এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • হিন্দুস্তানে প্রথম মুসলিম বিজয়

    দীপ্তেন
    আলোচনা | বই | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ | ৬৬৩ বার পঠিত
  • হিন্দুস্তান কথাটাই বেশ অস্পষ্ট। আরবেরা বলতেন অল হিন্দ, অর্থাৎ সিন্ধুর ঐ পার।

    অষ্টম খ্রীষ্টাব্দ। ইসলামও বেশ নবীন। কেরালার উপকূলে মালাবারে নিয়মিত আসত আরবেরা। স্থানীয় লোকেদের সাথে তাদের কোনো বিরোধ ছিল না। তাই না তাদের নাম ছিল মোপলা মানে জামাই বা শিশু। তারা তাদের ধর্ম মানতো, স্থানীয়রা তাদের।

    সিন্ধু প্রদেশের রাজা দাহীর। এর আগে রাজত্ব ছিল বৌদ্ধদের হাতে। আরবদের সাথে সিন্ধুদেশের বাণিজ্য ছিল প্রচলিত। তবে আরব বাণিজ্য ছিল জলদস্যুদের আতঙ্কে অস্থির। সিন্ধুদেশের রাজা দাহীর নাকি ছিলেন সেই সব হানাদারির প্রযোজক।

    ৭১২ সালের জানুয়ারি মাস। এর আগে আরবেরা বার দুএক সিন্ধু উপত্যকায় হানা দিয়েছে। হেরে গেছিল রাজা দাহীর আর তার ছেলে জয়সিহার সাথে যুদ্ধে।

    অবশেষে খলীপের নির্দেশে বড়সড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিল মাত্র সতেরো বছর বয়সী মুহম্মদ বিন কাসিম। সাথে তার ৬০০০ সিরীয়ান ঘোড়া, ৬০০০ উট। আরব ছাড়াও ছিলো ৩০০০ ব্যাক্ট্রিয়ান (উত্তর আফঘানিস্তান, বলতে পারেন মহাভারতের গান্ধার দেশ) সেনা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো অত্যাচারিত জাঠ আর মেডের দল। মেড অর্থাৎ এক যাযাবর গোষ্ঠী, স্কাইথিয়ানদের বংশধর। আবার দাহীরের সাথে ছিলেন আলফি (আলভি) গোষ্ঠী। এরা ইরাকের এক মুসলিম ক্ল্যান। যারা খলিফার অত্যাচারে পালিয়ে এসে সিন্ধুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

    তবে তাদের তুরুপের তাস ছিল পাঁচটি অতিকায় ব্যালিস্টা বা গুলতি। সব থেকে বড়টির নাম উরূস অর্থাৎ বধূ- খুব রোম্যান্টিক নাম, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এর কাজ ছিল খুব বড় বড় পাথরের চাঁই ছুঁড়ে মারা। প্রায় পাঁচশো লোক লাগত এক একটি এই ক্যাটাপল্টের জন্য। উপকূল ঘেঁষে জাহাজে আসল এইসব অতিকায় ক্ষেপণাস্ত্র আর স্থলপথে এল মুহম্মদের বাহিনী । তাদের রসদ আনবার জন্যই হাজির ছিলো পণ্যবাহী তিন হাজার উট।

    তাদের প্রথম লক্ষ্য (বোধহয়) করাচীর কাছে দেবলের বন্দর দুর্গ। হিন্দু রাজারা স্ট্যাটিক ওয়ারফেয়ারেই বিশ্বাস করতেন। ৪০০০ সেনার গ্যারিসন দুর্গের মধ্য থেকেই যুদ্ধ করল এবং পরাজিত হল। কেননা ঐ পাথরের চাঁইএর আঘাতে দুর্গ প্রাকার ভেঙে গেছিল।

    এবার লড়াই স্বয়ং রাজা দাহীরের সাথে। দেবলের উত্তরে। সেখানে দাহীরের সাথে আছে পঞ্চাশ হাজার সেনা। মুহম্মদের সেনার তুলনায় অনেক বেশী - হয়তো তিন চার গুণ।

    কিন্তু হর্ষের পর থেকেই যুদ্ধনীতি &#৩৪৭;²মশ: ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যায়। (ট্র্যাডিশনটা খেয়াল রাখুন দ্রুপদ থেকে কৌটিল্য)। যারা ব্যূহরচনা আর সেনাদের শ্রেণীবিভাগকেই শাØ&#৩৪৭; সম্মত করবার প্রচেষ্টা করতেন। ব্যক্তিগত শৌর্য্য ছিলো দলবদ্ধ যুদ্ধের থেকে বেশী গুরুত্বপুর্ণ। রাজা দাহীরের বাবাও ছিলেন ব্রাহ্মণ মন্ত্রী। রাজা মারা গেলে, মহারাণী তাকে বিয়ে করেন। তিনি রাজা হন ,রাজ্যের অনেকের অসম্মতিতেই।

    আর ছিল হাতীর উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা। রাজা গজারা ছাড়া (সম্ভবত:) সাধারণ সেনাদের মধ্যে তীরন্দাজ ছিলো অপ্রতুল।

    যূথবদ্ধ আরব আক্রমণের সাথে লড়াইএর ক্ষমতা ছিল না দাহীরের সেনার। এরই মধ্যে এক জ্বলন্ত তীর দাহীরের (তিনি অবশ্যই হাতীর পিঠে - যেমনটি শাস্ত্রে আছে) বাহনকে আঘাত করলে হাতীটি ছুটে পালায়। হিন্দু সেনারা বিশৃংখল হয়ে পড়ে। অগত্যা দাহীর ঘোড়ায় চড়ে নিজেই গেলেন সম্মুখ সমরে। তার মৃত্যুর সাথে সাথেই পরাজয় মেনে নিলো হিন্দুরা। তুলনীয় তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে সদাশিব রাও বাহু যিনি খামোখাই একেবারে ফ্রন্টলাইনে গিয়ে লড়াই করে প্রাণ হারান এবং যুদ্ধও শেষ হয়।

    রাজধানী রাওয়ারে লাস্ট উয়োম্যান স্ট্যান্ডিং ছিলেন দাহীরের স্ত্রী রাণী বাই। তার পনেরো হাজার রক্ষীরাও পরাজিত হলো। আল হিন্দে প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের পত্তন হলো। এ হলো মিলিটারী হিস্টরী।

    আর কেমন ছিলো সেই প্রথম মুসলিম রাজ্য পালন ? সেটা বলেছেন এস এ এ রিজভী ( Wonder that was India :Volume 2 )।

    এটা ডিসক্লেইমার নয় , কিন্তু পরবর্তী রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে ইতিহাসের স্রোত হয়েছে খুবই ঘোলা। চিরাচরিত হিন্দু মুসলিম বিরোধ ছাড়াও রয়েছে সিন্ধু প্রদেশের নব্য জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তানী ঐতিহাসিক এ এম খান ও তার দশ ভল্যুমের সিন্ধুর ইতিহাসেও তাই মুসলিম অত্যাচার বর্ণিত হয়েছে বিশেষ বিশদে। এই বিষয়ে পন্ডিতেরা এতই লিখেছেন যে এই আলোচনা শেষ হবার নয়।

    কিন্তু এই লেখাটি শুধুই রিজভির বইটির আলোচ্য অংশ।

    রিজভি বলেছেন ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই বিজয় খুব তাৎপর্য পূর্ণ ছিলো না। তার (এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকদের) আকর গ্রন্থ চাচনামা, সেই সময়কার লেখা ইতিহাস যার পূর্ণাংগ ইংরাজী অনুবাদ নেটেও পাওয়া যায়।

    বিরোধী সেনাদের সকলের মাথা কেটে নেওয়া হয়। এবং অসামরিক জনতার উপর চাপানো হয় জিজিয়া, সেটা আবার আর্থিক সংগতির সাথে মিলিয়ে ১২,২৪ বা ৪৮ দিরহাম সাব্যস্ত হয়। তবে এই টাকা আদায় করবে কে? ব্রাহ্মণেরা রাজী হলেন এই টাকা আদায়ে। তাদের পুরোনো ক্ষমতা অনেকটাই ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এই রাজস্বে আদায়ের কমিশন হিসাবে ৩% ,সেটাও পুনর্বহাল হলো। যে জাঠেদের অনুমতি ছিলো না,সিল্কের কাপড় পরার বা ঘোড়ায় চরার, সেই আইন আবার মোতাবেক হলো। ইতিমধ্যে খলিফা নির্দেশ দিলেন সিন্ধু এখন zimmi অর্থাৎ অধীন,বশ্য দেশ। তাই হত্যা আর লুন্ঠন আর নয়। কিন্তু জিজিয়া কর দিতে হবে। এই অর্থের এক পঞ্চমাংশ তার হকের।

    কাসিম কিন্তু বেশীদিন টেঁকেন নি। তিন বছর পরেই নতুন খলিফার নির্দেশে তাকে ইরাকে ফিরে যেতে হয়,এবং সেখানেই কারাগারে তার মৃত্যু।

    যাহোক, এই মুসলিম বিজয়ের কতকগুলি সামাজিক দিক রিজভি উল্লেখ করেছেন। এক তো আরব বাণিজ্যের আরো বিস্তার। প্রায় দেড়শো বছর পরে ক্কোরানের সিন্ধু ভাষায় অনুবাদ বার হয়, মূলত: এক হিন্দু প্রধানের অনুরোধে। দশম শতাব্দীতে কিছু আরব ঐতিহাসিকেরা সিন্ধু দেশে আসেন। তারা লিখেছিলেন সাধারণ জনতা আরবী ও সংস্কৃত দুটোই বলতে শিখলেন। ইরাক থেকে চর্মকারেরা সিন্ধুর লোকেদের শেখালেন ট্যানিং। ফলে সিন্ধু প্রদেশের জুতো সারা আরবের এক খুব শৌখীন সামগ্রী হয়ে উঠলো। আরবী উটের সংমিশ্রণে দেশী উটের ভালো বর্ণ সংকর হলো। সেটিও ছিলো লাভজনক পণ্য। জ্যোতিষ ,চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ে সংস্কৃত পুঁথি সমাদৃত হলো আরব দেশে। আরব এবং সিন্ধু, মুসলিম এবং হিন্দু - এই দুই সমাজ ও ধর্মের মধ্যে আদান প্রদান হতো দুই তরফাই।

    পন্ডিতি তর্ক তো চলতেই থাকবে, তার উপর যদি তাতে থাকে তেরোশো বছরের পরেরও রাজনীতি। সিন্ধু,পাকিস্তান, ভারতবর্ষ, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ, জাঠ, আলভি। ধর্ম ও জনগোষ্ঠী। প্যালেস পলিটিক্স। বড্ড জটিল।

    তবে শেষ পর্যন্ত বোধহয় রিজভির কথাটাই ঠিক। এটা নেহাৎই এক স্থানীয় আক্রমণ, ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিছু নেই। যেটুকু রয়ে গেছে তা বর্তমান রাজনীতির ঢেঁকুর।

    সেপ্টেম্বর ১৬, ২০০৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ | ৬৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন