এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অ-সমাপ্ত গল্প (পর্ব - ১২ ও ১৩)

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৪৫৬ বার পঠিত
  • ১২।

    গোছগাছ হয়ে গেছে প্রায়। গোছানো বলতে একটা সুটকেসে দিন দুয়েকের জামাকাপড় আর বিভিন্ন পরীক্ষার শংসা পত্র গুলো। কালকে ভোরের ট্রেন ধরতে হবে কলকাতা যাওয়ার জন্য; পরশু ইন্টারভিউ। অনেক কিছু নির্ভর করছে এই ইন্টারভিউটার ওপর; বাড়ির সকলে তাকিয়ে ওর মুখের দিকে। হয়ত মুখে কেউ কিছু বলছেনা, কিন্তু কমল জানে সকলে ওর সাফল্য কামনা করছে মনে মনে। হতে পরে সকলের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে আছে ওর সাফল্যের সাথে, তাই এই চাওয়া; তবু এই চাওয়াটা ভালো লাগছে ওর। একটা অব্যক্ত চাপও যে পড়ছেনা ওর ওপর এমনটা নয়, কিন্তু তবু ভালো লাগছে!

    কলকাতা পৌঁছে মামার বাড়িতেই উঠবে ও। পরের দিন ফেয়ারলি প্লেসে ইন্টারভিউ। একা একা ফেয়ারলি প্লেস অবধি যেতে হবে ভেবেই কেমন যেন নার্ভাস লাগছে ওর। কলকাতার রাস্তা প্রায় কিছুই চেনে না ও। মামাকে বললেই উনি গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন কিন্তু সে কথা কিছুতেই বলতে পারবে না কমল। একা একা রাস্তা চিনে যাওয়ার উৎকন্ঠাটা বাদ দিলে ওর মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনার স্রোত বইছে। অনেকটা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের উত্তেজনার মতন - তাতে দহন নেই উষ্ণতা আছে, হয়তা বা কোমল উত্তাপ ও আছে। কিন্তু সিকি ভাগ হলেও অনুভূতির তালগোলপিন্ডের মধ্যে যেন বা মিশে আছে ভয়ও! ও পারবে তো, এতগুলো লোকের আশ্বাসেৱ মর্যাদা রাখতে? তা ছাড়া নিজের কাছেও জেতার একটা ব্যাপার আছে। গত দেড় বছর ধরে ধিরে ধিরে, তিলে তিলে, তিরোহিত হয়েছে ওর আত্মবিশ্বাস। ও পারবে তো সেটা ফিরিয়ে আনতে?

    ইন্টারভিউয়ের জন্য একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ গোছের জামা নিয়েছে কমল। ওর বন্ধু অনিন্দ্যর কাছ থেকে একটা ফুল প্যান্ট চেয়ে নিয়েছে। কমল কিছুতেই বুঝে পায়না ইন্টারভিউয়ের সাথে জামা-কাপড়ের সম্পর্ক কি। ওখানে তো সকলে নিজের মেধার সাক্ষর রাখতে যাবে; কে কোট প্যান্ট পড়ল আর কে ধুতি পাঞ্জাবি - তাতে সত্যিই কিছু যায় আসে কি? কে জানে, হয়ত সমাজের আর পাঁচটা জায়গার মতন এখানেও বৈভব কেই উচ্চাসন দেওয়া হয় বুদ্ধিমত্তার চাইতে!

    অনিন্দ্যর থেকে প্যান্টটা চেয়ে আনাতে মা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল বটে, কিন্তু অপারগ মানুষের খারাপ লাগা বা ভালো লাগা - দুটোই বাতুলতা। তাই খারাপ লাগলেও মা আর এ নিয়ে বেশি কথা বাড়ায়নি। যত অসুবিধেই হোক, মা কখনও কারোর কাছে হাত পাততে পারবে না; এটা জানে কমল। আসলে মা বড় অভিমানি। কি লাভ এমন অভিমানের যা কেবলই পোড়ায়, শৈত্য কাটায় না! হতে পরে এই অভিমানই মা কে ঋদ্ধ করেছে কিন্তু সেই অভিমানের আঁচে প্রিয়জনেরা যে দগ্ধ হয় এ কথা কি মা বোঝেনা!

    সন্ধ্যে নেমেছে। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আছে। আলো জ্বালতে ইচ্ছে করছেনা কমলের। অন্ধকারে একলা হওয়া যায় খুব সহজেই। আলো মনকে বিক্ষিপ্ত করে, আসেপাশের অপ্রয়োজনীয় ঘটনা জোর করে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে।
    চাকরিটা পেলে হয়ত চাঁপাকে নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারবে ও।

    চাঁপার কথা মনে হতেই মনে পড়ে গেল সেদিনের সন্ধ্যেটার কথা। রোজকার মতন চাঁপাদের বাড়ির সামনে থেকে একবার ঘুরে আসবে ভেবেছিল। দু দল যুযুধান যুবকের মাঝে পড়ে আরেকটু হলে প্রাণটাই যাচ্ছিল। একটা সরু গলির মধ্যে আটকা পড়ে আছে ও আর দু দিক থেকে ধেয়ে আসছে সশস্ত্র কিছু মানুষ, একে অপরের প্রাণ নেবে বলে। একটা বাড়ির খাটা পায়খানার নিচে ঢুকে পড়েছিল কমল। ধাঙড় যেখান থেকে বিষ্ঠার পাত্রটা নিয়ে নেয়, সেই ছোট্ট জায়গাটা দিয়ে কোন মতে ঢুকে পড়েছিল দুর্গন্ধ যুক্ত অন্ধকূপপ্রায় জায়গাটুকুর মধ্যে।
    কমলের উচ্চতা গড়পরতা বাঙালি ছেলেদের চাইতে একটু বেশিই-ছয় ফুট এক ইঞ্চি। কোনও মতে ঘাড় গুঁজে বসেছিল ঐ জায়গাটুকুর মধ্যে। প্রায় পনের মিনিটের খণ্ড যুদ্ধের পর রণে ভঙ্গ দেয় দু দলই; কিন্তু ঐ পনের মিনিট কমল কাটিয়েছে অন্তহীণ এক সময়। প্রতিটা মূহুর্ত ভগবান কে ডেকে গেছে ওই সময়। ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পরে কোনও মতে বেড়িয়েছে ওই মলাগার থেকে। হাত-পা তখনও কাঁপছিল ওর। ওই অবস্থাতেই দেখেছিল গলিটার পাশে পড়ে আছে একটা দেহ, একটু একটু কাঁপছেও যেন বা। ওদিকে যাওয়ার আর সাহস হয়নি ওর। কোনোওক্রমে নিজের শরিরটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল বাড়ির দড়জায়। কলঘরে গিয়ে স্নান সেরে তারপর ঘরে ঢুকেছিল। মা জিজ্ঞেস করতে কোনমতে বর্ণনা দিয়েছিল ঘটনাটার। একটা চাপা শ্বাস ফেলে মা বলেছিল, ”তোর বাবাকে বলিস না, চিন্তা করবে।”
    কমল জানে মায়ের ওই দীর্ঘশ্বাসটুকুর মধ্যে দিয়েই মা প্রকাশ করেছিল নিজের উৎকণ্ঠা, কামনা করেছিল কমলের দীর্ঘায়ুর। আর পাঁচটা মা যা করত, তা করতে পারবে না ওর মা।

    সেদিনের সন্ধ্যেটা ওর জীবনে একটা নতুন উপলব্ধির সঞ্চার করেছে। ও বুঝেছে প্রাণের চাইতে বড় আর কিছু নেই। অন্য সময় হলে বিষ্ঠার পাত্রের পাশে পনের মিনিট বসে থাকার কথা ও ভাবতেই পারত না। ওই পনের মিনিট ওর একবারের জন্য মনে হয়নি যে জায়গাটা অপরিষ্কার। অন্য সময় হলে তীব্র বিবমিষায় হয়ত ছটফট করে উঠত ও কিন্তু সেদিন করেনি। হয়ত পারিপার্শিকের অস্থিরতার কারনে ওই দূর্গন্ধ ওর মস্তিষ্কে কোনো বার্তাই পাঠাতে পারেনি! সেই সময়টুকুর জন্য ওর সকল ইন্দ্রিয়ের কাছে একমাত্র সত্য ছিল কিছু মানুষের পাশবিক চিৎকার আর হাত বোমার শব্দ।

    ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দিল ছবি। মা কে দেখে একটু হাসল কমল। বড্ড নার্ভাস হাসিটা। ছেলের হাসির পাঠোদ্ধার করতে পেরে মনটা আর্দ্র হয়ে এল ছবির। প্রথম সন্তান বলে কিন জানা নেই, কিন্তু আর সকলের মধ্যে কমলকেই সবচাইতে বেশি স্নেহ করে ছবি। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, চিন্তা করিসনা, খুব ভাল হবে ইন্টারভিউ। মায়ের কথা কটার কোনো উত্তর দিতে পারল না কমল। এরকম অবস্থায় কি বলা যায় বা বলতে হয় তা জানেনা কমল। কিন্তু কথা গুলো যেন ওর মনের ওপের আরেকটু চাপ বাড়িয়ে দিল। অস্থির ভাবে ঘরের ভেতরে একটু পায়চারি করে নিল কমল তারপর মা কে বলল, ”একটু আসছি।” নিজের সঙ্গে বোধহয় এখন একটু একলা থাকার দরকার ওর। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল কমল।

    ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছবি। আহারে! ছেলেটাকে দেখলে বড় মায়া হয়। আজ দেড় বছরের ওপের মুখ কালো করে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য। এই দেড় বছরে যেন হাসতেও ভুলে গেছে ছেলেটা। ভালো ফূটবল খেলত, গান গাইত। সব যেন ভুলে গেছে একেবারে। অভাবে কি? না, না! ছবির কোনো অভাব নেই। নিজেকে অভাবী ভাবতে ভালো লাগেনা।
    কমলের চলে যাওয়াটা দেখছিল ছবি। চেহাড়ার গড়নটা ছেলে পেয়েছে ওর বাবার মতন। পেছন থেকে দেখলে কর্তার মতই লাগে ছেলেটাকে। কখনও কখনও খোকার মধ্যে বড়দার ছায়াও দেখতে পায় ছবি। বড়দা ফুটবার ছিল বলে কি? কোনও কারন নেই তবু মাঝে মাঝে আরেকজনের মতও লাগে ছেলেটাকে। তার চোখ চুল চামড়ার রং সমস্তই খোকার চাইতে আলাদা-তবুও লাগে। এর কোনও যুক্তি গ্রাহ্য ব্যাখা নেই ছবির নিজের কাছেই।

    বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎই। প্রথম বৃষ্টির ফলে মাটির যে গন্ধটা নাকে এসে লাগে সেটা পছন্দ হয়না ছবির। কেমন যেন ধুলোর গন্ধ! তার চেয়ে বরং কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর বাতাসে যে সতেজ গন্ধটা পাওয়া যায়, সেটা মনটাকে বড় ভালো করে দেয়! কান পেতে কিছুক্ষণ বৃষ্টির শব্দ শুনতে চেষ্ঠ করল ছবি তারপর বাইরের রোয়াকটায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির সতেজতাটাকে নাক দেহ মন দিয়ে নিজের অন্তরে শুষে নিতে চাইছে যেন ছবি। বাতাসের ঠান্ডা সতেজতা মনের মধ্যে প্রবেশ করছে, কিন্তু অন্তরকে স্নিগ্ধ করতে পারছেনা। পারবে কি কোনদিন?

    ১৩।

    টিফিনের ঘন্টা বেজে গেছে। ছেলেরা সব হই হই করে বেরোচ্ছে ক্লাস থেকে। খাতাটা মুড়ে রাখল রতন। ক্লাস থেকে সকলে বেড়িয়ে গেলে পর ধীরে ধীরে চলে এল ক্লাসের বাইরের টানা বারন্দাটায়। বারন্দা দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে দেখল ইতিমধ্যেই হেড স্যরের ঘরের বাইরে লাইন পড়ে গেছে। টিফিনের লাইন। স্কুল থেকে টিফিনের সময় ছেলেদের একটা করে পাঁউরুটির টুকরো আর মিষ্টি দেওয়া হয়। কোন দিন লাড্ডু, কোন দিন মোহনভোগ, কোনো দিন অন্য কিছু। নিচে নেমে এসে লাইনে দাঁড়াল রতন। লাইনের একটু আগে দাঁড়িয়ে আছে গণেশ। গণেশের দু এক জন আগে দাঁড়িয়ে বাবলুদা। ওদের বাড়ির প্রায় সব ভাইয়েরাই পড়ে এই স্কুলে। তবে বাবলুদা কে লাস্ট ওয়ার্নিং দেওয়া হয়ে গেছে স্কুল থেকে, এবার ফেল করলে আর নিস্তার নেই। এমনিতে এই স্কুলে ফেল করা ছেলেদের রাখার রেওয়াজ নেই, কিন্তু জ্যাঠার অনুরোধ হেড স্যর ফেলতে পারেননি। তবে এটাই শেষ বার। বাবলুদার রকম সকম দেখে অবশ্য কিছুটি বোঝবার জো নেই! সেই আগের মতই হ্যা হ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এবারো পাশ করবে বলে মনে হচ্ছেনা। এর পর কি তাহলে বাড়ির কাছের তথাকথিত "বাজে" ছেলেদের স্কুলটাতেই ঢুকতে হবে বাব্লুদাকে?

    মিনিট পনের লাইনে দাঁড়ানোর পর নিজের রুটি আর মিষ্টিটা নিয়ে গাছতলায় এসে বসল রতন। এদিক ওদিক আরো অনেকে বসে খাবার খাচ্ছে। খেতে খেতে অভ্যাস মত মাথা তুলে গাছটাকে দেখল ও। একটাও ফুল নেই। ফুল যখন ফোটে তখন তার গন্ধ স্কুলের গেট থেকেই পাওয়া যায়। বকুল ফুলের গন্ধ। স্কুলে আরো রকমারি গাছ থাকলেও রতন সর্বদা এই বকুল গাছটার নিচেই এসে বসে। গাছটা ওকে বোঝে; ভালোওবাসে হয়ত।

    খাওয়া হয়ে গেলে পর হাতটা প্যান্টের পেছনে মুছে নিল রতন। টিফিন শেষের ঘন্টা এখনও পড়েনি। গাছটার ছায়ায় শুয়ে পড়ল টানটান হয়ে। স্কুল ভেতরের কোনো একটা গাছে বসে একটানা ডেকে চলেছে একটা পাখি। পাখিটার ডাক রোজই শোনে রতন। ঠিক যেন একটা বাচ্চা ছেলের খিলখিল করা হাসির শব্দ। তবে বাচ্চার হাসির মধ্যে যে আনন্দটা ধরা থাকে, সেটা অনুপস্থিত পাখিটার ডাকের ভেতর। অকটু হলেও যান্ত্রিক যেন। দুটো ডাকের ভেতর একই সময়ের ব্যবধান রেখে ডেকে চলে পাখিটা-যতক্ষণ হাঁফিয়ে না পড়ছে। পাখিটাকে কোনদিন দেখতে পায়না রতন। কে জানে কি পাখি ওটা! কাউকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করে। লজ্জাটা অজ্ঞানতার নয়, ধরা পড়ে যাওয়ার। কাউকে জিজ্ঞেস করলে তার কাছে ধরা পড়ে যাবে রতন। ধরা পড়ে যাবে যে ওর পাখিটাকে ভালো লেগেছে। তবে পাখিটার নাম একদিন ও ঠিক জেনে নেবে; কাউকে জিজ্ঞেস না করেই।

    শরীরটাকে অল্প তুলে আধশোয়া হয়ে বসল রতন। স্কুল বাড়িটা গমগম করছে। স্কুলের মাঠটায় বন্ধুদের সাথে খেলছে গণেশ। সেদিন রাতে বেচারা জ্যাঠার কাছে খুব মার খেয়েছে। জ্যাঠা যখন গণেশ কে মারছিলেন তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর। মুখ বুজে পড়ার বইয়ের ভেতের মননিবেশ করার চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু ছোট ভাইটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল রতনের। এখনও যেমন ওর ভীষণ ইচ্ছে করছে গণেশ কে ডেকে জিজ্ঞেস করতে-তোর সেদিন বেশি লাগেনি তো! কিন্তু ও তা করবে না। ওর ভাইবোনেরা ওকে পড়ুয়া আর রাশভারি মনে করে। একটু স্বার্থপর আর হৃদয়হীণ ও ভাবে হয়ত। তা ভাবুক। কিন্তু নিজেকে কোনো মতেই কারুর কাছে ধরা দিতে পারবেনা ও। ওর কষ্ট হয়েছে জেনে কেউ ওকে সহানুভূতি দেখালে সে কষ্ট ও সহ্য করতে পারবেনা। সে বড় লজ্জার। তার চেয়ে বরং এইই ভালো!

    টিফিন শেষের ঘন্টা পড়ে গেছে। গাছতলা থেকে উঠে দৌড়ে ক্লাসের দিকে চলে গেল রতন। খেলুড়েদের মধ্যে থেকে সেদিকে একবার চেয়ে দেখল গণেশ। তারপর ধিরে সুস্থে কলতলায় গিয়ে হাত পা ধুয়ে নিল। এর ফলে পরের ক্লাসটায় ঢুকতে একটু দেরি হবে। তার ফলাফলও জানা আছে ওর। অশোককে আগে থেকেই বলা আছে-টিফিনের পরের ক্লাসটায় একটু দেড়ি করে ঢুকবি। তার পর দুজনেই ক্লাসের বাইরে! বেশ মজার ব্যাপার। অথচ দাদাটাকে দেখ! ঘণ্টা পড়া মাত্র দৌড়ে ক্লাসে চলে গেল। অত পড়ে কি হবে!

    সেদিন দাদার ওপর খুব রাগ হয়েছে ওর। জ্যাঠা যখন ওকে মারছিলেন তখন একবারও কি দাদা এসে বারন করতে পারতনা! দাদা একবার বললে জ্যাঠা আর কিছুতেই ওকে মারতেন না। বাড়িতে সকলে দাদাকে ভালোবাসে। তাতে গণেশর কোনো দুঃখ নেই, বরং ওর ভীষণ গর্ব হয় যখন দাদা ক্লাসে ফার্স্ট হয়, অঙ্কে একশো পায়। কিন্তু তা বলে কি ওকে একটুও ভালোবাসতে নেই! এমনকি সেদিন রাতে খেতে বসে দুটো রুটি বেশি চেয়েছিল বলে মা পর্যন্ত কেমন দুর ছাই করল ওকে! দাদার মতন লেখাপড়ায় নয় বলেই না ওর এত অপমান। বেশ! ও না হয় সবার কাছে খারাপ ছেলে হয়েই থাকলো!

    চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে-ধূলো পড়েছে বোধহয়। চোখে মুখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিয়ে ক্লাসের দিকে চলল গণেশ। অশোকটা যে কোথায় গেল! ক্লাসের সামনে পৌঁছে দেখলে অশোক আগে ভাগেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখে একগাল হেসে বলল, "এসে গেছিস! আমাকে স্যর বের করে দিয়েছেন-তোকেও দেবেন। তাড়াতাড়ি আয়! " ক্লাসের ভেতর মুখ বাড়িয়ে নিয়ম রক্ষার্থে গণেশ জিজ্ঞেস করল, "আসব স্যর?" রামবাবু অঙ্ক করাচ্ছিলেন। হাতের চকটা ওর দিকে প্রবল বেগে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, বেরো, বেরো শিগ্গির! বাঁদর কোথাকার! এটাকে কি খেলার মাঠ পেয়েছিস?
    মনের আনন্দে ক্লাসের বাইরে চলে এল গনেশ। তবে আজকে ওর অতটা আনন্দ হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে স্যর ওদের ক্লাসের মধ্যে ডেকে নিলেই হয়ত ভালো হত।

    স্কুলের পেছন দিকটায় চলে এল দুজনে। জলের ট্যাঙ্কের নিচে এক মানুষ সমান জায়গা আছে। দুজনে এর তলায় বসে আড্ডা মারে। অশোক গণেশের চাইতে অনেকটাই লম্বা। ছিপছিপে একহারা চেহারা। আর কিছুদিন পরেই এই জায়গাটায় ঢুকতে গেলে ওকে মাথা নোয়াতে হবে। গণেশ তুলনামূলক ভাবে বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা। ওর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ট্যাঙ্কের তলাটা ঠান্ডা। দু জনে জুত করে বসল অল্প ভেজা মাটিতে। লোহার ট্যাঙ্কের তলা চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ে বলে এখানকার মাটিটা সর্বদাই একটু ভিজে ভিজে আর নরম থাকে। পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে পড়ল অশোক। বলল, "ঢাকা মেল আর চলবেনা জানিস তো!" মাথা নাড়ল গণেশ। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ট্রেনটা। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অশোক বলল, " বড় মাসিমাদের তারপর থেকে আর কোনো খবরই পেলাম না। মোটামুটি ছ' মাস হয়ে গেল।"

    অশোকের বড় মাসিরা ঢাকার বাংলা মোটর এলাকাতে থাকেন। যুদ্ধের পর থেকে চিঠি পত্রও অনিয়মিত হয়ে গেছে। দেশভাগের পরও অশোকের মেসোমশাই নিজের দেশ ছেড়ে আসতে চাননি। কিন্তু আজকাল পাকিস্তান আর্মি নাকি পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারন মানুষের ওপর খুব অত্যাচার চালাচ্ছে-হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। ওখানকার লোকে ওদের বলে খান-সেনা। এসব কথা অশোক ওর বাবার কাছে শুনেছে। আসলে ভাষা আন্দোলনে বাঙালির প্রতিবাদের সামনে পিছু হটতে হয়েছিল পাকিস্তান সরকারকে; তারই বদলা নিচ্ছে এখন সূদে আসলে। গণেশ কখনও পাকিস্তান যায়নি কিন্তু অশোক গেছে। যুদ্ধ লাগার আগে। অন্য দেশ বলে কখনও মনে হয়নি।

    গণেশ বলল, "হ্যাঁরে, মনোরঞ্জন কাকা অনেকদিন পার্টির কোনো কাজ দিচ্ছেননা তো! " অশোক বলল,"ভালো কথা মনে করিয়েছিস। কাজ একটা আছে বটে। একটা নয়, দুটো। বাবা আমাদের একটা লিফলেট পড়তে দিয়েছে। কোন এক সুন্দরইয়া না কার লেখা। আর দ্বিতীয়ত আজ বিকেলে প্রাচীন মায়াপুর যেতে হবে একবার। এক ভদ্রলোককে একটা চিঠি দিয়ে আসতে হবে। তবে খবরদার! কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না জানে!" বেশ একটা গোপন কাজের কথায় গণেশ বেশ উল্লসিত বোধ করল। রোমাঞ্চ হচ্ছে ওর।হেমেন রায়ের গল্প পড়লে যেমনটা হয়, সেরকম। ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা কে সেই লোক?

    উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অশোক বলল, "সে সব কথা বিকেলে বাবার কাছে গেলেই জানতে পারবি। এখন চল পরের ক্লাস শুরু হল বলে"। পায়ে পায়ে ক্লাসের দিকে চলে গেল দু জনে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৪৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন