এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপার বাংলা

  • আসামের হিংসা আর বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের গপ্পো ঃদ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

    নীলিম দত্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ০৬ অক্টোবর ২০১২ | ৭৫১ বার পঠিত
  • ( প্রথম কিস্তির পর)

    এই আন্দোলনের হর্তাকর্তা ও জনকদের কাছে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে স্থানীয় উপজাতিদের তাদের আক্রমণের টার্গেট করে তোলা চলবে না, ফলাফলটা আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। আর ভিন প্রদেশের বসবাসকারীদেরও চাঁদমারী করে আন্দোলন টানা মুশকিল কেননা তাঁদেরও দিল্লি দরবারে যথেষ্ট যোগাযোগ আছে আর তাঁরা রয়েছেনও অন্য অনেক প্রদেশ জুড়ে। এই উপলব্ধির পর থেকেই আন্দোলনের টার্গেট ঘুরে যায় ও আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়  "বেআইনী অনুপ্রবেশকারী" যারা নাকি স্থানীয় মানুষদের পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যেই নিজরাজ্যে সংখ্যালঘু করে তুলবে, তাদের  হটানো।

    এই ব্যাপারে একটি চমৎকার তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন অধ্যাপক মণিরুল হুসেইন তাঁর The Assam movement: Class, Ideology, Identity (১৯৯৪) বইটিতে। তিনি দেখিয়েছেন, এই আন্দোলনের লোকদেখানো চাঁদমারি যদিও মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা, আসল লক্ষ্য ছিল সুবিধাবাদী অহমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে উপজাতি ও সংখ্যালঘুরা যে রকম ভাবে জোট বেঁধে তাদের ক্ষমতার একাধিপত্যকে টলিয়ে দেবার চেষ্টা করছে সেই প্রচেষ্টাকে উৎখাত করা।

    তো, ধীরে ধীরে এর প্রেক্ষাপট তৈরী হতে লাগল। প্রচার শুরু হল এই সব বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে। এরা নাকি মতলব সাঁটছে স্থানীয় মানুষদের নিজভূমে সংখ্যালঘু করে তুলবে এবং ক্রমশই গ্রাস করে নেবে স্থানীয় মানুষদের জমি। যদিও এই মুসলমান দেশান্তরীরা কয়েক প্রজন্ম ধরেই অসমে বসবাস করছেন তাও তাঁদের সবাইকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে, এটাও রটনা করা হচ্ছিল যে সীমান্তের ওপারের স্বধর্মী মানুষদের সাথেও যোগাযোগ রেখে চলছে এপারের অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীরা। অহমিয়া ভাষার কিছু পত্র পত্রিকা, যেগুলির মালিক অবশ্যই অসমের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পুরোধা অংশ, তারাই এই অপপ্রচারে মুখ্য ভূমিকা নিলেন।

    না, সবাই তো মেনেই নেন নি। কিন্তু যাঁরা সহমত হতেন না, তাদের উপর নেমে আসত হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ। রটনা করা হত, এটি একটি শান্তিপুর্ণ "গণতান্ত্রিক আন্দোলন", কিন্তু ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত্য অসংখ্য  হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেই চলছিল,যার মধ্যে সবথেকে মারাত্মকটি নওগাঁ জিলার নেলি গ্রামের হত্যাকান্ড। ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩, দু হাজারেরও বেশী মুসলমান অভিবাসীকে খুন করা হল এই গ্রামে। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। অবশ্যই এই গণহত্যাকে দেখানো হল অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় তিয়োআ উপজাতির এক স্বতস্ফুর্ত অভ্যুত্থান বলে। দীর্ঘদিন ধরে উসকে দিয়ে উত্তেজিত করে যে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সংশয়ই আজ আর নেই। উল্লেখযোগ্য যে এই জন্য একটি লোকেরও আজ অবধি কোনো শাস্তি হয় নি।

    এই ভাবেই, মুসলমান দেশান্তরী ও স্থানীয় মানুষদের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী বিভাজন সৃষ্টি হয়ে গেলো যার ফলে "বেআইনী অনুপ্রবেশ" নিয়ে আর কোনো আলোচনার আর স্থান থাকল না। এই সব মুসলমান বসবাসকারীদের কাছে সব আলোচনাই ছিল এক আশঙ্কার ব্যাপার, তাঁরা ভাবতেন কোনো অজুহাতে তাঁদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে ভারতীয়  নাগরিকত্ব। যে বিকল্প জোট দানা বেঁধে উঠছিল সেটি চিরতরে ধ্বংস হলো। অসম আন্দোলনের মূল কিন্তু গোপন লক্ষ্য জয় হল। শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর কাছে দারুন জনপ্রিয় এই অন্দোলনের ফলে যে একচেটিয়া  ক্ষমতা মসনদে বসলো, তা কিন্তু মোটেই সমগ্র আসামের সব জনজাতির প্রতিভূ ছিলো না। আর মন্ত্রীসভা তো একেবারেই নয়।

    দেড় দশকের মধ্যেই সেই উদ্দীপনা থিতিয়ে এলো, সর্বব্যাপী আশাভঙ্গের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস আবার ফিরে এল ক্ষমতায় এবং পরপর তিনবার জিতে নিল নির্বাচন।

    এই কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া কোকরাঝারে ঘটে যাওয়া দাঙ্গায় তাই দেখা গেল, এই মুসলিম বসবাসকারীরা শুধুমাত্র "বাংলাদেশী" বলে চিহ্নিত হওয়ার জন্য কোনওখান থেকেই কোনো সমর্থন পেলেন না। তাঁদের প্রতিরক্ষাতেও কেউ এগিয়ে এলেন না।

    এই যে বোরোরা মুসলমানদের আক্রমণ করলেন, তার সাথে এটাও জানা দরকার যে ১৯৯০ থেকেই কিন্তু কোকরাঝাড়ে আদিবাসীরা এইধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হয়েছেন। তখন তাঁদের প্রতিপক্ষ কিন্তু মুসলমান অভিবাসীরা ছিলেন না, ছিলেন আরেক দল উৎখাত হওয়া মানুষ যারা সে সময়ের বৃটীশ রাজের নির্দেশে ১৮৫৫ সালে এই কোকরাঝার জিলায় চলে আসেন, সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। এই আদিবাসীদের উপর কিন্তু বোরোদের জমি দখল করে নেওয়ার কোনো অভিযোগ ছিল না, কেউ বলেও নি যে এঁদের সংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে বেড়ে গেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এঁরা হিংসার শিকার হন এবং আজ ৩২,৬১৩ টি পরিবার প্রায় কুড়ি বছর ধরে ত্রাণ শিবিরে বসবাস করতে বাধ্য হন। আমাদের কি তাহলে ঐ "অনুপ্রবেশকারী বনাম স্থানীয়"দের সংঘর্ষের ফর্মুলার বাইরে এসে দেখতে হবে না কেন এই ধরনের সংঘর্ষ বার বার ঘটে যাচ্ছে এইখানে? 

    এটা আগেই দেখানো হয়েছে যে দেশের মধ্যেই কী ভাবে জমিহীন দেশান্তরীর একমুখী স্রোত ছিল অসমে। এ ছাড়াও ছিল প্রকৃতির শাপে ছিন্নমূল চরের মুসলমান বাসিন্দারা যারা ছিল শহরমুখী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এদের অনেকেই সরকারী জমি বা বা অরণ্যভুমি বেদখল করে বসবাস শুরু করেছিল। কিন্তু এটা শুধু এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। যেমন ধরুন, পলাশপুরে ক্রমাগত পাড়ের জমির ক্ষয়ের দরুণ উদ্বাস্তু হয়ে সংরক্ষিত রাণি "আদিবাসী অঞ্চল"এ চলে আসতে বাধ্য হন অনেক অহমিয়া হিন্দু। যেটা আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে কোনো রকম ব্যাপক ভাবে বা খুঁটিয়ে কোনো সার্ভে এখনো করা হয় নি যাতে দেখা যায় কতটা "স্থানীয়" জমি এই অনুপ্রবেশকারীদের বেদখলে চলে গেছে বা কতটা স্থানীয়(নেটিভ) জমি দেশান্তরীরা তাদের দখলে এনেছেন সম্পুর্ন আইনি পথেই। কী ভাবে এবং কোন হারে এই নেটিভেরা তাদের নিজস্ব জমি হারাচ্ছেন।

    তাহলে আরেকবার খতিয়ে দেখা যাক  এই দাঙ্গা হাঙ্গামার ইতিহাস শুধুই স্থানীয় লোকেদের জমি দখলকারী বাংলাদেশিদের  বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের স্বতস্ফূর্ত ক্রোধের একটা স্বাভাবিক বিস্ফোরণ - এইটাই সত্য না কি?

    কোকরাঝাড়ের দশক ধরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯৯১-০১ দশকে ছিলো ১৪.৫% এবং তার পরে দশকে অর্থাৎ ২০০১-১১তে সেটি হলো ৫.২%। বোঝাই যাচ্ছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবল চাপ মোটেও সেখানে ছিল না।

     আর এটাও মনে রাখা দরকার বহুদিন ধরে এক সাথে বসবাস করবার ফলে স্থানীয় মানুষ ও বহিরাগতদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল। সাময়িক ভাবে কিছুটা মনোমালিন্য থাকলেও সামগ্রিকভাবে পারস্পরিক লেনদেন ও সহাবস্থান অব্যাহতই ছিল। স্বতস্ফূর্ত ভাবে ব্যাপক দাঙ্গা ঘটবার মতন কোনো পটভূমি সেখানে ছিল না।

     অনেকেই এই সাপ্রতিক দাঙ্গাকে বোরো আন্দোলনের পুনরুত্থান বলে ভাবছেন। দীর্ঘদিনের বঞ্চনার শিকার হিসাবে, এই বোরো গোষ্ঠির  একটি সুবিধাভোগী অংশের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন এমনও ভাবা যেতে পারে। আর সেটা করতে গেলে বোরো পরিচিতিকে আঁকড়ে ধরে লড়াই করা দরকার। এই অভিযোগও  উঠেছে যে অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈকে বেকায়দায় ফেলতে তার পার্টির কিছু নেতাই এই দাঙ্গাটি পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছে।

    ২০০১ সালের সেন্সাস তথ্য অনুযায়ী কোকরাঝাড়ের জনসংখ্যার ৬৫.৬%)  হিন্দু, মুসলিমেরা ২০.৪% এবং ১৩.৭% মানুষ হচ্ছেন খ্রীষ্টান ধর্মপন্থী। বোরোদের অনেকেই হিন্দু কিন্তু তাদের মধ্যে খ্রীষ্টানও কম নেই। আর আদিবাসীরা প্রায় সকলেই খ্রীষ্টান। ভাষার দিক দিয়ে দেখলে বন্টনটি এইরকমঃ  বোরো ৩২.৪%, বাংলা ২১.১%, অহমিয়া ২০.৩% আর সাঁওতালি ১৬.৭%।  তো এই ভাষার দিক দিয়ে দেখলেও স্থানীয় মানুষদের "আমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি" এরকম একটা ভিত্তিহীন ভয়ের কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। কোকরাঝাড়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামগ্রিক হার ৫.২% অসমের জিলাগুলির সবথেকে কমের একটি। ব্যাপক ভাবে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ ঘটলে সেটা এতো কম থাকত না। এই কম বৃদ্ধির ফলে জনঘনত্বও এই জিলায় বেশ কম - প্রতি বর্গ কিলোমিটারে সেটি বেড়েছিল ২৬৬ থেকে ২৮০টি মানুষে। ফলে দেখাই যাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য নেই যাতে একবারও ভাবা যেতে পারে যে এই জিলায় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি মুসলমানেরা ঢুকে পড়ছিলো।

    বোরোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউনসিল (বিটিসি) গঠিত হবার পর প্রথম যে নির্বাচন ঘটে ১৩ মে, ২০০৫ সালে; তাতে একচেটিয়া ভাবে জিতে যান হাগরমা মোহিলারির নেতৃত্বে বোরোল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট (বিপিএফ)।  আর ২০০৬ সালে অসম বিধানসভা নির্বাচনে এই বিপিএফই বারোটির আসনের মধ্যে ১১টি আসন জিতে নেন। এদের সমর্থনের জোরেই রাজ্যে কংগ্রেস সরকার পরপর ক্ষমতা টিঁকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। কিন্তু তাই বলে অঙ্কটা এতো সোজা ছিল না। অন্যান্য বোরো উপদলের সাথে বারবারই নানান সংঘাত হত বিপিএফের, কয়েকবার রক্তাক্তও।

    যারা বোরো রাজনীতির হাল হকিকৎ সম্বন্ধ ওয়াকিবহাল আছেন তারা সবাই জানেন কী ভয়ানক রক্তক্ষয়ী ও হিংস্র ছিলো এই রাজনীতি। বহু মধ্যপন্থী বোরো নেতাকে সরাসরি মেরে ফেলা হয়। বোরোলিবারেশন টাইগার(বিটিএল), (যেটির নেতৃত্বে ছিলেন এই মোহিলারিই, পরে অব্শ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেন)।  বা আগেকার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোরোল্যান্ড(এন ডি এফ বি) - এই দুই দলের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে বহুজন হতাহত হন। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অবাধ  জোগান এইসব আন্দোলনকে খুব সহজেই হিংসাত্মক করে তুলেছিল। এই হিংসা ও খুনোখুনির রাজনীতি বহুদিন ধরেই এই অঞ্চলে চলে আসছে, এমন নয় যে শুধু "অনুপ্রবেশকারী"দের সাথেই প্রথম এখানে হিংসার রাজনীতি পা রাখল।

    এই বিটিসি এলাকায় বোরো নন এমন লোকের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। তাই বোরো গোষ্ঠীর মধ্যে চটজলদি জনপ্রিয়তা বাড়াতে একটি স্বতন্ত্র "বোরোল্যান্ড"এর দাবী উঠল এবং সেটি চলো ২০১১এর নির্বাচন পর্যন্ত। অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি মনোভাব ও অন্যান্য কারণে কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্ব হবে, এই ভেবেই মোহিলারি তাঁর এজেন্ডা ঠিক করছিলেন।

    কিন্তু ফলাফল সেরকম হল না। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে কংগ্রেস বিপুল ভাবে ভোটে জিতে পরপর তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় চলে এল। মোহিলারীর সাথে জোট আর কংগ্রেসের জন্য আবশ্যিক রইল না যদিও গগৈ জোট ভাঙলেন না। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীসভায় বোরোদের সংখ্যা কমিয়ে মাত্র একজনকে রাখলেন।পরের নির্বাচনের (বিধানসভায় এবং BTCতে) অনেক দেরী, মোহিলারি তাই অধৈর্য্য হয়ে পড়ছিলেন। ধীরে ধীরে একটা হিংসার অবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তাঁর পক্ষে সুবিধে, হয়তো এই স্ট্র্যাটেজী নিয়েই তিনি এগোচ্ছিলেন।

    ২০১২ সালের জুন মাসে থেকেই এই হিংসাত্মক উশকানি শুরু হল মুসলিমদের উপর পরপর কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে। প্রাক্তন মিলিটান্টদের উপর সর্বসাধারণের বিরক্তি ক্রমাগতই বেড়ে চলেছিল, কেননা তোলাবাজি ও অপহরণের অনেকগুলি অভিযোগ ছিল এদের বিরুদ্ধে আর সরকারও এদেরকে সামলানোর কোনো চেষ্টাও করছিলেন না। বেছে বেছে মুসলিম অভিবাসীদের হত্যার ঘটনা পরিস্থিতিকে সঙ্কুল করে তুলছিল। ৬ জুলাই, কিছু লোক একটি মুসলিম গ্রামে আচমকা গুলি ছোঁড়ে, দু জন নিহত হন, আহত হন তিনজন। ১৯ জুলাই অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (AAMSU) দুজন সদস্য গুলিবিদ্ধ হন। ২০শে জুলাই জয়পুর নামে একটি মুসলিম গ্রামে চারজন বোরো প্রাক্তন মিলিটান্ট বাইকে করে ঢোকেন। সেই সময়ে নামাজের জন্য কয়েকশো মুসলমান ওখানে জমায়েত ছিলেন। সে সময়ে হঠাৎ করে ঐ জমায়েতের মুখোমুখি হয়ে ভয় পেয়ে বোরোরা তাদের অটোমেটিক বন্দুক থেকে শুন্যে গুলি ছোঁড়েন এবং সেটিকে আক্রমণের ঘটনা মনে করে মুসলমানেরা তাঁদের আক্রমণ করেন। পুলিশ যখন অকুস্থলে পৌঁছায় ততক্ষণে চারজন বোরোই নিহত হয়েছেন।

    এর পরের দিন, এই চারজন প্রাক্তন BLT মিলিটান্টের দেহ মিছিল করে সৎকার করা হয়। স্থানীয় টিভিতে একটানা এই মিছিলের প্রচার চলে। এর পরবর্তী দাঙ্গার জন্য এর বেশী ইন্ধনের আর দরকার ছিল না।

    এর ঠিক একই রকম সমান্তরাল ঘটনা ঘটেছিল আমেদাবাদে। যখন গোধরায় নিহতদের দেহ নিয়ে আমেদাবাদে এরকম মিছিল ও প্রচারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, এবং এর পরেই ঘটেছিল ২০০২ সালের কুখ্যাত গুজরাত দাঙ্গা। কোকরাঝারেও সেই রাতেই চারজন মুসলিম তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পরিস্থিতি দ্রুত বেসামাল হয়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা দফতরের গড়িমসির জন্য অকুস্থলে আর্মি পাঠাতেও দেরি হয়ে যায়।

    হিংসা ও গুজব, দুটোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে ও লক্ষাধিক বোরো ও মুসলিম শরণার্থী  তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে দূরের স্কুল ও সরকারি ভবনে আশ্রয় নেন। এবং সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতারাও দ্রুত এই ঘটনাকে আরো উশকানি দিতে শুরু করেন।  নিতান্ত স্থানীয় একটি ঘটনাকে  "জাতীয় সুরক্ষা" বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলেন বিজেপির লালকৃষ্ণ আদবানি যিনি এটাকে ক্রমাগতঃ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের টিঁকে থাকার লড়াই বলে ব্যাখ্যা করেন। এবং এই ভুলভাল ব্যাখ্যা ও অপপ্রচার থেকেই সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরে উত্তর পূর্ব অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে শঙ্কা ও ভীতি।

    এই যে তরুন গগৈ মন্ত্রীসভা এই এতবড় দাঙ্গা ঘটে যেতে পারে সেটা একেবারেই আঁচ করতে পারেন নি বা একবার হিংসা শুরু হবার পর খুব কড়া হাতে সামলানোর জন্য অনাবশ্যক সময় নিয়েছেন, এটা হয়তো তাঁদের এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকার জন্য একটা নির্বিকার আত্মপ্রসাদী মনোভাবের জন্য ঘটেছিল। আর এটাও ভাবা খুব খুব বোকামি হবে যে  এই রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় আসবার জন্য সুস্থ গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে যে কোনো ভাবেই এরকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাবার আরো চেষ্টা করবেন না। একমাত্র শুধুমাত্র সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে ও খুব কড়া হাতে ব্যবস্থা নিলেই এইরকম ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

    আর মানুষদের ও তাঁদের যাবতীয় অবিশ্বাস ও কুসংস্কারের নীতি ঝেড়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবে একসাথে থাকার আর কোনো পন্থা নেই। আসাম, ধর্ম, ভাষা, জাতিগত - এর কোনো ভাবেই একটি সমশ্রেণীভুক্ত (homogeneous) সমাজ ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না।

    ( সমাপ্ত )

    অনুবাদঃ দীপ্তেন


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপার বাংলা | ০৬ অক্টোবর ২০১২ | ৭৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুশান্ত | 127.203.168.28 (*) | ১০ অক্টোবর ২০১২ ০৪:৪০90618
  • এই দরকারি লেখাটা অনুবাদে প্রকাশের জন্যে ধন্যবাদ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন