ত্রস্ত মানবের জীবনে বড় আনন্দদায়ক লিটরেরি সাপ্লিমেন্টের কাজ করে।, এবং এটি সাহিত্যের ক্লাস ও মাস লিটারেচারের কৃত্রিম বেড়া টপকে সবার হৃদয়ে সমান ভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে।
    বলতে দ্বিধা নেই যে এই সাহিত্যে তেমন কিছু থাকে না, থাকে শুধু কোন পুরুষ অন্য কোন পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কিভাবে কী কী ব্যবহার করেছিল তার ফিরিস্তি। অর্থাৎ, ওতে , কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের ভাষায় 'মানব মানবের চিরন্তন' সম্বন্ধের বর্ণনা থাকে।
    এই কামরাটা অমনি সব সাহিত্য পাঠের জন্যেই ব্যবহৃত হত। আর বলা বাহুল্য যে সাহিত্যপাঠের কর্মটি পরিবারের একমাত্র ছাত্র রূপ্পনবাবুর দ্বারাই সুসম্পন্ন হত। রূপ্পনবাবু কামরাটা অন্য অনেক কর্ম সুসম্পন্ন করার জন্যেও ব্যবহার করতেন। যে সুখ পাওয়ার জন্যে অন্য লোকেদের রুটির টুকরো, গাছের ছায়া, কবিতা, পানপাত্র, প্রেমিকা ইত্যাদি ওমরখৈয়ামী জিনিসের দরকার পড়ে, সেই সুখ রূপ্পনবাবু এই কামরায় নিজে নিজেই পেয়ে থাকেন।
    পরিবারের সমস্ত সদস্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শ্লোগান তুলে ধরা এই কামরাটি দেখলে লোকের মনে স্থানীয় সংস্কৃতির জন্যে শ্রদ্ধা জন্মাবে। এই ঘরটাকে দেখার পরে কোন সমাজবিজ্ঞানীই জোর গলায় বলতে পারবেন না যে প্রাচ্যে সংযুক্ত পরিবার ভেঙে যাওয়ার কোন ভয় আছে।
    এই কামরায় রঙ্গনাথকে থাকতে দেয়া হয়েছিল। ও তো এসেছিল চার-পাঁচ মাস থাকবে বলে।
  • ranjan roy | 24.96.105.17 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:২৪574682
  • অভ্যু,
    সম্ভবতঃ এন বি টি করেছিল। বহুবছর আগে, বাজে অনুবাদ।
  • Abhyu | 138.192.7.51 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:২৬574683
  • কিন্তু তার মানে হল, আপনার ভালো অনুবাদটি বই হয়ে বেরোতে পারবে না :(
  • ranjan roy | 24.96.98.241 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:২০574684
  • অভ্যু,
    এক্দম ঠিকঃ))))
    তবু করছি, শুধু এই জন্যে যে এই বইটি আমার খুব প্রিয়। করাটাই একটা আনন্দ। আর এত বছর হিন্দি বলয়ে থেকে একটা ইচ্ছে যে বাংলার বন্ধুদের হিন্দিসাহিত্যের মণিমুক্তোর সঙ্গে একটু পরিচয় করাই। তার সহজ রাস্তা-- গুরুর পাতাঃ০))))
    তবে মোটা বই, অল্প অল্প করেও বছর দুই লেগে যাবে।
  • ranjan roy | 24.96.98.241 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ০৯:২৩574685
  • বৈদ্যজী ঠিকই বলেছিলেন। এম এ পড়ার চাপ নিতে নিতে রঙ্গনাথ সব সাধারণ ছাত্রের মতই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওর জ্বর হচ্ছিল। আর সমস্ত হিন্দুস্থানী জনগণের মত অ্যালোপ্যাথি শাস্ত্রে বিশ্বাস না থাকলেও ও ওষুধ খেয়ে যাচ্ছিল। তাতে ও এখ্নও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি।সব শহুরে মানুষের মত ওরও বিশ্বাস যে শহুরে ও গেঁয়ো চিকিৎসায় কোন ফারাক নেই। এইভেবেই ও এখানে চলে এসেছে। আর সব মূর্খের মতই এম এ পাস করে হাতে গরম চাকরি না পেয়ে রিসার্চ করবে ঠিক করেছে। তবে সব বুদ্ধিমানের মত ও এটাও জানে যে রিসার্চ করার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে থাকার বা নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাওয়ার কোন দরকার নেই।
    তাই ও ভেবেছে যে কিছুদিন গাঁয়ে থেকে আরাম করবে, শরীর সারাবে, পড়াশুনো করবে, দরকার হলে শহরে গিয়ে বই বদলে নিয়ে আসবে আর বৈদ্যজীকে সমস্ত স্টেজে সুসংস্কৃত ভাষায় বলার সুযোগ দেবে যে ইস্‌ ! আমাদের ছেলেপুলেরা যদি এমন অকম্মার ঢেঁকি না হত তাহলে আমাদের বুড়োদের পিঠের বোঝা একটু হালকা হত।
    ওপরের ঘরটা বেশ বড়। রঙ্গনাথ এসেই ওর এককোণায় নিজের ব্যক্তিবাদ কায়েম করে নিল।
  • ranjan roy | 24.99.4.43 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:৫১574686
  • ও ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে এককোণায় একটা খাটিয়া আর বিছানা বেশ পাকাপাকি ভাবে বিছিয়ে নিল। পাশে রাখা আলমারিতে ওর বইপত্তর সাজানো হল। তাতে স্বপনকুমার মার্কা গোয়েন্দাসাহিত্য ও গুপ্ত সাহিত্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হল। ওর একপাশে ছোট্ট একটা টেবিল আর চেয়ার বৈদ্যজীর কলেজ থেকে এসে গেল। খাটিয়ার পাশে
    একটা জানলা। খুললেই চোখে পড়ে বাগান আর ক্ষেতের প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই পরিবেশ রঙ্গনাথের জীবনকে কাব্যময় করে তুলতে সাহায্য করছিল। ওদিকে তাকিয়ে ওর সত্যি সত্যি মনে হত যে ওর সামনে কত শত ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বেশ কিছু রবার্ট ফ্রস্ট, আর অসংখ্য গুরুভক্ত সিং এক অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছেন আর তাঁদের পেছনে অগুনতি স্থানীয় ও আঞ্চলিক সাহিত্যিক মুখে শিঙ্গে লাগিয়ে গাল ফুলিয়ে লাইন লাগিয়েছে।
    রূপ্পনবাবু কোথা থেকে গোটাকয় আধলা ইঁট আর কিসব টুকরো-টাকরা নিয়ে এসেছিল। সেগুলোকে জুড়ে-টুড়ে ও একটা রেডিও মতন বানিয়ে নিয়েছিল। কামরাটার মাথায় বাঁশ আর আসপাশের গাছের সাহায্যে লম্বা লম্বা তার জুড়ে এমন করেছে যে দেখলে মনে হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রান্সমিশন সেন্টার এটাই। কিন্তু ভেতরের রেডিওটুকু শুনতে একটা হেড ফোন লাগে। সেটা কানে লাগিয়ে রঙ্গনাথ কখনো কখনো স্থানীয় সংবাদ ও বৈষ্ণব সাধুসন্তদের কাঁদোকাঁদো ভজন শুনতো আর মেনে নিত যে অল ইন্ডিয়া রেডিও আগে যেমন ছিল তাই আছে। হাজারবার গাল শুনেও বেহায়াটা একটুও বদলায় নি।
  • ranjan roy | 24.99.71.179 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ১২:৫৩574687
  • রঙ্গনাথের রুটিন বৈদ্যজীর পরামর্শে ঠিক হয়েছিলঃ
    খুব ভোরে ওঠা, তারপর কল্পনা করা কি কাল রাত্তিরে যা খেয়েছ সব হজম হয়েছে( ব্রাহ্মে মুহূর্তে উত্তিষ্ঠেৎ জীর্ণাজীর্ণং নিরূপয়েৎ), তামার লোটায় রাখা বাসি জল পান করা, অনেক দূর হাঁটতে থাকা, তারপর নিত্যকর্ম করা( কারণ সংসারে এই একটা কর্মই নিত্য, বাকি সব অনিত্য), হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফেরা( পর চংক্রমণং হিতম্‌ ), হাতমুখ ধোয়া, দাঁতন করা( নিম্বব্স্য তিক্তকে শ্রেষ্ঠঃ কষায়ে বব্বুলস্তথা),ঈষদুষ্ণ জলে কুলকুচি করা( সুখোষ্ণোদকগণ্ডষৈঃ জায়তে বক্রত্বলাঘবম্‌ ),ব্যায়াম করা, দুধ খাওয়া, অধ্যয়ন করা, দ্বিপ্রাহরিক ভোজন, বিশ্রাম, অধ্যয়্ন, বিকেলে বেড়ানো, ফিরে সামান্য ব্যায়াম, বাদাম-মুনক্কা মিশ্রিত পানীয় সেবন, অধ্যয়ন, ভোজন, অধ্যয়ন, শয়ন।
    রঙ্গনাথ এই রুটিন বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলছিল।এতে শুধু একটু অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছিল। পড়ার টেবিলে বসার সময়টা মামা বৈদ্যজীর বৈঠকে 'গঞ্জহা'দের সংসর্গে কাটতে লাগল। রুটিনের এই 'ভ্রম সংশোধন'এ বৈদ্যজীরও কোন আপত্তি নেই কারণ রঙ্গনাথের বীর্য্য রক্ষা নিয়ে কোন আশংকা নেই। আর এতে রোজকার গোটা রুটিনে তেমন ইতরবিশেষ হচ্ছে না। উনি বরং এতে একটু খুশিই হলেন। এর ফলে ওনার দরবারে এক লেখাপড়াজানা ব্যক্তি সব সময় ওনার পাশে বসে থাকবে আর বাইরের লোকজনের কাছে পরিচয় দিতে ভাল লাগবে।
  • ranjan roy | 24.99.2.69 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৪:২৭574688
  • কিছুদিনের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হতে লাগল যে শিবপালগঞ্জের ব্যাপারটা খানিকটা মহাভারতের মত। অর্থাৎ, যা কোথাও নেই তা' এখানে আছে, আর যা নেই এখানে, তা নেই কোনখানে। ও বুঝতে পারল যে আমরা ভারতবাসী যেমন এক, আমাদের বুদ্ধিটুদ্ধিও সর্বত্র একইধরণের।
    ও দেখতে পেল-- যেসব রাজনৈতিক দাঁও-প্যাঁচ, পাঁয়তারা নিয়ে রোজ সমস্ত নামকরা খবরের কাগজ প্রথম পাতা জুড়ে বোল্ড টাইপে চেঁচামেচি করে, যার হাত ধরে বড় বড় কর্পোরেশন, কমিশন ও প্রশাসন ওঠেপড়ে, রগড়াতে থাকে, সেইসব প্যাঁচকষার অখিল ভারতীয় প্রতিভা এখানে কাঁচামাল হিসেবে পোচ্চুর এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এসব ভেবে ওর ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যে বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল।
    কিন্তু একটা দূর্বল জায়গা দেখা যাচ্ছে।
    শহরে নতুন ও পুরনো প্রজন্মের মধ্যে বিতর্ক একটা নতুন চেহারায় দেখা দিচ্ছে। কারণ পুরনোরা মনে করে যে শুধু ওরাই বুদ্ধিমান, আর তারপরে বিশ্বে বুদ্ধির ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই যে নতুন প্রজন্মকে কিছু দেয়া যাবে। ওদিকে বর্তমান প্রজন্ম মনে করে যে পুরনোরা অচল অনড়, অল্পে সন্তুষ্ট,সমাজের প্রতি সৎ নয়। আর আমরা চেতনাসম্পন্ন, গতিশীল এবং কখনোই সন্তুষ্ট হই না। আমরা নিজেদের প্রতি সৎ, কিন্তু সমাজের প্রতি নয়। কারণ সমাজ বলে কিছু নেই।
    এই সব ঝগড়াঝাঁটি-তর্কবিতর্ক মূলতঃ শিল্প-সাহিত্যের জগতে সীমিত ছিল। কারণ,অন্য সব ফিল্ডের তুলনায় শিল্প-সাহিত্যের জগত অনেক বিস্তৃত আর এখানে ঝগড়াঝাঁটিতে বাস্তবিক লোকসান খুব কম।
    পুরনো প্রজন্মের চোখে নতুনেরা মূর্খ আর নতুনের চোখে পুরনোর দল হল জোকার। এইসব লেবেল সাঁটা এমন বেড়ে গেছে যে শিল্পসাহিত্যের জায়গায় অন্য কিছু হলে নির্ঘাৎ সিভিল ওয়ার হয়ে যেত। রঙ্গনাথ অ্যাদ্দিন ভাবত যে শিবপালগঞ্জে এখনো এই দুই প্রজন্মের লড়াই শুরু হয় নি। কিন্তু একদিন ওর ভুল ভেঙে গেল, বুঝল যে রাজনীতির এই ময়দানেও এই গ্রাম পিছিয়ে নেই।
  • ranjan roy | 24.99.2.69 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১৪:৪৭574690
  • গল্পটা এক চোদ্দবছরের ছেলেকে নিয়ে। কোন এক বিকেলে কেউ বৈঠকে বসে শিবপালগঞ্জের ওই আশ্চর্য বালকের জীবনচরিত কীর্তন শুরু করে দিল। জানা গেল ওই বাচ্চাটার মধ্যে পাক্কা বদমাশ হয়ে ওঠার প্রতিভা এত তাড়াতাড়ি ফুটে উঠছে যে বড় বড় মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজতাত্ত্বিকের দল একে 'প্রভুর লীলা' মানতে বাধ্য হয়েছেন।বলা হয় যে আমেরিকা-ফেরৎ কিছু বিদ্বান ছেলেটার ব্যাপারে অনেক খোঁজখবর করেছেন। ওরা পরিবারের ভাঙ্গন, ভুল লালন-পালন, খারাপ পরিবেশ, অপরাধ জগতের সঙ্গে বংশপরম্পরায় যোগাযোগ গোছের বাঁধাধরা থিওরির ফ্রেমে ছেলেটাকে বাঁধতে চাইলেন। কিন্তু ছেলেটা ওই ফ্রেমের বাঁধনে নিজেকে ধরা দিতে কিছুতেই রাজি হল না। শেষে বিদ্বানেরা মানতে বাধ্য হলেন যে এটা প্রভূর লীলা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন