এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • সর্ষেঃ তালেগোলে হরিবোলে, দয়ারা বুগিয়ালে ...

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৬০৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:৩৩689476
  • বিশ্বেস করুন, মা শেতলা আর বাবা ইন্টারনেটের দিব্যি, দু হাজার চোদ্দ শেষ হয়ে যখন দু হাজার পনেরো শুরু হয়েছিল, খুব ঘুরব, খুব বেড়াব, হাঁই হাঁই জার্নি করব – এমন কোনও প্রকারের রেজলিউশন আমি নিই নি। ইন ফ্যাক্ট, ওই রেজোলিউশন নেবার গল্পটাই আমার বেজায় বোকাবোকা লাগে। তাও যখন শেষমেশ পনেরো শেষ হয়ে দু হাজার ষোলতে এসে পড়লাম, পেছন ফিরে দেখি, গোটা বছরটায় মনে রাখার মত বেশ কটা ট্রিপ করে ফেলেছি। প্রথমে জুন মাসে এন এইচ ওয়ান এন্ড টু এন্ড – লাদাখ, বাইকে করে, তার পরেই নভেম্বরে অলমোস্ট এন্ড টু এন্ড এন এইচ টু, দিল্লি থেকে কলকাতা গাড়িতে করে। এর পরে হতেই পারত এন এইচ থ্রি – কিন্তু সেটা যে কোথা থেকে কোথা যায়, ইন্টারনেটে খুঁজবার আগেই দানা বাঁধতে লাগল পরের বেড়াবার প্রস্তুতি। এবারে আর দু-চাকাও নয়, চার-চাকাও নয়, বেড়াবার মাধ্যম হবে এগারো নম্বর বাস।

    আজ্ঞে হ্যাঁ, ট্রেকিং। হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে চড়া আর নেমে আসা। এই গুরুচন্ডালিতেই আমাদের এক চন্ডাল আড্ডা মারে – বুনান, তাকে তো আপনারা হাড়ে হাড়ে চেনেনই, সে মোটামুটি হামাগুড়ি দেবার বয়েস পেরোবার পর থেকেই ট্রেক করতে শুরু করেছে। ছেলেটা নেহাৎ লেখে না – নইলে আপনারা জানতে পারতেন ওর মোটামুটি হিমালয়ের বেশির ভাগ পাস আর কল্‌ই পায়ে হেঁটে ঘোরা হয়ে গেছে। প্রথাগত মাউন্টেনিয়ারিং-এর বা ট্রেকিং-এর তেমন কোনও ট্রেনিং নেই, কিন্তু জাস্ট অদম্য নেশা আর মনের জোরে সে যে কোন কোন রুটে ঘুরে আসে নি, আর কোন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নি, সে বলা মুশকিল।

    বুনানই আমাকে প্রস্তাব দিল, ডিসেম্বরে চলো আমাদের সঙ্গে ট্রেকিং করতে – খুব সোজা রুট, দয়ারা বুগিয়াল। সাত আট দিনের মামলা দিল্লি থেকে দিল্লি, কোনও চাপ হবে না, চলে এসো।

    জুটে যেতে একেবারেই আপত্তি ছিল না, পঁচিশে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারি অফিসে মোটামুটি ছুটির মেজাজই থাকে, কিন্তু আমি কি পারব? এমনিতে আমি বেজায় কুঁড়ে টাইপের জনতা। বাইকে বা গাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা ড্রাইভ বা রাইড করতে আমার যদিও এতটুকুও ক্লান্তি আসে না, কিন্তু পায়ে হেঁটে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পেরনো কি আমার পক্ষে সম্ভব? আমার দম এমনিতেই কম, ছোট থেকে আমাকে বহু চেষ্টা করা হয়েছিল খেলাধূলোয় জুতে দেবার, কিন্তু অচিরেই ফুটবলের মাঠে আমি গোলকীপারের পোস্টটিই বেছে নিয়েছিলাম কারণ ওতে ছুটতে হত না। সাঁতার শিখেছি দীর্ঘ পাঁচ বছর, সাঁতারের সমস্ত কলাকৌশল আমি জানি – কিন্তু জীবনে কোনওদিন সাঁতার কম্পিটিশনে মেডেল পাই নি, প্রত্যেক বছরেই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পাতলা স্টিলের টিফিন বাক্সো নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। স্কুলে কলেজে কোনওদিন স্পোর্টসে নাম দিই নি, কোনওদিন একশো মিটারও দৌড়ই নি, ক্রমশ খেলাধূলো, স্পোর্টস জিনিসটাকেই আমি আমার জীবন থেকে বের করে দিয়েছি, খেলার চ্যানেল খুলি নি কোনওদিন, ইন্ডিয়ান টিমের ক্যাপ্টেনেরও নাম জানি না, সপ্তাহে এক দুদিন পায়ে হেঁটে বাজার যাই বটে, তবে সেটা ঐটুকুই – খুব বেশি হলে এক দু কিলোমিটার হন্টন। আমার পক্ষে কি সম্ভব?

    বুনান শুনেটুনে বলল, আরে অত ভাবছো কেন? আমরা তো থাকছি সঙ্গে, ধীরে ধীরে থেমে থেমে উঠব। আমাদের ট্রেক গাইড হবে প্রেম, সে এক দারুণ লোক, অনেকগুলো পীক ও জয় করেছে মাউন্টেনিয়ারিং টিমের সঙ্গে, প্রচুর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে ওর, শুনতে শুনতে চলবে, কোনও চাপ হবে না।

    সে না হয় নিলাম না, কিন্তু জিনিসপত্র কী লাগবে? খরচা কেমন হবে? রুট কী রকম? মোদ্দা কথা – আমরা যাচ্ছি কোথায়?

    সিকিনী যতবারই আমাকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি ট্রেক করতে, আমি কিছুতেই বলতে পারি না, কারণ নামটাই তো মুখস্ত হয় নি। দয়ারা বুগিয়াল – এই নাম মনে রাখা কি সম্ভব? হোয়াটস্যাপের চ্যাট খুলে স্ক্রোল আপ করে যতক্ষণে সে নাম বের করি, তখন সিকিনী অফিস চলে গেছে, আর সে যখন ফিরে এসে আবার জিজ্ঞেস করে, আমি ততক্ষণে নামটা ভুলে যাই। প্রায় দশদিন লেগেছিল নামটা মেমোরাইজ করতে।

    খরচ নাগালের বাইরে কিছু নয় – অন্ততপক্ষে লাদাখ বা কলকাতা যাবার খরচের থেকে অনেক অনেক কম খরচে ঘোরা হবে।

    জিনিসপত্র যা যা লাগতে পারে – তার দেখলাম সবই আমার কাছে আছে – মোটা জ্যাকেট, গ্লাভস, চার জোড়া মোজা। বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হবে, ফলে ট্রেকিংএর উপযুক্ত স্পাইক-জুতোও লাগবে। আমার উডল্যান্ড জুতোটা যদিও ঠিক ট্রেকিং শু নয়, তবে নিচের খাঁজকাটা দেখে মনে হল, এটা পরেই হাঁটা সম্ভব। আর তাই জুতো কেনার পেছনে ইনভেস্ট করলাম না। বুনান বলল, ওয়াকিং স্টিক লাগবে, সেটা ও আমার জন্য নিয়ে আসবে, বাকি দু সেট জামা সোয়েটার ইত্যাদি ভরে একটা নর্মাল ব্যাগ পিঠে নিলেই হয়ে যাবে। বাকি যা যা লাগবে, গেটার, টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, সমস্ত আমাদের গাইড প্রেম প্রোভাইড করবে।

    ব্রাউজার খুলে দয়ারা বুগিয়াল দিয়ে সার্চ মেরে বেশ নয়নমনোহর ছবিপত্র পেলাম। উত্তরকাশী থেকে বেশ খানিকটা ওপরে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা মেডো, ঢেউখেলানো বিস্তীর্ণ ময়দান – একেই গারোয়ালি ভাষায় বলে বুগিয়াল। জায়গাটার নাম দয়ারা, তাই দয়ারা বুগিয়াল। গরমকালে স্থানীয় পশুপালকরা তাদের গরু-ছাগল চরাতে নিয়ে আসে এখানে, শীতে এই এলাকা ধূধূ বরফে ঢেকে যায়। আমাদের হাঁটা হবে এই বরফে ঢাকা বুগিয়ালের ওপর দিয়ে। ছবিটবি দেখে দিল্লির হাল্কা ঠাণ্ডাতে বসেও বেশ কেঁপে গেলাম। দিগন্তবিস্তৃত বরফের চাদর। সামনে দেখা যায় বান্দরপুঞ্ছ পীক।

    দু চারটে ট্রেক আইটিনেরারি খুঁজে বের করলাম। দৈনিক তিন চার, ম্যাক্সিমাম পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক, এই রকম জায়গায় হাঁটতে মোট্টেই কষ্ট হবার কথা নয় – কিন্তু, কিন্তু, সমস্ত ট্রেকের টাইম দেখাচ্ছে এপ্রিল থেকে নভেম্বর, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কেউই কোনও ট্রেক অ্যারেঞ্জ করে না। তার মানে কি … এত বরফ পড়ে সেখানে, যে ট্রেক করা যায় না?

    অগতির গতি বুনান, সে আবার অভয় দিল, আরে তেমন কিছু ব্যাপার না, ওগুলো ফ্যান্সি ট্রেকারদের জন্য, যারা বরফ পড়ার আগেই ঘুরে আসে। আমরা তো যাচ্ছিই বরফ দেখতে। আর ওই ওয়েবসাইটের রুটে তো আমরা যাবো না, ওগুলো যায় বারসু হয়ে, আমরা যাবো উত্তরকাশী হয়ে। এটা একটা আনকনভেনশনাল রুট।

    অ্যাপারেন্টলি বোঝাই গেল, বিশেষ চাপের কিছু নেই, কিন্তু সিকি যাচ্ছে যেখানে, সেখানে ঘটনার ঘনঘটা থাকবে না, তাই কি হয় নাকি? ঘটনা ঘটেই, তাই তো সিকি ভ্রমণকাহিনি লেখার অনুপ্রেরণা পায়।

    হাঁটা তো শেষ চোদ্দ কি ষোল কিলোমিটার, উত্তরকাশী অবধি যাবো কেমন করে?

    বুনান বলল, আমি তো কত ট্রেক করেছি উত্তরকাশী হয়ে। দিল্লি থেকে বাস নিয়ে প্রথমদিন হরিদ্বার, পরের দিন ভোরবেলায় বাস ধরে আবার উত্তরকাশী। ব্যাস। আমরা তো তিনজন, তুমি, আমি আর আমার অফিসের এক ছানা যাবে।

    আমার মন অতএব আবার গুণগুণায় – তিনজনে যাচ্ছি যখন, খামোকা বাসে করে যাবো কেন? আমার গাড়ি আছে কী কত্তে? তোরা ট্রেনে করে দিল্লি আসছিস আয়, আমি তোদের রিসিভ করে সো-জা চলে যাবো হরিদ্বারে, পরের দিন হরিদ্বার থেকেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাবো উত্তরকাশী, সেখানেই গাড়ি রেখে ট্রেক শুরু করব।

    বুনান বলল, আইডিয়াটা মন্দ নয়, তবে তুমি গাড়িটা হরিদ্বারেই হোটেলে রেখে দাও, তোমার তো পাহাড়ে ড্রাইভ করা অভ্যেস নেই, উত্তরকাশীর রাস্তাও শুনেছি খুব একটা ভালো নয়, ওটা গাড়িতে রিস্ক না নেওয়াই ভালো। হরিদ্বারের হোটেলে কথা বলে নাও, ওদের পার্কিং আছে, ওরা ছদিনের জন্য তোমার গাড়িটা রেখে দেবে।

    বেশ, তাইই সই। হরিদ্বারের হোটেল শিবমূর্তিতে কথা বলে নিলাম। লোকটি প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে রাজি হয়ে গেল আমাদের গাড়ি রাখতে।

    কিন্তু একটা চাপ আছে – বুনান বলল আবার হোয়াটস্যাপে। – আমাদের আসার ট্রেন ওয়েটিং লিস্ট। সেটা কনফার্ম হবার চান্স কম।

    সম্ভাব্য সবরকম সোর্স কাজে লাগিয়েও বোঝা গেল সেটা কনফার্ম না হবার দিকেই চান্স বেশি, তখন বললাম, ফ্লাইটে চলে আয় না।

    বুনান বলল, ফ্লাইটে প্রচুর খরচা হবে এখন, দশ হাজারের নিচে টিকিটই নেই, আর আমার সঙ্গে যে আসছে সে অনেক জুনিয়র, ওর পক্ষে ফ্লাইটের টিকিট অ্যাতো বেশি দামে কেনাটা খুব বেশি চাপ হয়ে যাবে।

    আমি সাথে সাথে মেকমাইট্রিপ খুলে দেখলাম – বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দামের টিকিট, তার মধ্যেই জেট এয়ারওয়েজের টিকিট দেখলাম অনেক শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, পঁচিশে ডিসেম্বর সন্ধ্যেবেলায়। বুনানকে দেখাতেই বেশ খুশি হয়ে ঝটপট টিকিট কেটে ফেলল। ফাইনালি তা হলে ঠিক হল – পঁচিশে ডিসেম্বর রাত নটায় ফ্লাইট এসে নামবে দিল্লিতে, আমি এয়ারপোর্ট থেকে বুনানকে আর তার ছানাকে রিসিভ করে সোজা দৌড় লাগাবো হরিদ্বারের দিকে। যত রাতই হোক, সোজা পৌঁছে যাবো হোটেলে। পরদিন ভোরবেলা একটু চাপ নিয়ে উঠে বাস ধরে উত্তরকাশী যেতে হবে, সে দরকার হলে বাসেও বাকি ঘুমটা ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

    অল্‌ সেট। আমার ব্যাগ গুছনোও কমপ্লিট। সকালে শুধু দাঁত মেজে ব্রাশটা ভরে নিতে হবে।
  • পুপে | 131.241.184.237 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ১১:১৭689505
  • অ্যাঁ, এত্ত ছবিছাবা দিয়ে লোভ দেখিয়ে শেষে এইটুকুন লেখা!!!! এ তো দু মিনিটে পড়ে ফেল্লুম।
  • Manish | 127.200.91.144 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ১১:৪৭689516
  • পড়ছি
  • ম্যাগি | 126.50.59.180 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ১২:৪৭689527
  • সিকিকে এত হ্যাপা সামলাতে হয় - এর বেশি এক এক দিনে হবে না, এমনকি মাঝেমধ্যে দু একদিন স্কিপও হতে পারে। এর মধ্যে পুপে তো নিজের ল্যাখাটা শেষ করে নিলেই পারে।

    আর এ তো সবে গৌরচন্দ্রিকা, এতে আবার ছবি কীসের? জার্নি শুরু হলে পরে ছবি দেওয়া যাবে খন।
  • PM | 37.97.246.108 | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ১৩:৩৪689538
  • অনেকদিন পরে সিকির লম্বা লেখা দেখে দারুন ভালো লাগলো। প্রথম লাইন পড়েই রেখে দিলুম। বাড়ি ফিরে তারিয়ে তাড়িয়ে পড়বো ঃ)
  • সিকি | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ২৩:৩৫689549
  • মোটামুটি এই ঠিক হল যে, পঁচিশ তারিখে রাত নটার পরে বুনান আর তার ছানাকে পিক আপ করে আমরা এগবো হরিদ্বারের দিকে, পরদিন সেখান থেকে বাস ধরে উত্তরকাশী। ২৭ তারিখ সকালবেলায় দয়ারা বুগিয়ালের জন্য ট্রেক শুরু, উত্তরকাশী ফিরব ৩১শে ডিসেম্বর। পয়লা জানুয়ারি আবার হরিদ্বার, এবং দোসরা সকাল সকাল স্টার্ট করে দিল্লি, করিমসে লান্‌চ সেরে ওরা ফেরার ট্রেন ধরবে।

    পঁচিশ তারিখ, বড়দিনের রাতে, নটা পঁচিশ নাগাদ এয়ারপোর্টের বাইরে বুনানের ঝাঁকড়া চুল দেখা গেল, পিঠে একটা ইয়া গাবদা ব্যাগ, সঙ্গে একটা নিরীহ, মিষ্টি দেখতে ছেলে, চোখে শিয়াল পন্ডিতের মত চশমায় তাকে আরও নিরীহ দেখাচ্ছে, তার পিঠেও অনুরূপ একটা গাবদা ব্যাগ। ঝটপট ডিকিতে ব্যাগ ভরে সাড়ে নটা নাগাদ আমরা যাত্রা শুরু করলাম। বুনান আলাপ করিয়ে দিল - ছেলেটার নাম হচ্ছে অর্পণ, একই অফিসে কাজ করে, এ-ও ট্রেক ইত্যাদি করে, আগে নাকি কোথায় কোথায় ঘুরে এসেছে, এইবারে বেরিয়েছে বুনানের সঙ্গে। যা বুঝলাম, এই দলে একমাত্র আমিই সে অড ব্যক্তি, যে জীবনে এক কিলোমিটারও ট্রেক করে নি। যা থাকে কপালে - বলে অ্যারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।

    হরিদ্বার যাবার একটিই রাস্তা, আমার বাড়ির পাশ দিয়ে। যেতে যেতে বুনান বলল, তুমি উত্তরকাশী অবধি গাড়ি চালাতে পারবে? পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভ্যেস আছে তোমার?

    গাড়ি চালানোর কথায় আমার তো কখনওই 'না' নেই। যদিও এর আগে পাহাড়ে চালানো বলতে সেই ধরমশালা ম্যাকলিওডগঞ্জ যাত্রা, তাও সে তো পাহাড়ই বটে। হিমালয় পাহাড়, হোক না অনেক নিচু হাইটে! বললাম, হ্যাঁ দিব্যি পারব। বুনান এবং অর্পণ দুজনেই বলল - তা হলে এক কাজ করো, হরিদ্বারে গাড়ি না ছেড়ে সোজা গাড়ি চালিয়ে পরদিন উত্তরকাশী যাই চলো। একে তো হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীর বাসগুলো ছাড়ে খুব ভোরের দিকে, আমাদের ভোর পাঁচটায় উঠে বাস ধরতে হবে - এদিকে হরিদ্বার পৌঁছবোই আজ হয় তো রাত দুটো আড়াইটেয়, ঘুম হবে না। সঙ্গে গাড়ি থাকলে আমরা আরামসে বেলা পর্যন্ত রেস্ট নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বেরোতে পারি, হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী মোটামুটি দুশো কিলোমিটার - দিল্লি থেকে হরিদ্বারের যা দূরত্ব। পাহাড়ি রাস্তায় মোটামুটি আরামসে চালালেও পাঁচ থেকে ছ ঘন্টায় দিনের আলো থাকতে থাকতে উত্তরকাশী পৌঁছে যাবো। বুনান বলল, আমি প্রেমের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি, উত্তরকাশীতে তোমার গাড়ি পার্ক করার জায়গা থাকবে, আর রাস্তাও খুব কিছু খারাপ নয়। চলে যাওয়া যাবে।

    জিও পাগলা - আমার তো কোনও চাপই নেই, গল্প করতে করতে ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলাম গাজিয়াবাদ, মীরাট, মুজফফরনগর। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার সময়ে একটা ছোট ধাবায় দাঁড়িয়ে একপ্রস্থ চা খাওয়া হল, জল কেনা হল। অর্পণ দেখছি একটা একটা করে জায়গা পেরোচ্ছে, আর ফোন করে কাকে যেন সময়ে সময়ে স্টেটাস আপডেট দিচ্ছে - হুঁ, বুঝলে, এই মীরাট পেরোলাম, হ্যাঁ, এর পরে মুজফফরনগর, হ্যাঁ-হ্যাঁ, দেরাদুন - না না, হরিদ্বার পৌঁছবো হয় তো রাত দেড়টা নাগাদ, হ্যাঁ হ্যাঁ, খেয়ে নিয়েছি, হুঁ, জল কিনেছি।

    বুনান পাশের সীট থেকে বলল - স্টেটাস কল। কথায় কথায় কাহিনি বেরলো, এবং অর্পণের লজ্জা লজ্জা মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না স্টেটাস কলগুলো এত রাতে কাকে দেওয়া হচ্ছিল।

    একটু পরেই রুড়কী ঢুকল, আর সাথে সাথে কোথা থেকে যেন রাস্তার ওপর জেঁকে বসল চাপ চাপ কুয়াশা। অলমোস্ট কিছু দেখা যায় না, তবে সে কুয়াশা বেশিক্ষণ রইল না। রুড়কী টাউনের ভেতরে ঢুকতেই কুয়াশা কমে গেল, আইআইটি গেটের পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলাম, হরিদ্বার আর মাত্র তিরিশ কিলোমিটার।

    হরিদ্বারে হোটেল শিবমূর্তিতে পৌঁছনোর রাস্তাটা খুঁজে পেতে অবশ্য একটু সময় লেগেছিল, জিপিএস ঠিক করে দেখাতে পারছিল না, হাইওয়ে থেকে হরিদ্বার সিটিতে ঢোকার রাস্তা ঠিক কোনটি। তবে খানিক এদিক ওদিক করার পর অবশেষে একজনকে জিজ্ঞেস করে সঠিক রাস্তার দিশা পেলাম এবং যতক্ষণে হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম, তখন বাজে রাত দুটো বেজে আটচল্লিশ।

    রুমে ঢুকে চমৎকার বিছানা, হাল্কা ঠাণ্ডা আর মোটা লেপ। ঘুম আসতে কি সময় লাগে?

    নাহ্‌, বুনানের বা অর্পণের সময় লাগে না বটে, কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না। আসবে কী করে? কী সাংঘাতিক নাক ডাকে রে ভাই বুনান! সাধে কি লোকে ওকে দেখলেই মাথার চুলে চিউয়িং গাম আটকে দেবার চেষ্টা করে?

    অগত্যা, কী আর করা, ভেড়া গোনার অভ্যেস নেই, ওর নাক ডাকাই গুণতে শুরু করলাম, এক ... দুই ... তিন ... চার ... ... একশো পঞ্চান্ন ... একশো ছাপ্পান্ন ...

    ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। একগুচ্ছ বাঙালির ক্যালোর ব্যালোরে।
  • সিকি | ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ২৩:৩৭689560
  • চারপাশের রুমগুলোয় সম্ভবত অনেক বাঙালি এসেছে, গামা গামা পরিবার-পরিজন সাথে নিয়ে। তারা বেড়াতে বেরোবে, সবাই তৈরি হচ্ছে - তারস্বরে বাক্যালাপ চলছে, হ্যাঁরে তোর বাদরুম এখনও হল না? আর কতক্ষণ ডাঁড়িয়ে থাগ্‌বো? ওদিকে তো বাস এসে গেল। আরে সুবল, তোদের পায়খানায় কি জল পড়ছে রে? এদিকের পায়খানাটায় ব্লা ব্লা ব্লা ...

    বুনানের আর নাক ডাকছে না, বুঝতে পারছি, বাইরের তর্জন গর্জনে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেছে, কেবল দায়িত্ব নিয়ে কেউ উঠতে পারছে না। ... আমিই উঠলাম, বাইরে বেরিয়ে দেখি, ঠিক তাই, একগুচ্ছ বাঙালি, আটপৌরে শাড়ি পরা গোটা তিনেক বিভিন্ন বয়েসের মহিলা, লুঙ্গি এবং বার্মুডা পরা (দুটোই আমার দু চক্ষের বিষ) মুশকো গুঁপো কয়েকটা ছেলে, তাদের গায়ে গেঞ্জি, সোয়েটার, মাথায় মাফলার - এ ঘর সে ঘর করে বেড়াচ্ছে। আশেপাশের গোটা তিনেক রুমের দরজা হাট করে খোলা, তার মধ্যে দুটির ভেতর থেকে বিচিত্র স্বরে দাঁত মাজা এবং জিভ ছোলার আওয়াজ আসছে - একেবারে পুঁদিচ্চেরি কাণ্ড। এর মধ্যে একজন লুঙ্গি দেখি বালতি হাতে করিডরে যাতায়াত করছেন।

    ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাকিদের ডেকে তুললাম। অর্পণ ঘুম থেকে উঠেই হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিল, এবং দিনের প্রথম স্টেটাস কল্‌ দেওয়া শুরু করে দিল। বাথরুমে ঢুকে দেখি সে বিচিত্র বাথরুম। কল দিয়ে জল পড়ে না, বেসিনে পড়ে, তবে গরম জল নেই, মানে গীজার কাজ করছে না। এত সকালে চান করার কোনও মানেই হয় না - তবে মুখ টুখ তো ধুতে হবে। প্রথমে রিসেপশনে দুবার ফোন করলাম, কেউ এল না, অগত্যা ঠাণ্ডা জলেই দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ফেললাম। এর পরে অর্পণ বাথরুমে ঢুকেই বেরিয়ে এল কলের মুখটা হাতে নিয়ে - সে নাকি জোর করে কলটা খুলতে গেছিল, জল তো পড়েই নি, মুখটা আলগা হয়ে খুলে চলে এসেছে, আর লাগছে না।

    অগত্যা, নিচে গিয়ে তাগাদা লাগিয়ে এলাম। সুবিশাল বাঙালি গ্রুপ তখন রিসেপশনে ভিড় জমিয়েছে, তাদের বাস এসে গেছে, বেড়াতে যাবে। রিসেপশন থেকে একটা ছেলেকে পাঠাল, সে ছেলেও আমাদের বাথরুমে বিস্তর কোস্তাকুস্তি করে না গরম জল বের করতে পারল, না কলের মুখ লাগিয়ে দিতে পারল। অগত্যা আমিই তাকে বললাম, অন্য কোনও রুম খালি থাকলে একটু খুলে দাও, আমরা বাথরুমটা ইউজ করব। ... তা সে খুলেও দিল, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের সকলেরই বাথরুমের কাজ শেষ - মানে, এত সকালে চান করার তো প্রশ্নই আসে না, সবে ভোর সাড়ে আটটা বাজে - বাকি কাজ সব কমপ্লিট। আমরা নিচে নেমে এলাম।

    সামনেই মিষ্টির দোকান, একটু কাজু বরফি কেনা হল, রাস্তায় খাবার জন্য, পাশে চায়ের ঠেলা, সেখানে দাঁড়িয়ে চা খেলাম। ধীরেসুস্থে সোয়া নটা নাগাদ গাড়ি বের করে আমরা বেরোলাম। জিপিএসে যদিও দেখে নিয়েছিলাম রুটটা - তা, বুনান বলল, সে এর আগেও উত্তরকাশী গেছে, ও রুট চেনে, এখান থেকে দেবপ্রয়াগ হয়ে শ্রীনগর হয়ে (এটা উত্তরাখণ্ডের শ্রীনগর) যেতে হয়। শ্রীনগরের পরে জিপিএস অন করলেও হবে।

    খুব ভালো কথা। হরিদ্বার থেকে বেরিয়ে পড়লাম। একটু এগোতেই রাস্তার দুপাশে বেশ জঙ্গল এলাকা শুরু হল, বুনান বলল, এটাই নাকি রাজাজি ন্যাশানাল পার্ক। সেটা পেরোতেই আবার লোকবসতি শুরু হল, একটা রাস্তা 'দেরাদুন' লেখা - বাঁদিকে বেঁকে গেল, আমরা সোজা রাস্তা ধরে হৃষিকেশ ঢুকে গেলাম। খানিক পরেই পেরিয়ে গেলাম লছমনঝুলা, বিশাল চওড়া গঙ্গা নাচতে নাচতে চলেছে। হরিদ্বার, হৃষিকেশ - জায়গাগুলো খুবই ভালো সন্দেহ নেই, কেবল এখানে পিওর ভেজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ফেরার সময়ে আমাদের আবার হরিদ্বারে থাকতে হবে, একবেলা কীভাবে ভেজ খেয়ে থাকব, সেই ভেবে যাবার সময়েও চিন্তায় পড়ে গেলাম, বুনান একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, চাপ নিও না, আমি একটা জায়গা জানি, যেখানে গুছিয়ে নন ভেজ পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে খেয়ে আসব।

    বেশ অনেকটা চালাবার পরে পৌঁছলাম একটা ফাটাফাটি সুন্দর জায়গায়, জায়গাটার নাম দেবপ্রয়াগ। সামনে একটা খাদের মধ্যে গঙ্গার বুকে এসে মিশেছে অলকানন্দা, দু রকমের জলের রঙ, সে এক অপূর্ব দৃশ্য।


    খানিক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই বুনানের কাছে ফোন এল প্রেমের। প্রেম, মানে আমাদের ট্রেকিং গাইড। তাকে জানানো হল যে আমরা দেবপ্রয়াগে পৌঁছেছি, শ্রীনগর পৌঁছে তাকে খবর দেব। প্রেম, মনে হল একটু চিন্তায় পড়েছে। বলল, আপনারা তো বেশি ঘোরা রুট নিয়েছেন, একটা শর্ট রুট ছিল, তাতে করে পঞ্চাশ কিলোমিটার কম পড়ত রাস্তা। যাই হোক, শ্রীনগর পৌঁছে ফোন করে দেবেন।

    গাড়ি চলেছে, চলেছে, সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে ওপরে উঠছে, নিচে নামছে, এই করে আমরা মোটামুটি বেলা একটা নাগাদ শ্রীনগরে এসে পৌঁছলাম। শুরুর সময়ে ওডোমিটারের রিডিং দেখি নি, তবে আন্দাজ সোয়া শো কিলোমিটার তো এসে গেছিই, আর খুব বেশি হলে আশি কিলোমিটার মত রাস্তা বাকি আছে। এইবারে জিপিএস অন করি।

    অলকানন্দা নদীর ওপর ছোট্ট ব্রিজ, ব্রিজ পেরিয়েই দুদিকে দুই রাস্তা বেঁকে গেছে, বাঁদিকের রাস্তায় লেখা - শ্রীনগর। গাড়ি সাইড করে জিপিএস অন করতেই চক্ষু চড়কগাছ!

    জিপিএস বলছে, উত্তরকাশী থেকে আমরা এখন রয়েছি একশো আটানব্বই কিলোমিটার দূরে, এবং - আমাদের যেতে হবে উল্টোদিকে, যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকেই পয়েন্ট করছে ম্যাপ। মানে, আমরা কিনা সকাল থেকে এক ইঞ্চিও এগোই নি? তড়িঘড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুটো লোককে জিজ্ঞেস করলাম, তারাও খুবই কনফিউজড হয়ে উল্টোদিকেই হাত দেখাল।

    গাড়ি ঘোরালাম। উল্টোদিকে মানে, কতদূর যেতে হবে? কোনও কাট কি আমরা মিস করে গেছি? জিপিএসে পুরো রুটটা এইবারে ভালো করে মন দিয়ে দেখলাম - রাস্তা যাচ্ছে টিহরি ড্যামের পাশ দিয়ে - নিউ টিহরি বলে একটা গ্রাম পড়বে - যেটা মোটামুটি মাঝামাঝি, এখান থেকে একশো কিলোমিটারের মাথায়, সেটা ছাড়িয়ে চাম্বা, সেখান থেকে উত্তরকাশী যাবার রুট। এইবারে মনে পড়ল, দেবপ্রয়াগ ছাড়াবার পরেই বাঁদিকে একটা রাস্তা দেখেছিলাম নিউ টিহরি লেখা, সে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার আগে, আমরা সেটা না নিয়ে সোজা এসেছি শ্রীনগরের দিকে। তার মানে সেই অবধি পৌঁছতে হবে।

    আমাদের সবারই মুখ চুন প্রায় - নেহাত গাড়িতে পর্যাপ্ত তেল আছে, আর সবে দুপুর একটা বাজে, এখন নতুন করে আবার দুশো কিলোমিটার পাড়ি দিতে গেলে সন্ধ্যে ছটার মধ্যে আরামসে পৌঁছে যেতে পারব, সন্ধ্যে হবার মুখেই।

    এগনো গেল, অবিশ্যি দেবপ্রয়াগ অবশি যেতে হল না, তার আগেই ডাইভার্সন পেয়ে গেলাম, সোজা রাস্তা পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে নিউ টিহরি গ্রামের দিকে। আর জিপিএস বন্ধ রাখার প্রশ্নই নেই, গাড়ি চালাতে থাকলাম। অনেকখানি আসার পরে চোখে পড়ল গঙ্গা - ক্রমশ চওড়া হচ্ছে ওপরের দিকে, আর চারপাশে কংক্রিটের কাজ। এখানে অবশ্য গঙ্গার নাম ভাগীরথী। আরও খানিক এগিয়ে বুঝলাম, আসল নদী নয়, নদীর জল বাঁধ দিয়ে এই হচ্ছে টিহরি ড্যামের শুরু। ভারতের বৃহত্তম ড্যাম এটা। চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার, আর তেমনি নীলচে সবুজ জল। পড়ন্ত দুপুরের সূর্যের আলো পড়ে আরও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। একটা জায়গায় গাড়ি থামাতেই হল, টিহরি ড্যামের ছবি তোলার জন্য। খানিক ফটো তুলে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম, কিন্তু ড্যাম শেষই হয় না, ক্রমশ আরও চওড়া হচ্ছে, আরও চওড়া। তার পরে এক জায়গায় দেখি ড্যাম সরু হয়ে এসেছে, আর রাস্তা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে - রাস্তা বলেই কিছু নেই, ধূলো আর বোল্ডারের ওপর দিয়ে চলা। জিপিএস কিন্তু রাস্তা দেখাচ্ছে, খানিক এগোতেই ছোট্ট একটা ব্রিজ আমাদের ভাগীরথী পার করিয়ে দিল, এইবারে শুরু হল টিহরি ড্যামের অন্য দিক দিয়ে আমাদের ফিরতি যাত্রা। চারটে বাজে - রাস্তা খারাপ, সামনে এখনও সাতানব্বই কিলোমিটার, প্রেম আরও দু তিনবার ফোন করেছে বুনানকে, বলেছে ল্যাম্ব গাঁও এলে যেন ওকে একবার ফোন করে দেয়, ওখান থেকে উত্তরকাশী কাছেই।

    খিদে পেয়েছে, লান্‌চ হয় নি, সকালে কেনা কাজু বরফি দিয়েই চলেছে মোটামুটি। একটু এগোবার পরে খারাপ রাস্তা শেষ হল, আর আবার সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা শুরু হল। একটা সময়ে আমরা চাম্বা এসে পৌঁছলাম - সেখানে দেখি ডানদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে ধারাসু বেন্ড হয়ে উত্তরকাশী, আর বাঁদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে হরিদ্বার হৃষিকেশ। বোঝো কাণ্ড! হৃষিকেশ নাকি এখান থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার? আমরা তার মানে শুরু থেকেই ভুল রাস্তায় চলেছি? সব ব্যাটা বুনানের ওভার-কনফিডেন্সের ফল।

    ধারাসু বেন্ড মানে, রাস্তাটা ওখানে চুলের কাঁটার মত বেঁকে গিয়ে অন্য এন এইচে উঠেছে। ধারাসু একটা ছোট গ্রামের নাম। জিপিএস বলছে এটা এন এইচ নাইন্টি ফাইভ, কিন্তু রাস্তার বোর্ড, মাইলস্টোনে সর্বত্র দেখছি লেখা আছে এন এইচ থার্টি ফোর। এটা কী রকম হল? এন এইচ চৌত্রিশ তো জানি কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যায়! আমরা বাই এনি চান্স শিলিগুড়ির দিকে যাচ্ছি না তো? না, বোর্ডে তো লেখা উত্তরকাশি পঁয়ষট্টি কিলোমিটার।

    ধারাসু বেন্ড আসার আগে একটা ছোট গ্রাম, কামান্দ, সেখানে দাঁড়ালাম চা খাবার জন্য। কোনওরকমে এক গ্লাস করে চা চোঁ চোঁ করে মেরে দিয়ে বুনান আর অর্পণ দৌড় লাগালো ইসের খোঁজে, সারাদিন জার্নি করার পর নাকি রাতে কয়েক গেলাস ইসে না হলে ওদের চলবে না। আমি ধীরেসুস্থে গাড়ির কাচ-আয়না মুছে আবার স্টার্ট করে বাজারের শেষপ্রান্ত থেকে দুই মূর্তিমানকে তুলে নিয়ে এগোলাম।

    ধারাসু বেন্ড আসতেই রাস্তাটা ঘুরে গেল, আর শুরু হল এন এইচ একশো আট। ওরেবাবা, সে কী রাস্তা। জায়গায় জায়গায় বোল্ডার, ভাঙা রাস্তা, আবার জায়গায় জায়গায় বেশ পরিষ্কার রাস্তা। কোথাও কোথাও অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে আজ দুপুরেই এখানে ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে। বুনান খানিকক্ষণ দেখে গম্ভীরভাবে বলল - রাস্তাটা স্পেশাল, এটা পার্টলি এন এইচ, আর পার্টলি 'একশো আট'। দুটো একসঙ্গে কোনওমতেই নয়। ... মনে ধরে গেল কথাটা। এর পর যখনই ভাঙা রাস্তা শুরু হয়, আমরা সমস্বরে বলি, এই একশো আট শুরু হল, আবার ভালো রাস্তা পেলেই - এই এন এইচ শুরু হল।

    সবই হল, কিন্তু ল্যাম্ব গাঁও কোথাও পেলাম না। প্রেমকে ফোন করব কী করে? ঠিক হল, মাইলস্টোনে যখনই দেখাবে উত্তরকাশী আর পাঁচ কি সাত কিলোমিটার, আমরা প্রেমকে ফোন করব। উত্তরকাশীই যখন এসে যাচ্ছি, আর ল্যাম্ব গাঁও কি মাটন গাঁও দেখে কী করব? এমনিতেই এইসব নাম শুনলে আমার প্রচণ্ড খিদে পায়, তার ওপরে দুপুরে কাজু বরফি খেয়ে খিদে মেটাতে হয়েছে।

    প্রেম বুনানের পূর্বপরিচিত, ওরা একসাথে এর আগেও ট্রেক করেছে, তাই উত্তরকাশী ঢোকার মুখে প্রেমকে পিক আপ করে নিতে অসুবিধে হল না। রোগাসোগা একজন লোক, এ কিনা পীক টিকে উঠে ঘুরে এসেছে? তাও এক নয়, একাধিকবার? মুখ দেখে সন্দেহ হচ্ছিল, তা প্রেম নিজেই খোলসা করে দিল - সে আসলে নেপালী, কেবল জন্ম আর বেড়ে ওঠা উত্তরকাশীতে। প্রচণ্ড খাতির করে প্রেম নিয়ে গেল হোটেল মন্দাকিনীতে, ভাগীরথীর একদম সামনেই। সুন্দর রুম, খানিক বসে হাত পা ছাড়িয়ে আবার প্রেমের সাথেই নেমে এলাম - একটু সামনেই প্রেমের ভাই আর ভাই-বৌয়ের দোকান, সেইখানে আমাদের ডিনারের ক্ষুদ্র আয়োজন। বুনান সমানে জিজ্ঞেস করছে, প্রেম ভাইয়া, চিকেন টিকেন হ্যায় তো? আর প্রেম ছোট ছোট চোখদুটোকে আরও ছোট করে হাসছে, সবকুছ হ্যায় দুইপায়ন্দা (বুনানকে ওই নামেই ডাকে) বাকি সব ইন্তেজাম ভি হাম কার দেঙ্গে।

    ঠান্ডা, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক কিছু নয় - আমরা টুক টুক করে হেঁটে সেই দোকানে গিয়ে অমৃতসমান মাংসের চাট আর রুটি খেলাম। সঙ্গে ডালও ছিল, কিন্তু অমন ডেলিসিয়াস চিকেন পেলে আর ডাল কে খায়? খেয়ে দেয়ে উঠে এক গ্লাস করে চা, তারপরে হোটেলে ফেরত।

    এদিকে আমি ব্যাগের সাইড পকেটে একটা ছোট থামস আপের বোতলে করে খাবার জল এনেছিলাম, সেইটা দেখি আর নেই। কোথায় পড়ল? নিচে গিয়ে আবার গাড়িতে খুঁজে এলাম, না, গাড়িতেও নেই - ওপরে এসে দেখি, বুনান, অর্পণ আর প্রেম তিনজনেই গ্লাস সাজিয়ে বসেছে, আর তাদের সামনে, ঠিক আমার থামস আপের বোতলটার মতই একটা বোতল, তাতে লাল জল ভরা। অবিশ্যি সব থামস আপের বোতলই এক রকমের দেখতে হয়। সামনে প্রেম আছে, জিজ্ঞেসও করতে পারছি না, সবার চাপাচাপিতে এক গ্লাস লাল পানি নিয়ে আমিও বসলাম।

    রামোঃ! কী অখদ্দে টেস্ট। লোকে যে কী সুখে এইসব খায়!

    প্রেম চলে গেল খানিক বাদেই। কিন্তু কিন্তু করে আমি বোতলটার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম বুনানকে। ও মা, বুনান দেখি হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ওটা তো তোমার ব্যাগেরই সাইড পকেট থেকে নিইচি। হাফ লিটারের বোতল, ক্যারি করা সুবিধে হবে - এত বড় বোতল (আসল রাম-এর বোতলটার দিকে দেখিয়ে) নিয়ে ট্র্যাভেল করা চাপ হয়ে যায় না? তাই তোমার বোতলটা আমি নিয়ে নিয়েছি। তুমি চাপ নিচ্ছো কেন, আমার কাছে তো জলের বোতল আছে, তেষ্টা পেলেই খেয়ে নেবে।

    আমি তখন মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছি। এক বিশেষ কারণে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর যাই করি, বুনানের দেওয়া জলের বোতল থেকে জল খাবো না - কিছুতেই না। অবশ্য, এখনও পর্যন্ত হোটেলে আছি, পাকা বাথরুম আছে, কিন্তু এর পর? আর হতভাগা বুনান কিনা প্রথম দিনেই আমার একমাত্র জলের বোতল ঝেড়ে দিল? তাতে রাম ঢেলে দিল?

    রাগ করে আর দ্বিতীয় গেলাস নিলাম না। একে তো ওই পচা টেস্ট, তার ওপর কিনা আমার জলের বোতল ঝেড়ে দেওয়া? ওচ্চেয়ে গুলতানি মারা ভালো। বুনান অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, ধীরেসুস্থে চুমুক মারছে। কিন্তু বুনানের ছানা তো ঢকঢক করে খাচ্ছে আর পরের গ্লাস বানাচ্ছে। খানিক বাদেই যা হবার তাই হল। ...

    ... তখন বোধ হয় বইটই নিয়ে খানিক নষ্টলজি হচ্ছিল। অর্পণ হঠাৎ খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে আমাকে বলল, আচ্ছা সিকিদা, জুল ভের্নের একটা বই পড়েছিলাম, তাতে একটা লোক সাবমেরিন চালাতো -

    আমিঃ হুঁ, টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস

    অর্পণঃ হ্যাঁ, কিন্তু গল্পটা শেষ হয়ে গেল, তারপরে ক্যাপ্টেন নিমোর কী হল, সেটা কোথাও লেখা নেই? নিমোর কী হল? সে কি বেঁচে রইল, না মরে গেল?

    অর্পণ রীতিমত সিরিয়াস। হাল্কা করে জিজ্ঞেস করলাম, জুল ভের্নের সবকটা লেখা পড়েছিস?

    অর্পণঃ না, সবকটা পড়া হয় নি - মানে কয়েকটাই পড়েছি।

    আমিঃ তা হলে এক কাজ করিস, বাড়ি ফিরে জুল ভের্নের দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড বইটা খুঁজে নিয়ে পড়ে ফেলিস। ওতেই ক্যাপ্টেন নিমোর শেষটা আছে।

    অর্পণ শুনে কী খুশি। আরও খানিকক্ষণ এতোল বেতোল বকে, তার যে একেবারেই নেশা হয় নি, সেটা প্রমাণ করে ধপাস করে শুল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।

    সারাদিন ড্রাইভ করে আমিও এখন অল্প ক্লান্ত। কিন্তু ঘুমোই তার জো আছে নাকি? কাল ছিল একা বুনান, আজ জুড়েছে অর্পণ। দুটো আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে আমার পাশ থেকেই ভেসে আসছে নাসিকাগর্জন। এ আর কাঁহাতক সহ্য হয়? খানিক এপাশ ওপাশ করে আমিও কালকের মতই গুণতে শুরু করলাম একষট্টি ... বাষট্টি ... পঁয়ষট্টি ...

    ঘুম এসে গেল খানিক বাদেই।
  • hu | 108.228.61.183 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০২689571
  • যা তা ভালো হচ্ছে!
  • ranjan roy | 24.99.25.191 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৫689582
  • জ্জিও কাকা!
    বুনানের সঙ্গে খাওয়া এবং পান? আমার ছোট্ট সুযোগ হয়েছিল--মাত্র দুবার। আমি নিশ্চিত যে বুনান হল দেবযোনি। মানে ঈশ্বর ওকে শুধু খাওয়ার (সবরকম খাদ্যাখাদ্য এবং পানীয়) জন্যেই সৃষ্টি করেছেন।
    ও এই অধমকে নিম্নরূপ ফান্ডা দিয়াছিলঃ
    মদ খাওয়া আবার কম-বেশি? যত পারেন খাবেন!
  • King Ghidorah | 117.167.104.143 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৬689477
  • ভাঙের গুলি নিয়ে যায়নি? সিকিমে গুলি খেয়ে সারা রাত্তির বাবু হয়ে বসে "কী নেসাআআআ, কী নেসাআআআ" করেছিলো।
  • sosen | 184.64.4.97 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৭:৪৮689488
  • আমাকে বলেছিল অ্যালকোহল খেলে পেটের সব জীবাণু মরে যাবে , জীবাণুনাশক কিনা!
  • Div0 | 132.171.164.47 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:১২689497
  • কিন্তু বুনানের জলের বোতল থেকে সিকি জল খাবে না এমং পিতিজ্ঞা সিকি কেন করেছিল?

    ধারাসু, নগরাসু সব গ্রামগুলো মনে পড়ে যায়। ওই রাস্তা ধরে চামোলি যাওয়া। জোশিমঠ (শুনেছি জোশিমঠ থেকে মুসৌরি একটা ট্রেক হয়।)। সেখান থেকে অলি (যেখানে আজও রোবুর চোখের জল বরফে নীল হয়ে মিশে আছে স্কি না করতে পারার দুঃখে)।
  • King Ghidorah | 151.0.12.130 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:৩৩689498
  • কারণ বুনান জলের বোতলে ইসে করে। আর সেটা রেখে দেয়। কার যেন একটা চ্যালা, তাই।

    আর এই স্টেটাস কল মাইরি, আমার হল স্টেটাস মেসেজ। চেকইন করলুম, প্লেনে উঠবো, এই পৌঁছলুম - এসব না দিলে ফোন এসে যাবে, আর আমি ঐ ম্যাট্রিক্স ইঃ সিম নিয়ে ঘুরি না, ইন্টারন্যাশনাল রোমিংএ গুছিয়ে পকেট কাটে। আমি নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে যাই, তাইঃ-(
  • Div0 | 132.171.164.47 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:৩৮689499
  • (ㆆ_ㆆ) ... ( ˘︹˘ )
  • | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:৫৩689500
  • হি হি হা হা হা বুনু সেরেপ দুপুরের খাওয়া সারতেই কলকেতা শহরে ভরদুপ্পুরবেলা আমাকে যা ঘুরিয়েছিল ....
  • sinfaut | 74.233.173.193 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:০৭689501
  • এ পুরো হ্যাডক লেভেলের ভালো হচ্ছে। উফ্ফ বন্ধুদের সাথে এমন ঘুরতে যাওয়ার থেকে মজাদার, পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
  • sinfaut | 74.233.173.198 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:১১689502
  • বুনান ভাগ্যিস ট্রেকের সময় গাইড নিয়ে যায়। নইলে হয়তো ঐ তো ঐ মোড়টা ঘুরলেই সন্দাকফু বললো আর তারপরেই হাল্কা করে লোকজন তালসারীর দিকে নেমে গেল।
  • Div0 | 132.171.164.47 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:১৮689503
  • বুনান নিজের ইনবিল্ট কম্পাস ঠিকঠাক ক্যালিব্রেট না করার ফলে র‍্যান্ডম আওয়াজ খাচ্ছে, এটা খুব ভালো ব্যাপার। :D

    ডিডিদা', লক্ষ্য করবেন, সিকি রাম্পান শুরু করেছে।
  • না না | 192.69.246.234 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:২৩689504
  • জলের বোতলে ইসে করে না, ইসের পরে ধোয়ার কাজ এবং জলপানের কাজ ও একই বোতল থেকে করে।
  • তবে | 192.69.246.234 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:২৫689506
  • তবে বুনানের এই একটাই ছড়ানো - রুট সম্বন্ধে ওভারকনফি। এর পরে ছড়ানোর যাবতীয় কীর্তি একা সিকির কাঁধে।
  • dd | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:৩৬689507
  • আমি তো শুনেছিলাম ব্ল্যাং, প্লেন বা টেনেও গাইড নিয়ে চলে। যদি সীট বা ক্ম্পারট্মেন্ট চিনতে না পারে?
  • ranjan roy | 24.96.74.157 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:৪৭689508
  • সে তো মহান সব ধর্মাত্মা সাধুরাও একই কমন্ডলু থেকে দুটো কাজই করে থাকেন, মানে ধোওয়া এবং নাওয়া-খাওয়া! বুনান যে দেবযোনি সেট ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।ঃ))
  • d | 144.159.168.72 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:৫৩689509
  • "দেবযোনি"!!?? ইন্টারেস্টিং!
    নরযোনিটা বেশ খারাপ কিছু আর দেবযোনিটা উন্নততর কিছু?
  • Abhyu | 127.194.203.111 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১১:২০689510
  • আচ্ছা এবারে বুনুকে কল করলাম। রিঙটোন তো আগের মতো ইন্টারেস্টিং নেই? সেই হিন্দিতে এক্জন ধমক দিতো, এখন ফোন করেছো কাকু এখ্খুনি একটা ধাক্কা লাগাতে লাগাতে বেঁচে গেও এইসব।

    আর, আর, বুনুর শিকাগো বেড়ানোর একটা টই ছিল, সেই মোবাইল মনে করে টিভির রিমোট আনা - দমুদি সেটা তুলে দিতে পারবে?
  • Ekak | 125.99.230.220 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১১:৩৩689511
  • উহ দেবযোনি শুনলে মিহির্দা কে মনে পরে। আরকেএম এর বাংলা প্রোস টিচার । টীকা লেখাচ্ছেন : অপ্সরা আআআ লিখো লিখো অপ্সরা দেবযানী বিশেষ ।
    খটাং করে উঠে দাঁড়ালুম । স্যার ওটা যানি হবেনা। তখন ডেকে বলেন আহা যোনি মানে আসলে তো ....আমরা জানি স্যার , যোনি মানে হইতে জাত। ওহ আমি ভাবলুম সবাই হাসবে :( আর অমনি ফ্যাক ফ্যাক করে কেলাশ্শুধ্ধু ছেলে হেসে উঠলো :))
    এ সে খচ্চর ক্লাস যেখানে জনতা পাইকারী রেটে আফগানিস্তানের ভূপ্রকৃতি পড়া বলত যাতে খানকিন পাহাড়ের নাম চিল্লে উচ্চারণ করা যায় ও সেই ফ্যা ফ্যা হাসি ।
  • Blank | 213.132.214.81 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১২:৪৫689512
  • কি কুচ্চো আমার নামে। একি অন্যায়। এদিকে আমি অন্তত কলম্বাসের মতন ছরাই নি।
  • souvik | 116.220.143.223 | ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৩:২৯689513
  • লেখাটা দারুণ হচ্ছে।কদিন আগেই একটা বই পড়লাম,দিজেন্দ্রনাথ বসুর লেখা গঙ্গোত্রি ,যমুনোত্রি।সেখানে এই নাম গুলো মানে ধারাসু,টেহরি,উত্তরকাশী হয়ে এই পথের এক দারুণ বিবরন ছিলো।তবে সেটা আজ থেকে ১০০বছর আগের।১৯১৪ই গেছিলেন লেখক ও তার বন্ধুরা।
  • d | 144.159.168.72 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:১৭689514
  • হেঁইয়ো ...
  • সিকি | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৬:১৪689515
  • তখন আমরা সতোপন্থ সামিটে যাচ্ছি। এভারেস্টের উচ্চতা না হলেও এভারেস্টের থেকে কোনও অংশে কম চ্যালেঞ্জিং নয়। সামিটের প্রথম বেস ক্যাম্প পড়ে যোশীমঠে। গারোয়াল রিজিয়নে এইটা একটা মেজর সামিট। এইদিককার সামিটগুলো মূলত আর্মির তরফেই আয়োজন করা হয়। ছজন আর্মির টিম, একজন লেডি মেজরও ছিলেন। আর পোর্টার, শেরপা ইত্যাদি মিলিয়ে মোট তিরিশজনের টিম। আমি ছিলাম হ্যাপ। আমার কাছে আর্মির সার্টিফিকেট আছে - HAP মানে, হাই অলটিট্যুড পোর্টার। অত ওপরে কম অক্সিজেনে আমরা মাল বয়ে ওপরে নিয়ে যাই, খচ্চরদের সঙ্গে।

    তিরিশজনের দলের মালও তো কম হয় না, তবু সমস্ত মাল নিয়ে আমরা ওপরে উঠলাম। সতোপন্থ সামিট বেশ ডেঞ্জারাস সামিট, মাঝে ক্রেভাস পড়ে। ক্রেভাস বিভিন্ন সাইজের হয়। ছোটখাটো ক্রেভাসের জন্য আমরা ল্যাডার ইউজ করি। মই বেয়ে এক এক করে পার হওয়া যায়, বড়সড় হলে প্রথমে রোপ বেঁধে চেষ্টা করি, একান্তই না পাওয়া গেলে, সে রাস্তা অ্যাবানডন করে অন্য দিক দিয়ে নতুন রুট খুঁজে বের করতে হয়।

    খাড়া চাড়াই, সবার কোমরে ঝুমর বাঁধা থাকে, সেখানে মাউন্টেনিয়ারিং-এর জন্য সমস্ত জিনিস তো বাঁধা থাকেই, আর বাঁধা থাকে রোপ। সবাই একের পর এক বাঁধা থাকে এই দড়ির সাহায্যে - এই দড়িই হচ্ছে আমাদের লাইফলাইন। কখনও কারুর পা ফসকালে রোপ টেনে ধরে তাকে বাঁচানো হয়।

    চ্যালেঞ্জিং হলেও, সতোপন্থ সামিট আমরা করে ফেললাম। সামিটে পৌঁছে স্যাটেলাইট ফোনে আর্মি বেসকে খবর দেওয়া হল যোশীমঠে। এবার ফেরার পালা।

    যাওয়াটা যত কঠিন, ফেরাটা তার চেয়েও বেশি কঠিন, কারণ প্রথমত একই রাস্তা ধরে ধরে নামা, ফলে একটা একঘেয়েমি এসে যায় বেশির ভাগেরই মনে। তার সাথে একটা ওভারকনফিডেন্স কাজ করে - সামিট হয়ে গেছে মানে আসল কাজ শেষ, চেনা রাস্তাই তো, জাস্ট নেমে গেলেই হল, ফলে ওঠার সময়ে গ্রুপের লোক যতটা সতর্ক থাকে, নামার সময়ে ততটা থাকে না। আর বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে সামিট করে নামার সময়েই। জর্জ হারবার্ট ম্যালোরিও - বিশ্বাস করা হয়, মাউন্ট এভারেস্ট সামিট করে ফেরার পথেই এইভাবে মারা যান, পঁচাত্তর বছর বাদে এই সেদিন যাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছে। তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারি তো প্রথম লোক যাঁরা এভারেস্ট সামিট করে জীবিত নেমে আসতে পেরেছেন। ম্যালোরি জীবিত নেমে এলে তেনজিংকে আজ আর কেউ চিনত না।

    সামিট সেরে নামার মুখে সেটা দ্বিতীয় দিন। আমরা এক জায়গায় বসে খাওয়াদাওয়া করছিলাম। খাবারের কোনও অভাব আমাদের কাছে ছিল না, যথেষ্ট রসদ নিয়েই ওঠা হয়েছিল। আর খেতে বসে একটা ছোট্ট ভুল করে বসলেন মেজর বাত্রা, আমাদের এক্সপিডিশন টিমের একজন ইয়ং সদস্য। বরফের ওপর খেতে বসার সময়ে উনি কোমরের ঝুমর থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে হাতে রাখলেন, বসতে অসুবিধা হচ্ছিল নইলে।

    দুর্ঘটনাটা ঘটল খাওয়া শেষ করে চলা শুরু হতেই। উনি দড়িটা আর কোমরে বাঁধেন নি, হাতে ধরেই চলছিলেন - সামনেই ছিল একটা তেরছা ক্রেভাস, বরফে ঢাকা ছিল, বাত্রার পা পড়ল সেখানে আর, নিমেষে ক্রেভাসের মধ্যে ঢুকে গেলেন মেজর বাত্রা। দুপুর তখন দুটো। ... আমরা ভোররাতে জার্নি শুরু করি, যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতে সামিট সেরে নিচে চলে আসা যায়। একবার অন্ধকার হয়ে গেলে এই সব রাস্তা আরও ডেঞ্জারাস হয়ে যায়।

    ক্রেভাস, বা পাহাড়ের ফাটলটা একটু নিচে নেমে ইংরেজি এল্‌ শেপে বেঁকে গেছে, বাত্রা সেইখানে আটকে গেছেন। নামবার কোনও রকমের উপায় নেই, আমাদের কাছে যা রোপ আছে, সেটাও নামিয়ে পৌঁছনো যাচ্ছে না বাত্রার কাছে।

    দুপুর দুটো থেকে রাত নটা পরযন্ত আমরা চেষ্টা চালিয়ে গেছিলাম। সমানে বাত্রার সঙ্গে কথা হচ্ছে, ওই রকম আটকে থাকা অবস্থায় বাত্রা বলছে তার কথা, তার গ্রামের কথা, তার সন্তানসম্ভবা বউয়ের কথা - সদ্য বিয়ে হয়েছে তাদের, এইসব বলছে আর খালি বলছে, মুঝে বচা লো, মুঝে বচা লো, ম্যায় মরনা নহী চাহতা ... আর আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, খাবারের প্যাকেট ছুঁড়ে দিচ্ছি, জল দিচ্ছি, কিন্তু ওকে তুলে আনতে পারছি না। ওর সাথে কথা বলছি, ওকে সাহস জোগাবার চেষ্টা করছি।

    কিন্তু হিমালয় একবার যার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে দিয়েছে, তাকে বাঁচায় কার সাধ্য? রাত নটায় স্যাটেলাইট ফোনে আর্মি বেস ক্যাম্প থেকে কল্‌ এল। এ সব ব্যাপারে আর্মির রুল অত্যন্ত কড়া - একজনের জীবন বাঁচাবার জন্য এতজনের জীবন রিস্কে ঠেলে দেবার কোনও মানে হয় না, অ্যাবানডন হিম, তোমরা নেমে এসো নিয়ারেস্ট ক্যাম্পে।

    আর্মির হুকুম হল, হুকুম। কারুর অমান্য করবার ক্ষমতা নেই - আর আমরাও জানতাম, এইভাবে এত প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আমরা যতই চেষ্টা করি, আমরা ওকে উদ্ধার করতে পারব না - এত নিচে গিয়ে ও আটকে আছে। কিন্তু কীভাবে ওকে ছেড়ে যাব?

    বাত্রা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল। সে বলছিল, মুঝে পতা হ্যায়, তুমলোগ মুঝে ছোড়কে জা রহে হো, আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি এখনও বাচ্চার মুখ দেখি নি, একটু চেষ্টা করো, প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না - আমরা ওকে প্রবোধ দেবার জন্য বলছিলাম, না না, আমরা নিচে যাচ্ছি আরও লম্বা রোপ আনতে, শিকল আনতে, যাতে তোমাকে তুলে আনা যায় -

    বাত্রা বিশ্বাস করে নি। আমরা নেমে আসতে আসতে ওর আর্তনাদ শুনছিলাম, জানি, তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো - আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ, আমি বেঁচে যাবো - প্লিজ -

    এক ঘণ্টা? খুব বেশি হলে দু ঘণ্টা? আমরা চলে আসার পর হয় তো অতক্ষণই বেঁচে থাকবে বাত্রা। ওই হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় অত রাতে এর চেয়ে বেশিক্ষণ কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।

    আমি এর পর আর কখনও সতোপন্থের রাস্তায় যাই নি। একটা টিম গেছিল বাত্রার ডেডবডি খুঁজে আনতে, পায় নি। সেই ক্রেভাসটা লোকেট করা যায় নি আর।

    ******************************

    আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। প্রেমের ঝুলিতে এমন অনেক অনেক গল্প আছে। আমারই বয়েসী লোকটা প্রচুর সামিট করেছে, প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে, এমন একটা লোক কিনা আমাদের সাথে দয়ারা বুগিয়ালের ট্রেকের দায়িত্বে। এত সুন্দর ব্যবহার, যেন মনে হচ্ছে, আমরা আসলে ওর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি।

    উত্তরকাশীতে সকাল হল প্রেমের ফোনে। ঝটপট তৈরি হয়ে গেলাম। কাল রাতের সেই ছোট্ট দোকানে গিয়ে আলু পরোটা আর অমলেট খেয়ে পেট ভরালাম। প্রেম এইবারে আমাদের নিয়ে যাবে এন আই এম-এ। নেহরু ইনস্টিট্যুট অফ মাউন্টেনিয়ারিং, উত্তরকাশী। এনআইএম আরও বেশ কয়েক জায়গাতেই আছে, তবে উত্তরকাশীরটা গাড়োয়াল হিমালয়ে ফেমাস, এদিককার বেশির ভাগ পীকের সামিট এক্সপিডিশন এই ইনস্টিট্যুট থেকেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের ছোট্ট ট্রেকের জিনিসপত্রও এখান থেকেই নেওয়া হবে। টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, আরও কী কী সব লাগে।



    আমার গাড়িতে করেই গেলাম এনআইএম। পাহাড়ের মাথায় ঝকঝকে একটা ইনস্টিট্যুট। এখন ছুটি চলছে সেখানে, তাই বিশেষ কেউ নেই। প্রেমের অনুরোধে ওদের মিউজিয়ামটা আমাদের জন্য খুলে দিল, সাথে স্যুভেনির শপও। এদের বিভিন্ন এক্সপিডিশনের ছবি, মাউন্টেনিয়ারিং ইকুইপমেন্টের টুকরোটাকরা জিনিসপত্র, এইসব দিয়েই সাজানো ছোট্ট মিউজিয়াম। পাশেই স্যুভেনির শপ, সেখান থেকে আমরা তিনজনেই কিনলাম এনআইএমের পাজামা, বুনান আর অর্পণ নিল উত্তরকাশীর ম্যাপবই, আমি নিলাম লাহুল স্পিটির ম্যাপবই। এর পরে আমাদের বড় বড় কাপে ঝকাস কফি খাওয়ালো, ক্যান্টিনের পরিচালক নাকি প্রেমের বন্ধু। বেরিয়ে দেখি একটা টাটা সুমোতে সব জিনিসপত্র লোড করা হয়ে গেছে। প্রেম আলাপ করিয়ে দিল আরেকটা ছেলের সাথে - বিজেন্দর। এ হল এনআইএমের কুক, প্রেম নিজেও দারুণ রান্না করে, তবে আমাদের ট্রেকে এবারের কুক হচ্ছে বিজেন্দর।

    আবার ফিরে এলাম হোটেল মন্দাকিনীর সামনে। এখানেই রাস্তার ধারে আমার গাড়ি রাখা থাকবে, আমরা এইবারে এই সুমোতে করে খানিকটা ওপরে যাবো। কাল থেকে শুরু হবে হাঁটা।



    লাগেজপত্র নিয়ে আমরা সুমোতে গিয়ে বসলাম। সুমো ভাগীরথীটা পেরিয়েই বাজারে আমাদের নামিয়ে দিল। বুনান আর অর্পণ বিজেন্দরের সাথে সাথে গেল ইসের দোকানে ইসে কিনতে, আমাকেও পিছু নিতে হল, প্রেম আরও একজনের সাথে গেল সব্জীবাজার করতে। ফাইনালি সাড়ে বারোটার সময়ে আমরা সবাই মিলে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গন্তব্য রায়থাল। উত্তরকাশী থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার ওপরে একটা ছোট্ট গ্রাম। কাল ওখান থেকেই আমাদের ট্রেক শুরু হবে।



    আমাদের সঙ্গে সীটের নিচে জায়গা হল আরও একটি প্রাণীর। প্রেম নিয়ে এসেছে বাজার থেকে। আমাদের আজ রাতের ডিনার।



    গাড়ি উঠতে শুরু করল ভাগীরথীর গা ঘেঁষে। প্রতিটা বাঁকে তার অপরূপ সৌন্দর্য, বিশ্বাসই হয় না এই জলই বয়ে যাচ্ছে এলাহাবার বারাণসী হয়ে আমাদের হুগলি কলকাতায়। স্বচ্ছ অ্যাকোয়া ব্লু রঙের জল পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে নিচের দিকে। আড়াই বছর আগে এই জলই আচমকা বেড়ে উঠে ধ্বংস করে দিয়েছিল দুপাশের অসংখ্য গ্রাম। সেখানে এখন গাড়োয়াল ডিজাস্টার রিকভারি প্রজেক্টের সৌজন্যে তৈরি হচ্ছে নতুন উঁচু রিভারবেড। এই এখন আমরা যে রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছি, এটাও আগে ছিল না, বন্যার পরে তৈরি হয়েছে।



    খানিক পরেই ডানদিকে পড়ল একটা ক্যাটক্যাটে লাল হলুদ রঙে রাঙানো আশ্রম, আর তার সামনে কিছু কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি। একটা মূর্তি আইডেন্টিফাই করতে পারলাম কালীর মূর্তি বলে। আরেকটা শিবমূর্তি - মাইরি এত অখদ্দে মূর্তি কোনও শিল্পী বানাতে পারে - আমার আগে জানা ছিল না। শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ার উপমা আগে শুনেছিলাম, এই প্রথম চোখে দেখলাম। এটা পাইলট বাবার আশ্রম।



    আরও খানিক এগিয়ে একটা গঞ্জ এলাকা, গুটিকয় দোকান, একটা এসবিআই এটিএম, সেইখানে গাড়ি থামল। জায়গাটার নাম ভাটওয়ারি। ড্রাইভার, বিজেন্দর, প্রেম আর বাকিরা এখানে একটু চা খাবে। আমরা নেমে একটু এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে নিলাম। ভাগীরথীর কোনও ভালো ভিউ নেই এখানে, চারদিকে এলোপাথারি দোকানঘর বানিয়ে তুলে জায়গাটার সৌন্দর্যই নষ্ট করে দিয়েছে।

    একটু এগিয়ে একটা টি পয়েন্ট। সোজা রাস্তাটা যাচ্ছে রায়থাল, আমাদের গন্তব্যে, ডানদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে গঙ্গোত্রী - আরও বাহাত্তর কিলোমিটার দূরে, গাড়ি চলে এখন গঙ্গোত্রীর রুটে। আর সেই মোড় ছাড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠলে একটু আপাত শান্ত এলাকা একটা ইউ-মোড়। সেইখানে একটা ছোট বাড়ি - দয়ারা ক্রিশ্চিয়ান অ্যাকাডেমি।

    পনেরো মিনিট বাদে গাড়ি আমাদের সেইখান থেকে তুলে নিল, আর আধঘন্টা পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রায়থাল। পাহাড়ের কোলে ছোটমত একটা গ্রাম। খুব বেশি হলে কুড়ি তিরিশটা ঘর, এদিক সেদিক ছড়ানো। চারপাশে ঝকঝক করছে বিভিন্ন বরফের পীক, তার কোনওটার নাম শ্রীকণ্ঠ, কোনওটা বান্দরপুঞ্ছ, কোনওটা গঙ্গোত্রী, একটা পীকের নাম, প্রেম বলল ডিকেডি। ডিকেডি কী? না, দ্রৌপদী কা ডান্ডা। সে আবার কী? হ্যাঁ, কথিত আছে, এই ডান্ডা (মানে এই পীকটা) দিয়ে নাকি দ্রৌপদী রান্না করতেন, মানে কড়াইতে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেন।





    একটা পীকের নাম খালি প্রেমও বলতে পারল না - বুনান এই সুযোগটা একেবারেই ছাড়ল না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের নামে করে নিল পীকটা - মাউন্ট ডিডাব্লুপি।

    মুরগী ততক্ষণে ড্রেসড হয়ে গেছে, রান্না শুরু হবার মুখে, জিনিসপত্র নামিয়ে একটা ছোট বাড়িতে ঢোকানো হয়েছে, এখানেই আমাদের রাতের আস্তানা, হোমস্টে। আমরা ক্যামেরা হাতে হাঁটতে বেরোলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সন্ধ্যে নেমে আসছে চারদিকে।















    প্রেম এর মাঝে এক ফাঁকে আমাদের পরের দিনগুলোর প্ল্যান সম্বন্ধে বলতে লাগল। আগামীকাল আমাদের হাঁটা হবে আট কিলোমিটার, গোই বলে একটা ছোট জায়গা পড়ে মাঝে, সেইখানে আমরা কালকের জন্য ক্যাম্প করব, পরের দিন গোই থেকে যাবো দয়ারা বুগিয়াল। আরও ছ কিলোমিটার। তৃতীয় দিন আমরা দয়ারাতেই থাকব, এদিক ওদিক ঘুরব। চতুর্থ দিনে সকালবেলা দয়ারা থেকে শুরু করে একসাথে চোদ্দ কিলোমিটার ট্রেক করে নামব রায়থাল, সেখান থেকে গাড়ি করে সোজা উত্তরকাশী, বিকেলের মধ্যে।

    আট কিলোমিটার? প্রথম দিনেই? পারব তো? আইটিনেরারি যা পড়েছিলাম তাতে দৈনিক চার পাঁচ কিমি করে হাঁটার গল্প ছিল। প্রথম দিনেই আট কিলোমিটার?

    এই বাড়িটা পাকা রাস্তার একদম শেষে, এর পরেই রাস্তা মোটামুটি শেষ। কাল সকালে এখান থেকেই আমাদের ট্রেক শুরু হবে, আজ সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। বাড়িটা প্রেমের ভায়রাভাইয়ের বাড়ি। মাঝবয়েসী লোকটি আমাদের তিনজনকে দেখে কেমন তটস্থ হয়ে ছিলেন। প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছিল বিজেন্দর, সন্তোষ (প্রেমের ভাগ্নে), ক্রমশ সেটা একটা সময়ে প্রায়-বিরক্তির পর্যায়ে চলে যেতে থাকল।

    একটা ঘরে দুটো চওড়া খাট। সেইখানেই আমাদের রাতের শোবার ব্যবস্থা। সাড়ে ছটা নয়, সাড়ে সাতটার সময়ে এসে গেল গরম গরম হাতে গড়া রুটি, ভাত আর মুরগির ঝোল। তার আগে বুনান আর অর্পনের ইসের বোতল খুলে বসার গল্প আলাদা করে আর কীই বা বলার আছে, খানিকক্ষণের জন্য প্রেমও যোগ দিল, কিন্তু ওদের নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল পাশের ঘরে, তাই খানিক বাদেই প্রেম চলে গেল। এদিকে আমরা ঘরে ঢোকবার পর থেকেই পাক্কা গুণে গুণে দশ মিনিট অন্তর অন্তর হয় বিজেন্দর, নয় সন্তোষ, নয় প্রেমের ভায়রাভাই, একবার করে দরজা খোলে আর উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করে - কিছু লাগবে কিনা, কিছু দরকার আছে কিনা, কিছু চাই কিনা। প্রথমে কয়েকবার নিরস্ত করবার চেষ্টা করলাম, আপনারা এত ব্যস্ত হবেন না, আমরা তোফা আছি, লেপের নিচে পা ঢুকিয়ে বাংলায় গল্পগাছা করছি, কিন্তু তাতে তারা একেবারেই নিরস্ত হল না। ফ্রিকোয়েন্সিটা ক্রমশ কমতে কমতে সাত আট মিনিটে দাঁড়াল। এ কী মুশকিল! খালি একজন করে ঢোকে, আর একই প্রশ্ন, আর আমাদের তরফে একই উত্তর।

    শেষমেশ দেখলাম, এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার একটাই উপায়, খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। কিন্তু চাইলেই তো শুয়ে পড়া যায় না, আমাদের এত তাড়াতাড়ি শোবার অভ্যেসই নেই। যাই হোক, খেয়েদেয়ে আরও খানিকক্ষণ অত্যাচার সহ্য করে সাড়ে আটটা নাগাদ আলো নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তেই হল।

    বুনান আর অর্পণ পৃথিবীর সুখীতম মানুষ, শোয়ার প্রায় সাথে সাথে ঘুম, অবশ্য ঘুমোবার আগে অর্পণ বার তিনেক স্ট্যাটাস কল সেরে নিয়েছিল, তাতে কী দিয়ে ভাত মেখেছে থেকে শুরু করে কবার বাথরুমে গেছে, সবই বলল বলে মনে হল। আজ আর চাপ নিই নি, ওদের একসাথে একটা খাটে দিয়ে আমি নিজে অন্য খাটে একা শুয়েছি, যদি তাতে আওয়াজের তীব্রতা একটু কমে। আপাদমস্তক মুড়ি দিলাম, ইয়া মোটা লেপ, তাতেও দেখি আওয়াজ ঠিকই কানে ঢুকছে, তবে ওই আর কি, এতদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে, খানিক পরে ঘুমিয়েই পড়লাম।

    সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল, ভোরবেলায়। টয়লেট যেতে হবে। বেরোলাম।

    সে এক অপূর্ব দৃশ্য। দুদিন আগেই পূর্ণিমা গেছে, আজ দ্বিতীয়া। চরাচর ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়, দূরে ঝকমক করছে বরফের চূড়োগুলো, আর আহা, আজি যত তারা তব আকাশে। লাখে লাখে তারা ঝিকমিক করছে গোটা আকাশ জুড়ে। এই আকাশ তো আমাদের শহর থেকে দেখা যায় না।

    ফিরে এসে আর ঘুম এল না, কোনওমতে একটু এপাশ ওপাশ করতে করতে সকাল হয়ে গেল।

    সবাই উঠে রেডি হলে আমাদের বেরনো। আজ নাকি আট কিলোমিটার হাঁটতে হবে, গন্তব্য, গোই। দয়ারা যাবার মাঝপথে একটা সমতল জায়গা।
  • পুপে | 131.241.184.237 | ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৬:৩৮689517
  • ই বাবা কান পেতে একটা কুঁচো ছেলের প্রেমালাপ শুনছে!!!

    তবে লেখাটা একঘর হচ্চে। 'শিব গড়তে বাঁদর গড়ার' উল্লেখটা বেশ মজাদার লাগলো। ঃ))
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন