এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অ-সমাপ্ত গল্প (পর্ব - ১৬ ও ১৭)

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৫৯৮ বার পঠিত
  • ১৬।

    তবলচী একটা গৎ বাজাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুনছে বিশ্বনাথ। বড় মিঠে হাত লোকটার। আজকে রেওয়াজ করতে মন চাইছে না। শোনাটাও অবশ্য রেওয়াজেরই একটা অঙ্গ। গুরুজী বসে আছেন ফরাসের ওপর, মাঝে মাঝে ওনার মুখ দিয়ে বেরচ্ছে উৎসাহ ব্যঞ্জক কিছু শব্দ। বিশ্বনাথ মাটিতে বসেছে; গুরুজীর সাথে একাসনে বসার কথা চিন্তাও করতে পারেনা ও। ঘরের মধ্যে ওরা তিনজন ছাড়া আর রয়েছে এস্রাজ বাদক ধীরেন্দ্র । সেও নিজের বাদ্য যন্ত্র পাশে রেখে দিয়ে বাজনা শুনছে তন্ময় হয়ে। গুরুজীর ঘরটা ছোট ও বাহুল্য বর্জিত । ঘরে কিছু বাদ্য যন্ত্র ছাড়া রয়েছে দেওয়ালে টাঙ্গানো দুটো ছবি। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। একটা প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী গহরজানের, অপরটি কাশীর মণিকর্নিকা ঘাটের; গুরুজী বলেছেন। গুরুজীর পূর্বপুরুষেরা কাশীর বাসিন্দা ছিলেন। বিশ্বনাথ একবার জিজ্ঞেস করেছিল - কাশীর ঘাটের ছবিই যদি লাগাতে হয় তবে দশাশ্বমেধই তো ভালো ছিল; ওসব শ্মশান মশানের ছবি আবার ঘরের মধ্যে কেন! গুরুজী অল্প হেসে বলেছিলেন - আঁখিরকার জানা তো ওয়হিঁ হ্যয়!

    তো সেই কাশীর ঘাট থেকে কিভাবে যে ভাসতে ভাসতে ওঁরা চলে এলেন বাংলায়, এই নবদ্বীপে; সে কথা কেউ জানে না। মানে গুরুজী কাউকে বলেননি কখনও। বিশ্বনাথ অনেকদিন ভেবেছে কথাটা গুরুজীকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি।
    অপর ছবিটা সম্পর্কেও কৌতুহল আছে ওর। গহরজান নিঃসন্দেহে বিরাট শিল্পি, কিন্তু ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের তো আরও অনেক নামিদামি শিল্পী রয়েছেন, তবে তাঁদের ছবি নেই কেন এই ঘরে?

    তবলায় ঝড় তুলেছে লোকটা। হাতের আঙুল গুলো দিয়ে বোল বেড়িয়ে এসে ধাক্কা মারছে তবলার চামড়ার ওপর আর তার শব্দে বিভোর হচ্ছে বাকিরা। হয়ত বা তবলচী নিজেও। লহরী শেষ হলে পর সকলের কাছ থেকে অভিবাদন গ্রহন করে উঠে দাঁড়াল বাজিয়ে। মুখে পরিতৃপ্তির লাজুক হাসি। সকলের যে তার বাজনা ভালো লেগেছে, এতেই তার সন্তুষ্টি, এটাই তার একমাত্র চাহিদা। সত্যিকারের শিল্পীর কাছে এর চাইতে বড় পুরষ্কার আর হয়না। প্রকৃত সমঝদারের তারিফ পেলে জীবনের সব না পাওয়া, সব দুঃখ এক লহমায় দূর হয়ে যায়। পেটের দায়ে দুটো পয়সার জন্য আদাড়ে বাদাড়ে আনাড়িদের সামনে লোকটা বাজিয়ে বেড়ায়। পেট ভরে, কিন্তু মনের ক্ষুধার অবসান হয়না।

    একে একে উঠে পড়ছে সবাই। সন্ধ্যে গাঢ় হয়েছে অনেক্ষাণ। বিশ্বনাথের ইচ্ছে আজকে আরও একটু বসার গুরুজীর কাছে। ওই ছবিদুটোর বৃত্তান্ত বিশদে জানতে ইচ্ছে করছে। বাকিরা চলে গেলে পর গুরুজীকে সরাসরি প্রশ্নটা করল বিশ্বনাথ, "গুরুজী, গহরজান জী কে কি আপনি আর সকল সঙ্গীতজ্ঞদের চাইতে উচ্চ স্থান দেন?" স্মীত হাসলেন বৃদ্ধ। - "ঘরে ওনার তসবীর টাঙিয়েছি বলে? সে তো ঘরে কাশিধামের ভি তসবীর আছে। তার মানে কি এই যে কাশি দুনিয়ার সব চাইতে উমদা জায়গা?"
    চুপ করে আছে বিশ্বনাথ। গুরুজীর কথার মধ্যে উর্দূ শব্দের বাহুল্য আছে। বড় আশ্চর্য ব্যপার। কাশীর ত্রিবেদীর এহেন শব্দ চয়ন ওর কাছে অভাবনীয়। ফরাস থেকে উঠে গহরজানের ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন গুরুজী। "আসলে কি জানো, ঘরে মানুষ তারই ছবি টাঙায় যাকে সে দিল মে রাখে, শ্রদ্ধা করে, হয়ত বা পেয়ারও করে। জরুরী নহি কি ওয়হ সবসে হোনহার, সবসে কাবিল হো। গহরজান আমার কাছে সেই রকম একজন মানুষ। আমি ওনাকে শ্রদ্ধা করি, হয়ত বা পেয়ার ও করি। আর তা করে যাব বাকি জীবনটাও।"

    অবাক হল বিশ্বনাথ। কিন্তু এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করল - আর কাশীর ছবিটা? প্রশ্নটা করেই বুঝল বোকার মতন প্রশ্ন হয়েছে এটা। গহরজানের ছবিটার উল্টোদিকের দেওয়ালে টাঙানো মণিকর্নিকার ছবি। সেদিকে ফিরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন গুরুজী। অনন্তপ্রকাশ ত্রিবেদী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছেন ছবিটাকে। সাদাকালো ছবি। একটু বিবর্ণও বুঝিবা। ধীর পায়ে ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেওয়াল থেকে নামিয়ে আলতো হাত বোলালেন ছবিটার ওপর। হাতের লম্বা আঙুলগুলো যেন বা কাঁচ ভেদ করে ছুঁতে চাইছে বিস্মৃতপ্রায় কোনো অতীত কে। মুহূর্ত খানেক পরে ছবিটাকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিয়ে বিশ্বনাথের দিকে ফিরলেন অনন্তপ্রকাশ ত্রিবেদী। বললেন, "গাছ কে তার শেকড় থেকে তুললে তার যে কেমন লাগে তা তো এ জন্মে বুঝলামনা। কিন্তু নিজের বাড়ি, নিজের মুল্‌ক থেকে যদি মানুষকে চলে যেতে হয় অন্য কোথাও তবে তার কষ্টও কিছু কম হয়না। তুমি বুঝবে না বাবা!"

    উঠে পড়ল বিশ্বনাথ। গুরুজী উদাস হয়ে গেছেন। নিজের ফেলে আসা মুলুক, ফেলে আসা অতীতের কথা ভেবে হয়ত। ওঁনাকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল বিশ্বনাথ। জুতোজোড়া পায়ে গলাতে গলাতে শুনল গুরুজী শায়রী বলছেন একটা। ওনার নিজের লেখা। দেবনাগরী হরফে লেখা উর্দূ শায়রী -

    ফিরতে হ্যঁয় দরবদর দিল মে লিয়ে অপনা আশিয়াঁ
    জানে হ্যায় কঁহা মঞ্জিল, হ্যায় কঁহা অপনা জঁহা

    ওনার মুখে আগেও শুনেছে এই শায়রীটা, কিন্তু আজকের আগে এই দুটো লাইনের বিষন্নতা স্পর্শ করেনি বিশ্বনাথকে।

    উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে শুরু করল বিশ্বনাথ। গুরুজীর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গাড়িটাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই। হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই চলে এসেছে ওদের ভাড়া দেওয়া বাড়িটার কাছে। সুবোধ বাবুরা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকেন। একতাল অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। বাড়ির ভেতরে আলোর আভাস। বাড়িটাকে কি ওর নিজের বলা চলে? একটা বাড়ির মালিকানা অর্জন করা আর বাড়িটাকে নিজের করা - এ দুটো কি একই জিনিস? এ বাড়িটার সাথে ওর বা ওর পরিবারের কোনো আত্মিক যোগ কি সত্যিই আছে? সুবোধ বাবুদের কিন্তু আছে। সেদিন ওনাদের সাথে গল্প করতে করতে বিশ্বনাথ দেখেছে ভাড়া বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো হাতে আঁকা ছবি। সুবোধ বাবুর মেজ মেয়ের আঁকা। টেবিলে কুরুসের কাজ করা ঢাকনা। নিজের বাসস্থানের প্রতি ভালবাসা না থাকলে কি কেউ এসব করে? স্বাধীনতার পর নিজেদের ভিঁটে মাটি ছেড়ে এপাড়ে এসেছেন সুবোধ বাবুরা কিন্তু এই ভাড়া বাড়িটাই কি এখন ওনাদের 'নিজেদের' বাড়ি নয়! গুরুজীর লেখা শায়রীটার বিষন্নতা কি সুবোধ বাবুর পরিবার কেও স্পর্শ করে একই ভাবে? নাকি অনুভূতিটা একান্ত ভাবে গুরুজীরই! অবশ্য মানুষের কোনো স্থায়ী দেশ হয় কিনা এ নিয়েও আজকাল ওর মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। চরৈবেতির যে মন্ত্রে মানব সমাজ দীক্ষিত, তা তাকে স্থিতু হতে দেয়না কোনো একজায়গায় খুব বেশি দিন। দুই-তিন-চার প্রজন্ম সে হয়ত কোনো এক শহরে, এক বাড়িতে থেকে যায় কিন্তু তারপর নতুন প্রয়োজন, নতুন আকাঙ্ক্ষা বা পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে রওনা হতে নতুন ভূখন্ডের দিকে। বিশ্বনাথ দের পরিবার এই শহরের বহুদিনের বাসিন্দা। তার আগে হয়ত অন্য কোথাও অন্য কোন খানে বসতি গড়ে ছিল ওর পূর্বপুরুষেরা! আবার পরবর্তী প্রজন্মও হয়ত ছড়িয়ে পড়বে এই সসাগরা ধাত্রী র বুকের অন্য কোনো কোণে!

    আকাশে অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার আকাশে প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রকট ছায়াপথ। দেবতাদের হাইওয়ে। ওই রাস্তা ধরে দেবতারাও হয়ত যান দেশান্তরে। ওঁনাদেরও কি মনে হয় - জানে হ্যায় কঁহা মঞ্জিল, হ্যায় কঁহা অপনা জঁহা?
    ভাবনা ঘোড়ার লাগাম অলতো করে ধরে পায়ে পায়ে ভূতগ্রস্থের মতন সুবোধ বাবুদের বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল বিশ্বনাথ। নাকি ওদের বাড়িটার দিকে? কে জানে!

    ১৭।

    দিন গুলো আজকাল কেমন যেন কাটে! না ভালো না মন্দ। না তাড়াতাড়ি না স্লথ গতিতে। স্কুলটাও যেন মনে হয় ঝিমিয়ে আছে। ওদের পাঁচজনের দলটার কীর্তিকলাপ গুলোও ছেলেমানুষি মনে হয়। তবু দলে ভিড়ে এর খাতায় কালি ঢালা, ওই দিদিমণির গলা নকল করে হুল্লুড়ে ক্লাসকে চমকে দেওয়ার মতন কাজগুলো করে চলে শোভা, শুধুই অভ্যেসের বসে।

    নিজের যে ছবিটা স্কুলের মেয়েদের আর দিদিমণিদের মনে আঁকা হয়ে রয়েছে, সেটাকেই ওকে বয়ে বেড়াতে হবে স্কুলের বাকি বছর গুলোতেও। শোভা জানে। অথচ আজকাল কেন কে জানে সেই বয়ে বেড়ানোটায় কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ভাব খুঁজে পায়না ও। আবার, পরিচিতদের মনের পটে নতুন কোনো ছবি আঁকার কথা ভাবাও যায়না!

    বিকেলের হুল্লোড় গুলোও আর তেমন টানেনা ওকে। কিন্তু ওই যে অভ্যেস! তার টানেই নির্দিষ্ট সময়ে রোজ জড়ো হয় বাড়ির সামনের টাটটায়। ছোট্ট জমিটার এই নামটা শোভারই দেওয়া। টাট। মাঠের ছোট অথচ উঠোনের বড় সংস্করন। একদা প্রিয় জমিটাকে আদরের ডাকনামটা ধরে ডাকতেও ভুল হয়ে যায় যেন আজকাল। বড্ড বেখেয়ালে মন হয়েছে! আর এই সব অনাসৃষ্টি শুরু হয়েছে সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বিশ্বনাথদার গান শুনে। আথচ গান কি আর ও আগে শোনেনি? রেডিওতে তো কতই গান হয়! মায়ের বা দাদার গলাতেও বহু গান শুনেছে ও। কিন্তু কই, কোন দিন তো এমনটা হয়নি! হঠাৎ হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যায়। নাকি ভারি হয়ে যায়? ঠিক কি যে হয় বলা মুস্কিল কিন্তু কিছু একটা তো হয় অবশ্যই।

    সেদিনের সন্ধ্যেটা যে মনে এভাবে দাগ কাটবে তা সেদিন বিশ্বনাথদার গান শোনার সময় ও বুঝতেও পারেনি। বিশ্বনাথদা এসেছিলেন সন্ধ্যে পার করেই। হঠাৎ করে চলে আসার জন্য মার্জনাও চেয়ে নিয়েছিলেন ওদের সকলের কাছে। আর সকলের কথা বলতে পারবেনা, কিন্তু শোভা নিজে বেশ অবাকই হয়েছিল বিশ্বনাথদার ও হেন আগমনে। আবাক হওয়াটাই দস্তুর। কারন বিশ্বনাথদা এর আগে কোনোদিনও ওদের বাড়িতে আসেননি। না না, এসেছিলেন বটে এর আগে একদিন। তা সে তো ভাড়া আদায় করতে! শোভা সেদিন বাড়িতে ছিলনা। অঞ্জনাদের বাড়িতে গেছিল। বাড়ি ফিরে মায়ের মুখে শুনেছিল যে এবারের বাড়ি ভাড়াটা নিতে অবিনাশ বাবুর বদলে বাড়িওয়ালার ছেলে এসেছিল। সে তো আসতেই পরে। তেমন আসাতে আশ্চর্য হওয়ার রসদ নেই। কিন্তু কোন কারন ছাড়া এভাবে হুট করে সন্ধ্যেবেলায় শোভাদের বাড়ি চলে আসবেন উনি - এ ভাবনাটাই যেন একটু আশ্চর্যের। তবে আশ্চর্য হওয়ার তখনও অনেক বাকি ছিল শোভার। বিশ্বনাথদাকে দেখে বাবার মতন আর সকলেরই মনে হয়েছিল কোনো বিশেষ দরকারে এসেছেন বুঝিবা। কিন্তু উনি যখন কুন্ঠিত মুখে বললেন - ঘুরতে ঘুরতে এমনিই একটু আপনাদের বাড়ি চলে এলাম - তখন আশ্চর্য হওয়ার চাইতেও প্রীত বেশি হয়েছিল বাবা। মা ও। শোভার মনে অবশ্য কোন বিশেষ ভাবের প্রকাশ ঘটেনি কথাটা শুনে। যে মানুষটাকে প্রথম বার দেখছে, তার মুখের দু একটা সাধারন কথায় কারুর মনেই কোনো প্রভাব পড়ে কি? শোভার অন্তত পড়েনা। কিন্তু গান ও তো সেই অর্থে ”মুখের দু একটা কথা”ই! তা হলে ওনার গান শুনে ওর এরকম হল কেন?

    অতিথির জন্য চা-জলখাবার বানাতে মা গেছিল রান্নাঘরে। বাবার সাথেই বসে গল্প করছিল বিশ্বনাথদা। দাদা ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা গেছিল,বড় মামা জোর করে রেখে দিয়েছে কদিন। নইলে দাদাও শুনতে পেত বিশ্বনাথদার গান। দাদাটাও বড় ভালো গায়। তবে দাদার গলায় যে গান গুলো শুনেছে শোভা, সে গুলো সবই চলতি গান; রেডিওতে মাইকে আকছারই শুনছে সকলে। বিশ্বনাথদা করেন ধ্রুপদী গান। সেদিন গেয়েছিলেন মিঞা কি মল্লার। মা বলেছিল, এখন তো বর্ষার সময় নয়, তবে কেন মিঞা মল্লার? বিশ্বনাথদা বলেছিলেন মাসিমা, ঋতু কি শুধুই প্রকৃতিতে বিরাজ করে,মনে কি করেনা? মা আর কিছু বলেনি।
    আলাপের সময় একটু অসুবিধে হচ্ছিল ওনার; সঙ্গত ছাড়া গাওয়ার অভ্যেস নেই বলে। শোভা দেখছিল আস্তে আস্তে বিশ্বনাথদা ডুবে যাচ্ছিলেন রাগের ভেতর। বোলরে পপিহরা, অবঘন গরজে। শোভার বুকের ভেতরেও কি মেঘ গর্জাচ্ছিলনা তখন? উনি ঠিকই বলেছেন - ঋতুর প্রকাশ প্রকৃতিতে যতটা, মানুষের অন্তরেও ততটাই। তবে এ দু জায়গার ঋতু সর্বদা যে এক হবে, তার কোন মানে নেই।

    কেমন অবলীলায় অন্তরায় ঢুকে গলেন - উন উন কর আই বদরিয়া…। চোখের সামনে এখনও যেন দেখতে পাচ্ছে বিশ্বনাথদার বাহ্যজ্ঞান রহিত মুখ খানা!
    বাহ্যজ্ঞান রহিতই। নইলে ওনার গানের কালো মেঘ যে একটা শ্যামলা মেয়ের বুকের মাঝে এখনও চরে বেড়াচ্ছে সে খবর আর উনি রাখলেন কই!

    এত ভাল গাইতে পরে একটা মানুষ! গানের কথাগুলো যেন এখনও ওর কানে অবিরাম বেজে চলেছে …। বরসন লাগী সদা রঙ্গীলে…...। গানটা শুনে বুকের ভেতরে কেমন যেন করছিল ওর। কষ্ট নয়, আনন্দ নয়, উত্তেজনা নয়। এই সব কটা অনুভূতি একসাথে মেশালে তবে বোধহয় এমন হয় বুকের ভেতরে। ওই ধরনের গান বাজনার সঙ্গে সেদিনই প্রথম আলাপ হল শোভার। প্রথম আলাপ হল বিশ্বনাথদার সঙ্গে। প্রথম আলাপের মেদুরতা যে এতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা জানত না শোভা। তবে মেদুরতাটার কারন বিশ্বনাথদার গান, না কি উনি নিজে - এটা এখনও বুঝতে পারছেনা ও। আর বুঝতে না পারাটা মন জমিতে ছড়াতে ছড়াতে ওকে উদাস করার সাথে সাথে করে তুলছে অস্থিরও। মনের অস্থিরতাটা যে পায়ে পায়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে শরিরেও, সেটা বুঝে উঠতে পারছেনা শোভা। আর তাই থেকে থেকে আরোও যেন অস্থির হয়ে পড়ছে ও। এই যেমন এখন! ঘরের ভেতর চুপটি করে বসে রয়েছে, কিচ্ছুটি করতে মন চাইছেনা। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতেও ইচ্ছে করছেনা ওর।

    বিছানা থেকে উঠে বাবার ঘরের দিকে গেল শোভা। বাবার পড়ার টেবিল বসে মেজদি একমনে কি একটা করছে। কাছে গিয়ে দেখল, টেবিলের ওপর একটা বিশ্বের ম্যাপ পড়ে। কিছু কিছু অঞ্চলের ওপরে লাল পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে মেজদি।

    -এ জায়গাগুলোর বৈশিষ্ঠ কি রে, মেজদি?
    -এ সব অঞ্চল গুলোতে চাল ভাল উৎপন্ন হয় - বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম।
    -হ্যাঁরে মেজদি, এই ভিয়েতনামটা একটু দ্যাখা না রে কোথায়!
    -চিনের পেট থেকে এই ল্যাজটা বেড়িয়েছে দেখছিস?এটাই ভিয়েতনাম
    -ওখানে কি একটা গন্ডগোল চলছে না?সেদিন অশোক বলছিল
    -হ্যাঁ। আমেরিকার সাথে যুদ্ধ।

    দুই বোনের কথোপোকথনে ছেদ পড়ল। দাদা এসে ঢুকল ঘরে। গতকাল সন্ধ্যে বেলায় দাদা ফিরেছে কলকাতা থেকে। শোভা বলল, মেজদি,দেখেছিস, দাদার গা দিয়ে কিন্তু এখনও কলকাতার গন্ধ বেরুচ্ছে! প্রত্যুত্তরে শুধু অল্প হাসল সুধা। অযথা প্রগলভতা অপছন্দ সুধার। সে কথা শোভা বিলক্ষণ জানে কিন্তু অভ্যেস বড় বালাই! চাইলেও সর্বদা তকে বদলানো যায়না। বদলানো যায়না আপনজনেদের সাথে ব্যবহার। বুকের ভেতরের তুফানটাকে চুপ করিয়ে স্বাভাবিক কথোপোকথন চালিয়ে যেতে হয়।

    দাদার সঙ্গে খুনসুটি চালাচ্ছে শোভা। কমল ও মজা পেয়ে তাল দিচ্ছে। দাদা-বোনের আনন্দটাকে বসে বসে দেখছে সুধা। শোভার মতন সুধাও তো কমলের বোন, কিন্তু হাল্কা আলাপ-আলোচনার মধ্যে নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগে ওর! অন্যরা মজা করলে, আনন্দ করলে দেখতে বেশ লাগে কিন্তু নিজে কিছুতেই তার মধ্যে যোগ দিতে পারেনা। অজানা অস্বস্তিতে আড়ষ্ঠ হয়ে যায় মন। কলেজ, টুইশানি আর বাড়ি - এই তিনটে বিন্দুর তৈরি ত্রিভুজের মধ্যেই কেটে যায় ওর কুড়ি বছরের জীবন। কাটতে থাকে যৌবনও, কিন্তু সে খবর সুধা রাখেনা। এই ত্রিভুজের মধ্যেও চাইলে ফুল ফোটাতে পারত সুধা, পারত ছোট ছোট আনন্দ গুলোকে নিংড়ে একটা সতেজতর জীবনের নির্মাণ করতে - কিন্তু এখন ওর একমাত্র লক্ষ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো। দাদা যদি এ চাকরিটা পেয়ে যায় তো ভালো - নইলে ও দাঁড়াবে বাবার পাশে। আর তো একটা বছর! একটা ভদ্রস্থ চাকরি নিশ্চয়ই জোগাড় করে নিতে পারবে ও। যে আনন্দগুলো এখন মুলতুবি রাখছে ও, সেগুলো তখন না হয় সূদ সমেত পুরণ করে নেবে! শোভা , দাদা, বাকিরা তো রইলই ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য; কিন্তু এখন কোনোমতেই লক্ষ্যচ্যূত হওয়া চলবে না!

    আর দাদা যদি চাকরিটা পেয়ে যায় তবে তো আর কথাই নেই! এম এ পড়তে কলকাতা যাবে সুধা। কলকাতা! অদ্ভূত প্রাণ আছে শহরটার মধ্যে। মিছিল, স্লোগান, ফুটবল - সব মিলিয়ে আজব শহর একটা। মামার বাড়িতে গেলে সারাটা দিন মামাদের তিনতলার বারন্দাটাতেই কেটে যায় ওর। বসে বসে রাস্তার প্রাণস্রোতে স্নাত হয় মনে মনে।

    তবে কলকাতার যেটা সবথেকে ভালো লাগে ওর তা হল, ওখানকার শিক্ষায়তন গুলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়! বড় মামা একবার দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এ নিয়ে গেছিলেন। উফ্‌! কি বিরাট উঁচু সিলিং টা! তবে থেকে মনের গভিরে একটা স্বপ্ন লালিত হচ্ছে ওর; কতকটা নিজের অজান্তেই - কিন্তু লালিত হচ্ছে বটে!
    একদিন ওই বিল্ডিংটায় ক্লাস করবে সুধা।
    অফ পিরিয়ড গুলো লাইব্রেরীতে কাটাবে। ছুটির দিনগুলোতে যাবে ন্যাশান্যাল লাইব্রেরীতে। ন্যাশান্যাল লাইব্রেরীতেও সুধার প্রথম যাওয়া বড় মামার হাত ধরেই। দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর মতই ন্যাশান্যাল লাইব্রেরীও মুগ্ধ করেছিল সুধাকে প্রথম দর্শনেই।
    তবে এ সবই সম্ভব হবে দাদা চাকরিটা পেলে।
    দাদা এখন পেছনে লাগছে শোভার। শোভাও চেঁচিয়ে চলেছে সমানে। সুধা ওদের পাশেই বসে, কিন্তু তবু নেই ওদের সাথে। ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে আসার পরে অল্প হলেও ফিরে এসেছে দাদার আত্মবিশ্বাস। আগের চাইতে অনেক খোলামেলা ব্যবহার করছে সকলের সাথে। ভালো লাগছে দেখে। এখন তাই দাদাকে একটা প্রশ্ন করাই চলে - দাদা, চাকরিটা পেয়ে যাবি তো?

    মনে মনে প্রশ্নটা অগ্রজকে করেই ফেলল সুধা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৫৯৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন