এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রেডিও-স্মৃতি

    Zarifah Zahan লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৬ জুলাই ২০১৭ | ৯০০ বার পঠিত
  • ছোট-বড়-মাঝারি নানা সাইজের সাদাসিধে তরকারি কিংবা ডাল মাখা ভাতের গোল্লা।মাথলের উপর হাল্কা ওজনের চোঙাটাকে বাদ দিলে পড়ে থাকে যতটুকু জমি, সেই সাইজের একটা থালায় তাদের বেশ একখানা আন্দাজসমান দূরত্বে সাজিয়ে রেখে শুরু হতো আম্মির কসরৎ। তখন বছর দুই। সেসময় আমাকে খাওয়ানো ছিল পাঁজি দেখে লগ্ন মেনে 'গোমাতা' উচ্চারণ বিনা নিষ্পাপ দেশভক্তি প্রমাণের থেকেও অবিশ্বাস্য প্রজেক্ট। মুখ থুবড়ে পড়বে জেনেও অবস্থাখানা 'আশায় মরে চাষা' আর কী। একটা গোল্লা হাতে নিয়ে আম্মি বলতো, "এটা হাঁসের ডিম...ঐ দ্যাখো হাঁস...প্যাঁক প্যাঁক" আমি হাঁস খুঁজতে ঘাড় ঘোড়ালেই হাঁস বাবাজি একদম পি সি সরকারের ম্যাজিকে অদৃশ্য ডানা মেলে তরকারি মাখা ভাতের গোল্লা হয়ে মুখের ভেতর চকম চকম। বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার। ম্যাজিকটা কীভাবে হচ্ছে বোঝার জন্য মনে বিস্ময়, বুক আনচান আর প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মুখখানা হাঁ হয়ে গিয়ে একে একে ইঁদুর, বাদুড় সবার ডিমেরই একই পরিণতি হলে আমি মুখবন্ধ করে প্রবল সন্দেহ নিয়ে তাকাতাম আম্মির দিকে । ম্যাজিক বদলে ডায়নামোর কৌশলে জাতীয় পশুটিরও (তখনো বাঘে আর গরুতে এক ঘাটে জল খেতনা) ডিম হবে ঘোষণা হলেই অবিশ্বাসের রুলার মেপে আমার মুন্ডুটিকে নাড়াতাম। এরপর কৌশল-প্রকৌশল গলাগলি করে বাটিচচ্চড়িই হোক বা ঝগড়াঝাঁটিতে সাপে-নেউলে হোক আমার থোড়াই কেয়ার।

    তবে ব্যাপারটায় রদবদল হতো নানুবাড়ি গেলে। নানু ঘুমোনোর সময়টুকু বাদে একটা রেডিও কাঁধে ঘুরতো।বেশ মাদুর-মাদুর হলদেটে খয়েরি রং। রেডিওর ডানপাশে নব। তার ভেতরে স্নেহসুবাস, শব্দকথায় রূপকথা। একটু ঘোরাও ঝিরঝির, আর একটু...মিহি...আলতো...অল্প আঁচড়। ব্যাস ভালোবাসার আস্তিনে ম্যাজিক। আকাশবাণী বুলি। এরপর হাতি, তিমি মায় ঘোড়া অব্দি ডিম পাড়লেও আমি চোখ বুজে গিলে নিতাম গোল্লা। ঠিক, ভুল, মাথাউঁচু, নতজানু... সব। তখন বছর দুই।

    রেডিও ছিল আমার খেলনাবাটি। ফিক হাসির সাথী। মেয়েবেলার দুপুর। মনের ওজন ভারী হলে জলপট্টি হতো সে। মুহূর্ত গন্ধে আবেগাতুর।
    মাঝে সে নিজগুণে নষ্ট হয়ে বিবাগী হলো বহুদিন।

    ক্লাস এইট। লোডশেডিং এর দাপটে আব্বু একটা ইমার্জেন্সি লাইট কিনে এনেছে। দিব্যি টুকটুকে ডালিম রং। লাইটটাকে আরো পরখ করতে ঘোরাতেই দেখি দুটো নব। চেনা চেনা। আধো অচেনা। ছায়াস্মৃতি। নবের গায়ে চারপাশে খোদাই করা অনেক সংখ্যা। যেন কম্পাস। দশমিক। এ এম থেকে এফ এম। আমার ডানা চওড়া হলো গুপগুপিয়ে। বাহানায় না-বাহানায় চলতে থাকলো সে। আমার সাথে।ক্লাস নাইনে উঠলেই যখন অভিভাবকজাতির আগাম পরীক্ষা-পরীক্ষা ভাব, টেনশনে আয়োজনে বুক ধড়ফড়, ঘুম শূন্য তখন আদেশ-উপদেশ ঝুলিতে বেঁধে তাঁরা দ্বিতীয় মহাভারতের খসড়া লিখতে লিখতেও লিখে উঠে পারেন না ( এজন্য অবশ্যই সরকার তরফে কোনো 'গ(উ)রুজি' নিয়োগ করা উচিত, বলা যায়না তার নিঃশ্বাসে অক্সিজেনের সাথে দু'ছিলিম জ্ঞানরস ও বেরোতে পারে)।
    আমার যেখানে উপপাদ্যের স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট খুঁজতে ইমার্জেন্সি বাবার দশমিক হুল না ফুটলে অবস্থা সঙ্গীন সেখানে অঙ্ককালীন এই সু-আশ্রয়টুকু কেড়ে নেওয়ার হুঁশিয়ারিতে যথারীতি ভিরমি খেলাম। বিদ্রোহের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে। এরপর হাফ-ইয়ার্লিতে কীভাবে ইউনিটারি মেথডে ডাইরেক্ট আর ইনডাইরেক্ট প্রোপোরশন একে অপরের টুঁটি চেপে ধরলো, কীভাবেই বা বাঁদর মহাশয় তৈলাক্ত বাঁশ পিছলে দুধ-জলের বালতিতে পড়ে পালানোর সময় মূলধন থেকে সুদ হাপিস করে নিলো সেসবের রহস্য সমাধান করতে আমি নোবেলচুরি কেসের সিবিআইকে পর্যন্ত টক্কর দিতে পারি। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি পরীক্ষার এক হপ্তা আগে ইমার্জেন্সি বাবা ঠাকুরকে সামনে বসিয়ে সাড়ে বত্রিশ বার 'আজ থেকে গান শোনা বন্ধ' ( সাড়ে কারণ, হাফ তেত্রিশের মাথায় পেনের নিব পা ভেঙে এর প্রতিবাদ জানায়) দস্তখত দিয়ে আব্বুর সাথে ব্যাপারটার মীমাংসা হয়।

    এরপর ঘাটের জল গড়িয়ে তিস্তা ঘোলা করেছে।তবু ঘুলঘুলিতে টিকটিকির মতো আটকে আছে সেসব পুরোনো গান আমার সাথে। মিউজিক প্লেয়ার এ। যতই সিং বাবাজিরা কেঁদে কেটে ভূত ভাগান না কেন আমার ভারী ভয় হয় এই বুঝি সেল্ফি, স্কুটার সব তেড়ে এসে আমার কানের বাঁ পাশে সপাটে চাঁটি মারলো। এরপর বুকজ্বালা, মাথা ঝনঝন এসব হলে সারাদিনে ফেসবুকে লাইক গুণবে কে। শাস্তিস্বরূপ দোজখে গেলে কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে দিনে কুড়ি ঘন্টা নাক টিপে সব পেজ এ গালি পাড়ার বিধান জুটলে বুকজ্বালা নির্ঘাৎ চোঁয়াঢেঁকুর। অতএব মিউজিক প্লেয়ার। তাতে চন্দ্রবিন্দু, রূপম, মহীনের ঘোড়াগুলি। মোলায়েম স্মৃতি। আহঃ।

    অবশ্য আরো এক কারণ আছে। চুপি চুপি বলি। চাদ্দিকে যা বেছে বেছে কথা বলার ধুম মায় সেন্সর বোর্ড অব্দি, তাতে স্রোতে গা ভাসালে ছ‍্যাঁকা ফুলে কলাগাছ। যখন তখন। যা বিপ বিপ বাপান্তরের হুজুগ, তাতে ভয় হয় এই যদি প ঝুলটুল ঝেড়ে ক্লান্ত হয়ে বর্ণমালার পাশের অক্ষর এর ফ্ল্যাটে চলে যায় একটু জিরিয়ে চা-বিস্কুটে আড্ডা মারবে বলে তাহলে ফ্ল্যাট তো দূর অস্ত ব্যাটাকে দেশছাড়া না করে দেয় 'সোসাইটি'র জনগণ। অতএব বিপ এর আমি, স্রোতের তুমি। বর্ষায় পুজোবার্ষিকী ছাপের মানিকজোড়।

    "চেনা তবু চেনা নয়, এভাবেই স্রোত বয়ে যায়
    খোদার কসম জান, আমি ভালোবেসেছি তোমায়"
    পুরোনো বন্ধুকে হঠাৎ দেখা মুহূর্ত। পুরোনো ফুটপাথ। সরুগলি। বইপাড়া। স্মৃতি আজ বৃষ্টিতে ঝিমঝিমে। রেডিও বন্দী স্মৃতি। রঙিন আদরে চোখ কাঁপছে বুঝি তিরতির...।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৬ জুলাই ২০১৭ | ৯০০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    তোষণ - Zarifah Zahan
    আরও পড়ুন
    ফড়িং - Zarifah Zahan
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ওর | 209.65.210.5 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৭ ০৬:০৭61413
  • দারুন লাগলো
  • | 52.110.188.76 (*) | ২৬ জুলাই ২০১৭ ০৬:২২61414
  • বাহ বেশ গীতালি এক মন্তাজ! ভাষাও তন্দরুস্ত!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন