এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 203.108.233.65 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১১:৫৯628433
  • প্রথমে ভেবেছিলাম ব্যাপারটা কোনো দৈনিক সংবাদপত্রকে জানাবো। কিন্তু গুছিয়ে লেখা হয়ে উঠছে না। তার ওপরে এই ব্যাপারটা কোনো নতুন কিছু নয় - বহু বছর ধরেই চলে আসছে।
    প্রতিটি মানুষ - যারা এই কষ্ট সহ্য করেছেন - পরে আর এই নিয়ে বিশেষ উচ্যবাচ্য করেন না। করতে চান না।
    আমিও চুপ করেই থাকতে পারতাম। তবু মনে হলো লিখেই দিই। লিখছি।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:১১628444
  • সময়কালঃ- ২৬শে ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে ৩রা জানুয়ারী ২০১৪।
    ঘটনাস্থলঃ- শহর কোলকাতা

    ১। ২৬শে ডিসেম্বর ২০১৩

    কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের থেকে বার্থ সার্টিফিকেটের অনুলিপি বের করবার উদ্দেশ্যে ২৬শে ডিসেম্বর ২০১৩য় সকাল নটা নাগাদ আমি নিম্নোক্ত ঠিকানায় যাই।

    The Kolkata Municipal Corporation,
    5, S.N. Bannerjee Road, Kolkata - 700 013

    কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে (https://www.kmcgov.in/KMCPortal/jsp/KMCBirth.jsp) লেখা আছে যে Chief Mpl. Health Office's office হচ্ছে ঐ উপরোক্ত ঠিকানার 1st floor এ।

    এই বাড়ীটির যে গেটগুলো S.N. Bannerjee Road এর দিকে, সেগুলো সব বন্ধ এবং তালা মারা। ফলে একটু ঘুরে গিয়ে প্রধান গেট (যেটার পাশে কয়েকটা ব্যাঙ্কের এটিএম রয়েছে) দিয়ে বাড়িটির চত্ত্বরে প্রবেশ করলাম। অল্প এগিয়ে খোলা আকাশের নীচে। একজনকে জিগ্যেস করলাম বার্থ সার্টিফিকেটের অফিস কোথায়?
    তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এত দেরী করে এসেছেন- এখন কি আর লাইন দিতে পারবেন?
    - কেন? অফিস কখন খোলে?
    - খোলে তো নটায় কিন্তু ভোর থেকেই লাইন পড়ে যায়। যাইহোক ঐ তিন তলায় উঠে যান।
    প্রায় দৌড়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়েও থেমে যাই। ফের ঐ ভদ্রলোককে শুধোই - দাদা ফর্ম 24H কোথায় পাবো? শুনেছি ওটা ফিলাপ করে নিয়ে যেতে হয়।
    - যা ফর্ম দেবার ঐ ওখানেই দেবে।
    উনি ফের প্রায় আকাশের দিকে আঙুল দেখান। বুঝে যাই তিনতলাতেই ফর্ম পাবো।
    সিঁড়ির সামনে গিয়ে দেখি সটান তিনতলায় উঠে গেছে সিঁড়ি। উঁচু উঁচু ধাপ। কোনো বাঁক কেই, কোনো মোড় নেই। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি তাই প্রতিটি তলার উচ্চতা ভালোই। পাশাপাশি দুজন চলতে পারেন এমন প্রস্থের সিঁড়ি।
    কিছুদূর উঠেই হাঁফ ধরে যায়। একজন নেমে আসছিলেন তাঁকে শুধোই - আচ্ছা ওপরে উঠবার লিফট আছে কোথাও?
    তিনি দায়সারা উত্তর দেন- আছে।
    - কোথায়, কোনদিকে একটু বলবেন প্লীজ?
    - লিফট্‌ দশটার আগে খুলবে না।
    তিনি নীচে নেমে যান।
    আমি উঠতে থাকি।
  • | 127.194.81.151 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৩:১৩628455
  • পড়ছি। তারপরে?
  • ম্যামি | 69.93.209.172 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৪:০২628466
  • তারপর?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০১:০৯628477
  • আন্দাজ কম বেশি পঞ্চাশ শাট ধাপ উঁচু উঁচু সিড়ি ভেঙে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। কিন্তু ওপরে উঠেই সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাতারে কাতারে মানুষ। প্রকান্ড সেই সাবেকি আমলের বারান্দায় রাশি রাশি মানুষের জটলা। ভিড়ের মধ্যে কোথায় যাবো, কোথায় লাইন, কীসের লাইন, লাইনের শুরু কোনটা, শেষ কোনদিকে - ঠাওর করতে হকচকিয়ে যাই।
    কোনোমতে ঠেলে ঠুলে বারান্দার গায়ে গায়ে যে দরজাগুলো রয়েছে তারই একটার কাছে পৌঁছতে পারি। সেখানেও প্রবল বাধা। দরজার পাহারায় একজন পিওন যুবক। আমায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে চতুর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সোজা তাকায় আমার চোখে। একটাও কথা বলে না।
    কথা বলি আমি - দাদা বার্থ সার্টিফিকেটের ফর্ম কোথায় পাবো?
    - কেন?
    - মানে বার্থ সার্টিফিকেটের জন্যে এসেছি, তাই।
    - লাইনে দাঁড়ান, সরে যান এখান থেকে।
    - লাইন কোনটা?

    সে আর কোনো উত্তর দেয় না। শরণার্থীদের মতো যারা দেয়াল ঘেঁষে সেই পিওনের দিকে ভয়ে ভক্তিতে তাকিয়ে রয়েছে তাদের একজনকে প্রশ্ন করি "বার্থ সার্টিফিকেটের ফর্ম কোথায় পাবো বলতে পারেন?"
    - ফরম তো জানি না। এই লাইনের শেষে দাঁড়ান।
    লাইনের শেষ খুঁজতে হাঁটা দিই দক্ষিণ দিক বরাবর। বারান্দা শেষ হয়ে যায়। লাইন চলছেই। বারান্দা শেষে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ করিডোর ঐ বাড়ীর ভেতরের ঘরগুলোর পাশে পাশে অল্প জায়গা, সেখানেও লাইন। তারপরে ফের পূর্ব দিকে আরেকটা বারান্দা। এটা অনেক সরু। সেই বারান্দার একপ্রান্তে লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াই।
    আমার সামনে এক কিশোরী। আমি ঠিক তার পরেই। আরেকবার শিওর হয়ে নিতে তাকে জিগ্যেস করি, এটাই বার্থ সার্টিফিকেটের লাইন কিনা।
    সে বোরখার ফাঁক দিয়ে আমায় দেখে হেসে বলে, "এটাই তো লাইন।" তারপরে আমায় জিগ্যেস করে, "কার সার্টিফিকেট? আপনার বাচ্চার?"
    - না। আমার নিজের।
    - হাঁ?
    - হ্যাঁ।
    এই শুনে সে খিলখিলিয়ে হাসে।
    - অস্‌পতালের কাগজ আছে?
    এই সমস্ত তথ্য বিনিময় করে আমরা সময় কাটাতে থাকি। লাইন এগোয় না। বরং আমার পেছনে আরো জনা দশেক মানুষ লাইনে সামিল হন।
    এতে আমার ভরসা বাড়ে - আর যাই হোক সবার শেষে নই আমি, আমার পরেও লোক আছে।
    কিশোরীটি এই ফাঁকে জানায় তার বাচ্চার বয়েস পাঁচ। সে এখন তার বাচ্চার কম্পুটারাইজড্‌ বার্থ সার্টিফিকেট নিতে এসেছে। বাচ্চাকে স্কুলে দিতে হবে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০২:৪৪628488
  • প্রায় দশটা বাজতে চলে। আমরা তখনো এক ইঞ্চিও এগোই নি। এর মধ্যে অপেক্ষারতদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে করে জানা যায় যে দিনে একশ টা বার্থ সার্টিফিকেট বরাদ্দ। লাইনে একশজনের বেশি নাকি নেয় না।
    তবে? আমরা তো অনেক পেছনে। কত নম্বরে আমি? একবার গিয়ে গুনে দেখে আসবো?
    সেই প্রায় কিশোরী মা টিকে বলি - আমার লাইনটা একটু দেখবেন?
    পেছনের লোকটিকেও বলি - দাদা ৫ মিনিটের জন্যে একটু লাইনটা দেখবেন?
    গুনতে গুনতে এগোই সামনের দিকে। একশ পেরিয়ে যায় - লাইনের মুখ তখনো বেশ কয়েক হাত দূরে।
    হঠাৎ ভয়ঙ্কর হৈ চৈ, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। দৌড়ে নিজের জায়গায় চলে যাই আমি।
    যা বোঝা যায়। এক এক করে নম্বর অনুযায়ী লাইনটা এগোচ্ছে তাই অমন ধাক্কাধাক্কি লেগে গেছল।
    এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে গেলাম আমি।
    সেই পূবের বারান্দা ফারান্দা পেরিয়ে, সংকীর্ণ করিডোর পার করে মূল বারান্দার শেষপ্রান্ত অবধি পৌঁছনো গেল।
    সামনে তখনো গোটা পঞ্চাশ বা ষাটেক লোক। আশা জাগে প্রাণে। আমার পেছনেও তখন লম্বা লাইন।
    এবার বেশ উঁচু গলায় ধমকের আওয়াজ শোনা যায়। কে এত ধমকায়? কাকেই বা?
    ধমকানির আওয়াজ কাছে আসে।
    সেই পিওন যুবক। খুব শাসাচ্ছে আমাদেরকে। এবার সে শেষবারের মতো আমাদের গুনে গুনে নম্বর দেবে। বেগড়বাঁই দেখলে লাইন থেকে ধরে ধরে বের করে দেবে।
    আমরা কেউ তার এই ব্যবহারের প্রতিবাদ করি না। চুপচাপ ভয়ে ভয়ে তার পানে করুণা ভিক্ষার চোখে চেয়ে থাকি।
    সেই অসম্ভব ক্ষণে কেন জানিনা অদ্ভুত একটা স্মৃতি, একটা সিনেমার দৃশ্যের স্মৃতি চকিতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই সিনেমাটার নাম মনে নেই, তবে দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের ওপর। সারি সারি ইহুদীরা অসহায় ভাবে লাইন দিয়ে রয়েছে। তাদের পাশ দিয়ে গটমট করে সামরিক ইউনিফর্মের কেউ দাবড়ে শাসিয়ে হুমকি দিতে দিতে যাচ্ছে। এটা কোনো সিনেমা হতে পারে, হতে পারে কোনো ডকুমেন্টারি ক্লিপ। মনে নেই। এমন অসংখ্য সিনেমা দেখেছি, নাম মনে নেই। তবে এই দৃশ্যটাই কেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে? ভয়ে কুঁকড়ে থাকি বাকি সবকটা অপেক্ষারতদের সঙ্গে আমি নিজেও।
    আমাদের দাবড়ে ধমকে শাসাতে শাসাতে লোকটা এগোয়, আর আমরা হাতের কাগজপত্র তাকে "চেক" করাতে দিই। সেই কাগজ দেখে তবেই সেই পিওন যুবক ঠিক করবে যে এই লাইনে দাঁড়াবার যোগ্যতা আমাদের মধ্যে কার কার আছে, কার কার নেই।
    আমরা একজনও তার সেই অমার্জিত অসভ্য ব্যবহারের প্রতিবাদ করিনা। শুধু করুণাপ্রার্থীর মতো করজোড়ে তার হাতে নথিপত্র তুলে দিতে থাকি। যে মুরুব্বির মতো সেগুলো চেক করে, তারপরে হয় নম্বর বলে দেয় অথবা লাইন থেকে বের করে দেয় কর্কশ তিরষ্কার করে। আমরা হিন্দু মুসলমান বা অন্যধর্মী কেউ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলেই চুপ করে থাকি - কেউ এই অন্যায় অভদ্রতার বিরুদ্ধে রা কাড়ি না।
    এই লাইনের মানুষগুলোকে কোন সেগমেন্টে ফেলবো?
    একটা জিনিস প্রায় সকলেরই খুব কমন হিন্দু মুসলমান নির্ব্বিশেষে - ফর্সা কাপড় প্রায় দেখাই যায় না। খুব খুব কম। আতর - ডিয়োডেরেন্টের গন্ধও নেই। আছে ময়লা কাপড়ের গন্ধ, শীতকাল হলেও ঘামের গন্ধ। এরাই আমার সহ নাগরিক। আমার ভারতবর্ষের মানুষ। জন্মপত্রিকা সংগ্রহ করবার জন্যে এদের কাছে এর চেয়ে সহজ কোনো অল্টারনেটিভ নেই।
    পরিচ্ছন্ন পরিষ্কার দামী পোশাকের লোকজন সত্যিই খুঁজে পাই না যেন। শুধু গরীবগুলো সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে নাকি? বড়োলোকেদের ঘরে বাচ্চা জন্মাচ্ছে না? তাও আবার হয় নাকি? তাদের দেখছি না কেন এই লাইনে?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০৩:১১628499
  • নেভী ব্লু পুলোভার পরা কোলকাতা পুলিশের তিনজন সাব ইন্স্‌পেক্টর গটগট করে আমাদের পাশ দিয়ে টহল দিয়ে যায়। বেয়াদপি করলে আমরা উপযুক্ত সাজা পাবো সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। শান্তি শৃঙ্খলার জন্যে পুলিশ দরকার। লাইনে মেয়েরা রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে একজন মেয়ে পুলিশও কটমটিয়ে তাকাতে তাকাতে টহল দেয়।
    যে চুড়ান্ত অপরাধে আমরা অপরাধী, তার বিচারের সময় আসন্ন।
    পিওন যুবক এবার আমার নথিপত্র পরীক্ষা করে। সমস্ত কিছু দেখবার পরে বলে - এখানে দাঁড়িয়ে কিছু হবে না শুধু সময় নষ্ট হবে। আপনি তো শুধু কপি নেবেন বলে এসেছেন সেটা যে কোনো বরো থেকে পেয়ে যাবেন।
    - সত্যি!
    আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। এই ভয়ঙ্কর অত্যাচারের দিন তবে শেষ? (এটা মুখে বলি না)।
    - আপনি বরো ৬ এ চলে যান, এই পাশেই।
    - ঠিকানা? এই বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে কোন দিকে?
    - বিল্ডিং থেকে বেরোতে হবে না। এই বারান্দা দিয়ে গেলেই (সেই পূবের বারান্দার দিকে দেখায়) দেখতে পাবেন। যান যান এখানে দাঁড়াবেন না।
    - দাঁড়াবো না?
    - আপনার খুসি। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকুন। ওদিকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন।
    পিওন যুবককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমি পূবের বারান্দার দিকে প্রায় উড়তে উড়তে যাই।
    যাবার পথে কানে ভেসে আসে সে আরেকজনকে তুমুল দাবড়াচ্ছে। কোন অপরাধে দাবড়ায় সেটা শুনবার অপেক্ষা করি না।
    পূবের বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখি সেটা এই বাড়ীর শেষ সীমানা। তিনতলার সেই বারান্দার শেষে কোলাপ্সিবল্‌ গেট। তাতে গোব্দা সাইজের গোদরেজের তালা মারা। সেই তালার চাবি কার কাছে জানি না। তবে আশার আলো এই যে সেই গেটে বাইরে দেখা যায় ঝুলন্ত সরু একটা কানেক্টিং বারান্দা গিয়ে মিলেছে রাস্তার ওপারে একটা বাড়ীতে। দূর থেকে সেই বারান্দার ওপারের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সম্যক ধারনা হয় না।
    জানতে ইচ্ছে হয় বরো ৬ এ যাবার পথ কি একমাত্র এই সরু নড়বড়ে ঝুলন্ত প্রাচীন বারান্দা? আর কোনো পথ নেই?
    এই বারান্দার ওপ্রান্তে যাবার উপায় হবে কেমন করে? কার কাছে আছে চাবি?
    - জানেন কখন খুলবে এই দরজা?
    আমার মতো অপেক্ষারত কয়েকজন এই প্রশ্নই করে চলে বারবার। কাকে প্রশ্ন করে কে জানে। উত্তর দেবার কেউ নেই।
  • π | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ০৯:৫৮628504
  • তারপর ?
  • | 127.194.86.152 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:২৯628505
  • কী সাঙ্ঘাতিক। ঃ(((
  • ম্যামি | 69.93.193.202 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:৪৩628434
  • দারুন লাগছে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৫:২৭628435
  • দাঁড়িয়ে থাকি। হাঁ করে চেয়ে থাকি সেই ঝুলন্ত সেতুর দিকে। ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকে।
    একবার মনে হয় এই বাড়ী থেকে বেরিয়ে পাশের ঐ বাড়ীতে বরো ছয় এ যাই। কিন্তু তাহলে এই লাইন তো চলে যাবে। দ্বিধায় পড়ে যাই। শুধু ধৈর্য চাই এখন। ধৈর্য।
    একপাশে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার মেঝেয় গাঁথা। তাতে কয়েকজন অপেক্ষারত। তাদেরও শুধোই জানেন কখন খুলবে এই গেট?
    আরো বেশ কয়েকজন সেখানে ঘোরাঘুরি করে। বসে থাকা একজন সেইখানেই একজনকে ঠাট্টার গলায় বলে - কীরে চাবি কোথায়? চাবি আনবি না?
    সে উত্তর দেয় হেসে - আরে বোলো না ওদিকে ডাকছে, তার ওপরে ... এরপরে বড়দিনের ছুটিতে কোথায় পিকনিকে গেছল সেনিয়ে কীসব বলে।
    - যা এবার চাবিটা নিয়ে আয়।
    মোটকথা বুঝি এই অপেক্ষারতদের সকলেই বহিরাগত নয়। ভিড়ে মিশে আছে ভেতরের চেনাজানা লোকেরাও।
    এগারোটা বেজে যায়।
    আগের সেই লাইনের দিক থেকে হুঙ্কারের শব্দ শোনা যায়, আজকের মতো আর ফর্ম দেওয়া হবে না।
    হন্তদন্ত কয়েকজন এদিকে ছুটে এসে খোঁজখবর করে।
    তার মধ্যে একজন বলে, এইটাই কি ফর্মের লাইন? ওদিকের লাইনে আর নিচ্ছে না। এখন কি এখান থেকে দেবে?
    - কী চাই আপনার?
    - ডেথ সর্টিফিকেট?
    - না না, ডেথের লাইন এদিকে নয়।
    - ডেথ বার্থ একটাই লাইন নয়?
    - ডেথের জন্যে ঐ বারান্দার একদম শেষের দিকে লাইন আছে। সেখানে যান।
    তীর বেগে ডেথের লাইন লক্ষ্য করে সে ছুটে যায়।
    এবার কথা ওঠে যে এগারোটার পরে নাকি কোনো বরোতেই ফর্ম দেওয়া হয় না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাই বৃথা হবে।
    আস্তে আস্তে ভীড় কমতে থাকে। ঝুলন্ত সেতুর কোলাপ্সিবল্‌ গেট খুলে দিতে কেউই চাবি হাতে এগোয় না।
    ভারাক্রান্ত মনে আমি পিছু হাঁটি। পূবের বারান্দার শেষে সেই মূল বারান্দার শেষপ্রান্তে নজরে পড়ে পুরোনো আমলের লিফ্‌ট্‌। সেটা এখন চলতে শুরু করেছে। ঐ খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামবার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। লিফটের জন্যে অপেক্ষা করি। ঐ বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ভাবি, এই নরকে আর নয়। অন্য কোনো বরো থেকে সংগ্রহ করে নেবো বার্থ সার্টিফিকেট। সকাল সকাল যাবো। জানা তো রইলই প্রসেসটা।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:২৬628436
  • ২। ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৩

    আগেরদিনের ভারাক্রান্ত মন, দুর্ব্যবহার, অসহায়তা, সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে নবোদ্যমে বেহালার ম্যান্টনের দিকে বরো ১৩-১৪য় (দুটোই একই জায়গায়) উপস্থিত সকাল আটটা নাগাদ।
    অফিস তখনো খোলেনি। আরও সুখবর যে লাইন তখনো পড়ে নি। যদি লাইন পড়েও, সবার সামনে তো থাকবো আমি। চিন্তা কি?

    কিছুক্ষন সেই বন্ধ অফিসযুগলের সামনে হাঁটাহাঁটি করি। তারপরে একটু ফাঁক পেয়ে কেয়ারটেকার গোছের একজনকে জিগ্যেস করি এখানে কি বার্থ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়?
    - না, পাশের বিল্ডিং এ যান।
    তড়িঘড়ি উত্তরদিকে তিরিশ চল্লিশ পা হেঁটে পাশে বিল্ডিং। সেখানেও কেয়ারট্কার/দারোয়ান গোছের একজন।
    তাকেই জিগ্যেস করি - দাদা এটাই তো বরো ১৩/১৪?
    - কী চাই?
    - বার্থ সার্টিফিকেট।
    - হাসপাতালের কাগজ আছে?
    - আজ্ঞে হাসপাতালের কাগজ তো নেই, কিন্তু...
    - তাহলে কীকরে হবে? হাসপাতালের কাগজ লাগবেই।
    - আজ্ঞে হাসপাতালের কাগজ কোত্থেকে পাবো? বার্থ সার্টিফিকেটের ফোটোকপি রয়েছে তো!
    - তাহলে আবার বার্থ সার্টিফিকেট চাইছেন কেন?
    - আরেকটা দরকার।
    - কেন? কপি দিয়েই কাজ চলে তো। আসলটা হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?
    (ভয় হয়, হারিয়ে ফেলেছি বললে আবার না জানি কী বিপদে পড়তে হবে)
    - না মানে আরেকটা কপি পাওয়া কি সম্ভব নয়? ধর্মতলার কর্পোরেশন অফিসে যে বলল যেকোনো বরো থেকেই দিতে পারে।
    - কই আপনার জেরক্স কপি দেখি।
    আমি কম্পিউটারাইজড্‌ জেরক্স কপি দেখাই।
    তিনি খুঁটিয়ে সেই কাগজটা দেখে নিয়ে বলেন, - না, এ জিনিস এখান থেকে পাওয়া যাবে না। আপনার বার্থ কি এই বরোর আন্ডারে হয়েছে?
    - না বোধহয়। আমি জন্মেছি ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইডেনে।
    -ও। (তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন, তারপরে...), নাঃ এ আমাদের এখান থেকে আপনি পাবেন না।
    - তবে কোত্থেকে পাবো?
    - যে বরোর আন্ডারে জন্মেছেন, তারা দিতে পারে?
    - কোন বরো কীকরে বুঝবো?
    তিনি সেই জেরক্স কপির অস্পষ্ট রাবারস্ট্যাম্পের ছাপ দেখে বললেন - বরো আট। এইতো পড়া যাচ্ছে।
    আমিও যেন অস্পষ্ট রোম্যান আট অক্ষরটা পড়ে নিলাম।
    - বরো আট কোথায় দাদা?
    - এইটা আমাকে জিগ্যেস করবেন না।
    - কেন? বলা বারণ?
    - বারণ কেন হবে? কোথায় কোনদিকে কী বরো আছে তার অ্যাড্রেস আমরা দিই না। আপনি ইন্‌ফরমেশনে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
    -ইন্‌ফরমেশন কখন খুলবে?
    - তা দশটা সাড়ে দশটা হবে।
    হিসেব করে দেখলাম, দশটা সাড়ে দশটায় ইন্‌ফরমেশন পেলে এই শহরের অন্য কোনো বরোতেই আমি এগারোটার আগে পৌঁছতে পরব না। ফর্ম পাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার।
    টোটাল কটা বরো কোলকাতায়? হেড অফিস বাদ দিয়ে বরো ছয়, তেরো ও চোদ্দো ঘোরা হয়ে গেল।
    বরোগুলোর ঠিকানা কি ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে না? আগামী কাল? ২৮শে ডিসেম্বর? একবার কনফর্ম তো করে নিই।
    - আচ্ছা দাদা, একটা লাস্ট প্রশ্ন, এই বরো আটে যদি কালকে যাই, তাহলে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়, বলুন?
    - কালকে তো শনিবার।
    - শনিবার বন্ধ?
    - বন্ধ নয়, তবে শনিবার তো। বুঝতেই পারছেন। তার ওপরে এখন ছুটির টাইম। আপনাকে বলছি সেকেন্ড জানুয়ারীর আগে যাবেন না।

    ফিরে গিয়ে প্রথমেই ইন্টারনেট থেকে বরোগুলোর ঠিকানা টুকতে থাকি। মোট পনেরোটা বরো আছে, তার মধ্যে তিনটে হয়ে গেছে। হাতে রইলো বারো।
    ইন্টারনেটেও দুরকমের ইন্‌ফরমেশন পাওয়া যায়।
    একটা লিঙ্ক বলছে এইরকমঃ
    https://www.kmcgov.in/KMCPortal/jsp/KMCBirth.jsp
    Sl. No. Borough Address
    1 I 10, B.T. Road, Cossipore, Kolkata - 700 002
    2 II 79, Bidhan Sarani, Kolkata - 700 006
    3 III 109, Narkeldanga main Road, Kolkata - 700 014
    4 IV 213/B, Chittaranjan Avenue, Kolkata - 700 006
    5 V

    22, Surya Sen Street, Kolkata - 700 012

    (a) W-36, WHU-36, 10 Hansi Street, 2nd Floor
    (b) W-37, WHU-37, 92 Baithak Khana Road, 1st Floor
    (c) W-40, WHU-40, 22,Surya Sen Street
    (d) W-41, WHU-41,25,Balmukund Maccar Rd
    (e) W-42, WHU-42,under the Fly Over on Raja Woodment Street
    (f)) W-43, WHU-43,128, M.G. Road
    (g) W-44, WHU-44,1, Nilmadhab Sen Lane
    (h) W-45, WHU-,under the Fly Over on Raja Woodment Street
    (i) W-48, WHU-48, Medical College Hospital
    (j) W-49, WHU-49, 34, Surya Sen Street
    (k) W-50, WHU-50,27/1 Sashi Bhusan Dey Street

    6 VI

    1. NRS Hospital
    2. WHU 46+47 - 16, Jadunath Dey Rd
    3. WHU 51+52, Raja Subodh Mallick Sq
    4. WHU 54+55 & 60 - 3, Girish Bose Road,Kol-14(Taltala Dispensary)
    5. WHU 53+61+62, 21, Hazi Md Moh Sqn (Hazi Disp)
    7 VII 1. WHU-59, P-65, Sundari mohan Ave, Kol 14
    2. WHU-63, 9/1, A.J.C. Bose Road, Kol-17
    3. WHU-66, 38, Sreedhar Roy Rd
    4. WHU-58, 12, Gobindo Ghattick Rd, Kol-46
    5. WHU-85, 3A, Dover Terrace, Kol-29
    6. WHU-56, 48, Radhanath Chowdhury Rd, Kol
    7. WHU-68, 175/2, Rashbehari Ave, Kol-29.
    8 VIII

    1. 36.Ballygunge Circular Road
    2. Tiljala Road
    3. Ladian Park, 3, Ramamoy Road
    4. 118, Hazra Road
    5. 26. Debenda Ghosh Rd, Bhowanipur, Kol-25
    6. Vivekananda Park (Br Office Gr. Floor)
    7. Southern Avenue
    8. 1, Panchanantola Road
    9 IX

    1. Belvedere Road, Kolkata - 700 027
    2. 59, Dr. Sudhir Bose Road
    3. 2, Hide Road
    4. 103, Tollygunge Road
    5. Bhukailash Roj Bari
    10 X 217, Prince Anwar Shah Road, Kolkata - 700 033
    11 XI Atabagan Health Centre, Garia, Kolkata - 700 084
    12 XII 47, Garia Main Road, Kolkata - 700 075
    13 XIII 2, Raja Rammohan Roy Road, Kolkata -700 008
    14 XIV 516, Diamond Harbour Road, Kolkata - 700 024
    15 XV

    E 3, Circular Garden Reach, Kolkata - 700 024
    WHU - 135, Shyama Charan Pal, KMC
    WHU - 134, G.R. Mat Home, B3, P.D. Jaan Lane
    WHU - 138, Karbala Railline (Battala) (Santoshpur Rly goods office)
    WHU - 139, Kashyapara
    WHU - 140, Khaldhari Mullick Para
    Chief Mpl. Health Office's office The Kolkata Municipal Corporation,
    5, S.N. Bannerjee Road, Kolkata - 700 013.(1st floor)
    তো অন্য লিঙ্ক বলে এইরকমঃ
    https://www.kmcgov.in/KMCPortal/jsp/BoroughOffices.jsp
    Borough No. Office Address Phone Nos.
    I 10, B. T. Road, Kolkata - 700002 2557-4232
    II 79, Bidhan Sarani, Kolkata - 700006 2555-9081, 2555-9111
    III 109, Moulana A. K. Azad Sarani, Kolkata - 700054 2352-9955, 2352-8851
    IV 213B, C. R. Avenue, Kolkata - 700007 2272-2933
    V 22, Surya Sen Street, Kolkata - 700009 2241-3715, 2241-3741
    VI 1, Hogg. Street, Kolkata - 700087 2286-1034
    VII 9/1A, A. J. C. Bose Road, Kolkata - 700017 2247-6635
    VIII 172/5, Rash Behari Avenue, Kolkata - 700029, (Triangular Park) 2466-6766, 2465-2860
    IX 11, Belvedere Road, Kolkata - 700027 2479-1833
    X 28, Prince Anwar Shah Road, Kolkata - 700033 2422-9043
    XI Baghajatin Mkt. Complex, Unit - 3, Baghajatin Stn. Road, Kolkata 2425-8138
    XII 97 & 98, Garfa Main Road, Kolkata - 700075 2418-0646, 2418-1857
    XIII 516, Diamond Harbour Road, Kolkata - 700034 2468-1034, 2468-0135
    XIV 516, Diamond Harbour Road, Kolkata - 700034 2468-1034, 2468-0135
    XV E/3, Circular Garden Reach Road, Kolkata - 700024 2469-6049

    কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল বুঝবার উপায় নেই।
    সেকেন্ড লিস্টটা অপেক্ষাকৃত বিশাসযোগ্য লাগে কারণ সেখানে বরো ১৩/১৪ র ঠিকানা আমি নিজেই যাচাই করে ফেলেছি।
    প্রথম লিস্টে ১৩/১৪ র ঠিকানা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো, পিনকোডও নাকি ৭০০০২৪(!)
    দুনম্বর লিস্টাটাকে সম্বল করে শুরু হয় আমার বরোযাত্রা।
    বরো আট হবে আমার পরবর্তী গন্তব্য। ঠিকানা বলছে 172/5, Rash Behari Avenue, Kolkata - 700029, (Triangular Park) 2466-6766, 2465-2860
    সঙ্গে ফোন্নং ও রয়েছে।
    একবার ফোন করে যাচাই করে নেবো?
    ফোন শুধু বেজে যায়। বেজে বেজে বেজে বেজে লাইন কেটে যায়। চেষ্টার অন্ত রাখিনা ফের ডায়াল করি। এর পরে ফোন বেজেই কেটে যায়।

    আমার রোখ চেপে গেছে। ২০১৩য় হোলো না তো কী হয়েছে?
    ২০১৪র দোসরা জানুয়ারী নবোদ্যমে শুরু হবে বার্থ সার্টিফিকেট অভিযান। গন্তব্য বরো আট।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৭:১৪628437
  • ৩। ২রা জানুয়ারী ২০১৪

    আমি প্রস্তুত। বার্থসার্টিফিকেটের অনুলিপি, নাগরিকত্বের (এক্ষেত্রে আধার কার্ড বা পাসপোর্ট) প্রমাণের অরিজিনাল ও অনুলিপি, একটা লিখিত দরখাস্ত (যদি দরকার হয়) ফোটো সহ।
    সেইসঙ্গে রয়েছে যাবতীয় বরো অফিসের তালিকা (ঠিকানা সহ), বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করবার ফি (১০০ টাকা প্রতি অনুলিপি) এবং আরো একটি প্রয়োজনীয় তথ্য। এই কাগজটিও প্রতিবারই হেড অফিস বা বরো অফিসে দেখাতে চেয়েছি, কিন্তু এরা "দেখতে" চায় না।
    সেটা হচ্ছেঃ
    https://www.kmcgov.in/KMCPortal/jsp/KMCBirthRecordSearch.jsp
    এই লিঙ্কে গিয়ে তারকা চিহ্নিত খোপের প্রথমটায় পিতার পদবীর প্রথম তিন অক্ষর, দ্বিতীয়টায় মাতার পদবীর প্রথম তিন অক্ষর, ও শেষ খোপটা জন্মের তারিখ দিয়ে
    Birth Registration Details
    Father's Name* (atleast 3 chars):
    Date Of Birth*(dd/mm/yyyy):
    Mother's Name*(atleast 3 chars):
    সাবমিট বাটনটা ক্লিক করলে একটা লিস্ট আসবে।
    সেই লিস্টে পাওয়া যাবে নিমলিখিত তথ্য।
    Child Name Child Sex Date Of Birth Father Name Mother Name Regn No Registration Year Institution Name

    অধিকাংশ ক্ষেত্রেই Child Name এর তলায় NEW থাকে। আমার ক্ষেত্রে জন্মের সময়েই নামকরণ হওয়ায় নাম পদবী দুটোই বর্ত্তমান। Child Sex (কী এর অর্থ!!) এর তলায় MALE বা FEMALE জন্মের সময় যেমন বোঝা গেছে, (তৃতীয় লিঙ্গের ঠাঁই নাই) তারপরে Date Of Birth, Father Name, Mother Name এই খোপ গুলোর তলায় জন্মের তারিখ, বাবার নাম পদবী, মায়ের নাম পদবী, Regn No এর নীচে একটা সংখ্যা যেটা দেখে বার্থ রেকর্ড খুঁজতে সুবিধে হওয়া উচিৎ, Registration Year এর নীচে যে বছর জন্ম নথিভুক্ত করা হয়েছে। আমার ক্ষেত্রে জন্মের সময়েই কাজেই একই বছর। (ডিসেম্বরের শেষ তারিখগুলোতে যারা জন্মায় তাদের ক্ষেত্রে সরকারী হাসপাতালে হলেও, রেজিট্রেশনের সাল অন্য হতে পারে)। Institution Name হচ্ছে যেখানে শিশুটির জন্ম। তা সরকারি/বেসরকারি প্রসূতি সদন হতে পারে, বা তার বাইরে। যেমন বাড়িতে, রাস্তায়, ট্রেনের মধ্যে, ইঃ। সেক্ষেত্রে কোনো বরোর এক্তিয়ারের মধ্যে শিশুটির জন্ম হচ্ছে সেই বরোর সংখ্যা লেখা থাকবে।
    আমার নিজের বার্থ রেকর্ডের এই তথ্যের প্রিন্ট আউট সঙ্গে করে নিয়ে নিই।
    কোথা থেকে বিপদ আসবে জানা তো নেই।
    সকাল আটটায় ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে শরৎ সমিতির অফিস ঘেঁষে এই ঠিকানায় উপস্থিত হই।
    172/5, Rash Behari Avenue, Kolkata - 700029, (Triangular Park)
    পাশেই সুলভ কমপ্লেক্স।
    একবার তাও মিলিয়ে নিই ঠিকানাটা। হ্যাঁ। বরো আটই লেখা রয়েছে বাড়িটার গায়ে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৭:২৬628438
  • যা আশা করা যায় নি তেমনটাই হয়। এটা বরো আট হলেও, এখান থেকে বার্থ সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।
    এটা আমাকে জানান স্থানীয় কর্মচারী।
    তবে কোথা থেকে দেওয়া হবে?
    Vivekananda Park এর বরো অফিস থেকে।
    তাড়াতাড়ি আমার সেই বরো ঠিকানার লিস্টে চোখ বুলিয়ে নিই।
    এখন বোঝা যাচ্ছে এক নম্বর লিস্টটাও মাঝে মাঝে ঠিক।
    এই অফিস খুব বেশি দূরে নয় মোটামুটি আধ কিলোমিটারের মধ্যেই। একে ওকে তাকে জিগ্যেস করে করে পৌঁছে যাই।
    তখনো সাড়ে আটটা বাজেনি। আমার আগে জনা বিশেক শরণার্থী। পাশেই চায়ের দোকান। রাস্তার ওপরেই ফুটপাথে অপেক্ষা। অফিসের ভেতরের দিকটায় সারদিয়ে হাতে ঠেলা দুচাকার জঞ্জালের গাড়ি গ্যারেজ করা রয়েছে। এগুলো নতুন নয়, সবকটাই ব্যবহৃত এবং জঞ্জালের চিহ্ন বহন করছে।
    যে ঘর থেকে 24H পাওয়া যাবে তার সবটাই দেখা যায়। শুধু গ্রীলের গরাদ। জানলায় কোনো পাল্লা নেই।
    অফিসের বাবুরা আসবেন নটার পরে।
    আমরা অপেক্ষা করি। হ্যাপি নিউ ইয়ার।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৮:১৭628439
  • লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে এক ভাঁড় চা হয়ে যায়। অন্য দিকটায় রয়েছে ভাতের হোটেল। দুপুর দুটো আড়াইটে তো হবেই কাজ চুকতে চুকতে। লাইন বাড়তে থাকে জনা ষাট সত্তর হবার পরে লক্ষ্য করি নটা বেজে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। তারপরে সাড়ে নটা। দশটা। অফিস খুলবে কখন দাদা?
    - আরে এখনো তো তেমন লোক হয় নি। দেখলেন তো এসে দেখে ঘুরে গেল। ওয়েট করছে। আরো লোক হোক।
    - সেকী!
    - হ্যাঁ আমার এই নিয়ে দেড় বছর হোলো। তবে দেড় বছর রেগুলার আসিনি আমারই দোষ। ছুটি পাওয়া ঝামেলা। টেম্পোরারি করি তো। ডিউটি কখন থাকবে সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। অন্য অন্য দিনগুলোয় ও ও ও ই মোড় ছাড়িয়ে যায় লাইন। আপনি আজ ফার্স্ট?
    -এখানে আজ ফার্স্ট। আগে দুদিন অন্য বরো অফিস ঘুরেছি।
    -কত বয়েস বাচ্চার? দেড় দুবছরের আগে দেবে না দেখে নেবেন। ও ঠিক ঘুরে আসতে বলবে।
    -বাচ্চার নয়, আমার নিজের।
    - ওরে বাবা তাহলে তো খাওয়ানো ছাড়া উপায় নেই।
    - আরে না না। আমার সার্টিফিকেট ছিলো, আরেকটা কপি নেবো।
    -কালার জেরক্স করিয়ে নিন। এসব জায়গায় আসাটাই পাপ। সেই যে বলে না গঙ্গাসাগর একবার। এটাও সেরম।
    -বেশ বলেছেন।
    - এই দেখুন না আমার ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট। চিত্তরঞ্জনে হয়েছে। দুটো চিত্তরঞ্জন আছে জানেন তো? একটা থেকে সেরম পবলেম কম, অন্যটা থেকে হলে খুব ঝামেলা, এই তো দেড় বচ্ছর ধরে শুধু ঘুরছি।

    চিত্তরঞ্জনের নাম শুনে আরো দুয়েকজন পাশ থেকে সমর্থন জানান। খুব খারাপ জায়গা।
    - দেখুন না টিভিতে তো বারবার দেখাচ্ছে জন্মের একমাসের মধ্যে জন্ম নথিভূক্ত করতে, কিন্তু এরা দেবেনা সেটা।
    হাসপাতাল বলবে কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছে। এরা বলবে পায় নি। আবার হাসপাতালে যাও। আবার এদিকে পাঠিয়ে দেবে। এই করছি তা একবছরের বেশি হয়ে গেছে। এখন একবছরের মধ্যে হয়ে গেলে ফিরি। যেই এক বছর পার করে দেবে তখন ফাইন দিয়ে নাও। কড়কড়ে একশ টাকা করে ফাইন।

    যা বুঝি, একশটাকাটাই এদের কাছের অ নে ক টাকা। ঘুষ এরা দিতে পারবেই না। আমার সন্দেহ খুব একটা ভুল নয়। এরা মূলতঃ গরীব লোক। গরীবলোকেরা বংশবৃদ্ধি করেই চলেছে। এই লাইনে বড়োলোক একজনও নাই। এক দুজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক (মহিলা) দেখি। বকি সব ভুক্কাড়।

    - এত দিন ধরে ঘোরাবার মানেটা কী?
    - মানে আর কী? ঐ। ঘোরাবে। এখন গর্মেন্ট থেকে টিভিতে দেখাচ্ছে। আগে হলে এত চাপ নিতাম না। তারপরে কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্যেও বার্থ সার্টিফিকেট চাই। বিপিয়েল কার্ড বলুন, শিডুলকাস্ট কার্ড, সবতাতেই এই সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ কথা শুনবে না।

    কন্যাশ্রী শুনে দুজন এগিয়ে এলেন। ক্লাস এইটে পড়ে মেয়ে। বার্থ সর্টিফিকেট ছাড়া কন্যাশ্রী আটকে যাচ্ছে একজনের।
    আরেকজন শোনালেন - এই একবছর ডেড় বচ্ছর কেন ঘোরায় তার একটা কারণও কিন্তু আছে। জিনিসটা অন্যভাবে দেখুন।
    -যেমন?
    -একটা বাচ্ছা। মনে করুন, বলতে নেই, আমাদের মতো ঘরে সবসময় তো ডেড় দু বছর পার করতে পারে না। তখন এই ঘোরাটা বেফালতু হয়ে যায়। তবে ইস্কুল টিস্কুলে দেয়ার আগে সার্টিফিকেট বের করে নিলে অনেক সুবিধা।
    সত্যিইতো এদিকটা ভেবেই দেখা হয় নি। যে শিশুর জন্ম নথিভুক্ত হবার আগেই সে মরে যেতে পারে তার জন্যে অযথা কাগজের বোঝা বাড়িয়ে লাভ কি? এরা দূরদর্শিতার কারনেই তবে এত ঘোরায়?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৮:৪০628440
  • আজ আর খুব বেশি লম্বা লাইন হবে না বুঝতে পরে অফিসের বাবুটি ঘরে ঢোকেন। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। টেবিল ঝাড়েন, চেয়ার ঝাড়েন। কলম খাতা আরো জিনিসপত্র একেক করে টেবিলে রাখেন। আমরা দেখি। শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়াই।
    বাবুটি আবার হুট করে কোথায় চলে যান। একি! আবার কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে?
    - আরে নানা এখন বেশিক্ষণ নয়। পেচ্ছাপ ফেচ্ছাপ করতে গেছে। দাঁড়ান না। (ইনি অভিজ্ঞ। দেড় বছরের অভিজ্ঞতা)।
    মিনিট দশেকের মধ্যে বাবুটি ফিরে আসেন। এঁর কিন্তু হুঙ্কার নেই, যেটা ছিলো এড অফিসের পিওন যুবকের মধ্যে। ইনি সময় নিয়ে নিয়ে কাগজ দেখে দেখে দেখে ফর্ম 24H দিতে থাকেন। খাতা দেখে দেখে কীসব তারিখের হিসেব করেন এবং তার ফলে কেউ কেউ ফর্ম পায় না। তাদের কাগজ এখনো হাসপাতাল থেকে আসেনি।
    আমি ফর্ম পাই। মনে হয় হাতে যেন চাঁদ পেয়েছি।
    চার ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি সাইজের এক টুকরো কাগজ।

    Form No: 24H

    To

    THE CHIEF MUNICIPAL HEALTH OFFICER
    The Kolkata Municipal Corporation

    Required a certified extract from the Birth Register in respect of the following:

    1. Name of Child : ....................................
    2. Sex : ....................................
    3. Name of Mother : ....................................
    4. Name of Father : ....................................
    5. Place of Birth : ....................................
    6. Date of Birth : ....................................
    7. Date of Registration: ....................................
    8. No. of Copies required: ................................
    9. Fee Paid Rs. :.....................................

    -------------------------------
    Signature of Applicant

    Name .....................................
    Address ..................................
    Date ........................................

    C.P. - 1081-08.03.2013-2,00,000 Phone No. if any .........................................
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৮:৫৫628441
  • 1 থেকে 6 এবং তলায় Name ও Address এগুলোর গায়ে টিক মারা, অর্থাৎ এগুলো ভর্তি করা বাধ্যতামূলক।
    বার্থ সার্টিফিকেটের ফোটোকপি দেখে দেখে হুবহু সমস্ত ফিলাপ করলাম। সমস্তই ব্লক ক্যাপিটালে, ধরে ধরে।
    এখন অপেক্ষা জমা দেবার। প্রথমে সকলে ফর্ম পাবেন, তারপরে ঐ একই লাইনে জমা দেবার ব্যাপার। অবশ্য বাবুটি একা নন। ঐ অফিস ঘরটিতে আরো একজন বসে রয়েছেন। তিনি অনায়াসে জমা নেবার কাজটা করতে পারেন। করছেন না।
    অপেক্ষা। সেই লোকটি যিনি ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে নিয়ে দেড় বছর ধরে ঘুরছেন, আজও পেলেন না ফর্ম।
    অনেকজনের ফর্ম ফিলাপের দায়িত্ব নিতে হলো। এঁরা সকলেই যে নিরক্ষর, তা কিন্তু নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীতে এখনো এই ফর্ম কেবলমাত্র ইংরিজিতেই ছাপা হয়, অন্য কোনো স্থানীয় ভাষায় নয়।
    জমা দেবার পালা যখন এলো - সমস্ত নথিপত্র মিলিয়ে বাবু বললেন এই ফর্মটারও ফোটোকপি চাই।
    - কোথায় করব ফোটো কপি?
    - করিয়ে আনুন।

    পাশের চায়ের দোকান জানায় দেড়শো দুশো গজের মধ্যেই আছে জেরক্সের দোকান। তারা রোজই ফোটোকপি করায়।
    ছুটে যাই। ছুটে ফিরি। আবার লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিই 24H; তারপরে প্রতীক্ষা। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে ব্যাথা সকলেরই।
    অফিস চত্তরের ভেতরে একটা গাছের গুঁড়ি তাকে ঘিরে ময়লা তুলবার দুচাকার গাড়ি। সেগুলোর পাশেই ঠেষ দিয়ে বসি।
    - এখন কী দেখছেন? তবুতো শীতের টাইম। গরমকালে এলে বুঝতেন। জল ঝড়ের দিনে। ফিট্‌ হয়ে যায় লোকে।
  • sch | 126.203.197.20 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৯:০৩628442
  • এই লেখাটা শেষ হলে কেউ মুখ্যমন্ত্রীর ফেসবুকে তুলে দেবেন?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৯:০৫628443
  • ঃ-) এখনো কিছু বাকি আছে।
  • ম্যামি | 69.93.215.176 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ১৯:৫৯628445
  • ফেসবুকে নয়। কাগজে ছাপা হওয়া চাই।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:০৭628446
  • সকলের ফর্ম জমা হয়ে গেলে সামনের সেই অফিস থেকে বাবুটি চলে যান অন্য কোথাও। আমরা পালা করে করে গাছের গোড়ায় বেদিটির ওপরে বসি। সামনে আরেকটা অফিস টিকা-ভ্যাক্সিনেশনের মনে হয়। সেখানে জায়গা আছে ভেতরে বসবার কিন্তু সেখানে আমাদের বসতে দেবার "নিয়ম" নেই। রোগা একজন যুবক কাশতে কাশতে মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ে। তাকে উঠিয়ে গাছতলার বেদিতে বসতে দিই। সবাই কেমন দুরে সরে যায়। লোকটার "বুকের দোষ" আছে - তাই ভয় পায় অন্যেরা।
    আরো ঘন্টা দেড় দুই পার করে গোছাকাগজ নিয়ে নিচে নেমে আসেন সেই বাবু।
    জোরে জোরে নাম ডাকা হচ্ছে। আর লাইনে দাঁড়াবার স্ট্যামিনা নেই। অল্পক্ষণ পরেই আমার বাবার নাম ধরে কেউ ডাকে। ছুটে যাই। ফর্ম 24H ফিরিয়ে দেন বাবু।
    - আপনারটা এখানে হবে না।
    -কেন?
    - বরো সেভেনে যান, বরো সেভেন।
    - কেন? বরো সেভেন কেন?
    (দেখি ফিয়ে দেওয়া ফর্ম 24H এর কোণায় লাল ডটপেনের কালিদিয়ে Br. VII লিখে দিয়েছে।)

    সেখানেও যদি অন্য বরো দেখিয়ে দেয়? মনে হয় একটা অদ্ভুত জালে জড়িয়ে পড়ছি।
    বাবুকে বলি - তবে যে আমাকে মেইন অফিস থেকে বলল যেকোনো বরোতে গেলেই হবে?
    - কোথায় বলেছে? লিখে দিয়েছে?
    - না লেখেনি। কিন্তু আপনারা যে লিখলেন বরো সেভেন
    - হ্যাঁ আমরা ফর্মের গায়ে লিখে দিয়েছি।-
    লিখে তো দিয়েছেন, কিন্তু সেটা বরো সেভেনে গিয়ে প্রমাণ করব কীকরে?
    বাবু কোনো উত্তর দেন না। লাইনে অন্যরাও অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আমি সরে যাই।
    বরো সেভেন কোথায়? কোথায় যাবো এখন?
    খেয়াল হয় বরোগুলোর লিস্টি তো আছেই সঙ্গে।

    একনম্বর লিস্টি বলছে
    VII
    1. WHU-59, P-65, Sundari mohan Ave, Kol 14
    2. WHU-63, 9/1, A.J.C. Bose Road, Kol-17
    3. WHU-66, 38, Sreedhar Roy Rd
    4. WHU-58, 12, Gobindo Ghattick Rd, Kol-46
    5. WHU-85, 3A, Dover Terrace, Kol-29
    6. WHU-56, 48, Radhanath Chowdhury Rd, Kol
    7. WHU-68, 175/2, Rashbehari Ave, Kol-29.
    সাতখানা ঠিকানা। একেকটা থেকে অন্যগুলোর বিরাট দূরত্ব।
    লিস্টি ২ বলছে
    9/1A, A. J. C. Bose Road, Kolkata - 700017 2247-6635
    কে কনফার্ম করবে আসল ঠিকানা?
    কাউন্টারের বাবু উত্তর দেন না।
    আমি মূল বাড়িটার দোতলায় উঠে যাই। সিঁড়ির ধারে চা তৈরী হচ্ছে। ওটাই কিচেন। যে পিওনটি কেটলিতে চা ঢালে তাকে জিজ্ঞাসা করি, দাদা বরো সেভেনের ঠিকানাটা বলবেন?
    তিনি ভেতরের এক বাবুর দিকে দেখান।
    তাঁকে ফের একই প্রশ্ন করি। তিনি বলেন - দেখুন এভাবে অ্যাড্রেস আমরা দিই না।
    - কোথা থেকে তবে অ্যাড্রেস পাবো বলুন? একটু হেল্প করুন।
    - অ্যাই, বরো সেভেনটা কোনদিকে হচ্ছে বলোতো? (উনি অদৃশ্য কাউকে প্রশ্ন করেন)। পাঁচ হচ্ছে তোমার কলেজস্ট্রীট, ছয় হচ্ছে..., সাত... বরো সেভেন আপনার মৌলালীতে।
    - মৌলালীতে?
    - মৌলালীতে
    - ঠিক কোনখানটায়?
    - ঐ মৌলালী গেলেই পেয়ে যাবেন। একদম মোড়ের মাথায়।
    - থ্যাঙ্কিউ স্যার।

    নীচে নেমে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হয় এখন বার্থ সার্টিফিকেট পাবার চেয়েও, পাবার পুরো প্রক্রিয়াটা নথিভূক্ত করাটা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। কত ঘোরাবে দেখি। আমি প্রস্তুত।
    বিকেল হয়ে গেছল। তবু বরো সাতটা যাচাই করবার লোভ সামলাতে পারি না। রওনা দিই মৌলালী অভিমুখে।
    মিথ্যেবাদী।
    মৌলালী যাবার অনেক আগেই পার্কসার্কাস মল্লিকবাজারের মুখটায় দক্ষিন-পশ্চিম কোণে বরো সাত চোখে পড়ে যায়।

    বরো সাতের দরোয়ান আমায় বলে - কেনো শুধু শুধু ঘুরছেন? ঐ ধার্ম্‌তাল্লা অফিসেই দিবে। এখানে দেবে না। আপনি সব কাগজ লিয়ে যান। বুঝিয়ে বলেন। কেন দিবে না? দিবে।
  • CM | 132.177.195.172 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:২৪628447
  • এই নিয়ম গুলো কি গত ২ বছরে হয়েছে। sch কি এগুলো আগে হত না ? নাকি তখন বড় অফ্ফিচে থেকে বাড়ি এসে সের্তিফিকাতে দিয়ে দিত?
  • চান্দু মিঞা | 127.247.114.94 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:৩২628448
  • আমার নাম গিয়েছে চুরি।
  • রোবু | 213.147.88.10 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:৫২628449
  • ধুস, ওটা আপনার নাম না, ওটা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এসে লিখলেন।
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:৫৮628450
  • দিদি টাইপেছে। বল্লে হবে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২২:৪৪628451
  • ৪। ৩রা জানুয়ারী ২০১৪

    একটা কাগজ তো আমার পাওয়া হয়ে গেছে - ফর্ম 24H
    এটার জন্যে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কিছু পরিশ্রম তো অন্ততঃ কমবে। এই আশায় বুক বেঁধে ৩রা জানুয়ারী ভোরবেলায় বাসে চাপি। হাওড়াগামী E4 বাস আমায় রেডরোডে যখন নামিয়ে দেয় ঘড়িতে বলছে ছটা বেজে চল্লিশ মিনিট। কুয়াশা ভরা গড়েরমাঠের শেষপ্রান্ত থেকে হেঁটে মনোহরদাস তড়াগের পাশ ঘেঁষে মৃতদেহ ভেবে ভুল করি পাতাখোরদের। তারপরে চৌরঙ্গী পেরিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের পাশ দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঐ পাড়াটা ক্রস করে পৌঁছে যাই কর্পোরেশন অফিসের মেইন গেটের কাছটায়। পাশেই অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের এটিয়েম। ঘড়ির কাঁটা জানায় সাতটা বাজতে দশ।
    গেটে তালা মারা কিন্তু আমারো আগে শখানেকের মতো মানুষ এসে পৌঁছে গেছেন।
    কাগজে লেখা হচ্ছে লিস্ট। আমার নম্বর হয় ৪৯ - বার্থ সার্টিফিকেটের লিস্টে। একটা ফুলস্কেপ কাগজের একপিঠে সেটাই তখন প্রায় শেষ সংখ্যা। ৫০ হয়ে গেলেইকাগজের উল্টোপিঠে নম্বর ও নাম লেখা হতে থাকে।
    ওপাশে আরেকটা কাগজেও নাম লেখা হচ্ছে। উঁকি মেরে দেখি "ডেট সাটিফিকেট" এই শিরোনামে পঞ্চাশ পার করে ফেলেছে লিস্টি।
    লিস্টের প্রথমে যার নাম, তিনি এসেছেন সাড়ে চারটে নাগাদ। কীভাবে এসেছেন জানতেও ভয় করে।
    একদল মুসলমান বৌ বারবার অনুরোধ করে তাদের নাম লিস্টে লিখে দিতে। লিখে দেওয়া হয়। আটটার আগেই একশ জন্ম ও একশ মৃত্যুর সার্টিফিকেট নেবার লিস্ট ভরে যায়। তবু সকলে ঐ কাগজগুলোর ওপরে কড়া নজর লাগে। চোখের আড়াল না হয়। হারিয়ে না যায়। কেউ ছিঁড়ে না ফেলে। তেমন হলে দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। পরিস্থিতি টান টান - উত্তেজনাময়।
    অদূরেই নিজামের দিকটা থেকে ভেসে আসছে ডালপুরী, নেহারি, আলুরতরকারির লোভনীয় গন্ধ। দৌড়ে গিয়ে গোগ্রাসে খেয়ে আসি। এর পরে কখন খাবার সময় পাবো তা জানিনা। যুদ্ধের আগের প্রস্তুতি। আগেভাগেই শক্তিক্ষয় না হয়ে যায়। প্রায় সকলেই রাস্তায় বসে বা উবু হয়ে রেস্ট নিয়ে নিই। পাশেই ছড়ানো হয়ে গেছে ব্লিচিং পাউডার। আজ অত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিচারের স্কোপ নেই। অনেকেই বসে আছি রাস্তার ওপরে। নতুন প্রযুক্তির রাস্তা ধোবার গাড়ি রাস্তা ধুয়ে দিয়ে যায়, তার জলের ছিটে অল্প বিস্তর লাগে আমাদের গায়ে পোশাকে। ঐ নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। আমরা অপেক্ষা করছি কখন নটা বাজবে - খুলবে কর্পোরেশনের গেট।
    নটার একটু আগে, যিনি গেট খুলতে আসেন আমাদের সাবধান করে দেন - কালকে একজনের হাত ভেঙ্গে গেছে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় স্লিপ করে পড়ে গিয়ে।
    গেটের তালা খুলতেই আমরা সবাই দৌড়তে থাকি। দৌড়ে গিয়ে ডানহাতি সেই দরজা দিয়ে ঢুকে সেই সটান তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে প্রাণপনে ওপরে উঠতে থাকি। থামবার জো নেই। থামলে ধাক্কায় পড়ে যাবো। স্ট্যামপিড হবার মতো অবস্থা। দুর্ভিক্ষপীড়িত কোনো অঞ্চলে যেন লঙ্গরখানার গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। পড়িপড়ি করে সকলে ছুটে চলেছি ওপরে। সবার আগে আগে লাফ দিয়ে দিয়ে উঠে যাছে সেই দুজন যাদের হাতে কাগজের লিস্ট্দুটো রয়েছে।
    আজ কোনো দুর্ঘটনা হয় না। জন্ম ও মৃত্যুর লাইন তৈরী করে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আমরা নম্বর ধরে ধরে একে একে দাঁড়িয়ে যাই ঠিক যেমনটি ছিলো লিস্টে।
    আজও সেই পিওন যুবককে দেখা যায়। আরও একজন যুবককে দেখি। এদের নাম দিচ্ছি যথাক্রমে যুবক১ ও যুবক২।

    মিনিট দশেক দাঁড়াবার পরে আমার মনে হয় - আরে! 24H তো আমার সঙ্গে রয়েইছে। তবে খামোখা কেন দাঁড়িয়েছি এখানে?
    সামনে পেছনে যাঁরা অপেক্ষারত তাদের অনুরোধ করে, লাইন থেকে বেরিয়ে যুবক১ কে প্রশ্ন করি - যাদের কাছে ফর্ম 24H অলরেডি আছে তাদেরও কি দাঁড়াতে হবে এই লাইনে?
    যুবক১ আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষন করে (সে ইতিমধ্যে আমাকে চিনে ফেলেছে - ২৬ তারিখে আমি এই লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম - সে আমার মুখ মনে রেখে দিয়েছে) তারপরে বলে - দেখি কি ফর্ম? এইখান থেকে দিয়েছি? আমার সাইন আছে? আমার সাইন না থাকলে সে ফর্ম এখানে চলবে না। বাইরে থেকে ফর্ম আনলে হবে না।
    আমি ভয় পেতে শুরু করি। সেই ফর্ম বের করি না। লাইনে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই। আমি এখন জানি ফর্ম কেমন করে ফিলাপ করতে হয়, কতটা সময় লাগে। হাতে কলম নিয়ে রেডি হই।
    দশটায় ফর্ম দেওয়া শুরু হওয়া উচিৎ। যুবক১ সেই ছাব্বিশ তারিখের মতো আচরণ শুরু করে দেয়। সঙ্গে পুলিশের টহল। সেইসঙ্গে প্রত্যেকেই কথা বলে অল্প বেশি, শিশুর ক্রন্দন (যেসব মায়েরা বাড়িতে শিশুটিকে একা রেখে আসতে পারেনি, যাদের স্বামীরা ছুটি পায় নি কাজের জায়গা থেকে)। ঐ ভীড়ের মধ্যেই মায়েরা আব্রু রক্ষা করে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবার ব্যবস্থা করতে থাকে।
    মুরুব্বির মতো কয়েকজন লোক গট্গট করে হেঁটে যায়। তারা যুবক১ এর ঘাড়ের কাছে মুখ দিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। লাইন থেকে একটু বেরিয়ে আমি এগুলো দেখি। তখন যুবক১ আমার দিকে তাকিয়ে শাসায় - কত নম্বর অ্যাঁ? কত নম্বর? লাইন থেকে বেরোলে নাম কেটে বাদ করে দেবো।
    নামের লিস্ট এখন তার হাতে। আমি অপমানিত হব কিনা বুঝতে পারি না। তবে বুঝি এই ভারতবর্ষ আমার চেনা নয়। এ আমার দেশ হতে পারে না।
    এবার দশটা বেজে যায়। যুবক১ এর হাতে সেই চার ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি ফর্ম 24H এর তাড়া। এই একগুচ্ছ সরকারি কাগজ তাকে দিয়ে অথরিটি, দুর্ব্যবহার করবার, অপমান করবার, অত্যাচার করবার ক্ষমতা।
    সে এক এক করে নথিপত্র পরীক্ষা করে আর হাতে হাতে দিতে থাকে ফর্ম 24H; তাতে এককোণে কীসব সাইন করে - ঠিক কর্পোরেশনের মশাল দেওয়া চিহ্নটার পাশেই। আমাকেও দেয় এবার। দেবার ইচ্ছে হয়ত ছিলো না। কেন জানিনা যুবক১ এর বিষনজরে পড়ে গিয়েছি খুব বেশি করে।
    প্রত্যেককেই ঐ ফর্ম নিয়ে সেই দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবার নিয়ম। আমার আগের জনও তাই ই করল। কিন্তু আমাকে সে ঢুকতে দেয় না ভেতরে। বলে ফর্ম ফিলাপ করে তাকে দেখিয়ে তবেই ঢুকতে পারব।
    আমিতো নিমেষে ফিলাপ করে নিয়েছি। ৩০ সেকেন্ড কি একটু বেশি সময় লেগেছে।
    তা সে বিশ্বাসই করবে না। শুধু নীচে সইটুকু করা হয় নি।
    বলে - ফিলাপ করে নিয়ে আসুন। এখন ঢুকতে দেবো না।
    আমি তার হাতের ফাঁক গলে ঐ ঘরে ঢুকে যাই।
    সে আমার জামা ধরে টানে। তারপরে ভেতরে ঢুকে ঐ ঘরের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে - এই! এটাকে এক লাইনও লিখতে দিবি না। যদি দিয়েছিস তবে ঐ ফর্ম আমি ছিঁড়ে দেবো! বের করে দে!
    দুজন সাব ইন্স্‌পেক্টরকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলে যুবক১।
    আমি মেঝেতে বসে যাই। সই করি ফর্মের নীচে। তারপরে উঠে দাঁড়াই। ভাগ্যভালো যে সাব ইন্স্‌পেক্টরদ্বয় আমাকে মারে না, বকে না, তারা চেয়ার থেকে উঠেছিলো আবার বসে পড়ে।
    ষোলো নম্বর কাউন্টারে আমি সমস্ত নথিপত্র সমেত আমার ফর্ম 24H জমা করি। কোনো রসিদ পাই না। আমাকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। এটা সকলের জন্যেই। এটাই নিয়ম। এর পরে নাকি নাম ধরে ধরে ডাকা হবে।
    কখন, কতক্ষণ পরে ডাকা হবে?
    কেও উত্তর দেয় না।
    ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি যুবক১ তখন অন্যদের ফর্ম দিচ্ছে। বারান্দাটায় অসম্ভব ভীড়। সকলেই কখন "নাম ধরে ধরে ডাকা হবে" এই প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। একপাশে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার মেঝের সঙ্গে গাঁথা, তাতে কয়েকজন মেয়েপুরুষ বসে। মাঝে মাঝেই "সরে যান সরে যান" বলে আমাদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সেই চেয়ারগুলোর দিকে চেপে দেওয়া হচ্ছে। তাতে টাল সামলাতে না পেরে আবালবৃদ্ধবনিতা হুড়মুড়িয়ে সেই চেয়ারে বসা মানুষগুলোর গায়ে গিয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে হেঁটে যাচ্ছেন কোনো বড়ো অফিসার হয়ত বা। তিনি যেন দেখেও দেখতে পাচ্ছেন না এতগুলো মানুষের কষ্ট। এই ভীড়, এই আওয়াজ, এই গুমোট, কষ্ট, কিছুই যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, শুনতে পাচ্ছেন না। এসব যেন একজিস্টই করে না। সব মায়া।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:১৩628452
  • যেখানটা আমরা অপেক্ষা করছি কখন নাম ধরে ডাকা হবে সেই অপেক্ষায়, সেখানে কিন্তু জন্ম মৃত্যু সবাই একসঙ্গে।
    সটান মেঝেতে বসে পড়বার উপায় নেই কারণ তাতে জায়গা বেশি লাগে। একদিকে কিছু মেয়ে পুরুষ বসে পড়েছিলো দাঁড়াতে না পেরে। পুলিশ এসে তাদের তুলে দিয়েছে। মোটামুটি হিসেব কষলে সকাল সাতটা থেকে এগারোটা সাড়ে এগারোটা টানা চারঘন্টা তো মিনিমাম স্ট্রাগল করা হয়ে গেছে। কোনো বাথরুমে যাবার উপায় নেই।
    তারই মধ্যে আমরা একে অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতা করে সময় কাটাই কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করি।
    এই সময়েও দার্শনিক কথাবার্তার অভাব হয় না।
    - এই বার্থ সার্টিফিকেট নেবার প্রসেস কঠিন করে একটা ভালো জিনিস হয়েছে। লোকে সেকেনবার বাচ্চা পয়দা করবার আগে দুবার ভাববে। এর চেয়ে ভালো কন্ট্রোল আর কী আছে?

    - ডেথ সাট্টিফিকেটের লাইনে ঘাপলা আরো বেশি। কেন জানেন?
    - কেন?
    - সবার তো ডেথ সাট্টিফিকেট নিতে হয় না।
    - হয় না?
    - আরে বার্নিং ঘাট থেকে যে দুটো দেয় সে দুটোতেই কাজ চলে যায়। বাকি এক্‌স্ট্রা যারা নিতে আসছে তারা কেন আসছে? প্রপার্টির গন্ধ আছে তাই। হুঁ হুঁ। একদম বাচ্চাফাচ্চাদেরও ডেথ সাট্টিফিকেট লাগে না।

    কয়েকজন মহিলা নিজেদের মধ্যে ফিস্‌ফিস্‌ করে। ঐ ষোলো নম্বর কাউন্টারে ফরম জমা দেবার সময়েই নাকি হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে তারা।
    - কেন?
    - নাহলে ডাক্তারীর লাইনে ঠেলে দেবে।
    সে আবার কী? ডাক্তারীর লাইন কী ব্যাপার?
    মহিলারা বলে - ফালতু দু ঘন্টা বেশি দাঁড়াতে হবে।
    এদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।
    সেই যেখানে মেঝেয় বসে পড়ে সই করেছিলাম ফর্মে, সামনে দুজন সাবইন্স্‌পেক্টর ছিলো সেখানে ফর্মের সঙ্গে টাকা গুঁজে দেবার ব্যাপারও চলে?
    না হলেই ডাক্তারীর লাইন?
    এর পরে বাবার/মায়ের নাম ধরে ধরে ডাকা শুরু হয়। কারোকে তিন নম্বর কাউন্টারে যেতে বলা হয়, কারোকে ডাক্তারীর লাইনে।
    আমার বাবার নাম ধরে ডাকা হয় - ডাক্তারীর লাইনে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:৩৬628453
  • যেখান থেকে ডাক আসে সেই দরজার কাছে যেতেই সেই যুবক২ আমার ফর্ম 24H আমার হাতে ফিরিয়ে দেয়। সেখানে আমার নামের চারদিকে গোল করে দাগ দেওয়া লাল কালি দিয়ে।
    বলে ডাক্তারীর লাইনে চলে যান।
    ডাক্তারীর লাইনে আমার সামনে লাইনে গোটা ষাটেক মানুষ। বার্থ/ডেথ সার্টিফিকেটের প্রার্থী নির্ব্বিশেষে। তাদের হাতে ফর্ম 25H.
    আমার সামনে এক শীর্ণকায়া যুবতী পেছনে অসম্ভব রুগ্ন এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধ মেঝেতে বসে পড়ে। এই লাইন এগোয় না।
    দেড়টা-দুটো বাজে প্রায়। সামনের শীর্ণকায়া যুবতীকে প্রশ্ন করি - ডাক্তারীর লাইন কেন? কিছু জানেন?
    -বাঃ জন্ম মৃত্যু এই দুটোতেই ডাক্তার লাগবে।
    -জন্ম তো হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুও সেইরকম, মূল সর্টিফিকেট ক্রিমেশান বা কবর দেবার সময়েই তো পাওয়া গেছে আবারো ডাক্তারী পরীক্ষা করা হচ্ছে কীসের?
    মেয়েটি অনেক কথা বলে যায়।
    -এতো কিছুই না। আমার মতো সিঙ্গল মাদারদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আলিপুর কোর্ট থেকে কাগজ আনতে হয়। এই নিয়ে তিনবার এলাম এখানে। আজ যদি না পাই তবে আমার লয়্যারকে পাঠাবো।
    হাতের মুঠোয় সে শক্ত করে ধরে রাখে কোর্টের অর্ডার। স্ট্যাম্প পেপারটাকে আংশিক আড়াল করে দেয় ফর্ম 24H.
    - আমার হেল্থ্‌ টা আসলে ভালো নয় জানেন। আসলে আমি অনেক আগেই আসতে পারতাম। আমরা একটা রেয়ার ডিজিজ আছে ব্রেণের ঠিক নয়, নার্ভের। সেটা সারবে না কোনোদিন। কিন্তু ট্রিটমেন্টে অনেক খরচ। ডাক্তার বলেছে বোম্বেতে ভালো ট্রিটমেন্ট আছে। কিন্তু বোম্বে যাবার মতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তার ওপরে এই বার্থ সার্টিফিকেটের প্রবলেম। মেয়েটির চোখে পুরু চশমা। দুচোখের কোনেই থকথকে পিচুটি। সে শালের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে হাতদুটো সেখানে আড়াল করা থাকে কোর্ট অর্ডার।
    পেছনে বৃদ্ধ আমার পা ধরে নাড়া দেয়। তাকে টেনে ধরে তুলি।
    ভাবি এই এত অশক্ত মানুষটা ৫০-৬০ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠল কেমন করে?
    সে কথা ভালো বলতে পারে না। তার নাতির বার্থ সার্টিফিকেট নিতে এসেছে। ছেলে- ছেলের বৌ দুজনেই সামান্য কাজ করে, তাদের ছুটি নেই। বৃদ্ধ পড়তে পারে না - দুচোখেই ছানি।
    তার ফর্মে কী ভুল আছে সেটা আমায় "চেক" করে দিতে বলে।
    বস্তুতঃ তার ফর্মের কোনো ভুল আমি দেখতে পাই না। তবু তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে ডাক্তারীর লাইনে।
    চারজন চারজন করে ঢোকায় ঐ ঘরে। ভেরতে কী আছে কিছুই জানি না।
    একটা কম্পিউটারাইজ্‌ড্‌ বার্থ সার্টিফিকেটের কপি ইস্যু করবার জন্যে কেন এত লাঞ্ছনা সইতে হবে ভেবে কুল কিনারা পাই না।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ ২৩:৫৯628454
  • বৃদ্ধের পাশে আমিও কিছুক্ষণ বসি সটান মেঝের ওপরে ধুলোবালি কোনো কিছুর তোয়াক্কাই আমাদের নেই। দীর্ঘ সেই প্রতীক্ষা। অনেকক্ষণ পরে আমার পালা এলে সেই যুবক২ চারজনের জায়গায় তিনজনকে ঢোকায়, আমাকে আটকে দেয়। আবারো অপেক্ষা করি। আমার সামনে দিয়ে সে "চেনা জানা"দের ঢুকতে দেয় সেই ঘরে।
    এই ধরণের টর্চারের পদ্ধতি কি অ্যাডল্ফ হিটলারের কন্‌সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছিলো নাকি এসব আইডিয়া একেবারেই আনকোরা কে জানে।
    অবশেষে আমাকে ঢুকতে দিতেই হয় সেই ঘরে, নইলে পেছনে লম্বা লাইন শেষ হবার নয়।
    ঘরটার ভেতরে ঢুকে দেখি, এতো সেই পুরোনো ঘর, সেই যেখানে মেঝেয় বসে সই করেছিলাম, শুধু তখন অন্য দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম - এখন পাশের দরজা দিয়ে ঢোকাচ্ছে।
    ভেতরে দু তিনজন সাবইন্স্‌পেক্টর তখনও চেয়ারে বসে। সেই শীর্ণ বৃদ্ধকে এরা কেও চেয়ার ছেড়ে দেয় না।
    ঐ ঘরে আরো অনেক কাউন্টার আছে। আমাকে দাঁড়াতে হয় ডাক্তারী পরীক্ষার লাইনে।
    অবশেষে ডাক্তার আমার ফর্ম 24H পরীক্ষা করে বলেন - সবই তো ঠিক আছে, এখানে পাঠিয়েছে কেন?
    (উত্তর তো দিতে ইচ্ছে করেই এই প্রশ্নের - ষোলো নম্বর কাউন্টারে টাকা গুঁজে না দেওয়া ইঃ - কিন্তু আমার তো মেরুদণ্ডই নেই - সত্যকথা বলব কেমন করে?)
    ডাক্তারবাবু টিক দিয়ে দেন ফর্মে। আধ মিনিটও লাগে না। ঐ ঘরেই এক নম্বর কাউন্টারে লাইন দিতে হয় টাকা জমা দেবার।
    তিন কপি চাই আমি। তিনশ টাকা। আমার আগে যিনি তিনি এক কপি চান এবং তিনশ টাকা দেন স্পষ্ট দেখি। এত কষ্ট সহ্য করে এত লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দেবার সময়েও কেন তিনগুণ দিতে হচ্ছে মাথায় ঢোকে না।
    আমি তিন কপি চাই হাজার টাকার নোট দিই। এক নম্বর কাউন্টার থেকে জানায় খুচরো নেই। বলি তাহলে দশ কপি দিন। তখন উত্তর আসে হাজার টাকার নোট পরখ করবার মেশিন নেই বলে। আমি খুচরো তিনটে একশ টাকার নোট দিই। এরপরে হাজারের নোটটি চেয়ে ফেরৎ নিই। রসিদ পাই তিনশ টাকা দেবার।
    এরপরে নাকি বাইরে অপেক্ষা করতে হবে রসিদ হাতে - কাচের ঘরের সামনে।
    বাইরে বেরিয়ে জানতে পারি ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষা করতে হবে। এখন আর কোনো ঝামেলা নেই। রসিদ হাতে নীচে যাই খেতে। সবার আগে নিউমার্কেটে যেতে হয় একটা টয়লেটের সন্ধানে।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৪ ০০:১৭628456
  • সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার বাবার নাম ধরে ফের ডাকা হয়। কাচের ঘর থেকে নয়। মাইকে। ফের তিন নম্বর কাউন্টারে ডাকে।
    সেখানে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকেন একন দিদিমনি। দিদিমনির পাশে যুবক২। আমাকে বলে আপনার বার্থ সার্টিফিকেট নিয়ে সমস্যা আছে।
    - কী সমস্যা?
    - আপনার বার্থ সার্টিফিকেটের পদবীর স্পেলিং এখনকার স্পেলিং এর সঙ্গে মিলছে না।
    - মিলবে কেমন করে? সেতো মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময়েই বিশেষ বিশেষ স্পেলিং ব্যবহারের নিয়ম ছিলো।
    - হ্যাঁ কিন্তু সেটার জন্যে লাগবে কোর্টের অর্ডার (এটা বলে যুবক২)
    -মানে আপনি যদি বার্থ সার্টিফিকেটে নতুন স্পেলিং চান (এটা বলেন দিদিমনি)
    যুবক২ রাগত চোখে দিদিমনির দিকে তাকায়।
    -কোনো নতুন স্পেলিং চাচ্ছিনা। আগের সার্টিফিকেটে যেমনটি আছে, আপনাদের কম্পিউটারে ঠিক যেমন এন্ট্রি ছিলো, জন্মের সময়ে ঠিক যেমন নাম পদবী, ঠিকানা ছিলো আমার ঠিক তেমনটিই দিন। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ কোনো কিছু পাল্টাবেন না দয়া করে।
    - হ্যাঁ হ্যাঁ যান যান আপনার সুবিধের জন্যেই বলছিলাম। বাইরে যান।(যুবক২ আমায় তাড়িয়ে দেয় সেই ঘর থেকে)।
    পাঁচটা নাগাদ আমি বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পাই।
    পাশের শুভাকাঙ্খী এক ভদ্রলোক বলেন, ভা আ লো করে খুঁটিয়ে সব মিলিয়ে নিন, বানান, তারিখ, বাপ মার নাম, জন্মস্থান।
    সব সম্ভব এখানে।

    মিলিয়ে নিই। সমস্ত।

    তখনো ডেথ সার্টিফিকেটের আশায় বসে আছেন এক বিধবা। মৃত স্বামীর চাকরির জায়গায় একটা পোস্ট পেয়েছেন অনেক বছর লড়াই করে। পুরোনো ডেথ সার্টিফিকেটগুলো করায়ত্ব করে নিয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। এখন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেট জমা না দিলে চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তখনো কেন জানি না ওঁর নাম ডাকেনি। কাহিল অবস্থা সারাদিনের ধকলে। আশাকরি স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেট হাতে পেলে মুখে অল্প হাসি ফুটবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন