এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • দিল্লী লৌহস্তম্ভ – এখনো ক্ষয়ে যায় নি কেন? (পর্ব - ২)

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি | ০১ মে ২০২০ | ৩১৫৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • বাজারে হাজারো রকমের আম পাওয়া গেলেও হিমসাগর, ল্যাঙড়া এবং আলফানসো এই তিন আম নিজেদের যেমন চিহ্নিত করেছে আলাদা করে নিজগুণে, তেমনি বেশ কিছু থিওরী বাজারে ছড়ালেও, লৌহস্তম্ভ কেন ক্ষয়ে যাচ্ছে না তার ব্যাখ্যাটি তিন সম্ভাবনায় মাথাচাড়া দিয়েছে অন্যদের তুলনায় বেশী করে –

    ১) ওই লৌহস্তম্ভ কোন বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো হয়েছিল

    ২) স্তম্ভের লোহাতে এটা সেটা মেশানো ছিল, যার ফলে ওই লোহা কম ক্ষয়

    ৩) স্তম্ভ যেখানে খাড়া ছিল সেখানকার জলবায়ু ক্ষমাসুন্দর ছিল ধাতুর প্রতি – মানে আদর করে কম ক্ষয় হতে দিত আর কি।

    এই ব্যাপারগুলো নিয়ে এবার একটু নাড়াচাড়া করা যাক। প্রথমত, ‘বিশেষ’ পদ্ধতিতে বানানো হয়েছে মেনে নিতে গেলে আগে দেখতে হবে যে সেই সময়ে ভারতের পাবলিক লোহা বানানোর পদ্ধতি কতটা ভালো জানতো। রেগুলার পদ্ধতিতে এক্সপার্ট হলে তবেই তো স্পেশাল পদ্ধতিতে সিফট করবে নাকি? যেমন মোগলাই পরোটা বানাতে গেলে আগে তো একটা সম্যক ধারণ থাকতে হবে যে পরোটা জিনিসটা আদপে কি!

    প্রোফেসর সিধু ১৯৮৩ সালে বেশ একটা জমকালো বই লেখেন যেখানে ভারতের লোহা তৈরীর ইতিহাস বেশ সুন্দর করে বর্ণণা করা আছে। তবে এই বিষয়ে আরো অনেক বই আছে, উৎসাহীরা একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। তা সিধুর মতে ভারতে এই লোহা এবং ইস্পাত নিয়ে নাড়াঘাঁটা বেশ বেশ প্রাচীন। এবং শুধু তাই নয়, এই লোহা নিষ্কাশন এবং তার ব্যবহারের ভারতীয় পদ্ধতি যতটাই প্রাচীন ঠিক ততটাই প্রকৌশলগত ভাবে চমকপ্রদ। এখানে আমরা বেশী গভীরে ঢুকব না সেই ব্যাপারের – তবে এটুকুই বলা, ভারতীয়রা লোহার ব্যাপারে বেশ দক্ষ ছিল, এটা ঘটনা, বিজেপির আই টি সেল হতে প্রচারিত ম্যাসেজগুলোর মত নয়। তাই আপনারা বিজেপির সমর্থক না হলেও এই বিষয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব বোধ করতেই পারেন খানিক।

    বৈদিক যুগে লোহাকে ‘আয়স’ নামে ডাকা হত। খ্রীষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে থেকে খ্রীষ্টের জন্মের পরে প্রায় আরো এক হাজার বছর পর্যন্ত ভারতের লোহা এবং তার বানানোর জ্ঞান-জন্মি একদম স্টেট অব্‌ দ্যা আর্ট ছিল। অনেক বিষয়ে ভারতে সেই সব পৃথিবীতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। মিশরের পাবলিক যে সব মন্দির, পিরামিড এই সব বানিয়ে তাতে হেয়ারোগ্লিফিক্স নাকি কি সব দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল, সেই সব বানাতে যে যন্ত্রপাতি ইত্যাদি লেগেছিল তা বানাতে নাকি ব্যবহার করা হয়েছিল ভারতীয় ইস্পাত। বলা হয়ে থাকে যে সেই সময়ে ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন সভ্যতায় এমন লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে তারা ভারতের মতন এত উন্নত মানের ইস্পাত তৈরী করতে পারত। সেই সময়কার গ্রীক এবং ল্যাটিন লেখা লিখি পড়লে এটা বোঝা যায় যে এই লোহা-ইস্পাত ইত্যাদির ডিটেলস্‌ সম্পর্কে তারা বেশ অজ্ঞই ছিল। অবশ্যই তারা জানত কি ভাবে লোহা-ইস্পাত ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু কি ভাবে লৌহ আকরিক থেকে লোহা নিষ্কাষণ করে তার থেকে ইস্পাত ইত্যাদি বানাতে হয় সেই সম্পর্কে তারা তেমন কিছু জানত না।

    এই পর্যন্ত পড়ে আপনি এবার ভাবতেই পারেন যে, ভাই সিধু নিজে তো এ সব বলবেই – হয়ত সিধুর মধ্যে ভারতীয় ব্যাপারটা বেশ প্রবল ছিল, কিংবা বিজেপি করত সেই ১৯৮৩ সালেও! কিন্তু ব্যাপারটা নয়, লেলিন এই ব্যাপারে কি বলেছিলেন বা চীনের চেয়ারম্যানের এই বিষয়ে কি বক্তব্য ছিল তা ঠিক খুঁজে বের করতে না পারলেও, খুঁজে পেয়েছি যে প্রোফেসর সিধুর এই দাবী দাওয়া কি প্রবল ইংরেজরাও মেনে নিয়েছে। স্যার রবার্ট হ্যাডফিল্ড, যিনি কিনা ধাতুবিদ্যা জগতে একদম শাহেনশা ছিলেন এককালে, তিনিও বলেছেন যে “এই বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে ভারতীয়রা হাজার হাজার বছর ধরেই লোহা-ইস্পাতের ব্যাপারটা জানত। তো এমনটা হতেই পারে যে ব্যাবসা ইত্যাদি সূত্রে মিশরের পাবলিক ভারত থেকে এই জ্ঞান লাভ করে গিয়েছিল – বা ভারতের কারিগরদের থেকেই লোহার জিনিসপত্র বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বা এখান থেকে লোহা নিয়ে গিয়ে মিশরে নিজেদের মত যন্তপাতি বানিয়ে নিয়েছিল। সেই সময়কার ওই স্থাপত্য এবং নানাবিধ বাড়িঘর বানাতে যা যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়েছিল তা মনে হয় কেবলমাত্র ‘হার্ডেনড্‌ স্টিল’ থেকেই সম্ভব। এই কিভাবে অধিক শক্ত ‘হার্ডেনড্‌ স্টিল’ বানাতে হয় তা একমাত্র সেই সময়ে ভারতীয়রাই জানত”। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যদি হ্যাডফিল্ড সাহেবের কথাও না মানতে চান, তাহলে সেই বিখ্যাত গ্রীক হেরোডেটাস-এর কথাকেও কি উড়িয়ে দেবেন? তাঁর লেখা অনুসারে, খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ বছরের কাছাকাছি সময়ে জেরেক্সেস এর সৈনীবাহিনীতে যে ভারতীয় রেজিমেন্ট ছিল তারা সামরিক উদ্দেশ্যে লোহা ব্যবহার করত ব্যপক ভাবে।

    তবে একটা ব্যাপার হালকা করে বলে নিই এই সময়ে – এই লেখায় লোহা এবং ইস্পাত প্রায় সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হলেও, গভীরভাবে দেখতে গেলে লোহা এবং ইস্পাত কিন্তু একটু আলাদা। আমরা প্রচলিত অর্থে বেশীর ভাগ জিনিস যাকে লোহার বলে জানি, তা আসলে ইস্পাত। ‘আয়রণ’ এর অনুবাদ যদি করা হয় লোহা, তা হলে বিশুদ্ধ লোহা কিন্তু বেশ নরম। লৌহ আকরিক থেকে যখন লোহা নিষ্কাষণ করা হয় তখন কিছু অবাঞ্ছিত পদার্থ থেকে যায় – যেমন সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি। এদের লোহা থেকে দূর করার পদ্ধতি ওনেক আধুনিক কালে আবিষ্কার হয়েছে। পুরাকালে সেই পদ্ধতি জানা ছিল না মানুষের। এবার এই লোহার সাথে যদি আপনি ‘কার্বন’ মেশান তাহলেই পাবেন ইস্পাত বা স্টিল। লোহার সাথে কার্বন মিশে গিয়ে খুব জোর বাড়িয়ে দেয় এবং তাই ইস্পাত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই বাড়িতে আমরা যেমন রান্না করে এটা সেটা মিশিয়ে স্বাদ বাড়াই খাবারের, তেমনি আয়রণের সাথে আরো অন্য পদার্থ অল্প পরিমাণে মিশিয়ে ইস্পাতের ধর্মের নানা রকম পরিবর্তন করা হয়। আবারো এই সবই আধুনিক যুগের প্রাপ্ত জ্ঞান।

    নীচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে মাটির উপরেই কেমন লোহার আকরিক পাওয়া যাচ্ছে এবং আদিবাসীরা কেমন ভাবে কাঠ কয়লা বানাচ্ছেঃ



    আর একটু হালকা করে খুলে বলা যাক, সাধারণ উদাহরণ ধরুণ এই গহনার সোনা – ২৪ ক্যারেট সোনা প্রায় বিশুদ্ধ এবং তাই খুব নরম। পি সি চন্দ্র জুয়েলার্স যতই দাবী করুক, এই চব্বিশ ক্যারেট সোনা দিয়ে টেকসই গয়না বানানো খুব চাপের। খালি এটা সেটা বেঁকে যাবে, খুলে যাবে। সোনাকে শক্ত করতে তাই মেশাতে হয় খাদ – সোনার সাথে তামা মিশিয়ে ২২ বা ১৮ ক্যারাটে এ নামিয়ে ভালো টেকসই গহনা বানানো যায় – অঞ্জলি জুয়েলার্স জিন্দাবাদ!

    ক্ষয় নিয়ে কথা হচ্ছে – এখন আমরা জানি লোহার সাথে কি মেশালে তার ক্ষয়রোধ ক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু সেই জ্ঞান আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে ছিল না, বা হয়ত ছিল না দিল্লীর লৌহস্তম্ভের সময়েও। তারা হয়ত জানত, এটা মেশালে এই ধর্মের একটু পরিবর্তন হয় – কিন্তু কেন হয় জানত না। যেমন ধরুণ, বর্ধমানের লোকেরা জানে অম্বল বা চোঁয়া ঢেঁকুর উঠলে শুকনো মুড়ি খেলে বেশ উপকার দেয়। কিন্তু পাবলিক জানত না এর পিছনে কারণটা কি – এবার যদি আমি আজকে গবেষণা করে বের করে বের করি যে মুড়ি ভেজা জলে এক বিশেষ এনজাইম আছে যার নাম ‘ঘোষ ২০২০’ এবং সেটা থাকার ফলেই মুড়ি খেলে অম্বলের উপশম হয়। তার মানে আপনি নিশ্চয়ই দাবী করবেন না ‘ঘোষ ২০২০’ এনজাইম বর্ধমানের লোকেরা আজ থেকে শত শত বছর আগে জানত! এই ব্যাপারটা বোঝা খুব জরুরী দিল্লীর লৌহস্তম্ভের ক্ষয় ব্যাপারটা বোঝার জন্য – আজকের যা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সেটা নিতান্তই আজকের। এমন কোন প্রমাণ নেই যে এই বিজ্ঞান জেনেই আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে সেই স্তম্ভ তৈরী হয়েছিল। যতদূর সম্ভব তাদের ছিল অম্বল হলে শুকনো মুড়ি খাবার মত কেস।

    শুধু ওই মিশরের লোহার যন্ত্রপাতি সাপ্লাই করেই ভারতের কেরামতি শেষ হয়ে যায় নি – অনেক গবেষকের মতে আজকে যা ‘দামাসকাস্‌ স্টীল’ বলে সারা পৃথিবীতে পরিচিত, তা আদপেই ভারতীয় দেশী মাল – চেন্নাই এবং হায়দারাবাদের দিকে কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে এই ইস্পাত তৈরী করত। দামাসকাস (সিরিয়া দেশের রাজধানী) থেকে ব্যবসায়ীরা এদিক দিয়ে যাতায়াত করত লোহা কাঁচামাল সংগ্রহ করার জন্য, যে থেকে মূলত অস্ত্রসস্ত্র বানানো হত। এই আধুনিক সময়েই বলতে গেলে ইউরোপে ইস্পাত শিল্পে বিপ্লব আসে এবং তার পরে তারা ভারতের মত বা ভারতের থেকে ভালো স্টিল তৈরী করতে শুরু করে। এই তো মাত্র কয়েকশো বছর আগে পর্যন্ত ইংরেজরা ভারত থেকে লোহা নিয়ে গিয়ে ছুরি-কাঁটা-চামচ বানাতো। ইংরেজরা অন্য জায়গা থেকে সে স্টীল আমদানি করত (যেমন সুইডেন) তার থেকে ভারতীয় স্টিল বেশী মর্যাদা পেত, কারণ তার গুণমাণ ছিল খুব ভালো। ভারতীয় ইস্পাতে অশুদ্ধি (ইমপিউরিটি) এর পরিমাণ থাকত অনেক কম। এবং সেই একই দেখা গিয়েছিল দিল্লীর লৌহস্তম্ভের লোহাতে – অনেক কম অশুদ্ধি সেই সময়কার অন্য জায়গার ইস্পাতের থেকে।

    আইন-ই-আকবরি তে লেখা আছে সেই সময়ের মোগল আমলে কিভাবে লোহা তৈরী করা হত – আজকের তেলেঙ্গনা রাজ্যের কারিগরেরা সেই সময় গুঁড়ো লোহার আকরিক অক্সাইড (ম্যাগনেটাইট এবং হেমাটাইট) ছোট পাত্রে নিয়ে কাঠ, কাঠকয়লা, গাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে গরম করত – এইভাবে লোহার অক্সাইড আকরিক রিডিউস হয়ে থেকে লোহা নিষ্কষিত হত। আর ওই কাঠ ইত্যাদি থেকে কার্বন ঢুকত লোহাতে – তৈরী হত ইস্পাত, যা আগে যেমন বলেছি অনেক শক্ত লোহার থেকে। এই ইস্পাত তৈরী হত ছোট ছোট চাঙড়ের মতন – আর এই ইস্পাতের টুকরো বা চাঙড়ের চাহিদা ছিল খুব সেই দামাসকাস ব্যবসায়ীদের কাছে। এই চাঙড় গরম করে তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে বানানো হত তরবারী।

    এই ছবিতে প্রাচীন কালের লোহা নিষ্কাষণের চুল্লীঃ



    তাহলে এই পর্যন্ত কি বোঝা গেল? ভারতীয়দের কাছে লোহা বানাবার পদ্ধতি জানা ছিল – তাই তারা ‘বিশেষ’ পদ্ধতির কথা ভেবে থাকতেই পারে দিল্লী লৌহস্তম্ভ তৈরীর সময়ে। অর্থাৎ, পরোটা কি জিনিস জানা হয়ে গ্যাছে, তাই এবার মোগলাই পরোটা বানাবার ট্রাই নেওয়া যেতেই পারে। তবে এতেও কিন্তু একটা ছোট্ট টুইষ্ট আছে। বিশেষ ভাবে বানাবার যা কিছু বাহাদুরী তা কিন্তু আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ওই লোহার চাঙড় বা কঠিন লোহা থেকে পিটিয়ে পিটিয়ে বানাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ গলিত লোহা দিয়ে (কাষ্টিং বলে যাকে) ওই মাপের জিনিস তৈরী করার জন্য যা কারিগরী জ্ঞানের দরকার হয়, তা ভারতে ছিল না পঞ্চদশ শতকের আগে। লোহা গলনের চুল্লী ভারতে ওই পঞ্চদশ শতকের পর থেকেই চালু হয়।

    তাহলে এবার দেখা যাক দিল্লী লৌহ স্তম্ভটা কিভাবে বানানো হয়ে থাকতে পারে সেই সময়। তবে এই বানানোর ব্যাপারটা দেখতে গেলে, দুই ভাবে ভাগ করতে হবে বিষয়টা। প্রথমত, মূল স্তম্ভ এবং দ্বিতীয়ত স্তম্ভের মাথায় সেই ঘন্টাকৃতির এবং ডিম্বাকৃতির সজ্জা। যেভাবে মূল স্তম্ভ বানানো হয়েছিল, ঠিক সেইভাবে ওই ঘন্টাকৃতি/ডিম্বাকৃতি জিনিসটা বানানো হয় নি।



    মূল স্তম্ভটা বানানো হয়েছিল ওই লোহার চাঙড় গরম করে একটার উপরে একটা বসিয়ে হাতুড়ী পেটা করে। গরম থাকার জন্য এবং হাতুড়ি দিয়ে ঘা মেরে বল প্রয়োগের ফলে দুটো লোহার চাঙড় একে অপরের সাথে জুড়ে যেত। এই পদ্ধতিতে বলা হয় ‘ফোর্জ ওয়েল্ডি’'। তবে যত সহজে বলছি অবশ্যই তত সহজে বানানো যায় না একটা ২৩ ফুট স্তম্ভ! এর জন্য চাই খুব নিখুঁত গণণা এবং প্রতিটা বিষয়ের প্রতি নজর – কেমন ভাবে - কত জোরে হাতুড়ী মারা হবে, কিভাবে-কতটা গরম করতে হবে সেই লোহাকে, প্রাথমিক ভাবে কোন ঠ্যাকনা দিতে হবে কিনা – এবং মালটাকে হ্যান্ডেল করার সুবিধার জন্য এবং ঘোরাবার জন্য বিশেষ কিছু আঙটা লাগবে কিনা, ছাঁচের ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আঙটা ব্যবহারের চিহ্ন অন্তত দুই জায়গায় দেখা গেছে স্তম্ভের গায়ে।

    ফোর্জ-ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে যে এই স্তম্ভ বানানো হয়েছিল সেই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই – কিন্তু প্রথম দিকে দ্বিমত ছিল স্তম্ভটিকে কি উলম্ব অবস্থায় বানানো হয়েছিল নাকি অনুভূমিক অবস্থায় (ভার্টিক্যাল বনাম হরাইজন্ট্যাল)। এক গবেষক বলেন এটা উলম্ব করে বানানো হয়েছিল তো অন্যজন বলেন না ভাই, এটা শুইয়ে শুইয়ে বানানো হয়েছিল। প্রথম দিকে প্রোফেসর বালা দাবী করেছিল যে এটা অনুভূমিক বানানো কিন্তু পরে অন্যদের সাথে আলোচনা ইত্যাদি করে শিফট করে গিয়েছিল উলম্ব ভাবে বানানোর থিওরীতে। আজকাল মেনে নেওয়া হয় যে মূল স্তম্ভ বানানো হয়েছিল উলম্ব ভাবে ফোর্জ-ওয়েল্ডিং দ্বারা। কিন্তু বানানোর পরে স্তম্ভের গায়ে যে ফিনিসিং দেওয়া হয়েছিল মসৃণ করার জন্য তা সম্পন্ন হয়েছিল অনুভূমিক ভাবে। আর স্তম্ভের গায়ে যে খোদাই করা লেখা দেখা যায় তা অনুমান করা হয় যে ছাঁচ নিয়ে ঠান্ডা অবস্থায় ঠুকে বসানো হয়েছিল।





    তো এই পর্বে দেখলাম স্তম্ভটি কেমন ভাবে বানানো হয়েছিল – অনেক গবেষক মনে করেন যে এই যে চাঙড় পিটিয়ে পিটিয়ে স্তম্ভ বানানো হয়েছিল, তার ফলে ঠান্ডা-গরম, ঠান্ডা-গরম এই করতে করতে স্তম্ভের লোহার উপরের ভাগে কিছু পরিবর্তন চলে আসে, প্রতিরক্ষা-মূলক এক স্তর (প্রোটেকটিভ লেয়ার) তৈরী হয়, যা কিনা ক্ষয় রোধ করতে বা ক্ষয়ের দ্রুততা কমাতে সক্ষম হয়েছিল।

    পরের পর্বে আমরা দেখব লোহার ভিতরে কিছু মেশানো ছিল কিনা যা ক্ষয় রোধে সাহায্য করছে।

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০১ মে ২০২০ | ৩১৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০১ মে ২০২০ ২০:৪৬92881
  • শুধুমাত্র উপস্থাপনার জোরে নিরস ধাতু বিদ্যার ইতিহাস কতোটা প্রাণোজ্জ্বল হতে পারে তার উদাহরণ এই লেখা।  হিমসাগর আম বা মোগলাই পরোটার সাথে লৌহ বিনির্মাণ তুলনা? তা-ও মিলবে এই সরেস লেখায়।

    একটি ছোট প্রশ্ন, এই লৌহ স্তম্ভ নির্মাণ কেন আবশ্যিক? আগে বলে থাকলেও হয় চোখ এড়িয়ে গেছে, নয়তো বুঝিনি।

    পরের পর্বের অপেক্ষায়। উড়ুক

  • b | 162.158.166.156 | ০১ মে ২০২০ ২০:৫০92882
  • দারুণ। সব বিজ্ঞানী এরকম লেখেন না কেন?

    আমার আরেকটা জিনিস ইন্টারেস্টিং লাগে (এখনো পাই নি কোথাও) সেটা হল দাক্ষিণাত্যের ঐ দামড়া সাইজের পাথরের মন্দিরগুলোর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্লেষণ। অবশ্যই সুকির স্টাইলে।
  • সুকি | 172.69.134.182 | ০২ মে ২০২০ ০৯:৪৭92904
  • বিপ্লব, অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। কিন্তু "লৌহ স্তম্ভ নির্মাণ আবশ্যিক কেন" সেই নিয়ে আমি বিশেষ পড়াশুনা করি নি - আর ওটা আমার এরিয়া নয়, হয়ত ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন। 

    বি, 

       ধন্যবাদ। সিভিল তো আমার বিষয় নয়, তাই সেই নিয়ে লেখা হালকা চাপের হবে আমার পক্ষে। তবে পড়াশুনা করে নিয়ে না লেখার তেমন কিছু নেই। আসলে কি জানেন, এই ধরণের লেখা গুলো লিখতে অনেক সময় লাগে - আরো বেশী সময় লাগে 'এমন' ভাবে লিখতে। বেশীর ভাগ পাবলিক এটা হয় বোঝে না, বা বুঝলেও মানতে চায় না। এই ধরণের লেখা শক্ত ভাবে লেখা অনেক সোজা। অনেক সো কলড জ্ঞানী গুণি গবেষক/লোক টার্গেট অডিয়েন্স আর লেখার পারপাশ জিনিস দুটির সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে তুলতে পারেন না। এবং সেই কারণেই এই গুরুর পাতাতেই পথিক গুহ-কে বেশ কিছু বার হ্যাটা হতে দেখেছি। 

  • PM | 162.158.166.18 | ০২ মে ২০২০ ১০:০৪92906
  • বি, নারায়ন সন্যালের লেখা ভারতীয় স্থাপত্বের ওপোর লেখা বই গুলো পড়তে পারেন। উনি সিভিল ইন্জিনিয়ার ও ছিলেন।
  • PM | 162.158.166.18 | ০২ মে ২০২০ ১০:১১92907
  • এই লেখাটা দারুন আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বাংলায় প্রথম লেখা হচ্ছে সম্ভবত
  • b | 162.158.166.218 | ০২ মে ২০২০ ১১:১৯92909
  • "এই ধরণের লেখা শক্ত ভাবে লেখা অনেক সোজা।"
    এ ক ম ত। টুপি খুললাম।

    পি এম কে ধন্যবাদ।
  • ঝর্না বিশ্বাস | ০৫ মে ২০২০ ১১:২৮93043
  • দারুন সব তথ্য জানতে পারছি সুকান্ত। অসম্ভব ভালোলাগছে পড়তে। 

  • b | 162.158.165.25 | ১৪ মে ২০২০ ১৭:১৭93319
  • সুকি, তিন নং কোথায়?
  • ar | 108.162.219.73 | ১৫ মে ২০২০ ০৪:০১93331
  • আচ্ছা , একটা প্রশ্ন। এই ধাতুবিদ্যার অধ্যাপকরা, যারা এই লৌহস্তম্ভ নিয়ে গবেষণা করেছেন বা করে চলেছেন, তারা কখনো এই রকমের একটা স্তম্ভ বানানোর চেষ্টা করে দেখেছিলেন? মানে এই রকম কোন অ্যাকাডেমিক প্রোজেক্টের কোন কাজ হয়েছে বা হচ্ছে? সেই ছোটবেলার পড়া কথা, "সিয়িং ইজ বিলিভিং"। মানে কি ভাবে বানাতো জানি, কী দিয়ে বানাতো তাও মোটামুটি জানা। যদি ঐ রকম একটা লৌহস্তম্ভ, দৈর্ঘ্যে, ব্যাসে একটু ছোট হলেও চলবে, বানিয়ে কুতুবের পাশে এক-্দু বছর ফেলে রেখে দিয়ে দেখা যায় যে, কিছুই হল না, তাহলে বেশ হত। কিছু ছাত্রের পি-হেইচ-্ডিও হয়ে যায়।
    জং ধরে গেলেও কোন ক্ষতি নেই। "ব্যর্থতা সাফল্যের স্তম্ভ" এই হককথার হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া যাবে।

    ঐ "একতার ভাস্কর্য" এর ছবিটা দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে যে এই লৌহস্তম্ভের প্রোজেক্টের জন্য টাকা পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

    লেখাটা আগ্রহ সহকারে পড়ছি।
  • debu | 172.69.33.68 | ১৫ মে ২০২০ ০৫:৫৪93333
  • কোনারক এর মন্দির এর উপর কিছু বলুন
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন